জনাব জাফর ইকবাল, আমাদের কিছু প্রশ্ন ছিল।

4

 

মাহবুব মিঠু।।

একদলীয় নির্বাচনকে বৈধতা দিতে গত ৪ তারিখে (জানুয়ারী ৪, ২০১৪) জনাব জাফর ইকবাল ‘সহিংস রাজনীতি, সংকটে দেশ- ভবিশ্যত ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে যে বক্তব্য রাখলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম আওয়ামিলীগের কোন ডাকসাঁইটে নেতা হয়তো বক্তব্য রাখছেন। নিজেকে নিরপেক্ষ দাবী করলেও ওনার ইদানিংকার সবগুলো লেখার ‍ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথাও তার ছাপ থাকে না। কেন জানি মনে হয়, সরকারকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তোলার দায়িত্ব বোধহয় সিংহভাগ জনাব জাফর ইকবালের কাঁধে চেপেছে।

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=2eba6ef37ac9b1344c9c466446d0072a&nttl=04012014253918

উক্ত সেমিনারে জনাব জাফর ইকবাল বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলেছেন।

ভাল কথা।

’জামায়াত’ বলতে উনি নিশ্চয়ই যুদ্ধপরাধী এবং রাজাকারদের সংগঠনকে বুঝিয়েছেন। জামাত কোন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সংগঠন না হলে উনি নিশ্চয়ই সঙ্গ ছাড়ার কথা বলতেন না।

সেই চেতনা থেকে একই অনুরোধ কি আপনি আওয়ামিলীগকে করতে পারবেন?

শেখ হাসিনাকে বলুন না, তার বেয়াইর সাথে আত্নীয়তা ছিন্ন করতে। তিনি তো রাজাকার এবং যুদ্ধপরাধী ছিলেন।

শেখ হাসিনাকে বলুন না, তার দলের রাজাকার, যুদ্ধপরাধী নেতাদের দল থেকে বহিস্কার করতে।

জনা্ব জাফর ইকবাল, আপনি বিএনপিকে বাইরের রাজাকার যুদ্ধপরাধীদের (জামাত শিবির) সঙ্গ ছাড়তে বলছেন। অথচ দলের ভিতরে, আত্নীয়তার সম্পর্কের ভিতরে যে রাজাকার যুদ্ধপরাধী অবস্থান করছে, সেটা নিয়ে রা নেই। আওয়ামিলীগকে সংগঠন হিসেবে রাজাকার এবং যুদ্ধপরাধী মুক্ত করতে না পারলে কিছুটা হলেও এই দলটিতেও জামাতের চরিত্র থেকে যাবে। তখন কি বলতে পারবেন জাতিকে আওয়ামিলীগেরও সঙ্গ ছাড়তে?

অবশ্য চেতনার এতো উধ্বমার্গে গমনের আগে স্যার, নিজেকে প্রশ্ন করুন, যুবক থাকা সত্ত্বেও কেন ৭১এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি? বিষয়টা ব্যাক্তিগত হলেও আপনার বর্তমান অবস্থানের জন্য এই প্রশ্নের উত্তর জানা যে কোন নাগরিকের অধিকার আছে। নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবী করে অন্যের ভূমিকার সমালোচনা করতে হলে নিজের ভূমিকাকে সবার আগে পরিস্কার করতে হয়। ৭১সালের একজন যুবক কেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হবে?  তারতো মুক্তিযোদ্ধা হবার কথা।

একই সেমিনারে উনি বলেছেন “কয়েকদিন আগে কানাডিয়ান হাইকমিশনের একজনের সাথে দেখা হলে তিনি আমার কাছে যুদ্ধপরাধের বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, জামাতে ইসলাম বিএনপির লোকদেরই শুধু বিচার করা হচ্ছে। এখানে তো আওয়ামিলীগের লোকই নাই।”

এর উত্তরে বলেছিলেন, “৭১ সালে আওয়ামিলীগই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। সঙ্গতকারণে তাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যাবার সুযোগ ছিল না”।

কথাটা অর্ধসত্য। এখানে আপনি খুবই সচেতনভাবে প্রতারণা এবং মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন।  আপনার কথায় বুঝা যায়, ৭১সালে যারা আওয়ামিলীগ করতো, এখনো শুধুমাত্র তারাই দলে আছে। নতুন কেউ এই দলে যোগ দেয়নি। তাহলে তো আওয়ামিলীগের প্রায় বিলুপ্তি হয়ে যাবার কথা ছিল।

সোজা প্রশ্ন করি। স্যার, আপনি কি বলতে চান, আওয়িামিলীগে কোন রাজাকার বা যুদ্ধপরাধী নেই? শেখ হাসিনার বেয়াই কে? মরহুমা জাহানারা ইমামের করা লিষ্টে অন্ততঃ প্রায় ৪০ জনের মতো বর্তমান আওয়ামিলীগে সক্রিয় আছে এমন রাজাকার এবং যুদ্ধপরাধীর নাম আছে। গতবারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর নাম ভুলে গেলেন?

সাজেদা চৌধুরী কে ছিলেন?

মহিউদ্দিন খান আলমগীর সম্পর্কে স্বয়ং কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, একাত্তুরে তিনি শুধু পাকিস্তানের পক্ষেই ছিলেন না, বরং পাকি সেনাদের সহায়তা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে।

তারপরেও আপনি কানাডিয়ান দূতাবাসের লোকটার সঙ্গে যে কৌশলে র আশ্রয় নিয়েছেন সেটা কি অনৈতিক নয়? আপনার যুক্তিতেই যদি ফিরে যাই, তাহলে বিএনপিতে কোন রাজাকারই থাকার কথা নয়। কারণ বিএনপির জন্মই হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের বেশ কয়েক বছর পরে।

আপনি  বিএনপি জামাতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যতোখানি স্পষ্টভাবে বলেন ঠিক ততোখানি নিরব থাকেন আওয়ামিলীগের ব্যাপারে। এই পর্যন্ত অন্ততঃ দুইটা ঘটনা পত্রিকায় এসেছে বাসে পেট্রল বোমা নিক্ষেপে আওয়ামিলীগের জড়িত থাকার বিষয়ে। এর আগে এক লেখায় বোমা মেরে বাস যাত্রীদের পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ১৮দলীয় জোটের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু যেই মাত্র প্রমাণ হোল, এই ঘটনার সাথে সরকারদলীয় লোকজন জড়িত, তারপর আশা করেছিলাম আপনি কিছু একটা লিখবেন।  সরকারীদলের গুন্ডারা হিন্দু বাড়ী মন্দিরে হামলা করল। ধরা খেয়ে তাদেরকে কসাই এবং পাগল বলে চালিয়ে দেয়া হোল।  এ বিষয়েও লেখার সময় হোল না।

জানুয়ারীর ৪ তারিখের বাঙলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার খবর ছিল, ‘নৌকায় ভোট দিলে গ্রেফতার করা হবে না’।  এই খবরে বলা হয়েছে, বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ-শরনখোলা আসনে চাইতে গিয়ে সেখানকার আওয়ামিলীগের নেতা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানার ওসি জামাত শিবিরের ক্যাডারদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তারা নৌকায় ভোট দিলে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। ওদিকে এই সেদিনও হানিফের হাত ধরে আওয়ামিলীগে জয়েন করেছেন জনৈক জামাত নেতা। তার মানে কে রাজাকার, কে যুদ্ধপরাধী সেটা তার অতীত কর্মকান্ডের চেয়ে বর্তমানে সে কতোটুকু আওয়ামিলীগার তার উপরে নির্ভর করছে!

http://www.bd-pratidin.com/2014/01/04/35977

নতুন বার্তার ২৮শে ডিসেম্বর ২০১৩, খবর ‘একটির বিনিময়ে দশটি গুলি করবে ছাত্রলীগ’। কথাটি বলেছিলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া নিত্যদিন আওয়ামিলীগের নেতা বিশেষ করে, হানিফ, কামরুল, হাছান মাহমুদ, নাসিম সাহেবরা যে সন্ত্রাসী ভাষায় কথা বলছে, তারপরেও আপনার কাছে সন্ত্রাসী কেবলমাত্র এককভাবে বিরোধীজোট!

http://www.natunbarta.com/politics/2013/12/28/61462/‘একটির+বিনিময়ে+দশটি+গুলি+করবে+ছাত্রলীগ

রাতের আঁধারে সরকারের নির্দেশে হেফাজতের কর্মীদের হত্যাকে আপনি লেখার মাধ্যমে প্রকারান্তরে সমর্থন করেছেন। অপু উকিলরা যখন আদালদের দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারে আপনি তখন নিরব থাকেন। আওয়ামি যুবলীগের কর্মীরা যখন প্রকাশ্যে বিরোধীদলীয় মহিলা আইনজীবীকে নির্মমভাবে প্রহার করে, তার স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে হাতড়ে ফেরে, তখনো আপনার কলম থেকে এক ফোটা কালি বের হয় না। মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে আদালতের দিকে ফিরে একই দলের কর্মী যখন জিপার খুলে এ্যাডাল্ট শো করে তখনো আপনি লেখার তাড়না বোধ করেন না।

এর আগে “বিষন্ন বাঙলাদেশ” নামক লেখায় নির্বাচন নিয়ে সাদা চামড়াদের হস্তক্ষেপকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এটা আমাদের সমস্ত বাঙলাদেশীদের মনের কথা। আরেকটা মনের কথা আছে যেটা  আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের বাদামী চামড়ার লোকজন যে খুবই ন্যাক্করজনভাবে আমাদের নির্বাচনসহ প্রায় প্রতিটা ব্যাপারে নাক গলিয়ে যাচ্ছে, সে কথাটা বেমালুম চেপে গেছেন।

জনাব জাফর ইকবালের কাছে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করে লেখা শেষ করব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আপনি জাতিকে কি বুঝাতে চান? এই প্রত্যয়টা সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন এই কারণে যে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দিকে ঢিল ছোঁড়া লোকজন থেকে শুরু করে সেই প্যান্টের চেইন খুলে, মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে যে ছেলেটি হাইকোর্টের দিকে ফিরে তার গোপনাঙ্গ দেখাচ্ছিল, সেও এই চেতনার কথা বলে। আপনি আমিও বলি। এই বলার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে বৈকি! সেজন্যই প্রশ্নটা করছি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিয়ে এক তরফা নির্বাচনে গিয়ে দেশকে সংঘাতের মুখে ঠেলে দেয়া? অবশ্যই না। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চেতনাই ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা এবং শোষন মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়াসহ অর্থনৈতিক শোষন থেকে মুক্তি। এবার একটু চোখ বুলিয়ে দেখা যাক, আপনি যে দলকে নানাভাবে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরীখে সেই দলের অবস্থান কোথায়! শুরু থেকেই আওয়ামিলীগ সরকার, বিরোধীদলের উপর দমন পীড়ন চালিয়ে আসছে। তাদের অনেক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীও পুলিশ এবং দলীয়  কর্মী বাহিনী দিয়ে পন্ড করা হয়েছে। মতের অমিল হলে ডঃ ইউনুস থেকে শুরু করে অনেকেই রেহাই পায়নি প্রতিহিংসা থেকে। বিরোধীদলীয় নেত্রীকে গত কয়েকদিন ধরে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নিজেদের ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন করে পুণরায় ক্ষমতায় আসার জন্য তারা পুরো জাতিকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলেছে। দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের সার্বভৌমত্ব বলতে গেলে ভারতের জিম্মায়। আমাদের নির্বাচন কেমন হবে সেটা নির্ধারণ করে দেয় তারা। অর্থনৈতিক শোষন থেকে মুক্তির ব্যাপারে যদি বলি, তাহলে এই সরকারের আমলে যে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নিতি হয়েছে তা বিগত যে কোন সরকারের আমলে করা দূর্নিতিকে ব্যাপকভাবে ছাড়িয়ে যাবে।  ঢাকা শহরের অধিকাংশ জমি আওয়ামিলীগের কতিপয় নেতার দখলে।  এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে এই দলটি স্বাধীনতার চেতনার একমাত্র ধারক বাহক হিসেবে কেন মনে হোল আপনার কাছে?

এতো কিছু জানার পরেও যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সহজলভ্য পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে নিজেকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি মনে করে তৃপ্তি নেয় তাদের উদ্দেশ্যে বলি। টকশোতে আল আমিন নামের এক শ্রোতা জনাব শাহরিয়ার কবিরকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বঙ্গবীর কাদের সিদিকী মাঝে মাঝেই আপনাকে মুরগী সাপ্লাইয়ার হিসেবে বলে থাকে, এটা কতোটুকু সত্য?” উনি কিছুটা রাগতভাবে প্রশ্নকর্তার উত্তর সুকৌশলে এড়িয়ে যান।

http://www.youtube.com/watch?v=UYIMRg6Yc6A

অতএব, যারা শাহরিয়ার কবিরকে প্রশ্ন করতে পারে না, ৭১ সালে আপনার ভূমিকা পরিস্কার নয়। আপনি কি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার নেতৃত্ব দিতে চান?

যারা জাফর ইকবালকে প্রশ্ন করতে পারে না, স্যার, ৭১ এ আপনি ছিলেন যুবক ছেলে। কেন সেদিন যুদ্ধে না গিয়ে রাজাকারের বাড়ীতে পালিয়ে ছিলেন?

যারা শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করার নৈতিক সাহস রাখে না যে, হ্যালো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভায় চিহ্নিত যুদ্ধপরাধী এবং আরো প্রায় অর্ধ ডজন রাজাকার রেখে কিভাবে প্রতিপক্ষের লোকদের ধরে শুধু বিচার করছেন?

যারা এই তিনটি প্রশ্ন করার মুরোদ রাখে না, তাদের আর যাই হোক, কোন যুদ্ধপরাধীর বিচার দাবী করার নৈতিক অধিকার নেই।

Mahalom72@msn.com