চির উন্নত মম শিরঃ আগষ্ট বিপ্লব প্রসঙ্গ

এমন একটি সেনাবাহিনী কল্পনা করুন, যারা সদ্য একটি যুদ্ধ শেষ করে ব্যারাকে ফিরেছে । তাদের ফায়ার আর্মস বা মিলিটারী টেকনোলজি বেশ প্রাচীন আমলের । কিন্তু সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার মতো জ্ঞান, সাহস এবং দৃঢ়তা তাদের আছে । আবার কল্পনা করুন এমন একটি সেনাবাহিনী যারা জীবনে কখনো যুদ্ধই দেখেনি । প্রতিসপ্তাহে কমপক্ষে তিনটা করে পার্টিতে অ্যাটেন্ড করে, আনুষ্ঠানিকতায় দেশের মধ্যে শীর্ষে তাদের অবস্থান, সবার কাছে স্যার-স্যার শুনতে থাকে প্রতিনিয়ত । অবশ্য তাদের প্রশিক্ষণ আছে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার বিষয়ে । আপনাকে যদি বলা হয় দুটি সেনাবাহিনীর মধ্যে দায়িত্বশীলতার তুলনা করতে, আপনি অবশ্যই প্রথম দলকে এগিয়ে রাখবেন যদি সত্যিকার অর্থে সেনাবাহিনীর মূল্যায়ন করার মতো শিক্ষা আপনার থাকে ।

১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে কারো অজানা নয় । এ বিষয়ে যথেষ্ট ইতিহাস লেখালেখি হয়েছে, কলাম পড়া হয়েছে, ডকুমেন্টারি দেখা হয়েছে, ফেসবুকে নোট/স্ট্যাটাস পড়া হয়েছে । আমিও এটা নিয়ে লিখতে যাচ্ছি না । এতোবড় ঘটনার নিখুঁত বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা যেমন আমার নেই, তেমনি সস্তা মকারি করে রম্য লেখারও উদ্দেশ্য নেই । বরং আমি এখনো আগস্ট বিপ্লবের প্রকৃত তাৎপর্য এবং সাফল্যের শিক্ষণীয় দিকটি বুঝতে চেষ্টা করি । যতোবার আগস্টের গল্প শুনি বা আগস্ট মাসে শোক প্রকাশের কালো পতাকা দেখি, আমার মনে একটা অদ্ভুত রকমের ডিলেমা তৈরি হয় । সেটা শেয়ার করাই আমার লেখার মূল প্রেরণা ।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একধরণের অচলাবস্থা চলছে এটা সত্য । সম্ভবত ৭৫ সালেও প্রায় একই অচলাবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছিলো । যেহেতু বাংলাদেশের কোন নিরপেক্ষ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি, আমরা কোন এক বা একাধিক লেখকের বই পড়ে বা কয়েকটা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখে অথবা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সত্যিকার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম হবো- এটা ভাবাই বাতুলতা । তাহলে আমরা যারা এই প্রজন্মে বড় হয়েছি, তাদের সামনে একটিমাত্র পথ খোলা থাকে । সেটা হলো নিজেদের স্বশিক্ষিত বিচারবোধ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের প্রিম্যাচিউর বার্থ থেকে শুরু করে ৭৫ সালের দিনগুলো পর্যন্ত বুঝে বুঝে ১৫ আগস্টের মূল্যায়ন করা । আপাতত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সময় নষ্ট না করে প্রথমেই দেখে নেয়া যাক আগস্ট বিপ্লবের চারটি লক্ষ্য মূলত কি ছিলোঃ

১। রুশ-ভারতের নাগপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা ।

২। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ।

৩। ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ নামে বাকশাল ও মুজিব সরকারের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা ।

৪। কৌশলগত কারণে স্বল্প সময়ের জন্য সংসদকে বলবৎ রেখে সাংবিধানিকভাবে একটি দেশপ্রেমিক (সর্বদলীয়/র্নিদলীয়) অস্থায়ী সরকার গঠন করা ।

চলুন দেখে নিই অস্থায়ী সরকারের কাজগুলো কেমন হবার কথা ছিলোঃ

১। বাকশাল প্রণোদিত শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশোধনী, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা আইন, রক্ষীবাহিনী আইন, আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আইনের পরিপন্থী শ্রমিক আইন ও অন্যান্য কালা-কানুন বাতিল করা ।

২। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে দেশে অবিলম্বে প্রকাশ্য রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ।

৩। সকল রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া ।

৪। সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা ।

৫। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকি মোকাবেলা করার জন্য ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলা ।

৬। সমাজতন্ত্রের নামে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ, স্বেচ্ছাচারী একনায়কত্ব ও সরকারি সহযোগিতায় জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, চোরাচালান ও অবাধ দুর্নীতির ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটিয়ে বিপর্যস্ত দেউলিয়া অর্থনীতির পূর্ণবিন্যাসের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ।

৭। জাতীয় জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বিচার বিভাগের পুর্ণ স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশে আইনের শাসন প্রবর্তন করা ।

৮। প্রশাসন কাঠামোকে দুর্নীতিমুক্ত করা ।

৯। রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহে বাংলাদেশী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জীবনাদর্শের প্রতিফলন নিশ্চিত করার সাথে সাথে সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা ।

১০। ভারতের সাথে পঁচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করা ।

আরেকবার এক থেকে দশ পর্যন্ত পড়ে দেখুন । বর্তমানকালের সাথে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার এই নির্দেশিকায় কি খুব একটা পার্থক্য ধরা পড়ছে ? বর্তমান আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে যেসকল শক্তি আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, তারা কি ঠিক একই অভিযোগ এবং অভিপ্রায় প্রদর্শন করছে না ? তাহলে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পার করে আগষ্ট বিপ্লবের ফায়দা কি দাঁড়ালো ! তখনকার আওয়ামী গডফাদার গাজী গোলাম মোস্তফা যেভাবে লেডিস ক্লাব থেকে মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রী নিম্মীকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করতে পারতো, এখনকার জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমানরা কি এমন দুঃসাহস দেখাচ্ছেনা ? ১৯৭৩ সালে যেভাবে শেখ কামাল পুলিশের গুলি খেয়েছিলো ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে, এখনকার ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করার জন্য কি একই গ্রুপ কাজ করছেনা ? তাহলে বিপ্লব কিভাবে বলি ১৫ আগস্ট কে ! এটাই আমার কাছে প্যারাডক্স ।

শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা প্রথমেই যে ভুলটা করি তা হলো- এটাকে নিছক একটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হিসেবে চিন্তা করি । যা সম্পূর্ণরুপে একটা সিভিলিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি । অথচ সম্পূর্ণ সামরিক সিদ্ধান্তে, সেনাকর্মকর্তাদের দ্বারা এই ফেইট আকমপ্লি সংঘটিত হয়েছে । আমরা আওয়ামী বিরোধী মহল কথায় কথায় শেখ মুজিবকে ফেরাউনের সাথে তুলনা করি- যেনো হত্যাকান্ডের পক্ষে একটা ধর্মীয় আবহ তৈরী হয় । তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যারা মুজিব হত্যার পর রাতারাতি চেহারা পাল্টে জানরক্ষায় নিয়োজিত হয়েছিলো- তাদের কর্মকান্ডকে বার্ডেন অব প্রুফ ধরে আমরা ১৫ আগস্টের আলোচনা করি । একারণে বিষয়টির গভীরে আমরা যেতে পারিনা এবং প্রতিবছর শোক দিবসের একপেশে বিরোধিতা করতে থাকি ।

আরেকটি সমস্যা হলো দেশের অধিকাংশ জনগণ কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীকে দেবজ্ঞান করে এড়িয়ে চলা । একারণে টকশোতে যেমন বুদ্ধিজীবিরা সেনাসদর/আইএসপিআর নিয়ে কোন সমালোচনা করতে বিব্রতবোধ করেন, আমজনতাও সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডকে স্বর্গীয় নজরে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । ফলস্বরুপ সেনাবাহিনী একটা পুতুল নাচের মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । তারা রাজনীতির মাঠে নিষ্কৃয়তার প্রমাণ দিতে গিয়ে বিদেশী আগ্রাসনের মুখেও মুখ খুলতে পারেনা । ভারতের সেনাপ্রধান দলবীর সিং যতোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাকিস্তানী সেনাপ্রধান রাহিল শরীফ কে হুমকি দিতে পারেন, ইরানী কমান্ডো চীফ কাসেম সোলায়মানি যেভাবে প্রকাশ্যে গাজা হত্যাকান্ডের জন্য ইসরাঈলের নিন্দা জানাতে পারেন, বাংলাদেশী সেনাপ্রধান ততোটা  জোর গলায় নিজদেশের পাহাড়ি জঙ্গিগোষ্ঠি জেএসএস বা ইউপিডিএফ কেও ধমক পর্যন্ত দিতে পারেন না । বিজিপি বা বিএসএফের বিরুদ্ধে মুখ খোলা তো অলীক কল্পনা !

অথচ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিলো অনেক বেশি স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ । মানুষের হৃদয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি একটা গভীর সহানুভূতি কাজ করতো । তাদের সাহসিকতা এবং প্রতিশোধ পরায়নতার ওপর মানুষ এতোটাই আস্থা রাখতো যে, রক্ষীবাহিনীর সমস্ত অপরাধের খবারখবর সাধারণ মানুষ নিজ থেকেই সেনাবাহিনীকে অবহিত করতো । কোন সেনাকর্মকর্তার সাথে বা সেনা পরিবারের সাথে সংঘটিত অপরাধের জন্য স্বয়ং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে ক্ষমা চাইতে হতো । আর এযুগে পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন বলে কখনো শুনিনি । আমাদের যুগে এমনও ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কথা শোনা যায় যিনি তার মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন । শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজের লম্পট শিক্ষক যখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বসে ছাত্রীদের পর্ণো ভিডিও বের করে তখনো পুলিশের আশায় বসে থাকা ছাড়া সেনাবাহিনীর করার কিছু থাকেনা । অপরদিকে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাড়াটে খুনী হওয়ার বিষয়টি না হয় এড়িয়েই গেলাম । অথচ যে সেনাবাহিনী আগস্ট বিপ্লবের সিদ্ধান্ত নেবার মতো দৃঢ়তা এবং সাহস দেখিয়ে ইতিহাস রচনা করেছে তাদের এমন অসহায়ত্ব শুধুুমাত্র শোক দিবসকে তাচ্ছিল্য করেই বোঝা সম্ভব নয় ।

আমাদের দেশে যখনই সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা সম্পৃক্তি নিয়ে কথা হয়, বড় বড় দলগুলো সবসময় এটিকে টালবাহানা করে এড়িয়ে যায় । ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, রাজনৈতিক নেতারা যতোবার ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, ততোই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্ররাজনীতি জেঁকে বসেছে । দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য যতোবার ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠান গুলোকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার বুলি সম্প্রচার হয়েছে, ততোই যেনো ব্যাবসা-বাণিজ্যে রাজনৈতিক মেরুকরন তীব্রতর হয়েছে । তেমনিভাবে সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যতোই মধুর বাণী বর্ষন করা হোক না কেনো, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক কাঠামোর উত্থান-পতনে (একাত্তর থেকে এক-এগারো পর্যন্ত) সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা । এমনকি পিলখানা হত্যাকান্ডের পর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাকুঞ্জে গেলেন স্বান্তনা সভায়, তখনো সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক মেরুকরণের ভয়াবহতা উঠে এসেছে । অথচ সম্পূর্ণ বিষয়টিকে স্পর্শকাতরতার চাদর পড়িয়ে বদহজম বাড়ানোর নীতি কোন পক্ষই ছাড়তে পারেনি ।

মোটাদাগে যদি আগষ্ট বিপ্লবের দুটি পক্ষ ধরা হয়, একটি হবে আওয়ামী লীগ- যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দ্বারা সর্বদা নিয়ন্ত্রিত, আরেকটি হবে সেনাবাহিনী- যাদের প্রতি মানুষ বরাবরই বিশ্বাস রাখতে পছন্দ করে । বর্তমানে দুটি পক্ষের কার্যক্রম তুলনা করলেই বিগত চল্লিশ বছরে আগষ্ট বিপ্লবের সাফল্য/ব্যর্থতা বোঝা সহজ হয়ে যায় । এক মুজিবের লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে তৈরি না হলেও প্রতিটি পাড়ায়/মহল্লায় অন্তত একটি করে মুজিবের অনুসারী গডফাদার তৈরি হয়ে গিয়েছে এতোদিনে । মানুষজন বিপদে পড়লে যেমন তাদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়, ইফতার মাহফিলে যেমন তাদেরকে প্রধান অতিথি রাখতে হয়, মসজিদ কমিটিতে পর্যন্ত তাদের আইনে মানুষ চলে । শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার বলেই দায় এড়াবেন কিভাবে ! দেশের রাষ্ট্রপতি কে বিদায় করেও আগষ্ট বিপ্লবের নায়কেরা দেশের একনায়কতান্ত্রিক অনাচার এবং ভারতমাতার দাসত্ব রুখতে পারেনি । এদিক থেকে দেখলে সহজেই বোঝা যায়- রাষ্ট্রপতি মুজিব শেষপর্যন্ত মরণোত্তর বিজয়ী হয়েছেন । আমরা যতোই ভাঁড়ামো/চটুলতার আশ্রয় নিই, বাস্তবতা এড়াতে পারবোনা । অপরদিকে সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখুন । জেনারেল জিয়ার মতো এমন সেনাপ্রধান আর পায়নি বাংলাদেশ । আ ল ম ফজলুর রহমানের মতো বিডিআর প্রধানও পায়নি । সেনাবাহিনীর মান নিয়েও তৈরি হয়েছে যথেষ্ট প্রশ্ন । রেশমা নাটকের হোতা সারওয়ার্দিরা উঠে যায় আকাশে । আব্দুল্লাহ আযমীদের বরখাস্ত হতে হয় অযথা । গুলজারদের মৃত্যু হয় প্রতিশোধবিহীন । একটা উদাহরণ দেই- দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যদি সার্ভে করা হয়, ক্লোজ আপ ওয়ান তারকা এবং লাক্স সুপার স্টারদের মাস কিভাবে চলে, দেখা যাবে প্রতিদিন ক্যান্টনমেন্টগুলোতে কোন না কোন উপলক্ষে গানের কনসার্ট চলছেই, দেশের প্রায় সবগুলো এলিট ক্লাবে সেনাকর্মকর্তা দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা চালানো হয়, ইসরাঈলী আইডিএফ কেও এতোটা আনন্দঘন পরিবেশে রাখা হয় কিনা জানিনা । শেখ হাসিনার দলীয় অনুষ্ঠানেও অনেক সময় বাহিনী প্রধানদের হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । কারা আমাদের সেনাবাহিনীর বন্ধু, কারা তাদের শত্রু, এটা নির্ণয় করা যেনো গোলকধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । অথচ পৃথিবীর অন্য কোন সেনাবাহিনীর সমরনীতি এতোটা অস্পষ্ট এবং ঘোলাটে থাকে বলে মনে হয়না ।  ডিওএইচএস এর মালিকানা নিয়ে দরদাম চলছেই, বৈষয়িক হিসাব নিকাশে ভীষণ অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে ডিফেন্স ফোর্স । তাহলে সেভেনটি ফাইভ এর সেনাবাহিনী আজকের যুগে কিভাবে আশা করেন ! ‘তৃতীয় শক্তি’ নামের কাগুজে বাঘ হিসেবে শুধু পত্রিকার কলাম আর টিভি টকশোতেই সেনাবাহিনীর ক্ষমতার আভাস দেয়া হয় । একজন সামান্য প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কোন চাপ অনুভব করেন বলে মনে হয়না । ‘চির উন্নত মম শির’ চেতনার পরিস্ফুটন ইদানিংকালের সেনাবাহিনী খুব একটা দেখাতে পেরেছে বলেও প্রমাণ নেই । অর্থাৎ আগস্ট বিপ্লবের দ্বিতীয় পক্ষ, অথবা বিজয়ী পক্ষ বলেও যাদেরকে ধরা হয়- তাদের নৈতিক অস্তিত্ব আজ ভীষণ সংকটে ।

আমি বলছিনা যে, সেনাবাহিনীতে ভোটাভুটি চালু করাই এ সংকটের সমাধান । সেনাবাহিনীকে দলীয় ভাগাভাগির ব্যালেন্স অব পাওয়ার বানানোর কথাও বলছিনা আমি । বরং গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনীর সমরনৈতিক অবস্থানটি সুস্পষ্ট এবং প্রকাশিত রাখার পক্ষেই আমি অভিমত দিচ্ছি । আপনারা কি বলতে পারেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিলেবাসে এখন কি কি বিষয় পড়ানো হয় ? যে সেনাবাহিনী আফ্রিকার মাটিতে ভয়ংকর অপরাধীদের সাথেও শান্তিরক্ষীর আচরণ করতে পারে, তারা দেশীয় জনগণকে ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ হিসেবে পরিত্যাজ্য মনে করার সাইকোলজি কেনো ধারণ করে এটা নিয়ে কি কোন গবেষণা হয়েছে ? বিএমএ কমিশন্ড অফিসার হিসেবে আগামী লং কোর্স থেকে দুই বছরের স্থলে চার বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ চালু হচ্ছে এই কথা কি সবাই জানতেন ? এখন থেকে সেকেন্ড ল্যাফটেন্যান্ট নয়, সরাসরি ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম হচ্ছে, এটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে সেটা নিয়ে কি আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেছে কেউ ? এমনিতেই সেনাবাহিনী অনেকটা যুদ্ধবিমুখ হয়ে পড়েছে, তার উপরে যদি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই তাদেরকে বই-পুস্তক গিলিয়ে বিদ্যাবাগীশ করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়, তবে সেটা আমাদের ভূরাজনৈতিক প্রক্ষাপটকে কিভাবে প্রভাবিত করবে তার রিপোর্ট কি দেশের নেতানেত্রীদের কাছে আছে ? গত দশ বছরের মধ্যে লেঃ কর্ণেল বা মেজর পদবি ধারণ করেই বিপুল সংখ্যক প্রতিভাবান সেনাকর্মকর্তা স্বেচ্ছা অবসরে চলে গিয়েছে কেনো, তা নিয়ে কোন গবেষণাপত্র কি জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে ? হাসান সারোয়ার্দিরাই কেনো জেনারেল হয় সেটা বুঝতে হলে কি এ ব্যাপারে আরো তীক্ষ্ন নজর রাখার প্রয়োজন ছিলো না ? আমাদের ছেলেমেয়েরা অষ্টম শ্রেণির বইয়ে “নিজেকে জানো” শিরোনামে মূলত কি শিখছে সেটা জানা এবং লক্ষ্য রাখার অধিকার যেমন জনগণের আছে, তেমনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ভাইবোনেরা সমরনীতি চর্চায় কোন কোন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধান পাচ্ছে সেটা লক্ষ্য রাখার অধিকার কি জনগণের নেই ? আমার মনে হয় ১৫ আগস্টকে বোঝার জন্য সেনাবাহিনীর তখনকার অবস্থান এবং এখনকার অবস্থানের তুলনাটাই মুখ্য বিষয় । তাহলেই আমরা বুঝতে পারবো- একনায়ক শেখ মুজিব নিহত হওয়াতে যতটুকু বিজয় আমরা অনুভব করেছি, তলে তলে আরো বেশি হেরে গিয়েছি ।

অনেকে ধারণা করতে পারেন- আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারলেই এ সংকটের সমাধান হয়ে যাবে । সততার সাথে একবার ভেবে দেখুনতো- বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল গুলো কি জন্মদিন পালন করা ছাড়া ১৫ আগষ্টের আর কোন মূল্যায়ন করেছে কখনো ? যদি আবারো বিশ দলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় আসে তবে হয়তো দিবসটিকে তাচ্ছিল্য করার জন্যে হিসাব করে ১৫ আগষ্টের দিন এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করতে পারে যেনো সেদিনের শিরোনামটি উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা দখল করে নেয় । কিন্তু এর বেশি কিছুই তারা করতে পারবেনা । কারণ ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের চাইতে- ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ যে আরো ক্ষতিকর এবং ভয়ংকর এটা সেনাবাহিনী যেমন জানে, বিরোধী দলগুলোও জানে । অতএব আগস্ট বিপ্লব নিয়ে অতো আয়োজন করে বিভ্রান্ত হবার প্রয়োজন নেই ।

তাহলে করণীয় কি হতে পারে ! হ্যাঁ, করণীয় অত্যন্ত স্পষ্ট । প্রথমেই আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে ১৫ আগস্ট ছিলো বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের পক্ষে একটি যথার্থ বিপ্লব । ঝড়ে বক মরবে আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করবো আমরা, এমন মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে । সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের পক্ষে সুবিধা করে দেবে আর আমরা সবটুকু সুখভোগের পর তাদেরকে বিপথগামী নাগরিক খেতাব দিয়ে নিজেদের খোলসে আবার হারিয়ে যাবো, এমন লুকোচুরি বন্ধ করতে হবে । নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢেকে ঢেকে সামরিক অভ্যুত্থানের আশায় ঈদের পর ঈদ গুনতে থাকার প্রবৃত্তিও বাদ দিতে হবে । আগস্ট বিপ্লবের যথাযথ স্বীকার্য প্রদানের পর দেখতে হবে আগস্ট বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলো কি কি ! বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকি মোকাবেলা করার জন্য ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার ছিলো তা পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে । এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে । রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরে “র‌্যাব বিলুপ্তির আহবান”, “উপজেলা ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি”, “নাগরিক অধিকার আদায় কমিটি”, “সম্প্রচার নীতিমালা স্থগিত করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার কমিটি”, “একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধ কমিটি” এসব হাজারটা শিশুসুলভ আন্দোলন-আন্দোলন খেলা বাদ দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠনই সময়ের দাবি । সম্ভবত হুমায়ুন আহমেদের ‘দেয়াল’ এমন একটি নিরাপত্তা সূচক দেয়ালের অভাব অনুভব করেই লেখা । সম্ভবত কারারুদ্ধ মাহমুদুর রহমান এটা চিন্তা করেই ‘আমার দেশ’ অফিসে পাঠচক্রের আয়োজন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । যদি এতোদিনে একটি সত্যিকার নিরাপত্তা পরিষদ আমাদের থাকতো- হয়তো ফেলানীদেরকে মরতে হতোনা, পিলখানা ট্রাজেডী এড়ানো যেতো, একতরফা নির্বাচন কেন্দ্রিক কোটি কোটি টাকার লুটপাট থেকে জাতি রক্ষা পেতো । রানা প্লাজা ধ্বস, পিনাক লঞ্চডুবি, ডেসটিনির অর্থচুরির বিষয়ে অভিযোগ করার মতো মানুষের আরো একটি আশার জায়গা থাকতো ।

অনেক কথা বলা হলো । তবু কিছুই হবেনা এটা প্রায় নিশ্চিত । তারপরেও দিন বদলায়- মানুষ বদলায় । আশা ধরে রাখতেই হয় । শাপলা চত্বর থেকে শাহবাগ চত্বর পর্যন্ত দেখার অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের তরুণদের হয়েছে । সাগর-রুনি হত্যাকান্ড দেখার অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের হয়েছে । আমিনুল হত্যা থেকে দেলোয়ার খালাস পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ দেখা হয়েছে এ প্রজন্মের শ্রমিক ভাইবোনদের । আমাদের প্রজন্মের মাঝে এতোদিনে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদঘাটনের একটা দৃঢ় প্রত্যয় এসেছে বলেও মনে হয় । হপ-স্টেপ নেবার পর এখন শুধুই জাম্প দেবার অপেক্ষা । যদি সে দীর্ঘ অপেক্ষার পালা নিকট ভবিষ্যতে সমাপ্ত হয়, তবেই আগষ্ট বিপ্লবের সাফল্য তার চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছাবে বলে বিশ্বাস করি ।

‘দক্ষিন তালপট্টি’ এবং ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে সজিব ওয়াজেদ জয়ের মিথ্যা বক্তব্য

5

আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পূত্র এবং তার তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় গত ১১ জুলাই গুলশানের একটি হোটেলে সুচিন্তা ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনারে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি ভারতে দিয়ে দেয়া এবং বাংলাদেশের দীর্ঘজীবীতা কামনাসূচক জাতীয়তাবাদী শ্লোগান ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে কিছু অশালীন মিথ্যা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “তালপট্টি ভারতকে দিয়েছেন জিয়া” এবং “জিন্দাবাদ উর্দু, পাকিস্তানি শব্দ। যারা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেন তারা পাকিস্তানি এজেন্ট। তাদের পাকিস্তানে বসবাস করা দরকার।”

তার প্রথম মিথ্যাচারটি ১৯৮১ সালের দেশি-বিদেশী পত্রপত্রিকা এবং সার্ভে অব বাংলাদেশের তৈরী ১৯৮১ সালের টপোমানচিত্র দিয়েই প্রমান করা সম্ভব। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটির অস্তিত্ব ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী টপোমানচিত্র থেকে শুরু করে বর্তমান গুগল আর্থ স্যাটেলাইট ইমেজেও রয়েছে। এটি একটি আংশিক দ্বীপ। জোয়ারের সময় ডুবে যায় এবং ভাটার সময় সামান্য জেগে ওঠে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার অদূরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি জোয়ারের সময়ও জেগে থাকতে দেখা যায়। ১৯৭৪ সালের আমেরিকান স্যাটেলাইট ইমেজ অনুযায়ী এর আয়তন ছিলো আড়াই হাজার বর্গমিটার। ধীরে ধীরে দ্বীপটির আয়তন ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে এর আয়তন ১০ হাজার বর্গমিটারে দাঁড়ায়। খেয়াল করুন ১৯৭৪ সালে ক্ষমতায় ছিলেন শেখ মুজিব; কিন্তু তিনি দক্ষিণ তালপট্টি বাংলাদেশে অন্তর্ভূক্ত করা কোন ব্যবস্থা করেন নাই। সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশের ছিটমহল রেরুবাড়ী ভারতকে দিয়ে দেবার মতই এই দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটিও তিনি হয়তো ভারতের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন।

১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্টের টপোমানচিত্রে দক্ষিণ তালপট্টি

১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্টের টপোমানচিত্রে দক্ষিণ তালপট্টি

গুগল আর্থ এ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ

গুগল আর্থ এ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ

সার্ভে অব বাংলাদেশের ১৯৮১ সালের টপোশিটে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ

সার্ভে অব বাংলাদেশের ১৯৮১ সালের টপোশিটে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ

১৯৮০ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে রেডক্লিফের দেশভাগ অনুযায়ী হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোত দক্ষিন তালপট্টির পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় দ্বীপটির মালিকানা বাংলাদেশ দাবি করে। কিন্তু ভারত ১৯৮১ সালের মে মাসে সেখানে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে তাদের পতাকা ওড়ায়। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ভূখণ্ড ঐ দ্বীপটি রক্ষার জন্য রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের নেতৃত্বে তিনটি নৌ জাহাজ পাঠান। দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে ভারতের সামরিক আগ্রাসনের মোকাবেলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপের বিষয়টি ১৯৮১ সালের ১৭ মে তৎকালিন সবগুলো বাংলা দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কাছাকাছি সময়ে বিদেশী পত্রিকাগুলোতেও এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, প্রকাশিত হয় এই আগ্রাসনের প্রতিবাদে ভারতীয় দূতাবাস অভিমুখে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবাদ মিছিলের ছবি।

১৯৮১ সালের ১৭ মে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং এর প্রতিবাদে ভারতীয় দূতাবাস অভিমূখে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক প্রতিবাদ মিছিল

১৯৮১ সালের ১৭ মে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং এর প্রতিবাদে ভারতীয় দূতাবাস অভিমূখে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্তৃক প্রতিবাদ মিছিল

১৯৮১ সালে ২০ মে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকা ‘A little pile of mud could start a war’ শিরোনামে লেখে, “১৯৭৪ সালে প্রায় ১২বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি সনাক্ত করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সেখানে গানবোট প্রেরণ করলে বাংলাদেশও গানবোট প্রেরণ করে। ফলে দু’টি দেশ যুদ্ধের মুখোমুখি।” সেই একই সংবাদে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরও আছে এবং সেখানে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশের দ্বীপ দখল করার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা ও সজিব ওয়াজেদ জয় কর্তৃক দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের অস্তিত্ব অস্বীকার করা এবং শহীদ জিয়াকে জড়িয়ে এই বিষয়ে মিথ্যাচারের কারণে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, শেখ হাসিনা কী তবে ভারতে সরকারী অশ্রয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করার ঋণ শোধ করতে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি তাদের উপহার দিয়েছিলেন?

শহীদ জিয়া সামরিক শক্তিতে মোকাবেলার পাশাপাশি কুটনৈতিক সমাধানের পথেও অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ভারত কর্তৃপক্ষ একটি যৌথ জরিপের মাধ্যমে দ্বীপটির মালিকানা নিষ্পত্তিতে রাজী হয়েছিলো। এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। তবে নিহত হবার আগেই তার আমলে সার্ভে অব বংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত টপোশিটে তিনি দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি অন্তর্ভূক্ত করার ব্যবস্থা করেছিলেন, যার প্রমান তৎকালীন টপোশিটে তালপট্টির অবস্থান। কাজেই শহীদ জিয়া তালপট্টিকে মানচিত্রে অন্তর্ভূক্ত করার ব্যবস্থা করেন নাই, এটি একটি নির্লজ্জ মিথ্যাচার।

শহীদ জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে আগস্ট মাসে যৌথ জরিপ না করেই আবারো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তালপট্টিতে তাদের সৈন্য এবং ফ্রিগেট প্রেরণ করলে তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান মরহুম রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান আবারো সেখানে গানবোট প্রেরণ করেন। এই বিষয়ে ১৯৮১ সালের ২০ আগস্ট বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার তাঁর উদৃতি দিয়ে “South Talpatti Island is Ours : M H Khan” শিরোনামে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিলো। একইভাবে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিলো বিদেশী পত্রিকাতেও। ১৯৮১ সালের ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াসিংটন থেকে প্রকাশিত আবজারভার-রিপোর্টার পত্রিকায় ‘India, Bangladesh Quarrel Over Island’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিলো, “ভারতের ফ্রিগেট ও বাংলাদেশের গানবোটগুলো নিউমুর বা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের কাছে পরষ্পেরর মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আছে। ভারত কর্তৃক যৌথ জরিপের বিষয়টি অস্বীকার করার প্রেক্ষিতে এই অবস্থার উদ্ভব হয়েছে।”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ তালপট্টির মালিকানা বিষয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার এবং তাঁর মৃত্যুর পর তৎকালিন বিএনপি সরকার যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করেছে। বরং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সাথে সমূদ্রসীমা মামলা হবার পর থেকেই এই সরকার দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে চলেছে। এই মামলার শুরু থেকেই ভারত তার প্রাথমিক সমূদ্রসীমা দাবী থেকে শুরু করে প্রতিটি রিজয়েন্ডারের মানচিত্রেই বাংলাদেশের সাথে তার সীমান্তবর্তী দক্ষিণ তালপট্টি (নিউমুর) দ্বীপটি উল্লেখ করেছে অথচ বাংলাদেশ তার দাবী উত্থাপন থেকে শুরু করে কোন যুক্তিতর্কেই তালপট্টি দ্বীপটির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেনি। তার মানে মামলার আগেই তারা গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে দক্ষিণ তালপট্টিকে ভারতে হাতে তুলে দিয়েছিলো। এখন জনগণের প্রশ্নের মুখে তারা এই দায়ভার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ওপর চাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।

সজিব ওয়াজেদ জয় তার বক্তব্যে সবচেয়ে হাস্যকর মন্তব্যটি করেছেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান প্রসঙ্গে। তিনি দাবী করেছেন ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি উর্দু। প্রায় সারা জীবন বিদেশে থেকে বিদেশী ভাষায় পরাশোনা করে ও বিদেশিনী স্ত্রী বিবাহ করার কারণে তিনি বাংলা ভাষায় হয়তো দূর্বল হয়ে থাকবেন। তাই তার জানা নেই যে বাংলা ভাষায় অনেক বিদেশী শব্দ আছে। উনি যদি একটু কষ্ট করে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা – ইংরেজী অভিধান’ (২১ তম সংস্করণ – ২০০৫) এর ২৩৩ নম্বর পৃষ্ঠার ১ম কলামের শেষ থেকে ২য় কলামের শুরু পর্যন্ত খেয়াল করেন তাহলে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি পাবেন। অভিধানে এটিকে বাংলা শব্দ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অভিধানের প্রতি উনার অনাস্থা থাকলে ভারত থেকে প্রকাশিত সংসদ বাঙ্গালা অভিধান (শৈলেন্দ্র বিশ্বাস-সঙ্কলিত, চতুর্থ সংস্করণ – ১৯৮৪, অষ্টাদশ মুদ্রণ জুন – ১৯৯৫, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা) এর ২৬৪ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম কলামের মাঝামাঝি স্থানে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি পাবেন। সেখানেও এটিকে বাংলা শব্দ হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। উনার হয়তো জানা নেই যে উনার নানা শেখ মুজিব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত থাকা অবস্থায় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং পাকিস্তান হবার পর এমন কী ৭ মার্চের ভাষন পর্যন্ত ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগানটাই দিয়েছেন। এমন কী ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে মিরপুরে বিহারীদের ভোট পেতে আওয়ামী লীগ উর্দুতে লিফলেটও ছেপেছিলো।

বামে- ১৯৭০ এর নির্বাচনে কুষ্টিয়ার জনসভায় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান লেখা ব্যানার টানিয়ে বক্তব্য রাখছেন শেখ মুজিব, ডানে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিহারীদের জন্য উর্দুতে লিফলেট ছেপেছে আওয়ামী লীগ।

বামে- ১৯৭০ এর নির্বাচনে কুষ্টিয়ার জনসভায় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান লেখা ব্যানার টানিয়ে বক্তব্য রাখছেন শেখ মুজিব, ডানে- ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিহারীদের জন্য উর্দুতে লিফলেট ছেপেছে আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্ম বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর হয়েছে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে এই দেশে অন্য নৃগোষ্টীকে অগ্রাহ্য করার যে বিভক্তিমূলক নীতি আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন বাকশাল নিয়েছিলো সেটা থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে একটি অভিন্ন জাতিস্বত্তা হিসেবে পরিচিত করতেই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগানের উদ্ভব। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যুদ্ধ বিজয়ের জন্য রণহুংকার হিসেবে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটি তখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম প্রসিডেন্ট এবং স্বাধীনতা ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিজেও দিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধ জয়ের পর সেই শ্লোগানের পরিবর্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের দীর্ঘায়ু কামনাসূচক শ্লোগানই রাষ্টীয় শ্লোগান হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত। সেই প্রেক্ষিতে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগানটি বাংলাদেশের দীর্ঘায়ু কামনায় বাংলাদেশীদের হৃদয় নিংড়ানো শুভ কামনা। যারা নিজেকে বাংলাদেশী মনে করে না কেবলমাত্র তাদের পক্ষেই ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগানকে পাকিস্তানী বলা সম্ভব।

উর্দু নিয়ে যদি জনাব সজিব ওয়াজেদ জয়ের এতই মাথা ব্যাথা থাকে তাহলে উনাদের দলটির নাম কেন পরিবর্তন করছেন না। উনাদের দলটির নাম ‘আওয়ামী লীগ’ এর ‘আওয়ামী’ শব্দটি একটি খাটি উর্দু শব্দ, যার অর্থ জনগণ। উনি কী তাহলে উনার দলের নাম পরিবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন? না কী উনার দলটিকেও পাকিস্তান পাঠিয়ে দেবেন? পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদারদের অত্যাচার এই দেশে অবস্থান করা প্রতিটি মানুষ মনে রেখেছে। তারা এটাও মনে রেখেছে যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র দুই বছরের মাথায় জনাব সজিব ওয়াজেদ জয়ের নানা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান গিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার নায়ক ভুট্টোর সাথে কী ভাবে গলাগলি করেছিলেন এবং বাংলাদেশে ২৫ মার্চ রাত্রে অপারেশন সার্চ লাইটসহ লক্ষ মানুষের রক্তে রাঙ্গা টিক্কা খানের সাথে কী ভাবে হাত মিলিয়েছিলেন। অন্যদের বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ করার আগে জনাব সজিব ওয়াজেদ জয়ের উচিত হবে নিজেদের অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখা। নিজে কাঁচের ঘরে বাস করে অন্যের বাড়িতে ঢিল ছোঁড়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

বামে- ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের লাহোরে ভুট্টোর সাথে গলাগলি করছেন শেখ মুজিব, ডানে- ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী করাচী এয়ারপোর্টে টিক্কা খানের সাথে করমর্দন করছেন মুজিব।

বামে- ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের লাহোরে ভুট্টোর সাথে গলাগলি করছেন শেখ মুজিব, ডানে- ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী করাচী এয়ারপোর্টে টিক্কা খানের সাথে করমর্দন করছেন মুজিব।