ডোনাল্ড ট্রাম্পের র‍্যালি থেকে ফিরে (ছবি ও ভিডিও সহ)

1

শাফকাত রাব্বীঃ

ডোনাল্ড ট্রাম্পের র‍্যালি দেখার খুব শখ ছিল। দেখতে গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন ডালাস শহরের একটা নাইট ক্লাবে। আমার টিকেট ছিল না, একারনে নাইট ক্লাবের ভিতরে ঢুকতে পারা যায় নাই। ক্লাবের বাইরে দাঁড়িয়ে শত শত সাপোর্টার আর প্রতিবাদকারীদের চিৎকার চেঁচামেচি, নাচা নাচি, গালাগালি, আর স্লোগান উপভোগ করে বাড়ি ফিরেছি।

13453014_10153505275905653_1716457272_o

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইলেকশনের অবস্থা ভালো না। আর মাত্র ৪ মাস পরে ইলেকশন। ডালাস-ফোর্টোয়ার্থ এলাকা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৪র্থ বৃহত্তম জনবহুল এলাকা। এত গুরুত্বপূর্ন একটা এলাকায় ইলেকশনের মাত্র ক’মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে র‍্যালি করতে দিতে  বড় কোন ভেন্যু নাকি রাজী হয়নি। এই কারনে ডালাসের দক্ষিন দিকের বাজে একটা এলাকার নাইট ক্লাবে ট্রাম্পকে তাঁর র‍্যালি করতে হয়েছে।

র‍্যালির এলাকায় গিয়ে দেখি এলাহী কারবার। শত শত পুলিশ। আকাশে ৫ টা হেলিকপ্টার উড়ছে, দুটা হেলিকপ্টার পুলিশের আর তিনটা মিডিয়ার। ঘোড়ার গাড়ি, বাই সাইকেল, মোটর সাইকেল, মোপেড, গাড়ী আর পায়ে হেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সাজ সোজ্জার পুলিশ। উঁচা বিল্ডিং গুলোতে স্নাইপার রাইফেল নিয়ে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন। আমি এর আগে ডেমক্রাট পার্টির বার্নি স্যান্ডারস এবং রিপাব্লিকান পার্টির মার্কো রুবিও এর র‍্যালিতে গিয়েছি। কারো র‍্যালিতে এতো সিকিউরিটি এবং পুলিশি বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করিনি।

13441854_10153505279685653_1651228186_o

র‍্যালি এলাকার মধ্যখানে পুলিশ কাধে কাধ দিয়ে হিউম্যান ব্যারিকেড দিয়েছে।  এক পাশে ট্রাম্প সাপোর্টার আর অন্য পাশে প্রতিবাদকারীর দল। কেউ কারো দিকে বেশী এগিয়ে গেলেই পুলিশ বাঁধা দিয়ে দূরে সড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে থেকেই কোন কোন প্রতিবাদকারী হাটতে হাটতে অন্য সাইডে চলে যাচ্ছে, উত্তেজক দু চারটা কথা বলে ফিরে আসছে। ধরতে পারলে পুলিশ ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিচ্ছে। তখন আবার প্রতিপক্ষ খুশিতে স্লোগান দিচ্ছে।

র‍্যালির ঢুকার মুখেই দেখলাম একদল টেক্সাস মিলিশিয়া  দাঁড়িয়ে আছে। টেক্সাসে যে কোন সাধারন মানুষ তাঁর বন্দুক নিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুরাফিরা করতে পারে, মিলিশিয়া গঠন করতে পারে। এটা তাঁদের নাগরিক অধিকার। এটাকে বলে “ওপেন ক্যারি”।  র‍্যালির শুরুতেই ৭-৮ জন মিলিশিয়া বিশাল বিশাল বন্দুক, আর্মির মতো পোশাক, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, সান গ্লাস পড়ে এই অধিকার ফলাচ্ছেন। এদেরকে পাহাড়া দিচ্ছে ১০-১২ জন পুলিশ যারা কিনা মিলিশিয়ার থেকে হাল্কা অস্ত্র শস্ত্র বহন করছে।

13410729_10153505281075653_912270260_o

একজন পিস লাভিং পাগলাটে লোক এই মিলিশিয়াদের মরে যাওয়া গাঁদা ফুল টাইপের একটা ফুল দিবার অনুমতি চাইল। মিলিশিয়ারা গম্ভীরমুখে অনুমতি দিল। পাগলাটে লোকটা বন্দুকের নলে গাঁদা ফুল পড়িয়ে দিল। আমরা সবাই ছবি তুললাম।

13446317_10153505279360653_1135201895_o

প্রতিবাদকারীদের এলাকার মধ্য খানে বিশাল একটা মেক্সিকোর পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল একজন মেক্সিকান আমেরিকান। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল বাদবাকী প্রতিবাদকারীরা নানা ধরনের ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে। প্রতিবাদ কারীদের হাতে  অনেকগুলো মেক্সিকান পতাকা এবং সমকামীদের রেইনবো পতাকা দেখলাম। বড় সাইজের কোন আমেরিকান পতাকা চোখে পড়েনি। হয়তো আমি যখন ছিলাম তখন বড় পতাকা ওয়ালা প্রতিবাদকারী কেউ এসে পৌছায়নি।

13461317_10153505280130653_859908887_o

ট্রাম্পের সাপোর্টারদের মধ্যে  সাদা, খুবই আটো সাটো পোশাকের কয়েকজন তরুনী ছিল। দেখতে ভালো, এবং খুবই এগ্রেসিভ। বুঝাই যায় যে ট্রাম্প মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার মালিক।  নানা ধরনের শরীরি কসরতের মাধ্যমে এই  ট্রাম্প গার্লরা স্লোগান দিচ্ছিল। একজন পরীর মতো উড়ে বেড়ানোর একটা ভঙ্গিমা করছিল। এই পরী ইচ্ছা করে প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল বারবার।

আমি পরীর সাথে কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম ট্র্যাম্পের মহিলা বিষয়ক নানাবিধ মন্তব্য তাকে বদার করে কিনা। পরী উত্তরে বলল, ” আই ডোণ্ট গিভ আ শিট”। আমি বললাম ট্রাম্পের কোন জিনিসটা তোমার সবচাইতে ভালো লাগে? পরী জানালো, “বাকি সব ক্যান্ডিডেট হলো একদল পুসি”। প্রতিবাদকারীদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “এই যে এদের মতো। আর ট্রাম্প-ই  হলো একমাত্র আসল পুরুষ।”

13453188_10153505281520653_862247741_o

আমার কথা বলার মুহুর্তে একজন কালো একটা ছেলে এসে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো সে ঠিক ঠাক আছে কিনা। অর্থাৎ আমি পরীকে ডিস্টার্ব করছি কিনা। মেয়েটা বললো না। আমি মানে মানে সটকে পড়লাম।

এমন সময় দেখা হলো “ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস” নামে কালোদের সিভিল রাইট আন্দোলনের এক কর্মীর সাথে। আমি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড শেইক করলাম।  ছেলেটা পুরা র‍্যালিতে একমাত্র কালো মানুষ যে বন্দুক নিয়ে ওপেন ক্যারি করছে। অর্থাৎ সাদা মিলিশিয়াদের সাথে শেয়ানে শেয়ান পাল্লা দিয়ে এই কালো ছেলেটাও একটা বিশাল বড় বন্দুক নিয়ে এসেছে, ওপেন ক্যারি করার জন্যে। আমি তাঁর সাথে কিছু আলাপ সেড়ে তাঁর একটা ছবি তুললাম। খুব খুশী মনে ছবি তোলার পোজ দিল।

black lives

এখানে উল্লেখ্য, মাত্র ক’দিন আগে এধরনের একটা বিশাল বন্দুক দিয়েই  ৫০ জন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে ফ্লোরিডাতে।

13453305_10153505281060653_1680943089_o

এর পরে এক খুবই ইমশনাল ঘটনা ঘটলো। আমি খেয়াল করে দেখলাম একজন ৫০-৬০ বছরের মহিলা ফুটপাতে বসে কাঁদছেন। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে ঠিক আছে কিনা। মহিলা জানালেন সে ঠিক আছেন, কিন্তু তাঁর ছাত্রের কথা মনে পড়ছে। যার জন্যে সে প্রতিবাদ করতে এসেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ছাত্রের কি হয়েছে। জানালো পুলিশ মেরে ফেলেছে। ছাত্রটি কালো ছিল। তাঁর ভাষায় অসম্ভব মায়াবী একটা ছেলে ছিল,  পৃথিবীর সব চাইতে বড় হৃদয়বান, আর  ভালো ছেলে। বলতে বলতে মহিলা কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন। আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না পুলিশ মেরেছে কেন। মহিলার নাম সুজান।

সুজান জানালেন সে ডালাসের কালো আর হিস্প্যানিক অধ্যুষিত একটা এলাকায় হাই স্কুলের টিচার। তাঁর বাবা মা দু’জন ডাক্তার। পরিবারের সবাই রিপাব্লিকান। সুজান ইচ্ছা করে মাত্র ৫০ হাজার ডলার বেতনের চাকরী নিয়েছেন, ডালাসের সব চাইতে খারাপ একটা এলাকায়।

সুজান জানালেন তিনি কাদছেন মানুষে মানুষের মধ্যে ঘৃনা দেখে। এতো ঘৃনা সে আগে কখনও দেখে নাই। সুজান বললেন পুলিশের দোষ নাই। পুলিশদের মধ্যে এতো ঘৃনা জোগাড় করে দেয় ট্রাম্পের মতো পলিটিশিয়ানরা। আরো অনেক কথা হলো সুজানের সাথে। আমি সুজানকে জানালাম তাঁর মতো মানুষ আছে বলেই আমেরিকান মাইনরিটিরা এখনও আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।

এমন সময় পুলিশদের সাপোর্ট করা পোস্টার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একজন। সুজান আমাকে বললেন, সরি, তুমি আমার থেকে এখন একটু নিরাপদে দূরে গিয়ে দাড়াও। আমি এই পুলিশের সাপোর্টারের সাথে এখন ঝগড়া করবো। আমি সড়ে দাড়ালাম। মহিলা দেখলাম আস্তে আস্তে ঝগড়া শুরু করলেন। ঝগড়া শেষে আমাকে জানালেন সিচুয়েশন কোন কারনে খারাপ হলে তাকে জানাতে, তাঁর বাসা কাছেই একটা আপার্ট্মেন্টে, শেল্টার নিতে পারবো। আমি হাসি মুখে বললাম, “ওকে জানাবো তোমাকে”।

পুরো র‍্যালির ট্রাম্প সাপোর্টারদের সবাই সাদা। কিছু ভাড়া করা গুন্ডা টাইপের কালো ছেলেও ছিল। তাদের একজন প্রকাশ্যে চিৎকার করে সবাইকে জানাচ্ছিল যে কোন ট্রাম্প গার্ল-এর গায়ে কেউ যদি হাত দেয়, তাহলে তারা ফিস্ট ফাইটের জন্যে প্রস্তুত। এই কালো গুন্ডা গুলোর একজনই আমার সাথে কথা বলার সময় সেই পরীকে জিজ্ঞেস করেছিল সে ঠিক ঠাক আছে কিনা।

13446215_10153505279840653_523999363_o

প্রতিবাদকারীদের মধ্যে বেশি ভাগই দেখলাম হিস্প্যানিক আমেরিকান। তাদের সাথে প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছিল ইংরেজি সিনেমার গিক কিংবা ইন্টেলেকচুয়ালদের মতো দেখতে অনেকগুলো সাদা ছেলেমেয়ে। এদের সাথে ছিল ওয়ার্কিং ক্লাসের অনেক কালো মানুষ। এই প্রতিবাদকারীদের যেই বর্ননাটা দিলাম, এটাই হলো লিবারেল আমেরিকান কোয়ালিশন। সারা আমেরিকার যেকোন সিটিতে ইস্লামোফোবিয়া, এলজিবিটি, মেক্সিকান, ইমিগ্রেশন ইস্যু এই সব কিছুতে এই কোয়ালিশনটাকেই একশনে দেখা যায়।

ট্র্যাম্প সাপোর্টারদের স্লোগান ছিল বেশ বোরিং। স্লোগানের ভাষা কথা একটাই — “ইউ এস এ, ইউ এস এ”।  প্রতিবাদকারীদের ভাষার কারুকাজ অনেক আকর্ষনীয়, তবে মূল বক্তব্য  একটাই। সেটা হচ্ছে,  নো মোর হেইট , বা আর ঘৃনা নয়।

আমি র‍্যালিতে থাকার বেশির ভাগ সময়ই  ট্রাম্প সাপোর্টারদের সাইডেই ছিলাম। এটা করেছি প্রতিবাদকারীদের ছবি সামনে থেকে ভালো  ভাবে তোলার তাগিদ থেকে।  ছবি তোলার ফাকে,  অনেক ট্রাম্প সাপোর্টারের সাথে কথা হলো। একে বারে মুর্খদের মতো দেখতে যারা তাদের থেকে শুরু করে ভদ্র টাইপের অনেকের সাথেই। সবাই বেশ ফ্রেন্ডলি ব্যাবহারই  করলো।

এক ফাকে বন্দুক ধারী মিলিশিয়াদের কাছেও গেলাম। দু চারটি কথা বলে সরে গেলাম, এতো বড় বড় বন্দুক ওয়ালা সিভিলিয়ান দেখতে কেমন জানি আন কম্ফোর্টেবল লাগলো।

13467638_10153507611695653_325156753_o

আরো অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু লেখাটা  বিশাল হয়ে যাচ্ছে। র‍্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের  দেখে যা বুঝলাম, “নো মোর হেইট” এই মেসেজটা খুবই পাওয়ারফুল একটা মেসেজ।  এই মেসেজকে হারাতে ট্রাম্পের অনেক সমস্যা হবে।  কেননা আমেরিকার সাধারন মানুষগুলো খুবই সাদামাটা এবং ফেয়ার।

13461296_10153505279975653_2140286623_o

 

13441985_10153505280245653_2065440672_o

13446305_10153505280285653_594990252_o

মালয়েশিয়ান ফ্লাইট ১৭ এবং কতিপয় স্বৈরশাসকের ইতিবৃত্ত…

By Watchdog BD

সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ। ইউরোপের এ দিকটায় গ্রীষ্মের শেষ এবং শরতের শুরু। আমাদেরও শিক্ষা বর্ষেরও শুরু কেবল। এদিন ক্লাসে হাজির থাকা অনেকটা বাধ্যতামূলক। অন্যথা হলে মাসিক স্কলারশিপ সহ অনেক কিছুতে কর্তৃপক্ষের কুনজর পরার সম্ভাবনা থাকে। তাই টর্কি ও পেয়িংটনের দুমাসের শৃংখলবিহীন জীবনকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসতে হল।ইংল্যান্ডের সাউদ ভেভনের এ অংশের সাথে প্রেম সেই ৭০ দশক হতে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির একটা বড় অংশ ইংলিশ রিভিয়েরায় কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এ যাত্রায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বলাটা সহজ হলেও পূর্ব ইউরোপ হতে ট্রেনে চড়ে পশ্চিম ইউরোপের এ দিকটায় পা রাখা তত সহজ ছিলনা। এ পথে মুল বাধা ছিল বার্লিন দেয়াল। পূর্ব জার্মানির বার্লিন শহরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী কেন দুভাগ করেছিল এ নিয়ে অনেক তর্ক আছে। কিন্তু ঠাণ্ডা যুদ্ধের ফ্রন্টের শুরুটা যে বার্লিন দেয়াল দিয়ে তা নিয়ে কোন তর্ক ছিলনা। পায়ে হেঁটে যারা বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করেনি তাদের বুঝানো মুস্কিল হবে ঠাণ্ডা যুদ্ধের কঠিন শীতল চেহারা। সেমিস্টারের প্রথম দিনটা যেভাবে কাটার কথা সেভাবেই কাটল। কোর্স পরিচিতি, ক্লাস রুটিন এবং ক্লাসমেটদের সাথে ভেকেশন অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। শরতের শুরু হলেও শীত ঝাঁকিয়ে বসতে সময় নেয়নি। বিশেষ করে রাতের বেলা। পৃথবীর এ দিকটায় তাই হয়, গরমকালটা চোখের পলকে বিদায় নেয়। লম্বা, বিরক্তিকর এবং ভয়াবহ শীতের প্রস্তুতি নিতে হয় পেপ্টেম্বরের শুরু হতে। অক্টোবরের শুরুতে তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে নামতে শুরু করে এবং মধ্য শীতে তা -৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। আমাদের জীবনও থেমে যায়। মানিয়ে নিতে হয় প্রকৃতির এই নির্মমতার সাথে। ক্লাস শেষে রুমে ফিরে শুনলাম খবরটা।

 

সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র শেখা ছিল আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। এর তাত্ত্বিক সংজ্ঞা ক্লাসে ঘটা করে শেখানো হলেও তার বাস্তব গোলাপি চিত্রের সম্যক ধারণা পেতে এ রকম একটা সমাজে বাস করাই ছিল যথেষ্ট। খবর শোনা এবং তা বিশ্বাস করার একমাত্র সোর্স ছিল সরকারী মাধ্যম। এর বাইরে সবকিছু ছিল বুর্জুয়া প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র। সোভিয়েত সমাজে বাস করে বুর্জুয়া প্রোপাগান্ডা যারা বিশ্বাস করতো তারা ছিল সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হত কথিত এসব শত্রুদের বিরুদ্ধে। খবরটার কোন প্রধান্য ছিলনা। পশ্চিমা মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজের মত কোন নিউজ মিডিয়াতে ঠাঁই পেতনা যদিনা তাতে ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টি ও তার সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য জড়িত না থাকতো। খুব অনিশ্চিত সময় পাড় করছিল সোভিয়েত শাসকরা। লৌহমানব লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভের সময় শেষ হয়েছে কেবল। চেরনেনকো আন্দ্রোপভদের মত কট্টর নেতাদের আনাগোনা শুরু হয়েছে ক্ষমতার পাদদেশে। দেশটার মানুষ এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিল তাও নয়। আসলে একদল-একজনের (সাধারণ সম্পাদক) দাসত্ব করতে গিয়ে গোটা জাতি পরিণত হয়েছিল যান্ত্রিক পুতুলে। যার চাবি ছিল শতকরা ৪০ ভাগ এলকোহলের ভদকায়। ৩ রুবেল ৭৫ কোপেকের পৌনে এক লিটার ভদকার বোতলকে ঘিরে আবর্তিত হোত সোভিয়েত জীবন। হোক তা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী অথবা শ্রমজীবীর দল। তবে এর মাঝে ব্যতিক্রম ছিল রুশ ইহুদিরা। অভূতপূর্ব মেধার অধিকারী এসব নাগরিকদের প্রায় সবাই ব্যস্ত থাকত পশ্চিম ইউরোপে মাইগ্রেট করার মিশনে। দেশ অথবা সমাজের ভালমন্দ নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। তাদের শয়নে স্বপনে থাকত পশ্চিম ইউরোপ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা দুরের দেশ ইসরাইলে পাড়ি দেয়ার লালিত ইচ্ছা। কেবল তাদের সাথে আলাপ করলে বুঝা যেত পার্থক্য গুলো। সান্ধ্য খবরে জানা গেল ঘটনাটা। সাখালিনের উপর একটি মার্কিন গোয়েন্দা বিমানকে গুলি করে নামিয়ে ফেলেছে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর একটি ফাইটার জেট। আমার মত খবর সন্ধানী তৃতীয় বিশ্বের আদমদের জন্য এ ছিল সেনসেশনাল নিউজ। কিন্তু সোভিয়েত সমাজের কোন স্তরেই এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলনা।

 

গোয়েন্দা বিমান যে আসলে কোরিয়ার এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান ছিল খবরটা প্রথম এক বছর জনগণকে জানতে দেয়া হয়নি। পশ্চিমা চাপে তারা বলতে বাধ্য হয়েছিল গোয়েন্দা বিমানে বেশ কজন মার্কিন ও কোরিয়ান গোয়েন্দা ছিল। রোববারের টিভিতে যুদ্ধ বিষয়ক এনালিস্টদের মুখ হতে শোনা গেল মার্কিন ’অপরাধের’ ম্যাগনিটিউড। তাদের অনেকের মতে কোরিয়ান বিমানের মাধ্যমে রুশ আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে মার্কিনীরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করতে চেয়েছিল। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল চাঁদের অন্য-পীঠে কি আছে তা জানার জন্য। মাধ্যম রেডিও। কিন্তু হায়, হতাশ হতে হল। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, ডয়েচে বেল্লা সহ পশ্চিমা সবগুলো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে জ্যাম করে দেয়া হয়েছে। ইংরেজি অথবা রুশ ভাষা সহ কোন ভাষাকেই রেহাই দেয়া হয়নি। গোটা রুশ জাতিকে মিথ্যার সাগরে ভাসানো হল। কিন্তু খবর লিক হতে সময় লাগল না। গোয়েন্দা বিমান নয়, বরং কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে মিসাইল মেরে ঘায়েল করেছে সোভিয়েত বিমান বাহিনী। নিউ ইয়র্ক হতে আলাস্কার এংকোরেজ হয়ে বিমানটির শেষ গন্তব্য ছিল সিউল। পাইলট ও কো-পাইলট অটো-পাইলট মুডে দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। বুঝে উঠার আগে ফ্লাইট সোভিয়েত নিষিদ্ধ ফ্লাইং জোনের ১২ কিলোমিটারের মধ্য ঢুকে পরে। সেকেন্ডের মধ্যে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর একটি জেট আকাশে উঠে যায় এবং মিসাইল নিক্ষেপের মাধ্যমে ভূপাতিত করে ফেলে কোরিয়ান বিমান। ২৬৯ জন যাত্রী ও ক্রুদের সবার সলিল সমাধি হয় জাপান সাগরে। যাত্রীদের একজন ছিল জর্জিয়া হতে নির্বাচিত মার্কিন কংগ্রেসম্যান লরেনস ম্যাকডোনাল্ড। সিআইএ’র রিপোর্ট হতে জানা যায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের থাকার কথা ছিল একই ফ্লাইটে। কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নেয়া মার্কিন সৈন্যদের একটা গেট-টুগেদারে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং আরও অনেকে। সাগর হতে উদ্বার করা ব্ল্যাক বক্স পর্যন্ত গায়েব করে দেয় সর্বহারাদের একনায়করা। তবে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের ঊষালগ্নে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়লৎসিন জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করেন গুম করা ব্ল্যাক বক্স। এবং কেবল তখনই উন্মোচিত হয় ৩ রুবেল ৭৫ কোপেক মূল্যের ভদকা সভ্যতায় বেড়ে উঠা সোভিয়েত শাসকদের কালো ইতিহাস।

 

এ যাত্রায় কোরিয়ান নয়, নামানো হয়েছে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান। তবে সাগরে নয়, নামানো হয়েছে পূর্ব ইউক্রেনের দনেস্ক শহরের বিতর্কিত একটি অঞ্চলে। এলাকা নিয়ে বিতর্কটাও খুব অদ্ভুত। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের অনেক অঞ্চলে রুশ জাতির প্রাধান্য বাস্তব সত্য। ঐতিহাসিক ভাবে এ বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সোভিয়েত দেশের ১৫টি প্রজাতন্ত্রে। ঢাল-তলোয়ার বিহীন রুশ সাম্রাজ্যের অধিপতি ভ্লাদিমির পুতিন অস্ত্র দিয়ে এসব অঞ্চলের জনগণকে বলছেন তোমরা বিদ্রোহ কর এবং বলতে শুরু কর ইউক্রেনে নয়, আমরা রুশ দেশে থাকতে আগ্রহী। পুতিনকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিম ইউরোপের সাথে সম্পর্ক করার কারণে ইউক্রেনকে শাস্তি দিতেই এ নাটক। ইতিমধ্যে রক্তের নদী বয়ে গেছে দেশটার পূর্বাঞ্চলে। এ ক্ষেত্রে পুতিন বাহিনী ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পর রেড আর্মি কর্তৃক মধ্য এশিয়া দখলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে। পশুত্ব রুশদের শিরা উপশিরায়। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। সমসাময়িক চেচেন ম্যাসাকার এবং তার দখল তারই ধারাবাহিকতার ফসল। মালয়েশিয়ান বিমান ভূপাতিত করার দায়িত্ব নিয়ে রুশ এবং ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দায়ী করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ওরা একই বাক্সের দুই জিন। পশুত্ব ও নির্মমতায় একজন অন্যজনকে ছাড়িয়ে যেতে সামান্যতম সময় নেয়না।

 

৩০শে জুন ন্যাটোর ইউরোপীয় কমান্ডার জেনারেল এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন তাদের কাছে প্রমাণ আছে রুশ সৈন্যরা পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল লঞ্চ করার ট্রেনিং দিচ্ছে। খবরের সমীকরণ মেলাতে গেলে সহজেই বের করা যাবে কাদের হাতে ভূপাতিত হয়েছে মালয়েশিয়ান ফ্লাইট ১৭ এবং প্রাণ হারিয়েছে ১৫জন ক্রু সহ ২৮৩ জন যাত্রী। কথিত বিদ্রোহীদের হাতে শুরু হতে shoulder-to-air রকেট ছিল, যার উড্ডয়ন ক্ষমতা ১০,০০০ ফুটের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ট্রাক হতে ছোড়া যায় এমন সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইলের রেঞ্জ ৩০ হাজার ফুটের অনেক উপরে। নিশ্চিত ভাবে বলা যায় এমন একটা মিসাইল দিয়েই ধরাশায়ী করা হয়েছে মালয়েশিয়ান বিমানকে। এ পশুত্বের আসল আর্কিটেক্ট রুশ সেনাবাহিনী যার পেছনে শক্ত অবস্থায় দাড়িয়ে আছে পুতিনের একনায়কতান্ত্রিক অসুস্থ রাজনীতি।

 

কথায় বলে ভ্রমরে ভ্রমর চেনে। সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা মূল্যের অস্ত্র সদাই করতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী (অ-অবৈধ) গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। দেখা করেছেন স্বৈরশাসক পুতিনের সাথে। চুক্তি করেছেন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের উপর। এসব খবর শুনতে খুব ভাল শোনায়। মনে হয় উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে যাচ্ছে আমাদের দেশ। কিন্তু রুশ চরিত্রের উপর যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তাদের ধারণা করতে কষ্ট হয়না লিখিত চুক্তির পেছনে নিশ্চয় রয়ে গেছে অলখিত চুক্তি। এ চুক্তি দুই অবৈধ ও অসৎ স্বৈরশাসকের বুঝাপড়ার চুক্তি। চারিত্রিক দিক বিবেচনায় এই দুই নেতার উদ্দেশ্য ও বিধেয় এক ও অভিন্ন, যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী (অ) এখন বন্ধুহীন। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যার উপর ভরসা করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারবেন। সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিবেশী ভারতের উপরও বিশ্বাসে রাখতে পারছেন না। এ বিবেচনায় পুতিনের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। ক্ষমতায় বসে অর্থ-সম্পদ ভাগ-বটোয়ারা করার অনন্য নায়ক এই রুশ একনায়ক।

 

ল অব সাবষ্ট্রাকশনের ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাসে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গুলোকে শোয়ালে কতগুলো অদ্ভুত সাদৃশ্য চোখে পরতে বাধ্য। এই যেমন, দুই ব্যবস্থায়ই একজন স্বৈরশাসকের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। দুই সমাজ ব্যবস্থার ভীত প্রতিষ্ঠিত একই ফিলসফির উপর। সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের সমালোচক অথবা বিরোধীদের আখ্যায়িত করা হয় বুর্জুয়ায় হিসাবে এবং তাদের বিনাশের মাধ্যমে উড়ানো হয় ভবিষ্যৎ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ঝাণ্ডা। পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক কট্টর রাষ্ট্র গুলোর সমালোচকদের সবাইকে বলা হয় কাফের। কাফেরদের হত্যার জন্য নাকি পুরস্কারেরও ব্যবস্থা আছে পরজন্মে। এসব অসুস্থ এবং তামাদি সূত্রের উপর টিকে আছে আজকের সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মভিত্তিক সমাজ গুলো। যার একমাত্র কাজ একজন স্বৈরশাসক ও তার পারিবারিক ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করায় দাসত্ব করা। আজকের পুতিন ও সৌদি বাদশাহদের সাথে সাদৃশ্য এখানেই। অবশ্য এ পথের নতুন পথিক হয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী (অ)… নাকে গণতন্ত্রের মুলা ঝুলিয়ে জাতিকে গাধা বানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন গন্তব্য পথে। এ যাত্রায় কৌশল হিসাবে ব্যবহার করছেন জাতির মুক্তিযুদ্ধ। বুর্জুয়া এবং কাফের তত্ত্বের মত ব্যবহার করছেন জাতির এই মহান অর্জনকে। ফতোয়া দিচ্ছেন যারা শেখ পরিবারের আজীবন শাসনে বিশ্বাস করেনা তারা দেশদ্রোহী, রাজাকার এবং এ দেশের তাদের বাস করার অধিকার নেই। অত্যন্ত চৌকস কায়দায় প্রতিপক্ষকে নির্মূল করছেন। গোটা জাতিকে অসততার দৌড়ে নামিয়ে সপরিবারে মজা লুটছেন। এবং ধরে নিয়েছেন হাজার বছর ধরে চালিয়ে যাবেন পারিবারিক শাসন। এ মুহূর্তে এমন একটা শাসন অসম্ভব কিছু মনে হচ্ছেনা। কারণ অসৎ দৌড়ে বিরতি নেয়ার মত অবস্থানেই নেই জাতি। বিরতি মানেই ধ্বংস, বিপর্যয়। যা হতে উঠে দাঁড়ানোর মত শক্ত মেরুদন্ড নেই জাতির পীঠে।

 

খরার তাপ-দাহে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে ঈশান কোনে জমা হয় একখণ্ড মেঘ। এক সময় তা রূপ নেয় সর্বগ্রাসী কালবৈশাখীতে। তারপর ধেয়ে আসে। লন্ডভন্ড করে দেয় জনপদ। উড়িয়ে আছড়ে ফেলে পুরাতন অনেক কিছু। জাতির ঘাড়ে চেপে বসা শেখ নামের ভুত উপড়ে ফেলতেও আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে আকাশের দিকে। এক সময় না এক সময় মেঘ জমবে। এবং সে মেঘ প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে রূপান্তরিত হয়ে উড়িয়ে নেবে শাসক নামক এসব দানবদের। সভ্যতা বিবর্তনের এ অমেঘো ধারা হতে স্বৈরশাসক পুতিন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশা আর শেখ হাসিনার মত বেহায়া শাসকরা রক্ষা পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
http://www.amibangladeshi.org/blog/07-20-2014/1468.html

প্রসঙ্গ অ্যামেরিকার ‘সোফা’ চুক্তি এবং জাতীয় মেরুদণ্ড প্রশ্নে বাংলাদেশ

 

 Banda Reza ul Kabir

খুবই জনগুরুত্বপুর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সুকৌশলে জনসাধারণের চোখের আড়ালে রেখে দেয়া একটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অনেকদিন থেকেই প্রসঙ্গটা আমার বোর্ডের টু-ডু লিস্টে স্টিক করা ছিলো। সময় সুযোগের অভাবে লেখা হয়ে উঠছিল না।

Status of Forces Agreement সংক্ষেপে SOFA হল আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির এক গুরুত্বপূর্ন একটি অধ্যায়; যার ব্যাপারে আমেরিকা এবং চুক্তিতে আবদ্ধ দেশটির জনসাধারণকে পরিকল্পিতভাবে অন্ধকারে রাখা হয়। সাধারনত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা ছাড়া এই চুক্তির ব্যাপারে অন্য কেউ কিছু জানে না, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে কাউকে এ ব্যাপারে জানতে দেয়া হয় না।

আমেরিকান কংগ্রেশনাল রিসার্চ সেন্টারের ভাষ্যমতে (Chuck Masson নামক একজন আমেরিকান আইন বিশেষজ্ঞ ও এটর্নী কর্তৃক লিখিত সোফা চুক্তির উপর বিস্তৃত গবেষনাপত্র) সোফা চুক্তি হলো এমন কতগুলো ধারা, যার মাধ্যমে অন্য একটি দেশের সাথে আমেরিকার সামরিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। এই চুক্তির ধারাগুলোই নির্ধারন করে চুক্তিবদ্ধ দেশের অভ্যন্তরে একজন আমেরিকান সামরিক অফিসার বা রিপ্রেজেন্টেটিভ কী কী বিশেষ সুবিধা লাভ করবে। মূলত এই চুক্তিবলেই তারা অন্য দেশের মধ্যে দাপ্তরিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে সামরিক অপারেশন পর্যন্ত যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারে। এসব কাজ করার সময় আমেরিকান প্রতিনিধির উপর চুক্তিবদ্ধ দেশের আইন কানুনের সাধারন প্রয়োগ হবে না। চুক্তির শর্ত ও ধারাগুলোই নির্ধারন করে দিবে যে আইনের কোন কোন অংশ আমেরিকানদের জন্যে শিথিল বা অপ্রযোজ্য হবে।

সোফা চুক্তির কোন আনুষ্ঠানিক দাপ্তরিক দলিল দস্তাবেজ থাকে না। এতে কোন সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বা আওতাধীন বিষয়বস্তর তালিকাও থাকে না। এমনকি এই চুক্তিকে কোন সুনির্দিষ্ট শিরোনামের মাঝেও ফেলা যায় না। এর পেছনে কারন হল আমেরিকার স্বার্থ রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের জন্যে চুক্তিবদ্ধ দেশের উপর সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সোফা চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলোর একটা হল, আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তাদের উপর চুক্তিবদ্ধ দেশের কোন আইনী নিয়ন্ত্রন থাকবে না। বিনা বাধায় আমেরিকান সামরিক প্রতিনিধিদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ন কার্যালয় সমূহে প্রবেশাধিকার থাকবে। এসময় তাদের উপর সামরিক ইউনিফর্ম পরিধানের জন্যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। তারা সকল কর ও শুল্কের আওতামুক্ত থাকবে। কোন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই তারা আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করতে পারবে। বেতার তরংগ ব্যবহারের সুবিধা পাবে। লাইসেন্স ও অন্যান্য নীতিমালার ব্যপারে তাদের উপর ততটুকুই নিয়ন্ত্রন আরোপ করা যাবে যতটুকুর ব্যাপারে তারা নিজেরা সম্মতি দেবে।

উল্লেখ্য যে এখানে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা বলতে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে কর্মরত লোকদেরকেই বুঝানো হয়নি; বরং স্বশস্ত্র বাহিনীগুলোর সবগুলোই এর আওতাভুক্ত। উপরন্ত প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মকর্তা বা প্রতিরক্ষা বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত চুক্তিবদ্ধ বেসামরিক কন্ট্রাকটাররাও এই চুক্তির আওতায় পড়বে।

ন্যাটোর সাথে সোফা চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা ন্যাটোভুক্ত প্রতিটি দেশের কাছ থেকেই এই কাজের জন্যে সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। যেহেতু সামরিক দিক থেকে ন্যাটো ও মার্কিন স্বশস্ত্র বাহিনীগুলো একে অপরের সহযোগী তাই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর জন্যে সোফা চুক্তিকে আবদ্ধ না হয়ে কোনো উপায় নেই।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সোফা চুক্তিকে কোন ধরনের সীমারেখার গন্ডিতে ফেলা যায় না। কোন ধরনের আইনের কাছে এটি মুখাপেক্ষী নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এই চুক্তির ধারাগুলো এত সংক্ষিপ্ত হতে পারে যে এক পৃষ্ঠাতেই পুরো চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করা যায়। উদাহরণস্বরুপ ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার একটি যৌথ সামরিক মহড়া করা। চুক্তিটিতে মাত্র ৫টি ধারা ছিল। তবে মূল উদ্দেশ্য একটাই ছিল, যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বতসোয়ানার সাথে আমেরিকার চুক্তির কথাটিও উল্লেখ করা যায়, যার মাধ্যমে আমেরিকা বতসোয়ানার সরকারের দ্বারা আইনানুগ ভাবে সেদেশের মাটিতে মানবিক সাহায্যের নামে কার্যক্রম শুরু করলেও বেসামরিক দাপ্তরিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে সামরিক মহড়া ও ট্রেনিং এর সুযোগ পায়। বস্তত এসকল ধারাগুলোর অন্তরালে আমেরিকার উদ্দেশ্য একটিই, আর তা হল একটি দেশে ঔপনিবেশিকতার সূচনা করা ও ধীরে ধীরে বিভিন্নভাবে দেশটির আভ্যন্তরীন ও প্রতিরক্ষা কাঠামোকে দূর্বল করে দেশটির উপর সার্বিক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা।

এ চুক্তির মাধ্যমে তারা দেশটির আইন শৃংখলা বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠাপূর্বক নিজস্ব মানদন্ডে প্রনীত “ন্যায়নীতি” ও “শান্তি-শৃংখলা” রক্ষা করতে চায়। মূলত এর পেছনে থাকে তথাকথিত সন্ত্রাস দমন, জঙ্গীবাদ নির্মূল সহ এধরনের অন্যান্য উদ্দেশ্য; যদিও অধিকাংশ থেকে এটা করা হয়ে থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন বা মানবাধিকার নিশ্চিতকরনের মত বাহ্যয় মহৎ কার্যক্রমের ছদ্মাবরনে।

 

উল্লেখযোগ্য কিছু দেশে সোফা চুক্তিঃ

 

আফগানিস্তানঃ

সেপ্টেম্বর ১১ এর হামলার পর আল ক্বায়েদা ও তালেবানের মূলোতপাটনের লক্ষে আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা চালায়। এরই সূত্র ধরে ২০০২ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত আফগান পুতুল সরকারের সাথে আমেরিকা কতগুলো পত্রবিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখার যাবতীয় বন্দোবস্ত সেরে ফেলে। আমেরিকান ভিন্ন দেশকে সাহায্য প্রদান আইন ১৯৬১ মোতাবেক আফগানিস্তানে আর্থিক সাহায্য দেয়ার শর্তসাপেক্ষে উক্ত চুক্তি আফগানিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষন থেকে শুরু করে অপারেশন, এমনকি ঘাটি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়। একারণে খুব সহজেই আফগানিস্তানকে তারা সামরিকভাবে কব্জা করে নিতে পারে। এই চুক্তির ধারামতে আমেরিকার সকল প্রতিনিধি আফগানিস্তানের সকল ফৌজদারী আইনের আওতার বাইরে থাকবে। অর্থাৎ আমেরিকার মনোনীত কোন ব্যক্তি যদি আফগানিস্তানে খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধও করে তবুও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় আইনে তার বিচার করা যাবে না। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ধারা হল যে, অন্য কোন দেশ থেকে কোন আমেরিকান নাগরিক যদি কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয় তাহলে আফগানিস্তান সরকার সেই অপরাধীকে সেই দেশের কাছে তুলে দিতে পারবে না। আফগান সরকার সরাসরি ও প্রকাশ্যে আমেরিকার এই চুক্তিকে মেনে নেয়।

২০০৫ সালের ২৩মে তে হামিদ কারজাই ও বুশের মধ্যকার একটি যৌথ ঘোষনাপত্রের মাধ্যমে আফগানিস্তান ও আমেরিকার পারস্পরিক ভবিষ্যত পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়, যার মাধ্যমে আমেরিকান সেনারা আফগানিস্তানে পূর্ন নিয়ন্ত্রনাধিকার তো পাবেই উপরন্ত এই চুক্তির মাধ্যমে তারা আফগান সৈন্যদেরকেও নিজস্ব কর্মকান্ডে ব্যবহার করতে পারবে। সরকারের কাছে এরুপ প্রস্তাব করা হয় যে আফগানিস্তানের জনগনকে বুঝাতে হবে যে তারা এখনো নিজ দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়ে উঠেনি; তাই নিজেদের স্বার্থেই তাদের উচিত হবে আমেরিকান সৈন্যদের কাছ থেকে প্রশিক্ষন গ্রহন করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে তালেবান থেকে ‘নিরাপদ’ থাকতে পারে।

 

জার্মানিঃ

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে জার্মানির মত ক্ষমতাবান একটি দেশ আমেরিকার সাথে এমন লজ্জাস্কর একটা চুক্তিতে আবদ্ধ! জার্মানির ন্যাটোতে যোগদানের চার বছর পর আমেরিকার সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যা ন্যাটো সোফা চুক্তি ১৯৫৩ নামে খ্যাত। এই চুক্তির আওতায় আমেরিকা-জার্মানির মধ্যে একটি সামরিক সম্পর্কের সেতু স্থাপিত হয়। চুক্তির ধারাসমূহ বেশ বিস্তৃত এবং প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার সুবিশাল পরিসরের। এর মাধ্যমে জার্মানির অভ্যন্তরে আমেরিকা অপারেশান চালানোর সুযোগ পায়।

জাপানঃ

জাপানের সাথে আমেরিকার এই চুক্তির মাধ্যমে জাপানের অভ্যন্তরে কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আমেরিকান বিনা বাধায় পার পেয়ে যেতে পারবে। ১৯৫৭ সালে একজন আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা একজন জাপানি নাগরিককে হত্যা করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তবে চুক্তিতে আবদ্ধ থাকার কারনে আমেরিকা তার সৈন্যের পক্ষে জোর দাবি জানিয়ে বলতে সক্ষম হয় যে, এই হত্যাকান্ড ছিল তাদের সামরিক কার্যক্রমেরই একটা অংশমাত্র। জাপান সরকার এটিকে ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে প্রমান করার জন্য সকল জোড়ালো প্রমান উপস্থাপনের কারণে আমেরিকা এটি মানতে বাধ্য হয় এবং তাকে জাপানের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত ঐ সেনা কর্মকর্তা নিজের পক্ষে আমেরিকার ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলম্বিয়াতে রীট করে। ঐ রীটটি খারিজ হয়ে গেলেও ঐ সামরিক কর্মকর্তার পক্ষে আমেরিকান সরকার জাপান সরকারকে বিচার কাজ না চালাবার জন্যে চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে ঘটনাটি আমেরিকান সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।

ইরাকঃ

২০০৩ এর মার্চ থেকে শুরু করে ২০১০ এর আগস্ট মাস পর্যন্ত ইরাকের অভ্যন্তরে আমেরিকা বহু সামরিক অপারেশন পরিচালনা করে। প্রথমত এর উদ্দেশ্য ছিল সাদ্দাম হুসেনের অপসারন, যদিও পরবর্তীতে তাদের আরো অনেক উদ্দেশ্য প্রকাশ পায়। ইরাকের সাথে আমেরিকার চুক্তির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলঃ

এই চুক্তির আওয়াতায় আমেরিকা ইরাকী সরকারকে ‘সহায়তা’ করবে; ইরাকী নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষন দিতে পারবে; তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাজ সরঞ্জাম ও আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে। ইরাকী সরকারকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী’ যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে যাতে তারা আল কায়েদা ও এর মত ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। পাশাপাশি পূর্বেকার অপরাধী সরকারগুলোর অবশিষ্ট কোন বাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালাতে পারে। সর্বোপরি ইরাকে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা হবে এবং ইরাকের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা হবে।

উল্লেখ্য যে ইরাকের সাথে আমেরিকার এই চুক্তি আইনী দিক থেকে সকল বিধি-নিষেধের উর্ধ্বে এবং এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে ইরাকের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এমনকি আইন প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলির উপরও আমেরিকা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।

এসবের সাথে আরো যুক্ত ছিল যে, ইরাকের অভ্যন্তরে আমেরিকার যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইরাক সরকারকে অবশ্যই সম্মত হতে হবে এবং তার নিজ বাহিনী দ্বারা আমেরিকাকে পূর্ন সহযোগিতা করতে হবে। চুক্তির প্রতিটি ধারাই নগ্নভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও অনেক গোড়া আমেরিকান সামরিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, এটি আমেরিকার স্বার্থ আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়।

এছাড়াও আর যেসব দেশের সাথে আমেরিকার এই চুক্তি রয়েছে তার মধ্যে ফিলাপাইন্স ও দক্ষিন কোরিয়ার নাম প্রনিধানযোগ্য।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সোফা চুক্তিঃ

Cold war পরবর্তী সময়ে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ যেন হঠাত করেই বেড়ে যায়। এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লাগে। এখানকার কোন দেশে পারমানবিক শক্তিকেন্দ্র স্থাপিত হবে, কোন দেশের সাথে কোন দেশের কী ধরণের ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদিত হবে ইত্যাদি সকল কাজেই আমেরিকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি লক্ষনীয়। কৌশলগত ভৌগলিক গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার এই আগ্রহ যেন একটু বেশিই।

প্রথমত সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের যা অবস্থা, তাতে এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শুরু করে শেষ শস্যদানাটুকুও যদি আমেরিকা হাইড্রলিক পাম্প লাগিয়ে নিয়ে নিতে চায় সেক্ষেত্রে চুপচাপ তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের হয়তো কিছুই করার থাকবে না।

SOFA-05

দ্বিতীয়ত, এই দেশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দক্ষিন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়। বাংলাদেশে আমেরিকার “প্রফিট” এর সম্ভাবনা যথেষ্ঠ। এটা বুঝতে কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমেরিকার ইতিহাস থেকে এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে বৃহৎ কোন স্বার্থ ছাড়া আমেরিকা কোন দেশের পেছনে এভাবে সময় বা সম্পদ কখনোই ব্যয় করে না।

বাংলাদেশে সোফা চুক্তির সূচনা হয় ১৯৯৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের সময়; যদিও বিএনপি-জামাত সরকার পরবর্তিতে মোটেই এর বিরোধিতা করেনি; যা এ চুক্তির প্রতি তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থনই প্রমাণ করে। আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট বিল রিচার্ডসন এর সূচনা করেন এবং পরবর্তীতে ততকালীন আমেরিকান সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সফরে এসে চুক্তিটি কার্যকর পর্যায়ে নিয়ে যান।

১৯৯৮ সালে যখন প্রথম এই চুক্তিটি সূচনা করা হয় তখন এর ধারাগুলো এত সুবিস্তৃত ও গভীর ছিল না; তখন এটা শুধু আমেরিকান সেনাবাহিনীর সাথে যৌথ সামরিক মহরার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে চুক্তির ধারাগুলো যখন স্পষ্ট করা হয় তখন দেখা যায় যে তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য এক সুস্পষ্ট হুমকি। চুক্তির ধারাগুলো নিম্নরুপঃ

১. ‘জরুরী প্রয়োজনে’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর বিনা বাধায় প্রবেশ পারবে
২. আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তারা এদেশের পাসপোর্ট ও ভিসা-নীতির উর্ধ্বে থাকবে
৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেকোন ধরনের সরঞ্জাম (যুদ্ধাস্ত্র বা সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার্য যন্ত্রাদি) কাস্টমস ছাড়াই বিনা বাধায় প্রবেশ এবং পরিবহনের পূর্ন অধিকার থাকবে।
৪. প্রশিক্ষন ও মহড়ার জন্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমেরিকান সৈন্যদের স্বশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশের অধিকার থাকবে।
৫. প্রশিক্ষন ও মহড়া চলাকালীন সময়ে তাদের দ্বারা রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি হলে তার কোনো দায়ভার তারা বহনে বাধ্য থাকবে না।
৬. বাংলাদেশে অবস্থানরত সামরিক সদস্যদেরকে দেশের আইন ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে রাখা।
৭. অন্য কোন দেশে কোন অপরাধ সংঘটন করে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর কেউ যদি বাংলাদেশে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চায় তাহলে তা দিতে হবে এবং তাকে সে দেশের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না।
৮. দেশের যে কোন স্থাপনাসমূহে আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তাদের বিনা বাধায় প্রবেশাধিকার থাকতে হবে।
৯. এদেশের যে কোন নাগরিকের পেছনে গোয়েন্দাগিরী,  তাকে গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ, এমনকি তাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার অধিকার থাকবে আমেরিকার সামরিক কর্মকর্তাদের।

এই চুক্তির আওতায় আমেরিকান সৈন্যরা বাংলাদেশে যখন খুশী তখন বিনা বাধায় আসতে পারবে এবং বাংলাদেশী সৈন্যরা শর্ত সাপেক্ষে প্রশিক্ষনের জন্যে আমেরিকায় যেতে পারবে, তবে কোনভাবেই বাংলাদেশী সৈন্যদের জন্যে সেসব সুবিধার কিছুই প্রযোজ্য হবে না যে সুবিধাগুলো আমেরিকা সৈন্যরা এদেশে ভোগ করতে পারবে।

এদেশের সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ের কেবল ততটুকুই জানে যতটুকু সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে জানতে দেয়া হয়। এই কথাটি আমেরিকার জনগণের ক্ষেত্রে আরো বেশি বাস্তব। এজন্যে উভয় দেশের নাগরিকরাই নিজ সরকারের এমন হীন পদক্ষেপগুলোর ব্যপারে অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে, ফলে প্রতিবাদ তো দূরে থাকুক, এসব বিষয়ে জনমতও গড়ে উঠছে না। টিকফা বা অন্যান্য চুক্তি নিয়ে কিছু কথা-বার্তা কেউ কেউ বললেও তার চেয়ে হাজারো গুন মারাত্মক ভয়াবহ চুক্তি সোফা নিয়ে তেমন কারো মাথাব্যথাই দেখা যায় না। অন্যদিকে এমন কিছু প্রো আমেরিকান সংগঠনের অস্তিত্বও এদেশে আছে যারা এই চুক্তিকে সমর্থন জানায় এবং একে দেশের জন্য কল্যাণকর হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে। তাদের বক্তব্যমতে আমেরিকা বাংলাদেশের বন্ধু এবং দুই দেশের পারস্পারিক সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশের উন্নতি সম্ভব। শাহারিয়ার কবির নামক তথাকথিত এক দেশপ্রেমিক তো বলেই দিয়েছে “জঙ্গি মৌলবাদ দমনে আমেরিকার সহায়তা প্রয়োজন।” গত ২০১৩ এর ৬ই জানুয়ারির ভয়েজ অফ আমেরিকার বাংলা অনলাইন সংস্করণে তা প্রকাশও হয়েছে। (লিঙ্কঃ http://www.voabangla.com/content/interview-with-shahriar-kabir-on-his-film-against-jihad-06-january-2013/1578761.html)

Shahariar-Kabir-VOABangla

উল্লেখ্য যে সোফা চুক্তির এই ভয়াবহ ধারাগুলো ২০০৯ পরবর্তী শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই যুক্ত হয়েছিল। ২০১২ তে আমেরিকান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর এই চুক্তি নবায়ন হয়। আওয়ামীলীগের সাথে হাজারো বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও এক্ষেত্রে বিএনপি-জামাত কিন্তু নিজেদের মুখে কুলুপ এটে রেখেছিলো।

দেশ ও জাতি তথা বিশ্বের কাছে আত্মমর্যাদাহীন ও পরাজিত ব্যর্থ সরকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আশঙ্কা ছাড়াও এই চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার আরও কিছু জটিলতার সম্মুখীন হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

১. বাংলাদেশে অন্য কোন দেশের সৈন্য প্রবেশের নিরঙ্কুশ অধিকার অনুমোদন করার বিষয়টি শুধু আইনী বা রাজনৈতিক দিক থেকেই অসমীচীন নয় বরং এদেশের সংবিধানেরও সুস্পষ্ট পরিপন্থী একটা ব্যাপার।

২. “সার্ক” ভুক্ত দেশ হবার কারণে বাংলাদেশ সার্ক এর কিছু নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য, যার মধ্যে অন্যতম হল স্থানীয় সীমারেখায় বহিরাগতদের প্রবেশাধিকারের উপর নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রন আরোপ করা। সোফা চুক্তির আড়ালে আমেরিকাকে এই অবৈধ সুবিধা প্রদান করা মানেই সার্কের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা।

এসমস্ত ভয়াবহ পরিনতির কথা বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে এই চুক্তির বিষয়টি শুধুমাত্র নীতিনির্ধারক মহল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এবং জাতীয় নিরাপত্তার আড়ালে বিষয়টি জনগনের কাছে গোপন করা হচ্ছে।

আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্ক ১৯৮০ সালের পর থেকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। সেসময় ৩০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশী সামরিক কর্মকর্তা আমেরিকায় প্রশিক্ষন নিয়েছেন এবং তখন থেকেই আমেরিকা-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে অনেক অপারেশান ও মহড়া হয়ে আসছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাইক্লোনকে কেন্দ্র করে অপারেশন সী এঞ্জেল।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দুটি প্রধান আন্তর্জাতিক দ্বন্ধে আমেরিকাকে সামরিকভাবে সমর্থন দিয়েছে।

ক) ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ, যাতে বাংলাদেশ প্রায় ২৩০০ সৈন্য পাঠায়

খ) ১৯৯৪ সালের হাইতি মিশন, যাতে বাংলাদেশের কন্টিনজেন্ট প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত ছিল

আমেরিকান নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তারা সোফা চুক্তির পেছনে তাদের যেসব প্রধান উদ্দেশ্যের কথা প্রকাশ করেছেন তা নিম্নরূপ-

১. মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে কার্যক্রম জোরদার করা

২. প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে ত্রানসাহায্য সরবরাহ করা

৩. জল ও আকাশ পথে উদ্ধারকাজ চালনা ও অপারেশন পরিচালনা করা

৪. স্কুল স্থাপন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন

৫. চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করা ও প্রশিক্ষন

প্রকাশ্যে এধরণের মানবিক সাহায্যের কথা বলে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ বরাবর বুঝাতে চেয়েছে যে সোফা কোন সামরিক চুক্তি নয় এবং এর পেছনে আমেরিকার ও মানবিক সাহায্য প্রদান ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যই নেই। তারা কখনই সোফা চুক্তির পেছনে লুকায়িত স্বার্থের কথা প্রকাশ করে না। উপরন্ত তারা এমন প্রস্তাবও করেছে যে এধরনের “লাভজনক” একটি চুক্তি করা থেকে বিরত থাকা মানে বাংলাদেশের নিজেরই ক্ষতি করা। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিয়েগো গার্সিয়ার পর বাংলাদেশের মত একটা সুইট স্পটে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন করার ব্যাপারে তারা সত্য-মিথ্যা যেকোন কিছুরই আশ্রয় নিবে এটাই স্বাভাবিক।

Hillary Rodham Clinton with Bangladeshi Prime Minister Sheikh Hasina and Foreign Minister Dipu Moni

হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের অব্যবহিত পরেই ডেইলি স্টার পত্রিকা সোফা চুক্তির ব্যাপারে স্বল্প পরিসরে কিছুটা আলোকপাত করেছিলো। একথা স্পষ্ট যে সোফা চুক্তিতে আবদ্ধ হবার মানেই হচ্ছে আমেরিকার কাছে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেওয়া। কারন এই চুক্তির ধারা মোতাবেক দেশের মধ্যেও কোন আমেরিকানের উপর দেশের আইন বলবত থাকছে না। তাছাড়া এই চুক্তির মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ন তথ্যাদির উপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।

US Secretary of State Hillary Rodham Cllinton

সোফা চুক্তির ব্যাপারে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নীরবতা সত্যিই অদ্ভূত। এমনকি হিলারি ক্লিনটনের সরাসরি টিভি সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত সাংবাদিকদের সোফা চুক্তির বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নিরবতা বিস্ময়কর। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির সাথে যারা একটু হলেও পরিচিত তারা খুব ভালভাবেই জানেন যে, কিভাবে একটি দেশকে আমেরিকা ধীরে ধীরে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। অতীতে এর অসংখ্য উদাহরন রয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলের অবাক করা নীরবতা রাজনীতিবিদদের স্বার্থান্বেষী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকাকে সন্তষ্ট করতে নিজ দেশের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে দিনশেষে বাংলাদেশের লাভের খাতায় যে কিছুই থাকবে না, বরং যা ছিল তার সবই যাবে—এই সহজ সমীকরনটা বুঝতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যত দেরী করবেন দেশ ও দেশের জনগণ ততই নিরাপত্তা হারাবে।

 

 
 

Wassalam,
Banda Reza ul Kabir
…until I taste what Hamza bin Abdul Muttalib (RA) tasted

Read me @ www.bandareza.com

Subscribe my videos on www.youtube.com/bandareza313
 

 

“ওয়ার অন টেরর”: বাংলাদেশ অধ্যায়

1

by Jahid Islam

সোভিয়েত-আফগানিস্তান যুদ্ধ থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর এ সময় পর্যন্ত নির্মিত বাস্তব দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা থ্রিলিং সিনেমার নাম ‘ওয়ার অন টেরর’/ এটা সিকুয়েল মুভি,পার্ট অনেক। সিরিয়ালও বলা যেতে পারে। ‘লিও স্ট্রাউস’ নাকি ‘স্যামুয়েল হান্টিংটন’ কে এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। আবার দুই জনের থিওরি জোড়া লাগিয়েও বানানো হতে পারে। তবে মানতেই হবে মাস্টার স্ক্রিপ্ট। প্রধান চরিত্রে এ শতাব্দীতে ইতিমধ্যে অভিনয় করেছেন জর্জ বুশ,টনি ব্লেয়ার। এরপর এসেছেন বারাক ওবামা, নিকোলাস সারকোজি, এবং সর্বশেষে এসেছেন ফ্রাঙ্কয়িস হলান্ডে। কাহিনী ও সময়ের বাস্তবতায় চরিত্রগুলো পরিবর্তন হয়েছে।

wot

সিনেমার শুটিং হয়েছে আফগানিস্থান, পাকিস্থান, ইয়েমেন, কেনিয়া, তানজানিয়া, ইরাক, মালি, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া সহ পৃথিবীর নানান প্রান্তে। অনেকগুলো স্পটে চিত্রায়ন এখনো চলছে।

সাধারণ দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে আলকায়েদার সাথে এ খেলায় অংশ গ্রহণকারীদেরকে তাদের ভুমিকার ভিত্তিতে চার ভাগে ভাগ করা যায় বলে আমার মনে হয়েছেঃ-

 ১/ প্লেয়ারঃ যারা সরাসরি এ খেলায় অংশগ্রহণ করে। যেমন- আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স।

২/ সহযোগীঃ যারা এই ওয়ার অন টেররে আমেরিকারকে সাহায্য করে। যেমন- পাকিস্থান।

৩/ ডাবল সাইডেড প্লেয়ারঃ যারা আলকায়েদাকে আর্থিক অনুদান এবং লোকবল সরবরাহ করে, আবার আমেরিকারকে তাদের ঘাঁটি ব্যবহার করে ওয়ার অন টেররে সাহায্য করে । যেমন –সৌদি আরব।

 ৪/ খেলায় অংশগ্রহণের ভয় দেখায়ঃ কতিপয় দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতায় থাকার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে একে ব্যবহার করতে চান। তাদের মূল বক্তব্য হল, “আমি এবং আমার দল ক্ষমতায় না থাকলে দেশ আফগানিস্থান, পাকিস্থান হয়ে যাবে অথবা আল কায়েদার ঘাঁটি হয়ে যাবে”। এ প্রপোজিশন নিয়ে খেলায় অংশ গ্রহণ করেছেন লিবিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি । তার খেলা শেষ। এখনো খেলে যাচ্ছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। তবে এ খেলা মনে হয় সহজে শেষ হবেনা। প্রফেসর ড. তারিক রমাদানের মত আমিও বিশ্বাস করি এ খেলা শেষ না হওয়ার ব্যপারে দুই পক্ষের মধ্যে (এক পক্ষে আমেরকা, অন্য পক্ষে রাশিয়া এবং চীন) ঐক্য আছে। এছাড়াও এখানে অন্য রিজিওনাল প্লেয়াররাও জড়িত আছে যারা নিজেদের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায় খেলছে। যেমন- ইরান, তুরস্ক, কাতার, ও সৌদি আরব।

যাই হোক, এটা হল ভূমিকা। এবার আসি আসল কথায়।  সম্প্রতি আইমান আল জাওয়াহিরি’র ভিডিও টেপ বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ার প্রকাশিত হয়েছে। এটি দেখিয়ে শেখ হাসিনা চার নম্বর গ্রুপে যোগ দিবেন দিবেন করছেন। যারা এ খবরে অবাক হয়েছেন, আসলে তাদের অবাক হওয়া দেখে আমি অবাক হয়েছি। আমার কাছে এর কারণ খুব পরিস্কার। যারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে তারা চিরকাল বেঁচে থাকবে না। এর মধ্যেই এক জনের ফাঁসি হয়েছে, একজন জেলে মারা গেছে। সম্ভাবনার বিচারে বাকিদেরও ফাঁসি হওয়ার কথা, একজাক্টলি কি হবে আল্লাহই জানেন। ফাঁসি না হলেও এরা সবাই বয়স্ক। ৮/১০ বছরের মধ্যেই অনেকে স্বাভাবিকভাবেই মারা যাবেন। অতপর এ খেলা শেষ। এরপর কি হবে ?

খেলার নিয়ম অনুসারে এরপর অন্য কোন ইস্যু আসার কথা।  ইসলামিক টেররিজম কিংবা আঞ্চলিক নিরাপত্তা একটা ভাল ইস্যু।  বাজারে এর চাহিদা আছে।  তাই একে সামনে ঠেলে দিতে হবে। এ কাজ করবে কে ? উত্তর সহজ। প্রচারের প্রধান ভূমিকায় থাকবে এই দেশের ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ অর্থাৎ দেশি নিউকনিয়ান সেপাইদের প্রমোশনাল ভেহিকল ‘প্রথম আলো’ ।  ‘নিউইয়র্ক টাইমস এবং ‘প্রথম আলো’ এর মধ্যে সমন্বয় করার কাজটি করবেন মাহফুজ আনাম এবং তার মেয়ে বিশিষ্ট ‘ফিকশন লেখিকা’ তাহমিমা আনাম। ভারতের ‘আনন্দবাজার’ ও থাকবে এ দলে । এ ছাড়াও এ দেশ থেকে থিঙ্ক  ট্যাঙ্কে থাকবেন আবুল বারাকাত, শাহরিয়ার কবির,মুন্তাসির মামুন, সজীব ওয়াজেদ জয়, দীপু মনি ও গওহর রিজভী। এরা প্রমিনেন্ট প্লেয়ার, অনেকে থাকবেন পর্দার আড়ালে।

তবে এ খেলায় সরাসরি আমেরিকা নামবে না। বাংলাদেশের এ গোষ্ঠী চাইলেও না। কেননা ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করার মত যথেষ্ট তেল সম্পদ বাংলাদেশে নেই। আমেরিকা চায় বাংলাদেশ মোটামুটি  স্থিতিশীল থাক। তাই তারা সবাইকে  রাজনীতিতে ইনক্লুড করার কথা বলে। এমনকি জামায়াতকেও। এতে সব দলকে একজিস্টিং ফ্রেমওয়ার্কে আনা যাবে যাতে অবস্থা স্থিতিশীল থাকবে।

তবে এখানে আছে লোকাল ভেন্ডর ভারত যাদের এ হিসেবে একটু আপত্তি আছে । ফলে দরকষাকষির মাধ্যমে যেটাতে মার্কেটে ইকুইলিব্রিয়াম এসেছে সেটা হল, আমেরিকা খেলাটা মনিটর করবে। কিন্তু সেটা রিজিওনাল এলাই হিসেবে গ্রেটার ইন্টারেস্টের কথা চিন্তা করে আউটসোর্স করে দিবে ভারতকে। ভারতের এখানে বহুমুখী লাভ আছে। যেমন- আসাম সহ অন্যান্য অস্থিতিশীল অংশগুলোতে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা, বাংলাদেশের উপর দিয়ে অবাদে বিনা খরচে পণ্য পরবিবহন, নামে মাত্র মূল্যে বন্দর ব্যবহার করা, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা নিয়ন্ত্রন করা ইত্যাদি। সর্বোপরি, বাংলাদেশ যদি ভারতের একটি স্থিতিশীল অঙ্গরাজ্য হিসেবে কাজ করে তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।
এটা করতে হলে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় থাকতে হবে যে কোন মূল্যে। এর জেন্য দরকার লং এবং শর্ট টার্ম প্ল্যান। শর্ট টার্ম পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আওয়ামীলীগ এবার ক্ষমতায় এসেছে, এতে আনপ্রেসিডেন্টেড সমর্থন দিয়েছে ভারত। ফলাফল হিসেবে ভারত প্রতিদানও পেয়েছে একেবারে হাতে নাতে। উলফা কে আর্মস সরবরাহ এর অভিযোগে অভিযুক্তদের ফাঁসি হয়েছে। এরপর, লংটার্ম পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এসেছে এ নতুন প্রপোজিশন। ৩ মাসের পুরনো ভিডিও টেপ নিয়ে মাতামাতির ব্যপারটি আমি এভাবেই দেখি।

তবে এ খেলার আরেকটি মজার দিক আছে যেটি সাধারণত চার নম্বর ক্যটাগরির লোকেরা আগে থেকে বুঝতে পারেনা, অন্তত এখনো পর্যন্ত কেউ পারে নি।  যারাই এ খেলায় অংশগ্রহন করে দেশের জনগণের সাথে “আল-কায়দা আল-কায়দা” খেলেছেন তাদের পরিণতি খুব একটা সুখকর হয়নি। উধাহরণ- গাদ্দাফি, পারভেজ মোশাররফ। এদেরকে ব্যবহার শেষে যথাস্থানে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে ঠিক যেমন মীর জাফর কে ছুঁড়ে ফেলেছিল ইংরেজরা।

ইতিহাস বলে থেকে মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। শিক্ষা না নেওয়ার পেছনে যুক্তি দেখায়- দিজ টাইম ইট ইজ কোয়াইট ডিফরেন্ট। লেটস সি হোয়াট হেপেন্স দিস টাইম !

একজন ইরাক ফেরত মার্কিন সৈনিকের গল্প…Capitalism & Dark Side Of the Moon!!!

1
প্রকৃতিতে এখন পরিবর্তনের পালা। ফুলে ফলে ভরে গেছে চারদিক। সাথে বসন্তের মৃদুমন্দ সমীরণ সবকিছুতে এনে দিয়েছে কাব্যিক পরিবর্তন। শহরের প্রান্তসীমায় রাজত্ব করা সান্দিয়া পাহাড়ের চুড়গুলো হতে অমল ধবল বরফ মালাও বিদায় নিয়েছে নীরবে নিঃশব্দে। এক কথায়, শীতের খোলস হতে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বসুন্ধরা। আমেরিকার বন্য পশ্চিমে এ পরিবর্তন শুধু মনে নয়, শরীর মন দুটোই ছুঁয়ে যায়। গোটা এপ্রিল মাস ছিল আনপ্রেডিক্টেবল। সকালে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা তো দুপুরে তীব্র গরম, বিকেল নামতেই প্রচন্ড ধূলি ঝড়। বাতাসের প্রচণ্ডতা এখানে এতটাই হিংস্র হাইওয়ে ধরে গাড়ি চালালে মনে হবে উড়ছে আমার গাড়ি। মে মাসের শুরুটাও ছিল একই রকম। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে বিজ্ঞজনেরা বহুমুখী তত্ত্ব ঝারলেও এসব নিয়ে নির্বিকার শহরের মুল বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানরা। প্রকৃতি ও মনুষ্য সৃস্টি হিংস্রতার সাথে লড়াই করেই বেড়ে উঠে তাদের জীবন, যার ছোয়া পাওয়া যায় তাদের সবকিছুতে; চেহারায়, কথায়, কাজে ও চলাফেরায়। এপাচি, সান ফেলিপে, জিয়া, সান্দিয়া, এসব পুয়েবলোগুলোতে গেলে হঠাৎ করেই মনে হবে মধ্য আমেরিকার কোথাও আছি আমরা। দারিদ্র্য, অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে উঠা রেড ইন্ডিয়ানদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মূলধারার আমেরিকানদের তুলনা করলে কষ্ট লাগবে, দুঃখ লাগবে এদের জন্যে। কারণ দেশটা তাদের, এরাই আমেরিকার আসল মালিক।

জুন মাস সামনে। কর্পোরেট দুনিয়ায় জুন মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। কোয়ার্টার ও হাফ-ইয়ারলী প্রফিট & লসের হিসাব কষার মাস এটা। এ নিয়ে অফিসে এখন মহামারির মত ব্যস্ততা। বসের অনুরোধে শনিবারও কাজে আসতে হল আমার। মার অসুখের কারণে গৃহিণী একদিনের নোটিশে তার নিজ দেশে চলে গেছে। সুবিশাল দালানের পাঁচতলার সবটা জুড়ে আমাদের অফিস। একদল প্রকৌশলী এখানে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে যন্ত্রের মত। হাল্কা পায়ের আওয়াজ ছাড়া বিশেষ কোন শব্দ হয়না। শনিবারের ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম। দু’একজন যারা কাজে আসে তাদের পরনে থাকে ’বিপজ্জনক’ খোলামেলা পোশাক, মুখে রাজ্যের গল্প, আর গোটা ফ্লোর জুড় গানের আওয়াজ। পরিবেশটাই অন্যরকম। জানালার বাইরে সান্দিয়া পাহাড়ের চূঁড়াগুলোকেও অন্যরকম মনে হয় এদিন। আমাকে ছাড়া কেবল অন্য একজন হাজির হল এ যাত্রায়। জন এডামস, আমার কলিগ হলেও এ লাইনে সে কাজ করছে অনেকদিন।

নিজের প্রফেশন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফেলে টেলেকমউনিকেশন লাইনের প্রথম চাকরিটা নিয়ে যেদিন এ অফিসটায় পা রাখি পুঁজি ছিল সিলিকন ভ্যালিতে নেয়া তিন সপ্তাহের একটা ট্রেনিং মাত্র। তাই ছয় ফিগার বেতনের চাকরিটা ধরে রাখতে পারবো কিনা এ নিয়ে মনে ছিল যথেষ্ট সন্দেহ। কিন্তু জন এডামসের কারণে সে সন্দেহ দূর হতে খুব একটা সময় লাগেনি। সাদা চামড়ার এমন একজন ভাল মানুষের সাথে আগে কখনো পরিচয় হয়েছিল কিনা চাইলেও মনে করতে পারিনা। বলতে গেলে নিজ হাতের নিবিড় ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছে আমার মত বেশ কজনকে। অফিসে তাকে বলা হয় মানুষ তৈরীর কারিগর। আসলেই বোধহয় তাই। অস্বাভাবিক অমায়িক এবং কথা বলে খুব নীচু স্বরে। আমাদের লাইনে এমন কোন সমস্যা নেই যার সমাধা ওর জানা নেই। ওর একটা টেকনিক্যাল খেতাব আছে, ভার্চুয়্যাল ল্যাব! এ নিয়ে অফিসে হাসি ঠাট্টারও অভাব নেই। এক কথায়, অন্য দশটা কর্পোরেট জীবনের মত আমাদের জীবনও এখানে বেড়ে উঠে ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। প্রায় ঘন্টা দশের মত কাজ করার পর মনে হল আমি ক্লান্ত এবং এক্ষুণি ঘরে ফিরতে হবে। জনকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমার সিদ্ধান্ত। উত্তরে জানাল সেও বের হচ্ছে আমার সাথে।

এলিভেটরে দেখা হল তার সাথে। প্রস্তাবটা আমিই দিলাম। ফোর্থ স্ট্রিটের কোনায় চমৎকার একটা পাব আছে, স্বল্প বসনা রমণীদের সার্ভিসে বিয়ার পান ওখানটায় সবসময়ই উপাদেয় অভিজ্ঞতা। এর আগেও দু’একবার কাজের শেষে দলবেঁধে আড্ডা দিয়েছি পাবটায়। জন রাজি হয়ে গেল। দুজনের জন্যে দু পাইন্ট ড্রাফট বিয়ার সাথে মেক্সিকান চিলি ও গোটা বিশেক ঝাল চিকেন উইং অর্ডার দিয়ে ভুলে যেতে চাইলাম কাজের ক্লান্তি। ব্যাক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা সাধারণত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি অফিসে। জনকে অনেকদিন ধরে জানলেও তার নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানা ছিলনা। ভাবছিলাম এ নিয়ে কথা বলি তার সাথে। আমাকে তা করতে হল না, জন নিজেই তার সূত্রপাত করলো। ’তুমি কি জান চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি? এবং আগস্টই হবে আমার শেষ মাস।’ ভূমিকম্প হলেও এতটা চমকে উঠতাম না। প্রশ্ন না করে তাকেই বলতে দিলাম নিজের কাহিনি। অদ্ভুত সব কাহিনি বলে গেল সে। আমি শুধু হা হয়ে গিলে গেলাম। ডাক্তারের নির্দেশে চাকরী ছাড়ছে সে। ডাক্তারী ভাষায় ’পোস্ট ওয়্যার ট্রমাটিক সিনড্রোম’ রোগে আক্রান্ত সে, এবং কাজের লোড না কমালে নার্ভাস ব্রেকডাউনে চলে যেতে পারে যে কোন সময়। আমি জানতাম জন ইরাক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এ যুদ্ধের কোন স্থায়ী এফেক্ট তার মধ্যে বাসা বেধে আছে বলে কখনো মনে হয়নি। কথা প্রসংগে জানা গেল অফিসের লিওনার্ড, জেফ্রি, এরিক ও ডোনাল্ড‌ ওরা সবাই তার সাথে একই প্লাটুনে যুদ্ধ করেছে ইরাকে।

কম্যুনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে লজিস্টিক সাপোর্ট দেয়াই ছিল তাদের মুল কাজ। কিন্তু সব বদলে দেয় ইরাকের মসুল নগরীতে এক রাতের ঘটনা। আই ই ডির (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) শিকার হয়ে প্রাণ হারায় তাদের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু। ঘটনার পর হতেই শুরু হয় মানসিক বিপর্যয়। যদিও এগুলো তাদের দায়িত্বের ভেতর ছিলনা তবু তারা জড়িয়ে পরে হত্যা, গুম আর নির্যাতনের মত পশুসুলভ কাজে। এমন কি শিশু কিশোরদেরও নাকি রেহাই দেওয়া হয়নি ঐ রাতে। এক কথায় প্রতিশোধের পশুত্ব স্থায়ী আসন করে নেয় তাদের রক্তে। এর প্রতিফলন ঘটতে থাকে দৈনন্দিন কাজে। তাদের পাঁচ জনকেই অসময়ে দেশে ফেরৎ পাঠনো হয় এবং বলা হয় পশ্চিমের এ অঞ্চলের বড় একটা কোম্পানীর সাথে যোগাযোগ করতে। সে সূত্রেই পাঁচ জনের সবাই চাকরী পায় এ কোম্পানিতে। এত সূযোগ থাকতে আর্মি কোরে কেন যোগ দিল এর উত্তরে জন জানাল আরও হূদয়বিদারক কাহিনি। ছোট হতেই মা-বাবা বহু বিয়ের নদীতে ভেসে কোন বন্দরে ঠাঁই নিয়েছে তা কেউ জানতো না। মানুষ হয় দাদা-দাদীর কাছে। ড্রাগ, অ্যালকোহল আর নারীর সহচর্যে আর দশটা বখে যাওয়া আমেরিকান যুবকের মতই বেড়ে উঠে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অষ্টিন শহরে। দাদা-দাদি আর কিছু না পারুক জোর করে কলেজে পাঠিয়েছিল তাকে। লেখাপড়া শেষে বিরাট অংকের দেনা কাধে নিয়ে ফিরে যায় দাদাবাড়িতে। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়, বিশেষ করে আর্থিক ভাবে। এমন প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীতে যোগদান ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। স্টুডেন্ট লোনের অনেকটাই বহন করে নেয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এবং ইরাক ডেপ্লয়মেন্ট সুযোগ এনে দেয় বেশ কিছু অতিরিক্ত পয়সা আয়ের। এ জন্যেই নাকি তার যুদ্ধে যাত্রা। দেশপ্রেমের প্রসঙ্গ টানতে তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দিল এবং জানাল এসব নাকি তৃতীয় বিশ্বের গরিবী বাগাড়ম্বরতা। যুদ্ধের ভাল-মন্দ নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করলাম না আমি। যা বলার সেই বলে গেল। কর্পোরেট ইহুদী স্বার্থের সাথে রিপাবলিকানদের হানিমুন হতেই নাকি এ যুদ্ধের শুরু। এবং তার ভাষায়, এ যুদ্ধ চলতে থাকবে অনন্তকাল। জন জানালো, তাদের ৫ জনকে প্রায়ই কাউন্সিলিং’এ হাজির হতে হয় এবং শুনতে হয় যুদ্ধ ফেরৎ অনেক আমেরিকানের না বলা কাহিনি। গল্পের কোন ফাঁকে অর্ধ নগ্না ওয়েট্রেস বিয়ার আর খাবার দিয়ে গেল তার হুস ছিলনা। জন হঠাৎ করেই থেমে গেল এবং বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো। ‘ফুড ইজ গেটিং কোল্ড‌, লেটস স্টার্ট’। ’চিয়ার্স’ বলেই শুরু হল আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব। এ পর্বে যুদ্ধের কোন ছায়া ছিলনা, ছিল বন্য আমেরিকার বন্যতায় ভরা পুরুষালী গল্প। বেলা পরে আসছিল। উঠতে হলে আমাদের। আমি দিতে চাইলেও সে মানল না। বিল দুজনে শেয়ার করে বড় ধরনের টিপস দিয়ে বেরিয়ে এলাম পাব হতে। ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নেয়ার আগে জন জানাল, যুদ্ধের আগে সে বিয়ে করেছিল এবং স্ত্রীকে ভীষন ভালবাসত। কিন্তু ইরাক হতে ফিরে আসার আগেই অন্য একজনের হাত ধরে তার নিজের মা-বাবার মতই ভালবাসার নদীতে নাও ভাসিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায় তার স্ত্রী।

ফোর্থ ষ্ট্রীটের পাব হতে আমার বাসা পাঁচ ব্লক হেটে যাওয়ার রাস্তা। আমাদের অফিসটা ফিফথ ষ্ট্রীটে। প্রতিদিন চার পাঁচ ব্লক হেটে অফিসে আসা যাওয়ার ভেতর অন্যরকম একটা মাধুর্য আছে। দারুন উপভোগ করি সকালের ডাউনটাউন। ফিকে হয়ে আসা সূর্যটার তেজও নেতিয়ে গেছে ততক্ষণে। পাশের ক্যাথলিক চার্চ হতে ভেসে আসা সন্ধ্যা ছয়টার ঘন্টা জানিয়ে দিল এবার ঘরে ফেরার পালা। হাতের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্রতিদিনের মত রওয়ানা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে।

ফোর্থ স্ট্রীট আর সেন্ট্রালের কোণাই ওদের বাড়িঘর। অফিশিয়ালি ওরা হোমলেস। আন-অফিশিয়ালি রেড ইন্ডিয়ান, এবং মার্কিন মুলুকের আসল মালিক। প্রতিদিন একই রাস্তা মাড়ানোর কারণে একজন আরেক জনকে ভাল করেই চিনি। দেখলেই লম্বা একটা সালাম দেয় এবং হাত বাড়িয়ে দেয় কিছু সাহায্যের আশায়। অফুরন্ত সুযোগের দেশ আমেরিকায় এ ধরনের ভিক্ষাবৃত্তি আমার কাছে এক ধরণের বিলাসিতা মনে হয়। তাই কোনোদিনই কাউকে এক পয়সা দিয়েও সাহায্য করি না। আজ কি মনে করে দুটা ডলার এগিয়ে দিলাম। কোথায় যেন দায় শোধের একটা মিহি তাগাদা অনুভব করলাম। হতে পারে বিয়ারের কারণে।