Quasicrystals, মুসলিম স্থাপত্য, এবং একটি নোবেল প্রাইজ

২০০৫ সালে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট পিটার ল্যু (Peter J. Lu) উজবেকিস্তান ভ্রমণে গিয়ে বুখারায় পঞ্চদশ শতকে নির্মিত একটি মাদ্রাসার সুদৃশ্য মোজাইকে Quasicrystal নামক জটিল জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাদৃশ্য দেখতে পান। ১৯৭০ এর দশকে আধুনিক গণিতবিদরা প্রথম এই জটিল প্যাটার্নের ধারণা দেন। পরবর্তীতে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ Paul J. Steinhardt সহ Science জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে Lu দেখান যে পাশ্চাত্যে Quasicrystal এর সঠিক গাণিতিক ধারণা আবিষ্কারের অন্তত ৫০০ বছর আগে দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে মুসলিম স্থাপত্য শিল্পে Quasicrystal প্যাটার্নের প্রায় নিখুঁত ব্যবহার ঘটে।

Quasicrystal হচ্ছে এমন একটি প্যাটার্ন যা একটি স্থানকে ভরাট করে কিন্তু True crystal এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী translational প্রতিসাম্য এতে থাকে না। দ্বিমাত্রিক ধারণায় এর অর্থ হল এই প্যাটার্নটির একটি exact copy slide করা হলে তা কখনোই exact match তৈরি করবে না, তবে প্যাটার্নটি rotate করা হলে তা exact match তৈরি করতে পারে। ১৯৭০ এর দশকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গাণিতিক Sir Roger Penrose তাঁর বিখ্যাত Penrose Tiles এর মাধ্যমে এর প্রথম গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন। এরও প্রায় এক দশক পর ১৯৮৪ সনে ইসরায়েলের Technion University এর প্রফেসর Dan Schechtman একটি সংকর ধাতুর পরমাণুর অবস্থানে quasicrystalline কাঠামো আবিষ্কার করেন, যে কাজটির জন্য (‘For the Discovery of Quasicrystals’) ২০১১ সালে তিনি কেমিস্ট্রিতে নোবেল প্রাইজ পান। এরপর থেকে প্রকৃতিতে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য quasicrystals আবিষ্কৃত হয়েছে।

Darb-i Imam Mosque Portal

২০০৭ সালে মার্কিন পদার্থবিদ Paul J. Steinhardt এবং Peter J. Lu তাঁদের গবেষণাপত্রে ১৪৫৩ সালে ইরানের ইস্পাহানে নির্মিত Darb-i Imam স্থাপনাটিতে Penrose টাইলস দ্বারা আচ্ছাদনের একটি ‘প্রায় নিখুঁত’ ব্যবহার তুলে ধরেন। এর আগে প্রচলিত ধারণা ছিল, মধ্যযুগীয় মুসলিম স্থাপত্যবিদরা সরাসরি straightedge রুলার এবং কম্পাসের সাহায্যে একটি zigzag লাইনবিশিষ্ট নেটওয়ার্ক অঙ্কনের মাধ্যমে মুসলিম স্থাপত্যে বহুল ব্যবহৃত জ্যামিতিক তারকা ও বহুভুজ সম্বলিত Girih (Persian: گره‎, ‘knot’) প্যাটার্ন তৈরি করতেন, যে পদ্ধতি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর। এ ধারণার বিপরীতে Lu এবং Steinhardt দেখান যে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে মুসলিম স্থাপত্যশিল্পে একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তিগত পদ্ধতির ব্যুৎপত্তি ঘটে যার দ্বারা কতিপয় সরল-রেখাঙ্কিত সমবাহুবিশিষ্ট বহুভুজ টাইলস বা girih tiles এর tessallation (এক বা একাধিক জ্যামিতিক আকারের টাইলস দ্বারা কোনও ফাঁক ও ওভারল্যাপ ছাড়া একটি সমতলকে আচ্ছাদন করার পদ্ধতি) এর মাধ্যমে জটিল girih প্যাটার্ন তৈরির পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছিল। পাশ্চাত্যে এর গাণিতিক ধারণা আবিষ্কারের অন্তত ৫০০ বছর আগে পঞ্চদশ শতকের ভেতরে tessallation এর সাথে self-similar transformations এর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে প্রায় নিখুঁত quasi-crystalline Penrose প্যাটার্ন তৈরির পন্থা উদ্ভাবিত হয়। Darb-i-Imam Shrine এ ব্যবহৃত ৩৭০০ টাইলের মধ্যে শুধুমাত্র ১১টি টাইলে্র অভিযোজনে Lu এবং Steinhardt সূক্ষ্ম ত্রুটি দেখতে পান, কেবল ওরিয়েন্টেশনের সামান্য পরিবর্তনেই যা নিখুঁত quasi-crystalline Penrose প্যাটার্ন তৈরি করে, যা কাকতালীয় হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নির্মানকালীন সময়ে অথবা পরবর্তীকালে মেরামতের সময় এই সামান্য সংখ্যক ভুল সংযোজিত হয় বলে Lu ধারণা করেন।

Gunbad-i Kabud

২০০৯ সালে physics world এ প্রকাশিত খবরে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের Texas Tech University এর স্থাপত্য বিশারদ Rima Ajlouni মুসলিম স্থাপত্যে quasicrystal প্যাটার্নের অন্ততঃ তিনটি নিখুঁত এবং নির্ভুল ব্যবহার খুঁজে পেয়েছেন। প্রথমটি সেলজুক স্থাপত্যে বহুল ব্যবহৃত একটি প্যাটার্ন, ইস্পাহানের Darb-i-Imam shrine এ যার সুনির্দিষ্ট ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় প্যাটার্নটি মরক্কোর ফেজ(Fez) নগরীতে ১৩২৩ সালে নির্মিত Madrasa al-‘Attarin এর ভেতরে দেয়ালে, এবং তৃতীয় নিখুঁত প্যাটার্নটি ১১৯৭ সালে ইরানের Maragha তে নির্মিত Gunbad-I Kabud টাওয়ারের বাইরের দেয়ালে খুঁজে পাওয়া যায়।


হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট মিউজিয়ামের ডিরেক্টর Tom Lentz এর ভাষ্যে,”কলা বিশারদরা বহু আগে থেকেই মুসলিম স্থাপত্যে জ্যামিতিক প্যাটার্নের পেছনে গণিতের জটিল ব্যবহার রয়েছে বলে ধারণা পোষণ করেছেন, কিন্তু এর চুলচেরা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এর আগে কখনও হয়নি।” সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। মুসলিম স্থাপত্যে জটিল জ্যামিতিক নকশা ও প্যাটার্নের কম্পিউটার মডেলিং এর উপরেও কাজ করছেন অনেকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে দেখুন –

1. Ancient Islamic architects created perfect quasicrystals – physicsworld.com
2. The Tiles of Infinity
3. Lu, Peter J.; Steinhardt, Paul J. (2007). Decagonal and Quasi-crystalline Tilings in Medieval Islamic Architecture. Science 315 (5815)
4. Quasicrystals in Medieval Islamic Architecture, Harvard Physics Colloquium Lecture

http://spacetimefactorbangla.wordpress.com/

আলহামব্রা – ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী

2

By শঙ্খচিলের ডানা :

“Rising up above the Red Hill, the royal city of the Alhambra stands proud and eternal, one of the most important architectural structures of the Middle Ages and the finest example of Islamic art left to us in the western world.”

“একগুচ্ছ পান্নার মাঝে যেন একটি মুক্তা” – মুরিশ কবিরা এমনভাবেই বর্ণনা করেছেন আলহামব্রার সৌন্দর্য! স্পেনের মুসলিম সভ্যতা ও স্থাপত্যের শীর্ষ আকর্ষণ গ্রানাডার আলহামব্রা প্রাসাদ ও দুর্গ। নবম শতকে দক্ষিণ স্পেনের সাবিকা পাহাড়ের (Assabika hills) ওপর নির্মিত একটি দুর্গের ভিত্তির ওপর একাদশ শতাব্দীতে আলহামব্রা দুর্গ-প্রাসাদের পত্তন ঘটান স্পেনের শেষ মুসলিম শাসকগোষ্ঠী নাসরিদ বংশের মোহাম্মদ বিন আল আহমার এবং এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন চলে পরবর্তী দেড়শ বছর। সমসাময়িক বাইজেন্টাইন এবং আব্বাসীয় মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব ছাড়াও আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় সুদীর্ঘ আটশ বছরের মুসলিম স্থাপত্যের পরম্পরা এবং নিজস্ব শৈল্পিক উদ্ভাবনার মিশেল ঘটিয়ে তৈরি হয় স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত বিশেষ ধরণের লাল মাটিতে নির্মিত দুর্গ-প্রাসাদ ‘আলহামব্রা’ যার নামের আক্ষরিক অর্থ The Red.

আলহামব্রার স্থাপত্যশৈলী ও অলঙ্করণে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে অশ্বখুরাকৃতির খিলান (Calliphal horseshoe arch), জটিল রম্বস আকৃতির আলমোহাদ সেবকা (the Almohad sebka – a grid of rhombuses), আলমোরাভিদ পাম (the Almoravid palm), এবং ত্রিমাত্রিক মুকারনাস ( Muqarnas – stalactite ceiling decorations).

Portico and Pool

The Court of the Lions

Decoration of the Court of the Lions

The Hall of the Ambassadors – a mirador with elaborately ornate walls and ceiling

ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যস্বরূপ আলহামব্রাতে খুঁজে পাওয়া যায় জান্নাতের বর্ণনা অনুযায়ী সৌন্দর্য ও শান্তিবর্ধক রূপে চলমান পানি ও ফোয়ারা, আলো-ছায়া, এবং পত্রপুষ্প-শোভিত বাগানের নয়নাভিরাম ব্যবহার –

The Court of the Water Channel

Sultana’s Garden

আলহামব্রার স্থাপত্যশৈলীতে অলংকার হিসেবে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ত্রিমাত্রিক মুকারনাস (Muqarnas – honeycombed stalactite ceiling decorations) যা দশম শতাব্দীতে পারস্য এবং নর্থ আফ্রিকায় প্রায় একইসাথে উদ্ভাবিত মুসলিম স্থাপত্যকলার অনন্য সংযোজন –

Use of Muqarnus in the Hall of the Abencerrajes

Use of Muqarnus in the Alhambra

Arabesque around the windows

ইসলামি স্থাপত্যের অনবদ্য নিদর্শনস্বরূপ আলহামব্রায় খুঁজে পাওয়া যায় জ্যামিতিক নকশা ও ক্যালিগ্রাফির জটিল ব্যবহার। কেবল একটি বিশেষ স্তবকই আলহামব্রার স্থাপত্যে উৎকীর্ণ হয়েছে ৯০০০ বার – لا غالبَ إلا الله (La ghaliba illa Allah – ‘There is no Conquerer but Allah’)

Wa la ghaliba illa Allah – calligraphy on the walls of Alhambra

কেবল নয়নাভিরাম অলঙ্করণই নয়, দুর্গ-প্রাসাদের নিরাপত্তা রক্ষায় ১৩টি ওয়াচ টাওয়ারসহ শক্ত প্রাচীরে ঘেরা আলহামব্রায় গড়ে তোলা হয়েছিল বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পাহাড়ের উপরে নির্মিত আলহামব্রা কমপ্লেক্সে পার্শ্ববর্তী ডারো নদীর (the river Darro) পানি কি ভাবে নদীর উৎসে বাঁধ দিয়ে পাহাড়ের ভেতরে সুড়ঙ্গ কেটে কৃত্রিম প্রণালী ও জলাধার নির্মাণ ও জলশোধন-ব্যবস্থা সহযোগে বহুদুর টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা আজও বিস্ময় জাগায়!

১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলার হাতে গ্রানাডার পতনের সাথে সমাপ্তি ঘটে আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় সুদীর্ঘ আটশ বছরের মুসলিম সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের। আগ্রাসী রিকনকিস্তার (Reconquista) জন্য গ্রানাডা ছিল একটি অনন্য বিজয় – বিপুল ধন-সম্পদ ছাড়াও পুরো ইউরোপে মুসলিম স্থাপত্যের শিরোমণি হিসেবে বিবেচিত আলহামব্রা প্রাসাদ তাদের কুক্ষিগত হয়। পরবর্তীকালে আলহামব্রা প্রাসাদ বারবার লুন্ঠিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং কালক্রমে পরিত্যক্ত হয়। দুর্গ-প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ ধ্বংস করে অপরিকল্পিত ও বেমানানভাবে গড়ে তোলা হয় অন্যান্য স্থাপত্যকর্ম – যেমন ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত পঞ্চম চার্লস (Charles V) এর প্রাসাদ। রেনেসাঁযুগীয় স্থাপত্যশৈলীসহ শক্তিশালী উপস্থিতি প্রমাণ করলেও লাস্যময়ী আলহামব্রা প্রাসাদের তুলনায় তা প্রাণহীন, শীতল, জগদ্দল পাথরসম। অবশেষে উনবিংশ শতকে ইউরোপীয় পরিব্রাজক এবং পন্ডিত ব্যক্তিদের উৎসাহে আলহামব্রা দুর্গ-প্রাসাদের পুনরুদ্ধারকাজ শুরু হয়। অধুনা আলহামব্রা স্পেনের সবচাইতে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন গুলোর একটি। তিলোত্তমা আলহামব্রা এখন একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট – যুগেযুগে অসংখ্য গল্প, কবিতা, ও গানের অনুপ্রেরণা!

The Palace of Charles V in the Alhambra

আলহামব্রার ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী সম্পর্কে আরও বিশদ ভাবে জানতে চাইলে দেখুন –