যায়নুদ্দিন সানী
বেশ নাটকীয় একটা নির্বাচন হচ্ছে। বাঙালির জীবনে বিনোদনের সাম্প্রতিক ঘাটতি মেটাতে এই নাটকীয় নির্বাচন বেশ বিনোদন এনে দিয়েছে। হরতাল অবরোধ নিয়ে যখন বিএনপির বেশ ত্রিশঙ্কু অবস্থা, না পারছে তুলে নিতে, না পারছে চালিয়ে যেতে, ঠিক সেই সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল নির্বাচন কমিশন। মেয়র ইলেশানের এই ঘোষণা বিএনপির সাথে সাথে দেশবাসীকেও বেশ স্বস্তি এনে দেয়। বিএনপি স্বস্তি পায় কারণ হরতাল অবরোধ প্রত্যাহারের একটা সুযোগ পেলো বলে আর দেশবাসীর স্বস্তি, এই দুই নেত্রীর জেদাজেদির হাত থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে বলে।
আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও যেমন নাটক করতে জানেন, আমাদের জনগণও এই নাটক তেমন উপভোগ করতে জানেন। বিএনপি যদিও প্রথমে ভাব দেখাচ্ছিল, ‘নির্বাচন করবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে।‘ ‘লন্ডন থেকে অনুমুতির অপেক্ষায় আছে’। তবে জনগণের বুঝতে সমস্যা হয়নি, ব্যাপারটা নাটক। বিশেষকরে যখন দেখা গেল হঠাৎ করে বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক বলতে শুরু করেছে ‘কৌশল’ হিসেবে এই নির্বাচনে যাওয়া উচিৎ তখনি সবাই বুঝে গেল সামনে আরও নাটক আসছে। আর শুরু হতে যাচ্ছে এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা—‘নির্বাচন’।
তবে অন্য যেকোন নির্বাচনের চেয়ে, এবারের নির্বাচনে, নাটকীয়তার পরিমাণ অনেক বেশি। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ বেশ নাটকীয়তা দিয়েই নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন নির্বাচন কমিশন। তার আগে অবশ্য কিছুদিন পত্র পত্রিকায় নাটকের কানাঘুষা প্রচার হল। ‘সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচন হতে পারে’ জাতীয় খবর প্রকাশ হল ‘বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে’। এরপরে নাটকের প্রথম পর্ব প্রচারিত হল। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। এবং বল চলে গেল বিএনপির ‘কোর্টে’। আবার ৫ই জানুয়ারী টাইপ নির্বাচন না দুইদলের অংশগ্রহণে নির্বাচন।
উত্তর সরাসরি আসবে এমন প্রত্যাশা কেউই করেনি। নাটক হবে, সবাই জানতো। এবং হলোও। ঠিক একটা নাটক না, বলা যায় নাটকের সিরিজ শুরু হল। একটার পর একটা নাটকীয়তা আসছে তো আসছেই। বিএনপি আসবে কি আসবে না, অবরোধের কি হবে, হরতালের কি হবে, আন্দোলনের কি হবে, তত্ত্বাবধায়ক সাহেবেরই বা কি গতি হবে—এমন দারুণ সব সাসপেন্সে প্রথমে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হল।
আমাদের নেতারা যে সরাসরি উত্তর দেবেন না, তা জনগণ জানে। ফলে সবাই অপেক্ষা করে থাকল, নাটক মঞ্চায়নের জন্য। এবং জনগণকে নিরাশ না করে একে একে বেশ নাটকীয় স্টাইলে উত্তরগুলো আসতে শুরু করল। বিএনপি নির্বাচন করবে। আর এমন সিদ্ধান্ত নিতে সবচেয়ে বেশ প্রভাব ফেলল আগের দফায় সিটি কর্পোরেশান নির্বাচনে জয়ের স্মৃতি। টিপিক্যাল কিছু ছোটখাট নাটকীয়তা সেরে বিএনপি ঝাঁপিয়ে পড়ল নির্বাচনে। এবং শুরু হল নাটকের দ্বিতীয় পর্ব।
মিন্টু সাহেব ছোটখাট একটা নাটক দেখালেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রার্থী হওয়ার জন্য সাধারণতঃ নাটক হয়, তবে এবার উল্টো ঘটনা ঘটল। মিন্টু সাহেব প্রার্থী হবেন না। আবার সেকথা ম্যাডামকে মানাতেও পারছেন না। ফলে নাটক করতে হল। এবার ম্যাডাম মানলেন। মাঝে কিছুদিন মাহী সাহেব দৌড়ঝাঁপ করলেন। তবে শিকে ছিঁড়ল না। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন কি না, তা নিয়ে কিছু নাটক হল এবং অবশেষে জানালেন, ‘করবেন না’।
কাহিনী ভালোই এগোচ্ছিল। তবে নাটকে আওয়ামীরা পুরোপুরি খুশি কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। ‘বিএনপি নির্বাচনে আসুক’ কথাটা মুখে বললেও সত্যি সত্যি তাঁরা কি চায়, তা নিয়ে কিছু সাস্পেন্স ছিল। কটাক্ষ, শ্লেষ যেমন চলছিল তেমনি চলছি ধরপাকড়। বিএনপির বহু প্রার্থীই পলাতক কিংবা আটক। এদেশে মামলা দেয়া যেহেতু কোন ব্যাপার না, তাই ব্যাপারটা পরিকল্পিত না ‘আইনের নিজস্ব গতিতে চলা’ তা নিয়ে কিছু সংশয় অনেকের মনে দেখা যাচ্ছে। অন্ততঃ বিএনপি চাইছে যেন ‘সংশয়’টা দেখা যায়।
এরমাঝে গাড়িবহরে হামলা হল। দুই পক্ষই দাবী করল নাটক। ভিডিও ফুটেজে সেই নাটক সবাই দেখল। নিজ নিজ রাজনৈতিক মত অনুযায়ী দুই দলই একে অন্যকে নাট্যকার আখ্যা দিলেন। আওয়ামী নেত্রী ছবি দেখালেন। এদেশে নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম বলে যেহেতু কিছু নেই, তাই জনগণও আর কারো ভাষ্য বিশ্বাস করে না। সবাই নিজের নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, ‘নাটকটা কার লেখা’। হামলা অবশ্য একটায় থামল না। মাহী আর রতন সাহেবের ওপরও হল। এবং যথারীতি সেই নাট্যকার বিতর্ক হল। কাউই মানতে রাজী না এতো সুন্দর নাটকের তিনিই নাট্যকার। ফলে জনগণের প্রজ্ঞাই ভরসা।
ওদিকে মীর্জা সাহেব সামনে আসবেন কি না, জামিন হবে কি না, কেস চলবে কি না, বিএনপি শেষ পর্যন্ত কি করবে, এমন ছোটখাট সাসপেন্স থাকলেও বিএনপি যে নির্বাচন করবে তা নিয়ে খুব একটা সন্দেহ কারো মনেই ছিল না। তবে নির্বাচনের পরে কি হবে তা নিয়ে এখনও সাসপেন্স আছে। পরাজয় হলে সেই ‘টিপিক্যাল’ কারচুপি ফর্মুলা যে হাজির হবে, তা অনেকটাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে বোঝা যাচ্ছে না, বিএনপি জিতলে কি হবে কিংবা ঢাকার দুই অংশে দুইজন জিতলে কি হবে।
যাক, গতকিছুদিন সময়টা বেশ ভালোই কাটল। বিজয়ী প্রার্থী নগরের জন্য আদৌ কিছু করবেন কি না, তা নিয়ে কেউ সত্যিকার অর্থে কেউ ভাবিত না। নির্বাচনে জয়ের পরে যে প্রার্থীর টিকির দেখা পাওয়া যাবে না, একথা কমবেশি সবাই জানেন। এসব রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কোন রকম প্রত্যাশা বহু কাল আগেই তিরোহিত হয়েছে। এখন জনগণের কাজ একটাই, হিসাব করা—‘কে জিততে পারে’। তবে এই নির্বাচন আরও একটি চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে, ‘নির্বাচনের পরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কি হবে?’