ফ্যাসিজম ও ঘৃনার ব্যাবসার বিবর্তন

 শাফকাত রাব্বী অনীকঃ  ফ্যাসিজমের একটা পরিচিত বহিঃপ্রকাশ হলো কোন একটী ক্ষুদ্র গোষ্টীকে নিয়ে ঘৃণা ছড়ানো এবং এই ঘৃনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে কোন একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্টিকে কোন দেশের সব সমস্যার কিংবা অতীতের কোন ঐতিহাসিক ঘটনার দায় চাপিয়ে দিয়ে ঘৃনার চর্চা চালিয়ে যাওয়াটা একটি পুরোন ফ্যাসিস্ট টেকনিক।

ঘৃণাকে কেন্দ্র করে যখন কোন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যাবস্থা বা রাজনৈতিক মতাদর্শ গড়ে উঠে, তখন সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক সুবিধার্থে এই ঘৃনার ডোজ বাড়াতে হয়। একারনে দেখা যায় ঘৃণার ব্যাবসা একবার শুরু করে দিলে, সময়ের সাথে সাথে মানুষকে খুশি রাখতে নতুন নতুন, তীব্র থেকে তীব্রতর ঘৃনাময় কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে হয়।

হিটলারের জার্মানী প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে হেরে যাবার পরে তাদের সমস্ত সামরিক ও অর্থনৈতিক ব্যার্থতার দায়ভার নগন্য সঙ্খ্যক জার্মান ইহুদিদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। খুব ক্ষুদ্র জনগোষ্টি হলেও ইহুদিরা শিক্ষার দিক্ষায় ব্যবসায় বানিজ্যে অনেক এগিয়ে ছিল। আর ঐতিহাসিক কারনে ইহুদিদের প্রতি সারা ইউরোপ জুড়ে, বিশেষকরে সাবেক প্রাষিয়ান সম্রাজ্যে ব্যাপক ঘৃণার লালন পালন ছিল। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত হিটলার এই ঘৃণাকে কেন্দ্র করে তাঁর রাজনীতি শুরু করেছিলেন। এই ঘৃণাকে ব্যবহার করে তিনি ইলেকশন জিতেছিলেন – ফ্রি এন্ড ফেয়ার।

ঘৃণাকে কেন্দ্র করে রাজনীতি পরিচালনার ফলাফল কি হয়, কিভাবে ঘৃণার ডোজ বাড়াতে বাড়াতে মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়, তা দেখতে পারবেন মাত্র দশ বছরের নিচের টাইম লাইনে।

January 1933 – এডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন। তখন জার্মানির ইহুদী জনসংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ লক্ষ ছেষট্টি হাজার।

April 1933 – হিটলারের নাজি বাহিনী ইহুদীদের ব্যাবসা ও দোকান পাট বর্জনের ডাক দেয়।

April 1933 – নাজি বাহিনি ঠিক করে দেয় বাপ-দাদার বংশ ও ধর্মের ভিত্তিতে কে হতে পারবে খাটী জার্মান। এই আইন অনুযায়ী, কারো ফ্যামিলিতে যদি একজন দাদা-নানা কিংবা বাবা-মা ইহুদী হন তাহলে তাকে খাটি জার্মান বলা যাবে না ( আরিয়ান)। তখন জার্মানীকে খাটি আরিয়ানদের বসতভুমি বানানোর কাজ চলছিল হিটলারের তত্তাবধানে।

July 1933 – নাজি বাহিনিকে জার্মানির এক মাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল ঘোষণা করা হলো। পোলান্ড থেকে আগত ইহুদীদের জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল করা হলো।

September 1933 – ইহুদীদের আইন করে জমি-জমার মালিকানা পাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়।

October 1933 – ইহুদীদের আইন করে পত্রিকার সম্পাদক হওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়।

May 1934 – হেলথ ইন্সুরেন্স থেকে ইহুদীদের বাদ দেয়া হয়।

May 1935 – ইহুদীদের সামরিক বাহিনীতে ঢোকা বন্ধ করে দেয়া হয়।

February 1936 – ইহুদীদের বন্দী করে রাখার জন্যে সৃষ্টি করা গেস্তাপো জেইলকে আইনের উর্ধে নিয়ে যাবার আইন পাশ করা হয়।

January 1937 – ইহুদীদের প্রফেশনাল চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। যেমন ইহুদিরা আর কোন জার্মান নাগরিকদের শিক্ষক হিসেবে পড়াতে পারবেন না, দাতের ডাক্তারি করতে পারবেন না, একাউন্টেন্ট হতে পারবেন না ইত্যাদি। ইহুদিরা সেসময় এই পেশা গুলোতে অধিক মাত্রায় ঢুকতো।

April 1938 – সকল ইহুদীকে তাঁর সহায়-সম্পত্তি, জমি-জামার হিসেব সরকারকে দিতে বলা হয়।

July 1938 – ইহুদিদের যাদের বয়েস ১৫ বছরের বেশী তাদেরকে পুলিশের কাছ থেকে স্পেশাল আইডি কার্ড নিতে বলা হয়।

July 1938 – ইহুদী চিকিৎসকদের আইন করে চিকিৎসা পেশায় থাকা নিষিদ্ধ করা হয়।

August 1938 – সকল ইহুদী মহিলার নামের শেষে সারাহ, আর ইহুদী পুরুষের নামের শেষে ইসরাইল রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়।

September 1938 – ইহুদীদের সকল প্রকার আইন পেশা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়।

October 1938 – ইহুদিদের পাস্পোর্টে স্পেশাল ইংলিশ “J” অক্ষর বড় করে লিখে দেয়া হয় (জিউইশ বুঝানোর জন্যে)

November 1938 – ইহুদী ছাত্র-ছাত্রিদের সাধারন স্কুল কলেজ থেকে বহিষ্কার করা শুরু হয়।

December 1938 – আইন করে ইহুদী ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান গুলো রাষ্ট্রীয়করন শুরু হয়।

February 1939 – ইহুদীদের হাতে থাকা সমস্ত সোনা ও রূপার গয়না হিটলারের নাজি পার্টিকে দিয়ে দিতে বলা হয়।

April 1939 – ইহুদীদের শুধু মাত্র ইহুদী বাড়ি ওয়ালার বাসায় ভাড়া থাকার আইন করা হয়।

July 1939 – ইহুদীদের সরকারী চাকরিতে ঢোকার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়।

September 1939 – গ্রীষ্মকালে রাত আটটার পরে আর শীত কালে রাত নয়টার পরে ইহুদিদের বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ করে দেয়া হয়।

September 1939 – ইহুদিদের ওয়ারলেস রেডিও কেনা বা সাথে রাখা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়।

October 1939 – পোলিশ ইহুদীদের যাদের বয়েস ১৪ থেকে ৬০, তাদেরকে বাধ্যতামূলক শ্রমিক বানানোর আইন করা হয়।

November 1939 – সকল পোলিশ ইহুদী যাদের বয়েস ১০ এর বেশি তাদের বুকে একটা হলুদ রঙের তারা চিনহ লাগিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়।

January 1940 – নাজি খবরের কাগজে বলা হয়, ” ইহুদিদের বিচার শুরু হয়েছে, এবং এই বিচার শেষ হবে যখন সকল ইহুদির খবর পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার কাজ শেষ হবে”।

হিটলারের সহচর হিমলার এই সময় ঘোষনা দেন, ” আমাদের সর্বচ্চো নেতা নির্দেশ দিয়েছেন ইহুদী প্রশ্নে আমাদের শেষ সলুশনের কাজ শুরু করতে ( Final Solution of the Jewish question)”. এই কথার মাধ্যমে ভদ্র ভাষায় গনহত্যা চালানোর নির্দেষনা বোঝাতো নাজি জার্মানি।

September 1941 – সকল জার্মান ইহুদীকে হলুদ তারা মার্কা চিনহ পড়ে ঘুরা ফেরা করতে বলা হয়।

April 1942 – জার্মান ইহুদিদের ট্রেনে, বাসে চলা বন্ধ করে দেয়া হয়।

June 1942 – ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়াতে ইহুদিদের হলুদ তারা মার্কা পরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।

May 1943 – হিটলারের নাজি বাহিনী জার্মানীর রাজধানী বার্লিনকে ইহুদী মুক্ত ঘোষনা দেয়। অর্থাৎ বার্লিনের সকম ইহুদী নারী, পুরুষ, শিশুর হত্যা নিশ্চিত করে।

 
 
 
 
 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s