এক্সিডেন্টাল জার্নালিস্ট

2

ফাহাম আব্দুস সালাম

এক
বড় মানুষদের, সফল মানুষদের শেষ বিচারে ভূমিকা আসলে একটাই: সেটা হোলো শিক্ষকের ভূমিকা। তারা মানুষকে শেখাতে চান – কেউ করে দেখান আর কেউ বা লেখেন (কিংবা বলেন)। শফিক রেহমানকে আমি কাছ থেকে দেখেছি গত পনের বছর। তার ভেতরকার সব থেকে বড় তাড়না আসলে একটাই : তিনি বাঙালিকে কিছু শেখাতে চান, জানাতে চান। পাঠকদের তিনি শিখিয়েছেন লিখে কিন্তু যারা সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত, যারা লেখালিখি করেন তাদেরকে শিখিয়েছেন সব থেকে বেশী – তিনি করে দেখিয়েছেন। এখন থেকে পনের বছর আগে বাংলাদেশে এমন পলিটিকাল কমেন্টেটর খুব বেশী ছিলো না যারা যায় যায় দিনে কলাম না লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

শিক্ষকের ভূমিকায় তিনি কি সফল হয়েছেন? জ্বী, আমার মতে হয়েছেন – সন্দেহ নেই তাতে। এর জন্য কি তাকে কোনো মূল্য হয়েছে? খুব চড়া মূল্য হয়েছে বলে আমার মনে হয়। নাহ, এরশাদের আমলে দেশছাড়া হওয়া কিংবা যায় যায় দিন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া – এসবকে আমি চড়া মূল্য বলি না। বরং দেশছাড়া করে এরশাদ ব্যক্তি রেহমানের কিছু উপকারও করেছিলেন হয়তো।
218424_10150575383235578_1820514_o
তার স্বপ্ন ছিলো বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ একজন ফিকশন লেখক কিংবা ফিল্মের স্ক্রিপ্ট রাইটার হওয়া (এটা আমার ধারণা, তিনি আমাকে কখনো বলেন নি) – সেটা তিনি হতে পারেন নি। আমার মনে হয় না শফিক রেহমান কোনদিনও সাংবাদিক হওয়াটাকে তার জীবনের মূল লক্ষ্য বলে মনে করেছিলেন। তার কাছে এই লেখক হওয়ার জন্য একটা প্রয়োজনীয় অন্তর্বর্তীকালীন ভূমিকা ছিলো সাংবাদিকতা – তৃতীয় তলায় উঠতে হলে দ্বিতীয় তলা বাদ দেয়া যায় না যেমন। কিন্তু সাংবাদিকতার বৃত্ত থেকে তিনি আর বের হতে পারেন নি।

পারিপার্শ্বিকতা তার স্বপ্নের সাথে তাকে আপোষ করতে বাধ্য করেছিলো। এটাই তার জীবনের সবচাইতে চড়া মূল্য।

সত্যিই কি তিনি এই ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ফিকশন রাইটার হতে পারতেন? বলা মুশকিল কিন্তু আমার ধারণা তার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিলো। আগ্রহী পাঠকরা পঞ্চাশের দশকে তার লেখা গল্প পড়ে দেখতে পারেন। হুমায়ুন আহমেদের আগে এরকম ঝরঝরে, নির্মেদ, টানটান বাংলা গদ্য খুব বেশী লেখক লিখতেন বলে মনে হয় না। তিনি একজন অনবদ্য স্টোরী টেলার – গল্প বলেই তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু পলিটিকাল কমেন্ট্রির গল্প তো আর সাহিত্যের গল্প না – গল্পকে ব্যাকড্রপের চেয়ে বেশী কিছু হিসেবে ট্রীট করার সুযোগ তার ছিলো না। প্রশ্ন হোলো রেহমান কেন চেষ্টা করলেন না সাহিত্য করার জন্য?

এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই লুকিয়ে আছে রেহমানের চরিত্রের সব থেকে উচ্চকিত বৈশিষ্ট্য। তার সব থেকে বড় যে শক্তি সেটা তার সব থেকে বড় দুর্বলতাও।

জীবনে তার মতো অফুরন্ত জীবনীশক্তিসম্পন্ন, উদ্দীপ্ত ও স্বাপ্নিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আশি বছর বয়সেও তিনি নতুন কিছু করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোন বিষয়ে তার আগ্রহ নেই? কিন্তু তিনি লিভ ইন দ্যা মোমেন্ট ঘরানার মানুষ – তার ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশানের চাহিদা আছে। নানান বিষয়ে তার যেমন আগ্রহ, সেই আগ্রহ তিনি হারিয়েও ফেলেন সহজে। প্রতিভা তার গল্প বলায় কিন্তু গল্পের বিস্তার আর বুনটের জন্য যে স্বভাব প্রয়োজন সেটা তার ছিলো না কোনোদিন; দু বছর ধরে গবেষণা করে তিন বছর ধরে উপন্যাস লেখার মানুষ তিনি নন। শফিক রেহমানের জীবনের সব থেকে বড় ট্র্যাজেডি: তার স্বভাব ও চরিত্র খুব বড় সাংবাদিক হওয়ার জন্য টেইলর-মেইড কিন্তু তার স্বপ্ন হোলো খুব বড় ফিকশন রাইটার হওয়া।

দুই:
আমি আগেও বলেছি, এখনো মত বদলাই নি – পলিটিকাল কমেন্ট্রি লেখার যে ক্রাফট (আমি টেকনিকের কথা বলছি, তার রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলছি না) সেই ক্রাফটে তিনি আজও অদ্বিতীয়। বাংলা ভাষায় কেউ তার মতোন চোখা পলিটিকাল কমেন্ট্রি লিখতে পারেন না। কেন? এর অনেকগুলো কারণ আছে, বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না – শুধু তার মূল প্রবণতা নিয়ে কিছু বলি। তিনি বাংলা ভাষাকে ইংরেজির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সত্যি বলতে কি, আমার মনে হয় যে তিনি ইংরেজিতে চিন্তা করেন আর বাংলায় তার অনুবাদ করেন।

তার এই প্রবণতাটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজে লিবারাল সোসিওপলিটিকাল ভিউজ এর অনুরক্ত এবং এতো ছোটো কিন্তু জনবহুল দেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক আদর্শ আমাদের সবাইকে টিকিয়ে রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি না। কখনোই মনে করি না যে লিবারাল সোসিওপলিটিকাল ভিউজ অনুধাবন ও আত্মস্থ করার জন্য ইংরেজি ভাষা জানাটা আবশ্যক কিংবা একমাত্র উপায় – কিন্তু এটা সম্ভবত সব থেকে সহজ উপায়।

রেহমান এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করে চলেছেন আজীবন – তিনি বাংলা ভাষাভাষীদের পশ্চিমের সাথে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি অবিরত পশ্চিমের জাইটগাইস্ট আমাদের পাঠকদের উপহার দিয়েছেন – তার লক্ষ্য পশ্চিমের সাথে আমাদের যে সহজাত দ্বন্দ্ব, সেটা যেন কমে আসে। বাংলাদেশ কি তার এই লক্ষ্যে সাড়া দিয়েছে?

না দেয় নি। ভিন্ন মতের জায়গা বাংলাদেশে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

তার পাঠকরা কি সাড়া দিয়েছে? বলা মুশকিল কিন্তু তার বহু পাঠককে আধুনিক মনস্ক ও সহনশীল হওয়ার জন্য সম্ভবত কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভুমিকা রেখেছেন।

তিন:
একেবারেই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। বহু বছর ধরে তার পত্রিকায় কলাম লেখা আর মানুষ হিসেবে সাহচর্যের পরে লেখক হিসেবে আমার নিজের ওপর তার প্রভাব কী ? এর কোনো সহজ উত্তর নেই কারণ আমি কোনোদিন সচেতনভাবে তার মতো করে লেখার চেষ্টা করি নি। কিন্তু তিনি আমাকে (এবং সম্ভবত আরো বহু লেখককে) দুটো রাস্তা দেখিয়েছেন।

প্রথমত, ইংরেজি থেকে শব্দ ধার করার সংকোচ কাটাতে তিনি আমার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। ছোটবেলা থেকেই আমার একটা প্রিয় কাজ হোলো বাংলা অভিধান ঘাটা। জানা শব্দের ভাণ্ডার তাই আমার একদম কম না কিন্তু ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে একদম অপ্রচলিত একটা তৎসম শব্দের চেয়ে প্রচলিত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা যে পাঠকের জন্য বেশী আরামদায়ক এই সাহসটা আমি পেয়েছি শফিক রেহমান থেকে।

তার দেখানো দ্বিতীয় রাস্তাটা খুবই প্রশস্ত, উঠেছেন অনেক লেখক।

বাংলাদেশের লেখকদের আবেগ অতিরিক্ত বেশী। কবিগানের ভনিতা ও ভক্তি আমরা পলিটিকাল কমেন্ট্রির মধ্যেও পারলে ঢেলে দিই। আমাদের এখনকার জনপ্রিয় গদ্য লেখকদের মধ্যে দুইজনকে আমার মনে হয়েছে ব্যতিক্রম – কেবল “বুদ্ধি দিয়েই” তারা লেখেন: ফরহাদ মজহার আর শফিক রেহমান (অজনপ্রিয় ও প্রয়াতদের যোগ করলে এই লিস্ট বেশ লম্বা হবে – সেখানে আহমেদ, আজাদ, ছফাসহ আরো অনেকে থাকবেন)। অন্যান্য কলামিস্টরা যেখানে ফিলার হিসাবে নিজের মতামত, মৃত মানুষের সাক্ষ্য আর “অশিক্ষিত পটুত্ব” জনিত তত্ত্ব কথা টেনে এনে খেই হারিয়ে ফেলেন – রেহমান সেখানে বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক আর ইনফরমেশনকে ফিলার হিসাবে হাজির করেন।

তিনি একটা রচনার স্ট্রাকচার খুব ভালো বোঝেন – সম্ভবত ভালো কলামিস্ট হওয়ার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আপনাকে একটা গতি বজায় রাখতে হবে, একটা প্যারাগ্রাফে একটার বেশী আইডিয়া আনা যাবে না এবং দীর্ঘ প্যারাগ্রাফ লেখা কলামিস্টদের কাজ না, খুব লম্বা বাক্য ব্যবহার না করে ছোটো ছোটো বাক্যে ভাব প্রকাশ, শুরুর দু-তিনটা বাক্যের মধ্যে পুরো লেখা প্রসঙ্গে একটা পরিষ্কার ধারণা দিয়ে ধীরে ধীরে বিল্ড আপ এবং শেষে গিয়ে টেনশন রিলিজ – এই টেকনিকগুলো আমাদের কলামিস্টরা খুব ভালো বোঝেন বলে মনে হয় না। রেহমান এর সাথে যোগ করেন “বুদ্ধি” – তার থেকে যদি কেউ যদি শুধুমাত্র একটা বিষয় শিখতে চায়, সেটা হবে আমার মতে তার নো-ননসেন্স এপ্রোচ।

চার:
শফিক রেহমান সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত আছেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় ধরে, সম্ভবত অভিজ্ঞতার বিচারে তিনি বাংলাদেশের প্রবীণতম সাংবাদিক। তার যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করে সেটা হোলো – এখনো তিনি সাংবাদিকতাকে ভালোবাসেন। পঞ্চাশ বছর ধরে কোনো কিছু – আবার বলছি – কোনো কিছুকেই ভালোবাসা আমার কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। সেজন্যেই তিনি আজো ক্ষুরধার, আজো প্রাসঙ্গিক।

খুব বেশী মানুষ সম্বন্ধে আমি একথা বলতে পারবো না কিন্তু রেহমান প্রসঙ্গে বলি – তার দীর্ঘায়ু হওয়াটা খুব জরুরী – আমাদের জন্য। তার কাছ থেকে আমার ও আমাদের শেখার আছে এখনো অনেক বাকী।

আমি তার সুস্থতা কামনা করি।

১৯শে জুন, ২০১৪

2 thoughts on “এক্সিডেন্টাল জার্নালিস্ট

Leave a Reply to ডা: আহমাদ যায়নুদদিন সানী Cancel reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s