আমাদের জন্য এই মানুষগুলো লাশ হয়েছে

hartal

by zainuddin sani

লাশ আসতে শুরু করেছে। প্রায় প্রতিদিনই একটি দুটি করে আসছে। প্রায় পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। তবে সেই ম্যাজিক লাশের দেখা এখনও কেউ পায়নি। ডাঃ মিলন কিংবা নুর হোসেন অথবা সেই লগি বৈঠার আঘাত বা বিশ্বজিৎ। কিছু লাশ সরকারের পক্ষে যায় কিছু যায় সরকারের বিপক্ষে। কিছু লাশ বিরোধী দলের আন্দোলনকে চাঙ্গা করে দেয় কিছু লাশ বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে দেয়। আজকের কিংবা কালকের লাশটি কার পক্ষে যাবে কেউই জানি না। তবে এ ব্যাপারটি নিশ্চিত, সুযোগ পেলে সেই লাশ নিয়ে রাজনীতি করতে কেউই পিছপা হবে না।

পেট্রোল বোমার এখন ফ্যাশান চলছে। কক্টেলে এখন আর সেই বিভীষিকাময় ইফেক্ট দেয় না। এখানে সেখানে ঝলসে যায় কিছুটা, হয়তো মাংসে গেঁথে থাকে কিছু স্প্লিন্টার। তবে আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়া বীভৎস লাস পেতে হলে চাই পেট্রোল বোমা আর নয়তো গান পাউডার। শিশুর লাশের ইমপ্যাক্ট সবচেয়ে ভালো। মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাওয়া শিরশিরে অনুভুতি, ইস, আহা, উহু— সবমিলিয়ে বাজারদর এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে এসব আগুনে পোড়া শিশুদের। এরপরে সম্ভবতঃ শিশুকে বাঁচাতে যেয়ে মায়ের মৃত্যু কিংবা অশীতিপর বৃদ্ধা নারী। পুরুষ মানুষের বাজারদর একটু কম। সঙ্গে কিছু রোমহর্ষক কিংবা করুণ গল্প থাকলেও, বাজারদর খারাপ হয়না। বরং শুরু হয় পত্রিকাগুলোর শিরোনামের খেলা।

লাশ যেমনই হোক, তা থেকে ফায়দা লুটতে দুই দলই নেমে পরে। সরকার নামে আবেগের ঝোলা নিয়ে। ‘দেখো দেখো, কি বীভৎসভাবে খুন করছে বিরোধী দল।‘ যত বীভৎস ততো প্রচারণা। টেলিভিশনে বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো। স্বজনদের আহাজারি। ‘কি দোষ ছিল এই শিশুটির?’ কিংবা ‘এই বাবা এখন কি নিয়ে বাঁচবে?’ জ্বলন্ত গাড়ী কিংবা পথচারীদের মতামত। যা কিছু সরকারের পক্ষে যাবে বলে মনে করে, কাজে লাগাবেই সরকার। ব্লগ, ফেসবুক এবং সেখানে তাঁদের পেটোয়া বাহিনীতো আছেই। আলোচনাকে যতটা সম্ভব মুখরোচক করে তোলা হবে।

এই ধরনের লাশ নিয়ে বিরোধী দলের বক্তব্যও বেশ গৎবাঁধা। ‘সরকারী দলের ষড়যন্ত্র’ কিংবা ‘এর পূর্বে যখন আপনারা বিরোধী দলে ছিলেন তখন কি করেছিলেন, তা কি ভুলে গেছেন?’ তবে তাঁদের মুখপাত্র যে ব্যাখ্যা সাংবাদিকদের সামনে পড়ে শোনাবেন সেখানে তিনি লাশের চেয়ে বেশি আগ্রহী হবেন, কেন এই হরতাল কিংবা অবরোধ ডাকতে হল, তাঁর ব্যাখ্যায়। রাজ্যের আবেগ ঢেলে দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করবেন, দেয়ালে তাঁদের পিঠ থেকে গিয়েছিল। হরতাল দেয়া ছাড়া আর তাঁদের কোন উপায় ছিল না। এরপরে আসবে সেই চিরাচরিত গণতান্ত্রিক অধিকারের গল্প, ‘হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার।‘

এই লাশগুলো বিরোধী দলের একেবারেই কাজে আসে না, এমন কিন্তু না। সাহায্য করে, তবে উল্টো পথে। লাশগুলো চিৎকার করে দেশবাসীকে বলে, বিরোধীদলের আন্দোলন, আদেশ, হুমকির পরোয়া করিনি বলে আমাদের এই দশা। তোমরা এই ভুল কর না। লাশের এই ইফেক্টটা বিরোধীদলের সত্যিকারের প্রত্যাশা, তবে তাঁরা সেকথা মুখ ফুটে বলে না। তাঁরা আবার এটাও বলে না, হে আমার দলের সমর্থকরা, তোমরা পিকেটিং কর না। আসলে এই লাশগুলো, বাহ্যিকভাবে বিরোধীদলের কিছুটা অপকার করে, ভেতরে ভেতরে উপকারই করে বেশি। আর সেকারণেই, বীভৎস এই লাশগুলোকে বাহ্যিকভাবে অপছন্দ করলেও, প্রতিটি বিরোধী দলই চায়, লাশ পড়ুক।

যে লাশগুলো বিরোধীদলকে সবচেয়ে বেশি প্রমোদ দেয়, তা হচ্ছে নুর হোসেন বা ডাঃ মিলন টাইপের লাশ। সরকারী পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে ঝড়ে পড়া কোন লাশ। আর সেটাও যদি আসে, সরকার বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই সময়ে, তবে তো আর কথাই নেই। সেই লাশ নিয়ে গল্প, কবিতা, কলাম সব কিছুই হবে। আঁকিয়েরা ছবি আঁকবে, কার্টুনিস্টরা ব্যঙ্গ করবে। বিরোধীদল সেই লাশ দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে, ‘দেখো কি করছে সরকার’। আর সরকার বলবে, দেশের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, এই কাজটা জরুরী ছিল।‘

লাশের এই রাজনীতি কি আদৌ বন্ধ হবে? কিংবা হরতাল, অবরোধের রাজনীতি? সৎ উত্তর হচ্ছে ‘না’। এই লাশ যতদিন রাজনৈতিক দলগুলোকে মুনাফার যোগান দিবে, ততোদিনতো অবশ্যই না। রাজনৈতিক দলগুলোকে একতরফা দোষও দিতে চাই না। একটি মিছিল কিংবা কিছু আহত, এমন রিপোর্ট আমরা নিজেরাই পড়ি না। লাশ না পড়লে আমরা নিজেরাও ভাবি না, বিরোধী দল সিরিয়াস। হরতালে কোন গাড়ী না পুড়লে, ভাংচুর না হলে, আমরা ধরেই নি, বিরোধী দল কোণঠাসা। আন্দোলনের ক্ষমতা নেই। টক শোতে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনাদের পিকেটিং করার লোক কৈ?’

সমস্যা সরকারী দলেরও। যদি তাঁরা বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে দেয়, আর সেখানে বিশাল লোকের সমাগম হয়, তখন প্রশ্ন শুনতে হবে, ‘সরকারের প্রতি আস্থা কি কমে গেছে?’ কিংবা ‘বিরোধীদল কি বেশি জনপ্রিয়?’ ফলে শুরু হয়, হালুয়া রুটির বিনিময়ে লোক এনে সমাবেশ ভর্তি করা। একদিন সরকারী দল সিঙ্গারা খাওয়ায় তো আরেকদিন বিরোধী দল মিষ্টি খাওয়ায়। আজ সরকারী দল গালি দেয় তো কাল বিরোধী দল গালি দেয়। আমরাও বসে থাকি, বেশি ভালো গালি দিতে পারে, তা দেখবার জন্য। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, আমরাই বাধ্য করছি এই দুই দলকে, ‘শুরু কর মুষ্টিযুদ্ধ’ ‘দখল কর এই দেশ’।

এই মুহূর্তে কোন দলের পক্ষেই পেছানো সম্ভব না। বা সম্মান নিয়ে পেছানো সম্ভব না। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, যে পেছাবে, তারই পরিনতি হবে ভয়াবহ। আমরা জনগণ, তাকেই গালি দিব, ‘ব্যাটা পারিস না তো লাগতে যাস কেন?’ নতুন কোন লাশ যেন আর তৈরি না হয়, যেন শান্তি ফিরে আসে, এই উদ্দেশ্যে যে কেউ এক পা এগোবে, আমরা ধরে নেব, সেই দলই হারল। সরকারের তত্ত্বাবধায়কের দাবী মানা, মানেই সরকার হারল। কখনই ভাবব না, এই সিদ্ধান্ত কত উপকার করল। কখনই ভাবব না, এই সিদ্ধান্তের কারণে, কত মানুষ লাশ হওয়া থেকে বেঁচে গেল। উল্টোটাও ঠিক। বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে রাজী হলে, ‘বিরোধী দলের মুরোদ নাই আন্দোলন করার’।

এই লাশের মিছিল চলবেই। আমাদের জন্যই চলবে। আমাদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দেখার অভ্যাসের জন্যই চলবে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, বুঝে কিংবা না বুঝে, আমরাই নিরন্তর উসকে দিচ্ছি এই লাশের উৎপাদন। পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশানে দেখে আঁতকে ওঠার আগে আমাদের একবার ভেবে দেখা উচিৎ, এই লাশের পেছনে আমাদের নিজেদের দায় কতোটুকু।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s