বাংলাদেশের আস্তিক-নাস্তিক বাইনারী নিয়ে একটি “বিজ্ঞানমনষ্ক” আলোচনা

2

ফাহাম আব্দুস সালাম

বাংলাদেশে ‘বিজ্ঞানমনষ্ক’ বলে একটা টার্ম আছে। সম্ভবত যারা বিজ্ঞানী নন, বিজ্ঞান নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করেন নি কিন্তু পরিপার্শ্বকে বোঝার জন্য বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করেন তাদের নির্দিষ্ট করতে এই টার্মটি ব্যবহার করা হয়। এই নির্দিষ্টকরণে একটা ফাঁক আছে – বেশ বড় ফাঁক। পরিপার্শ্বকে বোঝার জন্য বিজ্ঞানকে একেবারেই ব্যবহার করেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশী আছেন বলে আমার মনে হয় না। যাদের আমরা গণ্ডমূর্খ ধরে নিয়ে নিজেদের বিজ্ঞানমনষ্ক বলি তারাও অনেক কিছু বোঝার জন্য রিপিটেবল অবজারভেশন এবং যুক্তি ব্যবহার করেন। হ্যা, তাদের হয়তো দিলখুশ সংজ্ঞা জানা নেই, হয়তো তারা তাদের অবজারভেশনকে গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারেন না কিন্তু তারা অতশত না জেনেও বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেন।

কিন্তু তাদেরকে আমরা বিজ্ঞানমনষ্ক বলি না – কারণ দুয়েকটি ব্যাপারে তারা বিজ্ঞানমনষ্ক হলেও তাদের জীবনে অবিজ্ঞানমনষ্কতা আছে বেএন্তেহা – তারা তুকতাকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু কতোটুকু অবিজ্ঞানমনষ্কতা এতোটাই দূষিত করে ফেলে যে একজনকে আর বিজ্ঞানমনষ্ক বলে আর ঠাওর করা যাবে না এ ব্যাপারে কোনো কনসেনসাস নেই।

হয়তো তারা বোঝান যে পরিপার্শ্বকে বোঝার জন্য যারা ‘কেবলমাত্র’ বিজ্ঞানলব্ধ এবং বিজ্ঞানচর্চিত জ্ঞানকেই সঠিক ও নিরাপদ মনে করেন তারাই বিজ্ঞানমনষ্ক।

ফিজিকাল ওয়ার্ল্ডকে বোঝার জন্য বৈজ্ঞানিক চিন্তা প্রক্রিয়া সর্বশ্রেষ্ঠ ও অদ্বিতীয় হলেও মানুষ তার পরিপার্শ্বকে বোঝার সময়ে ফিজিকাল ও মেটাফিজিকাল – ব্যাপার দুটোকে সবসময় খাড়া দাগে আলাদা করতে পারে না। আমাদের সবার মাঝে একটা উদগ্র ও অনিঃশেষ বাসনা আছে – আমরা জানতে চাই। আমরা সব ধরনের প্রশ্নের উত্তর পেতে চাই। এ কথা সত্য যে বেশীরভাগ প্রশ্নের উত্তরের জন্য বিজ্ঞানই যথেষ্ট এবং বিজ্ঞানই একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাকারী। কিন্তু এমন কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। তার কারণ এই না যে বিজ্ঞান ইনফেরিয়র – কারণ সে সব প্রশ্ন বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে না। সমস্যা হোলো – ঠিক এই প্রশ্নগুলোই মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা প্রশ্ন।

যেমন ধরুন “জগৎ সংসারে আমি কেন এসেছি” – প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো সময়ে কিংবা সারাজীবন এই প্রশ্নটি তাড়িয়ে বেড়ায়। কোনো বিজ্ঞানী কোনোদিনও এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন না। কিন্তু স্টিভেন হকিন্স এর উত্তর দিতে পারবেন না বলে কি আপনি আপনার জানার তেষ্টাকে অনিবারিত করে রাখবেন? অবশ্যই না। কোনো ধরনের দর্শন ছাড়া এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই – এটাই পরমসত্য এবং এখানেই ধর্মের উপযোগিতা (ধার্মিকদের কাছে ধর্মের আরো অনেক উপযোগিতা আছে)।

আপনি যখন বলবেন যে বিজ্ঞানই আমার পরিপার্শ্বকে বোঝার একমাত্র সহায় তখন আপনাকে দুটো কাজ করতে হবে: আপনার মাথাকে বোঝাতে হবে যে মেটাফিজিকাল প্রশ্নের কোনো প্রয়োজন নেই, তাই এর উত্তরেরও কোনো প্রয়োজন নেই। অথবা যেহেতু এসব প্রশ্নের ‘নির্ভুল’ উত্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই তাই আমি এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তিত না। বলাই বাহুল্য, যেকোনো প্রশ্নের উত্তর জানার যে হিউম্যান স্পিরিট তার সাথে এ ধরনের অবস্থান সঙ্গত না। তাই বেশীরভাগ মানুষ দুটো গিয়ারে চলেন অর্থাৎ তারা ফিজিকাল এবং মেটাফিজিকাল প্রসঙ্গকে আলাদা আলাদা ভাবে বোঝার চেষ্টা করেন এবং স্বভাবতই তাদের ‘বিজ্ঞানমনষ্কতার’ ভেতরে ‘অবিজ্ঞানমনষ্কতা’ ঢুকে পড়ে।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই বিজ্ঞানমনষ্কতা একটা আলাদা আলোচনাও দাবী করে।

অনেকের লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে তারা নাস্তিকতা, মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা – এই টার্মগুলোকে ইন্টারচেঞ্জেবলি ব্যবহার করেন। সে সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ প্রমাণে এই শব্দ এবং শব্দবন্ধগুলো টেনে আনেন। আমার ধারণা, তারা বিজ্ঞান না বোঝার কারণে এই ভুলগুলো করেন। খুলে বলি। নাস্তিকতা, শেষ বিচারে একটি দার্শনিক অবস্থান, কোনো বৈজ্ঞানিক অবস্থান না। খোদাতালা আছেন কিংবা নেই – কোনোটিই আপনি ‘প্রমাণ’ করতে পারবেন না। এবং খোদাতালায় বিশ্বাস করা বা না করা – কোনোটিই আপনার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের কোনো স্বাক্ষর না। উনবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ ৫ জন ম্যাথমেটিশিয়ানের একজন গিয়োর্গ কানটোর মনে করতেন যে খোদাতালা তার কানে কানে গণিত নিয়ে কথা বলতেন। আল্লাহতে বিশ্বাস করা এবং খোদাতালার কানে কানে গণিত নিয়ে কথা বলার কারণে তিনি হুমায়ুন আজাদ কিংবা তসলিমা নাসরিনের চেয়ে ইন্টেলেকচুয়ালি ইনফেরিয়র – এমন দাবী যিনি করবেন তার সাথে যদি কানে কানে পাহাড়-নদী, মামদো ভূত ও সুচিত্রা সেন কথা বলেন রোজ – ওষুধ খাওয়ার আগে – শুনলে আশ্চর্য হবো না।

Image-1

বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ মোটা মোটা বই এসপার-ওসপার করে দেয়া না, সুন্দর করে বাংলা আর ইংরেজি লেখা না; বরং জ্ঞান সৃষ্টি করা। টমাস এডিসন পৃথিবীর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ একজন ইনভেনটর। তার সাথে কাজ করেছিলেন ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ কয়েকজন বিজ্ঞানীদের একজন; নিকোলা টেসলা। টেসলার মতামত যদি আমরা সঠিক বলে ধরে নিই তাহলে ধরে নেয়া যায় যে টমাস এডিসন আদতে একজন গাড়ল ধরনের মানুষ ছিলেন। মানে খুবই পরিশ্রমী কিন্তু পড়ালেখা জানেন না তেমন, বুদ্ধিও খুব বেশী না। নিঃসন্দেহে আমাদের ব্লগস্ফেয়ারের অনেক মানুষ এডিসনের চেয়ে অনেক বেশী পড়ালেখা জানা মানুষ – কিন্তু তারা “জ্ঞান”কে সমৃদ্ধ করতে পারেন নি এতোটুকু – যেটা এডিসন পেরেছিলেন।

জ্ঞান সৃষ্টি করার সাথে পরিশ্রম, কল্পনাশক্তি আর ইন্সপিরেশান জড়িত – খোদাতালায় বিশ্বাস করা বা না করার সাথে প্রায় এর কোনোই যোগাযোগ নেই। জ্ঞান সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে খোদাতালায় বিশ্বাস করা প্রতিবন্ধক; এমন বিতর্কে যে কাওকে আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি – যে কোনো সময়ে আমি প্রস্তুত।

এছাড়াও কিছু লক্ষণ আমার চোখে পড়েছে। আমি বলবো না যে বাংলা ব্লগস্ফেয়ারে ইসলামোফোবিয়ার জোয়ার বয়ে যাচ্ছে কিংবা “মুক্তমনা” নামক ব্লগে নাস্তিকরা ব্যাকটেরিয়ার মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরং বেশীরভাগ লেখাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। যারা সেখানে লেখেন তারা যে খুব ভালো লেখেন সেটা মনে হয় নি কিন্তু তারা ফ্রি এনকোয়েরির স্পিরিটেই লেখেন। তবে এও সত্য যে কিছু লেখা সত্যিই ইসলামোফোবিক এবং যে লেখাগুলো ইসলামোফোবিক সেগুলোতে কিংবা সেই লেখকরা অন্যত্র খুব উৎকট মাত্রার হেইট স্পীচ দেন (মুক্তমনার কিছু লেখককে মনে হয় দেখেছি যে তারা অন্যত্র সন্দেহাতীত ভাবে ইসলামোফোবিক হেইট স্পীচ দিয়েছেন এবং উগ্রতাবাদীরা অত্যন্ত অন্যায্যভাবে এর দায়ভার অভিজিৎ রায়ের ওপর চাপিয়েছেন)। এর কারণ মনে হয়েছে দুটো: প্রথমটি হোলো তারা নিজেদের যা দাবী করেন সেটি তারা নন অর্থাৎ ‘বিজ্ঞানমনষ্ক’ নন। তারা একজন দের হাজার বছর আগের ঐতিহাসিক চরিত্রকে মূল্যায়ন করেন আজকের পৃথিবীর মাপকাঠিতে এবং সেটিও করেন খুব অল্প পড়ালেখা করে। বাংলাদেশের ‘পাইছি’ সাংবাদিকতার মতো। একজায়গায় ইংরেজি ভাষায় লেখা কোনো আর্টিকেল পড়লেন, বাস ওটা ব্যবহার করতেই হবে। বিজ্ঞানমনষ্ক হলে তারা যাচাই বাছাই করে নিজেদের কুসুম কুসুম পাণ্ডিত্য জাহির করা থেকে নিবৃত হতেন। আর দ্বিতীয় কারণটি হোলো আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় কাওকে শুয়োরের বাচ্চা না বললে নিজের ক্ষোভ সুষম ভাবে প্রকাশ পেলো না বলেই অনেক লেখক অভিমান করেন।

যেমন ধরুন কা’ব ইবেন আল-আশরাফ নামক এক ইহুদি নেতাকে রসুল ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা লেখার জন্য হত্যা করিয়েছিলেন বলে তারা সমালোচনা করেন। এবং সে ঘটনার সাথে অভিজিৎ রায়ের হত্যার ‘ইসলামী’ যোগসূত্রের সন্ধান দেন পাঠকদের (অর্থাৎ ফ্যানাটিকরা যে রসুলের বিদ্রূপকারীদের হত্যা করে তার উদাহরণ রসুল নিজেই সৃষ্টি করেছিলেন)। তারা যে কথাগুলো বলতে কিংবা পড়তে ভুলে যান সেটা হোলো কা’ব ইবেন আল-আশরাফ বানু নাদির গোত্রের ইহুদি ছিলেন এবং এই গোত্রটি মদিনা সনদের সিগনেটরী। এই চুক্তি মোতাবেক কোনো গোত্র মক্কার কুরাইশদের সাথে প্যাক্ট করতে পারবে না এবং মদিনাবাসীরা কারো দ্বারা আক্রান্ত হলে সবাই এক সাথে প্রতিহত করবেন।

তা চুক্তি ভঙ্গ হলে কী হবে? আপনার খারাপ লাগতে পারে কিন্তু সে সময়ের যে আইন তাতে মৃত্যুদণ্ডই যে এর সাজা সেটা সবার জানা ছিলো – মদিনার মুসলমান এবং ইহুদি সবাইই এটা জানতেন। আপনি নিশ্চই আশা করেন না যে বিভিন্ন ধর্মের ও বিভিন্ন গোত্রের অংশগ্রহণে যে চুক্তি তাতে ইসলামী আইন বলবৎ হবে কিংবা আজকের আমাল আলামুদ্দিন ও জেফরি রবার্টসনকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করা হবে। কা’ব ইবেন আল-আশরাফ মক্কার আবু সুফিয়ানের সাথে চক্রান্তের জন্য মিলিত হয়েছিলেন এবং এর শাস্তি তখনকার বিচারে মৃত্যুদণ্ডই ছিলো। তাছাড়া রসুল সে সময়ে কেবল ধর্মীয় নেতাই ছিলেন না, বিচারক ও প্রশাসকও ছিলেন। তার অথোরিটি ছিলো এই আদেশের। কোনো সাহাবী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিংবা ইসলামী জজবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করেন নি।

এরপরও যদি আপনার রসুলকে সমালোচনা করার ইচ্ছা হয় করুন – কিন্তু তার ভাষাটা শালীন হওয়া উচিত। গালিগালাজ করা, কিংবা এই একটি ঘটনা থেকে ইসলামকে ভায়োলেন্ট বলাটা নেহাৎ ‘অবিজ্ঞানমনষ্ক’ হওয়ার লক্ষণ। আমি ধর্ম বিষয়ে পড়ালেখা করি নিয়মিত – সব ধর্মেই আমার আগ্রহ। আমার কখনোই মনে হয় নি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মই ইনহেরেন্টলি ভায়োলেন্ট। কিন্তু মানুষের চরিত্রে একটা প্রকৃতিগত ভায়োলেন্স আছে। তাই সব ধর্মই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতে পারে। বরং অন্তত কিছু মানুষের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে যে ধর্ম হয়তো ভায়োলেন্স কমাতে সাহায্য করে।

আসল বিষয় হোলো সে ধর্মের অনুসারীদের, সংখ্যার দিক থেকে একটা ক্রিটিকাল মাস আছে কি না? জীব হত্যা যে ধর্মে হারাম সে শান্তির ধর্ম পালনকারী বৌদ্ধরা মায়ানমারে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। নাস্তিকতার যখন যথেষ্ট-সংখ্যক অনুসারী হবে, যখন তারা অর্গানাইজড হবে এবং যখন তারা মনে করবে যে আক্রমণ করলে জেতার সম্ভাবনা প্রবল – তখন নাস্তিকরাও ভায়োলেন্ট হবে। ভায়োলেন্স মানুষের খাসলত – এটা ঐতিহাসিক সত্য। ধর্ম একটা অনুঘটক সন্দেহ নাই – কিন্তু আরো অনেক অনুঘটক আছে যেগুলোকে নির্দিষ্ট করার একটা দায়িত্ব আছে, যদি আপনি বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে থাকেন। উদাহরণ দেই –

কারোই জানা নেই অভিজিৎ রায়কে কারা হত্যা করেছে। সন্দেহ করা মোটেও অমূলক না যে কাজটা ধর্মীয় ফ্যানাটিকদের। সেটা ধরে নিলেও আমার জানা মতে এ ধরনের ধর্মীয় কারণে হত্যা এবং হত্যাপ্রচেষ্টা হয়েছে মোট চারজনের ওপর: হুমায়ুন আজাদ, থাবা বাবা, আসিফ মহিউদ্দিন এবংঅভিজিৎ রায়। ধরে নিই সংখ্যাটা এর দ্বিগুণ (যেহেতু সঠিক সংখ্যাটি আমার জানা নেই)। গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র বিএনপি করার জন্য কিংবা জামায়েত এবং হেফাজত করার জন্য সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় বিনা বিচারে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে পুলিশ এবং RAB হত্যা করেছে তার চেয়ে অ-নে-ক বেশী মানুষ। এমন কি ছাত্রলীগও তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে এর চেয়ে বেশীসংখ্যক মানুষকে হত্যা করেছে। বিজ্ঞানমনষ্ক হলে আপনার এমপিরিকাল ডেটার ওপর নির্ভর করার কথা। সেক্ষেত্রে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য ইসলামকে ইনহেরেন্টলি ভায়োলেন্ট বললে আপনাকে অন্তত এটা মানতে হবে যে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ উভয়ই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের কনটেক্সটে ইসলামের চেয়ে অ-নে-ক বেশী ভায়োলেন্ট।

দেখুন নিজেকে বিজ্ঞানমনষ্ক দাবী করার একটা সমস্যা হোলো আপনাকে সব সময় একটা নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখতে হবে। সারা রাত ফিফটি শেডস দেখে ভোর বেলায় ফজর নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ার মতো না ব্যাপারটা।

তবে এ কথাও সত্য যে শুধুমাত্র আক্রমণের সংখ্যা দিয়ে ধর্মীয় ফ্যানাটিসিজমের মাত্রা মাপা সম্ভব না। বাংলাদেশে ইসলামী ফ্যানাটিসিজম আছে – এটা সত্য এবং আমার কাছে যেটা ভয়ঙ্কর লেগেছে সেটা হোলো বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা নিজেদের ঈমানদার মুসলমান হিসেবে জ্ঞান করেন তারাও অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডকে নৈতিকভাবে সমর্থন করেছেন। তারা কয়েকটি সত্য খুব সুবিধাজনকভাবে ভুলে যান যে রসুল তার বিরোধী পক্ষের মানুষ, যারা তাকে দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রণা করেছেন তাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন। এমনটা কল্পনা করা মোটেও অসঙ্গত না যে কুরাইশরা তার অনুপস্থিতিতে তার সাহাবীদের সামনে তাকে নিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর কথা বলতো। তার সাহাবীরা যদি কুরাইশদের হত্যা করার চেষ্টা না করে থাকে এখনকার মুসলমানরা কি সাহাবীদের চাইতেও বড় মুসলমান যে রসুলকে নিয়ে আপত্তিকর কোনো কথা বললেই কাওকে হত্যা করতে হবে বলে তারা মনে করে? এই প্রশ্নগুলো এখনকার মুসলমানদের করা প্রয়োজন।

image-2

সিরিয়া আরবদের নিয়ন্ত্রণে আসে রসুলের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই কিন্তু সিরিয়ার জনসংখ্যার ৫০% মুসলমান হতে সময় লাগে প্রায় পাঁচশ বছর। সাহাবী এবং তাদের বংশধররা আছে, আছে মুসলমানদের শাসন। তারপরেও মোট জনসংখ্যার অর্ধেককে মুসলমান করতেই লেগে গেছে পাঁচটি শতক (ইসলাম প্রকৃতিগত ভাবে ভায়োলেন্ট হলে আরো কম সময় লাগা উচিত ছিলো বলে আমার ধারণা)। দের হাজার বছর পর আজকের পৃথিবীর এক বিলিয়নের বেশী মানুষ নিজেদের মুসলমান বলে দাবী করেন। কিন্তু ফ্যানাটিকদের মর্সিয়া শুনলে মনে হয় কাল সকালের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাবে। দের হাজার বছর যা টিকে থাকতে পারে সেটা নিজের মেরিটেই টেকে – এটা বোঝার জন্যে আপনাকে আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ফ্যানাটিকদের গেল গেল রব শুনলে মনে হয় রসুলকে নিয়ে কোথাকার এক হরিদাস পাল একটা ব্লগ লিখলেই তার নিজের এবং ইসলামের সব মানসম্মান ভূ-লুন্ঠিত হয়ে যাবে।

এবং এও সত্য যে সাম্প্রতিক কালে ইসলামী ফ্যানাটিসিজমের যে উৎকট প্রকাশ – সেটা উস্কে দেয়ার পেছনে বাংলাদেশে মুক্তমনের যারা দাবীদার তাদের একটা বড় অংশের খুব বড় দায়ভার আছে।

লাইফ সায়েন্স আমার পেশা। আমার বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে যে আড্ডাবাজি তার একটা বড় অংশ ধর্মের পেছনে ব্যয় হয়। সব ধর্ম নিয়েই আলোচনা হয় কিন্তু আমার দুয়েকজন বন্ধু ছাড়া বাকীদের ধর্মবিশ্বাস যে কী সেটা নিয়ে আমার কোনো ধারণাই নেই। সম্ভবত আমার বেশীরভাগ সহকর্মীই নাস্তিক অথবা অজ্ঞেয়বাদী। হ্যা, যারা বিবর্তনবাদকে অস্বীকার করে তাদের মূর্খতা নিয়ে আমিও রঙ্গতামাশা করি – সন্দেহ নেই। কিন্তু কখনোই কোনো ধর্মকে আক্রমণ করার কোনো প্রয়োজন কারো মধ্যে আমি দেখি না।

কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তমনাদের অনেকের মাঝে আমি ইভানজেলিক জজবা দেখতে পাই। যুক্তির কাজ আপনাকে চোক-স্ল্যাম দেয়া না। যুক্তির কাজ হোলো সবচেয়ে অল্প ও সহজ ভাষায় সত্যটাকে উপস্থাপন করা – আপনাকে ঘায়েল করা না। তাই নাস্তিকতা ও ফ্রি এনকোয়ারির একটা দায়বদ্ধতা আছে যে সেটা যেন সংঘবদ্ধ ধর্মের মতো অন্যকে আঘাত না করে। এই চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তমনারা মানেন না।

তাদের অনেকগুলো টুপি আছে। কখন তারা বিজ্ঞানমনষ্কতার টুপি পরেন, কখন তারা শাহবাগের টুপি পরেন আর কখন যে তারা আওয়ামী লীগের টুপি পরেন সেটা বোঝা মুশকিল। কিন্তু তাদের আবদার হোলো ভিন্ন ভিন্ন টুপি পরার এই ক্রমপর্যায় সকল দর্শককে সব সময় মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ আপনি যখন শাহবাগে গিয়ে ফাঁসি ফাঁসি করবেন কিংবা একটি ফ্যাসিস্ট রেজিমের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেবেন তখন আপনার ভাষ্যমতে যারা আপনার ও আপনার বন্ধুদের মূল শত্রু তাদেরকে ভুলে যেতে হবে যে আপনিই ইসলামোফোবিক হেইট স্পীচও দিয়েছিলেন। এই কঠিন আবদার গ্রাহ্য করা সহজ কাজ না।

আপনি যদি মোরাল হাউ গ্রাউন্ড দাবী করেন তাহলে আপনাকে কিছু ভ্যালুজকে বিনা শর্তে, সব সময়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সারা পৃথিবীর লিবারেল লেফট মোটা দাগের কয়েকটা বিষয়কে অনতিক্রম্য ধরে নেন। যেমন ধরুন যারা সমাজের একদম দুর্বল ও মার্জিনালাইজড অংশ তাদের পক্ষে দাড়ান, সব পক্ষের সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য উচ্চস্বর হন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভোকাল তো বটেই ক্ষেত্রবিশেষে অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার পরিচয়ও দেন, ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। বাংলাদেশে যারা নিজেদের লিবারেল দাবী করে ফ্রি স্পিরিটের চেতনায় পূণ্যস্নান করেন তাদের অনেকেই এই প্রতিটি শর্তের বরখেলাপ করেন হরহামেশা। বাংলাদেশে মাদ্রাসা ছাত্রদের মতো দুর্ভাগা জনগোষ্ঠী খুব বেশী নেই। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এদের হত্যা করলে তারা পুলক বোধ করেন। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করলে তারা তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। অনেকেই বলেন যে বাংলাদেশে ফাঁসি নিষিদ্ধ হয়ে যাক অসুবিধা নাই, কিন্তু সেটা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেয়ার পরে। বাংলাদেশে একটি সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক সরকার একটি হাস্যকর নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ার ধরে রাখলে তারা বলেন গণতন্ত্রের আগে উন্নয়ন প্রয়োজন।

এরকম স্ববিরোধিতা নিয়ে মোরাল হাইগ্রাউন্ড দাবী করাটা শুধুমাত্র হাস্যকর হলে আপত্তি ছিলো না – এটা বিপজ্জনকও বটে। তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ফেমিনিস্ট। তিনি যখন খালেদা জিয়ার ভ্রু আঁকা নিয়ে বিশ্রী ভাষায় কটাক্ষ করেন তখন “অনারীবাদী” পুরুষেরা একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন তোলেন যে এই একই কাজটা আমি করলে কুৎসিত শভিনিস্ট কিন্তু আপনি করলে ঠিক আছে কারণ আপনার ভ্যাজাইনা আছে আর আমার তা নেই। এবং এ জাতীয় কথাভাজা শেষ হয় সাধারণত একটি বাক্য দিয়ে, গুষ্টি মারি তোর এই ফেমিনিজমের। ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের যে কথাগুলো শোনা পুরুষদের জন্য ফরজ ছিলো সে কথাগুলো হারিয়ে যায় ফেমিনিস্টদের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এর জন্য।

আমাদের সমাজ যে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক কূপমোন্ডুকতায় বিপর্যস্ত সেটা কোনো খবর না। বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তা সত্যিই পারে আমাদের সমাজের চিন্তার মুক্তি ঘটাতে (চিন্তার মুক্তি মানে আপনাকে আঘাত করে কোনো প্রত্যাঘাতের ইমিউনিটি না)। সে নিরীখে আমাদের দেশে প্রয়োজন আছে মুক্তমনা’র মতো ব্লগের। কিন্তু সেই চেষ্টা মাঠে মারা যাবে যদি আপনি যাদের কাছে টানতে চান তাদেরকেই খোচানো শুরু করেন সবার আগে। তর্কে জেতাকে আপনি শিরোপা মনে করেন, তার জন্য ফ্রি-স্টাইল কুস্তিতে আপনার আগ্রহ। যাকে আপনি আপনার দলে নিতে চান তাকেই আপনি শত্রু বানাতে চান সবার আগে। অল্প বিদ্যা ও বেশী জজবার এটাই হোলো কুইনটেসেনশিয়াল লক্ষণ।

image-3

প্রশ্ন ওঠে যে যারা মুক্তচিন্তার পক্ষের মানুষ তারা মুসলমানদের নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যে – এমন কি ইসলামকে নিয়ে ন্যায্য সমালোচনা করলেও কি ধর্মীয় ফ্যানাটিকরা উন্মত্ত হয়ে উঠবে না? এমন কি হয় নি বাংলাদেশে? প্রশ্নটা ন্যায্য এবং এই প্রশ্নের সদুত্তর দেয়া প্রয়োজন। হ্যা, বাংলাদেশে ইসলামী ফ্যানাটিসিজম আছে এবং হ্যা, তারা বহু প্রয়োজনীয় সংস্কারেরও উৎকট প্রতিক্রিয়া দেখান। এ কথার বিরোধিতা হয় না।

এর একটা বড় কারণ সম্ভবত আপনি নিজে – সৎভাবে প্রশ্ন করুন। সম্ভবত মানুষ হিসেবে দাড়িটুপি ওয়ালারা আপনাকে কনফিডেন্সে নেয় না কারণ রাজাকারের প্রসঙ্গ আসলেই আপনি একটা দাড়িটুপি ওয়ালা ব্যক্তিকে খাড়া করান। এতিম বাচ্চাদের দেখভাল করার দায়িত্ব তো এতিমখানার না, রাষ্ট্রের – কিন্তু রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব পালনে বাধ্য তো আপনি করানই না বরং রাষ্ট্র এদের বিপক্ষে গেলে আপনি তালি দেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব যে মাদ্রাসাগুলো পালন করে চলেছে যুগের পর যুগ ধরে সেজন্য তাদের কোনোদিনও সামান্য ধন্যবাদ দেন নি। আপনি গণতন্ত্রের কথা বলেন কিন্তু একটি অবৈধ অত্যাচারী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করলে আপনি বলেন যে গণতন্ত্রের আগে উন্নয়ন প্রয়োজন। আপনি যদি একটু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন যে আসল সমস্যা এটা না যে আপনি তাদের মতোন না বরং আপনি নিজে যা দাবী করেন সেটা আপনি নন। এই দাড়িটুপিওয়ালাদের একটা বিশাল অংশ নোম চমস্কির বিশাল ফ্যান। কৈ, চমস্কির নাস্তিকতা আর বিজ্ঞানমনষ্কতা তো তার মুসলমানদের হিরো হওয়াতে কোনো সমস্যা হয়ে দাড়ায় নি। কারণ তার নাস্তিকতার চেয়েও বড় ব্যাপার হোলো তার উচ্চ নৈতিকতা ও সেই স্ট্যান্ডার্ড এর ওপর অবিচল আস্থা। তিনি প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে গিয়ে সত্যের পক্ষে দাড়ান। এই শক্তি যদি আপনার থাকতো, আপনার বন্ধুদের থাকতো তাহলে দাড়িটুপি ওয়ালারাও আপনার সাথে থাকতো।

একটা প্রশ্ন আপনার নিজেকে করা খুবই প্রয়োজন। আপনি নিজে কোন পক্ষের মানুষ? আপনার কার্যকলাপ কি ফ্যানাটিসিজম উস্কে দেয় না নিবারণ করে। যদি ফ্যানাটিসিজম উস্কে দেয় তাহলে তো আপনার লক্ষ্য অর্জিত হবে না। আপনার কি সত্যিই প্রয়োজন আছে আঘাত করার? কেন আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না যে যুক্তির নিজস্ব যে শক্তি সেটাই যথেষ্ট অন্ধবিশ্বাসকে মোকাবেলা করার। ডারউইনের তো প্রয়োজন হয় নি খোদাতালা নেই – এই দাবী করার। তার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট ছিলো বিবর্তনবাদ যে সত্য সেটা প্রমাণ করার জন্য।

যে কেও দশটা ইসলামিক ইতিহাসের বই পড়ে মুসলমানদের ইতিহাসের, তাদের সমাজের, তাদের রাজনীতির সমালোচনা করে একটা খাসা বই বাংলায় লিখে ফেলতে পারেন, কিংবা মুসলমানদের কিছু ঐতিহাসিক প্রিয় চরিত্রের সমালোচনা করতে পারেন। এর মধ্যে কোনো কেরদানি নাই, দুঃখিত। কঠিন কাজ হোলো আজকের সমস্যাকে আজকে মোকাবেলা করা, আজকের রসদ দিয়ে। এই দিক থেকে চিন্তা করলেই বুঝবেন যে আমাদের আসল সমস্যা ধর্মতাত্ত্বিক না। আমাদের দেশের মানুষেরা এখনও শিক্ষার অভাবে চিন্তা করতে শেখে নি। আপনি যদি বলতে থাকেন যে তুই ব্যাটা মুসলমান বলে চিন্তাই করতে পারোস না, তাহলে আপনার জিঘাংসা মিটবে একটু বটে কিন্তু সে তার নিজের কমফোর্ট জোনে আরো বেশী করে খাবি খাবে। তাকে আপনি আরো বেশী উগ্র হতে সাহায্য করবেন।

কিন্তু আপনি যদি তাকে বলেন যে আপনার মেটাফিজিকাল দুনিয়া নিয়ে আমার কোনো কথা নেই এবং সেটা নিয়ে আপনি আপনার মতো থাকেন। কিন্তু এই ফিজিকাল দুনিয়ায় বিজ্ঞান ছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা নেই তাহলে সে হয়তো আপনার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। যদি বলেন যে আপনার ধর্ম আপনি মনোযোগ দিয়ে পালন করুন কিন্তু আমার কথাটা শুনুন কারণ বিজ্ঞান আর যুক্তি ছাড়া এই পৃথিবীতে সফল হওয়া কঠিন তাহলে বলা যায় না সে একদিন হয়তো ধর্ম বিষয়েও আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। বিবর্তনবাদ খুবই প্রয়োজনীয় বিষয় এবং প্রত্যেকের সেটা বোঝা প্রয়োজন। আপনি নিজে বিবর্তনবাদের আধুনিক প্রসঙ্গগুলো বোঝেন না ঠিকমতোন কিন্তু অন্যকে বোঝাতে হবে আপনি এর ওস্তাদ। তাই বিবর্তনবাদকে এমনভাবে হাজির করেন যেন এর একমাত্র উপযোগিতা হোলো খোদাতালা যে নেই আর আদম-হাওয়া বলে কেউ আসে নি সেটা প্রমাণ করা। একবারও বোঝার চেষ্টা করেন না যে আপনি যদি বলতেন যে – খোদাতালা আছে কি নেই এ নিয়ে আপনি আপনার মতো করে সিদ্ধান্ত নেবেন কিন্তু এই হচ্ছে বিবর্তনবাদ – তাহলে আপনার শ্রোতা লাইফ সায়েন্সের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই তত্ত্বটিকে অন্তত মনোযোগ দিয়ে শুনতো। আপনি যদি তার ধর্ম বিশ্বাসের সাথে বিবর্তনবাদের বোঝাপড়ার দায়িত্ব তার ওপরেই ছেড়ে দিতেন তাহলে হয়তো সে অন্তত একটা সৎ চেষ্টা করতো বিবর্তনবাদ কী এটা জানার জন্য। সে হয়তো উপলব্ধি করতো যে পুরো লাইফ সায়েন্স দাড়িয়ে আছে বিবর্তনবাদের ওপর এবং এটা কোনো হাইপোথিসিস না, প্রমাণিত সত্য। এই গুরুত্বপূর্ণ মেসেজটা তাকে পৌঁছাতে না পারার পেছনে আপনি নিজে যে একটা বড় প্রতিবন্ধক সেটা আপনি স্বীকার করতে রাজি নন কারণ আপনার কাছে বিবর্তনবাদ হচ্ছে আপনার দার্শনিক অবস্থানকে বৈজ্ঞানিক অবস্থান বলে প্রমাণ করার একটা কৌশল মাত্র।

সম্ভবত আপনার বদ্ধমূল ধারণা যে মৌলবাদীদের “শেষ” করে দিতে হবে। তাদের পরাস্ত না করতে পারলে আপনার বিজ্ঞানমনষ্কতা সমাজে শেকড় গাড়বে না। এই যদি হয় আপনার সিদ্ধান্ত, বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনার কাণ্ডজ্ঞানের ঘাটতি আছে। নাহ, “তাদেরকে” আপনি শেষ করতে পারবেন না। কারণ তাদের একটা ক্রিটিকাল মাস আছে যেটা আপনাদের নেই। হ্যা বদলাতে আপনি পারবেন যদি আপনি নিজেকে বদলাতে সম্মত হন। যদি আপনি তার বিশ্বাসকে সম্মান করে সহবস্থানে রাজী হন তাহলে, যদি আপনি আপনার অটল নৈতিকতায় বিশ্বাস রেখে একটা হাত বাড়াতে সম্মত হন, তাহলে সেও আপনার বিজ্ঞানবাদ গ্রহণ করে উপকৃত হবে। বলা যায় না অনেকে আপনার মতো হওয়ারও চেষ্টা করতে পারে।

এজন্যেই কি আপনি লেখালিখি শুরু করেন নি?

ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে নেয়া কিন্তু ফোটোগ্রাফার করা খুঁজে বের করতে না পারায় কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা গেল না। মাফ করবেন।

এক্সিডেন্টাল জার্নালিস্ট

2

ফাহাম আব্দুস সালাম

এক
বড় মানুষদের, সফল মানুষদের শেষ বিচারে ভূমিকা আসলে একটাই: সেটা হোলো শিক্ষকের ভূমিকা। তারা মানুষকে শেখাতে চান – কেউ করে দেখান আর কেউ বা লেখেন (কিংবা বলেন)। শফিক রেহমানকে আমি কাছ থেকে দেখেছি গত পনের বছর। তার ভেতরকার সব থেকে বড় তাড়না আসলে একটাই : তিনি বাঙালিকে কিছু শেখাতে চান, জানাতে চান। পাঠকদের তিনি শিখিয়েছেন লিখে কিন্তু যারা সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত, যারা লেখালিখি করেন তাদেরকে শিখিয়েছেন সব থেকে বেশী – তিনি করে দেখিয়েছেন। এখন থেকে পনের বছর আগে বাংলাদেশে এমন পলিটিকাল কমেন্টেটর খুব বেশী ছিলো না যারা যায় যায় দিনে কলাম না লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

শিক্ষকের ভূমিকায় তিনি কি সফল হয়েছেন? জ্বী, আমার মতে হয়েছেন – সন্দেহ নেই তাতে। এর জন্য কি তাকে কোনো মূল্য হয়েছে? খুব চড়া মূল্য হয়েছে বলে আমার মনে হয়। নাহ, এরশাদের আমলে দেশছাড়া হওয়া কিংবা যায় যায় দিন হাতছাড়া হয়ে যাওয়া – এসবকে আমি চড়া মূল্য বলি না। বরং দেশছাড়া করে এরশাদ ব্যক্তি রেহমানের কিছু উপকারও করেছিলেন হয়তো।
218424_10150575383235578_1820514_o
তার স্বপ্ন ছিলো বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ একজন ফিকশন লেখক কিংবা ফিল্মের স্ক্রিপ্ট রাইটার হওয়া (এটা আমার ধারণা, তিনি আমাকে কখনো বলেন নি) – সেটা তিনি হতে পারেন নি। আমার মনে হয় না শফিক রেহমান কোনদিনও সাংবাদিক হওয়াটাকে তার জীবনের মূল লক্ষ্য বলে মনে করেছিলেন। তার কাছে এই লেখক হওয়ার জন্য একটা প্রয়োজনীয় অন্তর্বর্তীকালীন ভূমিকা ছিলো সাংবাদিকতা – তৃতীয় তলায় উঠতে হলে দ্বিতীয় তলা বাদ দেয়া যায় না যেমন। কিন্তু সাংবাদিকতার বৃত্ত থেকে তিনি আর বের হতে পারেন নি।

পারিপার্শ্বিকতা তার স্বপ্নের সাথে তাকে আপোষ করতে বাধ্য করেছিলো। এটাই তার জীবনের সবচাইতে চড়া মূল্য।

সত্যিই কি তিনি এই ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ফিকশন রাইটার হতে পারতেন? বলা মুশকিল কিন্তু আমার ধারণা তার পক্ষে সেটা সম্ভব ছিলো। আগ্রহী পাঠকরা পঞ্চাশের দশকে তার লেখা গল্প পড়ে দেখতে পারেন। হুমায়ুন আহমেদের আগে এরকম ঝরঝরে, নির্মেদ, টানটান বাংলা গদ্য খুব বেশী লেখক লিখতেন বলে মনে হয় না। তিনি একজন অনবদ্য স্টোরী টেলার – গল্প বলেই তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু পলিটিকাল কমেন্ট্রির গল্প তো আর সাহিত্যের গল্প না – গল্পকে ব্যাকড্রপের চেয়ে বেশী কিছু হিসেবে ট্রীট করার সুযোগ তার ছিলো না। প্রশ্ন হোলো রেহমান কেন চেষ্টা করলেন না সাহিত্য করার জন্য?

এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই লুকিয়ে আছে রেহমানের চরিত্রের সব থেকে উচ্চকিত বৈশিষ্ট্য। তার সব থেকে বড় যে শক্তি সেটা তার সব থেকে বড় দুর্বলতাও।

জীবনে তার মতো অফুরন্ত জীবনীশক্তিসম্পন্ন, উদ্দীপ্ত ও স্বাপ্নিক মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আশি বছর বয়সেও তিনি নতুন কিছু করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোন বিষয়ে তার আগ্রহ নেই? কিন্তু তিনি লিভ ইন দ্যা মোমেন্ট ঘরানার মানুষ – তার ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশানের চাহিদা আছে। নানান বিষয়ে তার যেমন আগ্রহ, সেই আগ্রহ তিনি হারিয়েও ফেলেন সহজে। প্রতিভা তার গল্প বলায় কিন্তু গল্পের বিস্তার আর বুনটের জন্য যে স্বভাব প্রয়োজন সেটা তার ছিলো না কোনোদিন; দু বছর ধরে গবেষণা করে তিন বছর ধরে উপন্যাস লেখার মানুষ তিনি নন। শফিক রেহমানের জীবনের সব থেকে বড় ট্র্যাজেডি: তার স্বভাব ও চরিত্র খুব বড় সাংবাদিক হওয়ার জন্য টেইলর-মেইড কিন্তু তার স্বপ্ন হোলো খুব বড় ফিকশন রাইটার হওয়া।

দুই:
আমি আগেও বলেছি, এখনো মত বদলাই নি – পলিটিকাল কমেন্ট্রি লেখার যে ক্রাফট (আমি টেকনিকের কথা বলছি, তার রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলছি না) সেই ক্রাফটে তিনি আজও অদ্বিতীয়। বাংলা ভাষায় কেউ তার মতোন চোখা পলিটিকাল কমেন্ট্রি লিখতে পারেন না। কেন? এর অনেকগুলো কারণ আছে, বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না – শুধু তার মূল প্রবণতা নিয়ে কিছু বলি। তিনি বাংলা ভাষাকে ইংরেজির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সত্যি বলতে কি, আমার মনে হয় যে তিনি ইংরেজিতে চিন্তা করেন আর বাংলায় তার অনুবাদ করেন।

তার এই প্রবণতাটাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজে লিবারাল সোসিওপলিটিকাল ভিউজ এর অনুরক্ত এবং এতো ছোটো কিন্তু জনবহুল দেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক আদর্শ আমাদের সবাইকে টিকিয়ে রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি না। কখনোই মনে করি না যে লিবারাল সোসিওপলিটিকাল ভিউজ অনুধাবন ও আত্মস্থ করার জন্য ইংরেজি ভাষা জানাটা আবশ্যক কিংবা একমাত্র উপায় – কিন্তু এটা সম্ভবত সব থেকে সহজ উপায়।

রেহমান এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করে চলেছেন আজীবন – তিনি বাংলা ভাষাভাষীদের পশ্চিমের সাথে মিলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি অবিরত পশ্চিমের জাইটগাইস্ট আমাদের পাঠকদের উপহার দিয়েছেন – তার লক্ষ্য পশ্চিমের সাথে আমাদের যে সহজাত দ্বন্দ্ব, সেটা যেন কমে আসে। বাংলাদেশ কি তার এই লক্ষ্যে সাড়া দিয়েছে?

না দেয় নি। ভিন্ন মতের জায়গা বাংলাদেশে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

তার পাঠকরা কি সাড়া দিয়েছে? বলা মুশকিল কিন্তু তার বহু পাঠককে আধুনিক মনস্ক ও সহনশীল হওয়ার জন্য সম্ভবত কিছুটা হলেও ইতিবাচক ভুমিকা রেখেছেন।

তিন:
একেবারেই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। বহু বছর ধরে তার পত্রিকায় কলাম লেখা আর মানুষ হিসেবে সাহচর্যের পরে লেখক হিসেবে আমার নিজের ওপর তার প্রভাব কী ? এর কোনো সহজ উত্তর নেই কারণ আমি কোনোদিন সচেতনভাবে তার মতো করে লেখার চেষ্টা করি নি। কিন্তু তিনি আমাকে (এবং সম্ভবত আরো বহু লেখককে) দুটো রাস্তা দেখিয়েছেন।

প্রথমত, ইংরেজি থেকে শব্দ ধার করার সংকোচ কাটাতে তিনি আমার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছেন। ছোটবেলা থেকেই আমার একটা প্রিয় কাজ হোলো বাংলা অভিধান ঘাটা। জানা শব্দের ভাণ্ডার তাই আমার একদম কম না কিন্তু ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে একদম অপ্রচলিত একটা তৎসম শব্দের চেয়ে প্রচলিত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা যে পাঠকের জন্য বেশী আরামদায়ক এই সাহসটা আমি পেয়েছি শফিক রেহমান থেকে।

তার দেখানো দ্বিতীয় রাস্তাটা খুবই প্রশস্ত, উঠেছেন অনেক লেখক।

বাংলাদেশের লেখকদের আবেগ অতিরিক্ত বেশী। কবিগানের ভনিতা ও ভক্তি আমরা পলিটিকাল কমেন্ট্রির মধ্যেও পারলে ঢেলে দিই। আমাদের এখনকার জনপ্রিয় গদ্য লেখকদের মধ্যে দুইজনকে আমার মনে হয়েছে ব্যতিক্রম – কেবল “বুদ্ধি দিয়েই” তারা লেখেন: ফরহাদ মজহার আর শফিক রেহমান (অজনপ্রিয় ও প্রয়াতদের যোগ করলে এই লিস্ট বেশ লম্বা হবে – সেখানে আহমেদ, আজাদ, ছফাসহ আরো অনেকে থাকবেন)। অন্যান্য কলামিস্টরা যেখানে ফিলার হিসাবে নিজের মতামত, মৃত মানুষের সাক্ষ্য আর “অশিক্ষিত পটুত্ব” জনিত তত্ত্ব কথা টেনে এনে খেই হারিয়ে ফেলেন – রেহমান সেখানে বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক আর ইনফরমেশনকে ফিলার হিসাবে হাজির করেন।

তিনি একটা রচনার স্ট্রাকচার খুব ভালো বোঝেন – সম্ভবত ভালো কলামিস্ট হওয়ার জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আপনাকে একটা গতি বজায় রাখতে হবে, একটা প্যারাগ্রাফে একটার বেশী আইডিয়া আনা যাবে না এবং দীর্ঘ প্যারাগ্রাফ লেখা কলামিস্টদের কাজ না, খুব লম্বা বাক্য ব্যবহার না করে ছোটো ছোটো বাক্যে ভাব প্রকাশ, শুরুর দু-তিনটা বাক্যের মধ্যে পুরো লেখা প্রসঙ্গে একটা পরিষ্কার ধারণা দিয়ে ধীরে ধীরে বিল্ড আপ এবং শেষে গিয়ে টেনশন রিলিজ – এই টেকনিকগুলো আমাদের কলামিস্টরা খুব ভালো বোঝেন বলে মনে হয় না। রেহমান এর সাথে যোগ করেন “বুদ্ধি” – তার থেকে যদি কেউ যদি শুধুমাত্র একটা বিষয় শিখতে চায়, সেটা হবে আমার মতে তার নো-ননসেন্স এপ্রোচ।

চার:
শফিক রেহমান সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত আছেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় ধরে, সম্ভবত অভিজ্ঞতার বিচারে তিনি বাংলাদেশের প্রবীণতম সাংবাদিক। তার যে ব্যাপারটা আমাকে সবচেয়ে বিস্মিত করে সেটা হোলো – এখনো তিনি সাংবাদিকতাকে ভালোবাসেন। পঞ্চাশ বছর ধরে কোনো কিছু – আবার বলছি – কোনো কিছুকেই ভালোবাসা আমার কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। সেজন্যেই তিনি আজো ক্ষুরধার, আজো প্রাসঙ্গিক।

খুব বেশী মানুষ সম্বন্ধে আমি একথা বলতে পারবো না কিন্তু রেহমান প্রসঙ্গে বলি – তার দীর্ঘায়ু হওয়াটা খুব জরুরী – আমাদের জন্য। তার কাছ থেকে আমার ও আমাদের শেখার আছে এখনো অনেক বাকী।

আমি তার সুস্থতা কামনা করি।

১৯শে জুন, ২০১৪

অপ্রমিত

ফাহাম আব্দুস সালাম

এক:

কিছুক্ষণের জন্য কল্পনা করুন যে আপনি ১৯১৪ সালের কোলকাতার তরুণ। খুব মেধাবী, বয়স ১৮।

আপনি পড়াশোনায় ভালো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হবেন। আপনার বাবা মাঝারি মাপের একজন জমিদার কিংবা জমিদারির সাথে সম্পৃক্ত। আপনি যে পড়াশোনায় ভালো এর মূল কারণ হোলো আপনার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যেটা পুরো বাংলার ৯০ ভাগ ১৮ বছর বয়স্কর নেই, আর সেটা হোলো অবসর – পড়ার জন্য।

পেশা বলতে আপনার আছে কেবল দুটো অপশন: ওকালতি আর বেশ্যাবৃত্তি (নীরদ চৌধুরী থেকে ধার করে একটু মশকরা করলাম, সেকালে “পেশা” শব্দটার যে মানে ছিলো এখন তার অনেকটুকুই পাল্টে গেছে )। যেহেতু আপনি মেধাবী, পরিবার শিক্ষিত, আমি ধারণা করছি আপনি ব্যারিস্টার হওয়াটাকে জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি বলে ধরে নিয়েছেন।

আপনি ১২ বছর পড়ালেখা করেছেন মূলত ইংরেজি মাধ্যমে, বিশ্ববিদ্যালয়েও ইংরেজিতেই পড়বেন, ওকালতি যে করবেন সেখানে দলিল দস্তাবেজের ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত ফার্সি মিশ্রিত বাংলা আছে যদিও (৮০ বছর আগে সরকারী কাজ কর্ম সব ফার্সিতেই হতো) কিন্তু উচ্চ আদালতে (যেখানে ব্যারিস্টারী পাশ করে আপনি ঢু মারবেন) ইংরেজি ছাড়া কোনো গতি নেই। মক্কেলের সাথে বাংলায় কথা বলা ছাড়া বাংলা ভাষার তেমন কোনো ব্যবহার নেই আপনার পেশায়।

তারপরও ভালো বাংলা জানার ব্যাপক ইনসেনটিভ আছে আপনার – সত্যিই ব্যাপক।

এলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কোনো অস্তিত্ব নেই। আজকের হিসাবে এন্টারটেইনমেন্ট বলতে আছে বইপত্র আর মাঝে মাঝে নাটক। গ্রামোফোন এসেছে মাত্র তের বছর – হিন্দুস্তানী গানের রেকর্ড করে প্রথম বিখ্যাত হয়েছেন গওহার জান মাত্র সাত-আট বছর আগে। যেহেতু তখনও গ্রামোফোন বেশ দামী এবং রেকর্ডের দামও মনে হয় কম না (গওহার জান প্রথম রেকর্ডিং এর জন্য পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৩০০০ রুপি – সোনার দাম দিয়ে এডজাস্ট করলে অন্তত ৬০ লক্ষ টাকা হবে এই মুহুর্তে) – গ্রামোফোন আপনার বাড়ীতে নাও থাকতে পারে। তওয়ায়েফ আপনার এফোর্ড করতে না পারারই কথা। যদিও সঞ্জয় দত্তের নানী জাদ্দান বাঈ (গুজব আছে এই মহিলা নাকি মতিলাল নেহেরুর প্রেমের সন্তান) এতোই বিখ্যাত যে ঢাকার মতো ছোটো শহরেও তার পোস্টার কিনতে পাওয়া যায় কিন্তু তওয়ায়েফ দের কোঠায় গিয়ে বিনোদিত হতে হলে অর্থবিত্ত ও প্রতিপত্তি লাগে – সেটা এখনও আপনার হয় নি। কাজেই সন্ধ্যা বেলায় বিনোদন বলতে হয় নানান ধরনের বই পড়া নয়তো এই বই নিয়েই আলোচনা করা, বন্ধুবান্ধবদের সাথে। বয়স আরেকটু বেশি হলে আপনি হয়তো প্রেমিকা পুষবেন কিন্তু সেটা এখনই না।

তখনও পার্টিসিপেটোরী এলেকশান শুরু হয় নি ভারতে, কাজেই পলিটিশিয়ানরা তখনও হাটে ঘাটে মাঠে চাড়া দিয়ে ওঠে নি। আপনি যদি কলকাতার who’s who নিয়ে একটু গবেষণা করেন দেখবেন যে হয় এরা জমিদারীর সাথে সম্পৃক্ত, নয়তো লেখালিখি, শিক্ষক, ডাক্তার আর উকিল। এবং এটা কিন্তু খুবই ছোটো একটা সার্কেল – খুব বেশী হলে দশ হাজার মানুষের সার্কেল। এমন কি মহাত্মা গান্ধীও মূখ্যত একজন লেখক (তার রচনাসমগ্র ৫০ হাজার পৃষ্টার)। আপনি যদি তখনকার কোলকাতার ওপিনিয়ন মেকার হতে চান, সমাজে যদি একটু গুরুত্ব আশা করেন এবং যদি অমরত্বের প্রতি আপনার একটু দুর্বলতা থেকে থাকে – সত্যি বলতে কি খুব ভালো বাংলা জানা ছাড়া আপনার তেমন কোনোই আর বিকল্প নেই (অন্তত জানতে হবে, না লিখলেও চলবে)। আপনি যদি পত্রিকায় লেখালিখি না করেন কিংবা পত্রিকা নিয়ে আলোচনা করতে না পারেন আপনার সাথে হরিদাস পালের খুব পার্থক্য নেই। সময়টা একটু অদ্ভুত – লেখক ও পণ্ডিতরা তখন সত্যিই রকস্টার। যারা আপনার চোখে গুরুত্বপূর্ণ – অর্থাৎ সমাজের ব্রাইট মাইন্ডস এর প্রায় সবাইই ভালো বাংলা জানেন।

ফাস্ট ফরোয়ার্ড টু ২০১৪।

আজকে ভালো বাংলা জানার যে প্রয়োজনীয়তা সেটা প্রায় শূণ্যতে নেমে এসেছে। ১৮ বছরের কোনো তরুণের যারা জীবিত হিরো তাদের প্রায় কেউই ভালো বাংলা জানেন না। আমার জানামতে এই ভাষার সর্বশেষ যে ব্যক্তিটি শুধুমাত্র লিখে জীবনধারণ করতেন সেই হুমায়ুন আহমেদও চলে গিয়েছেন। সাংবাদিক ছাড়া আমাদের এই দেশে এ মুহুর্তে সম্ভবত এমন একজনও নেই যিনি শুধুমাত্র লেখালিখি করে সম্মানজনক ভাবে বেঁচে আছেন।

ডিলেমাটা লক্ষ্য করুন। একশ বছর আগে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহরে পেশাগত ভাবে ইংরেজি জানা আবশ্যক হলেও সামাজিক গুরুত্ব পেতে হলে ভালো বাংলা না জানার তেমন কোনো উপায়ই ছিলো না। আর এখন বাংলা ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে ভালো বাংলা জানার তেমন কোনোই প্রয়োজনীয়তা নেই, বরং ভালো ইংরেজি জানলে আপনার সামাজিক ও পেশাগত – দু দিক দিয়েই পোয়াবারো।

যারা আপনার সময়ের ব্রাইট মাইন্ড তারা প্রায় সবাইই ভালো ইংরেজি শেখা নয়তো ব্যবহার করায় ব্যস্ত।

দুই:

মানুষ চিরকালই প্রয়োজনের কারণে ভাষা আয়ত্ত করেছে। এখানে দুটো প্রয়োজন আছে। একটা হোলো আনুভূমিক প্রসার অর্থাৎ একদম মৌলিক ভাব প্রকাশ – দোকানীর সাথে আলাপ, রিক্সাঅলার সাথে দরাদরি – এসব। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য যে বাংলা ভাষা শিক্ষা সেই প্রয়োজন আগামী দু- তিন শ বছরেও কমবে না – সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে আমরা নিরাপদ আছি। কিন্তু ভাষা শিক্ষার আরেকটা প্রয়োজন আছে যেটা হোলো উলম্ব প্রসার অর্থাৎ বিশেষায়িত যোগাযোগ। এই যেমন আমি এখন যে কাজটা করছি কিংবা আমি যদি আমার পেশা জীব বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালিখি করি বা শিক্ষকতা করি।

মনে রাখবেন ভাষার “উন্নতি” বলতে আমরা যা বুঝি সেটা কিন্তু বিশেষায়িত যোগাযোগের মধ্য দিয়েই শুরু হয়। দশম শতাব্দীতে হাসান ইবন আল হাইথাম বা আলহাজেন ক্যামেরা অবস্কিউরার প্রোটোটাইপ আবিষ্কার করলেন। মানে তিনি একটা বন্ধ ঘর বা চেম্বারে শুধু ছোট্ট একটা ফুটা দিয়ে আলো ঢুকতে দিলেন। ঐ ফুটার বিপরীত দেয়ালে উল্টা প্রতিবিম্ব তৈরী হোলো। আরবীতে চেম্বার কে কামারা বলে, ঠিক যেভাবে আমরা বাসার ঘরকে বলি কামরা। সেই কামারা ল্যাটিনদের হাত ধরে ইংরেজিতে এলো ক্যামেরা হিসেবে। এখন ক্যামেরা আর কোনো “বিশেষ” সায়েন্টিফিক টার্মিনোলজি না কিন্তু এককালে ছিলো। ঠিক তেমনি পাটনার শেখ দ্বীন মোহাম্মদ চাপানো (চাপ দেয়া) অর্থে হিন্দুস্তানী “চাপনা”র ইমপেরাটিভ ভার্ব চাম্পু শব্দটা ব্রিটেনে ব্যবহার করলেন ১৭৯০ এর দিকে। মানে ডলাডলি দিয়ে মালিশ। সেই চাম্পু বদলাতে বদলাতে হয়ে গেলো শ্যাম্পু। এখন সবাই শব্দটা ব্যবহার করে মূল শব্দটা না জেনে।

বাংলা ভাষাতেও এ ধরনের উদাহরণের শেষ নেই। প্রশ্ন হোলো প্রথম দিকে যিনি একটি ভাষায় অন্য একটি ভাষার শব্দ ব্যবহার করবেন তাকে যদি সেই ভাষাটা ব্যবহার করতেই না হয় তাহলে সেই ভাষায় নতুন এক্সপ্রেশান ঢুকবে কীভাবে? অন্যভাবে আপনি যদি আপনার ভাষার ব্রাইট মাইন্ডসকে আপনার ভাষা ব্যবহার করাতে না পারেন তাহলে আপনার ভাষার “উন্নতি” হবেটা কীভাবে?

তিন:

বাস্তবতা হোলো জীবিকার তাড়না হোক, পেশার কারণে হোক অথবা সামাজিক চাপ – গত বিশ-তিরিশ এই জাতির সবচেয়ে মেধাবী মানুষেরা ইংরেজি শিক্ষায় যতোটা মন দিয়েছেন, বাংলায় ততোটা দেন নি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা মূর্খতা, বাহাদুরী না। এই ট্রেন্ড যে আমার জীবদ্দশায় যে বদলাবে না সে নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য গবেষক হতে হয় না। বরং দিনে দিনে এটা বাড়বে। লিখে রাখুন – এখন থেকে তিরিশ বছর পর বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল সাহিত্যিক বাংলাদেশে বসেই ইংরেজিতে উপন্যাস লিখবেন এবং আপনি সেই উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ পড়বেন। বাংলা ভাষায় লেখালিখি করে সম্মানজনক ভাবে বেঁচে থাকা তো অনেক দূরের কথা – একজন ঔপন্যাসিক যে পরিমাণ খাটাখাটনি করে একটা ভালো উপন্যাস লিখবেন তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পাঠকই নেই বাংলাদেশে। তিরিশ বছর পরের মেধাবী ছেলেটি মনে করবে এর চেয়ে ভালো ইংরেজিতে লেখা কারণ সারা পৃথিবীতেই তার পাঠক আছে।

কিন্তু আমার আগ্রহ সাহিত্য না ঠিক। আমি আগেই দেখিয়েছি যে বাংলা ভাষায় বিশেষায়িত ভাব প্রকাশের সক্ষমতা সীমিত – ইংরেজির তুলনায়। এবং যেহেতু ভালো ইংরেজি শেখার পেশাগত ও সামাজিক সুবিধা মাত্রাতিরিক্ত বেশী (আপনি এমন কাওকে চেনেন যিনি খুব ভালো ইংরেজি জানেন কিন্তু খুব ভালো উপার্জন করেন না?) সেহেতু যারা এই জাতির ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন অর্থাৎ মেধাবী ও সফল পেশাজীবী তারা সবাই উমদা বাংলা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাবেন। বুঝতে হবে যে বাংলাদেশে সোশাল আপওয়ার্ড মোবিলিটির একটা বড় নিয়ামক হোলো ইংরেজি।

আমরা যদি এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই অর্থাৎ বাংলার প্রসার ও উন্নতি চাই তাহলে ইংরেজি শিক্ষার কারণে যে সামাজিক ও পেশাগত সুবিধার সিড়ি সৃষ্টি হয় সেটাকে ভাঙ্গতে হবে – ভাঙ্গতেই হবে।

কীভাবে ভাঙ্গা যাবে?

দুটো উপায় আছে। প্রথমটা হোলো কেউ ইংরেজি শিখতে পারবে না। আমরা সবাই শুধু বাংলা শিখবো এবং এই জাতির কেউ ইংরেজি জানবে না। আশা করি এই য়ুটোপিয়ান চিন্তার অসারতা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়টা হোলো আমরা সবাই বাই-লিঙ্গুয়াল হবো অর্থাৎ বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে ইংরেজি শিখতে হবে।

imgrok_60835

চার:

খেয়াল করুন এখন ইংরেজি শিক্ষা জনিত যে ফুটানি তার মূল কারণ হোলো অল্প কিছু মানুষ ভালো ইংরেজি জানেন এবং বাকীরা জানেন না। আমি মনে করি এই অল্প কিছু মানুষ অত্যন্ত অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন শুধুমাত্র একটা বিদেশী ভাষা জানার কারণে। যে কলোনিয়াল মেন্টালিটির সমালোচনায় রাত কাবার করি অনায়াসে তার কারণও হোলো এই অল্প কিছু মানুষের ইংরেজি-জানা জনিত সুযোগ সুবিধা। তারা একটি ভাষার সফল ব্যবহার করাটাকে এক বিশাল সক্ষমতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে – যেটা শুধু অন্যায্যই না, হাস্যকরও বটে। তবে এটাও ঠিক যে ভালো ইংরেজি জানলে আপনি দেশের বাইরে এমন সব সুযোগ-সুবিধার মুখোমুখি হবেন যেটা অন্য কোনোভাবেই সম্ভব না।

এই অবস্থার পরিবর্তন হবে শুধু তখনই যখন গ্রামের ছেলেটাও চোস্ত ইংরেজিতে যোগাযোগ করবে। আশ্চর্য হবেন না, আশি বছর আগে এই বড় বঙ্গেই ঘটনাটা অহরহ ঘটতো। তখনকার গ্রামের ছেলেটা গ্রামে থেকেই ভালো ইংরেজি শিখে, মেধার জোড়ে নিজের পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো। ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।

আমার যে থিসিস তার এতোটুকু সবাই মেনে নেন একটু ভাবনা চিন্তার পরে। মানতে পারেন না এর পরের অংশটুকু।

পাঁচ:

আমি আগে বিস্তারিত ভাবে প্রমিত বাংলার সমস্যার কথা লিখেছি। প্রমিত বাংলার বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের ভাণ্ডার বিপজ্জনক রকমের অপ্রতুল এবং এই বাংলার একটা পিউরিটান চরিত্র আছে। এই শুদ্ধবাদী মেজাজ শুধু ভাষা না আমাদের জীবনযাত্রাকেও ঘিরে ফেলে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। ধরা যাক আপনি পনের বছরের একজন কিশোরী এবং কথা বলছেন আপনার বাবার সাথে এমন একটি বিষয়ে যা নিয়ে কথা বলাটা একটু লজ্জাজনক – মনে করি আপনি আপনার যোনীপথ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান – হয়তো কোনো শারীরিক সমস্যার কথা। খেয়াল করুন যে সামাজিক ভাবে স্বীকৃত অযৌনাত্মক কোনো সভ্য টার্মিনোলজি নেই আপনার শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের। আপনি সম্ভবত আকারে ইঙ্গিতে ভাবটা প্রকাশ করবেন। আমি বলছি না যে শুধুমাত্র প্রমিত বাংলার কারণেই এই সংকোচ তৈরী হয়েছে – ধর্ম এবং আমাদের সামাজিক রক্ষনশীলতাও এর একটি বড় কারণ – মানছি। কিন্তু প্রমিত বাংলা এই সংকোচকে ধারণ করতে সহায়তা করে।

কীভাবে করে?

প্রমিত বাংলা শুদ্ধবাদী বলে সে নতুন শব্দকে এই ভাষায় ঢুকতে বাধা দেয়। ফলে সে ভাষার যে স্টেটাস কো সেটাকে ধরে রাখে। যেমন ধরুন পনেরো বছরের এই মেয়েটি যদি আপনার সন্তান না হয়ে বাসার কাজের মেয়ে হয়ে থাকে তাহলে সে সম্ভবত যোনীপথ বলতে পারবে না, এমন কি জেনিটাল বা ভ্যাজাইনা বলে যে মুখ রক্ষা করবে সে উপায়ও তার নেই। খুব সম্ভব (আমার ধারণা) তার জানা একমাত্র শব্দ এক্ষেত্রে হোলো ভোদা। এই শব্দটা হোলো ভদ্রলোকদের মাথায় এয়ারপোর্টে বসানো মেটাল ডিটেক্টরে ঘন্টা বাজার মতো। কোনো মেয়ে যদি ভুলেও শব্দটা উচ্চারণে জানায়, সাথে সাথে সে ইতর মানুষে পরিণত হবে। খেয়াল করুন যে বাংলা ভাষায় জঘন্য শব্দের অর্থ হচ্ছে ঘৃণিত বা গর্হিত। শব্দটা এসেছে জঘন থেকে যার মানে হোলো মেয়েদের শরীরের তলপেটের যে অংশটুকু সামনে থেকে দেখা যায় – অর্থাৎ গ্রোয়েন। জঘন ও জঘন্যের মাঝে যে যোগাযোগ সেই যোগাযোগই আপনাকে বুঝিয়ে দেয় এই ভাষার পিউরিটান চরিত্রের কথা।

আমার কাছে কোনো ডেটা নেই, এমন কি কোনো সায়েন্টিফিক রিজনিংও নেই, কিন্তু আমার ধারণা খুব ছোটো বয়সে যখন আপনার ব্রেইন হার্ড ওয়্যার হওয়া শুরু করে, যেহেতু সেটা আপনার প্রথম ভাষাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সেহেতু আপনি বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পৃথিবীকে দেখতে শুরু করেন – এবং আমার হাইপোথিসিস হোলো প্রমিত বাংলার এই রক্ষণশীলতা আপনার মানসিকতাকেও রক্ষণশীল করে তোলে (আবারও বলছি – এটা আমার অনুমান মাত্র)।

এছাড়াও খুব বড় সমস্যা আছে। প্রমিত বাংলা বা তার কাছাকাছি বাংলায় বাংলাদেশের শতকরা এক ভাগ কথা বলেন কি না আমার সন্দেহ আছে। ফলে আমরা আসলে দুটো বাংলা শিখি জীবনে। দুটো বাংলা শেখাকে আমি কোনো সমস্যা মনে করি না কিন্তু একটি বাংলার আপাত শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরবকে মেনে নেয়ার তীব্র আপত্তি আছে আমার। কারণ এই গৌরবে বাকবাকুম হয়েই প্রমিত বাংলা মৌলবাদী হয়ে উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে।

corjapod

ছয়

আমি বলতে চাইছি যে বাংলা ভাষার অপ্রতুলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে বড় অন্তরায় হোলো প্রমিত বাংলা নিজে। তাহলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি কোথায়?

আমি কোনো ভাষাবিদ নই, বাংলা ভাষার একজন সামান্য ব্যবহারকারী। আমি আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যবহার করছি মাত্র।

বাংলা ভাষাকে এমন একটা পর্যায়ে যেতে হবে যেখানে ভালো বাংলা জানা আর ভালো ইংরেজি জানা সমার্থক হয়ে উঠবে। এই ফ্লুয়িড অবস্থাটায় আপনি বাংলা ব্যবহার করবেন না ইংরেজি ব্যবহার করবেন সেটা হবে একটা ভাষিক সিদ্ধান্ত, সামাজিক গুরুত্বারোপের সিদ্ধান্ত না। কিছু লক্ষণ এখনই দেখা যাবে যদি আপনি দেখতে আগ্রহী হন। ব্লগস্ফেয়ারের বাংলায় যে পরিমাণ ইংরেজি শব্দ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সে পরিমাণ ইংরেজি আগে কখনোই ব্যবহৃত হয় নি। যারা ব্যবহার করছেন তারা কী ভেবে ব্যবহার করছেন একটু চিন্তা করুন। তারা মনে করছেন আমার এই লেখা যারা পড়ছেন তারা যদি মোটামুটি ইংরেজি না জানেন তাহলে আমার লেখা পুরাপুরি বুঝতে পারবেন না। অর্থাৎ মোটামুটি ইংরেজি না-জানামূলক যে সম্ভাব্য সমস্যা সেটাকে তিনি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করছেন। তার দৃষ্টিতে যে মোটেও ইংরেজি জানে না সে যদি তার লেখা নাই বা পড়ে, কোনো সমস্যা নেই।

এখন এই ধারণাটিকে খুব বড় পরিসরে পর্যালোচনা করুন।

আমি এমন একটা সময়কে কল্পনা করছি যখন প্রত্যেক লেখকই শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুমান করবেন যে আমার পাঠক ইংরেজি শব্দগুলো জানে। তখন আমাদের এমন কিছু কনভেনশনে আসতে হবে যে কী ধরনের প্রত্যয় যোগ করলে একটা ইংরেজি শব্দকে অনায়াসে বাংলা বলে চালানো যাবে, সেটা সবাই জানবে। যেমন ধরুন গুগল করো না বলে আমরা বলবো গুগলাও। আমাদের পদবাচ্য বা সিনট্যাক্স যেহেতু ইংরেজির আদলেই গড়া সেহেতু আমি মনে করি না এ ধরনের কনভেনশনে গ্রহীতার পক্ষে শব্দগুলো নেয়া খুব সমস্যাকর হবে।

কিন্তু বাংলা ভাষার এই স্ট্রাকচার ধারণ করতে হলে আমাদের কে অপ্রমিত বাংলার শরণাপন্ন হতে হবে। অর্থাৎ আবার জিগস ঘরানার বাংলা। আমি এই বাংলাকে সম্ভাবনাময় মনে করি ঠিক এ কারণে না যে অপ্রমিত বাংলা মাত্রই দুর্দান্ত চাছাছোলা বাংলা। কিন্তু এই বাংলা অভিভাবকত্বে জর্জরিত না, যে কেও যেভাবে ইচ্ছা দুমড়ে মুচড়ে ব্যবহার করতে পারছেন – যে কারণে অপ্রমিত বাংলার পক্ষে সম্ভব হবে বিশাল পরিবর্তনকে ধারণ করবার। যে কেউ যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করবে, এই স্বাধীনতার থেকেই একটা ভাষার উন্নতি – এই চেনা পথটা রুদ্ধ হয়েছে প্রমিত বাংলার অভিভাবকত্বে।

সাত

একদম শেষ কথা, বাস্তবতার কথা। আমাদের সবার আকাঙ্ক্ষা যে বাংলা ভাষা শক্তিশালী ও গৌরবময় হয়ে উঠবে। এই আকাঙ্ক্ষা সত্য হবে শুধুমাত্র – আরেকবার বলছি – শুধুমাত্র তখনই যখন এই দেশের সবচেয়ে মেধাবী মানুষেরা স্বচ্ছন্দে ভাষাটা ব্যবহার করবেন। অদূর ভবিষ্যতে আমি এমন কোনো সম্ভাবনা দেখি না যে এ দেশের সফল ও মেধাবী মানুষগুলোর পার্থিব উন্নতির জন্য বাংলা ভাষা জানাটা একটা প্রয়োজনীয় শর্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে ভালো ইংরেজি জানা আর ভালো বাংলা জানা বেশ কাছাকাছি পর্যায়ের সক্ষমতা সেক্ষত্রে আমরা আশা করতে পারি যে বাইলিঙ্গুয়াল হওয়ার সুবিধাটা তারা প্রয়োগ করবেন।

জিয়াউর রহমানের লেগাসি

1

Faham Abdus Salam

আপনি কী করতেন?
এক: 
২৫শে মার্চের রাতে পুরো চট্টগ্রাম এক ভয়ঙ্কর নগরী হয়ে গিয়েছিলো – কেওস, উৎকণ্ঠা আর প্রশ্নের শহর। কেও জানে না কী হবে এই জাতির? বেশীর ভাগের ধারণা শেষ করে দেবে আমাদের পাঞ্জাবীরা। সে রাতে আমি সেখানে থাকলে আমিও তাই মনে করতাম – সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক চারশ টাকার মেজর ঠিক সেভাবে চিন্তা করেন নি। সে রাতে তাকে কেউ জিজ্ঞেসও করে নি “কেমুন মেজর তুমি”। তিনি তার সিনিওর পাকিস্তানী অফিসার কমান্ডিং জানজুয়াকে হত্যা করেছিলেন আর বলেছিলেন – উই রিভোল্ট।

এই চারশ টাকার মেজরেরও কিন্তু একটা পরিবার ছিলো, ছোটো ছোটো দুটো ছেলে ছিলো, সন্তানের প্রতি মমতা আমার-আপনার চেয়ে তার হয়তো খুব কম ছিলো না। সেদিন তার জানা ছিলো না যে নয় মাসে আমরা স্বাধীন হবো। বরং তার মনেও উঁকি দিয়েছিলো শক্তিধর পাকিস্তান মিলিটারী বাঙালিদের শেষ করে দেবে। তিনি কিন্তু রাজনীতিবিদ ছিলেন না। ধরা পড়লে নির্ঘাৎ ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুবরণ।

একবার বুকে হাত দিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: আপনি কি রিভোল্ট করতেন? আজকে এই স্বাধীন বাংলাদেশের RAB এ টাকা নিয়ে মিলিটারী অফিসাররা মানুষ খুন করেন। একজনও কি উইসাল ব্লোয়ার হিসাবে বেরিয়ে এসেছে – একজনও কি বলেছে – আই রিভোল্ট?

দুই:

পৃথিবীর কোনো রাজনীতিবিদকে তার সময়টাকে মাথায় রেখে তার জুতায় নিজের পা ঢুকিয়ে চিন্তা না করলে আপনি তাকে অনুধাবন করতে পারবেন না। জিন্না, গান্ধী, বঙ্গবন্ধু এমন কি আমাদের পয়গম্বর – কাওকে আজকের পৃথিবীর মানদণ্ডে বিচার করলে আপনি কোনো সঠিক চিত্র খুঁজে পাবেন না।

প্রশ্ন আসলে একটাই: তার জায়গায় আমি হলে কী করতাম?

তিন:

জিয়াউর রহমানকে অনেকেই সমালোচনা করেন তিনি রাজাকারদের প্রতিষ্টিত করেছিলেন।

বাংলাদেশে অনেকেই এখন মনে করেন যে রাজাকাররা বোধহয় সেকালে য়ুনিফর্ম পরে ঘুড়ে বেড়াতেন এবং যারাই রাজাকার তারাই যুদ্ধাপরাধী। ব্যাপারটা এতো শাদাকালো ছিলো না। এবং এমন মনে করার কোনো কারণ নেই ৭১ এ রাজনৈতিক পাকিস্তান কনসেপ্টটাকে ধারণ করেছিলো মাইক্রোস্কোপিক একটা জনগোষ্ঠী। হ্যা – যুদ্ধাপরাধী মানের রাজাকার হয়তো নগন্য সংখ্যক ছিলো কিন্তু মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাস করা লোক নেহাৎ কম ছিলো না। তারপর ছিলো সেসময়ের পাকিস্তান রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণী। নাম করতে চাই না – সে সময়ের দলিল দস্তাবেজ একটু ঘেঁটে দেখবেন, কোন সব রথী মহারথীরা ৭১ সালে – হ্যা ৭১ সালেও পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন।

এই মানুষগুলো একটা বিশেষ সময়ের প্রোডাক্ট ছিলেন, তাদের যখন যৌবন তখন অনেকেই লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করেছিলেন, অনেকেই কলকাতার দাঙ্গা দেখেছিলেন – তাদের পলিটিকাল আইডিয়োলজিতে মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্যারামাউন্ট ছিলো। সময়ের প্রয়োজনে তারা তাদের আইডিয়োলজি বদলাতে পারেন নি। ৮০’র দশকে ছাত্রলীগের যে তরুণ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছিলো তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন যে আজকে জাপার সাথে লীগের আঁতাত তারা মেনে নিতে পেরেছেন কি না? আমরা বাঙালিরা আমাদের পলিটিকাল আইডিয়োলজি বদলাতে পারি না। আমাদের পলিটিকাল বিলিফ বেশীরভাগ সময়েই রিলিজিয়াস বিলিফের মতোই অনড়।

আপনি পারতেন?

তার মানে কিন্তু এই না যে পাকিস্তানে বিশ্বাস করা মানুষজন সব অপরাধী ছিলেন। আব্দুলাহ আবু সায়ীদ নিষ্ফলা মাঠের কৃষকে সে সময়ের ইংরেজির ব্রিলিয়ান্ট প্রফেসর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনকে নিয়ে আলোচনা করেছেন, সমালোচনা করেছেন বিস্তর – কিন্তু এটাও বলেছেন যে এরা ছিলো বিশ্বাসের শহীদ – তাদের বিশ্বাস ভুল ছিলো কিন্তু ব্যক্তি জীবনে উচ্চ আদর্শের মানুষ ছিলেন। আমাদের আজকের মতো চোর-ছ্যাচ্চর-গুণ্ডা ছিলেন না।

প্রশ্ন হোলো আপনি যদি দেশ প্রধান হতেন এবং যেকালে হারিকেন জ্বালিয়ে একটা গ্র্যাজুয়েট পাওয়া যেতো না সেকালে এই ভিন্ন বিশ্বাসের মেধাবী লোকগুলোকে জাতি গঠনের কাজে লাগাতেন কি না? জিয়াউর রহমান কিন্তু আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করা সদ্য প্রয়াত এ বি এম মুসাকেও প্রেস কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন। আমার আপনার জন্য আজকে এটা একটা ফিলোসফিকাল ডিসকাশন কিন্তু জিয়াউর রহমানের কিন্তু সেই লাক্সারী ছিলো না – তার জন্য সেটা ছিলো জাজমেন্ট কল। মনে রাখবেন, আজকাল যে মাপকাঠিতে রাজাকারিত্ব মাপা হয় সে মাপকাঠিতে মুনীর চৌধুরী ও তার ভাই কবীর চৌধুরীকে অনায়াসে রাজাকার বলা যায়। নিজেকে প্রশ্ন করুন কবীর চৌধুরীর মতো মেধাবী লোককে শুধুমাত্র বিশ্বাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের দেয়া কি ঠিক হতো?

আজকে আপনার প্রতিষ্ঠানে জামাতের লোক নেবেন না, বিএনপির লোক নেবেন না – এমন সিদ্ধান্ত নিয়েও হয়তো প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন কারণ যোগ্য লোকের কমতি থাকলেও চেষ্টা করলে খুঁজে বের করা সম্ভব। সত্তর এর দশকে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশটাতে সেটা সম্ভব ছিলো কি?

আর হ্যা – জিয়াউর রহমান কোনো দুর্নীতিবাজ কিংবা গুন্ডা-বদমাশদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কে? জিয়া কিংবা বঙ্গবন্ধুর চেয়েও হাসিনা অনেক বেশী একচ্ছত্র ক্ষমতা উপভোগ করেছেন। জিয়া যেমন চেরী পিক করে য়াং প্রফেশনালদের রাজনীতিতে এনেছিলেন সে সুযোগ হাসিনাও পেয়েছিলেন – তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন কি? তার নিজের দলেই জিয়া কোনো শামীম ওসমানকে ঠাই দিয়েছিলেন কি?

চার:

জিয়াউর রহমান বহু নিরপরাধ সামরিক কর্মকর্তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন।

একটু অন্যভাবে দেখা যাক।

আজকের ছাত্রলীগ কী ধরনের প্রতিষ্ঠান বোধ করি সেটা কাওকে বুঝিয়ে দেয়ার দরকার নেই। একবার চিন্তা করুন তো শেখ হাসিনা যদি সত্যিই ছাত্রলীগকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন তাহলে তাকে কী করতে হবে? প্রথমত খুন খারাবীতে জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা দিতে হবে, দ্বিতীয়ত ছাত্রলীগের হয়ে করা সব ধরনের অপরাধের কঠোর শাস্তি দিতে হবে এবং পুরা ছাত্রলীগের কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙ্গে নতুন করে সাজাতে হবে। সম্ভবত কট্টরতম লীগ সমর্থকও আমার সাথে এ ব্যাপারে একমত হবেন। এখন বলুন ছাত্রলীগের প্রত্যেকেই কি অপরাধী? প্রত্যেকেই কি সাজা পাওয়ার হকদার? কিন্তু ম্যাসিভ রিস্ট্রাকচারিং এ বহু নিরপরাধীকেও দণ্ডি দিতে হয়, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

মিলিটারীর যখন কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙ্গে যায় তখন কিন্তু বিপদ হয় ছাত্রলীগের চেয়েও হাজার গুণ বেশী কারণ তাদের কাছে অস্ত্র থাকে এবং সেটা ব্যবহার করতেও তারা সক্ষম।

৭৫ সালে যারা মিলিটারীতে চাকরি করেছেন তাদের একবার হলেও জিজ্ঞেস করে দেখুন জিয়া কী ইনহেরিট করেছিলেন। ইট ওয়াজ এ ব্লাডি মেস। একজন আর্মি অফিসারের সাথে দশজন আছেন বাস তিনি মনে করে বসলেন যে তার কু করা প্রয়োজন। আজকের দিনে যেমন DSLR থাকলে বানরও নিজেকে ফটোগ্রাফার মনে করে। এরকম অবস্থায় কমান্ড ফিরিয়ে আনার জন্য নির্মম হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো কি? মিলিটারীতে কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙ্গে পড়লে সুশীল উপায়ে ডিসিপ্লিন ফিরিয়ে আনার কোনো রাস্তা নেই, আপনাকে রুথলেস হতেই হবে। সেদিন এই কাজটা জিয়া না করলেও অন্য কাওকে ডার্টি জবটা করতে হতো, করতেই হতো। আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই, সেদিন যারা মিলিটারীতে চাকরি করতেন তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন – যে মিলিটারী নিয়ে আমরা আজকে গর্ব বোধ করি সেই কমান্ড-বেজড মিলিটারী জিয়াউর রহমানের রুথলেস এপ্রোচ ছাড়া সম্ভব হতো কি?

তিনি কি নির্ভুল ছিলেন? অবশ্যই না। ভুক্তভোগীরা বলবেন যে তিনি অপরাধ করেছিলেন। কিন্তু ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি না করলে মিলিটারীতে প্রাতিষ্ঠানিক ডিসিপ্লিনের বদলে ব্যক্তিগত ক্যারিজমা-ভিত্তিক যে কাল্ট গড়ে উঠছিলো বিপজ্জনক হারে সেটাকে প্রতিহত করার আর কী বিকল্প ছিলো? রিয়ালিস্টিকালি চিন্তা করে দেখুন। পৃথিবীর ইতিহাস ঘেঁটে বলুন কোন দেশে মিউটিনি গোছের বিশৃঙ্খলা শক্ত হাতে ক্রাশ না করে ফিরে এসেছে?

পাঁচ: 
জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় লেগাসি কী?

দুটো: প্রথমটা হলো তিনি এই জাতিকে য়ুনিফাই করার চেষ্টা করেছিলেন। বিভিন্ন ধারার রাজনীতির একটা স্পেস তিনি তৈরী করেছিলেন। এই কাজটা মিলিটারী ডিক্টেটররা কখনোই – আবারো বলছি – কখনোই করেন না। এজন্যে আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। হাসিনার মতো আদিম যুগের মানুষও যদি এই বহুধা বিভক্ত দেশকে “এক” করতে পারেন বিশ্বাস করুন আমি তার পিছে দাড়াবো, তাকেই আমার নেতা মানবো। আমি বঙ্গবন্ধুকেও বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখি কারণ তিনি এই কঠিন কাজটা করতে পেরেছিলেন। যদিও তিনি সেই একতা ধরে রাখতে পারেন নি তাও আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। বাঙালিকে একতাবদ্ধ করার চেষ্টা করা দুঃসহ কঠিন কাজ।

দ্বিতীয়টা বলছি। বাংলাদেশের যেকোনো নেতা – এই রিয়ালী মীন ইট – যে কোনো নেতার ভিডিও ফুটেজ লক্ষ্য করুন। দেখবেন যে তারা বক্তৃতা দিচ্ছেন। মাঠে ঘাটে জনসভায় টিভিতে বক্তৃতা দিচ্ছেন নয়তো তর্ক করছেন।

একমাত্র ব্যতিক্রম জিয়াউর রহমান। তার ভিডিও ফুটেজে দেখবেন যে তিনি দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছেন – গ্রামে গঞ্জে শহরে। হি ওয়াজ এ ডুআর। জিয়াউর রহমান সত্যিই ওয়াট এভার ওয়ার্কস এ বিশ্বাসী ছিলেন।

বাংলাদেশে এ ধরনের নেতা একেবারেই বিরল। আপনি যেই আদর্শের রাজনীতিই করুন না কেন এই লেগ্যাসি দুটো হয়তো কাজে দেবে।

শেকায়েতনামা

ইতিহাস এবং ইতিহাসের নাগরিক রোমন্থন মানে Public Remembrance এক জিনিস না। ভাষা আন্দোলন নিঃসন্দেহে আমাদের জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের একটা অন্যায় এবং আধিপত্যবাদী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে না; এবং ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আমাদের তৎকালীন খুবই ছোটো আরবান এডুকেটেড মিডল ক্লাসের যে গভীর আস্থা তার বিস্ফোরণ – এর সাথে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ত্বের কোনো সংযোগ নেই।

কিন্তু ষাট বছর ধরে আমরা ভাষা আন্দোলনকে যে ন্যারেটিভ সহকারে স্মরণ করেছি তা এক বিচিত্র প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। আদাবগুলো আমি লক্ষ্য করেছি গভীরভাবে।

ভাষার জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছি তাই আমাদের ভাষা সবার থেকে আলাদা অথবা শ্রেষ্ঠ। যেহেতু আমরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি সেহেতু আমাদের ভাষা মহান। এই মহান ভাষায় যারা কথা বলেন তারা সৌভাগ্যবান এবং তাদের একটা দায়িত্ব হোলো ভাষার “শুদ্ধতাকে” রক্ষা করা – নদীর মতোন করে। শুদ্ধ মাত্রই পবিত্র – বাঙালির মনে; তাই সে ভাষার ওপর পবিত্রতা আরোপ করে। খেয়াল করবেন যে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আমরা খালি পায়ে বেদীতে উঠি (কিন্তু ৭১ এর শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে সাভার স্মৃতি সৌধে খালি পায়ে যাওয়া আবশ্যক না) – পূণ্যভূমিকে মানুষ যেভাবে অবগাহন করে। যা কিছু আপনি পবিত্র বলে ধরে নেন তার প্রায় প্রতিটিই আপনাকে আশ্রয় দেয়, রক্ষা করে। Public Remembrance এর ভাষা আন্দোলনের সামনে দাঁড়ালে তাই আমরা এক বিশুদ্ধতা, এক পবিত্রতা, এক নিবেদন বোধ করি। আমাকে যদি “বাংলা ভাষা”কে একটা ছবি হিসেবে বর্ণনা করতে বলা হতো, আমি বলতাম – ২১শে ফেব্রুয়ারিতে “বাংলা ভাষা” হোলো মাইকেলএঞ্জেলোর সিস্টীন চ্যাপেলে আঁকা ফ্রেস্কো “The Creation of Adam” এর যে ঈশ্বরের মতন – যার সাদা লম্বা দাড়ি আছে (পিতৃবৎ), যে মহানুভব ও রক্ষাকারী, যে একটু উঁচুতে থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এডামের দিকে।

আমি মনে করি এ ধরনের অনুভব ও আচার বাংলা ভাষার বিন্দুমাত্র উপকার করে নি বরং ক্ষেত্রবিশেষে ভাষা আন্দোলনের যে Public Remembrance তা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Image

ভাষা কোনো “পবিত্র” বিষয় না এবং ভাষার দূষণ বলে যে ধারণা আমাদের মাথায় চেপে ধরে বার্ষিক একবার, সেটা এক আজগুবি ধারণা। ভাষা একান্তই – আরেকবার বলবো – একান্তই “অপবিত্র” জিনিস – ব্যাঙ্ক নোট যে অর্থে অপবিত্র, সে অর্থে। কোনো ভাষার উৎকর্ষের জন্য এমন “অপবিত্র” হয়ে থাকতে পারাটা খুবই খুবই জরুরী।

আমরা প্রায়ই অনুযোগ করি যে আমাদের “একটা” মান ভাষা থাকা আবশ্যক যেটা সবাই বুঝবে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে একটা ভাষার নিজের মধ্যে অনেক গুলো মানভাষা থাকে। একটা সায়েন্টিফিক পেপারের ইংরেজি, সাহিত্যের ইংরেজি আর, আইনী রায় লেখার ইংরেজির মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে সেটাও আমরা ভুলে যাই। ধরা যাক আপনি একটি পরীক্ষায় কোনো একটা স্টেজে বরফের মধ্যে একটা প্লেটে কিছু cell মানে কোষ আধা ঘন্টা ইনকিউবেট করছেন। সাহিত্যের ইংরেজিতে cells were incubated in ice বললে কোনো ভুল হবে না কিন্তু সায়েন্টিফিক ইংরেজিতে আপনাকে বলতেই হবে যে cells were incubated on ice কারণ আপনার প্লেটটা ছিলো বরফের স্তুপের ওপরে, মধ্যে না।

এটা একটা অ-তি সাধারণ উদাহরণ কিন্তু এর একটা তাৎপর্য আছে। বাংলায় যেটাকে আমরা মান ভাষা বলি সেটা সাহিত্য করার জন্যে, কিংবা সাধারণ ভাব আদান-প্রদানের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ভাষার ব্যবহার মানে তো শুধু গল্প-উপন্যাস লেখা না, আপনাকে খুবই বিশেষায়িত যোগাযোগও করতে হবে। মনে রাখবেন যখনই আপনি বিশেষায়িত যোগাযোগ করবেন তখনই দুটো ঘটনা ঘটবে। এক: আপনি অনেক বেশি বিশেষ্য ও ক্রিয়া পদ ব্যবহার করা শুরু করবেন এবং দুই: যে বিশেষ্য ও ক্রিয়া পদ আপনি ব্যবহার করা শুরু করবেন সেগুলোর অর্থের স্পেকট্রাম খুবই নির্দিষ্ট।

উদাহরণ দেই: ধরা যাক আপনি একজন ফ্যাশন ডিজাইনার, কথা বলছেন আরেকজন ফ্যাশন ডিজাইনারের সাথে। আপনি ঝগড়া করছেন রীতিমতন, যে না এই ড্রেসটা ফ্রেঞ্চ ব্লু দিয়ে বানালে হবে না, বানাতে হবে কর্নফ্লাওয়ার ব্লু দিয়ে (দুটোই নীল রঙের শেড)। এবং আপনার জুনিওরকে বকা দিচ্ছেন – I told you to press the trouser not to iron it. সাধারণ মানুষের কাছে ফ্রেঞ্চ ব্লু আর কর্নফ্লাওয়ার ব্লু’র মাঝে কোনোই পার্থক্য নেই কিন্তু একজন ডিজাইনারের কাছে পার্থক্যটা রাত-দিন। ঠিক তেমনি ভাবে press the trouser মানে হোলো ইস্ত্রী গরম করে প্যান্টের ওপর একজায়গায় বসাবেন, চাপ দেবেন তারপর উঠিয়ে ফেলে আরেক জায়গায় বসাবেন, ইস্ত্রী ঘষে ঘষে আরেক জায়গায় নেবেন না (একটা চাদর ইস্ত্রী করতে হলে যেমন একবার ইস্ত্রী বসিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব জায়গায় নিয়ে যান)।

লক্ষ্য করুন যে ইংরেজিতেও সাধারণ একজন মানুষের কাছে press the trouser এবং iron the trouser – এই যে দুটো এক্সপ্রেশান এর মাঝে ক্রিয়াপদের ব্যবহারের কোনো ফারাক নেই। কিন্তু ইস্ত্রী করা যার পেশা সে এই বিশেষায়িত ক্রিয়া পদের সীমানাটা বুঝতে পারে।

প্রশ্ন হোলো, এই ধরনের বিশেষায়িত ভাষিক যোগাযোগের কোনো সুযোগ প্রমিত বাংলা ভাষা মানে যে ভাষায় জ্ঞানী-গুণী জনরা লেখালিখি করেন সে ভাষার আছে কি না?

আমার উত্তর হোলো নেই। আমি এই আয়োজনে প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করবো যে প্রমিত বাংলা ভাব-প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা খুবই আটোসাটো মাধ্যম যার বিবর্তিত হওয়ার সক্ষমতা খুব কম। এরপর আমার থিসিস হোলো যে ভাষাটাকে প্রমিত বাংলার দূষণকারী বলা হচ্ছে, অর্থাৎ অপ্রমিত বাংলা, যেটাকে ব্রাত্য রাইসু কিংবা আবার জিগস ঘরানার বাংলা বলে নাক সিটকানো হয় সেই বাংলাকেই আমি মনে করি সম্ভাবনাময় বাংলা। আমি এও মনে করি যে এই ছোটোলোকের বাংলাই কেবল পারবে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটাতে এবং এ কাজটি করতে হলে প্রয়োজন হবে আমাদের শিক্ষার মাধ্যমকে ইংরেজি করা।

আপনার মনে হতে পারে যে আমি অনেক গুলো আজগুবি এবং স্ববিরোধী কথা বলছি। একটু অপেক্ষা করুন, হয়তো আমি আপনার মনে কিছু প্রশ্ন জাগাতে পারবো।

আমি “বাংলা মাধ্যম পর্ব” বলতে এই লেখায় বোঝাচ্ছি ৭০ পরবর্তী বাংলাদেশকে যখন স্কুলের ল্যাংগুয়েজ অফ ইন্সট্রাকশান ইংরেজি থেকে বদলে বাংলা করা হয়। এই পর্বের দুজন বিখ্যাত বাংলা ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হুমায়ুন আহমেদ। প্রথম জনকে বেশীরভাগ পাঠক মনে করেন যে সিরিয়াস লেখক এবং দ্বিতীয় জন জনপ্রিয় লেখক। আমি এ দুজনের যে কোনো দুটো উপন্যাস নিয়ে প্রথম দশ হাজার শব্দের মধ্যে শুধুমাত্র ক্রিয়াপদগুলোকে দাগ দেয়ার অনুরোধ করবো এবং সমসাময়িক ইংরেজি ভাষার দুজন লেখক সালমান রুশদী এবং জেফরি আর্চারের যে কোনো দুটো বই নিয়ে একই কাজ করার অনুরোধ করবো। তারপর বাংলা ও ইংরেজির ক্রিয়াপদ নিয়ে একটু তুলনা করুন।

আপনি দুটো জিনিস দেখতে পাবেন। সম্ভবত উক্ত দুই বাংলা লেখকের বই এ আপনি এমন একটা ক্রিয়াপদও পাবেন না যেটা রবীন্দ্রনাথ পড়লে বুঝতেন না কিংবা রবীন্দ্রনাথের সময়ে ব্যবহার করা ক্রিয়াপদটার মানে এখন এতোটাই বদলে গেছে যে তিনি এই মুহুর্তে পড়লে তার পাঠোদ্ধার করতে পারতেন না। শুধু তাই না আধুনিক জীবন যাপন জনিত কিছু শব্দ ছাড়া (যেমন কম্পিউটার, ফ্যাক্স ইত্যাদি) রবীন্দ্রনাথ প্রায় পুরো বইই সঠিক অর্থে বুঝতে পারতেন। দ্বিতীয় যে জিনিসটি আপনি লক্ষ্য করবেন সেটা হোলো একটা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা লেখায় ক্রিয়াপদের অপ্রতুলতা। প্রমিত বাংলা ক্রিয়াপদের জগৎটা একটা খাটি অচলায়তন। ইংরেজি ভাষায় নিত্য নতুন ক্রিয়াপদ ঢুকছে কিংবা প্রচলিত ক্রিয়াপদের মানে বদলে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে কারণ আমাদের জীবন-যাপন বদলে যাচ্ছে।

উদাহরণ দেবো? Sexting, Xeroxed, Hoovered, trending, skateboarding, tweeting, speed-dating এই ক্রিয়াপদগুলো একেবারেই নতুন। Phrasal Verb ও বদলে যাচ্ছে দ্রুত। বিশ বছর আগে bump off শব্দদ্বয়ের কেবল একটাই মানে ছিলো – কাওকে মেরে ফেলার একটা ইনফরমাল এক্সপ্রেশান। কিন্তু এখন কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের সাথে যোগাযোগ হুট করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে bump off বলা হয়। ইংরেজি phrase এর ক্ষেত্রে যেহেতু কিছু অলিখিত সূত্র আছে সেগুলো ধরে অহরহই নতুন ক্রিয়াপদ তৈরী হয়। যেমন ধরুন dumb down বলতে বোঝানো হয় – ভোদাইদের জন্য আমি এই কঠিন ব্যাপারটা সহজ করে প্রকাশ করলাম। এটা পুরনো এক্সপ্রেশান কিন্তু এখন dumb up ও ব্যবহার হচ্ছে। এর মানে হোলো সাধারণ একটা জিনিসকে খুব ইন্টেলেকচুয়াল ভাব দেখানো – খেলনা প্লেনকে ড্রোন প্রমাণ করে বিশাল একটা লেখা লিখতে হলে যে কাজটা আপনাকে করতে হবে। তেমনি ভাবে তৈরী হয়েছে sex up বা sex down।

খেয়াল করুন যে আধুনিক জীবনে আমরা এমন শত শত কাজ করছি যেগুলো ৫০ বছর আগেও কল্পনা করা যেতো না এবং সেগুলো প্রকাশের কোনো যুতসই শব্দ আপনার কাছে নেই। পোলাপান যে “গো আউট”, “ডেটিং”, “ফাকায়” শব্দগুলোকে ক্রিয়াপদ হিসেবে ব্যবহার করে এর যথার্থ কারণও আছে। বাংলা ভাষায় আধুনিক জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ শব্দভাণ্ডার নেই।
গরু আপনি জবাই (Slaughter/Butcher) করেন ঠিক আছে কিন্তু আমি যে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য ইদুর “ব্যবহার” করে মেরে ফেলছি যেটাকে ইংরেজিতে অপরাধ বোধ কমানোর জন্য বলা হচ্ছে culling কিংবা একদিন ইদুরের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলেছিলাম ভুল করে – যেটাকে বলা হয় sever বা decapitulation সেটাকে বাংলায় কীভাবে প্রকাশ করবেন? আমি তো আর ইদুর “হত্যা” করি না, কিংবা এমন স্যাডিস্টও নই যে ইদুর “মেরেই” আমার সুখ।

অনেকেই মনে করেন যে “ল্যাবে ইদুর মারি” বললেই শ্রোতা বুঝে নেবে যে পরীক্ষার জন্য ইদুর ব্যবহার করে মেরে তারপর ফেলে দেয়া হচ্ছে। ঠিক আছে। ইদুরের ক্ষেত্রে হয়ত আপনি সঠিক অর্থই গ্রহণ করতেন কিন্তু যদি আমি ল্যাবে “গরু মারতাম” তাহলে কিন্তু “মারা” দিয়ে আরো অনেক মানে বের করা যেতো।

এই সমস্যা শুধু ক্রিয়াপদ নিয়ে না, বিশেষ্য নিয়েও। আমি একটা বিজ্ঞানসম্মত (কিন্তু বৈজ্ঞানিক বলা যাবে না আপাতত) পরীক্ষার কথা চিন্তা করেছি। সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হোলো “কন্ট্রোল”। আমাদের তাই প্রয়োজন এমন বস্তু (বিশেষ্য) যেটাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ইন্টারপ্রেট করার সুযোগ আছে। আবার এমন জিনিস দিলেও হবে না যেটা সবার বোঝার কথা না। আপনি গাড়ী হিসেবে Jaguar XJ দেখিয়ে যদি জিজ্ঞেস করেন যে এটা কি – সবাই উত্তর দিতে পারবে না – পারার কথাও না।

সবার বোঝার কথা – অন্তত দেখার কথা এমন একটা বিষয় হতে পারে “রং” ও তার নাম। যেহেতু আমরা সবাই এই রংগুলোর মুখোমুখি হই অহরহ সেহেতু কেউ বলতে পারবেন না যে আমি তো এই বিশেষ্যর সাথে পরিচিত নই। (আগে ভাগেই বলে নি এটা সঠিক অর্থে সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টেশান না) আমি নীচে মোট ৬টা কালার সোয়াচ দিয়েছি এবং রংগুলোর নামও দেয়া আছে। আপনি কাউকে এই ৬টি রং দেখাবেন (অবশ্যই রঙের নামগুলো দেখাবেন না) কিন্তু একসাথে একটির বেশী রং দেখাবেন না এবং এই ৬টি রঙের মধ্যে আপনার ইচ্ছে মতন আরো কয়েকটি কালার সোয়াচ ঢুকিয়ে দেবেন (পর পর দেখালে ক্লু পেয়ে যাবে)। শুধু লক্ষ্য রাখবেন এই ৬টা রঙের নাম পরীক্ষার্থী কি বলছে?

Image

আমার অভিজ্ঞতা কী বলি। বেশীরভাগ মানুষ না বলে দিলে রঙের নাম ইংরেজিতে বলা শুরু করে। বাংলায় অনেকেই য়েলো অকার ও ক্রোম য়েলো দুটোকেই হলুদ বলেন। যদিও য়েলো অকারকে অন্তত বাদামী বলা যায়। বার্ন্ট সিয়েনাকে খয়েরী বলা যায় কিন্তু অনেকেই বলেন লাল। আবার যারা বার্ন্ট সিয়েনাকে লাল বলেন মাঝখানে আরো কয়েকটা রং দেখিয়ে মনোযোগ নষ্ট করলে ভার্মিলিয়নকেও লালই বলেন। বাংলায় বললে প্রায় সবাইই শেষ দুটো রংকে বেগুনী বলেন (হালকা আর গাঢ় বেগুনী) .

একটু খেয়াল করুন পাঠক এই রংগুলোর একদম পারফেক্ট নাম আর্টিস্ট ও ডিজাইনার ছাড়া প্রায় কেউই বলতে পারবেন না, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি বেছে বেছে এমন রং নিয়েছি যেগুলো মোটামুটি সবাইই বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন শুধুমাত্র লাইলাক ছাড়া। বাদামী, হলুদ, খয়েরী, কমলা/লাল, লাইলাক/ল্যাভেন্ডার/মভ ও বেগুনি। অন্তত ৫টা রঙের নাম কিন্তু চলনসই ভাবে বাংলা দিয়েই বলা যায় কিন্তু অনেকেই বার্ন্ট সিয়েনা ও ভার্মিলিয়ন দুটোকেই লাল বলেন এবং লাইলাক ও ভায়োলেট দুটোকেই বেগুনী বলেন।

এর কারণ কি?

এর অনেক ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে। রং নিয়ে খুব সফিস্টিকেটেড পরীক্ষা হয় যেগুলো আমার আয়ত্তের বাইরে। তাছাড়া এটাকে পরীক্ষা না বলে পর্যবেক্ষণ বলাটাই শ্রেয় – আমি অল্প কয়েকজনকে নিয়ে পর্যবেক্ষণটা চালিয়েছি। কিন্তু কয়েকটা প্যাটার্ন আমরা ধরতে পারি এবং হয়তো কিছু এডুকেটেড গেস করলে অপরাধ হবে না। যে ব্যক্তি খয়েরীকে লাল বলছেন তিনি কিন্তু দেখছেন খয়েরীই কিন্তু বলছেন লাল কেননা তিনি রংটাকে প্রকাশ করার সময়ে মনে করছেন যে লাল রঙের ব্যাপ্তি এতোটাই বড় যে খয়েরীকে লাল বললে অসুবিধা নাই (এটা আমার ব্যাখ্যা)। তার মাথায় একেকটা বিশেষ্যর ব্যাপ্তি এতোটাই বড় যে আরেকটা বিশেষ্যর সাথে ওভারল্যাপ করাটাকে তিনি “ভুল” মনে করেন না। হোমারের ইলিয়াড রচনার সময়ে গ্রীক ভাষায় “নীল” রঙের সমার্থক কোনো শব্দ ছিলো না (কিংবা এখনো গ্রীক ভাষায় Bush এর সমার্থক শব্দ নেই যেহেতু গ্রীসে ঝোপঝাড় হয় না)। সে হিসেবে লাইলাক রঙটা বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য “অপরিচিত” হতে পারে কিন্তু বাকী রংগুলোর নাম কিন্তু বাংলায় আছে। তাহলেও কেন সে একই নাম দিয়ে দুটো ভিন্ন রং প্রকাশ করে?

আমার কাছে মনে হয় বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার যেহেতু সীমিত সেহেতু বাংলা ভাষাভাষীরা ছোটোবেলা থেকেই একই শব্দ দিয়ে অনেকগুলো অর্থ বোঝানোর একটা বিদ্যা আয়ত্ত করে। এই কাজটা আমরা করি নিজের অজান্তেই। যার ফলে বাংলা ভাষার শব্দের পরিধি ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এই “কাজ চালানোর” একটা বিশাল সমস্যা আছে। বাংলা শব্দবিশারদ কলিম খান দেখিয়েছেন যে শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বঙ্গীয় শব্দকোষ” অনুসারে “তীর্থ” শব্দটির মোট ৪২ টি অর্থ করা যায় মধ্যে যোনি, নারী, রতিস্থান/ক্রীড়াস্থান, পাত্র/সৎপাত্র, আগুন, খেয়াঘাট এমন কি মন্ত্রীও আছে। আমি বলছি না, এমন কি সুপারিশও করছি না যে একটা শব্দের কেবল একটাই মানে থাকা উচিত (সেটা ভাষার দীনতা) কিন্তু তাই বলে ……….. কোথায় আগুন, কোথায় যোনি (তামাশাটা দেখুন – এটাও বাঙালির তীর্থ) আর কোথায় মন্ত্রী? মানেগুলো কি একটার সাথে আরেকটা মেলে কিংবা এগুলো কি কাছাকাছি শব্দ?

লেখক যে অর্থে তীর্থ শব্দটি ব্যবহার করছেন পাঠক সে অর্থে শব্দটি গ্রহণ করবেন কি না – এর কোনো নিশ্চয়তা আছে কি?

এটা আমাদের ব্যবহারিক বাংলারও একটা মূল সমস্যা। আমাদের কলহপ্রিয়তার একটা মূল কারণ আমার কাছে মনে হয় বাংলা শব্দার্থের স্পেকট্রাম খুব বড় হওয়া। আমি বহু ঝগড়া প্রত্যক্ষ করেছি যেখানে এক পক্ষ যে অর্থে ভাব প্রকাশ করছে গ্রহীতা সে অর্থে ভাবটা নিচ্ছে না, কারণ গ্রহীতার পক্ষে শব্দটার ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করার সুযোগ আছে। সংসদে চুদুর বুদুর শব্দদ্বয়ের ব্যবহার নিয়ে যে বিরাট ঝগড়া হয়েছিলো বছর খানেক আগে তার মূল কারণও এটি। কেউই জানে না এই শব্দের সীমানা আসলে কোথায় শেষ হয়? যেহেতু শব্দদ্বয় শুরুর দু-অক্ষর চ এবং দ ধ্বনি তাত্ত্বিক ভাবে “চোদা” শব্দের কাছাকাছি সেহেতু গ্রহীতা না জেনে ধরেই নিয়েছিলেন যে শব্দটি অশ্লীল।

এই আলোচনা আমি অনেকের সাথেই করেছি এবং একটি প্রসঙ্গ বারবারই এসেছে। অনেকেই মনে করেন যে কথোপকথনের ভাষা আর লেখার ভাষা ঠিক এক না। লেখার ভাষায় বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের অভাব থাকলেও বলার ভাষায় – অনেকেই মনে করেন যে পার্থক্য খুব বেশী নেই। আমি তা মনে করি না বরং আমার ধারণা বলার ভাষায় আমাদের শব্দভাণ্ডার আরো কম। আমার এই ধারণা সঠিক কি না তার জন্য একটা পরীক্ষার আয়োজন করি।

আমার বিচারে টেলিভিশন ইতিহাসে বাংলা ভাষায় লেখা শ্রেষ্ঠ সিরিয়াল হোলো বহুব্রীহি আর ইংরেজি ভাষায় Twin Peaks (এবং দ্বিতীয় সেরা হোলো Breaking Bad)। আমার রুচির সাথে আপনারটা মিলবে না জানি – প্রয়োজনও নেই – কিন্তু এই তিনটি সিরিয়ালই যে সুলিখিত সে কথা অন্তত কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। আমার কৌতুহল মেটানোর জন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে বহুব্রীহির একটি পর্ব (প্রথম পর্ব) এবং Breaking Bad এর একটি পর্ব (3rd Season, 1st episode) নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করি। আমার আগ্রহ বাংলা এবং ইংরেজি দু ভাষায় মোটামুটি ৪৫ মিনিটের লিখিত ও এডিটেড কথোপকথনে মোট কতোগুলো Unique Verb বা অনন্য ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হচ্ছে।

প্রথমে আমি দুই ভাষার দুটো পর্বে সর্বমোট কতগুলো শব্দ উচ্চারিত হয়েছিলো সেটা গুনেছি। বহুব্রীহি ৫২ মিনিটের প্রথম পর্বে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে মোট ৪৯২১টি। অন্যদিকে Breaking Bad, 3rd Season, 1st episod এর ৪৭ মিনিটে সর্বমোট ৩৫৭৩টি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। এরপরে আমি দেখেছি উভয় মাধ্যমে মোট কতগুলো Unique Verb ব্যবহৃত হয়েছে? ইংরেজিতে Auxiliary Verb আমি গুনি নি এবং একই Verb এর কর্তা ও কাল ভেদের পার্থক্যকে আমি একটাই গুণেছি, আলাদা করি নি। অর্থাৎ Unique Verb এর বিচারে I eat, He eats, Pinkman ate, Saul was eating – এই চার প্রকাশে কেবল একটাই মূল ক্রিয়াপদ আছে – আর সেটা হোলো eat । ৩৫৭৩টি শব্দের মধ্যে যতোবার যেভাবেই eat শব্দটি আসুক আমি গুনেছি কেবল একবারই, একটা Unique Verb হিসেবে।

ঠিক এমনিভাবে বাংলাতেও আমি পারি, সে পারে, রহিম পারছে, ফাহামবাগই পেরেছিলেন – এই চারটি বাক্যে আমি একটি মূল ক্রিয়াপদের চারটি ভিন্ন রূপ দেখেছি মাত্র। তাই গোনার সময়ে আমি গুনেছি একটি ক্রিয়াপদ: পারা। বহুব্রীহির এই পর্বে চারটা ইংরেজি ক্রিয়াপদও আছে যেগুলো হোলো গেট, গোয়িং, স্টার্টিং এবং মিক্স আপ। সে সাথে আছে “অপ্রমিত” ক্রিয়াপদ যেমন জিগানো। আমি এগুলোকে অনন্য ক্রিয়াপদ হিসেবেই গুনেছি তবে “করেছি”, “করি” এবং “কইরেন” কে শুধুমাত্র “করা” ক্রিয়াপদ হিসেবে গুনেছি।

বলে রাখা ভালো যে বহুব্রীহির কোনো অফিসিয়াল স্ক্রিপ্ট নেটে নেই যেটা Breaking Bad এর আছে। যেহেতু পুরো বহুব্রীহি শুনে লেখা সেহেতু ছোটখাটো কিছু ভুল থাকতে পারে – এবং ক্রিয়াপদের গণনায়ও কিছু ভুল থাকা অসম্ভব না।

Breaking Bad এর ৩৫৭৩টি শব্দের মধ্যে মোট Unique Verb ব্যবহৃত হয়েছে ১৭০টি, শতকরার বিচারে এই পর্বের কথোপকথনে সাকুল্যে ৪.৭৫% শব্দ হোলো Unique Verb। অন্যদিকে বহুব্রীহির ৪৯২১টি শব্দের মধ্যে মোট Unique Verb ব্যবহৃত হয়েছে ৮৫টি, শতকরায় ১.৭২%। অঙ্কের হিসেবে ইংরেজি কথোপকথনে বাংলার চেয়ে ২.৭ গুণ বেশী অনন্য ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়েছে এই উদাহরণে।

Image

কোনো উৎসাহী পাঠক চাইলে Pronoun ও Proper Noun বাদ দিয়ে শুধুমাত্র Unique Noun নিয়েও কাজ করতে পারেন, আমার কাছে দুটো স্ক্রিপ্টই আছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে ২.৭ গুণ না হলেও ইংরেজি কথোপকথনে Unique Noun ও ব্যবহার হয় বেশী।

বাংলার শব্দভাণ্ডার যে সীমিত এটা নিয়ে সম্ভবত কোনো তর্কের অবকাশ নেই। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হোলো বাংলা ভাষায় শব্দভাণ্ডারের যে দীনতা এর দায়ভার কি প্রমিত বাংলার? এবং এই অপ্রতুলতা কি আমাদের কোনো ক্ষতি করে?

হ্যা, আমি মনে করি যে বাংলা শব্দভাণ্ডারের দীনতার সাথে প্রমিত বাংলার সরাসরি যোগাযোগ আছে। প্রমিত বাংলা একান্তই শুদ্ধবাদী এবং শব্দের জন্য সে তৎসম ভাবাপন্ন। অর্থাৎ শেকড়ে সংস্কৃত শব্দের ছিটেফোটা না থাকলে প্রমিত বাংলা আড়ষ্টতা বোধ করে – প্রমিত বাংলা উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত গ্রহণবাদী না এবং আজুড়ে অভিভাবকত্বে এই ভাষা স্থবির হয়ে পড়েছে। ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে শেকড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান না (শেকড় নিজে এই কাজটা করে না – সে যেদিকেই পুষ্টি পায় সেদিকেই যাওয়া শুরু করে) – এর মাঝে নেই কোনো মহত্ত্ব, নেই কোনো পবিত্রতা এবং অবশ্যই নেই কোনো বুদ্ধিমত্তা।

এবং হ্যা, শব্দভাণ্ডারের দীনতা আমাদের ক্ষতি করে। আপনি যদি প্রচুর শব্দ না জানেন, যদি শব্দের সীমানা না জানেন তাহলে প্রথমত আপনার চিন্তা প্রসারিত হবে না এবং দ্বিতীয়ত আপনার চিন্তা ভাষায় প্রকাশের ক্ষেত্রে আপোষ করতে বাধ্য হবেন। আমি এই প্রসঙ্গে আগে যা লিখেছি সেটা এখানে উল্লেখ করা সঙ্গত মনে করি।

“মৌলিক কিছু অনুভূতি ছাড়া মানুষের ভাবনা ভাষা নিরপেক্ষ না। খিদে লাগার প্রকাশ ইংরেজ, আরব কিংবা বাঙালি সবার জন্যেই এক, কিন্তু জটিলতর কিংবা বিমূর্ত কোনো বিষয় (যেমন বিজ্ঞান বা দর্শন) নিয়ে চিন্তা শুরু করলে দেখা যায় যে সেটা আপনার জানা শব্দগুলোকে ঘিরেই বাড়তে শুরু করে। আমাদের অনুভূতি ভাষাতীত হতে পারে কিন্তু ভাবনা বেশীরভাগ সময়ই না। বরং শব্দই ধরে রাখে চিন্তাকে, সূক্ষ্মতর চিন্তাকে। তাই একজন লেখক একটি নির্দিষ্ট ভাষায় শুধু লেখেনই না ভাবেনও বটে। নীরদ চৌধুরী এ কারণেই বলেছিলেন যে তিনি যখন ইংরেজিতে লেখেন ভুলে যান যে তিনি বাংলা জানেন এবং যখন বাংলা লেখেন তখন ভুলে যান যে তিনি ইংরেজি জানেন। ভাষার সাথে ভাবনার এই গাঁট-ছড়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো, যে শব্দ আপনার জানা ভাষায় নেই সেই শব্দের দ্যোতক ভাবনা আপনার মগজে সহজে আসবে না (সবসময় না যদিও)। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। আপনারা যারা কোরান পড়েছেন তারা সম্ভবত “আব্দ” শব্দটা পেয়েছেন কখনো-সখনো (এই লেখকের মধ্যনামেও শব্দটি পাওয়া যাবে)। বাংলা অনুবাদে শব্দটিকে লেখা হয় দাস কিংবা গোলাম এবং ইংরেজিতে Servant অথবা Slave। দাস কিংবা Servant তার কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক আশা করে; অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে পারিশ্রমিক পাবে বলেই দাস তার কর্তব্য পালন করে। “আব্দ” এর দাসত্বে কিন্তু আরাধ্য পারিশ্রমিকের এই শর্তটি নেই। সে দাসত্ব করে ভালোবেসে। এই কনসেপ্টটি যদি আপনার মাথায়ই সর্বপ্রথম আসতো এবং প্রকাশ করতে হতো বাংলায় কিংবা ইংরেজিতে, কীইবা শব্দ ছিলো আপনার মজুদে?”​

বাংলা ভাষার এই অপ্রতুলতার কি কোনো সমাধান আছে? ভাষা কোনো মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন না যে চাইলেন আর দু বছরের মধ্যে স্ট্র্যাটেজি বদল করে প্রফিট করে ফেলবেন। তবে এমনও না যে কোনোদিনও এই অভাব পূরণ করার না। দ্বিতীয় পর্বে এর সমাধান নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রথমে, আমাদের ভাষার যে সব সমস্যা অন্তর্নিহিত সে প্রসঙ্গে একমত হতে হবে – এবং জানতে হবে যে অজ্ঞতা জনিত উচ্ছ্বাস ও আহ্লাদ কেবল শিশুদেরই কাজে দেয়, আর কারো নয়।

ফাহাম আব্দুস সালাম

এই লেখার জন্য আমাকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন মারুফ আল্লাম নামের এক সহৃদয় বন্ধু – তিনি পুরো বহুব্রীহি আমাকে বাংলায় টাইপ করে দিয়েছেন। জ্যোতি রহমান এবং শায়ান এস খানের কাছেও আমি ঋণী। শহীদ মিনারের ছবিটি কার তোলা খুঁজে বের করতে পারি নি – তার প্রতিও কৃতজ্ঞতা।

পাকিস্তান ও ভারত নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে

ধরা যাক পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে খেলা হচ্ছে ঢাকা স্টেডিয়ামে। খেলা দেখতে এসেছে হিনা রাব্বানী – বসে আছেন ভিআইপি বক্সে। দর্শকদের উত্তেজিত অংশের একজন গালের মধ্যে লিখে নিলেন: “ভইরা দিমু হিনা”। সেটা দেখানো হোলো টিভিতে। পরের দিন অনলাইনে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে? একটু সততার সাথে কল্পনা করুন।

– চরম মামা চরম
– সিরাম হইছে বস
– আমারটাও সাথে নিয়েন কইলাম
– আস্তে দিয়েন বস, পিছনে আছি

যিনি ভরে দিতে চান তাকে বীরের সম্ভাষণ দেয়া হবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে (এটাও এক অদ্ভুত প্রবণতা আমাদের, ভার্চুয়াল আর রিয়ালের মাঝে কোনো পর্দা দেখি না আর)। এবার একটু অন্যভাবে কল্পনা করুন। যে মেয়েটি “ম্যারি মি আফ্রিদি” লিখেছিলো সে কি “ভইরা দিমু হিনা”রই নারী সংস্করণ নয়? দুটোর মাঝে কি খুব পার্থক্য আছে? দুজনই বিপরীত লিঙ্গের একজন বিখ্যাত পাকিস্তানীকে কামনা করেন। কিন্তু মেয়েটাকে দেখা হয় অবক্ষয়ের নিম্নতম নিদর্শন হিসাবে আর ছেলেটাকে দেখা হবে বীর হিসাবে (তবে একটু ফাজিল টাইপ)।

ম্যারি মি আফ্রিদি নিয়ে ফেসবুকে যে সমালোচনার গণজোয়ার তার অন্তর্নিহিত কারণটি হোলো সেক্সিস্ট। ট্রাইবাল মানুষেরা বিভিন্ন সময়ে অন্য গোত্র দ্বারা নিজের গোত্রের মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়াকে জীনপুলের ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখেছে (ম্যারি মি আফ্রিদি’র প্রতিক্রিয়া) কিন্তু একই সাথে অন্য গোত্রের মেয়েকে উঠিয়ে আনাকে দেখেছে শিরোপা হিসেবে (ভইরা দিমু হিনা’র প্রতিক্রিয়া)।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে আমি প্রথম অনুধাবন করি যে পাকিস্তান ও ভারত দুটো দেশ সম্বন্ধে আমাদের যে বক্তব্য তার প্রায় আগাগোড়াই ভণ্ডামিতে ভরা এবং যেহেতু সমাজে এ প্রসঙ্গে একটা হাশ হাশ প্রচলিত (কেননা সবাই এ প্রসঙ্গে কতোটা পলিটিকালি কারেক্ট বক্তব্য দেয়া যায় তারই প্র্যাকটিস করেন, সত্যের কিংবা নিজের মনের ধার ধারেন না), সেহেতু ক্রমাগতই দুটো দেশ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা অসুস্থ থেকে অসুস্থতর হচ্ছে। আমি এ নিয়ে কিছু বলতে চাই।

Image

আমার প্রথম অবজারভেশন হোলো সংজ্ঞার সমস্যা। পাকিস্তান বলতে দেশপ্রেমিক পাকিস্তানের সরকার বোঝায় না ভূগোল বোঝায়, না রাজনীতি বোঝায়, না সংস্কৃতি বোঝায়, না কি ঐ দেশের প্রতিটি ব্যক্তিকে বোঝায় এ সম্বন্ধে তার পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। উদাহরণ দেয়া যাক। মশিউল আলমের একটা গল্প বেরিয়েছিলো কয়েক বছর আগে “পাকিস্তান” নামে। এই গল্পে লেখক নিজেই বলছেন যে, “আই হেইট পাকিস্তান! আই হেইট অল অফ ইউ, পাকিস্তানিস!” এবং বলেছিলেন এক পাকিস্তানীকেই। ভালো কথা। আপনি সকল পাকিস্তানীকে ঘৃণা করেন কায়মনোবাক্যে – এর মধ্যে কোনো যদি কিন্তু নাই।

কিছুদিন পরের কথাও লেখক আমাদের জানান এই গল্পে। ইমতিয়াজ নামের যে তরুণকে এই কথাটা লেখক শুনিয়েছিলেন তার বোনকে দেখেই তিনি তার প্রেমে পড়ে গেলেন। তখন কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন যে ইমতিয়াজের অনিন্দ্য সুন্দরী বোন ফারহানা কিন্তু বাঙালি নন, পাকিস্তানীই। সম্ভবত মশিউল আলমের মনে পাকিস্তান নামের যে ধারণা, তার মধ্যে মেয়েরা অনুপস্থিত – অন্তত ফারহানাকে যে পাকিস্তানের ঘেরাটোপে আটকে রাখা যাবে না সেটা নিশ্চিত। পাকিস্তানী মাত্রই ঘৃণিত, শুধু সুন্দরী মেয়েরা দুধভাত।

মনে করবেন না এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যারা বাংলাদেশে থাকেন তারা যেহেতু ব্যক্তিগত জীবনে ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের খুব একটা দেখেন না সেহেতু তাদের পক্ষে ধারণা করা কঠিন যে দেশপ্রেমিক জনগণ যখন আসলেই ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের সামনাসামনি হন তখন কী করেন। আই হেইট অল অফ ইউ, পাকিস্তানিস, ইন্ডিয়ানস মুখে বলা খুব সহজ। যারা ঘৃণা-বিদ্যায় এতো পারদর্শী তারা পাকিস্তানিস কিংবা ইন্ডিয়ানস দের ভিড়ে আসলে কী করেন সেটা না দেখলে তাদের কনভিকশানের দৌড় কতোদূর এটা বোঝা মুশকিল।

সৌভাগ্যক্রমে আমি এই তামাশা অনেক দেখেছি – অনেক। সাম্প্রতিকতম একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশের এক চরম পাকিস্তান বিদ্বেষী ও আওয়ামী মনোভাব সম্পন্ন পরিবারের মেয়ের কথা। আমাদের এক বন্ধুর বন্ধু। অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন বহু বছর – বাংলাদেশে খুব ভালো পরিবার বলে কী একটা জিনিস আছে না – ওটা মেয়েটির আছে। কিছুদিন আগে হুট করে দেখি যে এই মেয়ের নতুন বয়ফ্রেন্ড পাকিস্তানী – আবার তার সাথে কথাও বলে উর্দুতে (যদিও এই মেয়ে খুব ভালো ইংরেজি জানে)। মেয়েটার ভাষ্যে এই ছেলেটা শুধুই পাঠান – এন্ড য়ু নো পাঠানস আর নট রিয়ালি লাইক পাঞ্জাবিজ।

দেখুন আমার দৃষ্টিকোণে খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় – আপনি হিন্দু, পাকিস্তানি, আরব যে কারো প্রেমে পড়তেই পারেন (তবে এরশাদ এরশাদ খেলায় একটু অরুচি আছে) – কিন্তু আপনি তো আগে একটা শর্ত নিজেই বসিয়েছিলেন যে আই হেইট অল অফ ইউ, পাকিস্তানিস – এটা তো আমার কথা না। তাহলে কেন একটা পাকিস্তানীর সাথেও বা প্রেম।

এর বিপরীত নক্সাটা এতোই সহজলভ্য যে আলাদা করে কিছুই বলার নেই। দেশটারে ইন্ডিয়া ফাকায় দিচ্ছে, মালুগুলারে সাইজ করা দরকার, পোন্দে মাতরম – বলেন জাতীয়তাবাদী। যে ঘরে টিভি সেখানেই রয়েছে আয়াতুল কুরসীর ক্যালিগ্রাফি কিন্তু মুন্নী বদনাম হলে তিনি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে তার নীচের তলার অভিষেকের বাবা-মা যার চোদ্দ গুষ্ঠীর কায়কায়বার এই দেশে, – তারা ইন্ডিয়াকে রেপ্রেজেন্ট করে কিন্তু মুন্নী ইন্ডিয়াকে রেপ্রেজেন্ট করে না কারণ মুন্নী তাকে আরাম দেয়। আরামদায়ীর কোনো ধর্ম ও জাতীয়তা হতে নেই।

বাংলাদেশে অবস্থা দাড়িয়েছে এমন যে পাকিস্তান ও ভারত সম্বন্ধে আপনার আসল মনোভাব কি সেটা ভুলেও উচ্চারণ করা যাবে না কারণ যদি ব্যালান্সিং এক্টে আপনি সামান্য ভুল করেন তাহলে আপনি হয় হবেন ছাগু কিংবা রাজাকার না হয় হবেন দালাল কিংবা চেতনাবাজ। ক্রিকেটের সময় আসলে ঘৃণার পারা আরেকটু উপরে উঠে – তখন আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া উভয়কেই পাক্কা সমান ভাবে ঘৃণা করেন এবং শুধু বাংলাদেশের সাথেই আপনার ঘনপ্রেম।

এই বিচিত্র প্রবণতা কেন গড়ে ওঠে বাংলাদেশে – অনেক ভেবেছি এই নিয়ে এবং পেয়েছি অনেক কারণ; কিন্তু সর্বপ্রথম কারণ হোলো এইটি: আমি নিশ্চিত হয়ে বলছি – মনের কোনো এক কোণে আমরা নিজেদের পাকিস্তানী কিংবা ভারতীয়দের সমকক্ষ বলে মনে করতে পারি না। মনে করি যে আমি ওদের চেয়ে ইনফিরিওর।

এই ইনফিরিওরিটির কারণে আপনার একটা ক্রোধ সৃষ্টি হয় আর এই ক্রোধের পলিটিকালি কারেক্ট এক্সপ্রেশন হোলো “আই হেইট অল অফ ইউ, পাকিস্তানিস” কিংবা “পোন্দে মাতরম” – নিজ নিজ পরিমণ্ডলে। (দয়া করে ভাববেন না যে ইন্ডিয়ানদের চেয়ে নিজেকে ইনফিরিওর মনে করে সে পাকিস্তানিদের তুলনায় নিজেকে খুব সুপিরিওর মনে করবে। এই যে না জেনে, না বুঝে শুধুমাত্র জাতীয়তা কিংবা চেহারা-সুরত দেখে কারো থেকে নিজেকে ইনফিরিওর কিংবা সুপিরিওর মনে করা – এটা একটা মূর্খতাজনিত রোগ। যে একবার ইন্ডিয়ানদের তুলনায় নিজেকে ইনফিরিওরয়র মনে করেছে সে খুব সম্ভবত শাদাদের চাইতেও নিজেকে ছোটো মনে করে)।

যে মানুষ নির্বিচারে ঘৃণা করতে সক্ষম, অর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা, ইতিহাস কোনো কিছুর ভিত্তিতে আরেকটা মানুষকে না জেনেই তাকে ঘৃণা করে সে সুনিশ্চিতভাবে অক্ষম মানুষ। ঘৃণা একটি খুবই মূল্যবান অনুভূতি। কাজের মানুষ এটা অকাতরে বিলোয় না – সেটা করে গর্দভরা।

আপনি যদি কোনো একটা জাতিকে যে কারণেই হোক ঘৃণা করবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তাহলে আপনি নিজেকে একটা শর্তের মধ্যে আবিষ্কার করেন। শর্তটা কী বোঝানো মুশকিল – চেষ্টা করি। ইমতিয়াজ পাকিস্তানি। আপনার মনের মধ্যে ইমতিয়াজের যে অস্তিত্ব সেটা “অস্তিত্ব” হিসেবে কেবল তখনই কোয়ালিফাই করবে যখন আপনি তাকে ঘৃণা করবেন। ফলে ইমতিয়াজের অস্তিত্বকে একটা ঘৃণা-নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে কল্পনা করাও মুশকিল। এর পরেই আপনি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হবেন যে এই যে আপনি ইমতিয়াজকে ঘৃণা করছেন – এর মাধ্যমে যে একটা বিষয়কে “পবিত্র” মানেন (এই ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা) সেই পবিত্রতাকে গৌরবমণ্ডিত করছেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পবিত্র ও শুদ্ধতর হয়ে উঠবে আপনার কাজ দিয়ে না, মনের ঘৃণা দিয়ে।

এই পর্যায়টি খুব বিপজ্জনক একটা পর্যায়। কেননা এই সময়ে দেশপ্রেমিক নিজের প্রতি তীব্র একটা ভালোবাসা বোধ করে। এই ভালোবাসা হোলো মহত্তর একটা পবিত্রতার মাঝে নিজেকে শামিল করতে পারার তুষ্টি-জনিত গর্ববোধ। অক্ষম আবিষ্কার করে যে সে আর কোনোভাবেই তুচ্ছ নেই। বেভারলি হিলসে Chopard এর দোকানের সামনে দাড়ালেই যেমন মনে হয় এই বুঝি প্রীটি ওমেনের জুলিয়া রবার্টস বেরিয়ে আসবে এবং সব কিছু সিনেমা হয়ে যাবে।

বিপজ্জনক বলছি এজন্যে যে একজন বামন মানুষ এই ঘৃণার মৌতাত একবার খুঁজে পেলে তার পক্ষে এমন দ্বিতীয় কোনো মৌতাত খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন যা ঘৃণার মৌতাতকে টেক্কা দেবে। সে বারে বারেই ঘৃণার মাঝেই তার চৈতন্যের সারবত্তা খুঁজে পাবে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি – খুঁজে দেখুন – যে পাকিস্তানী কিংবা ভারতীয়দের ঘৃণা করে ইতিহাসের জন্য পাইকারী হারে, সে আপনার নিজের দেশেও বিরাট একটা জনগোষ্ঠীকে ঘৃণা করছে কোনো না কোনো কারণে। মনে রাখবেন, এই পর্যায়ে “ঘৃণা” আর কোনো স্টেট অফ মাইন্ড না, একটা লাইফ স্টাইল – তাকে ঘৃণা করতেই হয়। একটা অতি সাধারণ কথা কোনোদিনও তাকে বোঝানো সম্ভব হবে না যে এই যে ভাই আপনি একটা মানুষকে পাকিস্তানী বলেই ঘৃণা করা শুরু করে দিলেন এর মধ্যে দিয়ে কি তাকে অতিরিক্ত পাত্তা দিচ্ছেন না? পাকিস্তানীরা তো মানুষের জাত না বলে আপনার ধারণা, তাহলে তাকে আপনি এতো পাত্তা দিচ্ছেন কেন?

হুবুহু একই জিনিস আমি দেখি শাহবাগীরা যাদের ছাগু বলে প্রমত্ত হয় – তাদের মাঝেও। ইন্ডিয়ার প্রতি ঘৃণা বলতে তারা যে অনেক সময়েই হিন্দুদের ঘৃণা করা বোঝান – এই অনুভূতি টুকুও লোপ পায়। তারা ভুলে যান ছোটবেলায় যে কিছু বড় মানুষ আমাদের যে শিখিয়েছিলেন লাল পিপড়া হোলো হিন্দু পিপড়া – সেটা মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতা ছিলো। গম্ভীর মুখে বলেন, “ভাই এর দরকার আছে”।

এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?

আমার জানা নেই কিন্তু আমি কী করি তা বলতে পারি। আপনিও বলুন, আমি শিখতে চাই।

বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে আমি পাকিস্তানী ও ভারতীয় – উভয় দেশের মানুষকেই মোটের ওপর ভালোবাসি – মানে অন্তত তাদের ঘৃণা করি না। আজকের প্রজন্মের বহু পাকিস্তানী যাদের ৭১ এর জন্য লজ্জিত হতে দেখেছি – তাদের আমি আগের প্রজন্মের পাপের উত্তরসুরী মনে করি না। ঠিক তেমনি তিস্তার পানির ভাগ পাচ্ছি না বা ফালানিকে মেরে ফেলা হয়েছে দেখে পুরা ভারতকে ঘৃণা করতে হবে এই চিন্তা ভাবনার মানুষও আমি নই। পাকিপ্রেম, মালুপ্রেম এবং বাঙ্গুপ্রেম – তিনটাই আমার মধ্যে ক্রিয়াশীল। ফুল হাতে না আসলেও আমি কাওকে অবিশ্বাস করি না এবং ল্যাটকামিও করি না। দেখুন; খুব কম মানুষের সাথে বিশ্বাস করতে হয় – এমন পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে ফেলি – বাঙ্গুপ্রেম, মালুপ্রেম এবং পাকিপ্রেম বজায় রাখা আমার জন্য খুব মুশকিল কিছু না।

কেন?

কারণ আমার চোখে পুরা ভারতবর্ষ হোলো কংগ্রেগেশান অফ আ ভেরী লার্জ ক্রাউড অফ ইডিয়েটস। সত্যিকারভাবে অর্থে এমন কোনো পার্থক্য আমার চোখে পড়ে না যা থেকে মনে হবে যে চিটায়ঙ্গারা গুজরাটি কিংবা পাঠানদের চেয়ে অনেক অনেক আলাদা। একই আমাদের বেদনা, একই আমাদের খাসলত। একই রকম আমাদের নীচতা এবং একই রকম আমাদের গন্তব্য। শুধু কেউ বলেন আল্লাহ ভরসা, কেউ বলেন দুগ্গা দুগ্গা আর কেউ বা বলেন জয় বাংলা। অনেকেই দুই বঙ্গের মাঝেও বিশাল তফাৎ দেখতে পান, আমি পাই না। আমার চোখে ভারতীয় সরকার আর ভারতের মানুষ দুটো এক জিনিস না। কিন্তু ভারতের সাধারণ মানুষ আর আমাদের সাধারণ মানুষের মাঝে খুব বেশি পার্থক্য আমি দেখতে পাই না। ঠিক তেমনি ভাবে ৭১ এ যেমন, আজো তেমন পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের বন্ধু হতে পারে নি যেটা পেরেছে সেখানকার সাধারণ মানুষ।

বাকী থাকে রাষ্ট্রের কথা। দেখুন ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র একটা আজগুবী ধারণা – সে হিসাবে পাকিস্তান একটা সাম্প্রদায়িক ধারণা – সন্দেহ নাই। কিন্তু রাষ্ট্র মাত্রই সাম্প্রদায়িক ধারণা। রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতেই হবে – এটাই রাষ্ট্রের গন্তব্য। state is an imperfect solution for fighting idiots wo don’t have the necessary means or will to anhilate the others entirely. এতো বিপুল সংখ্যক গর্দভকে জায়গা করে দিতে হলে একটা পলিটিকাল সিস্টেমকে সাম্প্রদায়িক হতেই হবে। এই কথাটা অস্ট্রেলিয়ার জন্য যেমন সত্য তেমনি সত্য বাংলাদেশের জন্যেও। এবং এই সাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ না করলে আপনি কোনোভাবেই পলিটিকাল সিস্টেমের অংশীদার হতে পারবেন না।

কাওকে ঘৃণা না করে সবাইকে ভালবাসার ওয়াজ কি একটু বেশীই ক্যাথলিকসুলভ সুকোমল হয়ে গেলো?

হয় তো, কিন্তু এটাই আমি – আমি উপেক্ষায় বিশ্বাসী, ঘৃণায় না। সততার সাথে এতোটুকু বলতে পারি: কোনো পাকিস্তানী কিংবা ইন্ডিয়ান – এক মুহুর্তের জন্যেও আমার মনে হয় না – যে আমি পারবো না – এবসলিউটলি নেভার। এর একটাই কারণ: আমি কাওকে ঘৃণার মালা দিয়ে সম্ভ্রমের উচু চেয়ারে বসাই না। যে মানুষ একবার ঘৃণার ব্যবসা শুরু করবে সে কোনোদিনও সততার সাথে বলতে পারবে না – আই ডোন্ট গিভ আ ফাক। অনেকেই কথাটা বলেন রেগে গিয়ে – আমি বলি মন থেকে।

পুনশ্চ: অন্ধ দেশপ্রেম এবং জাতি বিদ্বেষ যে খুব বেশীদূর এগোয় না – এর একটা কারণ আছে। গর্দভদের নিজেদের মধ্যেকার যে প্রীতি সেটা ঘন হতে পারে খুব – কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয় না কখনোই।

শরীরী প্রেম

কার্ল ফন কোজেল আমাদের সমস্যায় ফেলেন, গভীর সমস্যায় ফেলেন – দিনরাত নষ্ট করা অস্বস্তি এক।

তার গল্পের প্রথম অংশটুকু শুনতে খারাপ লাগবে না। কান পাতি আসুন।

Image

প্রথম দেখায় মনে হবে যে সত্যজিৎ রায় এই লোককে দেখেই প্রফেসর শঙ্কুর ছবি এঁকেছিলেন। প্রফেসর শঙ্কুর মতো এই জার্মান শাদা দাড়িও বিজ্ঞানী – তবে সেটা কেবল তার নিজের দাবী। ১৯২৬ এ ফ্লোরিডায় চলে আসেন। বলে রাখা ভালো যে ফ্লোরিডা পৌঁছানোর আগে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন এবং তার আগে সম্ভবত ভারতেও ছিলেন (১৯২২ এ জন্ম হয় নেয়া মেয়ে আয়েশা ট্যানজলারের নামের বানান – Ayesha। আমার ধারণা তিনি ভারতে সত্যিই ছিলেন – নৈলে বানানটা হতো Aisha অথবা A’isha) আমেরিকায় এসে চাকরির জন্য কি না জানি না – অনেক মিথ্যা বলতে শুরু করেন। ৯টা কলেজ ডিগ্রী আছে, আগে সাবমেরিনে কাজ করতেন এই জাতীয় গপ্পোবাজি। নামটাও বদলে ফেলেন – আগে ছিলো কার্ল ট্যানজলার (Carl Tanzler) এখন কার্ল ফন কোজেল (Carl von Cosel)। বন্ধুরা বলে ‘কাউন্ট’ কার্ল ফন কোজেল – এলাহী কারবার। চাকরি শুরু করলেন কী ওয়েস্ট হসপিটালের টিউবারকিলোসিস ওয়ার্ডে এক্স-রে টেকনিশিয়ান হিসেবে।

তখনও যক্ষার চিকিৎসা আবিষ্কার হয় নি। জানা আছে যে দরিদ্রদের মধ্যে যক্ষার প্রকোপটা বেশী। এমনি এক গরীব ঘরের মেয়ে মারিয়া এলেনা মিলাগ্রো ডি হোয়োস। কিউবান-আমেরিকান, বয়স মাত্র ২১, অনিন্দ্য সুন্দরী এবং মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। প্রেমে পড়ে যান ফন কোজেল। শুরু হোলো উপহারের পালা – আজ এটা তো কাল সেটা। কিন্তু হোয়োস কোনো সাড়া দেয় না; ২১ বছরের মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ৫২ বছরের “বুড়ার” প্রেমে পড়ার কথাও না। কিন্তু ফন কোজেল তরফে ভাবনা: রোগটা সাড়ানো গেলে নির্ঘাৎ প্রেমের দাবী তৈরী হবে।

Image

ফন কোজেল নিজে ডাক্তার ছিলেন না কিন্তু ওস্তাদী করতে পিছপা হলেন না। হোয়োসের গরীব পরিবার সম্মতিও দিলো। এলেকট্রিক শক, রেডিয়েশন থেরাপি, বিচিত্র সব কেমিকেল আর গাছগাছড়ার – সবেরই প্রয়োগ হোলো কিন্তু বাঁচানো গেলো না মেয়েটাকে। ১৯৩১ এ মারা গেল হোয়োস।

যারা মনে করছেন যে গল্পের শেষ এখানেই তারা ভুল করলেন। গল্প সবে শুরু।

পশ্চিমে ফিউনেরাল খুব শস্তা জিনিস না। এ ব্যয়ভার বহন করলেন প্রায়-অপরিচিত জন ফন কোজেল। শুধু তাই না, তিনি একটা বিশাল স্মৃতিসৌধও তৈরী করলেন। লালবাগে পরীবিবির স্মৃতিসৌধটা যে রকম। বড় একটা ঘর, মাঝখানে শুধু সার্কোফ্যাগাস। একটু বুঝতে হবে ব্যাপারটা। কফিনে দাফন করলে জমিনের পানির জন্য লাশ পচে যায় তাড়াতাড়ি। কিন্তু বন্ধ পাকা ঘরে সার্কোফ্যাগাসের মধ্যে ময়শ্চার কম। তাই লাশ গলবে দেরীতে।

Image

সময় পাওয়া গেলো।

সারাদিন অফিস করে রাতে কবরে চলে যান ফন কোজেল। হোয়োস পরিবার জানে যে এ লোক হোয়োসের প্রেমে পড়েছিলো সত্যিই। তাই তারা ভদ্রলোকের মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়াটাকে ভালোবাসার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই নেয়। যে ঘরে হোয়োসের কবর সে ঘরের দুটো চাবি। অন্যটা হোয়োসের বোনের কাছে। কিন্তু পরিবার জানে না রাতে গিয়ে ফন কোজেল কী করে? ফন কোজেল আসলে সার্কোফ্যাগাসের মধ্যে ফর্মালডিহাইড আর অন্যান্য মশলাপাতি দিয়ে লাশটাকে সংরক্ষণ করতে চাইছিলো কাউকে না জানিয়ে।

Image

 

তখনকার দিনে আরো একটা চল ছিলো। মারা যাওয়ার পরপরই ডেথ মাস্ক বানানো হতো – মানে প্লাস্টার অফ প্যারিস জাতীয় কিছু দিয়ে মুখের একটা ছাচ বানানো হতো এবং এই ছাচ অনুযায়ী আবক্ষ মূর্তি। রাজা রামমোহন রায়েরও ডেথ মাস্ক বানানো হয়েছিলো। ফন কোজেল ডেথ মাস্কও তৈরী করেছিলেন হোয়োসের।

Image

দু বছর ধরে সংসার করতে থাকলেন ওই ছোট্ট স্মৃতিসৌধে। রোজ যান, কথা হয় হোয়োসের সাথে। একটা ফোনও লাগালেন প্রিয়তমার সাথে কথা বলার জন্য – ঠিক কবরের মধ্যে। এভাবে চললো দু বছর।

তারপর হুট করে আর তাকে দেখা যায় না। চাকরিও গেলো চলে হাসপাতাল থেকে – প্রেম খুব ঘন বলে কথা। একদিন দুইদিন করতে করতে দশ বছর চলে গেলো মারা যাওয়ার কিন্তু ফন কোজেলের দেখা নেই। হোয়োসের বোনের কেন যেন সন্দেহ হোলো, বুড়োর তো কবরে আসার কথা। স্মৃতিসৌধে গিয়ে খোঁজ লাগাতে গিয়ে যে ভয়টা সবাই পাচ্ছিলো সেটাই সত্য হোলো। সার্কোফ্যাগাসে হোয়োসের লাশ নেই।

ফন কোজেল বহু আগেই লাশটা ওখান থেকে সরিয়ে ফেলেছে। চাকরি চলে যাওয়ার পর সে দূরে ছোট্ট একটা বাসায় ওঠে এবং সেখানে সে নিয়ে যায় হোয়োসের মৃতদেহ। বড় একটা বিছানার এক পাশে সে আর অন্য পাশে হোয়োস। দশ বছর ধরে লাশ নষ্ট না করার জন্য বিশেষ ধরনের চেম্বার এবং টেকনোলজি প্রয়োজন, বাড়ীতে সে ব্যবস্থা করা অন্তত আশি বছর আগে সম্ভব ছিলো না। তাই লাশটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো। প্রচুর পারফিউম, নানান ধরনের তেল ও কেমিকেল ব্যবহার করে ফন কোজেল চেষ্টা করছিলেন প্রিয়তমাকে রক্ষা করার জন্য। মারা যাওয়ার পরপরই তার চুল কেটে রাখা হয়। সেই চুল আর গলে ঝড়ে পড়া চুল দিয়ে তৈরী করা হয় উইগ। আর ডেথ মাস্ক ব্যবহার করে তৈরী হয় মোমের মুখোশ। চোখের কটোরে ঢোকানো হোলো মার্বেলের চোখ। হাড়গুলো জোড়া রাখা হোলো পিয়ানোর তার দিয়ে। নষ্ট হয়ে যাওয়া চামড়ার জায়গায় সিল্ক আর মোমের জগাখিচুড়ি – ভয়াবহ এক পুতুল। পরিয়ে রাখা হয় বিয়ের গাউন।

Image

ফন কোজেলের মতে এটা তার সুখের সংসার। প্রিয়তমাকে সে গান শোনায়, পিরীতের কথা বলে – সংসার হয়ে ওঠে সাবলীল।

এদিকে হোয়োসের বোন মুখোমুখি হয় ফন কোজেলের। জিজ্ঞেস করলো তার বোনের লাশের কথা। ফন কোজেলের গলায় কোনো ভয় কিংবা ক্ষোভ ছিল না। সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় তিনি বললেন হোয়োসের সাথে তার সুখের সংসারের কথা। দেখাতেও নিয়ে গেলেন ওপর তলায় এবং বললেন আবার আসতে তার বোনের সংসার দেখার জন্য।

ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। কল্পনা করুন আপনার বোনের দশ বছরের পুরোনো লাশ আরেকজনের বিছানায় এবং আপনি তার সামনে দাড়িয়ে। ভয়ার্ত বোন ছুটে গেলো পুলিসের কাছে। এরপর রাষ্ট্র হোলো পুরো ঘটনা। সেন্সেশেনাল ঘটনা, পুরো দেশের মনোযোগ ফ্লোরিডা কীতে। ময়না তদন্ত হোলো হোয়োসের শরীর, জিজ্ঞেস করা হোলো বুড়োকে। বিচার বসলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সায়ক্রিয়াটিস্টরা জানালো যে ফন কোজেল মানসিক ভাবে অসুস্থ নন।

১৯৫২ সালে ৮৩ বছর বয়সে ফন কোজেল স্বাভাবিকভাবে মারা যান নিজের ঘরে। মারা যাওয়ার সময় একটা লাইফ সাইজের পুতুলকে তিনি জড়িয়ে ধরে ছিলেন। পুতুলের মুখে ডেথ মাস্ক দিয়ে বানানো মুখোশ। তার ডায়েরীর শেষ কথা ছিলো: Human jealosy has robbed me of the body of my Elena ……. yet divine happiness is flowing through me …… for she has survivied death for ever ….. for ever she is with me.

Image

বলে রাখা ভালো যে সে সময়ে ফন কোজেলের প্রেমের এই ঘটনাকে খুবই রোম্যান্টিক বলে ভাবা হতো। ব্যাটা পাগল কিন্তু ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। কিন্তু এখন আর ফন কোজেলকে সেভাবে দেখা হয় না।

হোয়োসের ময়না তদন্ত যারা করেছিলো তারা ১৯৭০ এর দিকে বোমা ফাটান। সময় এবং সমাজটা ভিন্ন বলে সে সময়ে একটা সত্য তারা চেপে গিয়েছিলেন। ফন কোজেল হোয়োসের যোনিপথে একটা টিউব বসিয়েছিলেন এবং টিউবের শেষ প্রান্তে তারা তুলার মধ্যে সীমেন খুঁজে পেয়েছিলেন।

ফন কোজেল হোয়োসের মৃত দেহের সাথে যৌনসঙ্গম করতেন, তিনি ছিলেন নেক্রফিলিয়ায় আক্রান্ত।

আসলেই তিনি হোয়োসের সাথে সেক্স করতেন কি না সেটা নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই যেহেতু সমসাময়িক কোনো প্রমাণ নেই এই দাবীর। তবে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে এই বাজে কাজটা করে আসছে এবং ফন কোজেলের বাকী কাজ নেক্রফিলিয়ার ইঙ্গিত দেয় সত্যিই। বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার ওপর। এই হলো পাঠক; ফন কোজেলের গল্প।

 

 

আপাত দৃষ্টিতে খুবই ডিস্টার্বিং এই ঘটনা – অস্বীকার করবো না – তবে সেটা গল্পের একটা লেয়ার। অন্য অনেক লেয়ারে গল্পটা আমার কাছে খুবই খুবই ফ্যাসিনেটিং।

কেন?

কারণ ফন কোজেল আমাদের এমন সব গুরুতর দার্শনিক প্রশ্নের মুখোমুখি করেন যার কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই। আমার মনোযোগ এই গল্পের খুটিনাটিতে না বরং মানুষ এই ঘটনায় কীভাবে রিএক্ট করেছে যুগ যুগ ধরে – সেখানেই আছে এলেম।

আমাদের প্রথম প্রশ্ন: who owns death?

যারা দর্শন পড়ান তারা মোরালিটি এবং ইথিক্স এর ফারাক নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করেন – সে পথ আমাদের না। তবে খুব মোটা দাগে – মানে অশ্লীল রকমের মোটা দাগে মোরালিটিকে বলা যেতে পারে ব্যক্তি পর্যায়ের নৈতিকতা আর ইথিক্স হোলো ব্যক্তি সমাজ পর্যায়ে যে নৈতিকতার প্রয়োগ করে। আপনি ঘুষ খান না – এটা মোরালিটির প্রশ্ন কিন্তু বিশাল একটা প্রতিষ্ঠানের কর্তা হিসেবে আপনি কর্মরত মেয়েদের মা হওয়া জনিত ছুটি দেবেন কি না – সেটা ইথিক্সের প্রশ্ন।

একটা ছোটো কিন্তু আছে। আমরা মানুষ ইথিক্সের প্রশ্ন তখনই তুলি যখন সে প্রসঙ্গে আমাদের ওনারশিপ থাকে। অপ্টামাস প্রাইম অটোবট এলিটার সম্পত্তি মেরে খেলে আমাদের মনে কোনো ইথিক্সের প্রশ্ন জাগে না কারণ সাইবাট্রন গ্রহকে আমরা ওন করি না।

মৃতের সৎকারের সাথে পরিচ্ছন্নতার সম্পর্ক প্রত্যক্ষ মানি কিন্তু মূলত এটা ইথিক্সের প্রশ্ন। তাই যদি হয় তাহলে মৃত্যু অর্থাৎ এক্ষেত্রে মৃতদেহকে ওন করছে কে?

মৃত ব্যক্তিটি, মৃতের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি না আল্লাহ?

যাকেই আপনি ফন কোজেলের গল্প বলবেন সেই প্রথমে বলবে য়াক, ডিজগাস্টিং। মন বলে, ফন কোজেল কাউকে বা কিছু একটা ভায়োলেট করেছে। এই “কেউ”টা কে? বেশীরভাগ মানুষ প্রথমেই বলবেন যে ফন কোজেল হোয়োসের শরীরকে ভায়োলেট করেছেন যেহেতু হোয়োসের শরীর ব্যবহার করা হয়েছে অনুমতি ছাড়া। এই কাজটা আমরা বছরের পর বছর ইজিপশিয়ান ফারাওদের মমি প্রদর্শন করে (ফারাওরা কি অনুমতি দিয়েছিলেন তাদের মৃতদেহ জাদুঘরে রাখার?)। মানুষ কি তাহলে মৃত্যুর পর তার দেহের ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলে?

অন্তত ত্রিশ বছর মানুষ জেনেছে যে ফন কোজেল দশ বছর ধরে একটা লাশের সাথে ঘর-বসতি করেছিলো – এতে তারা প্রশ্রয় সূচক বিস্ময়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছে মাত্র। কিন্তু যখন জেনেছে যে তিনি হোয়োসের মৃত শরীরের সাথে যৌনতাও সম্পন্ন করতেন তখন তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েছে – ব্যাটা একটা অসুস্থ দানব। কথা হোলো – কারো তো অজানা ছিলো না যে ফন কোজেলের নিজের মতে সে সংসার করছিলো হোয়োসের সাথে (আদালতেও তিনি এ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন)। যে মানুষ একটা লাশকে বিছানার পাশে রেখে দশ বছর ঘর করতে পারে তার জন্য সে লাশের ওপরে ওঠা আর এমন কি?

আমরা মানুষ যে নৈতিকতা নির্ণয়ে কোনো যুক্তি মানি না – সম্ভবত এ ঘটনাও তার একটা প্রমাণ।

আবার

পশ্চিমের মানুষেরা নৈতিকতার প্রশ্নকে “ক্ষতি” দিয়ে মাপে। অর্থাৎ কোনো কিছু যদি কারো কোনো ক্ষতি না করে তাহলে তা অনৈতিক না (আমরা আবার এরকম না। কেউ বাংলাদেশের পতাকার ডিজাইনের আন্ডারওয়ের পরে এবং কাউকে সে যদি তা নাও দেখায় তাহলেও তা অনৈতিক)। কিছুক্ষণের জন্য চিন্তা করুন যে হোয়োসের বোনটি যদি ‘৪২ এ মারা যেত তাহলে হয়তো কেউই কোনদিন জানতো না যে বুড়া মৃত শরীরের সাথে সেক্স করে। সেক্ষেত্রে কিন্তু কারো কোনো “ক্ষতি” হয় না। মনে রাখতে হবে যে ফন কোজেল ঠিক টেড বান্ডী না – মানে তিনি মৃতের সাথে সেক্স করার জন্য জীবিতকে হত্যা করেন নি। একটা মৃত মানুষের সে যদি সেক্স করে এবং কেউ যদি তা জানতে না পারে এবং আরেকটা শর্ত যদি আমরা কল্পনায় যোগ করে নিই যে এই সঙ্গমে কোনো রোগ বাহিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই – তাহলে পিওর রিজনের দিক থেকে এই বন্দোবস্তে কারো কিন্তু কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। সেক্ষত্রেও কি এই বন্দোবস্ত অনৈতিক?

আমার ধারণা যারা হার্ম প্রিন্সিপাল ধরে নৈতিকতার শুমার করেন তাদের অধিকাংশও এ কাজটাকে অনৈতিক বলবেন। মানুষ যে নৈতিকতার প্রশ্নে প্রথমে ইন্সটিংটিভলি সিদ্ধান্তে আসে তারপর সুবিধামতোন যুক্তি দিয়ে তার পেছনের সিদ্ধান্তকে জাস্টিফাই করে এ ঘটনা হয়তো তার আরো একটি প্রমাণ দেবে।

আমার সবশেষ পর্যবেক্ষণ: মানুষ এক অদ্ভূত কারণে জীবিতের শরীরের প্রশ্নে পবিত্রতাকে প্রাসঙ্গিক মনে করে না কিন্তু মৃতের শরীর – যা নিথর এবং পচনশীল – তাকে মনে করে পবিত্র। ফন কোজেল কোনো নিথর মরদেহ না, পবিত্রতা প্রসঙ্গে আমাদের যে অলংঘনীয় উচ্চ ধারণা – সম্ভবত তার ওপরেই সওয়ার হয়েছিলো।

বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যত

17

ধরা যাক ২০২০ কিংবা ২০২৫/ খালেদা- হাসিনা দুজনই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন – তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে? ইসলামিস্টরা কি তৃতীয় শক্তি হবে? জামাত কি ইসলামিস্টদের নেতৃত্ব দেবে না নতুন কোনো দল ইসলামিস্টদের প্রতিনিধিত্ব করবে? ইসলামিস্টরা কি বিএনপি-লীগ থেকেও শক্তিশালী হয়ে যাবে তখন?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ডিপ্লোম্যাটরা রাজনীতিবিদদের এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন, চিন্তিত নাগরিকরা করেন সাংবাদিকদের। বহু মানুষের সাথে আমিও বারবার আলোচনা করেছি এ প্রসঙ্গে। আমার কিছু বন্ধু আছে যারা মেধা, শিক্ষা ও পেশা – সব দিক থেকেই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ; তাদের সাথে আলাপচারিতাতেও এই প্রসঙ্গটি বারবার ফিরে আসে। মনে হলো আমাদের আজকের ভাবনাগুলো লিখে রাখা খুব দরকার, ৩০ বছর পর এই সময়টাকে আমরা কীভাবে দেখছিলাম সেটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে।

প্রথমেই কিছু শব্দের সীমানা নির্ধারণ করি, এটা জরুরী, ভবিষ্যতে এই শব্দগুলোর প্রাসঙ্গিকতা বদলে যাবে।

আমি “ইসলামিস্ট” বলতে বোঝাচ্ছি তাদের যারা পলিটিকাল ইসলামে বিশ্বাস করেন এবং সে মতে রাজনীতি ও এক্টিভিজম করেন। পাঁচ বেলা মসজিদে যাওয়ার মানে কিন্তু ইসলামিস্ট না, আবার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করাই ইসলামিস্ট হওয়ার একমাত্র শর্ত না। এটা একটা আমব্রেলা টার্ম এবং আমি সেই হিসাবেই ব্যবহার করেছি। ইসলামাইজেশান বলতে আমি অন্য ধর্ম থেকে ইসলামে আসা বলছি না এই লেখায়। শুধুমাত্র এই লেখার জন্য ইসলামাইজেশান শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে মুসলমানদেরই ইসলাম ধর্মের নতুন উদ্বোধন হওয়া অর্থে। এই ঘটনাটির কোনো সর্বজনগ্রাহ্য নির্ণায়ক শব্দ খুঁজে পাই নি দেখে এই ধারকর্জ। “সেনট্রিস্ট” বলতে আমি বুঝিয়েছি সে সমস্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা মানুষের কথা যারা সব দলের সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন, বাস্তবতা ও যুক্তি-তর্ককে চেতনা ও আদর্শের ওপরে স্থান দেন এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে উগ্রবাদী নন। আমার অভিজ্ঞতা বলে বাংলাদেশে সঠিক অর্থে সেনট্রিস্ট দল না থাকলেও বিএনপি অন্য দুটি মূল থেকে চরিত্রে বেশী সেনট্রিস্ট এবং সব দলেই সেনট্রিস্ট প্রবণতার লোকজন আছে। যারাই শাহবাগে গেছে তারাই শাহবাগী – এই অর্থে আমি “শাহবাগী” বলছি না। আমার কাছে (এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত) আওয়ামী লীগের কাছে যখন টাকা থাকে তখন সেটা স্পিরিচুয়াল প্রজেক্টে পরিণত হয়, কোনো রাজনৈতিক দল থাকে না। শাহবাগী বলতে আমি বুঝি এই স্পিরিচুয়াল প্রজেক্টের ফুট সোলজারদের। লক্ষ্যনীয় হোলো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সংস্লিষ্ট না হয়েও আপনি এই স্পিরিচুয়াল প্রজেক্টের ফুট সোলজার হতে পারবেন।

সবার আগে আমার জীবনের ছোট্ট একটা পর্যবেক্ষণ।

৮৭-৯০ সালের কথা মনে করছি। আমি তখন ছোটো কিন্তু বড়দের কিছু কথা আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। আমার বাবা যেহেতু ৫০ এর দশকে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন, তার বন্ধুরা প্রায়ই কে চীফ অফ স্টাফ হবে এ বিষয়ে খুব আলোচনা করতেন (তখনও তাদের সমসাময়িকরা কেউ কেউ চাকরি করছিলেন) /  এয়ার ভাইস মার্শাল জামাল (তখনও তিনি চীফ হন নি) প্রসঙ্গে তাদের কেউ কেউ মনে করতেন যে জামাল কোনোভাবেই চীফ হতে পারবে না কারণ – সহজ বাংলায় তিনি হুজুর এবং তার স্ত্রী হেজাবী।

২৫ বছর ফাস্ট ফরওয়ার্ড।

আজকে বাংলাদেশে শুধুমাত্র “হুজুর” হওয়ার কারণে উপরের দিকে ওঠাটা মনে হয় অতোটা কঠিন না কারণ “হুজুর” ও হেজাবীদের এখন যথেষ্ট ভিজিবিলিটি আছে সমাজের সব স্তরে। আমাদের ছোটোবেলায় এর ধারে কাছেও কিছু দেখি নি।

অন্যদিকে এখন যতো স্লীভলেস কামিজ ও ব্লাউজ দেখা যায় সামাজিক অনুষ্ঠানে, তার ধারে কাছেও কিছু আমরা দেখি নি ছোটোবেলায়। মজার ব্যাপার হোলো এই বিশেষ ব্যাপারটা অর্থাৎ স্লীভলেস কামিজ ও ব্লাউজ কিংবা কোনিকাল ব্রা পরাটা আমাদের জন্মের আগে মানে ৬০ ও ৭০ এর দশকে বাংলাদেশের আপার মিডলক্লাসে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো (হলিক্রস স্কুলের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা CD বানানো হয়েছিলো বেশ কিছু বছর আগে। ঐ CD ‘র ফটোগ্রাফ দেখলে এর সত্যতা খুঁজে পাবেন)।

আবার

৮০’র দশকে আমার মা’দের যে বয়স ছিলো এখন আমাদের স্ত্রীদের সেই বয়স। তখন দেখতাম তারা প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে মিলাদ করতেন এবং আমার খেয়াল আছে এই মিলাদে আসতেন একদম উঁচু তলার স্ত্রীরাও। এটাকে তাদের সময়ের হ্যাং আউট বলবেন কি না আপনার ইচ্ছা কিন্তু আমার মনে হয় তখনকার অহিজাবীরা এখনকার অহিজাবীদের চেয়ে বেশী ধর্মসম্মত জীবন যাপন করতেন।

আমার ধারণা যারা ঢাকায় বড় হয়েছেন তারা কম বেশী আমার এই পর্যবেক্ষণগুলোয় সায় দেবেন। আপনি যদি এই সব বিচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে “একটা” প্যাটার্ন বের করতে চান কিংবা সামাজিক পর্যবেক্ষণ থেকে রাজনৈতিক উপসংহারে আসতে চান, আপনি ভুল করবেন। এই সোশাল এভোলিউশানের কোনো সহজ ব্যাখ্যা নেই। তবে এরিক হবসবম ঠিক কাছাকাছি একটা প্যাটার্নের কথা উল্লেখ করেছিলেন শিল্প-বিপ্লবোত্তর ব্রিটেনে – যেখানে নতুন পুঁজি সৃষ্টির সাথে সাথে বিপুল ভাবে বেড়েছিলো ধর্মীয় এক্টিভিটি। একদল “উচ্ছন্নে” যাচ্ছিলো আরেক দল ক্রিশ্চিয়ানিটির ব্যাপক প্রসারকেই মনে করেছিলো এ রোগের দাওয়াই।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে উল্লিখিত জটিলতা হোলো সমাজ পর্যায়ের। এর উপর যোগ করেন রাজনৈতিক জটিলতা – এমন কঠিন এক জিগ স পাজল তৈরী হবে যার কোনো সমাধান নেই। এবং সমস্যা হোলো এমন অবস্থায় আপনি যে দৃষ্টিভঙ্গিই পোষণ করবেন, খুব সহজেই আপনার মতো করে একটা ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। যেমন শাহবাগীরা মনে করেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশ পুরা আফগানিস্তান হয়ে যাবে। আবার বিএনপির লোকেরা মনে করে যে বাংলাদেশে ঐ রকম রাডিকাল ইসলামাইজেশানের কোনো সম্ভাবনাই নেই, বরং উদ্ধ্বত সেকুলারিজমই সবচেয়ে বড় সমস্যা। মোদ্দা কথা আপনার নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন, সেই অনুযায়ী এবং অনুপাতে একটি ভয়াবহ ভবিষ্যত আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে।

প্রথম প্রশ্ন হোলো বাংলাদেশে গত ২৫-৩০ বছরে বিশেষ করে শেষ ১৫ বছরে এতো দ্রুত ইসলামাইজেশান হোলো কেন?

আমার পরিচিত এক বাংলাদেশী ক্যানবেরান যিনি বাংলাদেশে ৮৪ সালে গ্রামে শিক্ষকতা করেছেন তার অভিজ্ঞতা হোলো তখন গ্রামে দশ জনের মধ্যে বড়জোর এক জন হিজাব করতো আর এখন সেই স্কুলেই দশ জনের মধ্যে আট জন হিজাব করে কিন্তু এখন তাদের প্রায় প্রত্যেকেই “দুই নম্বর” কিন্তু ৮৪ সালে প্রতিটি মেয়েই সহজ সরল ছিলো। তার ধারণা এর মূল কারণ হোলো এনজিও – সহজ কথায় মিডল ইস্টের টাকা।

Image

তিনি যে ডেমোগ্রাফির কথা বলছেন সেখানে মিডল ইস্ট ও জামাতের টাকা ইসলামাইজেশানের কাজে এসেছে এ কথা সত্য (তবে বাংলাদেশের সব অঞ্চলে না) কিন্তু সমস্যা হোলো তিনি ধর্মকে একটা প্রডাক্ট হিসেবে জ্ঞান করছেন অর্থাৎ যত বেশী টাকা (= মাইলেজ = ইনভেস্টমেন্ট), ততো বেশি ইসলামাইজেশান। সোশাল এভোলিউশানের এরকম শুধু টাকা-ভিত্তিক ব্যাখ্যা একেবারেই খাটে না।

কিন্তু এই ব্যাখ্যার সবচেয়ে বড় খুঁত হোলো – যে ইসলামাইজেশানের জন্য এখন মনে হচ্ছে যে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির উত্থান হতে চলেছে অর্থাৎ শহুরে অনূর্ধ্ব ৪০ জনগোষ্ঠির মাঝে ইসলামের প্রসার সেখানে এই অয়েল মানি প্রায় কোনো কাজেই আসে নি।

আমি দেখেছি যে অসংখ্য তরুণ-তরুণী যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্ত ঘরের সন্তান এবং শহরের নাম করা স্কুল কলেজ থেকে পাশ করে পেশার দিক থেকে খুবই সফল – এরা ইসলামের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠছে যেটা ৮০’র দশকে আমার ছেলেবেলায় প্রায় কখনোই দেখা যেতো না। আমার এক বন্ধু টেলিভিশনের মডেলিং থেকে দাড়ি রাখা উঁচু বেতনের এগজিকিউটিভ হয়ে গেছে। আমাদের আরেক বন্ধু আইবিএ থেকে পাশ করে এখন আরবী শেখায়। এবং এই পরিবর্তন একটা দুটা না, হাজারে হাজারে।

এই ঘটনাটা কীভাবে ঘটলো?

প্রথমে আমার একটা অতি সরলীকৃত ব্যাখ্যা: আমরা স্কুল কলেজের বই পুস্তকে যা পড়ি, বিস্ময়কর হলেও সত্য যে বাস্তব জীবনে কেবল ইসলাম ধর্ম শিক্ষাই প্রাসঙ্গিক। বাংলা বইয়ে যে ভাষা শিখি সে বাংলাতে কেউই কথা বলে না, এমন কি টিভিতেও এখন আর তেমন শোনা যায় না। যে ইংরেজি বইয়ে থাকে সে ইংরেজি কোনোদিনও কোনো দেশে চর্চা হতো কি না আমার সন্দেহ, দশ বছরের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নির্ভুল বালকদের আজগুবি সব কেচ্ছা-কাহিনীতে ভরা। অঙ্ক আর বিজ্ঞানে শিখি যে দুই আর দুই চার – বাস্তব জীবনে এই যোগফল পাঁচ, ছয় এমন কি পাঁচ শও হতে পারে। বিজ্ঞানের প্রায় কোনোই ব্যবহার নেই দৈনন্দিন জীবনে (বিজ্ঞান ব্যবহার করা আর অন্যের বানানো টেকনোলজি এস্তেমাল করা এক জিনিস না)/ ইসলাম শিক্ষায় বলে সমর্পণ করো, শান্তি পাবে। বাস্তবে কী হয় এ সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব অল্প কিন্তু যারাই ইসলামের প্রতি অনুরক্ত তারাই বলে যে ধর্ম শিক্ষা বই যা প্রমিজ করে তা ডেলিভারও করে, নিজেদেরকে সমর্পণ করে তারা শান্তির খোঁজ পেয়েছেন।

আমাদের কালে, আমি বলবো মোটামুটি মিড নাইনটিজ থেকেই বিশ্বব্যাপী একটা ঘটনা ঘটেছে আর সেটা হোলো আমাদের জীবনে এখন কোনো ফিলোসফি নেই। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে নিজের জীবনের পরিপূর্ণতা দেখার জন্য কোনো একটা ফিলোসফির বাস্তবায়ন দেখতে চায়। আমাদের দেশে ৬০ থেকে নিয়ে ৮০ এর দশক পর্যন্ত সোশালিজমের মধ্যে দিয়ে তরুণরা দর্শনের খিদেটা মিটিয়েছে। নানা কারণে নাইনটিজে এসে এই বন্দোবস্ত বদলে যায়। সভিয়েট য়ুনিয়েনের পতন, বাংলাদেশী বামদের আদর্শিক স্খলন, বিশ্বব্যাপী বামপন্থার প্রতি আকর্ষণ কমে যাওয়া – সবই মনে হয় এর পেছনে কম বেশী কাজ করেছে।

অন্তত আমাদের দেশে দর্শনের অভাব কিছুটা মিটিয়েছে ইসলাম – অন্তত কিছু মানুষের জীবনে। এর একটা অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হোলো পলিটিকাল ইসলামের প্রতি আকর্ষণ-বোধ। ইসলাম ধর্মটা একটু বিচিত্র এই বাবদে। দশ জন লোক যদি ইসলামী অনুশাসনে মনোযোগী হয়ে ওঠেন দেখা যাবে যে পাঁচজনই সামগ্রিক মুক্তির জন্য পলিটিকাল ইসলামকে আবশ্যক মনে করে – এই ব্যাপারটা অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না। বলাই বাহুল্য এই পাঁচজন যদি শিক্ষিত তরুণ হয় তাহলে ধীরে ধীরে দেখা যাবে যে কোনো একটা ইসলামী দলের মধ্যে দিয়েই তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হচ্ছে।

শাহবাগী এবং আওয়ামী মনোভাব সম্পন্ন মানুষেরা এই ব্যাপারটার দুটো ভুল ব্যাখ্যা করে। প্রথমটা হোলো যে তারা মনে করে যে এই তরুনেরা অধিকাংশই জামাতী। ইন ফ্যাক্ট এই যে নতুন এনলাইটেন্ড ইসলামিস্ট ক্লাস, তাদের পলিটিকাল আইডেনটিটির দুটো মূল প্রতিপাদ্য হোলো জামাতকে অপছন্দ করা এবং কওমী মাদ্রাসা তথা হিফাজতকে একটু তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা এবং এর মধ্যে দিয়ে উভয়ের থেকেই আলাদা হওয়ার চেষ্টা করা। তার মানে কিন্তু আবার এই না যে বিএনপি যেভাবে আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করে – এটা সেই পর্যায়ের রেশারেশি। বলা যেতে পারে এটা একটা ইন্টেলেকচুয়াল ফ্যাড কিন্তু পরস্পরের সাথে রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক একাত্মতা ঘোষণা না করার জন্য যথেষ্ট। ভিকারুন্নিসা স্কুল থেকে পাশ করা মেয়েরা যেমন করে ভারতেষ্মরী হোমসের মেয়েদের দেখে অনেকটা সেরকম।

কিন্তু এই ভুলটা ততোটা মারাত্মক না যতোটা দ্বিতীয়টি। শাহবাগী, আওয়ামী, সেনট্রিস্ট, বিএনপি,সুশীল, ডিজুস – মানে আরবান ক্লাসের বিশাল একটা অংশ মনে করে যে এই ইসলামিস্টরা আন্ডার এচিভার কিংবা সহজ বাংলায় ভোন্দা গাজীর দল।

বাংলাদেশে ৬০ ও ৭০ এর দশকে সবচেয়ে মেধাবীরা বাম রাজনীতি করতো, এখনকার বাংলাদেশে সবচেয়ে মেধাবীরা রাজনীতি-বিমুখ বললে কম হবে, সম্ভবত অনেকে ঘৃণাই করে এই বিষয়টি। কিন্তু যারা রাজনীতি করে (অর্থাৎ সশরীরে এক্টিভিজম করেন, দল করেন, সংগঠিত হন – ফেসবুকে না শুধু), তাদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ও পড়াশোনা জানা ছেলে-মেয়েরা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ধারায় হয় ইসলামিস্ট, নয়তো বাম ধারার (কিন্তু বাম ধারার সংখ্যাটা খুবই কম) / ছাত্রদল কিংবা ছাত্রলীগের ছেলে-পুলেরা মেধার দিক থেকে ইসলামিস্টদের ধারে কাছেও না।

আরো একটা অদ্ভুত ব্যাপার হোলো সারা পৃথিবীতে যারা নিজেদের প্রগ্রেসিভ ঘরানার রাজনীতি করেন বলে দাবী করেন তারা অনেক বেশী সহনশীল হন আর ইসলামিস্টরা হয় অসহনশীল। বাংলাদেশে হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টা। এখানে যে নিজেকে লিবার্টিন বলে দাবী করে, সে আবার ফাসিও চায়। একদিকে সে নিজেকে সেকুলার বলছে অন্য দিকে “প্রয়োজনে লাখ খানেক মানুষকে হত্যা” করার পরামর্শও দিচ্ছে। এবং সব সময় সে রেগে থাকে – মানে ভয়ঙ্কর ধরনের রাগ। পরমতসহিষ্ণুতার দিক থেকে বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগ্রেসিভ ক্লাস এতোটাই প্রতিক্রিয়াশীল যে “সভ্য মত বিনিময়” মোটামুটি অসম্ভব হয়ে যায়।

আশ্চর্য ব্যাপার হোলো ইসলামিস্টরা অপেক্ষাকৃত বেশী সহনশীল (আমি বাসুদা ও মেজবাহ আহমেদ পর্যায়ের ইসলামিস্টদের কথা বলছি না)/ তাদের সাথে অন্তত কিছু সময় আপনি গালিগালাজ ছাড়া তর্ক করতে পারবেন (এটা নিতান্তই আমার পর্যবেক্ষণ)।

কথা হোলো, আসল কথা হোলো – ইসলামিস্টরা কি সংগঠিত হতে পারবে এবং হলেও তারা কোন ধরনের ইসলামিস্ট হবে?

প্রথমত একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশের ইসলামিস্টরা চরিত্রে টার্কিশ ইসলামিস্টদের কাছাকাছি, তালেবানদের মতো না কারণ ইসলামিস্ট নেতা এবং নেতৃস্থানীয়দের বিরাট অংশ আদতে অন্টাপ্রেনিওর – সহজ ভাষায় তাদের কাছে টাকা আছে এবং তারা ইসলাম না বুঝলেও ব্যবসাটা ভালো বোঝেন। সুদূর ভবিষ্যতে তারা যদি কোনোদিন ক্ষমতায় যায় – যে একটি পেশার মানুষ তাদের ব্যাপারে সব চেয়ে খুশী থাকবে বলে আমার ধারণা – তারা হোলো ব্যবসায়ী শ্রেণী।

কিন্তু ক্ষমতায় যেতে হলে যে পরিমাণ সংহতি ও পরিপক্কতা দেখাতে হবে তা কি তারা পারবে?

সম্ভবত না।

বাংলাদেশের ইসলামিস্টরা বাঙালি ইসলামিস্টও বটে – অনর্থক তর্কে তাদের অনন্ত অনুরাগ। নিজেদের মধ্যে কারা শুদ্ধতম ইসলামের অনুসারী – এ আলোচনার ক্ষুধা তাদের কেয়ামতের পরেও বলবৎ থাকবে। এটাকে মুসলমানদের কুইনটাসেনশিয়াল বৈশিষ্ট্য বললেও অত্যুক্তি হবে না।

কিন্তু

শাহবাগীরা মনে করেন বিএনপির যে বিশাল জনসমর্থন আছে দেশব্যাপী তারা খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে ইসলামিস্ট হয়ে উঠবে। এর কারণ হিসেবে তারা যা মনে করেন তা হোলো বিএনপি আদর্শিক ভিত্তি দুর্বল পক্ষান্তরে ইসলাম একটি ১৪ শ বছরের পুরোনো আদর্শ। বিএনপি টিকে আছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের কারণে। তার মৃত্যুর পর এন্টি-আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্টের জন্য বেটার আউটলেট হয়ে যাবে ইসলাম এবং বিএনপি ছেড়ে সবাই ইসলামপন্থীই হয়ে যাবে। অর্থাৎ সেনট্রিস্টরা ক্রমশ এক্সট্রিমিস্ট হয়ে উঠবে। মোটামুটি কাছাকাছি ধারণা আমি দেখেছি কিছু কিছু বিএনপিপন্থীদের মাঝেও।

প্রশ্নটা আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম বিএনপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে যিনি মোটামুটি পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি দেখেছেন কাছে থেকে এবং যার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপর আস্থা রাখা যায়। তিনি বললেন আর সব কিছু যদি মেনেও নেই, ইসলামিস্টদের নেতৃত্বটা দেবে কে? তার মতে ইসলামিস্টদের মধ্যে জামাত ছাড়া অন্য কোনো অংশ “রাজনীতি” “বোঝে” না এবং জামাতেরও যে একজনমাত্র নেতাকে তার মনে হয়েছে যে পরিবর্তিত পৃথিবীতে ইসলাম-পন্থী দলের ভূমিকা কী হবে এটা বোঝার মতো প্রয়োজনীয় সফিস্টিকেশান ও দূরদৃষ্টি আছে – তিনিও জেলে এবং সম্ভবত তার ফাঁসি হবে (আমার অপ্রয়োজনীয় মত: এই লোকটা আমার জানামতে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী এবং তার মৃত্যুদন্ড হওয়াটা হবে সঙ্গত)

কিন্তু যদি এমন হয় –

খালেদা-হাসিনার পর বাংলাদেশে অন্তত আওয়ামী লীগ-বিএনপির কোনো নেতা কোনোদিনও এ পরিমাণ ক্ষমতা সংহত করতে পারবেন না – সেটা জানা কথা। সে ফাঁকে ইসলামিস্টরা যদি একটা ইমরান খান খুঁজে পায়। পশ্চিম-ফেরত, ইংরেজিতে বক্তৃতা দেয়, ক্লীন শেভড, জন স্টুয়ার্ট মিল কোট করে, মিল্টন ফ্রিডম্যান কোট করে আবার কোরানের আয়াতও শুদ্ধ আরবীতে উচ্চারণ করে মেঠো বক্তৃতায়। অন্তত বিএনপি-আওয়ামী লীগের চেয়ে ইসলামিস্টরা যে গভর্নেন্সের দিক থেকে সফল হবে এ ব্যাপারে বেশীরভাগ লোক একমত হবেন। বিভিন্ন দলের সেনট্রিস্টরা যদি ইসলামের পতাকাতলে চলে এসে? এরকম একটা অবস্থার নিপুন বর্ণনা দিয়েছেন শফিকুর রহমান। তখন তো ইসলামিস্টরা এগিয়ে আসতে পারে।

আমি এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিই না। কিন্তু আমার ধারণা ইসলামিস্টরা সফল হবেন না। কেন?

সমস্যাটা ইসলাম নিজে। লিবারেল আইডিয়োলজির একটা সুবিধা আছে যেটা ইসলামের নেই। ব্যক্তিগত প্রশ্ন আসলেই লিবারেল আইডিয়োলজি বলতে পারে – এটা বাপু তোমার সমস্যা, ডু ওয়াটএভার য়ু লাইক। আপনি মদ খাবেন না স্লীভলেস কামিজ পরবেন এটা আপনার নিজের ব্যাপার – এখানে আমার কিছু করার নেই। বাই ডেফিনিশন ইসলাম একটা ধর্ম, তাকে রিএক্ট করতে হয়, দর্শকের ভুমিকা নিতে পারে না। ইসলাম বলতে পারে না গো ফাক য়োরসেল্ফ, এটা আমার সমস্যা না। রাষ্ট্র চালাতে গেলে “এটা আমার সমস্যা না” বলাটা খুব জরুরী, যেটা ইসলাম পারে না। ইসলাম একটা ধর্ম কিন্তু রাষ্ট্র একটা পলিটিকাল কনস্ট্রাক্ট। দিন শেষে বাস্তবতা হোলো য়োরোপিয়ান এনলাইটেনমেন্টের ফলাফল যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার দিক-নির্দেশনা কারী মতবাদ হিসেবে পলিটিকাল ইসলাম কমপ্যাটিবল না। রাষ্ট্রের দার্শনিক গন্তব্য হোলো ব্যক্তিস্বাধীনতা আর ইসলামের দার্শনিক গন্তব্য হোলো সমর্পনের মাধ্যমে অর্জিত শান্তি। প্রশ্নটা ইসলাম ভালো না লিবারেল ডেমোক্রাসি ভালো – তা না; বরং এটা কমপ্যাটিবিলিটির ইসু – “রাষ্ট্রব্যবস্থার” সাথে ইসলাম যায় কি না?

Image

আমাদের দেশে পলিটিকাল ইসলামের প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করতে হলেও কয়েকটা মৌলিক প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে। সারা পৃথিবীর ইসলামিস্টদেরই বোধ করি করতে হবে।

এগুলো কী?

পলিটিকাল ইসলামের দিক নির্দেশনা প্রত্যক্ষভাবে কোরানে নেই (যেমন আপনার নেতাকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করা হবে কি না)/  কিন্তু মুসলমানের ব্যক্তিজীবন কেমন হবে – এর অতি খুটিনাটি ব্যাখ্যাও কোরানে আছে। পলিটিকাল ইসলামকে রাষ্ট্র-পরিচালনাকারী মতবাদ হিসেবে যারা দেখতে চান তাদের এমন কিছু বিষয়ে আপোষ করতে হবে যার নির্দেশনা কোরানে আছে। যেমন ধরুন ইসলামিস্টদের বাংলাদেশে হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কি না কিংবা পোষাক পরিধানে ইসলামের কিছু বাধ্য-বাধকতা আছে, এর মাঝে কোনো যদি কিন্তু নেই। কিন্তু অনেক মুসলমান ছেলেমেয়েই আছে যারা এই বাধ্য-বাধকতা মানেন না কিংবা মানতে চান না। এখন ইসলামিস্টরা চোখ বুজে থাকতে পারেন কেননা তারা বলতে পারেন যে ভাই এটা তো আমাদের মাথা-ব্যথা না কারণ আমাদের কাছে ক্ষমতা নেই। যখন ক্ষমতা আসবে তখন কিন্তু তারা দর্শক থাকতে পারবেন না, পক্ষ নিতে হবে। রাষ্ট্র পর্যায়ে ইসলামের বাস্তবায়ন করার জন্য (যার সরাসরি নির্দেশনা নেই কোরানে), তারা কি ব্যক্তি পর্যায়ের ইসলামের সাথে আপোষ করার মতো (যার সরাসরি নির্দেশনা নেই কোরানে) সাহস দেখাতে পারবেন?

আমার ধারণা বিশ্বব্যাপী এ ধরনের সাহসী পদক্ষেপের জন্য যে ধরনের কনসেনসাস প্রয়োজন, ইসলামিস্টরা তার ধারে কাছেও আসতে পারে নি। বাঙালি তর্কপ্রিয় এবং শিশুতোষ তর্কে তার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি (অর্থনীতির নোবেল প্রাইজ যে আসলে নোবেল প্রাইজ না এবং অর্থনীতির নোবেল লরিয়েটদের নোবেল লরিয়েট বলা হলে বিশাল অপরাধ হয়ে যাবে – এ নিয়ে বাংলার দামাল বুদ্ধিজীবী ন্যশনাল মিডিয়ায় দীর্ঘ সময় আলাপ করেন)।

এটা আমাদের মাথাব্যথা না – আপনি যেভাবে খুশী করেন, এ বিষয়ে আমার কোনো মতামত নেই – এ ধরনের চিন্তা করাও বাঙালির পক্ষে অসম্ভব।

বাংলাদেশের মানুষ চরিত্রে সেনট্রিস্ট – সে ওয়াজে গিয়ে চোখের পানি ফেলে আবার যাত্রা দেখেও আদ্র করে মন। দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিকভাবে সফল হওয়ার চাবিকাঠি এই ব্যালেন্সিং এক্টের মধ্যে। যে একদিকে বেশী ঝুঁকে পড়বে তারই বিপদ। এই জিনিসটা বোঝে বিএনপি এবং এককালে আওয়ামী লীগও বুঝেছিলো। কাজটা করার জন্য সামষ্টিকভাবে যে পরিপক্কতা প্রয়োজন, ইসলামিস্টদের তা তাদের নেই। ভবিষ্যতে হবে কি না জানি না তবে ইসলামিস্টদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হোলো আওয়ামী লীগ। যে একমাত্র যুদ্ধে ধর্মের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা হোলো ধর্মযুদ্ধ এবং আওয়ামীবাদ ইসলামিস্টদের একটা ধর্মযুদ্ধই উপহার দিয়েছে। যে পোলারাইজেশান প্রজেক্ট আওয়ামী লীগ হাতে নিয়েছে তার একমাত্র ফলাফল হোলো দুটো ধর্মীয় উন্মাদনা: শাহবাগী চেতনা বনাম ইসলামী জজবা। এই ধর্মীয় উন্মাদনা চেতনাবাদকে কয়েকবার ধ্বংস করার জন্য যে যথেষ্ট – এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই, পুরো দেশটাই না ধংসাত্মক উন্মাদনায় মশগুল হয় – সেটাই দেখার বিষয়।

সারভাইভাল এক্টে চিন্তা ভাবনার কোনো সুযোগ থাকে না। সমস্যা হোলো সারভাইভাল এক্টের বিজয়ীদের চিন্তা ভাবনা করতে না দেয়ার খেসারত দেয় পুরো জাতি – ইতিহাসে এর শত শত উদাহরন আছে।

সত্য হোলো; শুধুমাত্র যে একটি পথে ইসলামিস্টরা সফল হতে পারে, ঠিক ওই পথেই তাদের ধাওয়া করছে লীগ।

ফোটো ক্রেডিট:

David Lazar (Girl with green eyes and red headscarf)

পাভেল রহমান/AP

কেওস-কণ্টক

Image

The greatest tragedy in this world is not that the only underlying principle which is recognizable, functional and ceaseless is “chaos” – it is our predisposition to think otherwise, that there is order and harmony. Successful minority of the very few who understand this secret are busy ripping off benefits from chaos, and those who don’t – namely the majority – are busy unweaving the rainbow, leaning on to some sort of idealism.

আমাদের সমাজে কোনো আইন নেই, নেই শৃঙ্খলা – এ অভিযোগ সবার মুখে। সেই দু-তিন শ বছর আগে এ অঞ্চলের মানুষ যেমন দুর্নীতির নালিশ করতো, আজোও করে; বিস্তর বর্ণনা মিলবে আমাদের সাহিত্যে, দলিল-দস্তাবেজে। সাধারণত এ জাতীয় কথা-ভাজা শেষ হয় একটি আর্জি দিয়ে। আহ! এই দেশে যদি একটু আইন-কানুন, নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকতো, তাহলে আমরা কই উঠে যেতাম! সত্যিই কি তাই হোতো?

আমাদের সমাজে পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর মতোন নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকলে অর্থনীতিক ভাবে আজকে যে অবস্থানে আছি তার চেয়ে উপরে থাকতাম বলে মনে হয় না। বিশৃঙ্খল, দুর্নীতিগ্রস্থ, মিথ্যাবহুল সমাজে বেড়ে ওঠার কারণে এমন কিছু বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের দৌরাত্ম্য আমাদের এখানে হয়েছে যেগুলো আমাদের এখানে ভীষণ কার্যকরী ও প্রাসঙ্গিক। যেগুলো ছাড়া দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এখন এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর, অন্তত অর্থনীতি যখন প্রাসঙ্গিক।

Image

পৃথিবীর মুখোমুখি হওয়ার তালিম আমরা পাওয়া শুরু করি পরিবার ও স্কুল থেকে। এই প্রশিক্ষণ আমাদেরকে এক ধরনের আদর্শ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়, যে পৃথিবীতে ন্যায় আছে, শৃঙ্খলা আছে, আছে কার্য-কারণের মাঝে সমন্বয়। আমরা আশ্বস্ত হই যে এমন একটা পৃথিবী এই মুহূর্তে না থাকলেও ভবিষ্যতে হতে পারে অবশ্যই – আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আমাদের মতো যাদের জন্ম তৃতীয় বিশ্বে, তারা স্বপ্ন দেখি যেন একটি সমৃদ্ধ ও সঙ্গত পৃথিবী উপহার দিয়ে যেতে পারি পরের প্রজন্মকে (মূলত নিজের দেশকে নিয়েই এই স্বপ্ন)। সমস্যা হোলো, সৃষ্টিকর্তার পৃথিবীতে শৃঙ্খলা থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু মানুষের পৃথিবীতে নিশ্চিতভাবে আছে chaos, যা ব্যাখ্যা করা যায় শুধুমাত্র ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর। এক অতিপ্রাকৃত বিশৃঙ্খলা ঘিরে রেখেছে আমাদের সর্বব্যাপী। আমরা যে তা উপলব্ধি করি না, তা না। কিন্তু মেনে নিতে মন চায় না। এক অসম্ভম তাড়না আমাদের প্রশ্রয় দেয় – বিশৃঙ্খলার ওপর শৃঙ্খলার কর্তৃত্বেই বুঝি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব।

প্রাকৃতিক ভাবে মানুষ জন্মেছিলো এই কেওসকে মোকাবিলা করার জন্য, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অতি শিক্ষা মানুষের এই অপার সম্ভাবনাটিকে কিছুটা হলেও নষ্ট করে বলে আমার অনুমান। কেওস থেকে লাভবান হওয়ার চেষ্টা মানুষসহ সকল প্রাণীর প্রবৃত্তি, এর মাঝে লজ্জা পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না, এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষার কারণে সে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা বাদ নিয়ে অন্য কাজে ব্রতী হয় প্রায়ই, সে প্রথমত কেওসকে বোঝার চেষ্টা করে, দ্বিতীয়ত সে বুঝতে ব্যর্থ হয়ে এর নাম দেয় “সমস্যা” এবং তৃতীয়ত কোনো আদর্শবাদ এই সমস্যার সমাধান বলে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এই প্রস্তুতি কেবল একটি পরম সত্য থেকেই তাকে বিস্মৃত করেঃ কেওস থেকে নিস্তার মানুষের নেই। তবে হ্যাঁ, কোন ধরনের কেওস নির্বাচ্য সে উদ্দামতায় মানুষের শ্রেয়তর বিচারবোধের উপযোগিতা আছে ভীষণ।

মেজাজের দিক থেকে মানুষ যুক্তিপ্রবণ না, শিক্ষা তাকে যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখায়। শিক্ষার এই প্রক্রিয়াটা ভীষণ গোলমেলে এবং দ্বান্দ্বিক। প্রবৃত্তি বলছে প্রয়োজনে ছিনিয়ে নাও, ধর্ম বলছে প্রয়োজনে বিলিয়ে দাও। আবার ধর্ম জোড় দিচ্ছে বিশ্বাসের ওপর, বিজ্ঞান বলছে যুক্তির স্থান সবার ওপর। হিচেন্স বলছেন ইরাকের ওপর আমেরিকার আক্রমণ উচিৎ হয়েছে, চমস্কি বলছেন সেটা ছিলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। শেখ হাসিনা বলছেন তারাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী, খালেদা জিয়া বলছেন মুক্তিযুদ্ধে যারা ছিলেন অনুপস্থিত(শারীরিকভাবে) তারা নেতৃত্ব দেয় কী করে? এতোসব পরস্পরবিরোধী তথ্য ও মতের অনিবার্য প্রকাশ হলো মানুষের আনপ্রেডিক্টেবিলিটি। তার যুক্তি, আবেগ, মানবতাবোধ সবকিছুই হয়ে যায় বিশেষায়িত, একই মানুষ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ করে, যা কোনো যুক্তি দিয়ে বিচার করা সম্ভব না। যে মানুষটি পরম বিশ্বাসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে, সে মানুষটিই অফিসে গিয়ে ঘুষ খাচ্ছে। যে মানুষটি ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসার জন্যে দিনরাত ব্যয় করে গবেষণা করছে, সেই দুঘণ্টা পরপর ল্যাবের বাইরে গিয়ে ধোঁয়া ফুঁকে। যে মানুষটি বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস গুপ্তহত্যা নিয়ে বিচলিত ও চরম ক্রোধান্বিত, সে একই মানুষ ঘটমান বর্তমানের একই দিনে সংঘটিত গুপ্তহত্যা নিয়ে সামান্যতমও চিন্তিত না। বিষয়টি সমালোচনার না, বলতে চাইছি যে এটিই মানুষের প্রকৃতি, ক্ষমাহীন স্বভাব।

ব্যক্তি থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্তরণে পরিস্থিতি আরোও বহু পাকে মনোহর হয়ে ওঠে। কেননা তখন মানুষের স্বভাবের সাথে যোগ হয় এমন সব এলোপাথাড়ি দৈব প্রভাবকের যার ওপর মানুষের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। স্বভাবতই সে ভীষণ বিচলিত হয়ে ওঠে। কেননা তার চারপাশের পৃথিবী, এমন কি হয়তো নিজের আচরণও কোনো সেন্স-মেক করে না। এই উপলব্ধি একেকজনের মাঝে একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কেউ ভাবে যুক্তি, কেউ ভাবে বিশ্বাস – পৌছে দেবে গন্তব্যে। কারোও আস্থা অর্জিত জ্ঞানে, কারোও আস্থা দৈব হস্তক্ষেপে – আদর্শবাদই পারে কেওস থেকে উত্তরণে, শক্তি আর নৈতিকতার শুভত্ব দিয়ে।

যাদেরকে আমরা বলি ভবিষ্যতদ্রষ্টা আর কেবল “স্ট্রীট-স্মার্ট” বলে যারা পান না যথাযথ কৃতিত্ব (কম বয়সে যাদের অনেককেই “চাল্লু-ম্যান” বলে ডেকেছি স্কুলে) তারা কিন্তু কেওসের মুখোমুখি হন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। এরা কেওসের ডায়নামিক্স নিয়ে চিন্তিত নন, সমাধানেও নেই কোনো আগ্রহ। এদের চিন্তা কেবল একটিইঃ এই গ্যাঞ্জামে আমার জন্য কী আছে?

আলতো নজরে মনে হয় যে সব নষ্টের গোড়াই হোলো এ স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি; অতর্কিতে এ দৃষ্টিভঙ্গি সামনে চলে এলে আমাদের রুচিবোধ রুষ্ট হয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমরা বেসামাল হয়ে পড়ি। কিন্তু বাস্তবতা হোলো এই “স্বার্থপরতা” ছাড়া সভ্যতা এগোয় না (তবে এটা অর্ধসত্য; সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বার্থপরতার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি প্রয়োজন আছে মহানুভবতার)।

প্রকৃতির দিকে চোখ ফেরালে ধারণাটা কব্জা হয় অনায়াসে। বিবর্তনের একটা প্রবণতা হোলো সহজ থেকে জটিলতর অস্তিত্বের দিকে যাত্রা। প্রথমে এসেছে এককোষী প্রাণী; সেখান থেকে বহুকোষী জটিলতর প্রাণের উন্মেষ। এবার আমরা ফিরে যাই একটু পিছে, প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। প্রায় হিমালয়ের সমান একটা উল্কা প্রচণ্ড গতিতে পৃথিবীতে এসে আঘাত হানে মেহিকোর য়ুকাতান পেনিনসুলায়। আঘাতের বিভীষিকাঃ সম্মিলিতভাবে মোট ১০ কোটি এটম বম্বের সমান। ফলাফলঃ ১৬ কোটি বছর ধরে যে ডায়নোসর চড়ে বেড়িয়েছিলো এই পৃথিবীতে দাপটের সাথে তারা হয়ে গেলো বিলুপ্ত। শুধু ডায়নোসর কেন, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক স্পিসিস শেষ হয়ে গেলো কেবল ঐ একটি আঘাতে। ডিলেমাটি লক্ষ করুন, খুব মজার। যে লক্ষ-কোটি বছরের পোক্ত শৃঙ্খলা “বিবর্তন” চাইছে শক্তিবহুল, সমর্থ প্রাণীর টিকে থাকা, এই উল্কার কারণে মারা পড়লো তারাই সবার প্রথমে। কেবল একটি দুর্ঘটনা বদলে দিলো পুরো “জীবনের” ইতিহাস, যেটা না হলে মানুষের উদ্ভব হোতো কি না কে জানে? যে কেওসের কথা আমি বলছিলাম তার একটা মহাজাগতিক চরিত্রও আছে। তো শেষমেশ টিকলো কারা? সবচেয়ে শক্তিশালী কিংবা বুদ্ধিমান প্রাণীটি টেকে নি, টিকেছিলো তারাই যারা এমন চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে নেয়ার মতো সক্ষম ছিলো।

বিবর্তনের এই ধারার সাথে মানুষের সমাজের তফাৎ আছে বিস্তর, সত্য। কিন্তু একটা মূলসুর আমাদের সমাজেও একইভাবে কার্যকর। পরিবেশ যেখানে বিশৃঙ্খলাময় এবং আনপ্রেডিক্টেবল, সেখানে প্রয়োজনীয় নয় যে আমাদের পছন্দের, আয়ত্তের কিংবা কোনো পুস্তক-সত্যায়িত দক্ষতাই রক্ষাকবচ হবে।

আসুন এ ছাঁচে একবার বাংলাদেশকে ফেলি। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই বাংলাদেশের মতো এতো ছোটো ভূ-খণ্ডে এক প্রজাতির এতো বিপুল সংখ্যক অগ্রসর স্তন্যপায়ী প্রাণী একসাথে হয়তো বাস করে নি। এমন অভূতপূর্ব ঘটনার অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বলাই বাহুল্য, আমাদের এখানে পুষ্টি, সম্পদ, সুযোগ প্রভৃতির জন্য কাড়াকাড়ি অচিন্তনীয় রকমের উদগ্র। জীবনের বিবর্তনে যেমন, সমাজের বিবর্তনেও এমন গলা-কাটা প্রতিযোগিতায় সাড়া না দেয়ার উপায় নেই। জন্ম হচ্ছে এমন সব সক্ষমতার যেগুলোকে বর্ণনা করার মতো যুতসই শব্দ নেই আমার তহবিলে।

আমার স্কুলবেলার এক বন্ধুর পারিবারিক ব্যবসা খুব বড়। বন্ধুটি কথায় কথায় একদিন জানালো বাংলাদেশে একটি ব্যবসায় তার আগ্রহের কথা। অংক করে দেখলাম যে ডলারের হিসাবে তার বিনিয়োগের পরিকল্পনা হোলো প্রায় আশি মিলিয়নের। আশ্চর্যের ব্যাপার হোলো এই প্রকল্পের কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয় নি তখনও, শুধুমাত্র ইন্সটিঙ্কট থেকে তার এই আগ্রহ। পশ্চিমে আশি মিলিওন ডলারের বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে কোনো ধরনের মার্কেট রিসার্চ ছাড়া (পণ্যটি অভিনব কিংবা যুগান্তকারী না, রোজই কোটি মানুষ ব্যবহার করে), এটা শুনলে বলবে মাথার ডাক্তার দেখাও। কিন্তু ব্যবসাটা শুরু করলে দেখা যাবে যে সবাই ভুল ছিলো, সেই ঠিক ছিলো; লাভ হচ্ছে তরতর করে। গত বিশ বছরে বাংলাদেশী অন্টাপ্রেনিওরদের সাফল্যের মূলে যে এমন বিচিত্র বিচারবুদ্ধিরহিত উচ্ছ্বাস ও লোভ রয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রশ্ন হোলো কোনো আইন ও শৃঙ্খলার দেশে এমন যুক্তিহীন প্রাণোচ্ছলতাকে ধারণ ও লালন করার উপায় আছে কি?

এই বন্ধুটিকেই প্রশ্ন করেছিলাম তারা পশ্চিমে ব্র্যান্ড শুরু করে না কেন (তাদের মূল ব্যবসা চামড়াজাত পণ্য)? অস্ট্রেলিয়ার মতো ছোটো মার্কেটে আশি মিলিওন ডলারের এক শতাংশের চেয়েও কম বিনিয়োগ করে বহু সফল ব্র্যান্ড বেরুচ্ছে হরহামেশা। এখানে আইন-কানুন আছে, বিশাল অঙ্কের লাভ আছে, নেই চাঁদাবাজি-রাজনৈতিক উপদ্রব, নেই লোডশেডিং। এখানে তো ব্যবসা করা অনেক সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু না, পশ্চিমে আমার বন্ধুর বা বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের স্টার্ট-আপ ব্যবসায়ে কোনো আগ্রহ নেই। ঐ যে বলছিলাম, বিশৃঙ্খলার মাঝে একটা স্ট্র্যাটেজিক এডভান্টেজ আছে, এটা কেউ খোয়াতে রাজী নয়।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হোলো বিশৃঙ্খলা যদি কারো স্ট্র্যাটেজিক এডভান্টেজ হয় রাষ্ট্রের সেখানে কী করার আছে? এর উত্তর আমার জানা নেই। জানা নেই এজন্য যে এমন প্রশ্নের উত্তরে চোখা-চিন্তার সুযোগ কম। যে সমস্যায় এক-দুজন না, পুরো সমাজটা জড়িত, সে সমস্যায় আমরা কার্যকারিতার চেয়ে নৈতিকতার মানদণ্ডকে প্রাধান্য দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আর নৈতিকতা এমনই এক ব্যাখ্যাক্রান্ত বিষয় যে এ নিয়ে ভাবাবেগবর্জিত আলোচনা করা এক কথায় অসম্ভব।

তাহলে এই কেওস-কন্টক পৃথিবীতে আমার আপনার জন্য কী করার আছে?

প্রথমে একটা কথা আবারো স্মরণ করিয়ে দেবো যে কেওস থেকে মানুষের নিস্তার নেই, তা আপনি যেখানে যে দেশেই থাকুন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা এমন কেওসের ব্যবস্থা করেছি যেটা খুব আদিম ও বন্য। এমন বিশৃঙ্খলায় লাভবান হতে চাইলে প্রায়ই ইতরামির শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু মনে রাখবেন কোনো আইন, কোনো মতবাদ কিংবা কোনো আদর্শই এই বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলায় রূপান্তরিত করতে পারবে না, এটা ধ্রুব সত্য। আমরা কেবল এক ধরনের বিশৃঙ্খলার চেয়ে অন্য ধরনের বিশৃঙ্খলাই বেছে নিতে পারি।

এছাড়া কেবল একটিই কথা বলার আছে আমার। ইনটুয়িশানকে (শব্দটির কোনো যুতসই বাংলা জানা নেই আমার। সহজ ভাবে বলা যেতে পারে “মন যা বলে”) প্রাধান্য দিন সবার আগে, এমন কি নৈতিকতারও আগে।

এই কথাটির তাৎপর্য আছে। একটু ব্যাখ্যা করি। আমরা মানুষেরা, নৈতিকতার প্রশ্নকে কীভাবে মোকাবেলা করি বলুন তো? আমার ধারণা, বেশীরভাগ পাঠক উত্তর করবেন যে আমরা ভেবে-চিন্তে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর হলে সিদ্ধান্ত দেই যে ব্যাপারটি অনৈতিক। দুঃখের বিষয়ঃ মানুষের মস্তিষ্ক এভাবে কাজ করে না। সে প্রথমে চিন্তা করে না, হুট করে সিদ্ধান্তে আসে, তারপরে নিজের মতোন করে যুক্তি খাড়া করে। এই যুক্তিগুলোও খুব মজার। সে যদি মনে করে কোনো একটি বিষয় অনৈতিক, তাহলে সে কল্পনায় কাউকে না কাউকে ভিক্টিম বানাবেই, বাস্তব যাই হোক না কেন (মানুষের মোরাল সাইকোলজি এক অনবদ্য বিষয় যা নিয়ে আলাদা একটা আলোচনার প্রয়োজন, সেটা ভবিষ্যতের খাতায় তোলা থাক)। অর্থাৎ সূক্ষ্ম বিচারে নৈতিকতার ব্যাপারটি ইনটুয়িটিভ, র্যাশনাল না। সমস্যা হোলো ঐ যে হুট করে সিদ্ধান্তে আসা – এই প্রক্রিয়াটাকে মানুষ স্বীকার করতে চায় না, মনুষ্যত্বের অবমাননা হবে বলে। আমি বলছি, হুট করেই যদি সিদ্ধান্তে আসি, না ভেবে-চিন্তে, তাহলে ঐ একটি সিদ্ধান্তের প্রতিই এতো আস্থা কেন?

ইনটুয়িশান যদি বলে কাউকে খুন করতে তাহলে কি তাকে খুন করতে হবে? না, অবশ্যই তা না কিন্তু মানুষের বাস্তব সমস্যায় “সঠিকত্ব” বা “ন্যায়বিচারই” একমাত্র বিচার্য না, আরোও বহু দিক আছে। নৈতিকতার বাধন অনেক সময়ই এই দিকগুলো দেখতে দেয় না (এ প্রবণতাটা খুব সহজেই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করে প্রমাণ করা যায়)। আমার প্রস্তাব শুধু এতোটুকু যে ইনটুয়িশানকে অগ্রাধিকার দিলে এমন বহু সুযোগ, বহু সমস্যার সমাধান আপনি দেখতে পাবেন যেটা নৈতিকতার চশমা পরে থাকলে নাও দেখতে পারেন।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হোলো ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান যার পেছনে সবচেয়ে বড় দুটো প্রভাবকের একটি ছিলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (মামলাটির সরকারী নাম ছিলো ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার’)। আমরা জানি যে রাষ্ট্রদ্রোহের এই মামলাটি ছিলো মিথ্যা ও নিবর্তনমূলক। কিন্তু এই মামলার একজন আসামী (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা) সহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা প্রকাশ্যে জানিয়েছেন যে মামলাটি মিথ্যা ছিলো না। সবকিছু বাদ দিয়ে নৈতিকতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একবার নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করুন তো, মামলাটি সত্য হলে এবং কোনো রাষ্ট্রের আওতায় থেকে এর অখণ্ডতাকে ভাঙতে চাইলে প্রচলিত আইনে একে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে কি না? কিন্তু আমরা সে প্রয়াসকে এভাবে দেখি না, কারণ নৈতিকতার ওপরে আমরা স্থান দেই সময়ের প্রয়োজন, কার্যকারিতা – এসবকে।

আমার বক্তব্য ছিলো এটাই; কেওস-কন্টক পৃথিবীতে সাফল্যের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সক্ষমতার। যে নৈতিকতা সক্ষমতাকে নিস্তেজ করে সে নৈতিকতাকে মহিমান্বিত করার আগে দুবার প্রশ্ন করুন, হয়তো কাজে দেবে।

(ছবি ইন্টার নেট থেকে মাইকেল ফ্ল্যাম এর তোলা ও Imagevat থেকে নেয়া ছবি)

আপনি কি চেষ্টা করেছিলেন তাকে থামাতে?

6

ক্লাস টেনের এক ক্লাস রুম। প্রতিদিন সকালে কেউ এসে ক্লাসের সবার চোখে পড়ে এমন একটা জায়গায় মেথামফেটামিন (য়াবা) রেখে যায়। প্রথম কিছুদিন কেউ ছুঁয়ে না দেখলেও শেষ পর্যন্ত কয়েকজন ধরেই ফেলে ড্রাগটা। মনে রাখবেন – সবাই না, কয়েকজন।

এই এডিকশানের জন্য দোষী কে?

এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে দেবে। যে সব ছাত্র য়াবা খাওয়া শুরু করলো না তারা বলবে কৈ আমরা তো খাই নি; যারা খেয়েছে তারাই দোষী। যারা খাওয়া শুরু করলো তারা বলবে এখানে না রাখা হলে আমরা য়াবা খেতাম না। আওয়ামী লীগ বলবে এটা এইট পাশ খালেদার কাজ আর বিএনপি বলবে আওয়ামী লীগের আমলে সামান্য ক্লাসরুমও য়াবার থাবা থেকে রক্ষা পায় নাই। বাম-পন্থীরা সারা পৃথিবীর দোষ খুঁজে পাবে শুধুমাত্র ক্লাসরুমের ছেলেপুলে ছাড়া। সুশীলরা বলবে কি এক সময় আসলো যে বাচ্চারা রবীন্দ্রনাথ না পড়ে য়াবায় পড়ে থাকে – এজন্যেই কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? আর ইসলামিস্টদের ব্যাখ্যা বরাবরই খুব সহজ – মুসলমানের ঈমান কমজোড় হয়ে গেলেই সব আপদ।

আমি আইডিয়ালিস্ট নই, হার্ডকোর রিয়ালিস্ট। আমার ব্যাখ্যা সাদাসিধা । যারা য়াবা খাওয়া শুরু করলো, তারা ক্লাসে য়াবা না পেলেও কোনো না কোনো দিন হয় তো শুরু করতো কিন্তু “আমি যদি পাখি হতাম” লাইনের যুক্তিতর্কে আমার রুচি নেই। বাস্তবতা হোলো বাচ্চা বাচ্চা দশটা ছেলের হাতের নাগালে ড্রাগ রাখলে সবাই হয়তো খাবে না কিন্তু কয়েকজন খাবেই খাবে – এর অন্যথা হবে না। এটা আপনি আটকাতে পারবেন না। কাজেই দোষী সে যে ড্রাগটা ওখানে রাখে প্রতিদিন। পাগলকে সাঁকোর মাঝখানে যে মনে করিয়ে দেয় পাগল ভালো হয়ে গেছে – দোষটা তার, পাগলের না।

আমি বলছি না যে আমার দৃষ্টিভঙ্গিই একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। আপনি যদি এ সমস্যা নিয়ে কবিতা লিখতে চান তাহলে, হয়তো বামপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি কাজে দেবে। যদি ফেসবুকে লাইক চান, সম্ভবত সুশীলদের দৃষ্টিভঙ্গি কাজে দেবে। কিন্তু আপনি যদি সমস্যার সমাধান করতে চান তাহলে একমাত্র আমার দৃষ্টিভঙ্গিই কাজে দেবে। হ্যা, কেবলমাত্র রিয়ালিস্টরাই যে কোনো সামাজিক সমস্যার টেকসই সমাধান দিতে পারে। আইডিয়ালিস্টরা সমস্যাকে ঘনীভূত করে।

আজকে বাংলাদেশের সমস্যা জটিল। আপনি নানানভাবে আপনার সুবিধামতোন এর ব্যাখ্যা করতে পারেন। বিজ্ঞানীদের এর চেয়েও জটিলতর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় হর-হামেশা (তবে সে সব সমস্যার কারণে মানুষ মরে না)। তারা সফল হন খুব বেশি কারণ তারা অসম্ভব জটিল সমস্যার সরলতম ন্যারেটিভ বের করতে পারেন – মানে ঐ “মোদ্দা কথায়” যেতে পারেন তাড়াতাড়ি। ছোটো মানুষেরা ফালতু আলাপে দিনভর থাকেন পেরেশান। মতিকন্ঠ করে, অপছন্দের মানুষটিকে খুবই ক্রিয়েটিভ, মনপসন্দ গালি দিয়ে আপনার পিংপং বল সাইজের ইগোটা একটু ফুলে টেনিস বল হয়ে উঠতে পারে বৈকি কিন্তু তাতে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।

আজকের বাংলাদেশী রাজনীতির স্টেল মেটের “মোদ্দা কথাটা” তাহলে কী?

বাংলাদেশের মানুষ ভোট দিতে খুব ভালোবাসে এবং এই কাজটার মাঝেই তাদের নাগরিক কর্তব্য সম্পন্ন করতে চায়। গণতন্ত্রের একমাত্র বিষয় ভোট না, কিন্তু প্রথম বিষয় ভোট। কাজেই জনগণের এই স্বপ্নটা ন্যায্য (তাদের আরোও অনেক স্বপ্ন দেখার কথা ছিলো, যেটা তারা দেখে না)। সমস্যা হোলো খালেদা কিংবা হাসিনা কিংবা তাদের দল ভোটগ্রহণের কাজটা নিরপেক্ষভাবে করবে এটা কেউ বিশ্বাস করে না – এবং ন্যায্য কারণেই করে না। কিন্তু হাসিনার খুব সাধ ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার। এই সাধ হওয়াটা দোষের না কিন্তু তিনি চান খালি মাঠে গোল দিতে। মানে হয় একাই নির্বাচন করে জিতবেন, নয়তো ভোটে ইয়ে করে জিতবেন। সেজন্য তিনি সংবিধানটাকে দেবব্রত চাকীর অঙ্কের নোটবই বানিয়েছেন (এই নোটবই নাকি ছয়ের দশক থেকে আছে, আমাদের সময়েও ছিলো, চাকী সাহেব মরে ভূত, সিলেবাস বদলেছে সতেরবার কিন্তু “দেবব্রত চাকী নোটবই” টিকে ছিলো – আছে হয়তো এখনো)।

বাস্তবতা হোলো আপনি যখনই বাংলাদেশে এলেকশান নিয়ে চাতুরীর আশ্রয় নেবেন, টালবাহানা করবেন; আন্দোলন হবে, মানুষ মরবে। এটা রিয়ালিটি। শেখ হাসিনা ঠিক এই কাজটা করেছেন এবং করছেন। এটা সত্য এবং তা অস্বীকারের উপায় নেই। দায়ের কথা বলার, বিচার করার সময় পড়ে আছে। এখন দরকার এই মানুষ মারার রাজনীতি বন্ধ করা।

এখান থেকে বেরিয়ে আসার কেবল একটিই উপায় আছে। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। কারণ হাসিনা বা খালেদার আন্ডারে কোনো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব না। তার চেয়েও সত্য কথা: হাসিনা পদত্যাগ না করলে হত্যার রাজনীতি বন্ধ তো হবেই না – সম্ভবত আমরা এমন একটা phase এ ঢুকে যাবো যেখান থেকে বেরিয়ে আসতে এক প্রজন্ম ব্যয় হয়ে যেতে পারে – য়েস ইট ইজ দ্যাট সিরিয়াস।

                              ………………………………….

বাংলাদেশের এক নাম করা ইংরেজি কলামিস্টের সাথে আলোচনায় টিপিকাল সুশীল মানসিকতার পরিচয় পেলাম – এটা আলোচনা করা দরকার। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে তার মত হোলো Why doesn’t the two hire a place and fight it out and leave us alone. এটা কোনো ছাগু বা চেতনাইজড লো লাইফের কথা না, সার্টিফায়েড এল্ডার সুশীলের কথা। ফেসবুকেও এই লাইনের হাজার হাজার মানুষ আছে। তোমারা লীগ, বিএনপি মারপিট করো – আমাদেরকে দু দণ্ড শান্তি দাও।

এই খোকাবাবুরা মনে করেন যে বিএনপি-লীগ তাদের থেকে আলাদা কোনো এক স্ফেয়ারে ফাংশান করে। তারা নিজেরা মারপিট করলে করুক – আমাদের বাউন্ডারীর মধ্যে না ঢুকলেই হোলো। এই ভদ্রলোকের ইতিহাসের ওপর যথেষ্ট কাজ থাকা সত্ত্বেও এতোটুকু জানেন না যে পীস টাইম কোনো “রিয়ালিটি” না, কন্ডিশান। শান্তি ওহী মারফৎ নাজিল হয় না। এর জন্য নাগরিকদের তার দায় শোধ করতে হয়। যখন হাসিনার মাঝে বাংলাদেশের সংবিধান, জুডিশিয়ারি, নির্বাহী বিভাগ সব ফানা ফি হাসিনা হয়ে যাচ্ছিলো তখন “ইয়া হাসিনা ইয় লীগ” বলে জিকির করে এখন যদি আশা করেন হুট করে সব সুন্দর হয়ে যাবে তাহলে দুঃখিত: জিকিরের আগে একটু ভালো মন্দ কিছু খেতেও হবে।

Image

এই দেশটা শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়ার কোনো সম্পত্তি না – এই কথাটা সবাই বিশ্বাস করে কিন্তু যা বিশ্বাস করে না তা হলো – এই দেশটা আমার, আমি ওন করি এবং আমার দায় আছে পরবর্তী প্রজন্মকে একটা বাসযোগ্য দেশ উপহার দেয়ার। তাই আমাদের সবার দায় আছে এটা নিশ্চিত করার যে কোনো মানুষই যেন এই দেশটাকে তার ইচ্ছার পুতুল বানিয়ে না ফেলে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রিয়ালিটি – আপনার কাজ শুধু ভোট দেয়া না, এই দুটো দলে যেন কখনোই কোনো হাসিনা কেউ হয়ে উঠতে না পারে, সেদিকে নিশ্চিত না করলে নিশ্চিত থাকুন: আপনি আপনার নিজের শান্তিটুকু খোয়াবেন। আপনি জিজ্ঞেস করুন নিজেকে সততার সাথে – আপনার সন্তান যদি কখনো প্রশ্ন করে, সে উত্তর দিতে যতোটুকু সততা লাগে ততোটুকু সততার সাথে, দেশটাকে যখন হাসিনা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তার খেলনা ঘর বানিয়ে ফেলছিলেন আপনি কি আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন তাকে থামাতে?

শাহবাগীদের দেশপ্রেম

19

এই শিরোনামের জন্য আমি লজ্জিত এবং দুটো ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে মনে করি। প্রথমত: শাহবাগী বলতে হালকাভাবে যাদের বোঝানো হয় তারা অনেকেই এই নামে ডাকাটাকে অপমানজনক মনে করেন। তবে এই বিশেষ গোষ্ঠীকে এছাড়া অন্য যেসব শব্দে বিশেষায়িত করা হয় যেমন চেতনা-ব্রিগেড, চেতনাইজড – সেগুলো আরো আপত্তিকর মনে হয়েছে। তাই এ লেখায় অপেক্ষাকৃত কম আপত্তিকর বিশেষ্যটায় আস্থা রাখা হোলো – আশা করি আপনারা ব্যাপারটা স্পোর্টিংলি নেবেন।

দ্বিতীয়ত: অনেকেই আশা করেন যে কারো দেশপ্রেম নিয়ে ক্রিটিক করতে হলে নিজের দেশপ্রেম স্পষ্ট করাটা জরুরী। এই প্রসঙ্গে ভণ্ডামীর  কোনো অবকাশ যেন না থাকে সেজন্য প্রথমেই বলে রাখি, আমি নিজেকে দেশপ্রেমিক বলে দাবী করি না। আধুনিক কালে যেই বিশেষায়িত আবেগকে “দেশপ্রেম” হিসাবে হাজির করা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, আমি তার ঘোরতর বিরোধী – কিন্তু সেটা ভিন্ন আলাপ। যারা দেশপ্রেমের সাগর কেচে ফেলেন অনুদিন, তারা যে স্ট্যান্ডার্ডকে দেশপ্রেম বলেন – কথা দিচ্ছি আমি কেবল সেই স্ট্যান্ডার্ড নিয়েই কথা বলবো। নিজের বিশ্বাস টেনে এনে ঘোট পাকাবো না – এটা আমার প্রতিশ্রুতি।

প্রথম নোক্তা: কারা শাহবাগী?

অনেকগুলো মেয়ের মজলিশে সুন্দরীতমাটি কে – এটি সনাক্ত করা খুব সহজ – সবাই ঠিক জেনে যায় পলকেই – কিন্তু ব্যাখ্যা করাটা কঠিন। শাহবাগী কে, এটাও ব্যাখ্যা করা সহজ না – you just know it। কিন্তু প্রয়োজন আছে ব্যাখ্যা করার। আমি একটা এসিড টেস্ট বের করেছি – শাহবাগী শনাক্ত করবার। অনেকটা সাইকোলজিকাল টেস্টের মতোন একটা প্রশ্ন।

ধরা যাক (আবারও বলছি – ধরা যাক। বাস্তবে এই অবস্থা তৈরী হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই) সৌদী আরব বললো যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে হবে। যদি না করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব শ্রমিকদের দেশে ফেরৎ পাঠানো হবে। কথার কথা হিসাবে ধরে নিচ্ছি যে বাংলাদেশের রেমিটেন্সের ৮০ ভাগ আসছে সৌদি আরব থেকে এবং রেমিটেন্স বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত – অঙ্কের হিসাবে জিডিপির ৫০ শতাংশ। এমন অবস্থা হলে আপনি কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার পক্ষে থাকবেন?

আমার পরিচিত যে কজন শাহবাগীকে জিজ্ঞেস করেছি সবাই বলেছেন যে না, বিচার বন্ধ করা যাবে না। বাকীরা স্বাভাবিক অবস্থায় যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইলেও এমন অবস্থায় পিছু হটবেন। (দয়া করে এটাকে আক্ষরিক অর্থে এসিড টেস্ট মনে করবেন না – এটি আমার পর্যবেক্ষণ মাত্র)

অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের বিচারকে শাহবাগীরা স্থান, কাল, পাত্র, বাস্তবতা এসবের ঘেরাটোপে বাঁধতে রাজী নন, এই দাবী এবং এই প্রসঙ্গটি তাদের কাছে একটি আইনী প্রসঙ্গ যতোটুকু তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী একটি “পবিত্র” বিষয়, “চেতনার” বিষয়। স্পষ্টতই যে অপরাধ তারা নিজেরা করেন নি (অর্থাৎ চল্লিশ বছর ধরে বিচার না হওয়াটা) সে অপরাধের দায়ভার নিজেদের ওপর চাপিয়ে তারা উচ্চ নৈতিকতায় আক্রান্ত হন (তারা প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন) এবং সেই অপরাধের শাস্তি চাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধ/পবিত্র করে তুলতে চান। পুরো ব্যাপারটাকে তারা প্রচুর ও প্রচুর সিম্বলিজম এবং শক্তিশালী সংস্কার সহযোগে ধর্মাচারের খুব কাছাকাছি নিয়ে যান।

Image

আমি এই মানুষগুলোকে খুব গুরুত্বসহকারে ও কৌতুকভরে পর্যবেক্ষণ করি, বোঝার চেষ্টা করি। যে বিশেষত্ত্ব আমি সবসময় লক্ষ্য করি তা হলো – দেশ, ৭১, গণতন্ত্র, জামাত, পাকিস্তান, বঙ্গবন্ধু এবং ছাগু – এসব শব্দের উপূর্যপুরি ব্যবহার, অবিরাম ব্যবহার। যেকোনো সচেতন পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে তারা গণতন্ত্র, পশ্চিমা “উদারনৈতিক” মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমকে খুবই উচ্চ আদর্শ মানেন এবং সে মতে অনুশীলনও করেন।

কিন্তু বাস্তবটা ভিন্ন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে তাদের প্রায় সবার প্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে যে শেখ হাসিনা একটি এক ব্যক্তির আজ্ঞাবহ গোত্রে পরিণত করেছেন তার বিরুদ্ধে অন্তত একটা বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান নেয়ার কথা ছিলো। আওয়ামী লীগের হয়ে এলেকশান করা এক রাজনীতিবিদ আমাকে বলেছেন যে শেখ হাসিনার চেয়ে বড় একনায়ক ভারতবর্ষের ইতিহাসে কখনো আসে নি। যতোবড় একনায়কই হোক, অন্তত পার্টি-মেন কিংবা জেনারেলদের সাথে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত দেন। সিনিয়র মেম্বারদের মতামত আপনি নেবেন কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ কিন্তু একনায়করা অন্তত আলোচনা করেন। শেখ হাসিনা এ প্রয়োজনটুকুও বোধ করেন না। দলের মহাসচিবও জানেন না তিনি কী করবেন।

তাদের প্রিয় দলের নেত্রী যে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুরো দেশটাকে বিস্ফোরণমুখ করে ফেলেছেন এবং এর দায়ভার যে প্রায় এককভাবে তার (আওয়ামী লীগের বহু দায়িত্বশীল নেতা পার্টির ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের বিরোধিতা করেছেন বলে তাদের দায়ভার কম) – এই কথা কোনো সুস্থ মানুষ অস্বীকার করতে পারবেন বলে মনে হয় না, কিন্তু বিস্ময়করভাবে নন-রেসিডেন্ট শাহবাগী, যাদের অনেকেই খুব ভালো পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ডিগ্রী করছেন তারাও কোনো উচ্চ-বাচ্য করেন না। এমন কি অনেকে এখনো এই বিষয়ে হাসিনাকে সমর্থনও করেন। এত মানুষ মারা যাচ্ছে এক ব্যক্তির এরকম গোয়ার্তুমির কারণে – দেশপ্রেমিক হলে এই অবস্থা জাস্টিফাই করার কথা ছিলো না।

এ পর্যবেক্ষণ থেকে আমি প্রথমত এই সিদ্ধান্তে আসি। আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন কোনো ভুলই করা সম্ভব না যার কারণে শাহবাগীরা তাদের সমর্থন তুলে ফেলবেন এবং বিএনপির পক্ষে এমন কোনোই ভালো কাজ করা সম্ভব না যার কারণে তাদের সমর্থন করা যায়। চল্লিশ বছর আগে যে যা করেছেন সেটিই চূড়ান্ত ও পরম। অনুভব করি যে অন্তত রাজনৈতিক সমর্থনের ব্যাপারে তারা ধার্মিকদের মতোন আচরণ করতে সচ্ছন্দ।

Image

কিন্তু এটা কোনো অভিনব বিষয় না। বিএনপির সমর্থকদের মধ্যেও আমি এ ধরনের মানুষ দেখেছি। আমার কাছে অভিনব লেগেছে দেশ ও দেশপ্রেম – এই বিষয়গুলোকে তারা কীভাবে দেখেন – এই ব্যাপারগুলো। শ্রদ্ধেয় এবং আমার দেখা মেধাবীতম বাঙালিদের একজন আবেদ চৌধুরীর ভাষা ধার করে বলি – যারা MIT’র ল্যাবে বসে পৃথিবী বদলে দেয়ার বদলে ৭১ এর জুলাই মাসে মেহেরপুরে কতো রাউন্ড গুলি করা হয়েছিলো – এই চিন্তায় দিনগুজার করেন তারা আর যাই হোক, সুতীব্র অনুভুতি যে পোষণ করেন – এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।
তা এই অনুভূতিকে কি আমরা দেশপ্রেম বলবো?

কোনমতেই না। কারণ এই একই মানুষ ঘটমান বর্তমানে নিজের দেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর পুলিশ বাহিনীর গুলি চালানোকে মনে করেন কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ, এই একই মানুষ ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী পালন করেন অথচ সেই দিনেই বিরোধী মতের রাজনীতিবিদ গুম হলে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেন না। শুধুমাত্র বিএনপি কিংবা জামাত করার কারণে রাষ্ট্র এখন বহু সাধারণ কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা ক্ষেত্র বিশেষে ৭১ এর চেয়েও ভয়াবহ কিন্তু এসব ব্যাপারে তারা মতিকন্ঠ করেন।

দেশের অর্ধেক মানুষকে বাদ দিয়ে “দেশপ্রেম” করা যায় কি?

তাহলে তারা যা করেন সেটা কি?

আমার ধারণা শাহবাগীরা তাদের পছন্দের একটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ডে থাকেন। এই “থাকার” একটা বিশেষত্ত্ব আছে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে তাদের কিছু আইডিয়া, কিছু টোটেম, কিছু মাসকট, কিছু ইভেন্ট আছে যেগুলোকেই তারা বাংলাদেশ বলে মনে করেন। ব্যাপারটা বোঝানো একটু কঠিন – তবু চেষ্টা করি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন – এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু শাহবাগীদের সাইকোএনালিসিস করলে আমার ধারণা দেখা যাবে যে দাড়িপাল্লার এক পাশে বাংলাদেশ, আরেক পাশে মুক্তিযুদ্ধ রাখলে তারা মুক্তিযুদ্ধ নামক “ইভেন্ট”টিকে বাংলাদেশের চাইতেও বড় মনে করবেন। আরো গহীনে গেলে আমার মনে হয় দেখা যাবে যে ৭১ এর আসল ঘটনা না, মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভটাই তাদের কাছে সবচেয়ে প্রেশাস। কারণ মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস কি তার চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হোলো এই ন্যারেটিভটাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে তারা নিজেদের পবিত্র, নৈতিক, মহান – এসব মনে করতে পারেন। তারা তাদের “দেশের” এমন “আলাদা বিষয়গুলোকে” প্রবলভাবে ভালোবাসতে সক্ষম কিন্তু বিষয়গুলো এক করতে পারেন না – সেজন্যই সেটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ড।

কেন এমন হয়?

আমার ধারণা “বাংলাদেশ” নামক রাষ্ট্রটিকে দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে ভালোবাসা খুব কঠিন – বিশেষ করে এখন যাদের বয়স ৩০ এর কম তাদের জন্য। কোনো অসুন্দর জিনিস দীর্ঘদিন ভালোবাসা যায় না। যারা আগ্রহী তারা ষাট, এমন কি আশির দশকের ঢাকার স্টিল ফটোগ্রাফ দেখতে পারেন। অপূর্ব সুন্দর, ছিমছাম এক নগরী। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বইয়ে (প্রকাশকাল জুন ‘৭১ – সম্ভবত) কাজী আনোয়ার হোসেন ঢাকাকে উল্লেখ করছেন “রমনীয়” ঢাকা বলে। সুন্দরকে ভালোবাসা যায়, ভালোবাসতেই হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না আমাদের বাবাদের প্রজন্ম যে যুদ্ধ করেছিলেন তার মূল কারণ ছিলো তারা তাদের মেমোরীকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, যে মেমোরী হোলো তাদের শৈশব ও কৈশোরের “সুন্দর” একটা দেশ, যাকে রক্ষা করা যায়, করতে হয়। কিন্তু আজকের ঢাকা কুৎসিত, পুরো দেশে শুধু মানুষ আর মানুষ, চারদিকে শুধু কংক্রিট। মানুষগুলোও বদলে গেছে – মুদির দোকানী থেকে প্রধানমন্ত্রী, সবাই অকারণে যখন-তখন মিথ্যা বলছেন। টিভি খুলবেন – বাজে খবর, পত্রিকা খুলবেন তো ভয়ঙ্কর খবর। শহরটাকে যে একটু অন্য চোখে তাকাবেন, সেই সময়টুকুও নেই।

কার্যকারণের সমন্বয় খুঁজতে গেলে এই দেশকে ভালোবাসা, রীতিমতোন এক এইচএসসি পরীক্ষা।

কিন্তু স্কুলে আপনাকে প্রাইম করা হয়েছে দেশকে ভালোবাসার জন্য। ইসলাম শিক্ষায় পড়েছেন “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ”, বাংলা বইয়ে পড়েছেন “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা”/ নিজের ভাইকে যদি আপনি ভালো না বাসেন আপনি বড়জোর হৃদয়হীন মানুষ, কিন্তু খারাপ নন। অন্য দিকে নিজের দেশটাকে যদি ভালো না বাসেন, আপনি “অনৈতিক” মানুষ। “দেশপ্রেম না থাকা” আর “বিশ্বাসঘাতকতা” বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি বিষয়।

আপনার মনের শিক্ষিত অংশ বলছে দেশকে ভালোবাসতে হবে কিন্তু ইনসটিংটিভ অংশ প্রশ্ন করছে এই দেশকে কি ভালবাসা যায়?

তা এই টানাপোড়েনের প্রতিক্রিয়া কী? আপনি পেছনে তাকাবেন এবং এমন কিছু ব্যক্তি, ইভেন্ট ও ধারণা বেছে নেবেন যার একটা অতি সরল ন্যারেটিভ আছে এবং এই ইন্ডিভিজুয়াল বিষয়গুলোকেই বাংলাদেশ বলে ভাবতে শুরু করবেন (সেহেতু তা “রক্ষা” করা যায়) / এটাই দেশপ্রেম, এটাই চেতনা।

আমার ধারণা শাহবাগীরা এই ভাবেই দেশটাকে দেখেন।

এর একটা খুব বড় সুবিধা আছে। যেহেতু আপনার “দেশ” আসলে আলাদা আলাদা কিছু ইভেন্ট এবং যেহেতু এই ইভেন্টগুলো বাস্তবতার উর্ধ্বে (আপনার কাছে) সেহেতু এই ইভেন্টগুলো নিজেরা খুবই ফ্লুয়িড। যেকোনো ব্যাখ্যা, যে কোনো নির্দেশ যতোক্ষন আপনার পক্ষে যায়, মনে হবে যে এটাই সত্যি। আগ্রহীরা হয়তো দেখেছেন যে দেওয়ানবাগী পীর ওয়াজে বলছেন যে তার স্ত্রী আসলে বিবি ফাতিমা এবং যেহেতু বিবি ফাতিমা তার “ভেতরে” আছেন সেহেতু তার সাথে রাসুলের একটা “যোগাযোগ” তৈরী হয়েছে এবং এই যোগাযোগের কারণেই তার মুরীদেরা তাকে রাসুল হিসাবে স্বপ্নে দেখেন। মজার ব্যাপার হোলো এই কথাগুলো যখন তিনি বলেন তখন তার ভক্তরা তাকে তীব্রভাবে সায় দেয়। ধার্মিকেরা যখন এই ভিডিও দেখেন তখন অগ্নিশর্মা হয়ে যান এবংসহজ প্রশ্নটি করতে ভুলে যান যে ভক্তদের কাছে কেন এটা রিয়ালিটি বলে মনে হয়?

কারণ দেওয়ানবাগীর ভক্তদের কাছে দেওয়ানবাগী একটা “প্রটেকটেড ইভেন্ট” – তাকে বাস্তবতার ধার ধরতে হয় না। আর যখন কোনো ইভেন্টকে আপনি বাস্তবতার উর্ধ্বে উঠিয়ে ফেলতে পারেন তখন এই ইভেন্ট “ইতিহাস” থাকে না, একটা অর্গানিজমে পরিণত হয় – সেল্ফ সার্ভিং অর্গানিজম। আমি একবার একটা সামান্য পরীক্ষা করেছিলাম, ঘটনাটা খুবই ইন্টারেস্টিং। আমার এক তীব্র আওয়ামী সমর্থক বন্ধুকে একটা গল্প বলেছিলাম, দেওয়ানবাগীর গল্প থেকে খুব আলাদা না। আমি খুব সিরিয়াসলি তাকে বলা শুরু করলাম যে মাত্র নয় মাসে যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে এর আসল কারণ বঙ্গবন্ধু। তিনি যে লায়ালপুর কারাগারে ছিলেন এটা পুরোপুরি সত্য না। প্রথমে বন্দী থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ সময় তিনি মস্কোতে ছিলেন এবং মস্কোতে তিনি ইস্টার্ন ব্লকের হয়ে দর কষাকষি করছিলেন আমেরিকার সাথে। গল্পটা বিশ্বাস করানোর জন্য প্রচুর নথিপত্রের উল্লেখ করলাম, বললাম যে – পুরোপুরি স্বীকার না করলেও প্রাভদা এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস এর অমুক তারিখের এডিটরিয়ালে এর উল্লেখ আছে।

আমার এই বন্ধুটি সম্ভবত বাসুদা এবং মেজবাহ আহমেদের পর্যায়ের শাহবাগী নন কিন্তু মজার সাথে লক্ষ্য করলাম যে একটিবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করলেন না যে পাকিস্তান কেন বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেবে মস্কোতে যাওয়ার জন্য এবং মস্কো থেকে তিনি পাকিস্তানে ফেরতই বা আসলেন কী করে?

এটাকেই আমি বলেছি “ফ্লুয়িড” এবং ফ্লুয়িড বলেই পুরো ঘটনা আর কোনো ঐতিহাসিক ইভেন্ট থাকে না – হয়ে যায় একটা অর্গানিজম। এখানে একজন লাকীর প্রয়োজন হবে স্লোগান দেয়ার জন্য, একজন মাহবুব রশীদ দেবেন ফেসবুক স্টেটাস, মেসবাহ আহমেদ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার ফাঁকে এসে আমাদের জানাবেন এক দেশে দুই আইন থাকার বিপদ এবং বাসুদা অনুরোধ করবেন সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য। ইতিহাস আর কোনো ঘটনা থাকে না, হয়ে যায় একটা প্রাণী – যে বদলে যায়, সরে যায়। যে অরক্ষিত হতে পারে এবং যার সম্ভ্রমহানিও হতে পারে।

Image

শুধুমাত্র – আবারও বলছি – শুধুমাত্র “চেতনা”ই পারে এই প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। কেন?

কারণ চেতনা হোলো এক গোছা বিশ্বাস যাকে আপনি যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বে প্রায়োরিটি দেন। আপনি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে এই বিশ্বাসগুলোই আপনার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই শেষ না – আপনার সামনের মানুষটিকেও চেতনা করতে হবে – কেননা আপনি তাকে বিচার করবেন আপনরা চেতনা দিয়ে। ওইজা বোর্ডে যেমন আপনার অবচেতনের শক্তি আঙ্গুল নাড়িয়ে ডেকে আনে আত্মা, ঠিক তেমনি চেতনার সমস্মর, নিয়ন্ত্রণ করে ইতিহাস নামক প্রাণীটিকে। বর্তমানে বসে আপনি বদলে দেন অতীত। পারেন না বদলাতে শুধু বর্তমান।

এই যে আপনার ধর্মের মতো বিশ্বাস যাকে আমি ধর্মই বলি, শাহবাগীরা ভালোবেসে তার নাম দিয়েছে দেশপ্রেম।

photo credit: Maciej Dakowicz, Zakir Hossain Chowdhury    

শেষ হোলো আমার শৈশব

Image

টেন্ডুলকার আমার কাছে শুধু শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানই নন, আমার কৈশোরের সাথে শেষ যোগসূত্রও – যতোবার তাকে দেখি, মনে হয় কোনো এক অদ্ভূত কারণে, সোনার দিনগুলো আমার আছে মোহাফিজ। এই লোকটার ব্যাট দিয়েই আমি যেকোনো সময়ে চলে যাবো সেই নব্বুই এ – ইচ্ছে হলেই। ব্যাট হাতে টেন্ডুলকার মানেই আমার কৈশোরের সেই নানান রঙের দিনগুলো।

আজকে যারা কিশোর তাদের পক্ষে কল্পনা করা কঠিন হবে ৮০’র দশকে কী বোরিং ক্রিকেট খেলতো ভারত। শ্রীকান্ত আর আজহার ছাড়া ধুন্ধুমার কোনো ব্যাটসম্যান নেই। কপিল মাঝে মাঝে পেটাতে পারে এবং ওই একটি মাত্র বোলার – বাকী সব কে কার থেকে স্লো বল করতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। ৮৮ সালে এশিয়া কাপ ক্রিকেট হয়েছিলো ঢাকায়, প্রথম বড় ধরনের আয়োজন। টিভিতে কমেন্টেটর ছিলো আলী জাকের, আজকের হিসাবে খুবই গরিবী আয়োজন কিন্তু ক্লাস ফাইভের এই ছেলেটার কাছে পৃথিবী বদলে যাওয়া ঘটনা (আজকের কিশোরদের কাছে কল্পনা করা হয়তো সম্ভবই না যে ৮৯ সালে ঢাকায় একটা আন্তর্জাতিক কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়েছিলো এবং সেটা লাইভ দেখানো হয়েছিলো টিভিতে। সেই বিজ্ঞ কমেন্ট্রি থেকেই জানতে পারি যে প্যাচ যেটাই হোক কমেন্টেটর সেটাকে বোস্টন ক্র্যাবই বলবেন। আমার কাছে সেটাও ওয়ার্ল্ড চেঞ্জিং ইভেন্ট) । মনে আছে আরশাদ আইয়ুব নামের এক অখ্যাত অফ স্পিনার (রাজেশ চৌহানের ঠিক আগে খেলতো ভারতের হয়ে) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নিয়ে বসে ২০ না ২১ রানে। কিন্তু গ্যালারিতে ভারতের একেবারেই সাপোর্ট নেই। মানে একটাও তালি পড়ে না, কিন্তু পাকিস্তানের জন্য দর্শকরা হাত ফাটিয়ে ফেলছে। আমার কাছে তখন মনে হয়েছিলো এটা মুসলমানির কারবার। কিন্তু এই একই মাঠে ১০ বছর পরে যখন পাকিস্তান ইন্ডিয়া ম্যাচ হোলো তখন বলা যায় সাপোর্ট ৬০-৪০ (পাকিস্তানের পক্ষে)। কারণটা আসলে ধর্ম ছিলো না, ছিলো টেন্ডুলকার। দশ বছর আগের এক বোরিং টিম শচিনের হাত ধরে হয়ে গেছে ফাইটিং আউটফিট।

আমাদের চেয়ে যারা দশ বারো বছরের বড় তাদের থেকে নিয়ে আমরাই শেষ – এ পর্যন্ত যে প্রজন্ম – তাদের কাছে ইমরান খান যে ড্যাশিং ফাইটার, আমাদের পর থেকে আজকের ছানাপোনা এই দীর্ঘ প্রজন্মের কাছে টেন্ডুলকার ঠিক তাই। ইমরান খানের সাপোর্টার থেকে আমাদের প্রজন্ম হয়েছিলো পাকিস্তানের সাপোর্টার, আর টেন্ডুলকারের সাপোর্টার থেকে আমাদের পরের প্রজন্ম হয়েছে ভারতের সাপোর্টার।

আমার ছেলেবেলা কেটেছে ওল্ড ডিওএইচএসে – সেখানে ৮৯ সালেও প্রায় পুরো বছর ক্রিকেট খেলা হতো। কায়সার হামিদের ভাই সোহেল হামিদ সেখানে তখন ষ্টার ক্রিকেটার। জাতীয় দলের হয়ে খেলা পেস বোলার হাসিবুল হোসেন তখন উঠতি তারকা মাত্র ক্লাস সেভেন-এইটেই। ওখানেই মনে হয় প্রথম শুনি যে ইন্ডিয়ার একটা বাচ্চা ছেলে খুব ভালো খেলে। ৯০ এ চলে যাই ক্যাডেট কলেজ। ক্যাডেট কলেজগুলো এখন কী রকম জানি না তখন কিন্তু পুরোপুরি ফুটবল প্রধান ছিলো। তবে বহু ক্যাডেট খেলার খবর রাখার দিক থেকে প্রাণান্ত ছিলো। আশ্চর্যের বিষয়: প্রায় কেউই ইন্ডিয়ার ডাই হার্ড ফ্যান ছিলো না (আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ফাইয়াদ ভাই ছাড়া)। কিন্তু টেন্ডুলকার বিষয়ে সবারই খুব আগ্রহ ছিলো। ভিনোদ কাম্বলির সাথে ৬শ রানের পার্টনারশিপের কথা সবার মুখে মুখে।

অবস্থা বদলে যায় ৯২ এর বিশ্বকাপের পরে। ক্রিকেট দেখাটা অনেক সহজ হয়ে যায় এবং খেলার পরিমাণও বাড়তে থাকে। মনে আছে পাকিস্তানের সাথে খেলায় কাম্বলি আর টেন্ডুলকার ব্যাটিং করছিলো (এই দিনটায় আমরা কলেজ থেকে ছুটিতে বাড়ি আসছিলাম) আর বল করছিলো ইমরান খান। দুজনের মিলিত বয়স ইমরানের সমান না। কিন্তু কী দারুন ছিলো টেন্ডুলকার।

ওই বয়সের একটা বিশেষত্ব ছিলো কীভাবে প্রমাণ করা যায় আমি যে টিম সাপোর্ট করি সেটাই বেস্ট এবং অন্য টিম কেন ধর্তব্যই না সেটাও প্রমাণ করা। ইন্ডিয়া যে বাজে টিম পরিসংখ্যানের দিক থেকে প্রমাণ করা খুব সহজ ছিলো। ইন ফ্যাক্ট ইন্ডিয়া উইনিং টিম হয়েছে এই তো সেদিন – ২০০৩ এর দিকে এসে। কিন্তু একজন ব্যাটসম্যানকে প্রায় সবাইই সমীহ করতো- সেটা ছিলো টেন্ডুলকার।

কোনো swagger নেই এমন একটা স্পোর্টসম্যানকে সবাই ভালোবাসে তার বিনয়ের জন্য, বিষয়টা কল্পনা করা খুব কঠিন – শচীন সেটা করে দেখিয়েছে। সত্যিই আশ্চর্য এই মানুষটা। কোনো একটা কাজ ২৪ বছর ধরে সমান উদ্যমে মানুষ ভালোবাসে কী করে এটাই আমি বুঝে পাই না।

টেন্ডুলকারকে আর দেখা যাবে না এটা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার শৈশবের এই মানুষটাকে আর দেখা যাবে না খেলার মাঠে, ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। বড় আমি হয়েই গেলাম তাহলে, শেষমেষ।

আপনি ঘুমান কী করে, প্রধানমন্ত্রী?

28

কর্নেল এরশাদের দীর্ঘ চাকরিজীবনের বাকি ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। ‘সেদিন’ ছিল তার জন্মদিন। কথা ছিল সে রাতে তারা যাবেন আইসক্রিম খেতে, সবাই মিলে। কর্নেল এনশাদের জীবনে ‘সে রাত’ আর আসেনি।

কর্নেল গুলজারের পরিবার মুক্তিযুদ্ধের সময় দল বেধে পালাচ্ছিলেন। পানির প্রয়োজন হলে খোঁজে বের হন গুলজারের পিতা ও অন্য আরেকজন। দ্বিতীয়জন ফিরে আসেন। প্রথমজন আসেননি। গুলজারের মা চিরজীবন এই আশায় ছিলেন যে তার স্বামী একদিন ফিরবেনই। কর্নেল গুলজারের লাশ এখনো মেলেনি সম্ভবত। এমন দুঃসহ অপেক্ষার প্রহর আরো কতগুলো জীবনকে অসহনীয় করে তুলবে কে জানে?

পমি ভাইয়ের (মেজর গাজ্জালী) সঙ্গে ছেলেবেলায় তাদের ড্রাম ফ্যাক্টরির অফিসার্স কোয়ার্টারে কতই না খেলেছি ‘সোলজার সেট’ নিয়ে। খেলার নাম হলো ‘গানস অব নাভারন’/ গুলি হবে মুখ দিয়ে আওয়াজ করে। একপক্ষ যদি মনে করে অন্যপক্ষের অমুক সোলজার তার মুখের গুলিতে মারা গেছে, তাহলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে শুইয়ে দিতে হবে। এ নিয়ে ঝগড়াও হতো। ঝগড়ায় জিতলে শুইয়ে দেয়া সোলজারকেও দাঁড় করানো যাবে। পমি ভাই, আজ বড্ড কষ্ট হচ্ছে, ভিজে আসছে চোখ। আপনাকে যদি দাঁড় করানো যেত, আর একটি বার।

হায়দার (ক্যাপ্টেন তানভীর) ছিল আমার চেয়ে এক ব্যাচ জুনিয়রয়র। খাড়া খাড়া চুলের শান্ত, লিকলিকে লম্বা এই ছেলেটাকে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে কোনোদিন হার্ডলস রেসে হারাতে পারেনি কেউ।

আমি কেবল জানতে পারিনি আমার এ ছোট ভাইটি ঠিক তার নামের মতোই সুপুরুষ বীর। হায়দার সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটিতেও কেড়ে নিয়েছিল অস্ত্র, পাশের সৈনিক থেকে। কিন্তু গুলি করেনি। ভাই কেন ভাইকে গুলি করবে। সরল ভাইটি বুঝতে পারেনি যাকে সে ভাই মনে করছে, ওরা ছিল দানব।

আমার আরেক ছোট ভাই ক্যাপ্টেন মাজহার প্রাণভিক্ষা চায়নি। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বোঝাতে চেয়েছিল শান্ত হতে। আর অপেক্ষা করেছিল সাহায্যের। মেজর জেনারেল শাকিলও অপেক্ষা করেছিলেন সাহায্যের। কিন্তু সে সাহায্য পৌঁছেনি।

Image

প্রধানমন্ত্রী, এ সৈনিকেরা আশা করেছিল সাহায্য আসবে। শেষ নিঃশ্বাসটুকু তারা ফেলেছিল হয়তো এই আশা নিয়ে যে এক্ষুণি সাহায্য আসবে। আপনার জীবনে গৌরব ও সম্মানের মূল্য কতটুকু জানি না। কিন্তু ওদের জীবনে ও দুটোই সব। ওরা প্রতিজ্ঞা করেছিল এ দেশের সঙ্গে, টিল ডেথ ডু আস পার্ট। ওরা ওদের প্রতিজ্ঞার মূল্য দিয়েছে, আপনি দেননি। আপনি সাহায্য পাঠাননি। সৈনিক কখনো হতাহতের সম্ভাবনা বুঝে লড়াই করে না। করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে।

অন্যায় ও অনিষ্টের দমন করার জন্যই যে শক্তির প্রয়োজন। আপনি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেছেন, লড়াই করেননি। আমি দুঃখিত। আপনি এদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু আপনি আমার নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আপনি কৌশলী হতে পারেন, কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার আত্মিক শক্তি আপনার নেই। অসুন্দর আর অন্যায়ের সঙ্গে চিরকাল সমঝোতা করতে করতে আজ বিপদের মুহূর্তে কেবল আপসের কথাই আপনাদের মাথায় আসে।

আপনার কারণে আমার মাথা হেট হয়ে আসে। আমরা সেই অযোগ্য জাতি যারা তাদের বীরদের সাহায্য করার চেষ্টাটুকু করেনি। রাগে আমার শরীর অসার হয়ে আসে, যখন দেখি পরদিন আপনার গুণকীর্তনে ভরে যায় পত্রিকার পাতা। আপনি নাকি জীবন বাঁচিয়েছেন। এমনসব কাপুরুষের জন্য কলম হাতে নেয়াটাই শ্রেয়। ‘এগুলোর’ অন্য কিছু বহন করবার শক্তি নেই।

আপনার অনন্য ‘বিচক্ষণতার’ সুযোগে হত্যাকারীরা হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের যথেষ্ট সময় পায় এবং তারপর পালিয়েও যায়। একবার ভাবুন তো, আজ যদি আপনার ওপর কেউ গুলি চালায় এই সৈনিকেরা কি প্রবাবিলিটির গণিত কষে এগিয়ে আসবে? আক্রমণকারীকে পাল্টা গুলি চালাতে গিয়ে যদি মারা যায় কোনো নিরপরাধ সাধারণ মানুষ – একবার প্রশ্নও করা হবে না তার জন্য। এই বাচ্চা ছেলেগুলো তাদের বুক পেতে দেবে আপনার জন্য। হিসাব করবে না তারা নিজের জীবনের। ওদেরও প্রয়োজন হয়েছিল- একবার আপনার সাহায্যের। মনে রাখবেন, সেদিন আপনি হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন।

হায়দার, মাজহার আর পমি ভাইয়ের চেহারা মনে এলে আজ আমি চোখের পানি আটকে রাখতে পারি না। তবু আমার গর্ব হয়, এমনসব বীরের সঙ্গে আমি কাটিয়েছি অনেকগুলো বছর, চিনেছিলাম তাদের, কাছ থেকে। আর আমার লজ্জা হয়, আমি আপনাকেও চিনেছি।

সুধী সমাজ

সুধী সমাজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান সত্যি কিন্তু সেটা এজন্য না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীটা ন্যায্য কিংবা এ পথে খুন-জখম কম হবে বরং এজন্যে “নিরপেক্ষতা” সুধী সমাজে খুব ফ্যাশনেবল জিনিস। তারা চান বিএনপি প্রয়োজনে কেয়ামত পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী করুক কিন্তু সেটা করতে হবে টেলিভিশনে, সংসদে। যে দাবী দেশের অন্তত ৮২ ভাগ মানুষের দাবী (প্রথম আলো জরিপ, সেপ্টেম্বর ২০১৩) এবং যে ন্যায্য দাবীর কারণেই এতো হানাহানি সে দাবী লীগ না মানলে কী হবে – এ প্রশ্ন করলে তারা মাথা চুলকে দার্শনিক ভাবে উত্তর দেন, “কী জানি ভাই আর ভাল্লাগে না এতো হানাহানি; আর পারছি না নিতে।”

তারা আবার বিস্মৃতিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসেন – খুব। খালেদা জিয়া যে মাসের পর মাস ধরে সরকার দলকে আলোচনা করার আহবান করেছেন সে সত্যটা ভুলে যাওয়াটাও দেশে খুব ফ্যাশনেবল।

তিনি আলোচনার দাবী জানালে বলা হয় যে বিএনপির আন্দোলনের মুরোদ নেই আবার আন্দোলন করলে বলা হয় আমরা তো বিএনপির কাছে এমন কিছু আশা করি না।Continue Reading

আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য এগজিট রুট

প্রথমেই বলে রাখি এই লেখাটি মূলত আওয়ামী লীগের রাজনীতি যারা সমর্থন করেন তাদের জন্য কিন্তু আমি নিজে সেসব সমর্থকদের একজন নই। সম্ভবত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক না হওয়ার জন্যে আমার পক্ষে আউট অফ দা বক্স চিন্তা করাটা যতোটা সহজ, অন্য অনেকের জন্যে ঠিক ততোটা সহজ নাও হতে পারে।
Image
Continue Reading

মেহেদীর কার্টুন

ধরা যাক আমি পোকার খেলছি। ব্লাইন্ড বেট। খুব আজব এক বেটের কথা কল্পনা করি। বাংলাদেশের সব কার্টুনিস্ট আমার কার্টুন এঁকেছে, সবাই। আমি কেবল একটা কার্টুন কিনতে পারবো এবং সেই কার্টুনটা আমাকে কিনতে হবে গাটের পয়সা খরচ করে – ১০ হাজার টাকা দাম – কিন্তু কার্টুনটা না দেখে কিনতে হবে। সেজন্যেই ব্লাইন্ড বেট।

এখন আমার কল, ইন করবো না ফোল্ড?

আয়েম ইন – চোখ বন্ধ করে কিনে ফেলবো মেহেদীর আঁকা কার্টুন।

Continue Reading

“উইল ডু” জেনারেশান

ভূমিকা

পশ্চিমের সোশাল এলিটদের একটি গ্রুপকে ’৫০ এর দশকে “জেট সেট” বলা শুরু হয়। এদের দেখা মিলত ইউরোপের সব বড় এয়ারপোর্টে, উড়ালের অপেক্ষায়। তখনকার এয়ার ফেয়ার সাধারণদের জন্য অকল্পনীয় রকমের ব্যয়সাধ্য ছিল বলে জেট প্লেনে ভ্রমণ কেবল অতিধনীদের জন্যই বরাদ্দ ছিল (লন্ডন-নিউ ইয়র্ক এখন যেখানে ৬০০ ডলারে ঘুরে আসা যায়, ’৫০ এর দশকে সেখানে আজকের হিসেবে ৫ থেকে ৬ হাজার ডলার খরচ হতো) । অঞ্জন দত্ত তার ‘মালা’ গানটি যে গানের অবলম্বনে/অনুকরণে রচনা করেছেন, পিটার সার্সটেটের সেই “Where do you go to (my lovely)” গানটিতে জেট সেটদের তীক্ষ্ণধী বিবরণ আছে। সে বর্ণনার সাথে বাংলাদেশের অতিধনীদের মিলিয়ে দেখার ইচ্ছা থেকেই এ লেখার শুরু। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে জেট সেটদের সমার্থক কোনও শ্রেণী বাংলাদেশে আছে কি না, থাকলে তাদের কী নামে ডাকা যায়, কতো সম্পদ কিংবা ঠিক কী ধরনের আচরণ এদের বিশেষায়িত করে – এ ধরনের বহু প্রশ্ন নিয়ে আমি বাংলাদেশের কিছু অতিধনীদের সাথে কথা বলা শুরু করি, যাদের বয়স ২৫ থেকে চল্লিশের মধ্যে। নিজেরা অতিধনী না বাবা অতিধনী এই পার্থক্যে আমি যাই নি যেহেতু সামগ্রিকতার খোঁজ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভবপর না, আমি কেবল নির্মোহভাবে এদের কয়েকজনকে দেখতে চেয়েছি। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল যাদের সাথে কথা বলছি তাদের ছবিও জুড়ে দেবো, যেহেতু এই মানুষগুলোকে বোঝার জন্য তাদের চেহারা দেখা খুব জরুরী। সমস্যা হোল, লেখালেখির কথা শুনলে হয় তারা নিজেদের গুটিয়ে নেন, নয়তো বানিয়ে বলা শুরু করেন। একজন বাদে (যিনি নিজেকে অতিধনী মনে করেন না) প্রত্যেকেরই শর্ত, পরিচয় দেয়া চলবে না। তাই আসল পরিচয় ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে দেয়া হোল।

Continue Reading

নুরালদীন

নুরালদীন আমাদের স্বপ্নপুরুষ, নুরালদীন ঠিক তাই, আমরা যা নই।

নুরালদীন সম্বন্ধে খুব বেশী কিছু যে জানা যায় তা না, কিন্তু দরকারী জিনিসটুকু আমরা জেনেছি। অষ্টাদশ শতকের পিছিয়ে থাকা পূর্ব-বঙ্গের একদম পিছিয়ে থাকা উত্তর অংশের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে তার জন্ম। জমিদারী এবং ব্রিটিশ শাসনের যাতাকল তিনি দেখেছিলেন কাছ থেকে এবং ঠিক করেছিলেন অন্য কৃষকদের সাথে নিয়ে বিদ্রোহ করবেন এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। বলাই বাহুল্য, তিনি সফল হতে পারেন নি।

নুরালদীন হেরে যান নি, মারা গিয়েছিলেন, নুরালদীনরা কখনই হেরে যান না। তিনি প্রেরণা, ন্যাশনালিস্টদের। মেল গিবসন ব্রেভ হার্ট ছবিটা করার পর বলেছিলেন যে ভারতবর্ষে এমন অনেক চরিত্র আছে যাদের নিয়ে ব্রেভ হার্টের মতো ছবি করা যায়। আমার কাছে নুরালদীন সেই চরিত্র – স্বপ্ন ও দৃঢ়তায় উইলিয়াম ওয়ালেসের চেয়ে এক বিন্দু কম নন – এমন মহামানব আমার নুরালদীন।Continue Reading