পদ্মা সেতুর ভিজিবিলিটির স্বপ্ন এবং দুর্নীতির ধারনা সূচকের বিস্তৃতি

1

 

ফয়েজ তৈয়্যব
১। চায়না মেজর ব্রিজের আর্থিক প্রস্তাব মেনে নিয়োগ দিলে (পড়ুন দেয়া হয়েছে) মূল সেতুতে তিন হাজার ৭৭২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে। ২০১১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য যে সংশোধিত প্রস্তাব (আরডিপিপি) অনুমোদন করা হয়, তাতে মূল সেতুর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল আট হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। ফলে এখন কেবল মূল সেতু নির্মাণের ব্যয়ই দাঁড়াচ্ছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা৷ তবে সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, নদী শাসন ও পরামর্শক নিয়োগ হলে মোট ব্যয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকা আরও বেড়ে যাবে।
২। যদিও RDPP তে নদী শাসনের ব্যয় ধরা হয়েছিল চার হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। এ কাজে ঠিকাদারদের আর্থিক প্রস্তাব জমা দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ২৯ মে পর্যন্ত। দরপ্রস্তাব জমা পড়লেই জানা যাবে, এই খাতে ব্যয় কী পরিমাণ বাড়ছে। দুটি সংযোগ সড়কের ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা। আবদুল মোনেম লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এক হাজার ২৯০ কোটি টাকায়। একইভাবে সেতুর কাজ তদারকিতে পরামর্শক নিয়োগের জন্য ৩৪৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। কিন্তু পরামর্শসংক্রান্ত কাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীকে একাংশের পরামর্শক, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বেশ কিছু কাজে ২০৫ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মূল সেতু ও নদী শাসনের জন্য আলাদা পরামর্শক নিয়োগের কাজ চলছে। এ ছাড়া নদীর দুই পাড়ে ভাঙন রোধে প্রায় ২৫০ কোটি টাকায় ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৩। একটামাত্র প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রস্তাবের ওপর ঠিকাদার নিয়োগ ঝুঁকি।
৪। শুরু হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে, এখন সেটি ঠেকছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷
৫। ব্যয়ের পরিকল্পনা এখানেই শেষ নয়৷ সেতু নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেতু বিভাগ এখন একটি প্রকল্প কয়বার সংশোধন করা যাবে, সেই নীতিমালাটিও মানতে চাইছে না৷ পদ্মা সেতুকে তারা এই নীতিমালার বাইরে রাখতে চায়৷ অর্থাৎ আবারও বাড়বে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয়৷
পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, আরডিপিপি অনুমোদনের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্মাণ সামগ্রী ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক পণ্যের দাম বাড়ার কারণে সেতু নির্মাণের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।“২০১০ সালে যখন প্রাক্কলন ধরা হয়েছিল, তার পর থেকে সময়ের সাথে সাথে সব নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে, ডলারের দাম বেড়েছে। ফলে খরচ বাড়ছে।”
মানে হোল কাজ না পেতেই উচ্ছিষ্ট ভোগীদের দালালী শুরু হয়ে গেসে। তাই খরচ/ব্যয় বৃদ্ধির পক্ষে আমাদের প্রকল্প পরিচালকই অতি উৎসাহী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।
৬।চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি পাকশীতে লালন সেতু নির্মাণ করেছিল। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীন ওই সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় পৌনে দুই কিলোমিটার। ওই প্রকল্পে চায়না মেজর ব্রিজের সহযোগী ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনাল। ৯০৭ কোটি টাকার ঐ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা কামরুজ্জামান এখন পদ্মা সেতু প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং মূল সেতুর দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়েছে। জনাব আবুল না থেকেও আছেন!
৭। এই মেজর ব্রিজ ই ঢাকা চট্রগ্রাম চার লেইন এর কাজ করছে ৭ গত বছর ধরে, যার ব্যয় বাড়ানো হয়েছে অনেক ধাপে, তার পরেও যা রয়েছে অসম্পূর্ণ। যারা ঢাকা চট্রগ্রাম সড়ক পথে যাতায়াত করেন তারা এই দুর্নীতিবাজ কোম্পানীর অতি নিন্ম মানের আর অব্যবস্থাপনা পূর্ণ কাজের মান সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পেয়েছেন।
একই কাজ পদ্মা সেতুর বেলায়ও হতে যাচ্ছে? তাহলে স্বপ্নের পদ্মা সেতু কবে শেষ হবে?
চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সম্পর্কেঃ
চারটি চীনা প্রকৌশলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে ২০০৪ সালে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড গঠন করে। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চায়না জঙ্গতি মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড, ইউয়ান আয়রন এন্ড স্টিল গ্র“প কর্পোরেশন, চায়না রেলওয়ে টানেল গ্র“প কোম্পানি, চায়না রেলওয়ে সাঙহাইজেন ব্রিজ গ্র“প কোম্পানি লিমিটেড।কোম্পানিগুলোর প্রতিটির বিরুদ্ধেই রয়েছে দুর্নীতি সম্পৃক্ততা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার ভয়ঙ্কর সকল অভিযোগ।এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চায়না জঙ্গতি মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। চীনের সংবাদ মাধ্যমগুলোর সূত্র মতে, দুর্নীতির অভিযোগ থেকেই রক্ষা পেতে এই কোম্পানিটির মাতৃপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক বাই জংগ্রেন চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একটি বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন।গত বছর চীনের রেলওয়ে খাতে ব্যাপক দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে দেশটির সরকার। তদন্তের অংশ হিসেবে চীনের সাবেক রেলওয়ে মন্ত্রীর দুর্নীতি প্রকাশ পায়। ধারণা করা হচ্ছে, দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের ভয়, শ্রমিকদের বেতন বাড়ানর চাপ ও অর্থসঙ্কটের কারণে বাই জংগ্রেন আত্মহত্যা করেছিলেন। গেল কয়েক বছরে, বাই জংগ্রেনের মতো আরও কয়েক নেতাই দুর্নীতির অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতে আত্মহত্যা করেছেন।পদ্মাসেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাওয়া মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে ইউয়ান আয়রন এন্ড স্টিল গ্র“প কর্পোরেশন। ২০১২ সালে কানাডায় চেক জালিয়াতি করে অর্থসংগ্রহের অভিযোগ উঠে ইউয়ান আয়রন এন্ড স্টিল গ্র“প কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে।পদ্মাসেতু নির্মাণে ভূমিকা পালন করবে এমন আরেকটি কোম্পানি হচ্ছে চায়না রেলওয়ে টানেল গ্র“প কোম্পানি। এই কোম্পানিটি আরেকটি চীনা কোম্পানির সাথে সম্মিলিতভাবে পোল্যান্ড-জার্মানি সংযোগ সড়ক নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ২০০৯ সালে। তারপর পোল্যান্ডের সরকার, চীনা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্ন করতে না পারা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ফেলার অভিযোগ তোলে। এবং পোল্যান্ডের সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
যেখানে একটি সেতুই একটি দেশের জিডিপি কে নুন্যতম ২% বাড়াবে বলে ধারনা করা হচ্ছে, সেখানেও দুর্নীতির সাথেই আমাদের সেতুবন্ধন! এ এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন, যা দুর্নীতি ব্যাপ্তির  বৈশ্বিক ধারনা সূচকের পরিবর্তন ঘটাতে পারে !
সংকলিত।