ফিরে যাওয়া

আবুধাবীতে ছোটখাটো একটা যাত্রাবিরতী – মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম – আবুধাবী ঢাকা রুটের যাত্রীরা উপচে পড়া বাক্স পেটরা নিয়ে বিমানে উঠবে এবং সাথে থাকবে ডিউটী ফ্রী শপ থেকে কেনা গোটা চারেক ব্যাগ ভরা সিগারেট কার্টুন, দুধ, পারফিউম, কম্বল ইত্যাদি। একটা বেশ কেওস এর জন্য রেডী হয়ে থাকা। ঈদ মাত্র তিনদিন পরে –

বিমানে বসে কিছুটা অবাক ই হলাম – ওভারহেড কম্পার্টমেন্ট গুলো গড়ের মাঠের মত খালি – সীট ও প্রায় অর্ধেক এর উপর খালি। তবে প্লেন ছাড়ার একেবারে আগে আগে – হুড়মুড় করে হাজির হোল শতের উপর যাত্রী। তবে এরা কিভাবে জানি কিছুটা ভিন্ন – কোথায় জানি কিছু একটা মিলছে না। প্রথম যা চোখে লাগল – এরা সবাই ঘরোয়া পোষাক পড়া – স্যান্ডেল, দু একজন তো লুঙ্গি পড়া। এদের কারো হাতেই কোন বাক্স পেটরা নেই – এমনকি একটি হাত ব্যাগ ও নেই। সবার হাতে স্ট্যেপল করা দু পাতা কাগজ। আমার পাশেই একজন, আশে পাশে এরা সবাই।

এর পর পরই প্লেন ছাড়ার সব আনুষ্ঠানিকতায় – ওদিকে আর মন দেয়া হয় নি- ক্রুইসিং লেভেল এ যাবার ঘোষনা শোনার পরই ল্যাপটপ খুলে ওদিকে মন দেবার চেষ্টা করছিলাম। আমার সারির উইন্ড সীটের তরুনের সাথে মাঝের সীটের যাত্রীটির কথা বার্তা শুনে আবার ভালো করে তাকালাম ওদের দিকে।

এই মিডল ইষ্ট ঢাকা রুটের ফ্লাইট গুল অভিভাসী বাংলাদেশীদের এক মিলন মেলায় পরিনত হয় – উইন্ডো সীটের তরুনটি লন্ডনে একটি কলজে প্রকশৌল বিষয়ে পড়াশোনা করে যুক্তরাজ্যেই কোথাও চাকুরী করছে। সে তীব্র আবেগ নিয়ে হৃদয় এর সবটুকু সহমর্মিতা নিয়ে মাঝের সিটের যাত্রীটির কথা শুনছে।

 

এই এয়ারক্রাফটে তারা ১১৭ জন আছে – ওদের সবাই মাত্র দুবাই জেল থেকে ছাড়া পেল, জেল থেকে বাসে করে বিমানবন্দরে নিয়ে এসে ওদের কে প্লেনে তুলে দেয়া হয়। সবাই ই আরব আমীরাতে বিভিন্ন শহরে আবৈধ ভাবে কাজ করছিল – কেউ ধরা পরেছে এক মাস আগে – কেউ ছয় মাস কেউ আরো বেশী সময় ধরে জেলে আছে।

একেক জনের একেক ধরনের গল্প। পাশের আইল সীটের তরুনের দিকে তাকালাম- শিশুর মত আগ্রহ নিয়ে অনভ্যস্ত হাতে সামনের এন্টারটেইনমেন্ট রিমোট নিয়ে দেখছে – এক হাতে মুখ মোছার টাওয়েল টা, মুখ না মুছে, খুব যত্ন করে ধরে আছে – আমি ই কথা শুরু করলাম –

ওর নাম কাদের – ভিসা আছে ওমানের- ওমানের ভিসা পাওয়া যায় – কিন্তু ওমানে চাকুরী নাই – আর আমিরাতে অনেক চাকুরী – কিন্তু আমীরাত ভিসা দেয় না। আগে বাংলাদেশে টঙ্গির কাছে এক বাজারে সবজী বিক্রি করত। আট মাস আগে সহায় সম্পদ সব বিক্রী করে ওমান এসেছিল – পরে টাকার বিনিময়ে অবৈধ ভাবে গভীর মরুভুমি দিয়ে দুবাই এসেছে – এবং এসে একটা কাজ ও করছিল। “ওই দিন কি যে হইল – কাম থিকা বাসায় ফিরতাছি – রাস্তার মধ্যে দেশী ভাই দাড়াইয়া আছে – আমারে ডাক দিল – গেলাম – গপ্প সপ্প শুরু করলাম – আর কোথা থিকা পুলিশ আইসা ধইরা লইয়া গেল আমাগো সবাইরে”।

এরা একেকজন একেক ভাবে এরেষ্ট হয়েছে – এক প্রৌড় ভদ্রলোক প্রায় ত্রিশ বছর আছে মধ্যপ্রাচ্যে – বললেন- “রাত তিনটার সময় যহন দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা শুনলাম – তখনই বুইঝা ফালাইলাম দেশে যাওয়ার সময় হইছে” । আমীরাত পুলিশ ইদানিং খুব এগ্রেসিভ ভাবে রাস্তা ঘাটে, বাসা, কাজে রেইড দিয়ে অবৈধ অভিভাসী শ্রমিক গ্রেফতার করছে। কেউ মাত্র দুশপ্তা হল প্রথম বারের মত বিদেশে এসেছে – এসেই ধরা পড়েছে ভুয়া ভিসার জন্য, কেউ ধরা পড়েছে তিন মাসের মাথায়, কেউ ত্রিশ বছর থাকার পর এমনিতেই পাততারি গুটাচ্ছিলেন।

 

বিমানের প্রতিটি যাত্রী গভীর সহমর্মিতার সাথে  ওদের কথা শুনছে – টুক টাক এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে – “জেলে কেমন ব্যাবহার করত” – আমি জিজ্ঞেস করি জনে জনে। কারো মাঝেই এই উত্তরের খুব একটা আগ্রহ নেই। এক জন একটু বিরক্ত ভাবেই বলে- “ আরে ওই গুলা মানুষ নি?”

 

জানা গেল – যেহেতু এরা মুসলমান দেশের ওবৈধ অভিভাসী – হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এই রোযার মাসে ওদেরকে সেহেরী আর ইফতারের সময় রুটী দেয়া হত। জিজ্ঞেশ করি জেল এর ভিতরের অবস্থা কেমন।

পাশের তরুন খুব আগ্রহ নিয়ে বলা শুরু করে – “ ভাই দুবাই জেল হইল পৃথিবীর দুই নম্বার জেল, এক নম্বার হইল অস্ট্রেলিয়ার জেল – আর দুবাই র টা দুই নাম্বার।“ ওর কথা শুনে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর দুই নম্বর জেলে থাকতে পেরে সে খুব ই গর্বিত।

 

জানতে চেষ্টা করি কেন আমিরাত পুলিশ এগুল করছে – একেক জন একেক কথা বলে- ওরা বড় পলিসি বঝে না। কেউ বলে “হাসিনা রাশিয়া রে ভোট দিছে, আমিরাত রে ভোট দেয় না- এইটা শুইনা আমিরাতীরা রাইগা গেছে”। আমি বলি ভারতীয় দের ও তো গ্রেফতার করছে – ওরা কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না।

একজন জানায় জেল ভরা পাকিস্তানী, ভারতীয় আর বাংলাদেশী। সে খুব সরল ভাবে ক্লাসিফাই করে – “ইন্ডিয়ান রা জেলে গেছে ব্যাঙ্ক, শেয়ার, টাকা পয়সা ঘাপলা করার লাইগ্যা, পাকিস্তানীরা জেলে গেছে চুরি, যচ্চুরী, খুন, জখম, রাহাজানী, বদমাইশী করার লাইগ্যা অ্যান্ড বাংলাদেশীয়া জেলে গেছে ভিসা না থাকার লাইগ্যা”।

 

বাংলাদেশের এম্বারকেশন ফর্ম ফিলআপ করে দিলাম অনেকের। ওদের সম্বল দুটি মাত্র কাগজ। একটা বাংলাদেশ দুতাবাসের এক কর্মকর্তার প্রত্যয়ন পত্র যে এরা বাংলাদেশী নাগরিক ( ওদের কারুর ই পাসপোর্ট নেই) – আরেকটি ছোট আরবী লিখা চিরকূট- সম্ভবত জেল কর্তৃপক্ষের রিলিজ লেটার।

 

এর মাঝে এয়ার হোস্টেস রা খাবার নিয়ে আসে- অনেকে রোযা- অনেকে বুভুক্ষের মত চেটে পুটে খেল একটু “ভাল” খাবার – অনেক দিন পর।

ওদের গিজ্ঞেস করলাম দেশে ফিরে যাবার টিকেট কিনে দিয়েছে কে। ওদের কোন ধারনাই নেই। বললাম “বাংলাদেশ সরকার নিশ্চয়?” –  দু তিন জন সমস্বরে থামিয়ে দিল “ হুর ভাই” – “বাংলাদেশ সরকার আমরার টিকেট কিনা দিত?  – আপনের মাথা খারাপ হইসে?”। “তাহলে নিশ্চয় আমিরাত সরকার” – আমি বলি। “ না না – ওগুলা তো জালীম। হেরা আমাগো টিকেট কিনা দিত না”। তাহলে কে কিনল এই টিকেট? কেউ জানে না। একজন ব্যাখ্যা দেয়- “এইদা সৌদি গো মিসকীন ফান্ড এর টাকা”। আমি বলি “ আমিরাত অবৈধ বাংলাদেশী ফেরত পাঠাচ্ছে – সৌদি আরব কেন খরচ দেবে”। কারো উত্তর নেই।

 

কেউ একজন সাথের জনকে জিজ্ঞেস করে – “ আপনারা যে দেশে ফিরছেন আজ – দেশে কেউ কি জানে”। না কেউ জানে না- ওরা জেলে ছিল – ওরাই জানত না যে ওরা আজ সকালেই প্লেনে চড়বে। আর একজন অনেক সঙ্কোচের সাথে জিজ্ঞেস করে “ আপনাদের সাথে টাকা পয়সা কি কিছু আছে?” – কারো কাছেই একটা কপর্দক ও  নেই।

“ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে কি করবেন?” – “কিভাবে বাড়ী যাবেন? “ – কারো বাড়ী নোয়াখালী, কার চট্টোগ্রাম, কেউ টাঙ্গাইল। “ব্যাবস্থা একটা হইব”। এইটাই কমন উত্তর। কাদের সাহেব বলনে – আমার টঙ্গি বাজার পর্যন্ত পৈছাইতে পারলেই হইল – তাইলে আর সমস্যা না।

 

উইন্ডো সীটে বসা যুক্ত রাজ্য প্রবাসী তরুন ভাঙ্গা গলায় জিজ্ঞেস করে –

“ দেশে গিয়ে কি করবেন” – “জানি না”।

সে খুব অপরাধীর মত – যতটা গোপনীয়তা ধরে রাখা যায় – পকেটে থাকা বাংলাদেশী সব গুলো টাকা মাঝের সীটে বসা যাত্রীর হাতে ধইয়ে দেবার চেষ্টা করেন । আমাদের তিন জনের চোখ ই জ্বলে ছল ছল।

 

“দেখি যাই দেশে , কিছু একটা ব্যাবস্থা হইব – জীবন দিসে আল্লা – রিজিক দিব আল্লা”। আবার পর মুহুর্তেই মত বদলায় – “ধার কর্জ কিছু পাইলে আবার আমু- দেশে কি করতাম? কি আছে দেশত?”

 

ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের পি এ সিস্টেমে গম গম করে ভেসে আসে ঘোষনা – পাইলটের কন্ঠে ভেসে যায় আমাদের টুক টাক কথপোকথন –

“২১, ২২, ২৩ নভেম্বর আবুধাবীতে ফর্মুলা ওয়ান ইতিহাদ আবুধাবী গ্রান্ড প্রিক্স – আমাদের সবার সাদর আমন্ত্রন –“