by zainuddin sani
বিএনপির জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। না, সরকারী কঠোর মনোভাব কিংবা জ্বালানো পোড়ানো নিয়ে তৈরি নেতিবাচক প্রচারণাকে সমস্যা বলছি না। সমস্যা তৈরি করবে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এতোদিন পর্যন্ত যেভাবেই হোক, বিরোধী দলের আন্দোলন ব্যাপারটা সংবাদের শিরোনামে ছিল। নেত্রীর গৃহবন্দী অবস্থা কিংবা পুত্রের মৃত্যু, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না করা— কোন না কোনভাবে টিভি চ্যানেল আর পত্রিকার লীড নিউজে তাদেরকে রেখেছিল। টেলিফোন আলাপ থেকে শুরু করে সরকারী বক্তব্য কিংবা পাতি নেতাদের হুঙ্কার, সব কিছুই সাহায্য করছিল তাঁদের প্রচারণায়। শিরোনামে রাখছিল বর্তমান পরিস্থিতিকে। বোঝা যাচ্ছিল, দেশে এখন স্বাভাবিক অবস্থা চলছে না। হরতালে রাস্তায় প্রচুর বাস কিংবা প্রাইভেট গাড়ী দেখা গেলেও, শিরোনামে থাকতো ৭২ ঘণ্টা হরতাল।
খুব দ্রুত পরিস্থিতি না পাল্টালে, সেখানে অচিরেই ছেদ পড়বে। এবং বেশ ভালভাবেই পড়বে। শিরনাম হতে তখন টক্কর দিতে হবে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সঙ্গে। ক্রিকেট পাগল এই জাতির জন্য তখন, বিরোধী দলের একঘেয়ে আন্দোলনের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয় হবে, ক্রিকেট। সঙ্গে যদি যোগ হয় বাংলাদেশের জয়, তবে তো কথাই নেই। বাঙালির উন্মাদনা তখন হবে দেখার মত। আফগানিস্তানের সঙ্গে হারলেও, শিরোনাম চলে যাবে ক্রিকেটের দখলে। তখন বাঙালির গালিগালাজও হবে আকাশচুম্বী। ভারত পাকিস্তান খেলা নিয়েও যে বাজার গরম হয়ে উঠবে, তা নিয়েও সন্দেহ নেই। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এই উন্মাদনা চলবে পুরো দেড় মাস, মার্চের শেষ নাগাদ।
যেভাবে একটা দুটা ঝলসানোর খবরে আমরা অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি, মনে হয় না, খুব মর্মান্তিক কিছু না ঘটলে, তা তখন শিরোনামে আসবে। শুনতে খারাপ লাগলেও, এটিই অমানবিক সত্য— এই জ্বালাও পোড়াও আর বার্ন ইউনিটের দগ্ধ মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে আমরা ধীরে ধীরে অভ্যস্থ হতে শুরু করেছি। এখন অনেক সহজেই আমরা পাতা উল্টিয়ে পরের খবরে চলে যাই। আর তেমনটা হতে শুরু করলে, সম্পাদক সাহেবরাও আর সেগুলোকে শিরোনামে রাখবেন না। নেতিবাচক হোক আর ইতিবাচক হোক, বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রচারণায় তখন ছেদ পড়বে।
শিরোনাম করতে আমরা কতোটা মরিয়া তাঁর জলজ্যান্ত প্রমাণ এসব ঝলসানো নিয়ে শুটিং, কিংবা খাওয়া থেকে উঠিয়ে ছবির জন্য পোজ দেয়ানো। অসভ্য আচরণ মনে হলেও, খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা এটি। যতই তিরস্কার করি, বিশ্বজিতের কোপানোর দৃশ্য যে সাংবাদিক বা ভিডিওম্যান খুব ভালভাবে ধারণ করতে পেরেছে, সে কিন্তু সেদিন তাঁর সম্পাদকের বাহাবা পেয়েছে। চ্যানেলগুলোর ভেতর সেদিন ছিল, সেই দৃশ্য দেখানোর প্রতিযোগিতা। আগুনে পোড়ানো নিয়েও আমার মনে হয় না ব্যতিক্রম হচ্ছে। পোড়ানো নিয়ে একদিকে যেমন বিরোধীদলকে সমানে ধিক্কার জানিয়ে একরাশ খবর ছাপা হচ্ছে, ঠিকই আবার সেই খবরগুলোকে শিরোনাম করা হচ্ছে। সেসব আক্রান্তদের নিয়ে হৃদয় বিদারক রিপোর্টিং যেমন হচ্ছে, আক্রমণকারীদের চোদ্দ গুষ্টি যেমন উদ্ধার হচ্ছে, তেমনি এটাও সত্য, সেই রিপোর্ট ছাপানোর সময় নৃশংস একটি ছবির খোঁজও হচ্ছে। আর যেসব ফটোগ্রাফার সেসবের ছবি যারা জোগাড় করছেন, ‘গ্রেট জব’ বলে একটা পিঠ চাপরানি কিন্তু তারাই পাচ্ছেন।
যা বলছিলাম, এই মুহূর্তে আন্দোলনের সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে, শিরোনামে থাকা। যেভাবেই হোক, যত নৃশংস কাজ করেই হোক, শিরোনামে থাকা চাই। প্রথম খবরটাই যেন হয়, বিরোধী দলের আন্দোলন সংক্রান্ত। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় লিড হওয়া মানেই, পিছিয়ে পড়া। আর একবার পেছনের পাতায় চলে গেলে, আন্দোলন শেষ। ফলে এখন ২৪ ঘণ্টার হরতাল আর ডাকা হচ্ছে না। কারণ এতো ছোট হরতাল আর এখন শিরোনাম না। ৭২ ঘণ্টার হরতালকেও শিরোনাম পেতে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। বরং শিরোনাম হয়, কিংবা মনে প্রশ্ন জাগে, সপ্তাহের বাকী দিন বাদ দিল কেন? হরতালের ডাক শিরোনামে ফিরে আসে, যখন হরতাল প্রলম্বিত করে ৬ দিন করা হয়।
শান্তিপূর্ণ হরতাল, নিঃসন্দেহে বিরোধী দলকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিবে। প্রচুর গাড়ী চলছে এমন কোন হরতালের ছবি পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হওয়া বিরোধী দলের জন্য একটি অশনি সংকেত। কোন হরতালে ভাঙচুর না হলে, ‘এটা কোন হরতালই হয়নি’— ক্যাডাররা রাস্তায় নেই, জনসমর্থন নেই, বিরোধী দল আন্দোলন তৈরিতে ব্যর্থ। অবরোধ, হরতালে দেশের কি অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে কেউই কিছু বলছেন না। অবরোধের কারণে চাষীরা কি মর্মান্তিক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, কিভাবে সস্তায় তাদেরকে পণ্য বিক্রি করে দিতে হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। কিংবা বললেও, শিরোনাম করছেন না। কারণ, সেখানে নৃশংসতা নেই বা পাবলিক খাবে না।
বিএনপির গেমপ্ল্যান ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আপাততঃ লাগাতার হরতাল আর সপ্তাহ জুড়ে হরতাল দিয়েই কাজ চালাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষা পেছানো, এবং সেই ব্যাপারটা শিরোনাম হওয়া, আপাততঃ এটাই তাঁদের টার্গেট। পরীক্ষা হতে না পারলে, সরকারকে সবাই যত অথর্ব মনে করবে, পরীক্ষা হতে পারলে বিরোধী দলকে ততোটাই অকর্মণ্য ভাববে। সরকারী দল চাইছে, জনগণ ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বিরোধী দলের ওপর ক্ষেপে উঠুক আর বিরোধী দল চাইছে, সরকারী দলকে কিংবা রাষ্ট্রকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে। আর এই জেদাজেদিতে কে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা নিয়ে কারোরই মাথা ব্যাথা নেই। এদেশের সরকার এবং বিরোধী দুই দলেরই যেহেতু দূরদৃষ্টি বলে কিছু নেই, তাই ধরে নেয়া যায়, এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে কেউই এগিয়ে আসবে না।
সরকার যেভাবে শুক্রবারে পরীক্ষা নিয়ে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে, মনে হচ্ছে শিরোনামে থাকবার জন্য অচিরেই হয়তো শুক্রবারেও হরতাল আসবে। জ্বালাও পোড়াও যদিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তারপরও শিরোনামে টিকে থাকবার লোভে, সেই কাজেও বিরাম আসবে না। হয়তো নিজের নেতা কর্মীকে দিয়ে না করিয়ে, ভাড়াটে সেনার আমদানী হবে। দরদ দেখানো বুদ্ধিজীবীদের নড়াচড়া শুরু হয়ে গেছে। তাঁদের বক্তব্য নিজেদের পক্ষে না গেলে, মনে হয় না তাঁদের সঙ্গে কোন দল সহযোগিতা করবে।
এই মুহূর্তে যে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ গেম চলছে, সেখানে বিরোধী দলের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে আসবে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আর সে কারণে শিরোনামে থাকবার সুযোগ হাতছাড়া হলে, হয়তো তখন আলোচনায় যোগ দিতে রাজী হবে বিরোধী দল। সরকারী দলও সুযোগটা নেবে বলেই ধারণা। আলোচনা আলোচনা খেলা খেলে যদি কিছু সময় পার করা যায়, তবে আন্দোলনে ভাটা পড়বে। আর একবার আন্দোলনে ভাটা পড়লে, বিরোধী দলের পক্ষে আর উঠে দাঁড়ান সম্ভব হবে না। সামনে কিছুদিনের ভেতরই বিরোধী দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আন্দোলন কিভাবে আর কতদিন চালাবে। সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নের সমাধান করতে হবে তা হচ্ছে, বিশ্বকাপের সময় কিভাবে বিরোধীদল শিরোনামে থাকবে।