মানবাধিকার নেই, কুকুরাধিকারও কি নেই?

20140503ROHINGYA-slide-LC4G-superJumbo

by: Aman Abduhu

আরাকান শব্দটা প্রথম শুনি ছোটবেলায়, কবি আলাওলের দেশ হিসেবে। তখন স্যারের মুখে জেনেছিলাম আরাকান এবং চট্টগ্রাম বহু-শত বছর আগে এক দেশ ছিলো। পরে মোঘলরা চট্টগ্রামকে আরাকান থেকে আলাদা করে নেয়।

ছোটবেলায় দেখতাম চট্টগ্রামে অনেক মানুষকে তাদের বার্মিজ পুর্বপুরুষদের কথা বলে সামাজিক খোঁটা দেয়া হতো। চট্টগ্রামে বার্মা-হাজী নামে এক নামকরা ধনী ব্যাবসায়ী ছিলেন। মাওলানা ইসমাইল হেলালী নামে একজনের জীবনের কিছু ঘটনা পড়েছিলাম, তিনি বার্মায় গিয়ে চাকরী করে জীবন কাটিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের বিখ্যাত এক ধনী পরিবারের সূচনা করেছিলেন শিল্পপতি একে খান, তার স্মৃতিগ্রন্থে পড়েছিলাম কিভাবে তিনি বার্মায় গিয়ে বিয়ে করেছিলেন। নিজ বাবার মুখেও শুনেছিলাম বার্মার কথা।

চট্টগ্রামের সেকালের ঐতিহ্যে বার্মা অথবা আরাকান শব্দটার সাথে কিছুটা রোমান্টিকতা জড়িত। আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়া হয়, গানের কথায় চট্টগ্রামের যুবককে আরাকানে গিয়ে আরাকানী কন্যার মায়াজালে বশীভূত না হওয়ার জন্য মিনতি করা হয়। আরাকানের মেয়েদেরকে একটু আবেদনময়ী, একটু বেশি আকর্ষণীয় হিসেবে ভেবে এসেছে চট্টগ্রামের সামাজিক মানস। একদা বাংলাদেশ থেকে ওখানে যেতো মানুষেরা, কর্মসংস্থানের জন্য। আরাকান ছিলো সমৃদ্ধ এক দেশ। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা জনপদ। যেখানে বাংলাদেশীরা অভিবাসন খুঁজতো।

সেই আরাকান আজ মৃত জনপদ। রোহিংগারা এখন নাগরিকত্ববিহীন, উপায়হীন একদল মানুষ। লক্ষ মানুষ এখন নিরুপায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে, পশুর মতো সরকারী নিয়মকানুনের অধীনে কোনভাবে বেঁচে থাকে। শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই। এমনকি স্থানীয় সরকার অনুমতি না দিলে বিয়ে করার কিংবা সন্তান জন্ম দেয়ার পর্যন্ত কোন অধিকার নেই তাদের।

বাংলাদেশ থেকে বেশি দূরের কথা না। টেকনাফে গিয়ে তাকালে নাফ নদীর ওপারেই আরাকানের ছায়া দেখা যায়। মংডু, সিতিউই। কত শুনেছি এসব শহরের গল্প। ছোটবেলায় পড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ আরাকানীদের যখন প্রথম দেখি, তখন মেলাতে পারিনি। তখন তারা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এক সংস্থায় কর্মরত চাচার সাথে গিয়েছিলাম শরণার্থী শিবিরে। ভয়াবহ সে জীবন। তখন শরণার্থী রোহিংগারা কক্সবাজার টেকনাফে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সাথেও জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে

পরবর্তীতে দেখেছি রোহিংগাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কিছু মানুষের সীমাহীন দুর্নীতি, বিভিন্ন দেশে প্রাসাদের মতো বাড়ি বানিয়ে জীবনযাপন। একই সাথে দেখেছি নিরুপায় রোহিংগাদেরকে, আক্ষরিক অর্থে বিদেশের রাস্তাঘাটে শুয়ে থাকা ছাড়া যাদের আর কোন উপায় নেই। রোহিংগা যোদ্ধাদের দেখেছি। আজ যার সাথে কথা বললাম, দুই সপ্তাহ পর শুনেছি নাসাকা বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে সে মারা গেছে। কবর দেয়া হয়েছে কোন এক পাহাড়ের পাশে। চিহ্নবিহীন মাটির নিচে শুয়ে আছে চিরদিনের জন্য। অন্য কোন দোষ ছিলো না তার। একটাই দোষ, জন্মতে মুসলিম পরিচয়।

দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছে, কিন্তু রোহিংগাদের দুর্ভোগের যেন শেষ নাই। বার্মাতে সামরিক জান্তার পতন হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসন শেষ হয়ে গণতন্ত্রের শুরু হয়েছে। একই সাথে মুসলিমরা ফুটন্ত কড়াই থেকে জলন্ত আগুনে গিয়ে পড়েছে। গত অক্টোবরে এসোসিয়েট প্রেসের সাংবাদিক রবিন ম্যাকডয়েল আরাকানে গিয়েছিলেন, তার রিপোর্টের শুরুটা ছিলো এরকম –

“দশ বছর বয়সী ছেলেটিকে দেখছিলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে, কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভারী পাথরভর্তি একটা বালতি। চেহারায় একটা নির্বিকার ভাব ধরে রাখার চেষ্টা। কিন্তু তার চোখ দুটো অশ্রু আর শ্রান্তিতে ছলছল করছে।

কথা বলার চেষ্টা করলাম। সে বললো, শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি ব্যাথা করছে তার। এ ভারী ওজন বইতে গিয়ে তার শরীর আর চলছে না। আনোয়ার সারদাদ নামের ছেলেটি একসময় নিচু স্বরে বললো ‘এ কাজটাকে আমি ঘৃণা করি’। বার্মার সরকারী এক কনস্ট্রাকশন প্রজেক্টে দশ বছর বয়সী ছেলেটি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। পরিবারের খরচ চালাতে এ কাজ করা ছাড়া তার সামনে অন্য কোন বিকল্প নেই। তবুও অন্য কোন ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। একসময় আক্ষেপ করে বলে ‘আমি যদি মুসলিম না হতাম, তাহলে আমাকে এভাবে বাঁচতে হতো না’।”

আর এই গত দু’সপ্তাহ আগের রিপোর্ট। নিই ইয়র্ক টাইমসের জেন পারলিজ গিয়েছিলেন ওখানে। রোহিংগা মুসলিমদের অবস্থা বিন্দুমাত্র ভালো হয়নি। বরং আরো খারাপ হয়েছে। পারলিজের রিপোর্টের শুরু হয়েছে একটা বাচ্চা মেয়ের মৃত্যুর ঘটনা দিয়ে। শুধুমাত্র কিছু ঔষধ আর অক্সিজেনের অভাবে তিলে তিলে দাদীর কোলে যে মারা যায়। তাকে নিয়ে ফার্মেসী আর ক্লিনিকে দৌড়াদৌড়ি করছিলো নিরুপায় আত্মীয় স্বজন। কিন্তু কোথাও উপযুক্ত চিকিৎসা মেলেনি। রোহিংগা গ্রামগুলোতে নির্বিচার খুন, ধর্ষণ আর নির্যাতনের কথা যেন পৃথিবীর মানুষ না জানে সেজন্য বিদেশী সাহায্যকর্মীদের ওখানে যেতে দেয়া হয়না। বিদেশী সেবাসংস্থার কাজকর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে

আন্তর্জাতিক সভ্য দুনিয়া চুপ করে বসে আছে। এরা মুসলিম। ‘মুসলিমদের মানবাধিকার থাকতে নেই’। বরং বার্মিজ সরকারী প্রচারণার ফলে বার্মিজ জনসাধারণ এদেরকে আর মানুষ মনে করে না। ফরেনপলিসির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, কিভাবে বার্মিজ বৌদ্ধরা রোহিংগা মুসলিমদেরকে ‘কুকুর’ মনে করে। এটাকে বলে ডিহিউম্যানাইজেশন। হিটলার তার নাৎসি জার্মানিতে যেভাবে ইহুদিদেরকে অথবা রুয়ান্ডায় হুটু টুটসি দাঙ্গার সময় টুটসিদেরকে ‘তেলাপোকা’ বানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। অথবা সাম্প্রতিক বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত চেতনা-ব্যাবসায়ী শাহবাগিরা জামায়াত-শিবিরকে ‘শুয়োর’ বানিয়েছিলো। এভাবে মানুষ থেকে নিচে নামাতে পারলে নির্বিকার ভাবে খুন করতে সুবিধা হয়। আরাকানে বার্মিজ বৌদ্ধরা এ কাজটা করে যাচ্ছে।

ওখানে বেশিরভাগ রোহিংগা মুসলিমদেরকে এখন ক্যাম্প বানিয়ে রাখা হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরের মতো করে মানবেতর ভাবে থাকা। সিতিউই শহরের ক্যাম্পের কথা লিখতে গিয়ে পারলিজ একটা ঘটনার কথা লিখেছেনঃ

“যাহরা খাতুনের বয়স বিশ বছর। বাচ্চা প্রসবের সময় হয়ে এসেছিলো, কিন্তু সরকারী হাসপাতালে না গিয়ে ক্যাম্পের ক্লিনিকে যায় সে। একজন বার্মিজ ডক্টর তাকে জানায়, গর্ভে থাকা জমজ বাচ্চা দুটি মারা গেছে। তাকে দ্রুত অপারেশন করার জন্য সিতিউই জেনারেল হাসপাতালে যেতে হবে। সে হাসপাতালে না গিয়ে বাড়িতে ফিরে যায়।

দুই দিন পর সে আবার ক্লিনিকে আসে। তার অসুস্থতা এতোই ভয়াবহ এবং বেদনাদায়ক যে, তাকে শেষপর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বাবা আবদুল্লাহ মি ভীত হয়ে বলছিলেন, রাখাইনরা যদি তাকে ওখানে হত্যা করে, তবে কি হবে! শেষপর্যন্ত যাহরাকে সার্জারী করে মৃত বাচ্চা দুটো বের করে নেয়া হয়। সে তখন বেঁচে যায়। এবং একসপ্তাহ পর ইনফেকশন/ম্যাটারনাল সেপসিসে সেও হাসপাতালে মারা যায়।”

আমরা এখন বাংলাদেশে সবকিছু ভুলে নিজেদের নিয়ে আছি। অসুখ হলে এপোলো ইউনাইটেডে দৌড়াই। আর উপকূলে রোহিংগা শরণার্থী ভর্তি নৌকা আশ্রয় নিতে এসে পড়লে ঠেলে সাগরে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু ভয় হয়, এককালের সমৃদ্ধ আরাকানের আজ যে অবস্থা, কোন একদিন আজকের বাংলাদেশের সে অবস্থা হওয়া অসম্ভব কিছু না। পরিচয় তো একই, মুসলিম।

http://www.foreignpolicy.com/articles/2014/05/12/preventing_the_next_genocide

http://www.nytimes.com/2014/05/03/world/asia/death-stalks-muslims-as-myanmar-cuts-off-aid.html?_r=1

http://www.irrawaddy.org/burma/suffering-dogs-rohingya-kids-northern-arakan.html