মুক্তিযুদ্ধ ও গেসু-সাদু উপাখ্যান..

by Watchdog BD

ডঃ পিয়াস করিমক নিয়ে অবৈধ সরকারের ততোধিক অবৈধ আইনমন্ত্রী জনাব আনিসুল হক স্মৃতিচারণমূলক একটা লেখা লিখেছেন। স্বভাবতই পছন্দ হয়নি আওয়ামী প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজের। এ আর খন্দকারের মত এই মন্ত্রীকেও রাজাকার উপাধি দেওয়া এখন সময়ে ব্যাপার। নিয়মিত গঞ্জিকা সেবক একদল তরুণ যাদের সাথে এ দেশের জন্মের কোন সম্পর্ক নেই তারা মুক্তিযুদ্ধের নবম ফ্রন্ট খুলে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। আর এসব সার্টিফিকেট যোগান দিচ্ছে গঞ্জিকা যোগানোর খরচাপাতি। ড্রাসাসক্ত যুবা তরুণের দল আজকাল মা-বাবাকেও খুন করছে ড্রাগ মানির জন্য। নবম ফ্রন্টের এসব জেনারেলদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ খুবই শক্তিশালী একটা ড্রাগ, যার ব্যবহার শরীর, মন ও মস্তিষ্ককে নেশা ছড়িয়ে দেয় অনেকটা পাগলা ঘোড়ার কায়দায়। বিশেষত্ব হচ্ছে এই ড্রাগ কেবল নেশাখোরদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনা বরং তার আমেজ গ্রাস করে নেয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একদল কিশোর, তরুণ ও যুবকদের। ইবোলা কায়দায় এই ড্রাগ দেশপ্রেম নামক সিফিলিস রোগের জন্ম দেয় যার জরায়ুতে জন্ম নেয় নতুন এক ভাইরাস, আওয়ামী জারজতন্ত্র। জনাব আনিসুলে হকের লেখাটা হঠাৎ করেই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল ৭১ সালে। স্কুল পড়ুয়া তরুণ হলেও সমাজ, সংসারের অনেক জটিল সমীকরণ বুঝে নিয়েছি ইতিমধ্যে। স্মৃতিচারণ এক ধরণের ছোঁয়াচে রোগ। এ মুহূর্তে আমিও আক্রান্ত এ রোগে। তাই পাঠকদের কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিয়ে যেতে চাই আগুন ঝরা ৭১’এর দিন গুলোতে। চলুন…

ঘটনা ১:

এপ্রিলের শুরুতে আকাশ পথে শুরু হল তাদের আনাগোনা। স্থলপথ ছিল ইপিআরদের দখলে। সকাল ১০টা হবে হয়ত। বাজার বন্দরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে কেবল। বাজ পাখির মত ছুটে এলো দুটো ফাইটার। বিকট শব্দে শুরু হল বোমা বর্ষণ। আমরা তখন ২০ মাইল দুরে দাদাবাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে। দুদিন আগে একদল বিহারীকে নদীর হাঁটু জলে নামিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করার পর অনেক আন্দাজ করেছিল ওরা আসবে। পেশায় চামার, মুচি ও নাপিত এসব নিরপরাধ বিহারীদের হত্যা করে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা কি ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিল তা বুঝা গিয়েছিল একদিন পরে। একে এক ১০টা ব্যাংক লুট করে সীমান্তের ওপারে পালিয়ে যায় ওরা। সাথে নিয়ে যায় বস্তা ভর্তি টাকা। যুদ্ধের নয় মাস তাদের কারও মুখ দেখা যায়নি ক্ষতবিক্ষত শহর-গঞ্জের জনপদে। শোনা যায় কোলকাতার বেহালায় বাইজী সহ বাসা ভাড়া করে বাদশাহ আওরাঙ্গেজেবের জীবন কাটিয়েছে অনেকে। সপরিবারে পলাতক আমরা। এর কিছুদিন পর গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার আঘাতে উড়ে যায় আমাদের বাড়ির কিয়দংশ। মে মাসের শুরুতে পাকি বাহিনীর পদভারে প্রকম্পিত হয়ে যায় আমাদের শহর। বাড়ি ফাঁকা হলেও বাড়ির একজনকে পলাতক বানানো যায়নি। সে আমাদের কাজের ছেলে গিয়াস উদ্দিন। ১৬ বছর বয়সী সদা চঞ্চল এই যুবক কাজের লোক হলেও পরিবারের স্থায়ী সদস্য ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা। তার হাতেই গচ্ছিত ছিল বাড়ির দায়িত্ব। আগস্টের মাঝামাঝি এক সময় নদীর গা ঘেঁষে অনেকটা গেরিলা কায়দায় হাজির হই ফেলে আসা বাড়িতে। উদ্দেশ্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে যাওয়া। বাড়িতে পা রেখে হতবাক। লুটের চিহ্ন¡ চারদিক। মূল্যবান সবকিছুই খোয়া গেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে প্রায়। শুয়ে আছি প্রিয় বিছানাটায়। সদর দরজা তালা দেয়া। শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করলাম মূল দরজার কড়া নড়ে উঠছে। উপরে দিকে তাকাতে আত্মা শুকিয়ে গেল, রাইফেলের লম্বা বেয়নেট। পালানোর সবকটা রাস্তা ছিল বন্ধ। ধীরে ধীরে খুলে গেল ফটকের তালা। কেউ একজন ৩০৩ রাইফেল নিয়ে প্রবেশ করলো বাড়িতে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এ আমাদের গিয়াস উদ্দিন। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আলাপ করলাম তার সাথে। জানা গেল বাড়ি লুটের সাথে সেও জড়িত। তবে মূল উদ্যোক্তা স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার ও মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল জনাব আক্কাস আলী দেওয়ান। তার প্ররোচনায়ই নাকি সে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। আসল কাজ চুরি ডাকাতি এবং ইতিমধ্যে বেশকিছু টাকাকড়ি জমাতে সমর্থ হয়েছে সে। ইচ্ছা যুদ্ধ শেষে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে একজোড়া হালের গরু কিনে তা ভাড়া খাটানো। দুপা ঝাপটে ধরে রইলো অনেকক্ষণ এবং অনুনয় করে জানালো গ্রামে গিয়ে কাউকে যেন না জানাই তার বর্তমান পরিচয়। সুযোগ পেলেই নাকি ফিরে যাবে লোকালয়ে এবং সাথে নিয়ে যাবে তার ৩০৩ রাইফেল ও প্রিন্সিপালের কল্লা।

১৬ই ডিসেম্বরের আগেই সে ফিরে গিয়েছিল। প্রিন্সিপালের কল্লা আর নিতে পারেনি তবে রাইফেল নিতে ভুল করেনি। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বরের পর ব্যাংক লুটেরা একদল আওয়ামী জেনারেল গিয়াস উদ্দিনকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে চৌরাস্তার মুখে।

ঘটনা ২:

স্থান দাদাবাড়ি। শহর হতে পালিয়ে আমাদের মত আরও অনেক পরিবার লুকিয়ে আছে। গ্রামটায় আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া লাগতে তখনো একশ বছর বাকি। বাকি দুনিয়ার সাথে রাস্তাঘাটের সম্পর্ক নেই। কাছের রাস্তা হতে হেঁটে যেতে হয় প্রায় দশ মাইল। এমন একটা গ্রামে পাকি বাহিনীর আগমনের আশংকা ছিল খুবই কম। জুন মাসের মাঝামাঝি সময় তার উদয়। হাতে সেমি অটোমেটিক রাইফেল। পায়ে জলপাই রংয়ের কেডস। গ্রামের বেকার যুবক সাইদুল হোসেন সাদু এখন মুক্তিযোদ্ধা। কবে এবং কোথায় ট্রেনিং নিয়েছে তার কোন সদুত্তর তার কাছে ছিলনা। অবশ্য এ নিয়ে প্রশ্ন করার মতও কেউ ছিলনা। যুদ্ধের শুরুতে গ্রামের মুরুব্বিদের প্রায় সবাই ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক। এ নিয়ে মসজিদে মসজিদে দোয়াও করানো হত। বিশেষ করে জুমা নামাজের পর। এ ধরণের সমর্থনের কিছু ঐতিহাসিক কারণও ছিল। অবিভক্ত ভারতে এ এলাকায় হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে জর্জরিত ছিল মুসলিম প্রজারা। জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে হেটে গেলে জুতা হাতে নেয়া ছিল বাধ্যতামূলক। তা করতে ব্যর্থ হলে নেমে আসতো নির্মম অত্যাচার। কৃষি ও তাঁত ব্যবসার সাথে জড়িত জনগণকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে নিরুৎসাহিত করা হত। মুসলমানদের শিক্ষা নিয়ে জমিদার তথা স্থানীয় হিন্দু বাসিন্দাদের মাঝে ঠাট্টা তামাশার অন্ত ছিলনা। অপমান হতে মুক্তি পেতে স্থানীয় অনেকেই সক্রিয় অংশ নেয় পাকিস্তান আন্দোলনে। তবে বর্ষার শুরুতে গঞ্জের বাজারে পাকিস্তানিদের গানবোটের আগমন বদলে দেয় অবস্থা। গ্রামের জনগণ শক্ত অবস্থান নেয় পাকিদের ঘৃণ্য তৎপরতার বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সাদুর সাথে যোগ দেয় আরও কজন। সবার হাতে অস্ত্র। সকাল বিকাল গ্রামের এ মাথা হতে ও মাথা মার্চ করে বেড়ায়। তবে রাত হলেই বদলে যায় তাদের চেহারা। গৃহস্থের দুয়ারে হানা দেয়। হাঁস, মুরগী, ছাগল সহ যা পায় তা ধরে নিয়ে আসে। প্রতি রাতে চলে তাদের বনভোজন। কদিন না যেতে তাদের চাহিদার আঙ্গিনা পা রাখে গ্রামের সোমত্ত মেয়েদের দিকে। পাকিস্তান সমর্থক হওয়ার কারণে মা-বাবাকে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে তাদের ভোগের পণ্য বানানো শুরু করে। যেদিন গঞ্জের বাজারে পাকিস্তানীরা হানা দেয় সেদিন সাদু ও তার দলবলকে একশ মাইলের কাছাকাছি কোথাও দেখা যায়নি।

যুদ্ধ শেষে সাদু ও তার বাহিনী জমিদার বাড়ি দখল সহ শত শত বিঘা ধানী জমি দখল করে কায়েম করেছিল অনাচার ও অবিচারের রাজত্ব। সাদু আজ বেচে নেই, কিন্তু তার কাজের ধারাবাহিকতায় আজও এলাকা চষে বেড়াচ্ছে একদল হায়েনা। ওরা খুন করছে, মা-বোনদের ঘর হতে উঠিয়ে নিচ্ছে, জমি দখল নিচ্ছে এবং গর্বভরে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক হিসাবে।

সব রাজাকারই যেমন খুনি রাজাকার ছিলনা তেমনি সব মুক্তিযোদ্ধাই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেনি। সবাইকে এক কাতারের ফেলে দেশকে বিভক্ত করে মুক্তিযুদ্ধকে বানানো হয়েছে গঞ্জিকা সেবনের উপকরণ। মৃত পিয়াস করিম উপাখ্যানও এ অধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s