প্যালেষ্টাইনী রক্ত আমার আপনার হাতে!

1

By Watchdog BD

আরব রাজা বাদশাহদের কথা না হয় বুঝা গেল। সিংহাসন টিকিয়ে রাখতে এমনটা করা ছাড়া তাদের কোন বিকল্প ছিলনা। কারণ প্যালেষ্টাইনিদের সমর্থন করা হবে গণতন্ত্রকে সমর্থন করা। দুঃখজনক হলেও সত্য গোটা মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র ইসরাইল এবং প্যালেস্টাইন ছাড়া বাকি সব দেশে রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র সহ অলৌকিক সব তন্ত্র বিদ্যমান। ক্ষমতার সমীকরণ মেলাতে গিয়ে কোন আরব রাষ্ট্রই ইসরাইলি পশুত্বের বিরুদ্ধে টু শব্দটুকু করেনি। এমনকি আল্লাহর ঘরের কথিত রক্ষকরাও না। তাদের ভূমিকা পাশে রেখে আমরা যদি বাকি বিশ্বের দিকে চোখ ফেরাই সেখানেও সুনসান নীরবতা। অথচ নিকট অতীতে আফ্রিকান খরা, হাইতির ভূমিকম্প, রুয়ান্ডার গণহত্যা নিয়ে বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিখ্যাত ব্যক্তিরা সচেতনা সৃষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আর্থিক তথা মানবিক সাহায্যের হাত বাড়াতে কার্পণ্য করেন নি। কি এমন ঘটল যার ফলে শত শত প্যালেষ্টাইনি শিশুর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহও তাদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছেনা? ঘটনার গভীরে যাওয়ার প্রায় তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার দিকে পাঠকদের নিয়ে যেতে চাই। হলিউড সুপার স্টার মেল গিবসনের বিরুদ্ধে শারীরিক অত্যাচারের অভিযোগ আনেন তার রুশ বান্ধবী অকসানা গ্রিগেরয়েভনা। অনেকদিন ধরেই তাদের ভেতর সমস্যা চলছিল। সূক্ষ্ম হিসাবে পারদর্শী অকসানা কায়দা করে মাতাল অবস্থায় গিবসনের কিছু মন্তব্য প্রকাশ করে দেয়। আর তাতেই টলে উঠে হলিউড। ভিডিওতে দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ান সুপারস্টার মাতাল অবস্থায় গোটা বিশ্বের দুরবস্থার জন্য ইহুদিদের দায়ী করছেন এবং এর প্রতিকার ও প্রতিশোধের আহ্বান জানাচ্ছেন। হলিউড মানে ইহুদি বিনিয়োগ। এদের সমালোচনা মানে সুশৃঙ্খল একটা ইনিস্টিটিউশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। গিবসন তাই করলেন এবং এর জবাব পেলেন খুব দ্রুত। প্রযোজকরা রাতারাতি মুখ ফিরিয়ে নিলেন গিবসন অভিনীত ছবি হতে। হুমকি দিলেন আজীবনের জন্য কালো তালিকভক্ত করতে। গিবসনকে ভাতে ও পানিতে মারার আয়োজন সম্পূর্ণ করতে জোটবদ্ধ হলেন বিনিয়োগকারীরা। ব্যাপারটা সুরাহা করতে এই হলিউড তারকা কতটা নীচে নেমে ছিলনে তার কোন প্রমাণ কারও হাতে নেই। কিন্তু এরপর গিবসনের মুখ হতে ইহুদিদের নিয়ে কোন মন্তব্য কেউ শুনেছে বলে দাবি করতে পারবেনা।

ইসরায়েলি বর্বরতার শুরুতে গায়িকা রিহানা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রতিবাদ জানিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন। ইহুদি নিয়ন্ত্রিত মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি কঠিন ম্যাসেজ পৌঁছে দেয় গায়িকার দুয়ারে। পৌঁছে দেয় ফলাফলের আগাম বার্তা। আবারও ভাতে মারার হুশিয়ারি। প্রতিবাদ শিকেয় তুলে নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পরেন এই গায়িকা। ফলশ্রুতিতে সোশ্যাল মিডিয়া হতে রাতারাতি উঠিয়ে নেন নিজের মন্তব্য। বিশ্ব বিবেককে ওরা এভাবেই জিম্মি করে রেখেছে নিজেদের ধন-সম্পদের কাছে। চলচ্চিত্র, মিউজিক, পারফর্মি আর্ট, স্পোর্টস হতে শুরু করে এমন কোন ব্যবসা-বাণিজ্য নেই যার চালকের আসনে ইহুদিরা বসে নেই। খালি চোখে ওদের উপস্থিতি বুঝা যায়না। কারণ অভিনয়ের জন্য ওরা শুটিং’এ যায়না অথবা খেলার জন্য মাঠে নামেনা। এসবে অনেক পরিশ্রম। কিন্তু যে টাকায় একটা সফল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যাদের অর্থে ফুটবল অথবা বেসবল টিম মাঠে সচল থাকে তার অনেকটাই আসে তাদের পকেট হতে। সে বিনিয়োগ লাভ হয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে ফিরে যায় তাদের পকেটে। এবং সে পকেট সদা-সর্বদা উন্মুক্ত থাকে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলে জন্য। আমরা যারা হলিউডের ব্লকবাষ্টার দেখার জন্য সিনেমাহলে উপচে পরি তাদের অনুরোধ করবো ছবি শেষে প্রদর্শিত নাম গুলো ধৈর্য ধরে পড়ে নেয়ার জন্য। বার্গ, ষ্টেইন, হফফ আর ভিচ দিয়ে যাদের নাম শেষ হয় ওরাই তারা। মেল গিবসন, রিয়ানা আর ইউ-টু’র বনো তাদেরই খেলোয়াড়। আমরা যারা গাঁটের পয়সা খরচ করে তাদের তৈরি ছায়াছবি, স্পনসরড্‌ সংগীত অথবা মালিকানাধীন দলের খেলা দেখতে হলে অথবা মাঠে যাই এক অর্থে সহযোগিতা করি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে। এক বোতলে কোক কিনলে তার একটা অংশ চলে যায় কথিত প্রমিজ ল্যান্ডে। এবং সে অংশ বিন্দু হতে সিন্ধু হয়ে আঘাত হানে প্যালেষ্টাইনি শিশুদের। আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়াতে ইসরায়েলি বর্বরতা নিয়ে চীৎকার করছি তারাও ইসিরায়েলি অপরাধের সহযোগী।

মালয়েশিয়ান ফ্লাইট ১৭ এবং কতিপয় স্বৈরশাসকের ইতিবৃত্ত…

By Watchdog BD

সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ। ইউরোপের এ দিকটায় গ্রীষ্মের শেষ এবং শরতের শুরু। আমাদেরও শিক্ষা বর্ষেরও শুরু কেবল। এদিন ক্লাসে হাজির থাকা অনেকটা বাধ্যতামূলক। অন্যথা হলে মাসিক স্কলারশিপ সহ অনেক কিছুতে কর্তৃপক্ষের কুনজর পরার সম্ভাবনা থাকে। তাই টর্কি ও পেয়িংটনের দুমাসের শৃংখলবিহীন জীবনকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসতে হল।ইংল্যান্ডের সাউদ ভেভনের এ অংশের সাথে প্রেম সেই ৭০ দশক হতে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির একটা বড় অংশ ইংলিশ রিভিয়েরায় কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এ যাত্রায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বলাটা সহজ হলেও পূর্ব ইউরোপ হতে ট্রেনে চড়ে পশ্চিম ইউরোপের এ দিকটায় পা রাখা তত সহজ ছিলনা। এ পথে মুল বাধা ছিল বার্লিন দেয়াল। পূর্ব জার্মানির বার্লিন শহরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী কেন দুভাগ করেছিল এ নিয়ে অনেক তর্ক আছে। কিন্তু ঠাণ্ডা যুদ্ধের ফ্রন্টের শুরুটা যে বার্লিন দেয়াল দিয়ে তা নিয়ে কোন তর্ক ছিলনা। পায়ে হেঁটে যারা বার্লিন দেয়াল অতিক্রম করেনি তাদের বুঝানো মুস্কিল হবে ঠাণ্ডা যুদ্ধের কঠিন শীতল চেহারা। সেমিস্টারের প্রথম দিনটা যেভাবে কাটার কথা সেভাবেই কাটল। কোর্স পরিচিতি, ক্লাস রুটিন এবং ক্লাসমেটদের সাথে ভেকেশন অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। শরতের শুরু হলেও শীত ঝাঁকিয়ে বসতে সময় নেয়নি। বিশেষ করে রাতের বেলা। পৃথবীর এ দিকটায় তাই হয়, গরমকালটা চোখের পলকে বিদায় নেয়। লম্বা, বিরক্তিকর এবং ভয়াবহ শীতের প্রস্তুতি নিতে হয় পেপ্টেম্বরের শুরু হতে। অক্টোবরের শুরুতে তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে নামতে শুরু করে এবং মধ্য শীতে তা -৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। আমাদের জীবনও থেমে যায়। মানিয়ে নিতে হয় প্রকৃতির এই নির্মমতার সাথে। ক্লাস শেষে রুমে ফিরে শুনলাম খবরটা।

 

সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র শেখা ছিল আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। এর তাত্ত্বিক সংজ্ঞা ক্লাসে ঘটা করে শেখানো হলেও তার বাস্তব গোলাপি চিত্রের সম্যক ধারণা পেতে এ রকম একটা সমাজে বাস করাই ছিল যথেষ্ট। খবর শোনা এবং তা বিশ্বাস করার একমাত্র সোর্স ছিল সরকারী মাধ্যম। এর বাইরে সবকিছু ছিল বুর্জুয়া প্রচারণা ও ষড়যন্ত্র। সোভিয়েত সমাজে বাস করে বুর্জুয়া প্রোপাগান্ডা যারা বিশ্বাস করতো তারা ছিল সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হত কথিত এসব শত্রুদের বিরুদ্ধে। খবরটার কোন প্রধান্য ছিলনা। পশ্চিমা মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজের মত কোন নিউজ মিডিয়াতে ঠাঁই পেতনা যদিনা তাতে ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টি ও তার সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য জড়িত না থাকতো। খুব অনিশ্চিত সময় পাড় করছিল সোভিয়েত শাসকরা। লৌহমানব লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভের সময় শেষ হয়েছে কেবল। চেরনেনকো আন্দ্রোপভদের মত কট্টর নেতাদের আনাগোনা শুরু হয়েছে ক্ষমতার পাদদেশে। দেশটার মানুষ এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিল তাও নয়। আসলে একদল-একজনের (সাধারণ সম্পাদক) দাসত্ব করতে গিয়ে গোটা জাতি পরিণত হয়েছিল যান্ত্রিক পুতুলে। যার চাবি ছিল শতকরা ৪০ ভাগ এলকোহলের ভদকায়। ৩ রুবেল ৭৫ কোপেকের পৌনে এক লিটার ভদকার বোতলকে ঘিরে আবর্তিত হোত সোভিয়েত জীবন। হোক তা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী অথবা শ্রমজীবীর দল। তবে এর মাঝে ব্যতিক্রম ছিল রুশ ইহুদিরা। অভূতপূর্ব মেধার অধিকারী এসব নাগরিকদের প্রায় সবাই ব্যস্ত থাকত পশ্চিম ইউরোপে মাইগ্রেট করার মিশনে। দেশ অথবা সমাজের ভালমন্দ নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা ছিলনা। তাদের শয়নে স্বপনে থাকত পশ্চিম ইউরোপ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা দুরের দেশ ইসরাইলে পাড়ি দেয়ার লালিত ইচ্ছা। কেবল তাদের সাথে আলাপ করলে বুঝা যেত পার্থক্য গুলো। সান্ধ্য খবরে জানা গেল ঘটনাটা। সাখালিনের উপর একটি মার্কিন গোয়েন্দা বিমানকে গুলি করে নামিয়ে ফেলেছে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর একটি ফাইটার জেট। আমার মত খবর সন্ধানী তৃতীয় বিশ্বের আদমদের জন্য এ ছিল সেনসেশনাল নিউজ। কিন্তু সোভিয়েত সমাজের কোন স্তরেই এর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলনা।

 

গোয়েন্দা বিমান যে আসলে কোরিয়ার এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান ছিল খবরটা প্রথম এক বছর জনগণকে জানতে দেয়া হয়নি। পশ্চিমা চাপে তারা বলতে বাধ্য হয়েছিল গোয়েন্দা বিমানে বেশ কজন মার্কিন ও কোরিয়ান গোয়েন্দা ছিল। রোববারের টিভিতে যুদ্ধ বিষয়ক এনালিস্টদের মুখ হতে শোনা গেল মার্কিন ’অপরাধের’ ম্যাগনিটিউড। তাদের অনেকের মতে কোরিয়ান বিমানের মাধ্যমে রুশ আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে মার্কিনীরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত করতে চেয়েছিল। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল চাঁদের অন্য-পীঠে কি আছে তা জানার জন্য। মাধ্যম রেডিও। কিন্তু হায়, হতাশ হতে হল। ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, ডয়েচে বেল্লা সহ পশ্চিমা সবগুলো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে জ্যাম করে দেয়া হয়েছে। ইংরেজি অথবা রুশ ভাষা সহ কোন ভাষাকেই রেহাই দেয়া হয়নি। গোটা রুশ জাতিকে মিথ্যার সাগরে ভাসানো হল। কিন্তু খবর লিক হতে সময় লাগল না। গোয়েন্দা বিমান নয়, বরং কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমানকে মিসাইল মেরে ঘায়েল করেছে সোভিয়েত বিমান বাহিনী। নিউ ইয়র্ক হতে আলাস্কার এংকোরেজ হয়ে বিমানটির শেষ গন্তব্য ছিল সিউল। পাইলট ও কো-পাইলট অটো-পাইলট মুডে দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। বুঝে উঠার আগে ফ্লাইট সোভিয়েত নিষিদ্ধ ফ্লাইং জোনের ১২ কিলোমিটারের মধ্য ঢুকে পরে। সেকেন্ডের মধ্যে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর একটি জেট আকাশে উঠে যায় এবং মিসাইল নিক্ষেপের মাধ্যমে ভূপাতিত করে ফেলে কোরিয়ান বিমান। ২৬৯ জন যাত্রী ও ক্রুদের সবার সলিল সমাধি হয় জাপান সাগরে। যাত্রীদের একজন ছিল জর্জিয়া হতে নির্বাচিত মার্কিন কংগ্রেসম্যান লরেনস ম্যাকডোনাল্ড। সিআইএ’র রিপোর্ট হতে জানা যায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের থাকার কথা ছিল একই ফ্লাইটে। কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নেয়া মার্কিন সৈন্যদের একটা গেট-টুগেদারে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং আরও অনেকে। সাগর হতে উদ্বার করা ব্ল্যাক বক্স পর্যন্ত গায়েব করে দেয় সর্বহারাদের একনায়করা। তবে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের ঊষালগ্নে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়লৎসিন জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তর করেন গুম করা ব্ল্যাক বক্স। এবং কেবল তখনই উন্মোচিত হয় ৩ রুবেল ৭৫ কোপেক মূল্যের ভদকা সভ্যতায় বেড়ে উঠা সোভিয়েত শাসকদের কালো ইতিহাস।

 

এ যাত্রায় কোরিয়ান নয়, নামানো হয়েছে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী বিমান। তবে সাগরে নয়, নামানো হয়েছে পূর্ব ইউক্রেনের দনেস্ক শহরের বিতর্কিত একটি অঞ্চলে। এলাকা নিয়ে বিতর্কটাও খুব অদ্ভুত। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শক্তিশালী প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের অনেক অঞ্চলে রুশ জাতির প্রাধান্য বাস্তব সত্য। ঐতিহাসিক ভাবে এ বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সোভিয়েত দেশের ১৫টি প্রজাতন্ত্রে। ঢাল-তলোয়ার বিহীন রুশ সাম্রাজ্যের অধিপতি ভ্লাদিমির পুতিন অস্ত্র দিয়ে এসব অঞ্চলের জনগণকে বলছেন তোমরা বিদ্রোহ কর এবং বলতে শুরু কর ইউক্রেনে নয়, আমরা রুশ দেশে থাকতে আগ্রহী। পুতিনকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিম ইউরোপের সাথে সম্পর্ক করার কারণে ইউক্রেনকে শাস্তি দিতেই এ নাটক। ইতিমধ্যে রক্তের নদী বয়ে গেছে দেশটার পূর্বাঞ্চলে। এ ক্ষেত্রে পুতিন বাহিনী ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের পর রেড আর্মি কর্তৃক মধ্য এশিয়া দখলের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে। পশুত্ব রুশদের শিরা উপশিরায়। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। সমসাময়িক চেচেন ম্যাসাকার এবং তার দখল তারই ধারাবাহিকতার ফসল। মালয়েশিয়ান বিমান ভূপাতিত করার দায়িত্ব নিয়ে রুশ এবং ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দায়ী করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ওরা একই বাক্সের দুই জিন। পশুত্ব ও নির্মমতায় একজন অন্যজনকে ছাড়িয়ে যেতে সামান্যতম সময় নেয়না।

 

৩০শে জুন ন্যাটোর ইউরোপীয় কমান্ডার জেনারেল এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন তাদের কাছে প্রমাণ আছে রুশ সৈন্যরা পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল লঞ্চ করার ট্রেনিং দিচ্ছে। খবরের সমীকরণ মেলাতে গেলে সহজেই বের করা যাবে কাদের হাতে ভূপাতিত হয়েছে মালয়েশিয়ান ফ্লাইট ১৭ এবং প্রাণ হারিয়েছে ১৫জন ক্রু সহ ২৮৩ জন যাত্রী। কথিত বিদ্রোহীদের হাতে শুরু হতে shoulder-to-air রকেট ছিল, যার উড্ডয়ন ক্ষমতা ১০,০০০ ফুটের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু ট্রাক হতে ছোড়া যায় এমন সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইলের রেঞ্জ ৩০ হাজার ফুটের অনেক উপরে। নিশ্চিত ভাবে বলা যায় এমন একটা মিসাইল দিয়েই ধরাশায়ী করা হয়েছে মালয়েশিয়ান বিমানকে। এ পশুত্বের আসল আর্কিটেক্ট রুশ সেনাবাহিনী যার পেছনে শক্ত অবস্থায় দাড়িয়ে আছে পুতিনের একনায়কতান্ত্রিক অসুস্থ রাজনীতি।

 

কথায় বলে ভ্রমরে ভ্রমর চেনে। সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা মূল্যের অস্ত্র সদাই করতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী (অ-অবৈধ) গিয়েছিলেন রাশিয়ায়। দেখা করেছেন স্বৈরশাসক পুতিনের সাথে। চুক্তি করেছেন নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের উপর। এসব খবর শুনতে খুব ভাল শোনায়। মনে হয় উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে যাচ্ছে আমাদের দেশ। কিন্তু রুশ চরিত্রের উপর যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তাদের ধারণা করতে কষ্ট হয়না লিখিত চুক্তির পেছনে নিশ্চয় রয়ে গেছে অলখিত চুক্তি। এ চুক্তি দুই অবৈধ ও অসৎ স্বৈরশাসকের বুঝাপড়ার চুক্তি। চারিত্রিক দিক বিবেচনায় এই দুই নেতার উদ্দেশ্য ও বিধেয় এক ও অভিন্ন, যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী (অ) এখন বন্ধুহীন। পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যার উপর ভরসা করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারবেন। সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিবেশী ভারতের উপরও বিশ্বাসে রাখতে পারছেন না। এ বিবেচনায় পুতিনের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। ক্ষমতায় বসে অর্থ-সম্পদ ভাগ-বটোয়ারা করার অনন্য নায়ক এই রুশ একনায়ক।

 

ল অব সাবষ্ট্রাকশনের ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাসে সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গুলোকে শোয়ালে কতগুলো অদ্ভুত সাদৃশ্য চোখে পরতে বাধ্য। এই যেমন, দুই ব্যবস্থায়ই একজন স্বৈরশাসকের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। দুই সমাজ ব্যবস্থার ভীত প্রতিষ্ঠিত একই ফিলসফির উপর। সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের সমালোচক অথবা বিরোধীদের আখ্যায়িত করা হয় বুর্জুয়ায় হিসাবে এবং তাদের বিনাশের মাধ্যমে উড়ানো হয় ভবিষ্যৎ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ঝাণ্ডা। পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক কট্টর রাষ্ট্র গুলোর সমালোচকদের সবাইকে বলা হয় কাফের। কাফেরদের হত্যার জন্য নাকি পুরস্কারেরও ব্যবস্থা আছে পরজন্মে। এসব অসুস্থ এবং তামাদি সূত্রের উপর টিকে আছে আজকের সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মভিত্তিক সমাজ গুলো। যার একমাত্র কাজ একজন স্বৈরশাসক ও তার পারিবারিক ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করায় দাসত্ব করা। আজকের পুতিন ও সৌদি বাদশাহদের সাথে সাদৃশ্য এখানেই। অবশ্য এ পথের নতুন পথিক হয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী (অ)… নাকে গণতন্ত্রের মুলা ঝুলিয়ে জাতিকে গাধা বানিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন গন্তব্য পথে। এ যাত্রায় কৌশল হিসাবে ব্যবহার করছেন জাতির মুক্তিযুদ্ধ। বুর্জুয়া এবং কাফের তত্ত্বের মত ব্যবহার করছেন জাতির এই মহান অর্জনকে। ফতোয়া দিচ্ছেন যারা শেখ পরিবারের আজীবন শাসনে বিশ্বাস করেনা তারা দেশদ্রোহী, রাজাকার এবং এ দেশের তাদের বাস করার অধিকার নেই। অত্যন্ত চৌকস কায়দায় প্রতিপক্ষকে নির্মূল করছেন। গোটা জাতিকে অসততার দৌড়ে নামিয়ে সপরিবারে মজা লুটছেন। এবং ধরে নিয়েছেন হাজার বছর ধরে চালিয়ে যাবেন পারিবারিক শাসন। এ মুহূর্তে এমন একটা শাসন অসম্ভব কিছু মনে হচ্ছেনা। কারণ অসৎ দৌড়ে বিরতি নেয়ার মত অবস্থানেই নেই জাতি। বিরতি মানেই ধ্বংস, বিপর্যয়। যা হতে উঠে দাঁড়ানোর মত শক্ত মেরুদন্ড নেই জাতির পীঠে।

 

খরার তাপ-দাহে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। কোন এক পড়ন্ত বিকেলে ঈশান কোনে জমা হয় একখণ্ড মেঘ। এক সময় তা রূপ নেয় সর্বগ্রাসী কালবৈশাখীতে। তারপর ধেয়ে আসে। লন্ডভন্ড করে দেয় জনপদ। উড়িয়ে আছড়ে ফেলে পুরাতন অনেক কিছু। জাতির ঘাড়ে চেপে বসা শেখ নামের ভুত উপড়ে ফেলতেও আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে আকাশের দিকে। এক সময় না এক সময় মেঘ জমবে। এবং সে মেঘ প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে রূপান্তরিত হয়ে উড়িয়ে নেবে শাসক নামক এসব দানবদের। সভ্যতা বিবর্তনের এ অমেঘো ধারা হতে স্বৈরশাসক পুতিন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশা আর শেখ হাসিনার মত বেহায়া শাসকরা রক্ষা পাবেন তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
http://www.amibangladeshi.org/blog/07-20-2014/1468.html

চেতনা-পরাবাস্তবতাঃ তুরস্ক বনাম বাংলাদেশ

2

by: Aman Abduhu

গত রবিবার তুরস্কে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়ে গেলো। সে নির্বাচনে ছদ্ম-ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের দল এগিয়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়া এখন বাংলাদেশেও দেখছি; ইসলামপন্থীরা প্রচুর আনন্দ প্রকাশ করছেন।

এই ইসলামপন্থীদের একটা জিনিস খুব ভালোভাবে বুঝা দরকার। এটা ঠিক যে কঠিন একটা সেক্যুলার পরিবেশে এরদোগান কিছু কাজ করেছেন, যা বৈশিষ্ট্যবিচারে ইসলামী। যেমন, কোন মেয়ে হিজাব করতে চাইলে পারবে, এটা তিনি অনুমোদন করিয়েছেন শেষপর্যন্ত। পাবলিক প্লেসে এলকোহল নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু এসব বিষয় তুরস্কের নির্বাচনে কোন ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর ছিলোনা। ঐদেশের মানুষজন এইসব সস্তা ইসলামী জযবায় উত্তেজিত হয়ে এরদোগানকে ভোট দেয়নি। বরং তুরস্কে গেলে মেয়েদের বেশভুষা এবং আরো কিছু দেখে ইসলামপন্থীদের হার্ট এটাক হয়ে যেতে পারে। এখন অলরেডি ফেসবুকে কানে তালা লেগে যায়। আর বাংলাদেশের দৃশ্যমান অবস্থা তুরস্কের মতো হলে তো ইসলাম-রক্ষক ভাইদের চিৎকারে ফেসবুকে কানের পর্দাই ফেটে যেতো।

তুরস্কের মানুষ বাংলাদেশের মানুষজনের মতো হুজুগে না। তারা আমাদের মতো অর্থহীন ইস্যু আর অতীত নিয়ে এতোটা মেতে থাকে না। বরং ইউরোপ আর এশিয়ার মাঝে থাকার অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারা দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করে।

এরদোগান আমার প্রিয় একজন নেতা। বর্তমান মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের মাঝে তাকে অন্যতম সফল একজন নেতা মনে করি। অর্জনের দিক থেকে মাহাথিরের চেয়েও বেশি। কারণ দেশী-বিদেশী এতো বেশি ষড়যন্ত্র আর বিরোধীতার মুখোমুখি মাহাথিরকে হতে হয়নি। তুরস্কের কনটেক্সটও মালয়েশিয়ার চেয়ে ভিন্ন এবং অপেক্ষাকৃত কঠিন ছিলো। এরদোগান লোকটা সবচেয়ে বেশি প্রাগমাটিকও।

তবে ভদ্রলোক সম্প্রতি ডিকটেটরদের মতো কাজকর্ম শুরু করেছেন। সাংবাদিকদেরকে জেলে ভরা, টুুইটার ইউটিউব ব্লক করা, বিশাল বিশাল গণজমায়েতের ছবি দিয়ে পাবলিককে ইমপ্রেস করার চেষ্টা, এসব। যদি শেষপর্যন্ত এসব সামলে নিতে পারেন, হয়তো তিনি আরো বেশি উচ্চতায় পৌছে যেতে পারেন। কারণ আলটিমেটলি তিনি তার দেশের জন্য ক্ষতিকার শাসক না। শেখ হাসিনার মতো নেতিবাচক মানুষ না। কিন্তু এভাবে সামলাতে পারার সম্ভাবনা কম। তারচেয়ে বরং তাঁর অবসর নেয়া উচিত। একে পার্টির হায়ারারকিতে যোগ্য মানুষজন আরো আছে।

এইসব কাজকর্ম করার পরও কেন এরদোগানের দল বিজয় পেলো? তুরস্কের নির্বাচন কি বাংলাদেশের মতো? সোমবারের পঞ্চম দফা উপজেলা নির্বাচনে যেভাবে বাংলাদেশে আওয়ামী মাফিয়া লীগের লোকজন কেন্দ্র দখল করছে? বিরোধীদলের পোলিং এজেন্টদের বের করে দিচ্ছে, সিল মেরে বাক্স ভরাচ্ছে।?

না। একে পার্টিকে এসব করে নির্বাচনে জিততে হয়নি। এবং ফাঁপা বেলুনভর্তি জযবার উপর ইসলাম মার্কাটি লাগিয়ে দিয়ে ঐদেশে জেতা যায় না, তা তো আগেই বলেছি। বরং এখনো এরদোগানের বিজয়ের কারণ দুইহাজার এগারো সালের জুনে আলজাযিরায় প্রকাশিত একটা রিপোর্টে বুঝা যায়। “ফ্রম স্ট্রিট সেলার টু গ্লোবাল স্টেটসম্যান”।

এরদোগান প্রথম জীবনে বাড়তি উপার্জনের জন্য তার এলাকা কাশিমপাশার রাস্তায় খাবার বিক্রি করতেন। এটাও একটা চিন্তা করার মতো বিষয়। ঐদেশে মৃত বাবা বা স্বামীর দড়ি ধরে মানুষজন রাজনীতিতে আসার সুযোগ তেমন একটা পায় না। নিজের যোগ্যতা দরকার হয়।

সেই রিপোর্টে এরদোগানের শাসন সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইস্তাম্বুলের টেক্সি ড্রাইভার মেরাল বলছিলেন “আমার বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়। আমার জীবনে প্রথমবারের মতো আমি ইন্সুরেন্স পেয়েছি, আমাদের প্রাইম মিনিস্টারকে ধন্যবাদ এর জন্য। আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তাহলে আমার পরিবার কোন সমস্যায় পড়বে না। আমার দশ বছর বয়সী মেয়েটা মিষ্টি বেশি খেয়ে খেয়ে দাঁত নষ্ট করে ফেলেছে। আগে হলে তার চিকিৎসার জন্য আমাকে ফতুর হয়ে যেতে হতো। আর এখন আঠারো বছর বয়সের কম সবার চিকিৎসার খরচ দেয় সরকার।”

এরদোগানের ইয়ং বয়সে তাঁর চুল কেটে দিতো যে সেলুন মালিক, তিনি আলজাযিরার রিপোর্টারকে বলেছিলেন “আমি যখন আটানব্বই সালে হজ্ব করতে সউদী আরব যাই তখন এক মিলিয়ন টার্কিশ লিরার নোটও এক্সচেঞ্জ করার জন্য কেউ নিচ্ছিলো না। আর দুইহাজার দশ সালে যখন আবার গেলাম, একশ লিরার নোট দিয়ে আমি দুইশ পঞ্চাশ রিয়াল পেলাম। ঠিক তখনই আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের জীবন বদলে গেছে। আমাদের একটা ভবিষ্যত আছে এখন।”

মানুষ এ পৃথিবীতে খুব বেশি কিছু চায় না। একটু শান্তিতে বাঁচতে চায়। এরদোগানের মতো নেতারা যখন সে প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করেন, তখন মানুষ তাদের ভালোবাসে। অথবা উন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন ইনষ্টিটিউশন ও ট্রাডিশনের কারণে নেতারা এর বাইরে যেতে পারেন না। আর আমাদের মতো দেশে? রাজনীতিবিদ নেতারা ব্যস্ত আছে একজন আরেকজনের সাথে নোংরা মারামারি আর রাষ্ট্রের সম্পদ চুরি করে খাওয়াতে।

আর তাছাড়া, নেতা তো উঠে আসে মানুষদের মধ্য থেকেই। ঐসব দেশের মানুষেরা ব্যস্ত থাকে কাজ করতে, অবসরে নিজের আনন্দ নিতে। ওদের ফেসবুকে গেলে দেখা যায় হয় নিজেরা বেড়াচ্ছে খাচ্ছে। দেশের বড় কোন সামষ্টিক ইস্যু যেমন নির্বাচন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা অর্থনৈতিকভাবে বড় কোন ঘটনা, এসব নিয়ে কালেভাদ্রে মাথা ঘামাচ্ছে।

আর আমাদের দেশে আমরা সবাই তালেবর। সবাই দেশপ্রেমে টুইটুম্বুর স্থবির গর্ভবতী। যেদেশে মানুষ আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষা করে, চিকিৎসা পায় না, বিচার পায় না, সেদেশে এখনো আমরা পরে আছি একাত্তর নিয়ে। সম্ভব হলে বিপ্লব করতে ব্রিটিশ আমলেও চলে যাই পারলে, এমন অবস্থা। এখনো আমরা গিনেজ রেকর্ডের মতো ফালতু একটা প্রতিষ্ঠানের পেছনে পুরো দেশ মিলে দৌড়াচ্ছি। অথবা হিমালয়ে উঠার জন্য ধাক্কাধাক্কি করে যাচ্ছি।

ওদের দেশের বুদ্ধিজীবিরা পত্রিকায় কলাম লেখে জমির দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে, বিদেশের সাথে অর্থনৈতিক ঘাটতি নিয়ে, অন্য দেশের যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে, রিফিউজিদের সমস্যা নিয়ে। আর আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিরা মুজিবকে সম্মান দেয়া হয়নাই, জাতীয় সঙ্গীত সবার সেরা, মুক্তিযুদ্ধ না থাকলে দেশ আগাবে না এইসব নিয়ে আবর্জনা লেখাতে ব্যস্ত।

এমন একটা অতীতমুখী দেশের কোন বর্তমান বা ভবিষ্যত কিভাবে থাকবে? আর কিভাবেই বা এইরকম ঊন-মানুষদের মাঝে এরদোগান, মাহাথির বা জিয়ার মতো স্টেটসম্যান জন্ম নেবে?

আল কায়েদা হুমকি ও ক্ষমতা সমীকরণের মধুচন্দ্রিমা..

by Watchdog BD

পাঠকদের মনে থাকতে পারে বিএনপির শেষ টার্মের শেষ দিকের কিছু ঘটনা। হঠাৎ করে ভারতীয় মিডিয়া ইনিয়ে বিনিয়ে প্রচার করতে শুরু করে আল কায়েদার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মিশরীয় ডাক্তার আইমেন আল জাওহিরি নাকি বাংলাদেশে। এবং বাংলাদেশি সরকার তাকে সব ধরণের সহযোগীতা দিয়ে লুকিয়ে রাখছে। একই সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরের আসেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী জনাবা শেখ হাসিনা। তিনি পরিষ্কার ভাষায় মার্কিনিদের জানিয়ে দেন এখনই ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে পরবর্তী আফগানিস্থান। ভাষাগত দুর্গন্ধে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এই মহিলার দাবির প্রেক্ষাপটে তাৎক্ষণিক মার্কিন কোন সৈন্য বাংলাদেশে হয়ত পা রাখেনি অথবা পাকিস্তানের মত ড্রোন হামলা চালিয়ে নির্বিচারে নারী,পুরুষ ও শিশু হত্যা করেনি। তবে সতর্ক বার্তাকে হেলাফেলা করেও উড়িয়ে দেয়নি মার্কিন কতৃপক্ষ। গ্রিনকার্ডধারী গোটা বাংলাদেশি সমাজকে তাৎক্ষণিকভাবে ইমিগ্রেশনে রিপোর্ট করে তাদের চলাচলের রোডম্যাপ অবহিত করতে ডিক্রি জারি করে দেশটার হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয়। অনেকের মত ব্যাক্তিগতভাবে আমিও বিশ্বাস করি খালেদা অধ্যায়ের করুণ পরিণতি, আহমদ গংদের উত্থান এবং শেখ ডাইনেস্টির ক্ষমতারোহনের অন্যতম ইনগ্রেডিয়েন্ট হিসাবে কাজ করেছিল ভারতীয় মিডিয়ার এ অপপ্রচার এবং পাশাপাশি নেত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর। অন্তত উদ্দিন গংদের প্রতি মার্কিন তথা পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন এ বিশ্বাসকে আরও জোরালো করে। পাঠকদের আরও মনে থাকার কথা তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে শেখ হাসিনার মন্তব্য, … ‘এ আমাদের আন্দোলনের ফসল’ এবং ‘ক্ষমতায় গেলে তাদের সব কাজের বৈধতা দেব’।

jawahiri-ed

দেশীয় রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হিসাবে আবারও হাজির হয়েছেন আল জাওহিরি। মার্কিনিদের সন্ত্রাসী তালিকায় এই ব্যাক্তির নাম সবার উপরে। এবং তারা যে কোন মূল্যে আল কায়েদার কমান্ডার-ইন-চীফকে নির্মূল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশের ৫ই জানুয়ারীর নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ উন্নত বিশ্বের কোন দেশই সন্তুষ্ট নয়। প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো এ নিয়ে লেখালেখি করছে। পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটিতে শুনানী হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে নেত্রীর চামচারা যতই লম্ফঝম্ফ করুন না কেন অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পশ্চিমা বিশ্বের সহযোগীতা বাধ্যতামূলক। পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রেকর্ড পরিমান রিজার্ভে হাত দিতে যাচ্ছে। অনিশ্চিত মানব সম্পদ রফতানি এবং তৈরী পোষাক শিল্পের উপর পশ্চিমাদের উপর্যুপরি হুমকির প্রেক্ষাপটে রিজার্ভের উপর হাত দেয়া কতটা বিপদজনক তা মাল মুহিত সহ অর্থনীতিবিদদের জানা থাকার কথা। এ অনিশ্চিত অবস্থা হতে উত্তরণে অতীতের মত আবারও আইমেন আল জাওহিরি ফ্যাক্টরকে সামনে আনা হয়েছে।

সরকারের বহুমুখী আক্রমণে জামাত সহ বাংলাদেশের সবকটা বিরোধী দল এখন বিধ্বস্ত। হামলা মামলার পাশাপাশি গুম ও বন্দুকযুদ্ধ নাটকের শিকার হয়ে দলের নেতারা হাটে মাঠে ঘাটে প্রাণ হারাচ্ছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে হেফাজত-জামাতের পক্ষে আল কায়েদার সমর্থন কার হাত শক্তিশালী করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক  নির্বাচন হতে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্যই আল কায়েদা হুমকির সূত্রপাত।

এখন বাকি থাকবে বাংলাদেশের জনবহুল কোন অংশে আল কায়েদার নামে বোমা মেরে বেশ কিছু মানুষ হত্যা করা। ৫ই জানুয়ারীর ভোট ডাকাতির ধারাবাহিকতা ও ক্ষমতা নামক সমীকরণের অংশ হিসাবে আইমেন আল জাওহিরির উপস্থিতি পশ্চিমা দুনিয়ায় কাজ করলেও খোদ বাংলাদেশে তা কাজ করবেনা। কারণ দেশের ১৫ কোটি মানুষের প্রায় সবাই জানে শেখ হাসিনা হয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় পর্যন্ত শেখ ডায়নাস্টি টিকিয়ে রাখতে এ মুহূর্তে এর কোন বিকল্প নেই।

শীতকালীন অলিম্পিক গেমস ও সন্ত্রাসী ঘটনা। আড়ালে কি আছে??? -Husasain Sumrat

 

পাশ্চাত্য মিডিয়াতে সন্ত্রাসবাদ ও সচি অলিম্পিক নিয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে। ২৭ জানুয়ারি’১৪ তে বিবিসি তে ব্রিটিশ সরকারের একটি সতর্কসূচক বক্তব্যও ছাপানো হয়। সচিতে অলিম্পিক মশাল আসার সাথে সাথে সিএনএন ১০০০ জন লোকের উপর জরিপ করে। যেখানে ৫৭% আমেরিকান মনে করে সেখানে সন্ত্রাস হবার সম্ভাবনা আছে। তার আগের খবরে বলা হয় রাশিয়ার ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের জন্য হটস্পট হল চেচনিয়া। যেখানে একে তাঁরা “Black Window” নামে আখ্যায়িত করেছেন। ড. গডন উও বলেছেন সেখানে সন্ত্রাসী হামলা ঘটার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে।

““Because of the history between the Russians and the Chechen people who splintered to form the Caucasus Emirate, Sochi is a prime target for terrorism,” said Woo, who has advanced insurance modelling of catastrophes, including designing a model for terrorism risk.” (http://www.ibtimes.co.uk/sochi-winter-olympics-terrorist-attack-very-likely-happen-1435265)

এই খেলাটি যখন চলছে তখন পৃথিবীতে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে চলছে সর্বচ্চ দন্দ (on the basis of geopolitical chessboard)। সব বিখ্যাত পত্রিকা ও সাময়িকী চোখ ঘুরিয়েছে “Black Widow” এর দিকে। তাঁরা লেখে যাচ্ছে মনের মাধুরী মিশিয়ে। টিভিও বসে নেই। এইসব স্লানটেড মিডিয়ার উদ্দেশ্য হল রাশিয়ার কতৃপক্ষকে বিব্রত করা।

কোন মিডিয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। সেটি হল এই ককেসিয়ান  সন্ত্রাসের পেছনে কে আছে???!!! যা কিনা এই সন্ত্রাসবাদের প্রকৃতি নিরূপণে সহায়তা করবে।

আমরা যদি আল-কায়েদার ইতিহাস দেখি এবং বর্তমানে লিবিয়া ও সিরিয়াতে যদি দেখি তাহলে স্পষ্ট বুঝতে পারি তাঁদের পেছনে ছিল পাশ্চাত্য শক্তি।

একটু ইতিহাসের দিকে যাওয়া যাক –

এই চেচনিয়ান জিহাদিদের পেছনের কথা কি বলে? যাদেরকে প্রমাণ না করা গেলেও বলা হচ্ছে যে এরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করবে।

১৯৯০ সালের দিকে যখন সোভিয়েত উনিয়ন ভেঙ্গে যায় তখন থেকেই রাশিয়ার সাথে একটি শীতল যুদ্ধ চলছে চেচনিয়াকে রাশিয়া থেকে আলাদা করার জন্য যা কিনা তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের জন্য Strategic rout হবে। এটি একটি Intelligence অপারেশন (গোপন)। চেচেন বিদ্রোহীদের প্রধান দুই নেতা শামিল বাচাজেভ ও আল খাত্তাব সিআইএ সহায়তাপুষ্ট পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। They were indoctrinated there. তাঁরা আল-কায়েদাদের সাথেও যুক্ত হয় যা কিনা আইএসআই সহায়তাপুষ্ট। যার পেছনে আছে সিআইএ। চেচনিয়াতে এদেরকে ফান্ডিং করে সৌদি ওহাবি মিসন।

The ISI played a key role in organizing and training the Chechnya rebel army:

“[In 1994] the Pakistani Inter Services Intelligence arranged for Basayev and his trusted lieutenants to undergo intensive Islamic indoctrination and training in guerrilla warfare in the Khost province of Afghanistan at Amir Muawia camp, set up in the early 1980s by the CIA and ISI and run by famous Afghani warlord Gulbuddin Hekmatyar. In July 1994, upon graduating from Amir Muawia, Basayev was transferred to Markaz-i-Dawar camp in Pakistan to undergo training in advanced guerrilla tactics. In Pakistan, Basayev met the highest ranking Pakistani military and intelligence officers (Levon Sevunts, “Who’s Calling The Shots? Chechen conflict finds Islamic roots in Afghanistan and Pakistan”, The Gazette, Montreal, 26 October 1999.)

Following his training and indoctrination stint, Basayev was assigned to lead the assault against Russian federal troops in the first Chechen war in 1995. (Vitaly Romanov and Viktor Yadukha, “Chechen Front Moves To Kosovo”, Segodnia, Moscow, 23 Feb 2000)

সচি অলিম্পিক রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের পাইপলাইনের কেন্দ্রে অবস্থিত (ব্ল্যাক সি)। ১৯৯০ এর দিকে রাশিয়ান ফোরসের সাথে চেচনিয়ান বিদ্রোহী (US sponsored) ও আল কায়েদার মতো আরও দল পরাজিত হয়।

রাশিয়া ভিত্তিক আল-কায়েদা ও মিডিল ইস্টের বড় নেটওয়ার্ক, মধ্য এশিয়া ও বাল্কানের আল-কায়েদাদেরা এই অলিম্পিকের জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে চিন্নিত করা হচ্ছে। যা কিনা ‘সিআইএ’ এর বড় অ্যাসেট।

বলার প্রয়োজন পরেনা যে মস্কো এটি খুব ভাল করেই জানে – আল-কায়েদা সিআইএ এর বড় অস্ত্র এবং তাঁরা গোপনে তাঁদেরকে সহায়তা করছে এই অলিম্পিক আসরে ভীতি ছড়ানোর জন্য।

Within the Russian military and intelligence establishment, this is known, documented and discussed behind closed doors. Yet at the same time, it is a “forbidden truth”. It is taboo to talk about it in public or to raise it at the diplomatic level. Washington knows that Moscow knows: “I know you know I know”.

The more fundamental questions which both the Russian and Western media are not addressing for obvious reasons:

  • Who is behind the Caucasus terrorists?
  • What geopolitical interests would be served, were the US and its allies to decide to trigger a “False Flag” terror event before or during the Sochi Olympic Games?

আমাদের মনে রাখা দরকার চেচনিয়া জিহাদিদের সাথে ন্যাটোর একটি যোগসূত্র আছে। ন্যাটো আমেরিকার সঙ্গী। নিম্নোক্ত লিঙ্কটি দেখে নিতে ভুলবেন না।

http://www.boilingfrogspost.com/2011/11/22/bfp-exclusive-us-nato-chechen-militia-joint-operations-base/

 

গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে স্বৈরতন্ত্র আপাততঃ প্রবল হয়েছে, তবে লড়াই চলবে

by মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

বাংলাদেশে ‘নির্বাচিত’ গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র জেঁকে বসেছে। আর প্রতিরোধ আন্দোলনের বন্ধ্যাত্ব সামষ্টিক মানসে এনেছে হতাশা আর নির্বেদ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম বাঙালি মুসলমানের সামষ্টিক চেতনায় একটি উজ্জীবন সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও তৎকালীন সার্বিক মাৎস্যন্যায় জাতির মানসে সেই উজ্জীবনকে ক্ষণস্থায়ী করে বয়ে এনেছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী অবসাদ ও ক্লেদ। জাতীয় মানসের সেই বিষণ্ণ নির্বেদ ও স্বপ্নভঙ্গজাত আত্মগ্লানি ও আত্মপ্রত্যয়রিক্ত দিকনির্দেশহীনতা থেকে বাংলাদেশকে পুনরায় জেগে উঠতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত।

কিন্তু ২০১৪ সালে এসে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। প্রাণহীন খোলসসর্বস্ব গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। সংবিধান একটি অন্তর্বিরোধপূর্ণ দলিলে পরিণত হয়ে জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতিফলনে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় সংসদ অকার্যকর একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্রের নামে দলীয় গোষ্ঠীতন্ত্র প্রবল হয়ে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নকে সর্বব্যাপী করে তুলেছে। গণতন্ত্রের যে একটি অনুসঙ্গ এতদিন জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণকে অন্তত একদিনের জন্য হলেও সম্ভবপর করেছে, সেই নির্বাচনকেও যাচ্ছেতাই রাজনৈতিক ব্যভিচারের মাধ্যমে একটি প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।

আর জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার এই অধোগতির ধারাকে প্রতিরোধ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করার যে রাজনৈতিক আন্দোলন ও নেতৃত্ব আমরা বর্তমানে দেখতে পাই তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত ও দুর্বল। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক দুর্বলতা যেমন রয়েছে, তার চাইতেও বেশী রয়েছে মতাদর্শিক, রণনৈতিক ও রণকৌশলগত অপরিপক্কতা ও অদূরদর্শিতা। মেধাবী, মননশীল ও সৃজনশীল নেতৃত্ব ও কর্মসূচির অভাবে প্রতিরোধ সংগ্রাম ও আন্দোলন গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ। জনসম্পৃক্ত মতাদর্শ, নেতৃত্ব, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মপ্রয়োগের অভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন বন্ধ্যাত্বের চোরাবালিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শুধুমাত্র পেশিশক্তিনির্ভর ও ফায়দালোভী রাজনৈতিক পেশাদারদের দিয়ে ব্যাপক গণভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী করা যায় না। ‘নির্বাচিত’ স্বৈরতন্ত্র এই সুযোগে ক্রমাগত ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠে এবং দেশী-বিদেশী সমর্থক গোষ্ঠীর সহায়তায় আরও সুসংহত হতে থাকে।

জাতীয় চেতনায় মনঃস্তাত্ত্বিক শূন্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, একটি সংঘবদ্ধ, সুসংহত, মতাদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংগঠনের জনসম্পৃক্ত ব্যাপক প্রতিরোধ সংগ্রামের অনুপস্থিতির কারণে একটি জাতিব্যাপী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মনঃস্তাত্ত্বিক শূন্যবোধের উদ্ভব ঘটেছে। এই বাস্তব ও ব্যাপক নিটশীয় শূন্যবোধের প্রতিক্রিয়ায় জাতির সংবেদনশীল ও মননশীল চেতনা ও মানসে এক যন্ত্রণাকাতর, বিষণ্ণ মনোবেদনা ও ব্যর্থতাজাত অবসাদ অনুভূত হচ্ছে। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া অথবা সাফল্য ব্যর্থতা থেকে এই সামষ্টিক বেদনা ও যন্ত্রণা পরিমাণগত ও গুণগত উভয়দিক থেকেই আলাদা। জাতি, দেশ, রাষ্ট্র প্রভৃতি নিয়ে যেসব মননশীল ও সৃজনশীল নাগরিকেরা ভাবেন ও সক্রিয় হবার চেষ্টায় ও চর্চায় ব্যাপৃত থাকেন, তাঁরা যে সামাজিক শ্রেণী ও স্তরেই অবস্থান করুন না কেন, তাঁদের চেতনায় ও মননে এই জটিল ও কুটিল সংকটজাত সংবেদনা ও সংক্ষোভ প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হবেই। আর এই মনোবেদনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হল অসংগঠিত ও অসংবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন ও বিযুক্ত ব্যক্তি-নাগরিকদের একান্ত অপারগতাজাত অসহায়ত্ববোধ ও তৎসংলগ্ন আত্মগ্লানি ও অপরাধবোধ।

উত্তর-ঔপনিবেশিক ও উত্তরাধুনিক জাহিলিয়া

এই বিষয়টি খোলাসা করতে মহামতি কার্ল মার্ক্সের একটি বিখ্যাত উক্তির আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন যে দার্শনিকেরা এ যাবৎ ইতিহাসের শুধু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মধ্যেই নিজেদেরকে ব্যাপৃত রেখেছেন, কিন্তু যা আরো বেশী কাম্য তা হল ইতিহাসের পরিবর্তনের জন্য কাজ করা, শুধু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নয়। বুদ্ধিবৃত্তির এই মহান দায় কাঁধে নিলে যে কোন মননশীল নাগরিক একধরণের বিদগ্ধ অপারগতার মনোযন্ত্রণায় আক্রান্ত হতে বাধ্য। জাতি-দেশ-রাষ্ট্র বিবর্তনের এমন এক বন্ধ্যা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যখন সামাজিক শুভশক্তিগুলো নিঃসঙ্গ, বিযুক্ত, অসংঘবদ্ধ ও নেতৃত্বহীন আর সামাজিক অশুভশক্তিগুলো দেশী-বিদেশী প্রেক্ষাপটে অনেক বেশী একাট্টা ও সক্রিয়। সর্বব্যাপী আঁধি, নেতি ও অকল্যাণের এই কৃষ্ণপক্ষকেই বোধকরি উত্তর-ঔপনিবেশিক ও উত্তরাধুনিক জাহিলিয়া বলে বয়ান করা যেতে পারে। কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বায়নের মাধ্যমে যখন পৃথিবীব্যাপী একধরণের পণ্যসম্ভোগবাদী ও আগ্রাসী বিশ্বব্যাবস্থা কায়েম করেছে, তখন নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক ব্যক্তি, শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জাতি হিসেবে স্বাধীনভাবে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো অনেকাংশেই অপসৃয়মান।

বিশ্ব মুসলিম সভ্যতার নবজাগরণ ও বাংলাদেশ

এর সঙ্গে রয়েছে মহান এক আল্লাহর প্রতি সমর্পণকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠাকামী আত্মিক শ্রেয়োবোধ ভিত্তিক বিশ্ব মুসলিম সভ্যতার নবজাগরণকে নস্যাৎ করতে সদা সতর্ক ও প্রস্তুত পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন সভ্যতার একক অথবা যৌথ যুদ্ধাভিযান। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এই আন্তর্জাতিক সমীকরণের বাইরে নয়। ‘জঙ্গিবাদ’, ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’ দমন বা নির্মূলের দোহাই দিয়ে গণতন্ত্রের ন্যূনতম পূর্বশর্তগুলোকে উপেক্ষা ও বিসর্জনের বিপজ্জনক ডিসকোর্স আমরা বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরেই শুনতে পাই। এই ডিসকোর্সের তাত্ত্বিক গুরুরা প্রকারান্তরে জুডিও-খ্রিষ্টান নব-ক্রুসেড ও ভারতীয় আধিপত্যবাদকেই প্রমোট করে চলেছেন।

চাই আত্মিক চেতনায় বলীয়ান আদর্শভিত্তিক নতুন সৃজনশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি

কাজেই বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই চলছে এর যেমন একটি দেশী প্রেক্ষিত রয়েছে, তেমনি এর রয়েছে একটি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত। তাই ব্যক্তি, শ্রেণী, সম্প্রদায় ও জাতি হিসেবে উপনিবেশ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ক্রমাগত বিকাশ ও উত্তরণের যাত্রায় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ হয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে স্বাধীনতা ও মুক্তির অভিযাত্রা, সেখানে একটি অভিজ্ঞতা বারবার বেঠোফেনের পঞ্চম সিম্ফনির বিখ্যাত থিমের মত বেজে উঠেছে। আর সেটা হল গণতন্ত্রকে দুর্বল করে ও স্বৈরতন্ত্রকে প্রবল করে কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম হতে পারেনি। অন্যদিকে বন্ধ্যা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পুনর্গঠিত হয়ে, অথবা পরিবর্তিত হয়ে অথবা নতুন জনসম্পৃক্ত ও আত্মিক চেতনায় বলীয়ান আদর্শভিত্তিক শক্তির আগমনের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ও প্রগতি বেগবান হয়েছে নানান পালাবদলের মধ্য দিয়ে।

সুতরাং ব্যক্তির একক ও জাতির সামষ্টিক চেতনায় যে সর্বগ্রাসী অবসাদ, হতাশা ও নির্বেদ ইতিহাসের পর্ব-পর্বান্তরে নেমে এসেছিল তা যেমন নতুন সৃজনশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির অভিঘাতে কেটে গিয়েছিল, আশা করা যায় যে এখনকার বন্ধ্যা প্রতিরোধ সংগ্রামও নতুন উদ্যোগে, নতুন কৌশলে, নতুন নেতৃত্বে সফল হয়ে অচিরেই সামষ্টিক মননের তমসা ও স্থবিরতার অবসান ঘটাবে।

আলহামব্রা – ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী

2

By শঙ্খচিলের ডানা :

“Rising up above the Red Hill, the royal city of the Alhambra stands proud and eternal, one of the most important architectural structures of the Middle Ages and the finest example of Islamic art left to us in the western world.”

“একগুচ্ছ পান্নার মাঝে যেন একটি মুক্তা” – মুরিশ কবিরা এমনভাবেই বর্ণনা করেছেন আলহামব্রার সৌন্দর্য! স্পেনের মুসলিম সভ্যতা ও স্থাপত্যের শীর্ষ আকর্ষণ গ্রানাডার আলহামব্রা প্রাসাদ ও দুর্গ। নবম শতকে দক্ষিণ স্পেনের সাবিকা পাহাড়ের (Assabika hills) ওপর নির্মিত একটি দুর্গের ভিত্তির ওপর একাদশ শতাব্দীতে আলহামব্রা দুর্গ-প্রাসাদের পত্তন ঘটান স্পেনের শেষ মুসলিম শাসকগোষ্ঠী নাসরিদ বংশের মোহাম্মদ বিন আল আহমার এবং এর পরিবর্তন-পরিবর্ধন চলে পরবর্তী দেড়শ বছর। সমসাময়িক বাইজেন্টাইন এবং আব্বাসীয় মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব ছাড়াও আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় সুদীর্ঘ আটশ বছরের মুসলিম স্থাপত্যের পরম্পরা এবং নিজস্ব শৈল্পিক উদ্ভাবনার মিশেল ঘটিয়ে তৈরি হয় স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত বিশেষ ধরণের লাল মাটিতে নির্মিত দুর্গ-প্রাসাদ ‘আলহামব্রা’ যার নামের আক্ষরিক অর্থ The Red.

আলহামব্রার স্থাপত্যশৈলী ও অলঙ্করণে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে অশ্বখুরাকৃতির খিলান (Calliphal horseshoe arch), জটিল রম্বস আকৃতির আলমোহাদ সেবকা (the Almohad sebka – a grid of rhombuses), আলমোরাভিদ পাম (the Almoravid palm), এবং ত্রিমাত্রিক মুকারনাস ( Muqarnas – stalactite ceiling decorations).

Portico and Pool

The Court of the Lions

Decoration of the Court of the Lions

The Hall of the Ambassadors – a mirador with elaborately ornate walls and ceiling

ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যস্বরূপ আলহামব্রাতে খুঁজে পাওয়া যায় জান্নাতের বর্ণনা অনুযায়ী সৌন্দর্য ও শান্তিবর্ধক রূপে চলমান পানি ও ফোয়ারা, আলো-ছায়া, এবং পত্রপুষ্প-শোভিত বাগানের নয়নাভিরাম ব্যবহার –

The Court of the Water Channel

Sultana’s Garden

আলহামব্রার স্থাপত্যশৈলীতে অলংকার হিসেবে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ত্রিমাত্রিক মুকারনাস (Muqarnas – honeycombed stalactite ceiling decorations) যা দশম শতাব্দীতে পারস্য এবং নর্থ আফ্রিকায় প্রায় একইসাথে উদ্ভাবিত মুসলিম স্থাপত্যকলার অনন্য সংযোজন –

Use of Muqarnus in the Hall of the Abencerrajes

Use of Muqarnus in the Alhambra

Arabesque around the windows

ইসলামি স্থাপত্যের অনবদ্য নিদর্শনস্বরূপ আলহামব্রায় খুঁজে পাওয়া যায় জ্যামিতিক নকশা ও ক্যালিগ্রাফির জটিল ব্যবহার। কেবল একটি বিশেষ স্তবকই আলহামব্রার স্থাপত্যে উৎকীর্ণ হয়েছে ৯০০০ বার – لا غالبَ إلا الله (La ghaliba illa Allah – ‘There is no Conquerer but Allah’)

Wa la ghaliba illa Allah – calligraphy on the walls of Alhambra

কেবল নয়নাভিরাম অলঙ্করণই নয়, দুর্গ-প্রাসাদের নিরাপত্তা রক্ষায় ১৩টি ওয়াচ টাওয়ারসহ শক্ত প্রাচীরে ঘেরা আলহামব্রায় গড়ে তোলা হয়েছিল বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পাহাড়ের উপরে নির্মিত আলহামব্রা কমপ্লেক্সে পার্শ্ববর্তী ডারো নদীর (the river Darro) পানি কি ভাবে নদীর উৎসে বাঁধ দিয়ে পাহাড়ের ভেতরে সুড়ঙ্গ কেটে কৃত্রিম প্রণালী ও জলাধার নির্মাণ ও জলশোধন-ব্যবস্থা সহযোগে বহুদুর টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা আজও বিস্ময় জাগায়!

১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রাণী ইসাবেলার হাতে গ্রানাডার পতনের সাথে সমাপ্তি ঘটে আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় সুদীর্ঘ আটশ বছরের মুসলিম সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের। আগ্রাসী রিকনকিস্তার (Reconquista) জন্য গ্রানাডা ছিল একটি অনন্য বিজয় – বিপুল ধন-সম্পদ ছাড়াও পুরো ইউরোপে মুসলিম স্থাপত্যের শিরোমণি হিসেবে বিবেচিত আলহামব্রা প্রাসাদ তাদের কুক্ষিগত হয়। পরবর্তীকালে আলহামব্রা প্রাসাদ বারবার লুন্ঠিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং কালক্রমে পরিত্যক্ত হয়। দুর্গ-প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ ধ্বংস করে অপরিকল্পিত ও বেমানানভাবে গড়ে তোলা হয় অন্যান্য স্থাপত্যকর্ম – যেমন ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত পঞ্চম চার্লস (Charles V) এর প্রাসাদ। রেনেসাঁযুগীয় স্থাপত্যশৈলীসহ শক্তিশালী উপস্থিতি প্রমাণ করলেও লাস্যময়ী আলহামব্রা প্রাসাদের তুলনায় তা প্রাণহীন, শীতল, জগদ্দল পাথরসম। অবশেষে উনবিংশ শতকে ইউরোপীয় পরিব্রাজক এবং পন্ডিত ব্যক্তিদের উৎসাহে আলহামব্রা দুর্গ-প্রাসাদের পুনরুদ্ধারকাজ শুরু হয়। অধুনা আলহামব্রা স্পেনের সবচাইতে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশন গুলোর একটি। তিলোত্তমা আলহামব্রা এখন একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট – যুগেযুগে অসংখ্য গল্প, কবিতা, ও গানের অনুপ্রেরণা!

The Palace of Charles V in the Alhambra

আলহামব্রার ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী সম্পর্কে আরও বিশদ ভাবে জানতে চাইলে দেখুন –

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ‘সন্ত্রাসবাদ’ আর ‘মিথ অব ইন্ডিফেন্ডেন্স’ এর পুনর্পাঠ

খন্দকার রাক্বীব, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের ‘ওয়ার অন টেরর’ প্রকল্পের আওতায় গত বছর যে ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন’ পাস করেছে তার ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী স্বরূপ দিন দিন উন্মোচিত হচ্ছে। ৭৪এর বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো এই কালো আইনকে রুখে দেওয়া রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য। এক্ষেত্রে জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রবর্তিত ‘মিথ অব ইন্ডিফেন্ডেন্স’ আর সলিমুল্লাহ খান প্রবর্তিত সন্ত্রাসবাদ কেন্দ্রিক ‘ত্রাসনীতিঃ বিচার না বারোয়ারী’ এর পুনর্পাঠ জরুরী। জানার কথা যে, সন্ত্রাসবাদের এংরাজি প্রতিশব্দ ‘টেররিজম’এর উৎপত্তি মূলত ফরাসি দেশে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। সেকালে জনগণের বড় বড় আন্দোলন রোধ করার মতলবে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র বা সরকার সমাজে ভয়ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করতেন। এই ধরণের চেষ্টার নাম-ই এক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছিল ‘টেররিজম। জগতখ্যাত ফরাসি বিপ্লবের বিশেষ এক বছরে ১৭৯৩-৯৪তে ডাক্তার গিয়োটিন প্রবর্তিত যন্ত্র তলোয়ারে যখন আনুমানিক বিশ হাজার লোকের মাথা কাটা হয়, তখনকার সময়কেই প্রথম বিবেচনা করা হয় ‘রেইন অব টেরর’ হিসেবে। যার বাঙ্গালায় সহজ বয়ান এখন ত্রাসের রাজত্ব।

সন্ত্রাসবাদের এই বয়ান জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার মূল দোসর জোসেফ কনরাডোর মত ঔপোন্যাসিকরা আর নীৎসেদের মত নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকরা। যার নজির আমরা বিংশ শতাব্দীতে আমাদের এই দেশে দেখেছি। যখন এখনকার মানুষদের অসহযোগ, অহিংস, খেলাফত আর সত্যাগ্রহের মত স্বাধিকার আন্দোলনের লড়াইগুলোকে ত্রাস হিসেবে হাজির করা হয়েছে। যেমন এখন করা হচ্ছে জায়নিস্ট কর্তৃক ফিলিস্তিনি মুসলমানদের আর সিসি কর্তৃক মিসরীয় মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিতকরণ। দেশে দেশে সংঘঠিত জনগণের আন্দোলনকে এভাবেই সাম্রাজ্যবাদীদের ‘ওয়ার অন টেরর’এর আওতায় আনা হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সম্প্রতি নিজেকে এই প্রকল্পে জড়িয়ে ফেলছে, যার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ।

জানা কথা যে, টেররের সাথে টেরিটরি তথা ভূখণ্ডের এক ধরণের সম্পর্ক থাকে। দুনিয়া তাবত বর্তমান সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে যুদ্ধরত একমাত্র গোষ্ঠী আল-কায়েদা যখন ৯/১১এর ঘটনায় অভিযুক্ত হল, তখন-ই এই সন্ত্রাস আর টেররের সংজ্ঞা নিয়ে গবেষক আর ভাষাতাত্ত্বিকরা বিপাকে পড়ে গেলেন। এক কালের নাস্তিক দেরিদা যখন থেকেই তাঁর অবিনির্মাণ তত্ত্ব নিয়ে জ্ঞানরাজ্যে হাজির হন, তখন থেকেই এই ‘টেররিজম’ ধারণার সমালোচনা করে আসছেন। কিন্তু এই জ্ঞানরাজ্যে আল কায়েদা প্রশ্ন হাজির হওনের সাথে সাথে তিনি নিজ অবস্থান থেকে কেমন করে উল্টে গেলেন।

এশিয় মুসলিমদের খেলাফতি পতনের পর হেজেমনিক পশ্চিমা কর্তৃক তৈয়ার করা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাওয়া ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ‘ইন্ড অব দ্যা হিস্ট্রি’র মত দেরিদা তাঁর ‘philosophy in the time of violence’এ পরিষ্কারভাবে বলেছিলেনদুই দলের এক দলকে যদি আমার বেছে নিতেই হয় তো আমি আমেরিকা আর ইউরোপকেই বেছে নিব। আমেরিকা আর ইউরোপের বিরুদ্ধে, তাদের রাজনীতির চেহারা আর ‘সন্ত্রাসবিরোধি জোট’ নিয়ে আমার অনেক নালিশ। তবু আমি শত দোষ সত্ত্বেও আইন যাদের পক্ষে আর যারা শত সত্য সত্য বেঈমানি আর ওয়াদাভাঙ্গার বৈফল্য সত্ত্বেও গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক বিধি ও ব্যবস্থার পক্ষে একজোট শেষবিচারে সেই দলেরই পক্ষ নেব।”

সলিমুল্লাহ খানরাও এরকম ২০০৫সালে লেখা ত্রাসনীতির প্রশ্নে মজলুমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাদের জন্য কলম ধরেছিলেন, কিন্তু আজ শেষ বিচারের সময়গুলোতে আর মজলুমের পক্ষে রইলেননা, তাদের বিরুদ্ধেই নব নব তত্ত্ব হাজির শুরু করলেন।

জীবনের সায়াহ্ন বেলায় দেরিদার গুরু লাকা নিজেদের অবস্থান ভুল বুঝতে পেরে স্বীকার করেছিলেন, পশ্চিমা সভ্যতার কথিত অনুন্নত দুনিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ার অন টেরর বর্ণঘৃণা আকারে হাজির হবে। তাঁর বক্তব্য যথার্থতার দিকেই আগাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে সলিমুল্লাহ খানদের ‘মিথ অব ইন্ডিফেন্ডেন্স’ আর নব সন্ত্রাসবাদের বয়ান জনগণের সামনে ঘৃণা আকারে সেরকম হাজির হতে পারে। যদি না তারা ওয়ার অন টেররের তাৎপর্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে না পারেন, বুঝতে না পারেন জনগণের মনের কথা, হাজির না করতে পারেন ‘মিথ অব ইন্ডিফ্যান্ডেন্স’এর বদলে ‘ফ্যাক্ট অব ইন্ডিফেন্ডেন্স’এর বয়ান।

 

পাদটীকাঃ রাষ্ট্র মানেই সন্ত্রাস, তবে সন্ত্রাস মানেই রাষ্ট্র না (হেবারমাস, ২০০৩)।