এলিট ফোর্স এবং দ্রুত বিচার আদালত, এই দুয়ের কার্যকর ফাংশন

1

 

by Faiz Taiyeb
সন্ত্রাস নির্মূলে এলিট ফোর্স র‍্যাব কে অপ্রাতিষ্ঠানিক দমনকারী হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিল। বিচার বহির্ভূত হত্যা দিয়ে শুরু হলেও, সেই সময় মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা এতটাই নাজুক ছিল যে দেশের নাগরিক এবং দেশে অবস্থানরত ভিনদেশী সবাই এই এলিট ফোর্স এর কর্মকাণ্ড কে স্বাগত জানিয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে আমরা অতি উতফুল্ল ছিলাম। অন্যতম একটা উদাহরণ ছিল পিচ্ছি হান্নান কিংবা নাঃগঞ্জের যুবদল নেতা ডেভিড হত্যা। রাজপথে পড়ে থাকা ডেভিডের লাশ নগর জীবনে স্বস্তি এলে দিয়েছিল। এই অসামান্য ঘটনা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার অতি অতি নিচু মাত্রা নির্দেশনে ব্যাপক তাৎপর্য মন্ডিত। আজ এত বছর পরে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়েনি তো বেটেই বরং অতি শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন ঘরে ঘরে গুম, অপহরন আতংক।
কিন্তু উচত ছিল র‍্যাব প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই আমাদের আদালতের বিচারকি সক্ষমতা কে বড়িয়ে অতি দ্রুত র‍্যাবকে কে সহায়ক ফোর্স হিসবে একটি দক্ষতায় ভরা চৌকশ পুলিশ বাহিনীতে রূপান্তর করা, যারা অপরাধী ধরার ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতাকে ঢেকে দেবে। এরা পুলিশ কে চৌকশ হতে প্রশিক্ষণ দিবে। হয়তবা এই লক্ষে একই সময়ে একটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছিল, যাদেরকে ৯০ দিনের মধ্যে বিচার বন্দোবস্তের কথা বলা হয়েছিল। এই ট্রাইবুনাল শুরু করেছিল খুবি ভাল ভাবে। দরকার ছিল র‍্যাব শুধু মাত্র এই দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল সম্পর্কিত মামলার তদন্ত, অপরাধী ধরা, চার্জশীট তৈরী ইত্যাদি কাজে দ্রুততা নিশ্চিত করবে। এটা না করে র‍্যাবকে দেয়া হোল মিছিল ঠেকানো, ময়লার গাড়ীতে ঢিল মারার আসামী ধরার, অবরোধে ঢাকার গেট, অর্থাৎ ক্ষমতা পাহারা দেয়ার রাজনৈতিক প্রকল্পে। পাল্লা দিয়ে বাড়লো বিরোধী দমনের ক্রসফায়ার। এটা এখন বিএনপি জামাত দমনের কার্যকর মেশিন। তাই তারা র‍্যাব এর বিলোপ চাচ্ছে। সেই সাথে আধুনা যুক্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন দের বিবাদমান পক্ষ প্রতিপক্ষের নির্ভুলে র‍্যাবের সহায়ক হয়ে উঠা।
এলিট ফোর্স নিয়ে আমাদের চাওয়া সরকার আর বিরোধীদের চেয়ে ভিন্ন।
কিন্তু আমরা চাচ্ছি, একটি দ্রুত বিচার আদালত থাকবে যারা নাগরিকের চাহিদামত ৯০ দিন বা এরও কম সময়ের মধ্যে সুবিচার নিশ্চিত করবে। এর তদন্ত কাজ, অপরাধী ধরা, চার্জশীট তৈরি ইত্যাদি কাজে র‍্যাব এর মত একটি চৌকশ প্যারা মিলিটারি থাকবে যারা পুলিশ কে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিবে, সময় ক্ষেপণ, দলীয় বাধা, আম্লাতান্ত্রিক জটিলতা, ক্ষমতাসীন আর পদধারী দের অনিয়ম আর ঘুষ বাণিজ্য ঠেকিয়ে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করনে ট্রাইবুনাল কে সার্বক্ষণিক সহায়তা করবে।
এছাড়া সরকার এ রয়েছে নাগরিক শান্তি স্থাপনে চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রুত নিস্পত্তির প্রয়োজনীয়তা, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান গুলোর রয়েছে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে অযাচিত বাধা হটানোর প্রয়োজনীয়তা। সুতরাং এই সময়ে আমাদের এলিট ফোর্স দরকার। কারন আমাদের সমাজ প্রবলভাবে অপরাধ প্রবন।
এর বাইরেও রয়েছে নাগরিক কে যে কোন ধরনের সাপোর্ট দেয়ার কাজ, যেটা অপরাধ সম্পর্কিত নাও হতে পারে। এটা পুলিশের সোশাল রিস্পন্সিবিলিটি এবং সেন্স অফ সার্ভিস (সেবা) কে উন্নততর এবং মানবিক করতে ভূমিকা রাখবে।
আমরা বলছি, এলিট ফোর্স এবং দ্রুত বিচার আদালত এর এই দুয়ের কার্যকর ফাংশনে নিন্ম আদালত এবং পুলিশ চ্যালেঞ্জ এ পড়বে। অন্যভাবে বলা যায় পরিকল্পত ভাবে দুর্নীতি গ্রস্ত আদালত এবং পুলিশ এর উপর রাষ্ট্রীয় চাপ বাড়ানো হবে। এতে নিন্ম আদালত এবং পুলিশ এর সৎ এবং দক্ষ হয়ে উঠার উপর নাগরিক চাপও বাড়বে।
তবে, যত দিন সমাজে কর্মসংস্থানের হাহাকার থাকবে, যতদিন মানসম্পন্ন এবং পেট চালানোর মত নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি না হবে তত দিন সমাজের এই অপরাধ প্রবনতা অব্যহত থাকবে। কাজ না পেয়ে নিন্ম, মধ্য এবং উচ্চ বিত্ত নিজ নিজ পরিসরে রাজনৈতিক দুরব্রিত্তায়নের হাতিয়ার হয়ে নিজেদের অপরাধে সপে দিবে। মালিকের অমানুষিক নির্যাতনে বা মারধর খেয়ে প্রান্তিক পরিবারের সেইসব শিশু শ্রমিক সেই মালিকেরই হত্যাকারীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে চাইবে। তত দিন মিছিলে ভাড়া করা লোকের অভাব হবে না, হত্যায়-গুম-খুনে ভাড়াটিয়া খুনীর অভাব হবে না। অস্তিত্বের প্রয়োজনে যে পেশা মানুষ বেছে নেয়, সে পেশায় সে অতি বেশি পারঙ্গম হয়ে উঠে। তাই আজ আমাদের ছিটকে চোররা হয়ে উঠছে নিখুঁত প্রফেশনাল কিলার।
রাষ্ট্র ব্যবস্থা কি সেই দিকে তার চিন্তা নিবিষ্ট করবে? করবে চূড়ান্ত সমাধানের বন্দোবস্ত? এলিট ফোর্স, দ্রুত বিচার আদালত এইসব তো নিতান্তই সাময়িক কথা। এটা চূড়ান্ত ভাবে সমাজ কে অপরাধ প্রবনতা থেকে বাচাবে না।
অপরাধের উৎস মূলে নিরাময় চাই।

 

প্রেক্ষিত হিজাবঃ এ কেস স্টাডি ফর দ্য গ্রোথ অব লিবারেল ফ্যনাটিসিজম

1

by Jahid Islam

বাংলাদেশের একটা শ্রেণী নিজেরদেরকে লিবারেল দাবি করে। বাস্তবে এরা ফ্যানাটিক। শুধু ফ্যানাটিক বললে কম বলা হবে। ফ্যনাটিসিজমের ১০ এর স্কেলে এদের স্কোর ৯.৯। এমাজান জঙ্গলের ‘মানুষ আকৃতির’ যেসব প্রাণী অন্য মানুষের মাংস খায় কেবল তারাই এ স্কেলে এদের চেয়ে উপরে আছে।

গড আছে নাকি নাই এটা কিন্তু নতুন কোন বিতর্ক না। এ বিতর্কের ইতিহাস অনেক পুরোনো। যারা এ তর্ক করেন আমার কাছে তাদেরকে খারাপ লাগে না। তাদের অনেকেই নিজেদের যুক্তি এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিং ব্যবহার করে কনভিন্সড হতে চান। এতে দোষের কিছু নাই। বাস্তবে এটাই আদর্শ পদ্ধতি হওয়া উচিত। যারা গডে বিশ্বাস করেন না কিন্তু রেশনালি চিন্তা করার চেষ্টা করেন এবং সে থেকে তাদের এ কনভিকশন আমি তাদেরকে রেসপেক্টও করি। এদের বেশিরভাগই নিজে গড বিশ্বাস করেন না, কিন্ত অন্যের বিশ্বাস এবং আচরণকে শ্রদ্ধা করেন। ‘গড’ বিশ্বাস করেন এমন কারও সাথে আলোচনা বা তর্ক হলে তারা নিজেদের যুক্তি দিয়ে তাদের বিশ্বাসের পেছনে কারণকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন। সমাজের ভিন্ন মতের মানুষের সাথে কোএগজিসটেন্স এ বিশ্বাস করেন। এরা আসলেই লিবারেলিজমে (প্লুরালিজম) বিশ্বাস করেন।

7bbae7bd7f30fc7e74a47780ac8bce0d

আমি যে ফ্যনাটিকদের কথা বলছি তারা অন্যের জীবন থেকে ‘গড ডিলিউশন’ দূর করতে গিয়ে নিজেরাই একটা ধর্মের জন্ম দিয়েছেন। যে ধর্মের প্রধান ডকট্রিন হল সবার জীবন থেকে গডের ধারনা দূর করা এবং সেটা যে কোন মূল্যে। প্রয়োজন হলে জোর করে। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশে তাদের প্রধান টার্গেট হল ইসলাম। বাস্তবে সমাজে যারা বিভিন্ন ধর্মে ধার্মিক হিসেবে পরিচিত এ শ্রেণী এর চেয়েও অনেক ডেডিকেটেডলি তাদের এ “গডলেস ডিলিউশন” ধর্ম পালন করেন। তারা হিজাব পরা বা পরানোকে খুব একটা পজিটিভলি দেখেন না। মনে করেন যে, হিজাব পরলে নারীদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়। এখানে আন্ডারলায়িং এসাম্পশান হল একটা বিরাট অংশকে জোর করে হিজাব পরানো হয়। যারা স্বেচ্ছায় হিজাব পরে তারাও আসলে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর লোক এবং হিজাব পরাই তাদের ইন্টেল্যাকচুয়াল ইনফেরিওরিটির প্রমাণ। তারা কেউ কেউ প্রচার করে বেড়ান যে, আরবের ১৪০০ বছর আগের গরম ‘লু হাওয়া’ থেকে বাঁচার জন্য মহিলারা হিজাব পরত। তাদের এ এসাম্পশান এবং আর্গুমেন্ট ঐতিহাসিক এবং তত্ত্বগত দিক থেকে ভুল। ইতিহাস এবং ধর্ম বিষয়ে সামান্য জ্ঞান থাকলেই এ যুক্তির অসাড়তা বোঝা যায়।

যেহেতু তারা মনে করেন যে অনেককেই জোর করে হিজাব পরানো হয় বা তারা নিজেরা কেবল হিজাব না পরার কারণেই হিজাব ব্যবহারকারীদের চেয়ে ইন্টেল্যাকচুয়ালি সুপিরিয়র, অতএব তাদের অধিকার আছে জোর করে সবার মাথা থেকে হিজাব খুলার।
জোর করে হিজাব পরানোর ঘটনা যে অল্প কিছু ঘটতে পারে সেটা মানছি। এ শ্রেণী কিন্তু তাদেরকে bullying করে না। তাদের ফিল্ড অফ ইন্টারেস্ট হল স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষিত শ্রেণীর মেয়েরা যাদের প্রায় সবাই স্বেচ্ছায়,কনশাসলি হিজাব পরে এবং এটাকে ধর্মীয় অনুশাসন মনে করে। জোর করে কাউকে হিজাব পরানো যদি ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়, জোর করে হিজাব খোলানো বা bullying যে সেটারই মিরর ইমেজ এ বাস্তবতা তাদের স্থূল মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না। আরও মজার ব্যপার হল, এদের কেউ কেউ টিভি টকশোতে এসে ইসলামকে এ দেশে মাইনরিটির ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করে। অথচ এ দেশের বেশির ভাগ লোক যে মুসলিম এ ফ্যাক্ট ক্লাস ৪ এর একটা বাচ্চাও জানে। দেখলে মনে হয় যেন কোন একটা ধর্ম মাইনরিটির ধর্ম হলে সে ধর্মের উপর মেজরিটির রিলিজিয়াস ডকট্রিন চাপিয়ে দেয়া বিশেষ পুণ্যের কাজ। মাইনরিটি হিসেবে মনে করার এ কাজটা যদি আসলেই তারা তাদের কনভিকশন থেকে করে থাকেন সে ক্ষেত্রে অবশ্য এদেরকে মানসিক রোগী হিসেবে ট্রিট করতে হবে।

এদের আরেকটি প্রধান ট্রেড মার্ক হল কিছু দিন পর পর তারা ‘বাঙ্গালী না মুসলমান’ এ অর্থহীন বিতর্ক উসকে দেয়। ভাবটা এমন যে কেবল তাদের কাছেই এর একটি অবজেক্টিভ উত্তর আছে। এ মিনিংলেস বিতর্ক চাঙ্গা করাকেই তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সবচেয়ে বড় উৎকর্ষতা মনে করে। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এটা অবশ্য জীবিকা। সে ক্ষেত্রে এটা বোধগম্য। প্রকৃতপক্ষে, অল্প কিছু Schizophrenia আক্রান্ত লোক যারা মাথায় বড় লাল টিপ দেয়া, স্লিভলেস ব্লাউজ পড়া এবং শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারাকেই বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতার অন্যতম প্যারামিটার হিসেবে মনে করেন এবং আসমানি গ্রন্থের বয়ানের মত বিশ্বাস সহকারে ’৭১ টিভি’ দেখেন তারা ছাড়া এ শ্রেণীর কার্যকলাপ অন্যদের কাছে মনে হয় অর্থহীন ফ্যনাটিসিজম। এ শ্রেণীর সুডো লিবারেলদের প্রগলভতা অল্প সময়ের সাময়িক উন্মাদনার জন্ম দেয় মাত্র। আদতে এরা লিবারেল আদর্শ প্রতিষ্ঠা ত দূরের কথা, লিবারেলিজম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে।

যে কোন আদর্শের অনুসারিদের মনের খায়েশ থাকতেই পারে যে তাদের অনুসৃত আদর্শ বিজয়ী হবে। সে ক্ষেত্রে নিজেদের আদর্শ প্রচারের জন্য তাদের প্রথম কাজ হবে তারা যে সমাজে এ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় সে সমাজের বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করা এবং পটেনশিয়াল ফলোয়ারদের মন-মগজ ও রুচির বাস্তবতা অনুধাবন করা। এরপর নিজেদের মডেলকে সে সমাজের বাস্তবতা অনুসারে এডজাস্ট করা। এছাড়া অন্য কিছু করে যারা কেবলি নিজেদের কনভিকশন অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায় (সেটা তাদের কাছে যত শুদ্ধই হোক) তারা সে আদর্শ সম্পর্কে একটা পাবলিক ফোবিয়া তৈরি করে মাত্র। এতে সে আদর্শের ক্ষতি ছাড়া উপকার হয় না। সম্ভবত, বাংলাদেশের এ ‘সুডো লিবারেল’ ফ্যনাটিক শ্রেণী দেশের সমাজ বাস্তবতা জানেন কিন্ত, মানতে চান না। তারা ভিন্ন মতের মানুষকে ইনক্লুশানে না বরং নিত্য নতুন কারণ দেখিয়ে এক্সক্লুশানের মাধ্যমে নিজেরদের এক্সক্লুসিভনেস প্রমাণ করতে চান। যারা নিজেদেরকে লিবারেলিজমের অনুসারি মনে করেন এবং নিজেদের আদর্শ ( liberty and equality, civil rights, freedom of the press, freedom of religion) সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা রাখেন তাদের উচিত হবে এগিয়ে এসে এ ফ্যনাটিক শ্রেণীর আদর্শিক এবং মানসিক সু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে স্বৈরতন্ত্র আপাততঃ প্রবল হয়েছে, তবে লড়াই চলবে

by মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

বাংলাদেশে ‘নির্বাচিত’ গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসেছে। আর প্রতিরোধ আন্দোলনের বন্ধ্যাত্ব সামষ্টিক মানসে এনেছে হতাশা আর নির্বেদ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম বাঙালি মুসলমানের সামষ্টিক চেতনায় একটি উজ্জীবন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও তৎকালীন সার্বিক মাৎস্যন্যায় জাতির মানসে সেই উজ্জীবনকে ক্ষণস্থায়ী করে বয়ে এনেছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী অবসাদ ও ক্লেদ। জাতীয় মানসের সেই বিষণ্ণ নির্বেদ ও স্বপ্নভঙ্গজাত আত্মগ্লানি ও আত্মপ্রত্যয়রিক্ত দিকনির্দেশহীনতা থেকে বাংলাদেশকে পুনরায় জেগে উঠতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত।

কিন্তু ২০১৪ সালে এসে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। প্রাণহীন খোলসসর্বস্ব গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। সংবিধান একটি অন্তর্বিরোধপূর্ণ দলিলে পরিণত হয়ে জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় সংসদ অকার্যকর একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের নামে দলীয় গোষ্ঠীতন্ত্র প্রবল হয়ে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নকে সর্বব্যাপী করে তুলেছে। গণতন্ত্রের যে একটি অনুসঙ্গ এতদিন জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে অন্তত একদিনের জন্য হলেও সম্ভবপর করেছে, সেই নির্বাচনকেও যাচ্ছেতাই রাজনৈতিক ব্যভিচারের মাধ্যমে একটি প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।

আর জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার এই অধোগতির ধারাকে প্রতিরোধ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করার যে রাজনৈতিক আন্দোলন ও নেতৃত্ব আমরা বর্তমানে দেখতে পাই তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত ও দুর্বল। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক দুর্বলতা যেমন রয়েছে, তার চাইতেও বেশী রয়েছে মতাদর্শিক, রণনৈতিক ও রণকৌশলগত অপরিপক্কতা ও অদূরদর্শিতা। মেধাবী, মননশীল ও সৃজনশীল নেতৃত্ব ও কর্মসূচির অভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম ও আন্দোলন গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ। জনসম্পৃক্ত মতাদর্শ, নেতৃত্ব, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপ্রয়োগের অভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন বন্ধ্যাত্বের চোরাবালিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুধুমাত্র পেশিশক্তিনির্ভর ও ফায়দালোভী রাজনৈতিক পেশাদারদের দিয়ে ব্যাপক গণভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। ‘নির্বাচিত’ স্বৈরতন্ত্র এই সুযোগে ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে এবং দেশী-বিদেশী সমর্থক গোষ্ঠীর সহায়তায় আরও সুসংহত হতে থাকে।

জাতীয় চেতনায় মনঃস্তাত্ত্বিক শূন্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একটি সংঘবদ্ধ, সুসংহত, মতাদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংগঠনের জনসম্পৃক্ত ব্যাপক প্রতিরোধ সংগ্রামের অনুপস্থিতির কারণে একটি জাতিব্যাপী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মনঃস্তাত্ত্বিক শূন্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে। এই বাস্তব ও ব্যাপক নিটশীয় শূন্যবোধের প্রতিক্রিয়ায় জাতির সংবেদনশীল ও মননশীল চেতনা ও মানসে এক যন্ত্রণাকাতর, বিষণ্ণ মনোবেদনা ও ব্যর্থতাজাত অবসাদ অনুভূত হচ্ছে। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া অথবা সাফল্য ব্যর্থতা থেকে এই সামষ্টিক বেদনা ও যন্ত্রণা পরিমাণগত ও গুণগত উভয়দিক থেকেই আলাদা। জাতি, দেশ, রাষ্ট্র প্রভৃতি নিয়ে যেসব মননশীল ও সৃজনশীল নাগরিকেরা ভাবেন ও সক্রিয় হবার চেষ্টায় ও চর্চায় ব্যাপৃত থাকেন, তাঁরা যে সামাজিক শ্রেণী ও স্তরেই অবস্থান করুন না কেন, তাঁদের চেতনায় ও মননে এই জটিল ও কুটিল সংকটজাত সংবেদনা ও সংক্ষোভ প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হবেই। আর এই মনোবেদনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হল অসংগঠিত ও অসংবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন ও বিযুক্ত ব্যক্তি-নাগরিকদের একান্ত অপারগতাজাত অসহায়ত্ববোধ ও তৎসংলগ্ন আত্মগ্লানি ও অপরাধবোধ।

উত্তর-ঔপনিবেশিক ও উত্তরাধুনিক জাহিলিয়া

এই বিষয়টি খোলাসা করতে মহামতি কার্ল মার্ক্সের একটি বিখ্যাত উক্তির আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন যে দার্শনিকেরা এ যাবৎ ইতিহাসের শুধু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যেই নিজেদেরকে ব্যাপৃত রেখেছেন, কিন্তু যা আরো বেশী কাম্য তা হল ইতিহাসের পরিবর্তনের জন্য কাজ করা, শুধু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়। বুদ্ধিবৃত্তির এই মহান দায় কাঁধে নিলে যে কোন মননশীল নাগরিক একধরণের বিদগ্ধ অপারগতার মনোযন্ত্রণায় আক্রান্ত হতে বাধ্য। জাতি-দেশ-রাষ্ট্র বিবর্তনের এমন এক বন্ধ্যা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যখন সামাজিক শুভশক্তিগুলো নিঃসঙ্গ, বিযুক্ত, অসংঘবদ্ধ ও নেতৃত্বহীন আর সামাজিক অশুভশক্তিগুলো দেশী-বিদেশী প্রেক্ষাপটে অনেক বেশী একাট্টা ও সক্রিয়। সর্বব্যাপী আঁধি, নেতি ও অকল্যাণের এই কৃষ্ণপক্ষকেই বোধকরি উত্তর-ঔপনিবেশিক ও উত্তরাধুনিক জাহিলিয়া বলে বয়ান করা যেতে পারে। কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের মাধ্যমে যখন পৃথিবীব্যাপী একধরণের পণ্যসম্ভোগবাদী ও আগ্রাসী বিশ্বব্যাবস্থা কায়েম করেছে, তখন নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক ব্যক্তি, শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জাতি হিসেবে স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো অনেকাংশেই অপসৃয়মান।

বিশ্ব মুসলিম সভ্যতার নবজাগরণ ও বাংলাদেশ

এর সঙ্গে রয়েছে মহান এক আল্লাহর প্রতি সমর্পণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠাকামী আত্মিক শ্রেয়োবোধ ভিত্তিক বিশ্ব মুসলিম সভ্যতার নবজাগরণকে নস্যাৎ করতে সদা সতর্ক ও প্রস্তুত পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন সভ্যতার একক অথবা যৌথ যুদ্ধাভিযান। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই আন্তর্জাতিক সমীকরণের বাইরে নয়। ‘জঙ্গিবাদ’, ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’ দমন বা নির্মূলের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রের ন্যূনতম পূর্বশর্তগুলোকে উপেক্ষা ও বিসর্জনের বিপজ্জনক ডিসকোর্স আমরা বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরেই শুনতে পাই। এই ডিসকোর্সের তাত্ত্বিক গুরুরা প্রকারান্তরে জুডিও-খ্রিষ্টান নব-ক্রুসেড ও ভারতীয় আধিপত্যবাদকেই প্রমোট করে চলেছেন।

চাই আত্মিক চেতনায় বলীয়ান আদর্শভিত্তিক নতুন সৃজনশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি

কাজেই বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চলছে এর যেমন একটি দেশী প্রেক্ষিত রয়েছে, তেমনি এর রয়েছে একটি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত। তাই ব্যক্তি, শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জাতি হিসেবে উপনিবেশ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ক্রমাগত বিকাশ ও উত্তরণের যাত্রায় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ হয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে স্বাধীনতা ও মুক্তির অভিযাত্রা, সেখানে একটি অভিজ্ঞতা বারবার বেঠোফেনের পঞ্চম সিম্ফনির বিখ্যাত থিমের মত বেজে উঠেছে। আর সেটা হল গণতন্ত্রকে দুর্বল করে ও স্বৈরতন্ত্রকে প্রবল করে কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম হতে পারেনি। অন্যদিকে বন্ধ্যা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পুনর্গঠিত হয়ে, অথবা পরিবর্তিত হয়ে অথবা নতুন জনসম্পৃক্ত ও আত্মিক চেতনায় বলীয়ান আদর্শভিত্তিক শক্তির আগমনের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও প্রগতি বেগবান হয়েছে নানান পালাবদলের মধ্য দিয়ে।

সুতরাং ব্যক্তির একক ও জাতির সামষ্টিক চেতনায় যে সর্বগ্রাসী অবসাদ, হতাশা ও নির্বেদ ইতিহাসের পর্ব-পর্বান্তরে নেমে এসেছিল তা যেমন নতুন সৃজনশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির অভিঘাতে কেটে গিয়েছিল, আশা করা যায় যে এখনকার বন্ধ্যা প্রতিরোধ সংগ্রামও নতুন উদ্যোগে, নতুন কৌশলে, নতুন নেতৃত্বে সফল হয়ে অচিরেই সামষ্টিক মননের তমসা ও স্থবিরতার অবসান ঘটাবে।