চেতনার বিশ্বরেকর্ড

1

Human-Flag-2

আমরা ইংরেজি প্রভার্ব “নিরো ফিড্‌লস ওয়াইল রোম বার্ন্স” যখন শুনি তখন নিশ্চয়ই মনে মনে দৃশ্যায়ণ করার চেষ্টা করি যে ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব। এসময় আমরা খুব ইথিকালি চিন্তা করি বলে দৃশ্যায়ণের কাজটি খুব স্থূল হয়ে যায়। নিরো তো আর গর্দভ ছিলো না, সে নিশ্চয়ই ব্যাপারটির মাঝে একটা অ্যাস্থেটিক ক্রুয়েলটি নিয়ে এসেছিলো, যার নান্দনিকতা ভেদ করে নৃশংসতার ডোমেইনটি বোঝা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

কথাগুলো যদি বুঝতে কষ্ট হয় তাহলেও সমস্যা নেই, ভালো উদাহরণ আছে বোঝানোর জন্য। এবং উদাহরণগুলো দেশী।

উদাহরণ ১: যখন সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ল তখন প্রথম আলোর মেরিল তারোকালোক নাচাগানার অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া। আজ থেকে ৫০০ বছর পর কেউ যদি ঘটনাটা শোনে সেও ভাববে কীভাবে সম্ভব এটা? কিন্তু সে যদি আমাদের পেত তাহলে আমরা তাকে বোঝাতে পারতাম যে প্রথম আলো তো আর বেকুব নয়। তারা সেই “অ্যাস্থেটিক ক্রুয়েলটি” বোঝে। তারা প্রোগ্রামটি বন্ধ করতে রাজি নয়, স্বার্থ জড়িত। আবার এটাও বুঝছে যে ক্রুয়েলটি হয়ে যাবে যা মানুষ পছন্দ করবে না। এখানেই প্রথম আলোর নন্দন তত্ত্ব প্রয়োগের মুন্সিয়ানা। আনিসুল হক বলল: এটা তারা জর্জ হ্যারিসনের “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ”-এর আদলে করছে। প্রোগ্রাম চলল, আবার তাতে চাঁদাও ওঠানো হোলো অর্ধ লক্ষাধিক টাকার। ব্যস, রোম বার্ন করার সময় নিরোর ফিডল বাজানোর ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেল। গান-বাজনাও হোলো, আবার কেউ আপত্তি তুললে তাকে মুখ ঝামটাও দেয়া হোলো – আমরা তো এত এত টাকা তুলেছি, তোমরা কী করেছো? এটার ফ্যালাসিটা অনেকেই ধরতে পারবে না, কারণ তারা নান্দনিকতা ভেদ করতে পারে না। টাকা তোলা এক জিনিস, আর নাচগান করা আরেক জিনিস। এ দুইটা জিনিস একসাথেই হতে হবে এমন না। প্রথম আলো নাচগান না করেও টাকা তুলতে পারতো, টাকা তোলার জন্য নাচগান শর্ত ছিলো না। ঐ পরিমাণ টাকা প্রথম আলো নিজেদের ব্যাংক ব্যালেন্স থেকেও দিতে পারতো। অথবা স্রেফ চাঁদা তুলেও করতে পারতো। টাকা না তুললেও কোনও সমস্যা ছিলো না। জাতীয় একটি দুর্যোগে প্রথম আলোর নাগরিক আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেটাকে প্রথম আলো ভেট নজরানা দিয়ে রিভার্স করতে পারবে না।

উদাহরণ ২: দেশ যখন রাজনৈতিক সমস্যার একেবারে অতল গহ্বরে তখন একদল দেশপ্রেমিক গেছেন জাতীয় পতাকার ব্লক বানিয়ে বিশ্বরেকর্ড করতে। এখানে অ্যাস্থেটিক ক্রুয়েল্টি কোথায়। আমি বরং আর না বলি। আপনারা দেখুন তো এখানে অ্যাস্থেটিক ক্রুয়েলটি কোথায় ধরতে পারেন কিনা? এটার নৃশংসতা কোথায় আগে বের করুন। এরপর চিন্তা করুন যে তারা কোন নান্দনিকতা ব্যবহার করলেন সেই ক্রুয়েলটি ঢাকার জন্য। বোঝা খুবই সহজ। কেন এই অ্যাস্থেটিক ক্রুয়েলটি তাদের করতে হোলো। কেননা, দেশপ্রেমের আসল যে পরিচয় তাদের এই সময় দিতে হতো সেটি তারা করতে অপারগ, তাদের স্বার্থ জড়িত, বিসনেস ল-এর ভাষায় এজেন্সি কনফ্লিক্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আবার দেশপ্রেমের যে সোল প্রোপ্রাইটরশিপ সেটা ছাড়লেও তো চলবে না, সেটাই তো মূল ব্যবসা। কাজে কাজেই বিশ্বরেকর্ডের নান্দনিকতা।

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ফালা ফালা হয়ে গেছে। আর কোনও দেশ এতোগুলো নিরো একসাথে প্রডিউস করতে পারেনি।

জামাতে ইসলামি সম্বন্ধে আমার ধারণা

Asif Shibgat Bhuiyan

এমফ্যাসিস দেখুন প্রথমত, আমার ধারণা। তার মানে হচ্ছে এখন আমি যে কথাগুলো বলব সেগুলো কুরআন হাদীসের আপ্ত বাণী নয়, সেই এক্সপেকটেশান আমার কাছে করাও ভুল। এই ধারণায় আমার ব্যক্তিগত ইসলামি চিন্তার প্রভাব রয়েছে এবং নিঃসংকোচে মানতে রাজি আছি যে আমার ব্যক্তিগত ইসলামি চিন্তা সবাইকে গ্রহণ করতে হবে না। যে কেউ আমার সাথে এ ব্যাপারে দ্বিমত করতে পারেন এবং আমিও যে কারও সাথে দ্বিমত করতে পারি। কমেন্টে খিস্তি খেউড় করে বা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে লাভ নেই। তবে সমালোচনা করতেই পারেন, সেই সমালোচনা গ্রহণ বা বর্জন করার এক্সক্লুসিভ রাইট আমার রয়েছে।

এই লেখাটি একটা তাগিদ থেকে লিখছি। মানুষজনের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় একজন ইসলামপন্থি হতে হলেও আমাকে জামাতকে অচ্ছ্যুৎ ঘোষণা করে কথা বলতে হবে। আমি সেটা একদমই সাপোর্ট করি না।

আমি জামাতের সদস্য নই আমি জামাত করি না। পিরিয়ড। তবে আমার জামাত না করাটা আমার জন্য কোনও ক্রেডিটের কথা নয় এবং জামাতের জন্যও কোনও ডিসক্রেডিটের কথা না। আমি এত গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই এবং সেটা আমি প্রিটেন্ডও করব না। আমি কি জামাতকে রাজনৈতিক ভাবে সাপোর্ট করি? কমপ্লিকেটেড প্রশ্ন। আমি কোনও ইসলামি দলকে একক ভাবে বাংলাদেশের ক্ষমতায় দেখতে চাই না, না জামাত, না তাবলীগ, না আহলে হাদীস, না এইচটি। আমি শরি’আর পক্ষপাতী কিন্তু সেটা বাংলাদেশের মানুষের শরি’আ বাস্তবায়নের যে হাস্যকর ইম্ম্যাচিউর আন্ডারস্ট্যান্ডিং সেই শরি’আ না। যেহেতু এই স্ট্যাটাস এই বিষয়ের না, আমি বিশদ ব্যাখ্যায় যাবো না। আবার আমি কোনও সেক্যুলার পন্থি দলকেও একা সরকারে দেখতে চাই না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় ইসলামি দল সহ কয়েকটি ডানপন্থি দলের যে জোট – এটিই এই মুহুর্তে বেটার। খেয়াল করবেন যে এটা আমার প্র্যাকটিকাল স্ট্যান্স, আইডিওলজিকাল স্ট্যান্স না। আইডিয়ালি কী হওয়া উচিৎ, সেটা অ্যাকাডেমিক আলোচনা, আরেকদিন। সুতরাং আমি রাজনীতিতে বিএনপি-জামাত ও অন্যান্য দল সম্বলিত জোটকে সাপোর্ট করি। একা বিএনপিকেও না, একা জামাতকেও না।

জামাতের ১৯৭১ এর ভূমিকা – এটি আমার সিনসিয়ার স্বীকারোক্তি যে ১৯৭১ এর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমি কনফিউজ্‌ড। এটা এডুকেটেড কনফিউশান, আমি বেশ কিছু বই পড়েছি এবং রেসাল্ট দাঁড়িয়েছে এই যে পিকচারটা আমার কাছে গ্রে। গ্রে-কে আমি জোর করে সাদা বা কালো বানাতে পারব না। কোলাবরেশান – আমার কাছে কোনও ফ্যাক্টর নয়। সত্যি কথা বলতে আমি যখন চিন্তা করি যে ১৯৭১ সালে আমি থাকলে কী করতাম, আমার মাথা ব্ল্যাঙ্ক থাকে। দিস ইজ গড’স অনেস্ট ট্রুথ। ওয়ার ক্রাইম? অবশ্যই! আমি সেই নবীর গর্বিত উম্মতের সদস্য যিনি বলেছিলেন যা যদি তার মেয়ে ফাতিমাও চুরি করে, তাহলে তার হাত কেটে নেয়া হবে। আফসোস যে হতভাগারা ইসলামে চোরের হাত কাটা নিয়ে মানবতাবাদের মায়াকান্না দেখে, কিন্তু ইসলামের ইমপেকেব্‌ল সেন্স অফ জাস্টিস খুঁজে পায় না। মানবতাবাদ সুবিচার ছাড়া আর কী? যাই হোক জামাতের যে কোনও সদস্য যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী থাকলে বিচার হতে হবে এবং উপযুক্ত শাস্তিও হতে হবে। কিন্তু অবশ্যই অবশ্যই সুষ্ঠ বিচারের মাধ্যমে কোনও রকম পক্ষপাতিত্বের বিন্দুমাত্র সুযোগ না রেখে প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে। একজন নিরাপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পাওয়ার চেয়ে লাখ লাখ অপরাধী খালাস পেয়ে যাওয়া একটি ইসলামি প্রিন্সিপ্‌ল এবং মানবতার বেসিক দাবী। এটা নিয়ে কোনও কথাও হতে পারে না, অসম্ভব। আপনি চূড়ান্ত বুদ্ধু বা চূড়ান্ত পাজি না হলে এটা স্বীকার করে নেয়াটা আপনার মানুষ হওয়ার প্রমাণ। আমি মনে করি যে জামাতের নিজের উদ্যোগ নিয়ে সুষ্ঠ বিচারে সহায়তা করা উচিৎ। ঠিক যেমন ‘উমার তার নিজ ছেলেকে ব্যভিচারের শাস্তি দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি।

জামাতের ইসলামিক কমিটমেন্ট – জামাত রাজনৈতিক কর্মকান্ডে প্রচুর ভুল করেছে -পলিটিকাল, স্ট্র্যাটেজিকাল এবং ইসলামিকও। যে কোনও দল বা গ্রুপ মাত্রই ভুল করবে না এটা হওয়াটা অসম্ভব, অসম্ভব। জামাত, তাবলীগ, আহলে হাদীস, এইচটি, মুসলিম ব্রাদারহুড, দেওবন্দী সব্বার ভুল আছে। যে দল মনে করে তারা ভুল করে না তারা ডিসইলিউশনড। আমাদের দেশের একজন প্রসিদ্ধ স্কলার আমাকে বলেছেন যে তারা জামাতের থিংক ট্যাংককে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব লিখিত আকারে দিয়েছিলেন। তারা গ্রহণ করেননি। সুতরাং হ্যাঁ, জামাতের ভুল আছে, সংখ্যায়ও সেগুলো কম নয়। অন্য সব দলের অবস্থা তথৈবচ। নবীজী (সা:) চলে যাওয়ার পর ত্রিশ বছর ইসলামি স্টেট একটা আদর্শিক অবস্থায় ছিলো, উইথ মাইনর হিকাপস। এরপর কিছু ডিস্ক্রিট রিজিনাল বা ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স ছাড়া ইসলামিক স্টেট এবং এর সামষ্টিক অভিজ্ঞতা সবসময়ই প্রশ্নবোধক ছিলো। এতে এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। ইসলাম মাসুম, মুসলিমরা নয়, ব্যক্তিগত ভাবেও নয়, সামষ্টিক ভাবেও নয়।

যে ব্যাপারটির আমি ঘোর বিরোধী সেটি হোলো জামাতকে ডিহিউম্যানাইজ করার ক্রমাগত চেষ্টা, কখনও তাদের ১৯৭১ এর ভূমিকা নিয়ে, কখনও তাদের ইসলামিক ভুলের দোহাই দিয়ে। ইদার কেস, আমি তাদের ডিহিউম্যানাইজ করার পক্ষপাতি নই। তাদের কড়া সমালোচনা করা হোক, তাদের ভুল পাবলিকলি আলোচিত হোক। যেমন আর সব দলকে করা হয়, হবে। কিন্তু তাদের মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, তাও যুগ-যুগান্ত ধরে, নাতি-পুতি সবাইকে? সমালোচনার পাশাপাশি তাদের সকল নাগরিক অধিকারকে ডিনাই করা (যার মাঝে তাদের রাজনৈতিক অধিকার) আমি সমর্থন করি না। এই ক্ষেত্রে আপামর মুসলিমদের ভূমিকার আমি নিন্দা জানাই। আজকে কাদের মোল্লার এই পরিণতির জন্য আপনি আমি তো ভাবের স্ট্যাটাস দিচ্ছি, কিন্তু এই অবস্থায় ব্যাপারটাকে নিয়ে আসার জন্য গত কয়েক দশক ধরে অজামাতি মুসলিমদের ভূমিকা রয়েছে। রক্তের দাগ আপনার আমার হাতেও।

জামাতের উল্লেখ করার মতো বহু কাজ আছে। প্রচুর ইসলামি বইয়ের পাবলিকেশন ও দোকান তাদের। বাংলাদেশে দুটি কনসেপ্টের আনডাউটেড পাইয়োনিয়ার তারা – ইসলামিক স্কুল এবং ইসলামিক ব্যাংকিং। আপনি এসবের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবেন না? আমি ইনশাআল্লাহ্‌ বুকে হাত দিয়ে করব। একটা ভায়োলেন্সের দায়ে অভিযুক্ত দলের নাগরিক অবদানগুলো যদি স্বীকার না করা হয় তবে তো তাদেরকে এক্সপায়েট করার কোনও সুযোগই আপনি রাখলেন না। এরপর যদি সেই দলের মূল নেতারা না হোক, মাঠপর্যায়ের কর্মীরা যদি ধৈর্য হারায়, আপনি তো সমালোচনা করে খালাস, কিন্তু দায় কি এড়াতে পারবেন?

না শিবিরের সন্ত্রাস সমর্থনযোগ্য নয়, যেমনটি নয় ছাত্রদলের বা ছাত্রলীগের। বাংলাদেশের সবচেয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন আর যেই হোক শিবির নয়। তার মানে এই নয় যে জামাত বা শিবির দায় এড়াতে পারবে। তার মানে এও নয় যে শুধুমাত্র জামাতকেই আপনি টার্গেট করে সলিটারি কনফাইনমেন্টে পাঠাবেন।

বহু জামাত কর্মী বা তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে আমার কথা হয়েছে। তারা নর্মাল মানুষ, আমার মতোই, অনেকে আমার চেয়েও বেটার, অ্যাজ এ মুসলিম অ্যাজ এ পার্সন। এটা আমার হার্টফেল্ট বিলিফ যে সব মুসলিমই আমার চেয়ে বেটার মুসলিম।

আমি শাহবাগ দেখেছি

by Asif Shibgat Bhuiyan

শাহবাগী ভাঙননৃত্য শেষ হলে কয়েকটি জিনিস ধীরে ধীরে প্রতিভাত হবে বলে আমার ধারণা। এখানে বলে ফেলি।
বহুদিন ধরে একটি মহলের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক হেজিমনির মূল উৎস ছিলো ১৯৭১ এর জুজুর ভয় দেখানো। গত ৪২ বছর ধরে একটি একচেটিয়া পারসেপশন তারা মানুষের মাঝে তৈরি করে রেখেছে। গত এক বছরে এই পারসেপশনের নাটকীয় পতন ঘটেছে। অত্যাচারী ভিলেনের সাথে চির অত্যাচারিত হিরোর একটি অসম লড়াই যাতে হিরোরা প্রাথমিকভাবে জয়ী হলেও ওঁতপেতে থাকা ভিলেন যে কোনও সময় আবার আক্রমণ করবে – এই চিত্র আমাদের মর্মমূলে একেবারে গেঁথে দেয়া হয়েছিলো। এই মানসিক দৃশ্যপট এখনকার তরুণ প্রজন্মটির মনে গেঁথে ছিলো গত বছর পর্যন্তও। এ বছরে এসে প্রথম হিরোদের সাথে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভিলেনরা মাটি পাওয়া শুরু করেছে। এতে ভিলেনদের তেমন কিছু করতে হয়নি। হিরোরা হঠাৎই অহেতুক ফাউল করে নিজেদের ফেয়ার প্লে নষ্ট করেছে এবং সুযোগ করে দিয়েছে প্রতিপক্ষের সমর্থন ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তোলার। এই আত্মহননে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে হিরোদের অফিশিয়াল চিয়ারলিডাররা – শাহবাগীরা।

একটি রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভের প্রহসনের বিচার কার্যে শাহবাগীরা কেবল সমর্থনই দেয়নি, ইন্ধন যুগিয়েছে। তাদের মনোভাব ছিলো একরোখা “রাজনীতি বুঝি না, ফাঁসি চাই”। বরং তারা ট্রাইব্যুনালের ফাঁক ফোকরগুলো খেয়াল করে যদি এই দাবী তুলতো যে “অবিলম্বে সুষ্ঠ বিচার চাই এবং প্রকৃত অপরাধীর বিপক্ষে মজবুত প্রমাণ সাপেক্ষে শাস্তি চাই।” তাহলে সেটা সবদিক থেকেই ফেয়ার হতো, যুদ্ধাপরাধের দায়মুক্তিও হতো এবং পুরো প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক ফাউল প্লে থেকে মুক্ত থাকতো। সেটা না করে শাহবাগ ঐ কাজটাই করল যা এই বিচার পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্যকে সার্ভ করে – রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি।

শাহবাগীরা দ্বিতীয় যে ব্লান্ডারটি করল সেটি হোলো এই দেশের জনমনে সবচেয়ে বড় যে দুটি চেতনা একই সাথে মানুষ লালন করে এসেছে এতদিন, সে দুটির মাঝে ক্ল্যাশ লাগিয়ে দেয়া। ৭১ এর চেতনা এবং ইসলামি চেতনা। শাহবাগীরা মঞ্চের প্রাথমিক সাফল্যে দ্বিতীয় চেতনাটিকে তাচ্ছিল্য করে বসেছিলো। এখানে বলে রাখা ভালো যে অন্তত ২০১২ পর্যন্ত মডারেট ইসলামি চেতনা ও ৭১এর জাতীয়তাবাদী চেতনা মানুষ একসাথে যত্নে লালন করে এসেছে। এটি একটি ফ্যাক্ট – এটাকে অস্বীকার করা বিরাট বোকামো। এ দুটি চেতনার কোনও একটি এক্সট্রিম (অপরটিকে আমল না দিয়ে) এদেশের মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। এটার প্রমাণ হোলো যে জামাতের এতদিনকার কোনঠাসা অবস্থা। কারণ জামাতের ইসলামি চেতনার ঝান্ডাটি হাতে থাকলেও, ৭১ এর ব্যাগেজের কারণে তারা এতদিন কোনঠাসা ছিলো। সেক্যুলাররা তো বটেই, সাধারণ অজামাতি মুসলিমদের একটি বড় অংশ তাদের বখে যাওয়া সৎ ভাই হিসেবে দেখতো। জামাতিদের প্রত্যাখ্যান করার কারণ যতটা ছিলো ইসলামিক মতবিরোধ তার চেয়েও বেশি তাদের এই ব্যাগেজ।

শাহবাগীরা নিজেদের পায়ে কুড়ালটা মেরেছে যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়ে নয় অবশ্যই, বরং অন্য দুটি কারণে। এক, একটি ভুল বিচার পদ্ধতিকে আরও ইন্ধন যুগিয়ে এবং দুই, ৭১ এর চেতনার সাথে ইসলামি চেতনার যে ডেলিকেট ব্যালেন্স এই দেশে রক্ষা করে চলতে হয় সেটি করতে ব্যর্থ হয়ে। এই অর্ডার আমি সময়ের প্রেক্ষিতে করেছি নতুবা সমস্যা শুরু হয়েছে বরং দ্বিতীয়টা দিয়ে। তাদের প্রাথমিক সাফল্যের ব্যাপারে মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে যখন তারা এদেশের অরিজিনাল সিন করে বসল – ইসলামি চেতনাটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দিতে পেরে, বরং পায়ে ঠেলে। তারা বলেছে অবশ্য সময়ে সময়ে যে এটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু আন্দোলন কেবল ইমোশানের ওপর চলে না, তার ট্যাক্টিক্স ঠিক থাকতে হয়। তাদের আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো যে দুটি চেতনার মাঝে ব্যালেন্স না করলে চলবে না। যখন তাদের বিরুদ্ধে ইসলামকে অবজ্ঞা করার অভিযোগ আসল এবং একই সাথে বিচারের বিভিন্ন অসঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও শাহবাগীরা সেটিকে সাপোর্ট করে গেল, তখন সাধারণ মানুষ দুই দুইয়ে চার করা শুরু করল। শাহবাগীদের জাতীয়তাবাদী চেতনার চেয়ে প্রাধান্য পেল তাদের অইসলামি চেতনা।

শাহবাগীরা যখন বুঝলো যে ইসলামি চেতনাকে তাচ্ছিল্য করার প্রবলেমটা তারা এটা বিভিন্ন ভাবে বোঝাতে শুরু করল যে তাদের মূল দাবী ছিলো যুদ্ধাপরাধের বিচার, ইসলামের সাথে তাদের কোনও বিরোধ নেই। তাদের এই দাবীও ছিলো যে এটা যারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায় না তারা এই তকমা তাদের গায়ে লাগিয়ে দিতে চাইছে। এটা একটা ভালো যুক্তি, এবং নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষদের অনেকেই, বিশেষ করে যারা তাদের সেকেন্ড চান্স দিতে চেয়েছে, তাদের যুক্তিটি মনে ধরেছিলো। আপনাদের মনে থাকবে নিশ্চয়ই মঞ্চে একজন মহিলাকে দিয়ে কুরআন পড়ানো এবং আরেকজনকে শ্রোতা হিসেবে রাখার কৌতুহলোদ্দীপক ছবিটির কথা। কিন্তু এরপরই শাহবাগ করল একটি আত্মঘাতী কাজ যা থেকে তারা আর রিকাভার করতে পারেনি এবং আর কখনও পারবেও না আমার ধারণা।

৬ মের ভোরে সরকার কর্তৃক হেফাযতকে উৎখাত করার ঘটনা এবং সেই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে যখন একটি পাল্টাপাল্টি কনফিউশান চলছিলো তখন শাহবাগীদের হাতে একটি সুবর্ণ সু্যোগ ছিলো নিজেদের ইসলামি চেতনা রিলেটেড ইমেজটিকে পুনরুদ্ধার করার। তারা এই বিষয়টিতে সম্পূর্ণ চুপ থাকতে পারত। তদের ঘটে বুদ্ধি আর একটু বেশি থাকলে তারা ইন ফ্যাক্ট সরকারের কাছে এই দাবীও জানাতে পারত যে ৬ই মের ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত হোক। আশ্চর্যজনক ভাবে তারা, বিশেষ করে সোশাল মিডিয়াতে তাদের নেতারা এবং অন্যান্য পাতি চেলাচামুন্ডারা ঘটনাটি নিয়ে রসিকতা করা শুরু করে, বিশেষ করে হেফাযতের দাবী করা সংখ্যাটিকে ঘিরে। তারা ভুলে গিয়েছিলো যে ৩০ লাখের ট্যালিসমান সংখ্যাটি তারা এতদিন জপে এসেছে সেটা ঠিক ততটাই বায়বীয় ছিলো যতটা ছিলো হেফাযতেরটি। আমি পূর্ণ কনফিডেন্স নিয়ে বলতে চাই যে এটাই ছিলো গেইম, সেট, ম্যাচ। শাহবাগীদের বিপক্ষে।

কেন শাহবাগীরা এরকম হঠকারিতা করল? বোঝা ডিফিকাল্ট। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে গোয়ার্তুমি বা রেকলেস স্বভাব। আফটার অল তারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক। আসলে কারণ এটি নয় আমার মতে। শাহবাগীরা তাদের মূল দাবীতে কখনই সৎ ছিলো না, তারা যুদ্ধাপরাধের আড়ালে একটি সেক্যুলার প্যারাডাইম শিফটের কাজ করতে চেয়েছিলো ঠিকই। শুধু মাত্র বিপদের সময়ই তারা সেটাকে ঢাকতে চেয়েছিলো। সেটা ছিলো থাবাবাবার মৃত্যুপরবর্তী হেফাযতের মিটিয়রিক উত্থানের সময়টি। কিন্তু যে দুবার তারা মনে করেছে তারা কন্ট্রোলে চলে এসেছে সে দুবারই তারা তাদের সেক্যুলার অ্যাটিচিউড ও অবজেক্টিভ লুকাতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রথমত, শাহবাগের প্রাথমিক উত্থানের সময় এবং দ্বিতীয়ত, ৬ই মেতে হেফাযতের উৎখাতের পর। অন্যভাবে বলতে গেলে তাদের সকল বাগাড়ম্বর ছিলো সরকারের ছত্রছায়ায়। সরকার যেমন তাদের ব্যবহার করেছে তারাও সরকারের লেজ ধরেই ঝুলে ছিলো।

এখন শাহবাগ যে আস্ফালনগুলো থেকে থেকে দেখাচ্ছে এটা বিপ্লবীদের হুংকার নয়, বরং চিয়ারলিডারদের কত্থক। সরকার যখনই গোল দিচ্ছে শাহবাগীরা উদ্বাহু নৃত্য শুরু করছে। লক্ষ্য করবেন যে সরকার এখন ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে যাচ্ছে যার ফলে দেশে একটি অরাজক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এসময় তাদের উচিৎ ছিলো, যদি সত্যিকার দেশপ্রেমিক তারা হয়ে থাকতো, এই অবস্থায় সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। একটি সাংগঠনিক ভিত্তি যেহেতু দাঁড়িয়েই গেছে তারাই ছিলো এই কাজের সবচেয়ে উপযুক্ত দল। পাঠকরা নিশ্চয়ই ইমরান এইচ সরকারের সেই দম্ভোক্তি ভুলে যাননি যখন সে বলেছিলো সরকারের চেয়ে শাহবাগই বেশি শক্তিশালী। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে শাহবাগ তাদের চিয়ারলিডিঙের কাজেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলো। প্রথমে তারা ইসলামি চেতনার পরীক্ষায় লাড্ডু মেরেছে, এবার তারা জাতীয়তাবাদী চেতনাতেও ফেল করে বসল।

দেশের প্রধান দুটি চেতনার পরীক্ষায় ডাব্বা মারা দলটি একটি দূর্নীতিপরায়ণ “স্কুল কমিটির” খুঁটির জোরে স্কুলে টিকে থাকলো তো বটে, কিন্তু এই টিকে থাকা তো আর সত্যিকারের বেঁচে থাকা নয়, বরং লাইফ সাপোর্টে বেঁচে থাকার শামিল। আপনি স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন হলে বুঝবেন যে এই সরকার পরিবর্তিত হয়ে গেলে শাহবাগকে বসতে দেয়া হবে না এটা যেমন ঠিক – তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে শাহবাগ নিজেই আর বসবে না। আন্দোলন আর চিয়ারলিডিঙের মাঝে যে স্থুল পার্থক্য – তা এতদিন যদি আপনার কাছে পরিষ্কার না হয়ে থাকে, সেদিন হবে।

আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে শাহবাগ নিজেদের কর্মকান্ডকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলো। প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সাথে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মিল একটিই – কম বেশি একই সময় স্থায়ী ছিলো দুটোই। কিন্তু মিলের এখানেই সমাপ্তি। কোথায় একটি বিদেশী শক্তির সাথে ৭১ এর প্রাণপন গেরিলা যুদ্ধ আর কোথায় এই বিরানীর গন্ধে ভুর ভুর করা পরিবেশে নৃত্যপটিয়সদের রোমাঞ্চকর মিলনমেলা। হায়, যে জাফর স্যার দূর্বার যৌবনকালেও কোনও এক অজানা কারণে মুক্তিযুদ্ধ মিস করে ফেলেছিলেন, আজ এই বার্ধক্যের করাল গ্রাসকে ফাঁকি দিয়ে তিনিও চলে এলেন যুদ্ধনৃত্যে যোগ দিতে।

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের নামে যে তামাশা শাহবাগীরা করল আগামি যত মাস এই সরকার থাকে তাতে চিয়ারলিডিং তারা চালিয়ে যেতে পারবে সন্দেহ নেই। কিন্তু যবনিকা পতনের পর দুটি জিনিস প্রতিভাত হবে স্পষ্ট ভাবে আমার বিশ্বাস:

১. “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের” ভিস্যুয়াল সার্কাসের কারণে প্রথমটির ব্যাপারে যে কাল্পনিক রোমাঞ্চ এই প্রজন্ম এতদিন মনে মনে পুষে এসেছিলো সেটি অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে গেছে।

২. এতদিন ৭১ ভিত্তিক জাতীয় চেতনা ও ইসলামি চেতনার মাঝে যে সমতা বিরাজ করছিলো সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। এগিয়ে এসেছে ইসলামি চেতনা। ইসলামপন্থিরা যদি বিশাল গাধামো না করে তবে সামনে তাদের জন্য সুদিন রয়েছে। যদিও তাদের গাধামো করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না, সেটা একটা ভ্যালিড সম্ভাবনা বটে। কিন্তু সে আরেকদিনের কথা।

উগ্র ধর্মপন্থার মোকাবেলায় কাকে বেশি প্রয়োজন?

এই লেখাটি পড়ার সময় মনে রাখতে হবে যে এখানে আমি একটি মাত্র প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করছি – সেটা হোলো উগ্র ধর্মপন্থার মোকাবেলার প্রশ্ন। এখানে দূর্নীতি, মানবাধিকার, অর্থনীতি এসকল প্রশ্ন Ceteris Paribas  অর্থাৎ অন্য সকল ইস্যুকে ধ্রুব ধরে কথা বলা হচ্ছে। উগ্র ধর্মপন্থিদের মোকাবেলার জন্য দুটি জিনিস দরকার: এক, এর কারণসমূহ দূর করা এবং দুই, যদি উগ্রপন্থা কেউ অবলম্বন করেই ফেলে তবে তাকে নিরস্ত করা। আমি এই দুটি দিক থেকে আলোচনাটা করতে চাই। Continue Reading

সংখ্যালঘু নিরাপত্তা প্রসঙ্গ: ইসলাম কী বলে?

আসিফ সিবগাত ভূঞা

আমাদের দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সবসময়ই একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে পরিগণিত হয়। বিশেষ করে সেক্যুলার ও বামপন্থি রাজনৈতিক মহলের একটি অভিযোগ যে বিএনপি সমর্থিত জোট – যার সাথে ইসলামপন্থি দলগুলো রয়েছে – ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট ক্ষমতার আসার সাথে সাথে এথনিক ক্লেনজিঙের একটি জোর অভিযোগ উঠেছিলো। বহু পত্রপত্রিকায়, বিশেষ করে ডেইলি স্টারে, সচিত্র কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো।

Continue Reading