দ্য আলটিমেট হেফাজত

3

by: Aman Abduhu

হেফাজতে ইসলাম প্রসঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। আরো কিছু কথা যোগ না করলেই হচ্ছেনা। রাজনীতি এবং অরাজনীতি; দুইটা ভিন্ন জিনিস। হেফাজত নিজেকে অরাজনৈতিক সংগঠন দাবী করে। কিন্তু তাদের আন্দোলনের পদ্ধতি রাজনৈতিক, তাদের ইস্যুগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে জড়িত। শাহবাগ একটা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট আন্দোলন ছিলো। সে আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের বড় একটা অংশ ইসলাম-বিদ্বেষী। তাদের ঘৃণ্য কাজকর্মের প্রতিবাদ জানানোটা একজন মুসলিমের দায়িত্ব। সে দায়িত্বটা অরাজনৈতিকভাবে পালন করতে হলে সিভিল পদ্ধতিতেই দেশের সরকারের কাছে জানাতে পারতো হেফাজত।

কিন্তু তা না করে তারা রাজনৈতিক দলের মতো মহাসমাবেশ, মিছিল, বিবৃতি, বিক্ষোভের পথে গিয়েছে। আবার একই সাথে নিজেদের অরাজনৈতিকতার পরিচয়ও দাবী করে গিয়েছে। এটা ভন্ডামী। এই ভন্ডামীর কারণে কিছুটা সুফল পেয়েছে রাজনৈতিক আরেকটা পক্ষ জামায়াতে ইসলামী। সুফল কিছুটা পেয়েছে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। একই সাথে তারা স্বভাবসুলভ রাজনৈতিক আচরণ করেছে। তাদের অভিজ্ঞতা ও কৌশল বেশি। কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে হেফাজত।

হেফাজত যেহেতু ইসলামকে ধারণ করে, তাদের কর্তব্য ছিলো অরাজনৈতিকতার ইসলামী পন্থার দিকে তাকানো। ইসলামী উলামাদের সামাজিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টার ঐতিহ্যের দিকে তাকানো। ইসলামের সালাফ সালেহীন স্কলাররা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন। কিন্তু মূলধারায় তারা থেকেছেন পুরোপুরি অরাজনৈতিক উপায়ে। এটাই ইসলামী স্কলারদের ঐতিহ্যগত পন্থা। তারা শাসকদের কাছে গিয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু জনগণকে মোবিলাইজ করেন নাই। নিজেদের কাজের জায়গাতে জ্ঞানচর্চা করে গিয়েছেন। ইসলামী জ্ঞানের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও উন্নয়ন করে গিয়েছেন। ঐটা ছিলো তাদের মৌলিক কাজ।

হেফাজতের আলেমরা অন্য নামে রাজনীতিও করেন। ইসলামী ঐক্যজোট তথা শাসনতন্ত্র, নেজামে ইসলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকগুলো দল উপদল। আওয়ামী লীগের সাথে স্বাক্ষর দিয়ে মৈত্রী চুক্তি করেন। কিন্তু এখন কেন তারা অরাজনৈতিকতার নামে এই ভন্ডামী করতে গেলেন? কারণ, এখন নিজেদের অরাজনৈতিক ঘোষণা দিয়ে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করলে তার কিছু না কিছু সুবিধা তারা নির্বাচনের সময় পাবেন। হয়তো ভেবেছিলেন, রাজনৈতিক পরিচয়ে মাঠে নামলে যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইবুনাল ইস্যুতে জড়িয়ে যেতে হবে। হয়তো এসবের সাথে ভালো কোন উদ্দেশ্যও ছিলো। ইসলামের প্রতি আলেম উলামাদের ভালোবাসা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, তা নিয়ে প্রশ্ন করাও বোকামী। কিন্তু এখানে হেফাজত স্বাভাবিক রাজনৈতিক নীতিহীনতাটা করে বসেছে। এবং সেই নীতিহীনতার বড় একটা প্রকাশ দেখা গেলো বৃদ্ধ ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেম মাওলানা শফি (আল্লাহ তাকে রহম করুন) কতৃক আওয়ামী লীগকে বন্ধু ঘোষণার কথায়।

আলেম উলামারা আমাদের সমাজেরই মানুষ। তারা খেজুর গাছ বা মিনার মার্কায় ভোট পেয়ে এমপি মন্ত্রী হতে চাইতেই পারেন। তারা তুলনামূলকভাবে সৎ ও ভালো মানুষ। সুতরাং সমাজের সেবা তারা করতেই পারেন। আর মানুষ যদি ভোট দেয় তাহলে আমার আপত্তি করার কি অধিকার আছে? কিন্তু একদিকে ভোটের সময় মিনার মার্কায় দাঁড়াবেন, অন্যদিকে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে অরাজনৈতিক আন্দোলন করবেন, বিষয়টা একটু কেমন যেন ইয়ে হয়ে গেলো না?

তারা যদি নিজেদের অবস্থানে থেকে নিখাদ ইসলামের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রতিবাদ করতেন, তাহলে দেশের সাধারণ মুসলমান নাগরিকদের ইসলামী জ্ঞান বৃদ্ধিতেই তাদের অবদান বেশি দেখা যেতো। নাস্তিকদের বদমায়েশি প্রসঙ্গে তারা নিজ নিজ এলাকার মানুষের জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতেন। প্রশাসনের কাছে যেতেন। সরকারের কাছে যেতেন। কিন্তু তা না করে তারা প্রটেস্ট করেছেন। প্রটেস্ট করার পরও হয়তো একে সোশাল মুভমেন্ট বলা যেতো, যদি না নির্বাচনের সময় একই আন্দোলনের লোকজন, মাদ্রাসার আলেমরা বিভিন্ন মার্কা নিয়ে ভোটযুদ্ধে না নামতেন। বিভিন্ন নাম নিয়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সাথে জোট না করতেন।

ধর্ম আর রাজনীতিও কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির বিষয়। দুইটার মাঝে যোগাযোগ প্রচুর, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে গিয়ে পৃথক বিবেচনার প্রয়োজন হয়। ধর্মে নীতিহীনতার কোন স্থান নেই। আর রাজনীতিতে উদ্দেশ্যসাধনের কোন বিকল্প নাই। এ নিয়ে বিস্তারিত তর্ক করা যাবে, কিন্তু এখন না। এখন যেই জিনিসটা দেখা যাচ্ছে তা হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা. কে নিয়ে শাহবাগিদের শয়তানির প্রতিবাদে হেফাজত অরাজনৈতিকতা দাবী করে রাজনীতির মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর যখন রাজনীতির নীতিহীনতা তাদেরকে স্পর্শ করছে তখন পেছন থেকে ধর্মের শিল্ডটা বের করে এনে সামনে ধরে বসছেন। তারা কর্দমাক্ত মাঠে ফুটবল খেলতে নেমেছেন, কিন্তু সাদা পাঞ্জাবীতে একটা দাগ পড়লে গোস্বা করেন।

তাদের কেউ কেউ মাওলানা শফির বক্তব্যকে ইলহাম/সুডো-ঐশীজ্ঞান ও বানিয়ে দিচ্ছে। এখন শেষপর্যন্ত আর না পেরে জামায়াতের হেকমতে ভাগ বসিয়েছেন। একদিন তারা এও দাবী করবেন যে তাদের মিনার মার্কায় ভোট না দিলে কাফের হয়ে যেতে হবে। অথবা খেজুর গাছে না দিলে আধা কাফের। কিংবা রিক্সায় না দিয়ে কোয়ার্টার। হয়তো ঈমানও চলে যাবে। এইটা হলো একটা ইগো-ইস্যু। রাজনীতি করতে আসলে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে। কিন্তু তাদের নিয়ে স্যাটায়ার করলে উম্মত থেকে বের করে দেবেন। ওয়ারাসাতুল আনবিয়া!! হাস্যকর।

আরেকটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, এই ধরণের দ্বিমুখীতা দিয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে পারার কথা ছিলো। কিন্তু তা হেফাজত পারবে না, কারণ প্রমাণিত বাস্তবতা হলো তারা ভন্ডামীটা দক্ষভাবে করার যোগ্যতা রাখেনা। তারা তুলনামূলক ভালো মানুষ। বরং খেলার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার অন্যদিকে এইসব করতে গিয়ে তাদের নিজেদের ধর্মীয় যে পবিত্রতা তাও তারা নষ্ট করছে। উল্টা আরও বৃটিশদের বিরুদ্ধে কওমী আলেমদের এই অবদান সেই অবদান ইতিহাস টেনে টেনে নিজেদের যথার্থতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন এখন। খাঁটি বাংলাদেশী পশ্চাতপদ রাজনৈতিক অভ্যাস। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর পেছনে পরে থাকা। আর তা নিয়ে বাগাড়ম্বর করে যাওয়া। বর্তমানে অবদান কি আছে তার কোন খবর নাই।

নিজেদের নীতি ও উদ্দেশ্য পরিস্কারভাবে না বুঝে এরকম চালাতে থাকলে এখন যেমন রাজনীতিতে অগুরুত্বপূর্ণ একটা ফেউমার্কা শক্তি, তেমনই থাকতে হবে। কোন উন্নতি হবে না। ইফেকটিভ ভাবে নিজেদের ভালো কোন দাবী আদায়ও সম্ভব হবে না। আবার বলা যায় না, যদিও ধর্মশিক্ষার ইনষ্টিটিউশনের মতো স্থায়ী একটা ভিত্তি আছে তারপরও রাজনৈতিক মাঠে হয়তো তাদেরকে একসময় আম ছালা দুটাই হারিয়ে উদ্দেশ্যহীন অগস্ত্যযাত্রায় রওনা দিতে হতে পারে। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় আন্দোলন অর্থহীনভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

এইসব ঘটনা সাদাচোখে দেখা যায়, কিন্তু এসবের পেছনে অন্য কিছু থাকার কথা। হেফাজত এবং শাহবাগ, দুইটা আন্দোলনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু গ্রেটার পারপাস সার্ভ করছে। হেফাজত তার নিজ সত্ত্বাতে স্থায়ীভাবে এমন কোন বড় রাজনৈতিক শক্তি না যে আওয়ামী লীগের তাকে খুব একটা পাত্তা দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-জামায়াত, দুই পক্ষের কাছেই হেফাজত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। এবং দড়ি টানাটানিতে সম্ভবত আবারও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে যাচ্ছে।

হেফাজত নিয়ে এই মাথাব্যাথার কারণ হলো, এসব ঘটনা ঘটার সময়কাল। মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির চুড়ান্ত রায় শীঘ্রই হতে যাচ্ছে। আওয়ামী সরকার যখন পরিস্থিতি সুবিধা মনে করবে, এক সপ্তাহ থেকে এক বা দুই মাসের ভেতর যে কোন সময় এ রায় হবে। সরকার যে রায় সুবিধা মনে করবে, ফাঁসি বা যাবজ্জীবন তাই হবে এ আপিলের রায়। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের প্ল্যান বি, সি, এমনকি ডি ও প্রস্তুত রাখার কথা। প্ল্যানের অংশ হিসেবে এই বড় ঘটনাটার আগে আরো কিছু ইস্যু আসবে নিঃসন্দেহে। এইসব একটার পর একটা ইস্যু নিয়ে বিরোধীপক্ষ চরম ব্যস্ততায় দিন কাটাবে। তারপর যখন ঘটনাটা ঘটবে, তখন সারা বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার ধর্মপরায়ণ জনগণের নেটওয়ার্কটা সরকারের সমর্থনে থাকা প্রয়োজনীয়। প্রথম রায়ের পর পুরো দেশে কি ঘটেছিলো, তা আওয়ামী লীগ কখনো ভুলে যায়নি।

যেহেতু মাওলানা সাঈদীর ইসলাম-সংশ্লিষ্ট পরিচয় তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে বড়, তাই এখন শাহবাগের বিদায়ের সময় হয়ে গেছে। সময় এসেছে হেফাজতের সাথে ঘর করার, যদি পর্দার আড়ালে হয় তবুও। হেফাজত যদি নেগোসিয়েশনে দক্ষ হতো, কিছু শাহবাগি নাস্তিকের ভালো একটা বিচারিক শাস্তি তারা এই সময়ে আদায় করে নিতে পারতো। এখন দেখার অপেক্ষা, কি হতে যাচ্ছে। এবং দোয়া করি, অনুমান ভুল হোক। ভালো কিছু হোক বাংলাদেশে।