বাংলাদেশের গ্রেট ডিভাইডঃ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে

by: Aman Abduhu
রোমান সম্রাজ্যে যখন গ্ল্যাডিয়েটরদেরকে বাঘ-সিংহের মুখে ছেড়ে দেয়া হতো, অথবা নিজেদের মধ্যে মৃত্যু পর্যন্ত মারামারি করতে হতো, তখন কলোসিয়াম বা স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়া হাজার হাজার দর্শক সেইসব বন্য মারামারি দেখে চরম আনন্দে ফেটে পড়তো। এরা অন্যায়ভাবে মারা যাচ্ছে, না কি সম্পদ বা খ্যাতির জন্য এ কাজ করছে, না কি অত্যাচারী সম্রাটের ইচ্ছার সামনে অসহায় হয়ে এরেনাতে গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া তার আর কোন গত্যন্তর নেই, এসব কোন ধর্তব্য বিষয় ছিলো না মানুষের কাছে। মানুষ বিভৎস মারামারি দেখতে ভালোবাসতো। একজন আরেকজনকে খুঁচিয়ে মেরে ফেলছে, অথবা কোন পশু এসে একটা মানুষকে কামড়ে কামড়ে ছিড়ে নিচ্ছে এসব দেখতে তারা ভালোবাসতো। বাস্তবতার যাতাকলে পিষ্ট মানুষজনের কাছে এগুলো ছিলো বিনোদন, কিছুটা বাঁচার আনন্দ। যত বেশি নিষ্ঠুরতা তত বেশি আনন্দ। এসব দেখতে দেখতে তারা সোৎসাহে মহাউল্লাসের চিৎকারে ফেটে পড়তো। চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার মানুষের গর্জনে আকাশ বাতাস ভরে যেতো। আর প্রধানমন্ত্রী কিংবা সম্রাটের সিংহাসনে বসে ক্যালিগুলা, নিরো অথবা টাইবেরিয়াসের মতো অত্যাচারী বিলাসপ্রবণ সম্রাটের দল মুচকি মুচকি হেসে আনন্দ নিতো। সবশেষে বুড়ো আঙ্গুল নিচু করে হত্যার ইশারা করতো, অনুমতি দিতো। তখন স্পার্টাকাস, ক্রিক্সাস অথবা ভেরাসের মতো গ্ল্যাডিয়েটররা হয় মারতো, অথবা মরে যেতো। সম্রাট হয়তো মহাউত্তেজনা শেষে হেলান দিয়ে বসে সুরাপাত্রে একটা চুমুক দিতেন। ক্ষমতার স্বাদ বড় মধুর।

সেই প্রাচীন রোমের সাথে আজকের তথাকথিত আধুনিক যুগের বাংলাদেশের তেমন বেশি একটা তফাৎ নেই। তখনও বেশ প্রতিষ্ঠিত বিচারব্যাবস্থা ছিলো, আনুষ্ঠানিক রায় দেয়া হতো। এখনও ট্রাইবুনালের নামে মোটামোটি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। স্বাক্ষী মিথ্যাবাদী অথবা স্বাক্ষী নেই কিংবা জাল দলিলপত্র অথবা বাস্তবে বিবাদী ছিলো অন্য কোথাও, এসব বিবেচ্য বিষয় না। বিষয় হলো মানুষের দাবী পুরণ। মানুষ বাস্তবে দেখে বাংলাদেশ একটি ব্যার্থ অথর্ব রাষ্ট্র, দুর্নীতি সন্ত্রাস শ্রেণীবৈষম্য অনায্যবন্টন নিরাপত্তাহীনতা সব মিলে দেশটা দিন দিন পাতালে যাচ্ছে। সুতরাং মানুষের একটু রিলিফ দরকার। দেশ নিয়ে গর্বের জায়গাতে মলমের প্রলেপ দেয়ার জন্য ফাঁসি দরকার। এভাবে তথাকথিত কলংকমুক্তির সান্তনা দরকার।

দুইহাজার বছর পরে এসে এখন রোমান সাম্রাজ্য নিয়ে অনেক বই অনেক মুভি হয়। ওখানে কোন গ্ল্যাডিয়েটর অত্যাচারের শিকার হলে দেখানো হয়। সম্রাট নিরো অথবা কমোডাস এর মতো রাজাদের অত্যাচারের কাহিনী দেখানো হয়। তাতে অবশ্য সেইসব গ্ল্যাডিয়েটর অথবা রাজাদের কি আসে যায় আমি বুঝি না। তারা যারা মারার মেরেছে, যারা মরার মরেছে, যারা অত্যাচার শোষণ করার করে গেছে। এখনও যার ফাঁসি হয় সে তার জীবনে যা করার করে গেছে। যে ফাঁসি দেয় সেও গরীব দেশের গরীব মানুষকে ভুখা রেখে রাজকীয় বিলাস করে যায়। আর আমরা গরীবের দল সেই ফাঁসি কখন দেয়া হবে, কিভাবে দেয়া হবে, এখনো দেয়া হচ্ছে না কেন, লাশ নিয়ে কি হবে, কে ভি চিহ্ন দেখিয়ে আঙ্গুল দিয়ে চেতনাকে সমস্যাগ্রস্থ করে দিলো, কে সাহসী হয়ে আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলো আর কে কলংকমুক্তিজনিত পুলক পেলো এইসব নিয়ে মেইনস্ট্রিম আর অল্টারনেটিভ মিডিয়াতে সেই দুইহাজার বছর আগের প্রাচীন রোমের উন্মাদ জনগণের মতো হিস্টিরিয়াগ্রস্থ চিৎকার করে যাই।

‘রাম যদি হেরে যেতো রামায়ণ লেখা হতো/ রাবণ দেবতা হতো সেখানে’।

আসল কথা একটাই। সময় একটা চলমান প্রক্রিয়া দুনিয়ার বাকী সব থেমে গেলেও যেইটা কখনো থামেনা। সুতরাং একজন মানুষের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত অথবা একটা প্রসেসের সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে ব্যর্থ অথবা সফল বলার পুরোপুরি সুযোগ আসে না। এবং সে মূল্যায়নে যে চলে গেছে তার কিছু আসে যায় না। কেউ টাইবেরিয়াসের মতো আটাত্তর বছর বয়সে গিয়ে মরে, একজন অত্যাচারী রাজার পক্ষে যা করা সম্ভব তা করে। অথবা কেউ নিরোর মতো মাত্র তের চৌদ্দ বছর রাজত্ব করার সুযোগ পায় আত্বহত্যার আগে, তবে এই অল্প সময়ে যা করে তাতেই অত্যাচার অনাচারের ইতিহাসে অমর হয়ে যায়। কোন গ্ল্যাডিয়েটর দীর্ঘদিন এমফিথিয়েটারে রাজত্ব করে। কেউ যোগ্যতা অথবা ভাগ্যের মারপ্যাচে পড়ে অল্পদিন পরে শেষ হয়ে যায়। ইতিহাস তাকে কিভাবে বিচার করলো বা না করলো তাতে ঐ মানুষটার কিছু আসে যায় না। সে নিজের কাছে নিজেকে কিভাবে বুঝে নিলো, উপভোগ করলো না কি হতাশ হলো, ততটুকুই তার প্রাপ্তি। আর আমরা আমজনতা থেকে যাই বিভিন্ন ব্যাখ্যা আর অর্থহীন লম্ফঝম্ফ নিয়ে ব্যস্ত।

মানুষের সমাজে জনগণ কেবলমাত্র তখনই মূল্যবান হয়ে উঠে যখন বিপ্লব সংঘটিত হয়। যখন মানুষ তার অমিত শক্তি নিয়ে জেগে উঠে সব সাজানো এমফিথিয়েটার তছনছ করে দিতে পারে। আর বাকী সব কিছু উপলক্ষ এবং পার্শ্বপ্রসঙ্গ।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s