মৃত্যুর মিছিলে আরও কজন

“মৃত্যুর মিছিলে আরও দুজন”- আজকের প্রথম আলোর হেডিং। বাসে আগুনে পুড়ে  দুটো মানুষ মরে গেলো। কী জঘন্য, কী ভয়ংকর! এই অপরাধের কোনো মাফ নেই। এই অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার হওয়া উচিত। এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার হওয়া খুব দরকার , শাহবাগে এ সকলের একত্রিত হওয়া দরকার। বাংলাদেশের “জেগে উঠা” দরকার। “ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই”, বলে স্লোগানে স্লোগানে মাতিয়ে দেওয়া দরকার “স্বাধীন” বাংলার আকাশ বাতাস। 

সেদিন ১৪ আর ১৬ বছরের দুটো ছেলে মরে গেল,  তবে আগুনে নয়, পুলিশের গুলিতে । গত কদিনে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে প্রায় ৫০ জনের মত। বেশীরভাগই তরুণ, কিশোর। সেই মৃত্যু- মিছিল আরো বড়, অনেক বড়। এভাবে গত ক’ বছরে হাজার হাজার নেতা-কর্মী মারা গেছে, গুম হয়েছে, জেলে গেছে।  প্রথম আলো কিংবা ডেইলি স্টার এদের নিয়ে  “সম্পূর্ণ রঙ্গীন” কোনো রিপোর্টিং করে না। এদের নিয়ে কোনো হৃদয়বিদারক টাইটেল হয় না। একই টাইটেল, মাসের পর মাস। “পুলিশের গুলিতে নিহত”।

কেনই বা করবে?  এরা তো গরীব “মানুষ” নয়। এরা গরীব “জানোয়ার”। “জানোয়ারের” আবার মানবাধিকার কী? এদের “জানোয়ার” ছানাপোনাগুলো চিৎকার করে আকাশ বাতাস কাঁদিয়ে তুললেও কোনো ফটোগ্রাফারের কিছু যায় আসে না। এদের মা “জানোয়ার” গুলো এদের কবরে বার বার হাত বুলালেও কিছুই যায় আসে না, আমাদের সেলিব্রিটি কলামিস্টদের।  ভ্রু কুচকে ভাবে-  “কেন” যে এরা  আমাদের “ট্রিগার হ্যাপী ” পুলিশের গুলির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়!  এদের জীবনে কোনো “গল্প” নেই। এদের কোনো স্বপ্ন ছিল না । এরা কেউ স্কুলে প্রথম হয় নি! এদের তো প্রেয়সী থাকতেই নেই। “জানোয়ারের” জীবনে আবার কিসের প্রেম?

Image

উপরের ছবিটি দেখুন। বাচ্চা মেয়েটির চোখগুলো দেখছেন? বিস্ময়। অগাধ বিস্ময়। মেয়েটি দেখছিল তার বাবাকে হত্যার দৃশ্য। নাটোরের বাবুর হত্যার দৃশ্য। বাংলাদেশে অবশ্য  আওয়ামী লীগ যারা করেন, এদের সমর্থক এবং যারা রাজনীতিকে “ঘৃণা” করেন, এদের ছাড়া আর কারো মানবাধিকার নেই। মেয়েটি সেটা জানে না। তার আছে “জানোয়ারের” অধিকার। তাইতো তার বাবা, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়া সত্তেও , রাস্তায়, প্রকাশ্য দিবালোকে, আওয়ামীদের হাতে “জানোয়ারের”  মৃত্যু বরণ করে, দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে  তাকে হত্যা  করা হয়। ফুটফুটে  মেয়েগুলো, বাবুর তিন মেয়ে, বিস্ময়ের সাথে দেখে তাদের বাবার জানোয়ার হওয়ার দৃশ্য। প্রথম আলো কিংবা ডেইলি স্টার এদের নিয়ে  “সম্পূর্ণ রঙ্গীন” কোনো রিপোর্টিং করে জানায় না এরা কেমন আছে। পাঠক জানতে পারে না,  ফুটফুটে মেয়েগুলো কত বড় হলো! বাবুর বউ, মহুয়া নামের রূপসী মেয়েটি, কেমন আছে!

ইলিয়াস আলী হঠাৎ এক রাতে হারিয়ে যায়। তার ছোটো মেয়েটা কাঁচা হাতে চিঠি লেখে। বাবাকে খুঁজে। ইলিয়াসের বউ, ছেলে মেয়ে নিয়ে ছুটে যায় গণভবনে। বিশাল ক্ষমতার অধিকারিনী, বাংলাদেশ আল্লাহর পরে যার ক্ষমতা (এবং কারো কারো মতে যার ক্ষমতা সেই একজনেরও নীচে না) সেই মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর পায়ে পড়ে যায়। “দিন না খুঁজে ইলিয়াসকে”/তার আগে এবং পরে  হারিয়ে গেছে আরো হাজার হাজার নেতা কর্মী। পুলিশের কাস্টডিতে মরে যায় মইন নামের এক মেধাবী তরুণ আইনজীবী। ছোট্ট একটি বাচ্চা নিয়ে মইন এর তরুণী স্ত্রী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

নতুন ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। নেতাকে না পেয়ে তার বউ, মেয়ে, জামাই, শাশুড়ি এমনকি শালার বৌকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে যায় এরা। ঠিকই তো আছে, শুধু নেতা কেন, নেতার চৌদ্দ পুরুষের মানবাধিকার থাকতে নেই, থাকতে পারে না।  নেতার বাসায় ককটেল ছুরুক, নেতার মেয়ের গাড়ী “দুর্বৃত্তদের” আক্রমণে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাক, জমানো টাকা শেষ হয়ে যাক মামলার পেছনে, পাড়ার লোকদের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যাওয়া “মানুষেরা” রেখে যায় বোতল ভর্তি পেট্রোল, উদ্দেশ্য পুড়িয়ে দিবে, জ্বালিয়ে দেবে নেতার সব, কী হয়েছে তাতে? নেতা তো “মানুষ” না। শুধু নেতা কেন, নেতার চৌদ্দ পুরুষের মানবাধিকার থাকতে নেই, থাকতে পারে না।

নেতা ভালো ছাত্র ছিল, বাবার আশা ছিলো ছেলে পিএইচডি করে থিতু হবে। কোথায় কি? দেশ জ্বলছে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে। নেতা ফিরে আসে দেশে। ঝাঁপিয়ে পড়ে  মুক্তি সংগ্রামে। কোথায় যায় ক্যারিয়ার!  যোগ দেয় শিক্ষকতায়। সারাজীবন সমঝোতা করেছেন বিবাদমান দলগুলোর মাঝে, তবে সমঝোতা করেন নি আদর্শের সাথে। আদর্শ খেতে খেতে নেতার বউ এর উঠে নাভিশ্বাস।  পাতি নেতা এসে বলে, স্যার, লাল কুমার বড্ড জ্বালায়। ভোট তো এমনিতেই দিবে না, একটু ঠাণ্ডা করে দেই স্যার? নেতা চিৎকার করে উঠে। খবরদার! একজন লাল কুমার ও যেন কষ্টে না থাকে। কিন্তু লাল কুমার ভোট দেয় না। লাল কুমারদের বড় দুঃখ, সবইতো ঠিক আছে,  নেতার মার্কাটা কেন নৌকা হইলো না!

সারাজীবন ভদ্র লোকের রাজনীতি করেছেন। এই নেতা তার কর্মীদের উজ্জীবিত করতে বলে ” শুধু দু একটি গাড়ি ভাঙলেই আন্দোলন হয় না, রাস্তায় হাজারে হাজারে নামতে হবে, সরকারের পতন ঘটাতে হবে”/এই কথা শুনে নড়ে চড়ে উঠে “মানুষেরা”/ তথ্য বাবা এবং তার চেলা চামুন্ডারা শুরু করে তথ্য বিকৃতি। যেন নেতার আদেশেই বাস পুড়ছে!  টপাটপ মামলা। মামলার সংখ্যা আর নেতার বয়স প্রায় ছুই ছুই – ৬৫ হয়ে গেছে মনে হয় এরই মধ্যে! তবুও নেতাকে টলানো যায় না। এরপর শুরু হয় তথ্যবাবার ফুট সোলজারদের আরেক কান্ড। তার স্বাক্ষর নকল করে ভুয়া পদত্যাগ পত্র প্রকাশ যার সারমর্ম আবার অহিংস – মানে তার প্রেসক্রিপশান মতো অহিংস আন্দোলন না হওয়াতেই পদত্যাগ! দলের “সহিংস” কর্মকাণ্ড সহ্য করতে না পেরে নেতা প্রস্থান করছেন! কতো দেউলিয়া আজ তথ্যবাবা এবং তার চেলারা। ষড়যন্ত্রে, প্রপাগান্ডায় কনসিস্টেন্সি পর্যন্ত রক্ষা করতে পারে না!

বাংলাদেশে গত দুবছর নেতার সাথে মেয়ের দেখা হয়েছে শুধু কাশিমপুর জেলে। চারদিকে গোয়েন্দারা বসে, নেতা গল্প করে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়াবহ শক্তির কথা,  গল্প করে সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বের কথা,  গল্প করে বিচার ব্যবস্থার দেউলিয়াত্বের কথা।  নেতাকে মেয়ে লেখে। বাবা, ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। এই বয়সে , এই শরীরে তুমি কোথায় আছো, কী খাচ্ছো ! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। আর কত দিন? কবে ভোর হবে?

ভোর তিনটায় নেতাকে গ্রেফতার করে অফিস থেকে, পায়ে তার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলির ক্ষত;  লাঠিটি পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয় না। তো কী হয়েছে? এরা তো  “মানুষ” নয়। এদের নেই “মানুষের” অধিকার। তাই ভীষণ যন্ত্রনায় পুড়ে ছারখার হয়ে গেলেও বলি- তবু দেশটা শান্তিতে থাকুক। দেশে আজ যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে তা নিভে যাক। দেশটা স্বাধীন থাকুক, সার্বভৌম থাকুক। আর একটা “মানুষও” যেন না মরে। দেবতারা সব মর্ত্যে নামুক। জয় হোক “মানুষের”।

এরপরেও  কথা থাকে। আমার শিক্ষা, মূল্যবোধ না হয় আমাকে  গান্ধীবাদে  দীক্ষা দিলো .এবং নিরাপদ আস্তানায় বসে এধরনের অদ্ভূত প্রার্থনায় উদ্বুদ্ধ  করলো.কিন্তু, আজ  রাস্তার ওই মিছিলটা, যেটা  বড় হচ্ছে খুব দ্রুত, ওই মিছিলটা কিন্তু একটা সিম্বল হয়ে যাচ্ছে। আরো হাজার হাজার মানুষ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, প্রার্থনায় নয়, বরং “জানোয়ারের” মৃত্যু বরণে। দেশের প্রচন্ড ক্ষমতাশীল ঐ “মানুষটি” পারবে না এই প্রলয় রুখতে। আর সেই প্রলয়ে ভাসবে কিন্তু সবাই। “মানুষ” এবং “জানোয়ার” সবাই।

আধুনিকাদের আড্ডায় নারী অধিকার

Image

অস্ট্রেলিয়ানদের প্রিয় বিনোদন হোল স্পোর্টস, বাঙালিদের কী বলুন তো? আড্ডা।
বহুদিন পরে দেশে বেড়াতে গিয়ে দিনে রাতে জমজমাট আড্ডা দিচ্ছি। হরেকরকম বিষয়ে বাগযুদ্ধ। বয়স, স্থান ও জেন্ডার ভেদে আড্ডার বিষয়ও বদলে যায় মাঝে মাঝে। “নারী অধিকার” বিষয়টি ভীষণ জনপ্রিয় এসব আড্ডায় । নারী অধিকারে আমার বন্ধুদের আগ্রহ আমাকে চমৎকৃত করেছে, করেছে আশান্বিত। তবে আমার শিক্ষিত, সুবিধাপ্রাপ্তা বন্ধুরা/আত্মীয়ারা নারী অধিকারের/স্বাধীনতার যে আকাঙ্ক্ষাটা করেন, তা আমাকে বিস্মিত করেছে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণেই। পাঠকদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি নারী অধিকার বিষয়ক কিছু আড্ডা, বিস্ময় জাগানিয়া সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণ এবং আমার নিজস্ব ভাবনাগুলো !

এক:
ডিনার পরবর্তী এক আড্ডায় হঠাৎ এক আত্মীয়া চোখ-মুখ ভয়ঙ্কর করে বলে বসলেন “খেয়াল করেছ তুমি? ইদানীং যে ঢাকায় হিজাবি মেয়ে বেড়ে গেছে”!? প্রবীণ প্রগতিশীল এই মহিলার ত্বক খুব চকচকে, দামি শাড়ী পড়নে, থাকেন গুলশানে, নিজেদের ফ্ল্যাটে। বিয়ে, শপিং, রূপচর্চা, বন্ধু-দর্শন ছাড়া বাসা থেকে বেরন না বললেই চলে। দারুণ রান্না করেন এবং হিন্দি সিরিয়ালে সামান্য আসক্তি আছে। একটু থতমত হলাম প্রশ্নটা শুনে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না, তিনি কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পুত্রসন্তানের সেই বিখ্যাত লেখাটির কোনো রেফারেন্স দিচ্ছেন? নাকি আমিনী এফেক্ট? “অর্থ কী?” প্রশ্ন করাতে জবাব পেলাম “মানে বাংলাদেশে পর্দানশীন মেয়ে অনেক বেড়ে গেছে, কী যে হবে দেশটার, নারী স্বাধীনতা সব গোল্লায় গেলো!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আত্মীয়া।

ঢাকার রাস্তায় হিজাবি মেয়ে দেখা যায়, সত্য। তবে ডানাকাটা ব্লাউজ আর শিফনের ফিনফিনে শাড়ী পরিহিতা মেয়েদেরও দেখা যায়। সুন্দরী ও সুগঠিত নারী-পুরুষ অন্তরঙ্গ পরিবেশে, প্রায়ই দেখা যায় ক্যাফে অথবা লাউঞ্জগুলোতে। এ প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু, যিনি গুলশানের একটি লাউঞ্জের সত্ত্বাধিকারী – তার একটি উক্তি মনে পরছে ,“বাচ্চালোগ প্রেম না করলে তো লাউঞ্জের ব্যবসা সব চাঙ্গে উঠবে”/আবার উত্তরবঙ্গের পথে দেখেছি শাড়ীর ওপরে ছেলেদের ঢোলা শার্ট পড়া মহিলারা ধান শুকাচ্ছে রাস্তায় (অভিনব পদ্ধতি, চলন্ত গাড়ীর চাকায় ধান মাড়াই)। ক্ষেতে কাজ করছে মেয়েরা মাথায় কাপড় দিয়েই। ওড়নাটা মাথায় তুলে শত শত মেয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টসে। জুতার কারখানায় ছেলে মেয়ে এক সাথে কাজ করছে, হাসছে। গ্রামের মসজিদের ভেতরে আমি নিজে গিয়েছি ইমাম সাহেবের সাথে । দেখেছি, মসজিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ভাই-বোন এক সাথে, পিঠে স্কুলের ব্যাগ। দিগন্ত নামের একটি টিভি চ্যানেলে হিজাবি মেয়েদের চমৎকার শুদ্ধ বাংলায় খবর পড়তে শুনেছি। একই সাথে একুশে টিভিতে দেখেছি, পশ্চিমা পোশাকে দারুণ ফিগারের তরুণীরা উপস্থাপনা করছেন ইংরেজিতে। “ঢাকার রাস্তায় আমারও আছে হাঁটার অধিকার”- এই শ্লোগানে মুখরিত রাজপথে হাত ধরে হেঁটে যেতে দেখেছি হিজাবি এবং অহিজাবি মেয়েদের। চমৎকার সহাবস্থান দুই মেরুর- আমার অত্যন্ত পছন্দের।

Image

তবুও একটা অজানা জুজুর ভয় এই প্রগতিশীল মহিলাদের। গত এক দশকে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণী যখন প্রায় বিলুপ্ত, তখন নতুন উচ্চবিত্তের ধর্ম (ইসলাম!) বিষয়ে উন্নাসিকতা ও আতংক চোখে পড়ার মতো। মজার ব্যাপার হোল, উল্লেখ্য মহিলার বাবা কিন্তু একজন মধ্যবিত্ত সরকারী চাকুরে ছিলেন। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ মধ্যবিত্তে উত্থান (স্বামীর বদৌলতে) তার চিন্তা, চেতনায় এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন যাতে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে পশ্চিমা বিশ্ব, ভারতীয় মিডিয়া এবং লাদেন। তিনি নিজের অজান্তেই অপছন্দ করছেন নিরপরাধ হিজাবি মেয়েটিকে শুধু মাত্র তাঁর ধর্ম চর্চার কারণে, মনে করছেন নারী স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক। আরো একটা কারণ আছে হয়তো: “এই মেয়েরা কেন আমার মতো না!” এটাকে কি “রেসিজম” বলা যায় ? বিস্মিত হই আমি। মহিলা পারিবারিক বন্ধু, তর্কে না যাওয়াই শ্রেয়। তার দীর্ঘশ্বাসের জবাব আর দেয়া হোল না।

দুই:
বন্ধুদের আরেক আড্ডায় এক বিখ্যাত ব্যবসায়ী-কাম-রাজনীতিবিদের মেয়ে বেশ তেজোদ্দীপ্ত হয়েই বলে বসলো; “শুধুমাত্র এই নারী-নীতির জন্যেই শেখ হাসিনাকে আমার ভোটটা দেব”/পশ্চিমে শিক্ষিত মেয়েটির ভোটাধিকার প্রয়োগের তুমুল ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা না করে উপায় নাই। তাকে প্রশ্ন করা হোল, তো নারী-নীতির ঠিক কোন বিষয়টি তোমাকে এতটা মুগ্ধ করেছে? উত্তর পাওয়া গেল “ঐ যে উত্তরাধিকারের ব্যাপারটা” (প্রসঙ্গত বলে রাখি, মেয়েটির কেবল একটিই ভাই এবং লোকমুখে শুনি যে তার পিতার সম্পদের পরিমাণ টাকায় বললে কম হলেও কয়েক শ’কোটি)/ আচ্ছা, ব্যপারটা তাহলে অর্থনীতিক। আর কী ভালো লাগলো এই নীতিমালার? “আর কিছু লাগে? ঐ একটাই যথেষ্ট। বাবার সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার ছাড়া সিভিলাইজেশান চলতে পারে”? তা বটে।

তার কিছুদিন আগেই হেনার মৃতদেহে দোররার দাগ নিয়ে হয়ে গেল মৌসুমী হইচই, বগুড়ার একটি মেয়ের মাথা কামিয়ে দিলো ফতোয়াবাজরা। মিজানুরের ওপর মোটর সাইকেল উঠিয়ে দিয়েছিল বখাটেরা, কেননা সে প্রতিবাদ করেছিল ইভ-টিজিং এর। এরই মাঝে আমিনীর মত লোকেরা রাজপথ কাঁপিয়ে তোলে, সরকার তেড়ে যায় আমিনীর দিকে, কেননা বান্ধবীর মতে, নারীর অধিকার রক্ষার ঝাণ্ডা তো তাদেরই হাতে, দায়িত্ব আছে না? ওদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা মহিলারা মানব বন্ধন গড়ে তোলে, ইউনূস সাহেবের মান রক্ষায়। কী আশ্চর্য! “সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমিতে” গণধর্ষিত হয়ে যেদিন একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছিলো, সেদিন, হ্যাঁ, ঠিক সেদিনই শ্বশুর এবং পিতার বিশাল সম্পদের প্রতিশ্রুতির তলে, “ নারী অধিকার” নিয়ে পরমা সুন্দরী বান্ধবীর আবেগভরা উচ্ছ্বাস রেস্টুরেন্টের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে উপভোগ্যই হয়েছিলো।

তিন:
এক সদ্য বিবাহিতা আত্মীয়া বাসায় এলেন দেখা করতে। জানলাম, তিনি, দেশে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে চলে গিয়েছিলেন পশ্চিমে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে। তার পড়নে ছিল ঢাকাই সূতী শাড়ি, স্লীভলেস ব্লাউজ, মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা। জানা গেল, খাঁটি বাঙালি সংস্কৃতির অনুরক্ত আমার এই আত্মীয়াটি শেকড়কে শ্রদ্ধা করে সিঁদুর এবং শাঁখা পড়েন। বিয়ের অনুষ্ঠানেও সিঁদুর পড়িয়ে দিয়েছিলো তার স্বামী। এর কারণ বাঙালি মুসলমান আগে সব হিন্দু ছিল, ইসলাম ধর্মপ্রচারকেরা এদেশে এসে জোড়-জবরদস্তি করে তাদের মুসলমান বানিয়েছে। তাই প্রতিটি হিন্দু ঐতিহ্যে আমাদের রয়েছে পূর্ণ অধিকার।

ঘটনাচক্রে কলকাতা থেকে আরেক পারিবারিক বন্ধু (আমার মা’র স্কুলবেলার বন্ধু) এবং তার স্বামী এসেছেন বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে, এই ঢাকায়। অঙ্কে গ্র্যাজুয়েট ভদ্রমহিলা হিন্দু, কিন্তু শাঁখা-সিঁদুর পড়েন না। তার ভাষ্য: শাঁখা-সিঁদুর হিন্দু মহিলাদের জন্য অত্যন্ত অপমানকর! এর সাথে বাঙ্গালিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই! কী অদ্ভুত! আমার খাঁটি বাঙালি আত্মীয়াটিকে পরে একদিন পাকড়াও করে যখন ঘটনাটা বললাম, একটু বোধ হয় বিব্রতই হয়ে গেলেন। বললেন, আমরা কেন সব ধর্মের ভালোটা নিতে পারি না, কেন ধর্মে-ধর্মে এতো হানাহানি, কেন আমরা কেবল মানুষ এই পরিচয়টুকুই যথেষ্ট না, ইত্যাদি।

পাঠক! লক্ষ্য করুন, উপরের প্রতিটি আলাপের মূল চরিত্র একজন সচ্ছল শিক্ষিত নারী, সমাজে যাদের “ priviledged” অথবা সুবিধাপ্রাপ্তা বলা হয় । এদের অনেকেই নারীবাদ, আধুনিকতা, বাঙ্গালিত্ব নিয়ে যার পর নাই চিন্তিত যদিও, বাংলাদেশের মেয়েদের আসল সমস্যা উপলব্ধি করার সময় এবং সম্ভবত ইচ্ছেটাও কম। এরা যে অবস্থানে আছেন, ভোগবহুল সে অবস্থান থেকে তার সম্ভাবনাও কম, স্বীকার করছি। আমার আত্মীয়া, যিনি শাঁখা-সিঁদুর পরে মনে করছেন সত্যিকারের বাঙালি নারী হওয়া গেল, তিনি বুঝেই উঠতে পারছেন না, এই বাঙ্গালিত্ব তার নিজের বানানো, ঠিক অথেনটিক না। বাঙালি হতে গিয়ে তিনি কিছু বাঙালি হিন্দু নারীর বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন যৌক্তিক কারণেই। ঠিক যেভাবে হিজাবি মেয়েটি বিরক্ত করছে আরেকটি গ্রুপকে! আবার হিজাবি মেয়েটির হিজাব পড়ার অধিকার/স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও কি বিতর্কের অবতারণা করে দেয় না? এই বিচিত্র স্ববিরোধিতার একটি কারণ সম্ভবত আইডেন্টিটি ক্রাইসিস । সম্ভবত এ জন্যই বাংলাদেশী নারীর অশিক্ষা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা লাঘবে সুবিধাপ্রাপ্তা শিক্ষিত নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারছে না । নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তাই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে সম্পত্তির সমান অধিকারে অথবা পোশাকের স্বাধীনতায় !

আধুনিকা এই সুবিধাপ্রাপ্তারা একটি সহজ ব্যাপার কি বুঝতে সক্ষম যে আজ তারা যে অবস্থানে আছেন, সেই একই অবস্থানে আসতে দেশের বাকি ৯০ ভাগ নারীর হয়তো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হতে পারে? ১৯৯৫ সালে চীনে আয়োজিত বিশ্ব নারী সম্মেলনে ইরানী নারীদের প্রতিনিধিদের যে দাবী দাওয়া ছিল (নারী স্বাধীনতার লক্ষ্যে), পশ্চিমা স্ট্যান্ডার্ডে সেটা তখনই ছিল অধীনস্ততার লক্ষণ। আমাদের দেশেও এই বাস্তবতাটি বর্তমান। সম্পত্তির সমান অধিকার নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত প্রয়োজন, তবে তার আগে আরও বেশি প্রয়োজন, সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি শ্রেণীতে বাকি ৯০ ভাগ নারীর শিক্ষা এবং উপার্জনের ক্ষমতা নিশ্চিত করা। এটা না করে, সুবিধাপ্রাপ্তারা নারী অধিকারের লঘু বিষয়গুলো নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুললে সংখ্যালঘু নারীদের সাথে দেশের সংখ্যাগুরু নারীদের মাঝে একটা বিভেদ রেখা তৈরি হয়। এবং তখনি সমাজের ৯০ ভাগ নারীর কাছে এরা পরিণত হয় লাফিং স্টকে । যে “ Freedom of expression” নিয়ে আমার আত্মীয়াদ্বয় অত্যন্ত চিন্তিত ,“Freedom of choice” এবং “Economic freedom” না থাকায় দেশের বেশির ভাগ নারীর কাছে তা “ Cruel joke”।

Image

শুরুটা আসলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকেই হয়, সবখানেই হয়েছে। বাংলাদেশে তথাকথিত আধুনিকাদের ধারণাও নেই যে তারা নয়, বরং সাধারণ খেঁটে খাওয়া, মাথায় কাপড় দেয়া কিংবা না দেয়া, দ্রুত পায়ে হেঁটে চলা পারিপাট্যহীন কৃষ্ণকায় মেয়েরাই এদেশের নারী বিপ্লবের প্রকৃত নেতৃত্ব দিচ্ছে, এই সমাজটাকে বদলে দিচ্ছে। বুঝে হোক না বুঝে হোক তারা যে কাজটি শুরু করে দিয়েছে সেটিই আসল। “সমধিকার” যেখানে আরাধ্য সেখানে ধর্ম হোক, রেস হোক কিংবা জেন্ডার, কেউই ভারসাম্যের ভুল দিকটায় থাকলে আমন্ত্রিত হয় না যতক্ষণ না সে অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণ করে। আমার পরিচিত কিছু আধুনিকাদের কাছে যে “নারী স্বাধীনতা” শুধুই অনুভব কিংবা আড্ডার বিষয়, বড় জোড় কুড়িয়ে নেওয়ার জিনিষ, সমাজের ৯০ ভাগ নারীর কাছে সেটা বাস্তবতা, খুব কঠিন বাস্তবতা এবং তার চেয়েও ভয়ঙ্কর – প্রতিদিনকার লড়াইয়ের বাস্তবতা। এই লড়াইয়ের কুশলীরা এতোটাই সুযোগ্য ও অসাধারণ যে আমি কিংবা আমার ওইসব আত্মীয়াদের কোনও আড্ডায় অংশগ্রহণ ছাড়াও তারা এগিয়ে যাবে সুনিশ্চিতভাবে। আমি কিংবা আমার আত্মীয়ারা শুদ্ধ বাংলায় নারী অধিকারের বিশাল বক্তৃতা দিয়ে নিজেরা জাতে উঠতে পারি, কিন্তু এদেশটাকে জাতে উঠিয়েছে ওইসব লড়াকু মেয়েরাই। তাঁদের ধন্যবাদ !

(লেখাটি পূর্বে বিডিনিউজ এ প্রকাশিত হয়েছে)

“কালীদা, বাঙালী হওয়া কাকে বলে?”

Image

সময় কাল, ১৯৭১/  বিহান তার ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছে । সীমান্তে যাবে, training নিতে, যুদ্ধে যাবে বিহান। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অবিচারের বিরুদ্ধে একটি ন্যায়যুদ্ধে । ১৬ বছরের দিহান অস্থির হয়ে ছুটে আসে বিহানের ঘরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ভাইয়া তুমি রফিকে বাঁচাও। মোহাম্মদ রফি দিহানের বন্ধু, সমবয়সী। বাইরে গোলাগুলি শোনা যাচ্ছে। বিহান শুধু বলল, রফিকে বাসায় এনে উপরের ঘরে লুকিয়ে রাখ।  কিছু হবে না ওর। আমি আছি না। হেসে বেরিয়ে গেল বিহান। দিহান ছুটে গেল  রফির সন্ধানে।

বিহান একটু চিন্তিত। খবর পেয়েছে , বিহারীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাঙালীরা। যুদ্ধে এটা হয়ই বোধ হয়। কিছু বাঙালী মনে করছে, এই উর্দু বলা বিহারীগুলোকে ধরলেই  বোধ হয় পাকিস্তানীদের নির্মম অত্যাচারের শোধ নেওয়া হবে। বিহান ভাবে, বন্ধু পবনদা, মিহিরদা, আজিজ, তাজু ,মানস এদের নিয়ে  কিছু একটা করবে, সীমান্তে যাবার আগেই। এই নিশ্চিন্তপুরে এটা হতে দেয়া যায় না।

রফি লুকিয়ে আছে, দোতলার ঘরে, ঠিক বারান্দার পাশেই। দিহানও আছে তার সাথে। বুক ফুলিয়ে বার বার বলছে, রফি, ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিহান ভাইয়া তো মুক্তিযোদ্ধা, ওরা কেউ এখানে তোকে খুঁজতে আসবে না।  রফি শুধু বলে, “আব্বা, আম্মা, ভাইয়া এদের তো কোনো খবরই পেলাম না। ওদের যদি তোর এখানে নিয়ে আসতে পারতাম!” হঠাৎ বাইরের রাস্তায় আওয়াজ, রফির মায়ের কন্ঠ, “ও বেটা, আমার রফি কোথায়?”; রফির বড় ভাই, হাসান এর গলা শোনা যায়,“ও আম্মা, ও বাঁচুক”! চিৎকার শোনা যায়, “চুপ”/ রফি ছুটে যায় রাস্তায়। দিহান ওকে আটকাতে পারে না।  রফি যোগ দেয় বিহারীদের কাফেলায়, ওরা তাদের বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, শোধ নিতে!

আচমকা কালিভূষণ! কালিভূষণ নাটক শেখায় ছোট্ট শহরটিতে, দিহান, বিহান, রফি, হাসান সকলেই  নাটক শিখেছে  কালিদার কাছে। যে বছর রফি, “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” আবৃত্তি করে প্রথম পুরস্কারটা পেল, সে বছরই কালিদা তাকে টেনে নিয়ে গেল তার নাটকের দলে, তখন থেকেই রফি কালিদার প্রিয় ছাত্র!

কালিভূষণ কাফেলার সামনে এসে দাড়ায়। রফি, কালিদাকে দেখে হাসে, বলে উঠে চমৎকার শুদ্ধ বাংলায়-

“কালিদা, বাংলা আবৃত্তি শেখালে, বাংলা নাটক শেখালে, শেখালে না কি করে বাঙালী হতে হয়”।

মুহুর্তের জন্য থমকে গেলেও পরমুহুর্তেই কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি খায় কালিভূষণ, ধুলো ভরা রাস্তার উপরে। “বাবাগো আমার, তোরা ছেড়ে দে ওকে। ওতো বাচ্চা ছেলে আমার!”

বীর পুরুষের দল, ধমকে উঠে কালিভূষণকে, “আহ, কালিদা, কাজের সময় জ্বালাতে এসো নাতো, সরে যাও,” একরকম ধাক্কা দিয়েই সরিয়ে দেয় তাকে। কালিভূষণ কাঁদতে থাকে, বীর পুরুষের দল এগিয়ে যায়, এগিয়ে যায় রফি, আমানত, হাসানদের কাফেলা।

Image

তারপর, অনেক দিন পার হয়ে যায়,লাখো বাঙালীর  আত্মত্যাগ, হাজারো নারীর সম্ভ্রম, আর একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে বাঙালী পায় নতুন একটা দেশ, বাংলাদেশ। বাংলাদেশীরা যুগ যুগ ধরে গর্ব করতে থাকে এই দেশ নিয়ে, তর্ক করতে থাকে স্বাধীনতার পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিল, এনিয়ে চায়ের কাপে উঠে ঝড়।

এভাবে ৪০ বছর কেটে যায়। এরি মাঝে একদিন হজরত শাহজালাল এয়ারপোর্ট এ ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এর একটি বিমান এসে নামে। মোহাম্মদ রফির আরেক ভাই, মোহাম্মদ নায়ীম, এসে পৌছায় ঢাকায়।  ৭১ এ সে এবং তার আরেক ভাই  লন্ডনে পড়ছিল। ঢাকায় পৌঁছেই সোজা চলে যায় বাসের উদ্দেশ্যে। বাস এসে থামে ঠাকুরগাঁয় । চৌরাস্তায় এসে অবাক হয়ে চারদিকে তাকায় নায়ীম । কত্ত বদলে গেছে শহরটা । কি যেন খুঁজে সে, নিজেও বোঝে না কি তা ! হঠাৎ চোখে পড়ে খুব চেনা একটা মুখ। একটু ইতস্তত করে এগিয়ে যায় সে।

“পবনদা; চিনতে পারছ?” শুদ্ধ বাংলায় প্রশ্ন নায়ীম।

পবন চমকে উঠে। “নায়ীম না”!

“হুম”।

দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অপলক। কত্ত ভাবনা, কত্ত স্মৃতি ভেসে উঠে।  জড়িয়ে ধরে পবন নায়ীমকে।

“কবে এলি নায়ীম ?”

“গতকাল, পবনদা। কেমন আছো তুমি, তোমরা ??”

“আছি ভালই”।

পবন নায়ীমকে নিয়ে যায় বিহানের বাসায়। বৈঠকখানায় বসে পেপার পড়ছিল বিহান। নায়ীমকে দেখে বুঝে উঠতে পারে না বিহান কি বলবে । নায়ীম এগিয়ে যায় বিহানের দিকে। বাঁধ ভেঙ্গে যায় বিহানের। বলে ওঠে, “আমাকে মাফ করে দিস নায়ীম, পারিনি আমি ওদের বাঁচাতে, আমায় মাফ করে দিস”।

“বাদ দাওনা বিহান ভাই, Nothing is unfair in love and war.  তোমরা ভালো আছো তো? এতো প্রাণ, এতো রক্তের বিনিময়ে এই মায়াভরা দেশটাতে তোমরা সুখে আছো তো?”

কাঁদতে থাকে নায়ীম, কাঁদতে থাকে পবন। ৪০ বছরের পুরনো কান্না।

তারপরে আরো কিছু দিন কেটে যায়। আড়িয়াল বিলের মানুষগুলো ফুঁসে উঠে, বাপদাদার ভিটা রক্ষার সত্য আন্দোলনে, একটা বোকা নিরুপায় পুলিশ মরে যায় এর মধ্যে, শেয়ারবাজারের ভরাডুবিতে লাখ লাখ মানুষ নেমে পড়ে পথে, সংবিধান মুদ্রণ, পুনর্মুদ্রণ এর খেলা চলে, মেহেরজান নিয়ে ব্লগে, ব্লগে চলে বিশাল উত্তেজিত আলোচনা, ধর্ষিত হেনার মৃতদেহের শুকিয়ে যাওয়া দোররার দাগ নিয়ে চলে গবেষণা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত আলেমেরা পায় ফতোয়া দেবার সরকারী অনুমতি, ওদিকে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে থাকে ফেলানি।

আগের প্রজন্মের গর্বের বাংলাদেশ রয়ে যায় আমাদের ভালোবাসার হয়ে, কর্পোরেট নারীপুরুষ লাল-সবুজ জামা পরে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে উঠে নীরব সংসদ ভবনের সামনে। আর আমি, সারাজীবন বিজ্ঞান পড়া মানুষটা,  প্রাপ্ত বয়স্কের মাথা নিয়ে খুঁজি একটি জরুরী প্রশ্নের উত্তর; “ বাঙালী হওয়া মানে কি?”

(চরিত্রগুলোর নাম বদলে দেওয়া হয়েছে)

দেবতারা সব মর্ত্যে নামুক -২

Bangladesh

ঢাকা কেন্দ্রিক ক্রাউড আর প্রবাসীদের সেকি উচ্ছ্বাস দুই বৃদ্ধ মহিলার ফোনালাপ নিয়ে! যে যার ফ্রন্ট থেকে বিশ্লেষণ করে চলেছে এই আলাপ। কেউ বলছে, হাসিনা ছিলেন শান্ত। কেউ বলছে, নাহ, তিনি খুঁচিয়েছেন খালেদাকে বড্ড বেশি। কেউবা বলছে, খালেদা ছিলেন অফেন্সিভ। রেগে গিয়ে অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন। ইত্যাদি। I was least interested to listen to the conversation. আমি আন্দোলিত হই না। আমি অপেক্ষা করছিলাম রেজাল্ট এর জন্য। কেননা, ওদিকে মানুষ মরতেই আছে গুলিতে, বোমায়। আবারও বলি, আমি অপেক্ষা করছিলাম রেজাল্ট এর জন্য। কেননা, আমি অস্থির হয়ে আছি আমার মা, বাবার নিরাপত্তার চিন্তায়।(দুদিন আগেই বাসার সামনের গলিতে ফেটেছে বোমা, মোটর সাইকেলে করে কারা যেন টহল দেয় বাসার সামনে)।
Continue Reading

দেবতারা সব মর্ত্যে নামুক-১

মিডিয়াতে গরম গরম খবর- দুই নেত্রীর ফোন আলাপ।টিভি সাংবাদিকরা ছুটছে গণভবন আর গুলশানে। আহা, কি কথা দুজনার! আর ওদিকে লাশ পরছে, দুদিনে ১৫টা, গরীব মানুষের লাশ!
ফেসবুকে বিখ্যাত অনলাইন একটিভিস্টরা ব্যস্ত নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নিজেদের জ্ঞান প্রচারে! আহ, কত্ত বড় সুশীল। আর ওদিকে লাশ পরছে, দুদিনে ১৫টা, গরীব মানুষের লাশ।

Image

২০০৬ এ একদিনে ৬টি লাশে সরকার পরেছিল। আর আজ দুদিনে ১৫টা লাশে কিছুই যায় আসে না! অর্থাৎ লাশেরও দাম কমেছে!

বিএসএফ বাংলাদেশী বৃদ্ধের লাশ ঝুলিয়ে রাখে সীমান্তে, বাংলাদেশের নাকের ডগায়। মেরুদন্ডহীন বিজিবি কিছুই করে না। অথচ নিজের দেশের মানুষের উপরে নির্বিচারে গুলি চালায় এই বর্ডার রক্ষা বাহিনী! বাহ, কত্ত বীর পুরুষ এরা!

<a Continue Reading

A Bridge too far

Image

প্রথম কিস্তি
দ্বিমতের  অবকাশ নেই, বাংলাদেশীরা জাতি হিসেবে homogenous ! শ্যামলা গায়ের রঙ, উচ্চতা মাঝারী, চেহারা তেমন sharp নয়, চুল কালো। গড়ে শারীরিক অবয়বটা অনেকটা এরকম। সাধারনত  কমন জেনেটিক মেকআপ এর জন্যই এমনটি হয়।  আমি অনেকদিন ধরেই এ জাতির মানসিক দিকটি নিয়ে ভাবছি।  বিদেশী কিছু সার্ভেতে দেখা গেছে- এরা খুব সুখী। অত্যন্ত আনন্দের কথা। দারিদ্র, উষ্ণ জলবায়ু, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ট্রাফিক জ্যাম, দুর্নীতি, বিশাল জনগোষ্ঠী ইত্যাদি সমস্যার পরেও এ জাতি কেন সুখী? আসলেই কি সুখী?  চাহিদা কম ?  জেনেটিক মেকআপের কথা আগেই বলেছি। জেনেটিক মেকআপ শুধু শারীরিক অবয়ব নির্ধারণ করে না, মানসিকতাও প্রভাবিত করে! এমনও  জিন ( Anger gene) আবিষ্কার হয়েছে, যার একটু “এদিক ওদিক” (gene mutation ) শুধু মাত্র রাগী মানুষদের শরীরে পাওয়া যায়।  কিছু gene mutation  হয়তো কাউকে করে অতিরিক্ত অভিমানী!
আচ্ছা, বাংলাদেশীদের কিছু exclusive  gene mutation তো হতেই পারে! একারণেই বোধ হয়, কেউ কেউ আমরা গাড়ি ভাঙ্গি, রাস্তাঘাটে গালি  গালাজ করি, কথা বেশি বলি, এবং এত সমস্যার পরেও নিজেদের সুখী ভাবি। আমরা কিছুটা পরশ্রীকাতরও  ( আমার জানামতে, পরশ্রীকাতরতার কোনো ইংরেজি নেই, শব্দটি একেবারেই বাঙালী জাতির উদ্ভাবন, এরকম আরেকটি শব্দ হলো অভিমান) ! সব সময় আবেগের তুঙ্গে অবস্থান আমাদের! আবার রানা প্লাজা ধসে পড়ে যখন, এ জাতির মানুষেরাই দিগ্বিদিক ভুলে ঝাপিয়ে পড়ে উদ্ধার কাজে, জীবনের তোয়াক্কা না করে! আমি ভাবছিলাম বাংলাদেশীদের  জেনেটিক মেকআপ নিয়ে। এদের জিনের “এদিক ওদিক” গুলো কেমন? কেন হলো? কিভাবে হলো? কবে হলো?Continue Reading