আওয়ামিলীগের প্রহসনের বিচার কাদের মোল্লাকে কিংবদন্তী বানিয়ে দিলো।

মাহবুব মিঠু।

কিছু প্রশ্নের উত্তর অমিমাংসিত রেখেই কাদের মোল্লার ফাঁসীর রায় কার্যকর হোল। অস্বিকার করার ‍উপায় নেই, আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মুসলিম লীগ এবং জামাতে ইসলামের ভূমিকা ছিল দেশের বিপক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের গোটা নয় মাস জুড়ে এই দুই দল সারাদেশে পাকীদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক সূর্য সন্তানকে হত্যা করেছিল। ১৪ই ডিসেম্বর, শুধুমাত্র একদিনে তারা খুন করেছিল অগনিত মানুষকে। তাই ৭১ এর নৃশংসতার শাস্তি জড়িতদের অবশ্যই প্রাপ্য।

এই বিষয়ে কারো প্রশ্ন থাকলে সে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয়। পুরো বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আজ জাতি যে দ্বিধাবিভক্ত তার উৎসমূলেও কিন্তু “যুদ্ধপরাধীদের বিচার করা যাবে না” তাও নয়। বিভক্তির জায়গাটা একটা নৈতিক অবস্থান থেকে। বিচার প্রক্রিয়ার দলীয়করণ চরিত্র দেখে বিবেকবান মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এটা কি ’বিচার নাকি প্রতিশোধ’? প্রতিশোধই যদি নিতে হবে তাহলে ট্রাইবুনাল গঠন করে, এতো এতো লোকজনের বেতন ভাতার ব্যাবস্থা করে জনগণের ট্যাক্সের টাকার শ্রাদ্ধ কেন? আওয়ামিলীগের দৃষ্টিকোণে প্রতিপক্ষের যাকে যাকে মনে হয় যুদ্ধপরাধী তাদের সোজা ধরে এনে লটকে দিলেই হয়!

মূলতঃ বিচার নাকি প্রতিশোধ, এই নৈতিক অবস্থান থেকে সরে যারা কাদের মোল্লার ফাঁসী নিয়ে মাতামাতি করছেন তাদের অপরাধের প্রকৃতিও কিছুটা সেই ৭১ এর ঘাতকদের মতোই জিঘাংসা থেকে উদ্ভুত।

স্বাধীনতার চেতনার একটা বড় অংশ ছিল সমাজে ন্যায় বিচার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। শুরু থেকে যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকার যে প্রহসন করেছে তাতে কি মনে হয় স্বাধীনতার এই চেতনার কোন সংযোগ ছিল? সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বিচার প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হয়। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হোল, বিচার কাজে সুষ্ঠুতা  দিতে সরকারের যে অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সেই আইন বিভাগের প্রধান আইনমন্ত্রী, সদা বাচালতায় স্বিদ্ধহস্ত কামরুল ইসলাম এবং তার পরিবার নিয়ে যুদ্ধপরাধ সংক্রান্ত যথেষ্ট অভিযোগ আছে। বেয়াইর কথা বাদই দিলাম। লিখতে লিখতে ক্লান্ত। রাষ্ট্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের তৎকালীন প্রধান মহিউদ্দিন খানের বিরুদ্ধে স্বয়ং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধপরাধের অভিযোগ তুলেছেন। এভাবে দেখতে গেলে বর্তমান আওয়ামিলীগ করছেন জীবিত এমন অন্ততঃ তিন ডজন রাজাকার এবং যুদ্ধপরাধী নেতা আছেন, যাদের কাউকেই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। এই লিষ্ট বিএনপির করা নয়। এটা করেছিলেন প্রয়াত জাহানারা ইমাম।  যুদ্ধপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত সালাহউদ্দিন কাদেরের একটা উক্তি বেশ মজার! তিনি বলেছিলেন, আওয়ামিলীগ এমন একটা কল যার একদিক দিয়ে রাজাকার ঢুকালে অন্যদিক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে বের হয়। তবে আমরা দেখেছি মুখ দিয়ে খাবার ঢুকালে পাছা দিয়ে হাগু বের হয়। অর্থাৎ কোন ভাল মানুষ আওয়ামিলীগ করলে সে আবুল হোসেন হয়।

আরেকটি হাস্যকর দিক এড়িয়ে যাবার নয়। ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ নামে পরিচিত লাভ করা সেই ঘাদানিকের প্রধান শাহরিয়ার কবির যুদ্ধের সময় পাক আর্মিদের মুরগী সাপ্লাই দিত। এরাই হোল বিচারের সংগঠক এবং ব্যবস্থাপক। বুঝুন এবার!

এই ঘটনা উল্লেখ না করলে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।  গত ফেব্রুয়ারী মাসে এই কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে যে সত্যিকারের গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের উপস্থিতি কমে কেন রায় বাস্তবায়নের সময়ে শতেক খানেক লোকে এসে ঠেকল? আজকে তো কোটি জনতার উল্লাসে মুখরিত হবার কথা ছিল শাহবাগ চত্ত্বর। খুব তাড়াতাড়ি সত্যিকার স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ বুঝতে সক্ষম হয় তারা সরকারের পাতানো জালে আটকে যাচ্ছে। বন্যার পানি সরে যাবার মতো তাই দ্রুততার সাথে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও কমতে থাকে। মূলতঃ এই ট্রাইবুনালের রায় স্বাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে কিম্বা অপরাধের মেরিট অনুযায়ী যতোটুকু দেয়া হয়েছে তার চেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছে সরকারের ইশারায়। কাদের মোল্লার রায়ে দেয়া যাবজ্জীবন ছিল পুরো খেলার একটা অংশ। সরকার দুর্নিতি, ভারতপ্রীতি, মানুষ অপহরণ, গুম নিয়ে যে ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিল সেখান থেকে উত্তোরণের জন্য এই প্রহসনের খেলা জরুরী ছিল। যদিও শেষমেষ খেলা জমাতে পারে নাই। রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনতা শাহবাগে ভীর জমাতে থাকে। শ্লোগান ওঠে, জামাতের সাথে ’সরকারের’ এই আঁতাতের রায় মানি না। দু’দিন না যেতেই শাহবাগের সেই আন্দোলনের ভিতরের কুশীলবরা আসল পরিচয় নিয়ে হাজির হয়। শুরুতে সরকার ভিলেন থাকলেও তারাই ধীরে ধীরে মঞ্চে এসে নায়কের চরিত্রে অভিনয় শুরু করে। আরো ক’দিন যেতেই মূল ইস্যু অর্থাৎ যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসীর দাবীর পরিবর্তে সামনে আসে বিএনপি বিরোধীতা।   বিএনপির এ্যানির নেতৃত্বে প্রাক্তন ছাত্রদলের অনেক নেতা ‘নব্বই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতার’ ব্যানারে শাহবাগের সেই প্রথমদিককার সত্যিকার গণজাগরণে একাত্নতা প্রকাশ করতে চেয়েছিল। আজকে আওয়ামিলীগ কর্তৃক পিতৃ সম্পত্তি হারানোর শোকে কাতর অঞ্জন রায় কার সাথে পরামর্শ করে তখন এ্যানিকে ‘না’ করেছিলেন? কেনই বা ‘না’ করেছিলেন? এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর পাই নাই তাকে জিজ্ঞেস করে। বাইন মাছের মতো পিছল কেটেছেন।

অঞ্জন রায়কে আরেকটি প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিলেও এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতেও সাহস পাননি। কয়েক সপ্তাহ আগে আমার ফেইসবুকের নিউজফিডে অঞ্জন রায়ের একটা পোষ্ট ভেসে ওঠে। মন্তব্য করতে না করতে মেসেজ আসে, পোষ্টটা ডিলিট করা হয়েছে। ওখানে অঞ্জন রায় লিখেছিলেন যা তার সারমর্ম হোল, তিনিও অনেক আশা নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের সাথে একাত্নতা দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মূল চেতনার সাথে লাইনচ্যুত হওয়ায় তিনি আর পূর্বের অবস্থানে থাকতে পারেননি। উল্লেখ্য, ওনার লেখার ভাষাটা আমি দিতে পারব না। কারণ উনি মুহুর্তের মধ্যে সেটা মুছে দিয়েছেন। যেহেতু আমি একবার পড়তে সক্ষম হয়েছিলাম, তাই মূল কথাটা আমার নিজের ভাষায় লিখে দিয়েছি। অঞ্জন রায়কে প্রশ্ন করেছিলাম কিসের এবং কাদের ভয়ে পোষ্টটা মুছলেন? কি কারণে আপনার অবস্থানের এই পরিবর্তন? উনি নিরব থেকেছেন। আমার মনে হয়েছে অঞ্জন রায়ের সরকারের বিরুদ্ধে যতোটুকু অবস্থান সেটা শুধুমাত্র পিতৃসম্পত্তি হাতছাড়া হবার শোকে। বাকী আনুগত্য ঠিকই আছে। সম্পত্তি ফিরে পেলে পুরোটাই ঠিক থাকবে।

যাইহোক, গণজাগরণ মঞ্চের হঠাৎ ইউটার্ন নেয়া দেখে কারো বুঝতে বাকী থাকল না, কেন কাদের মোল্লাকে ফাঁসী নয় , যাবজ্জীবন দন্ড দেয়া হোল। কেনই বা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হোল। তারপরেও এখনো কিছু মানুষ গণজাগরণ নিয়ে ভ্রান্তিতে আছেন। তাদের তুলনা শুধুমাত্র নেশাগ্রস্ত মানুষদের সাথে করা যায়। এ এক অদ্ভুদ বাতিকগ্রস্ততা! মনুষ্য সমাজের অনেকেই নিজের অবস্থান ঠিক করতে নিজের মাথা না খাটিয়ে চোখ খাটাতে ভালবাসেন। মাথা অর্থাৎ নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ না করে অন্যের আচরণ দেখে স্বিদ্ধান্ত নেন। মনে পড়ে ছোটবেলায় হাতাকাটা ভোজেন (নামটা ভুল হতে পারে। অনেক ছোটবেলার কাহিনী।) গেঞ্জী পড়ে ‍চুলের দুইদিকের চিপ কানের উপর বরাবর কেটে ভাব নেয়াটাই ছিল ফ্যাশন। স্কুলের অঙ্কের শিক্ষকের চুল টানা খেয়ে শুধরে নিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সিগারেট ফুঁকাও অনেকের কাছে স্মার্টনেস! এই ধরনের ’চোখে দেখে’ স্বিদ্ধান্ত নেবার মতো কিছু লোক এখনো আছে। এরা ’বিচার’ এবং ‘প্রতিশোধ” কিম্বা ‘প্রতিপক্ষকে দমনের’ সরকারী কৌশল বুঝে কিম্বা না বুঝে শুধুমাত্র ‘আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী’ এই তকমা পাবার জন্যই এতদসংক্রান্ত সরকারের সমস্ত অপকর্মে নিজেদের বিবেককে বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতার মূল চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিকে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর ক্ষেত্রে। এই বিচার প্রক্রিয়ার পক্ষে অবস্থান নেবার অর্থ হোল কলঙ্কিত এবং পক্ষপাতদুষ্ট বিচার প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানানো। অর্থাৎ স্বাধীনতার চেতনা যা কিনা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া।

আরো কিছু জিজ্ঞাসার কোন উত্তর পায়নি জনগণ। আওয়ামিলীগের প্রাক্তন এমপি রনির দু’টো লেখায় উঠে  এসেছে কিছুটা। এই কাদের মোল্লা কি সেই ঘৃণিত কসাই কাদের মোল্লা?

কাদের মোল্লার দাবী ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সে জেসিও মফিজুর রহমানের কাছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ধলা মিয়ার দুই মেয়েকে যুদ্ধচলাকালীন সময়ে কাদের মোল্লার দাবী মোতাবেক তিনি প্রাইভেট পড়াতেন।

কসাই কাদের খ্যাত এতো বড় একজন খুনী কি করে যুদ্ধের ঠিক এক বছর পরে ৭২-৭৩ সালে বাঙলাদেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পেল? কি করেই বা সে শেখ মুজিবের আমলে স্কুলে চাকরী পেল?

এর একটা প্রশ্নের উত্তরও আমাদের কাছে পরিস্কার নয়।

উপরের দাবীগুলোর সত্যতা বা মিথ্যা প্রমাণে সরকার কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিল আমরা তা জানি না। এই অস্বচ্ছতা অনেক মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। নামের কারণে যমে টানল না তো বেচারাকে? এই বিভ্রান্তি আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়বে। উত্তর না মিললে এক সময় এটা বিশ্বাসে পরিণত হবে।

যুদ্ধপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের দিন ঢাকা আতঙ্কের নয়, বরং উৎসবের নগরী হবার কথা ছিল। যে আকাঙ্খিত রায়ের বাস্তবায়ন নিয়ে আজ সারাদেশে সম্মিলিত আনন্দ উৎসব হতে পারত, বর্তমান সরকারের ঘৃণ্য এবং একপেঁশে বিচার প্রক্রিয়ার কারণে জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। আখেরে এই পুরো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জামাত শিবিরের উত্থান আরো ত্বরান্বিত হবে।

এতোগুলো প্রশ্নের উত্তর অমিমাংসিত রেখে আওয়ামিলীগ কাদের মোল্লার ফাঁসী দিয়ে যুদ্ধপরাধের বিচার কতোটুকু করতে পারল জানি না। তবে তড়িঘড়ি করে রায়ের বাস্তবায়ন করে কাদের মোল্লাকে অপরাধী হিসেবে নয়, একজন ইসলামী আন্দোলনের কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। আগামী অন্ততঃ কয়েক যুগ কাদের মোল্লার গল্প বলে শত শত মুসলিম যুবককে তারা দলে ভিড়াবে।

এমনটিই হয়তো চেয়েছিল আওয়ামিলীগ এবং তাদের একান্ত বন্ধু আমাদের প্রতিবেশী ভারত। বাঙলাদেশকে জঙ্গীবাদের ট্যাগ লাগাতে পারলে সুবিধা বিএনপির অনুকূলে নয়, সেটা যাবে এই দুই শক্তির পক্ষে। বাঙলাদেশ আফগানিস্তান হলে লাভ বিএনপির নয়, পুরোটাই সুদসহ মূলধন এই দুই শক্তির পকেটস্থ হবে।

কিভাবে?

এই বুঝটা যে সব মনুষ্য প্রজাতির নেই তাদের আমার লেখা পড়াটাই ভুল ছিল।

Mahalom72@msn.com