বুয়েট ভ্যানটেইজ পয়েন্টঃ এক

By: Aman Abduhu
জাহাঙ্গীর আলম সাহেবের মনটা বেশ বিষণ্ণ। বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যায়। মানুষের মৃত্যুতে এতো বিষণ্ণ হওয়ার কিছু নেই। তবে কয়েক মিনিট আগে ফাঁসিতে নিহত কামারুজ্জামান সাহেবের জন্য একটু বেশিই খারাপ লাগছে। মানুষটাকে তিনি দেখেননি। কিছু ঘনিষ্ঠ পরিচিতদের কাছ থেকে শুনেছেন তার কথা। যেসব অভিযোগে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে এসবের মিথ্যা হওয়া নিয়ে, ট্রাইবুনালের অন্যায় ও অবিচার নিয়ে তার যথেষ্ট অনুযোগ আছে। কিন্তু কিছু করার নেই। একটা রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের মেকানিজম আর বেশিরভাগ মানুষ মিলে এমন অন্যায় করতে পারে, এসব ভেবে তার ভালো লাগছে না। অসহায় লাগছে খুব। আগামীকাল সকালে ক্লাশ নেই, তাই মন খারাপ কাটাতে রাতের বেলাতেও ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন বুয়েটের শিক্ষক প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম। কিছু করতে পারছেন না। বারবার নিউজ সাইটগুলোতে খবরের আপডেট আর ফেইসবুকে বিভিন্ন লেখা আর মন্তব্য পড়ে যাচ্ছেন।

বন্ধু জামিলের কথা মনে পড়ছে। দুজন একসাথে পিএইচডি করেছিলেন জাপানে। পিএইচডি শেষে জামিল ওখানে থেকে যায়। হোন্ডা রোবোটিকস এ চাকরী নিয়ে। তার নিজের রেজাল্ট বরং জামিলের চেয়ে বেশি ভালো ছিলো। চাকরীর সুযোগ তার বেশি ছিলো। জামিলও অনেক বুঝিয়েছিলো। ভেবে দেখ দোস্ত, গাড়ি বাড়ি নিরাপত্তা শান্তি। আমরা গরীব দেশের মানুষ। আর কি চাই? এখানে নতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ আছে, কাজের সুযোগ আছে। মানসিক শান্তি পাবি। বাংলাদেশে গিয়ে কি করবি? ঐ দেশের মানুষ আর মানুষ নাই। আল্লাহ এখানে সুযোগ দিয়েছেন, থেকে যা দোস্ত।

জাহাঙ্গীর তখন মুচকি হেসেছিলেন। তার শুধু মায়ের কথা মনে পড়ে। প্রিয় বুয়েট ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ে। গ্রামের কথা মনে পড়ে। এমনকি হাতিরপুল বাজারের ডাস্টবিনের ময়লাগুলোকেও তার কাছে টোকিওর সাজানো গুছানো পার্কের চেয়ে সুন্দর মনে হয়। পরীক্ষার আগের রাতে রিভিশন শেষ করে ক্লান্ত হয়ে পলাশীর মোড়ে গিয়ে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা হয়। তার মনে হয়, পাবলিক ভার্সিটিতে জনগণের টাকায় পড়ালেখার দায় পুরোটা শোধ না হলেও কিছু অন্তত শোধ করা যাবে ওখানে পড়িয়ে। ওখানে চাকরী করে। ক্লাসরুমে বসে উম্মুখ তাকিয়ে থাকা, শিখতে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদেরকে শেখাতে আর নতুন নতুন বিষয় জানাতে তার ভালো লাগে। সে এদেশে ফিরে এসেছিলো।

এলোমেলো এইসব ভাবনার সাথে জাহাঙ্গীর আলম সাহেব ফেইসবুকে বিভিন্নজনের বিভিন্ন লেখাও পড়ছিলেন। বুয়েটিয়ানদের একটা গ্রুপ আছে, নাম ‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’। হঠাৎ গ্রুপের একটা পোস্ট ভেসে আসলো টাইমলাইনে। দীপু সরকার নামে এক ছাত্র কামারুজ্জামানের ফাঁসির খবর শেয়ার করেছে। তার নিচে চন্দ্রনাথ নামে আরেকজন উল্লাসের সাথে লিখেছে, জয় বাংলা। আধাঘন্টাও হয়নি ফাঁসি দেয়া হয়েছে। একজন ইসলামিক নেতার মৃত্যুতে হিন্দুদের এইসব লাফালাফি দেখে তার ভালো লাগছে না। তিনি জানেন এখন চুপ করে থাকাই ভালো। কিন্তু পারলেন না, ওখানে মন্তব্যে করে বসলেন ‘জয় মা কালী, জয় ইনডিয়া”।

ব্যাস, তান্ডব শুরু হয়ে গেলো। বুয়েটের অনেক ছাত্র-শিক্ষক ঝাঁপিয়ে পড়লো ঐ পোষ্টে। শাহবাগ সমর্থক এবং শাহবাগি নিয়ে একটিভ ছাত্রদের ওখানে মারাত্বক সব মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে। সবাই জাহাঙ্গীর আলম সাহেবের ঐ মন্তব্য নিয়ে ব্যস্ত। তুমুল প্রতিক্রিয়া। মন্তব্য প্রতিমন্তব্য গালাগালি। তাকে স্বাধীনতার শত্রু, সাম্প্রদায়িক, বাংলাদেশে থাকা পাকি জারজ বানানো হলো। অন্যান্য শাহবাগিরাও প্রচন্ড চিৎকারে ফেটে পড়ছে। একজন শত্রু পাওয়া গেছে। একে ধ্বংস করার আনন্দে শাহবাগিরা দলবেধে উৎফুল্ল ভয়ংকর এখন। তারা অনেক দেশপ্রেমিক।

এক ঘন্টা ধরে জাহাঙ্গীর সাহেব এসব দেখলেন। ক্লান্ত লাগছে। অসহয়ায় লাগছে। তিনি মন্তব্য এডিট করে লিখলেন ‘জয় ইনডিয়া, জয় মাসল পাওয়ার, জয় নেসটি পলিটিক্স, জয় ইনজাস্টিস’। একটু পরেই হঠাৎ দেখলেন গ্রুপে মিশকাত আল-আলভী নামে এক শাহবাগি প্রগতিশীল ছাত্র, যে গ্রুপের একজন এডমিনও, সে পোস্ট দিয়েছে ‘কেপি টেস্টে সাফল্যের সাথে পাশ করার জন্য বুয়েট শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রুপ থেকে ব্যান করা হলো। ধন্যবাদ। ছাগুসব করে রব ফাঁসি হইলো।’

কিছুক্ষণ পর থেকে তিনি আর গ্রুপে ঢুকতে পারলেন না। বুঝতে পারলেন তাকে বুয়েটিয়ানদের ঐ গ্রুপে ব্যান করা হয়েছে। একজন প্রফেসর হয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে, সহকর্মী শিক্ষকদের কাছ থেকে এ ধরণের আচরণ পেয়ে তার বেশ মন খারাপ হলো।

পরদিন দুপুর দেড়টা। জাহাঙ্গীর আলম সাহেব ডিপার্টমেন্টে তার অফিসে বসে একটা জার্নালে চোখ বুলাচ্ছেন। দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো কয়েকজন ছাত্র। একটু চমকে উঠলেন তিনি। আবু সাইদ কনককে তিনি চেনেন। বুয়েট ছাত্রলীগের সেক্রেটারী। আর শুভ জ্যোতি টিকাদারকে তো সবাই চেনে। বুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি। সাথে আরো সাত আটজন। কয়েকজন তার পরিচিত, বাকীরা অপরিচিত। তবে বুঝা যায় সবাই এখানকার ছাত্র। তিনি বললেন, কি ব্যাপার?

ছাত্রদের একজন চিৎকার করে বললো, শুয়েরের বাচ্চা, রাজাকারের বাচ্চা। কি ব্যাপার জিগাস? তিনি অবাক হয়ে গেলেন। কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।

এর মাঝেই শুভজ্যোতি এগিয়ে এসে তার কলার ধরে টেনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিলো। গালে এসে পড়লো কনকের জোরালো থাপ্পর। বাকিরাও এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। কাপড় ছিড়ে চুল এলোমেলো হয়ে বিশৃংখল অবস্থা। জাহাঙ্গীর সাহেব হঠাৎ এসবের মুখে পড়ে শকড হয়ে গেলেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। এর মাঝেই তাকে এই ছাত্রের দল মারতে মারতে আর ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে নিয়ে আসে। ডিপার্টমেন্টের আশেপাশের অফিস থেকে অন্য শিক্ষকরা আর ক্লাসরুম গুলো থেকে শত শত ছাত্রছাত্রী বের হয়ে এসেছে। সবাই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। কারো কিছু বলার সাহস নেই।

লজ্জায় অপমানে প্রফেসর জাহাঙ্গীর সাহেবের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না ঠিক কি হচ্ছে। মার খেতে খেতে তিনি বুঝতে পারলেন শুভজ্যোতি তার মাথায় একটা ডিম ভেঙ্গে লেপটে দিচ্ছে। বাকিরাও প্রচন্ড উৎসাহিত হয়ে পড়লো। তারাও ডিম নিয়ে তার মুখে ভেঙ্গে লেপটে দিতে লাগলো। ডিমের কুসুম আর আঠালো রসে তার মুখ চুল নোংরা হয়ে একাকার একাকার। কনক একটা প্যাকেট থেকে আঠালো মিস্টি নিয়ে তার নাকে মুখে ঢুকিয়ে দিলো। আর হাসতে হাসতে বললো, এইটা তোর বাপ রাজাকারের ফাসির মিষ্টি। খা শুয়োরের বাচ্চা। রাশেদ নামের তারই আরেক ছাত্র কয়েকটা মিষ্টি তার পিঠে ডলে দিলো।

আনন্দ করতে করতে, তাকে লাথি আর থাপ্পড় দিতে দিতে সবাই মিলে তাকে পাঁচতলা থেকে নামাতে থাকলো। সিড়িতে ছাত্রছাত্রীরা এসব দেখে আঁতকে সরে দাড়াচ্ছে। অনেক শিক্ষক চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। পরবর্তী দশ পনেরো মিনিট যাবত তাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের এ গ্রুপটা কুকুরের মতো মারতে মারতে ক্যাফেটেরিয়ার সামনের রাস্তায় নিয়ে গেলো। ওখানে দেখানো শেষ হলে রেজিষ্ট্রার বিল্ডিং এর সামনেও নিয়ে যাওয়া হলো।

শেষপর্যন্ত তাদের মনের সব আনন্দ মিটে গেলে, শুভজ্যোতি চিৎকার করে বললো, শুয়োরের বাচ্চা আর কোনদিন পারলে মা কালী অথবা ইনডিয়ার নাম নিস। তখন তোর জিহবা টেনে ছিড়ে ফেলবো। আজকে ছেড়ে দিলাম। এই চল। বাকী সবাইকে সে আদেশ দেয়ার পর সবাই উল্লাসে জয় বাংলা স্লোগান দিতে দিতে একাডেমিক বিল্ডিং এর দিকে চলে গেলো। আজ অনেক উত্তেজনা হয়েছে। এখন বোতল খুলে সেলিব্রেট করতে হবে। তার আগে হাত ধুতে হবে। ডিম মিস্টি রক্ত সব লেগে আছে হাতে। অবশ্য রাশেদ জিনসের প্যান্টে হাতটা মুছে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছে।

ছেড়া শার্ট আর বাকি সব ময়লাতে মাখামাখি হয়ে প্রফেসর জাহাঙ্গীর রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর রাস্তায় পড়ে আছেন। প্রচন্ড মার খেয়েও তিনি তেমন একটা ব্যাথা অনুভব করছেন না অবশ্য। শিক্ষক মানুষ, অপমানবোধ একটু বেশি প্রখর। অপমানের যন্ত্রণায় তার শরীরের ব্যাথা ঢেকে গেছে। এটা একটা ভালো দিক।

Correction: This Article previously said that  রাগিব হাসান নামের পুরনো শাহবাগি নেতাও বেশ আবেগঘন বয়ান দিয়ে যাচ্ছে। তার আর বুয়েটের শিক্ষক থাকার অধিকার নেই। তাকে বুয়েট থেকে বের করে দেয়া হোক। Mr Ragib Hasan protested that although he condemned the comments of Mr Zahangir, he never said he cannot be a BUET teacher anymore and he also vehemently protested the attack on Mr Zahangir. We apologize for the mis-attribution in the article.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s