ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে স্বৈরাচারের সাফাই

by Ariful Hossain Tuhin

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে একটা মতামত বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছে (link at the bottom of article) বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কথাবার্তার ফাকে একটি অনুচ্ছেদ বেশ চোখে পরার মত —

“But the battle between the BNP and Ms. Hasina’s Awami League—marked by pitched street battles and paralyzing strikes—isn’t between two equally bad parties. Ms. Hasina stands for a country whose Muslim majority lives in harmony with both its own distinctive Bengali cultural traditions and with other faiths. The BNP, by allying with Jamaat-e-Islami and condoning violence to force fresh elections, mostly offers strife and intolerance.”

প্রথম আলো অথবা ডেইলী স্টারেও আসলে এই ভাষায় বর্তমান পরিস্থিতিতে অপ-এড ছাপা হয় না। ২০০৯ সালের দিকে আনিসুল হকরা লিখতেন “ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড বাদ দিলে সরকারটা আওয়ামী লীগ খারাপ চালায় না”। আনিসুল হকের ঐ বক্তব্যের কনটেক্সট ছিল কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কিছু “কৃষিবান্ধব” পলিসি। ২০১৫ সালে আনিসুল হক এইভাবে লেখার সাহস করেন না। আসলে আবদুল গাফফার চৌধুরী ছাড়া কেউই বোধহয় ২০১৫ সালে এইভাবে লিখতে পারবেন না।

ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল রুপার্ট মারডকের মিডিয়া এম্পায়ারের অংশ। তাদের এডিটরিয়াল স্ট্যান্স প্রধানত নিও-লিবারাল পলিসির কট্টর এবং আন কম্প্রোমাইজিং সমর্থন দ্বারা পূর্ণ।

এই কারনেই এই অনুচ্ছেদের সাথে কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্রের মিশর পলিসির সাথে মিল খুজে পান, তাহলে তাকে দোষ দেয়া যায় না।

আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রএর মধ্য আমেরিকায় বিভিন্ন অন্যায্য কাজকর্ম যেমন সরকার উতখাত, গনহত্যাকারীদের সহায়তা দেয়া থেকে শুরু করে মাদক চোরাচালানীদের সাহায্য করা, কোনকিছুই বাদ পরেনি। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল রিগান এডমিনিস্ট্রেশনের ইরান-ইরাক যুদ্ধের “সাস্টেইন” করানোর নীতি। ইরান-কন্ট্রা স্ক্যাণ্ডালের সময় দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের দুই পক্ষকেই অস্ত্র বিক্রি করছে।

গনতন্ত্রের নামে এক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্য স্বৈরাচারের পক্ষে দাড়ানোর স্ববিরোধিতাটুকু কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা সমাধান করত? এই স্ববিরোধিতাটুকু সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের অস্বস্তি ছিল। কিন্তু তারা একটি যুক্তি দাড়া করিয়েছিল।

যুক্তিটি কিম্ভুত।

যুক্তিটি হচ্ছে “অথোরেটারিয়ান” আর “টোটালিটারিয়ান” সিস্টেমের মধ্যে পার্থক্য করা।

১৯৭৯ সালে Jeane Kirkpatrick কমেন্টারী ম্যাগাজিনে এই বিখ্যাত ধারনাটির সুত্রপাত করেন। তিনি অবশ্য হানাহ আর্ডান্টের একটি ধারনাকে ঘুরিয়ে পেছিয়ে এই আর্টিকেলে উপস্থাপন করেন। তার বক্তব্য থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া প্রয়োজন —

“There is a damning, contrast between the number of refugees created by Marxist regimes and those created by other autocracies: more than a million Cubans have left their homeland since Castro’s rise (one refugee for every nine inhabitants) as compared to about 35,000 each from Argentina, Brazil, and Chile. In Africa more than five times as many refugees have fled Guinea and Guinea Bissau as have left Zimbabwe Rhodesia, suggesting that civil war and racial discrimination are easier for most people to bear than Marxist-style liberation.”

তার মতে বর্ণবাদ-গৃহযুদ্ধ থেকেও মার্কিস্ট একনায়করা খারাপ!

বুঝলাম মার্কিস্ট একনায়করা খারাপ। ভালো কথা। কিন্তু মার্কিস্ট না হওয়া ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রিয় ডিক্টেটরদের “ভালো গুনগুলো” কি? মানে এল সালভেদর কিংবা নিকারাগুয়া কিংবা এপার্থিড দক্ষিণ আফ্রিকা কেন বেশ ভালো এইটা বুঝতে তার প্রবন্ধটি আরেকটু পড়তে হবে —

“Since many traditional autocracies permit limited contestation and participation, it is not impossible that U.S. policy could effectively encourage this process of liberalization and democratization, provided that the effort is not made at a time when the incumbent government is fighting for its life against violent adversaries, and that proposed reforms are aimed at producing gradual change rather than perfect democracy overnight.”

হুম বুঝলাম। যেহেতু অন্য একনায়করা তাদের জনগনকে পার্টিসিপেইট করতে দেয় না, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের পলিসির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকা ঐসব সরকারের পক্ষে সহজ হবে। সুতরাং দেশের জনগন এখানে গুরুত্বপূর্ণ না। এমনকি গনতন্ত্র তখনই গুরুত্বপূর্ণ যদি সেই গণতন্ত্র থেকে এমন কোন পন্থা না বেড়িয়ে আসে যা যুক্তরাষ্ট্রের হেজেমনিকে আক্রমণ করতে পারবে।

তাহলে আসল গনতন্ত্রীর সংজ্ঞা কি?

এই সংজ্ঞাও লেখিকা দিয়েছেন —

“If, moreover, revolutionary leaders describe the United States as the scourge of the 20th century, the enemy of freedom-loving people, the perpetrator of imperialism, racism, colonialism, genocide, war, then they are not authentic democrats”

মানে যারা যুক্তরাষ্ট্রের পাপের খতিয়ান রাখে তারা “আদি এবং আসল” গনতন্ত্রী নয়। বেশ সোজাসাপ্টা হিসেব আসলে। গনতান্ত্রিক হতে গেলে নিজের দেশের জনগনের অংশগ্রহন নিশ্চিত করনের কোন দরকার নাই। গুরুত্বপূর্ণ পলিসি ইস্যুতে যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সঠিক সুরে কথা বলতে পারেন, তাহলে আপনিও হয়ে যেতে পারেন “আসল গনতন্ত্রী”।

কিছুদিন আগে ইয়েমেনে সৌদি বোমা হামলার সমর্থন এর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে ওবামা এডমিনিস্ট্রেশনের একজন মন্তব্য করেছিলেন,

“The measure of the US policy should not be graded against the success or stability of the Yemeni government, that’s a separate enterprise. The goal of US policy toward Yemen has never been to try to build a Jeffersonian democracy there. The goal of US policy in Yemen is to make sure that Yemen cannot be a safe haven that extremists can use to attack the West and to attack the United States.”

৯/১১ এর পরে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বের অধিকারী বিষয়গুলোর মধ্যে উঠে এসেছে মিলিট্যান্ট ইসলামকে প্রতিরোধ করা। এখন কোনটা আসলে “মিলিট্যান্ট ইসলাম” সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারন সাদা চোখে অগনতান্ত্রিক, নিয়ন্ত্রনবাদী ইসলামিক রাজনীতিকেই যদি আমরা মিলিট্যান্ট ইসলামের প্রধান উপাদান ধরি তাহলে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্রই “মিলিট্যান্ট ইসলাম” নামের ছাতার তলে এসে জমা হয়। অন্যদিকে যারা “নিয়ন্ত্রনবাদী-অগনতান্ত্রিক” নয়, তারাও যদি যুক্তরাষ্ট্রের হেজেমনিকে অস্বীকার করে, যেমন ইয়েমেনের “হুতি”রা, তাহলে তারাও সন্ত্রাসবাদের তকমা পাবে।

এইসব ক্যাটাগোরাইজেশন করার সময় অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ পলিসিমেকার গাঁজা খেয়ে থাকেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কারন একজন শিশুর কাছেও প্রতীয়মান হওয়ার কথা যে ইয়েমেনে বোমা হামলা এবং ততপরবর্তী নৈরাজ্যে সবচেয়ে লাভবান হবে AQAP( Al qaida in Arabian Peninsula)

এই “ব্রেইন ডেড” ডক্ট্রিনের উপর ভিত্তি করেই ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের এই প্রবন্ধটির গোড়াপত্তন। এই মুহুর্তে আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্রের পলিসির কাছাকাছি ন্যারেটিভে চলছে। সুতরাং এই মুহুর্তে বাঙ্গালদেশের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কোন কথা হবে না। শুধু সরকার বিরোধীদের সন্ত্রাসই এখন সেই পলিসির চশমায় চোখে পরবে। এর সাথে দেশের মানুষের ইচ্ছা-আশা-আকাঙ্খার কোণ সম্পর্ক নেই।

আর এই কারনেই বিএনপিও বিভিন্ন চ্যানেলে বার বার সকলকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে, যে তারা কোনভাবেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের হেজেমনিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে না। তারাও সুবোধ বালকের মতই এই হেজেমনির আধিপত্যের ছায়ার তলে থেকে নিজেদের আখের গোছাবে।

এই খেলায় জনগন এবং তার ইচ্ছার কোন গুরুত্ব শেষ পর্যন্ত নেই। ৪৪ বছর ধরে চলা ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্টকে ধাক্কা দেয়ার জন্যে যেমন ইনোভেটিভ চিন্তাভাবনার দরকার ছিল তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। সেখানে শুধু প্রভুর প্রশাস্তি এবং প্রভুর আশীর্বাদে উদরপূর্তি একমাত্র লক্ষ্য।

http://www.wsj.com/articles/bangladeshs-good-fight-against-islamism-1429718057

প্রসঙ্গ অ্যামেরিকার ‘সোফা’ চুক্তি এবং জাতীয় মেরুদণ্ড প্রশ্নে বাংলাদেশ

 

 Banda Reza ul Kabir

খুবই জনগুরুত্বপুর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সুকৌশলে জনসাধারণের চোখের আড়ালে রেখে দেয়া একটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অনেকদিন থেকেই প্রসঙ্গটা আমার বোর্ডের টু-ডু লিস্টে স্টিক করা ছিলো। সময় সুযোগের অভাবে লেখা হয়ে উঠছিল না।

Status of Forces Agreement সংক্ষেপে SOFA হল আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির এক গুরুত্বপূর্ন একটি অধ্যায়; যার ব্যাপারে আমেরিকা এবং চুক্তিতে আবদ্ধ দেশটির জনসাধারণকে পরিকল্পিতভাবে অন্ধকারে রাখা হয়। সাধারনত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা ছাড়া এই চুক্তির ব্যাপারে অন্য কেউ কিছু জানে না, আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে কাউকে এ ব্যাপারে জানতে দেয়া হয় না।

আমেরিকান কংগ্রেশনাল রিসার্চ সেন্টারের ভাষ্যমতে (Chuck Masson নামক একজন আমেরিকান আইন বিশেষজ্ঞ ও এটর্নী কর্তৃক লিখিত সোফা চুক্তির উপর বিস্তৃত গবেষনাপত্র) সোফা চুক্তি হলো এমন কতগুলো ধারা, যার মাধ্যমে অন্য একটি দেশের সাথে আমেরিকার সামরিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। এই চুক্তির ধারাগুলোই নির্ধারন করে চুক্তিবদ্ধ দেশের অভ্যন্তরে একজন আমেরিকান সামরিক অফিসার বা রিপ্রেজেন্টেটিভ কী কী বিশেষ সুবিধা লাভ করবে। মূলত এই চুক্তিবলেই তারা অন্য দেশের মধ্যে দাপ্তরিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে সামরিক অপারেশন পর্যন্ত যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারে। এসব কাজ করার সময় আমেরিকান প্রতিনিধির উপর চুক্তিবদ্ধ দেশের আইন কানুনের সাধারন প্রয়োগ হবে না। চুক্তির শর্ত ও ধারাগুলোই নির্ধারন করে দিবে যে আইনের কোন কোন অংশ আমেরিকানদের জন্যে শিথিল বা অপ্রযোজ্য হবে।

সোফা চুক্তির কোন আনুষ্ঠানিক দাপ্তরিক দলিল দস্তাবেজ থাকে না। এতে কোন সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বা আওতাধীন বিষয়বস্তর তালিকাও থাকে না। এমনকি এই চুক্তিকে কোন সুনির্দিষ্ট শিরোনামের মাঝেও ফেলা যায় না। এর পেছনে কারন হল আমেরিকার স্বার্থ রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের জন্যে চুক্তিবদ্ধ দেশের উপর সব ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সোফা চুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলোর একটা হল, আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তাদের উপর চুক্তিবদ্ধ দেশের কোন আইনী নিয়ন্ত্রন থাকবে না। বিনা বাধায় আমেরিকান সামরিক প্রতিনিধিদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ন কার্যালয় সমূহে প্রবেশাধিকার থাকবে। এসময় তাদের উপর সামরিক ইউনিফর্ম পরিধানের জন্যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। তারা সকল কর ও শুল্কের আওতামুক্ত থাকবে। কোন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই তারা আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও ব্যবহার করতে পারবে। বেতার তরংগ ব্যবহারের সুবিধা পাবে। লাইসেন্স ও অন্যান্য নীতিমালার ব্যপারে তাদের উপর ততটুকুই নিয়ন্ত্রন আরোপ করা যাবে যতটুকুর ব্যাপারে তারা নিজেরা সম্মতি দেবে।

উল্লেখ্য যে এখানে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা বলতে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীতে কর্মরত লোকদেরকেই বুঝানো হয়নি; বরং স্বশস্ত্র বাহিনীগুলোর সবগুলোই এর আওতাভুক্ত। উপরন্ত প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মকর্তা বা প্রতিরক্ষা বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত চুক্তিবদ্ধ বেসামরিক কন্ট্রাকটাররাও এই চুক্তির আওতায় পড়বে।

ন্যাটোর সাথে সোফা চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা ন্যাটোভুক্ত প্রতিটি দেশের কাছ থেকেই এই কাজের জন্যে সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। যেহেতু সামরিক দিক থেকে ন্যাটো ও মার্কিন স্বশস্ত্র বাহিনীগুলো একে অপরের সহযোগী তাই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর জন্যে সোফা চুক্তিকে আবদ্ধ না হয়ে কোনো উপায় নেই।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সোফা চুক্তিকে কোন ধরনের সীমারেখার গন্ডিতে ফেলা যায় না। কোন ধরনের আইনের কাছে এটি মুখাপেক্ষী নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এই চুক্তির ধারাগুলো এত সংক্ষিপ্ত হতে পারে যে এক পৃষ্ঠাতেই পুরো চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করা যায়। উদাহরণস্বরুপ ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার চুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সাথে আমেরিকার একটি যৌথ সামরিক মহড়া করা। চুক্তিটিতে মাত্র ৫টি ধারা ছিল। তবে মূল উদ্দেশ্য একটাই ছিল, যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে বতসোয়ানার সাথে আমেরিকার চুক্তির কথাটিও উল্লেখ করা যায়, যার মাধ্যমে আমেরিকা বতসোয়ানার সরকারের দ্বারা আইনানুগ ভাবে সেদেশের মাটিতে মানবিক সাহায্যের নামে কার্যক্রম শুরু করলেও বেসামরিক দাপ্তরিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে সামরিক মহড়া ও ট্রেনিং এর সুযোগ পায়। বস্তত এসকল ধারাগুলোর অন্তরালে আমেরিকার উদ্দেশ্য একটিই, আর তা হল একটি দেশে ঔপনিবেশিকতার সূচনা করা ও ধীরে ধীরে বিভিন্নভাবে দেশটির আভ্যন্তরীন ও প্রতিরক্ষা কাঠামোকে দূর্বল করে দেশটির উপর সার্বিক নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করা।

এ চুক্তির মাধ্যমে তারা দেশটির আইন শৃংখলা বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠাপূর্বক নিজস্ব মানদন্ডে প্রনীত “ন্যায়নীতি” ও “শান্তি-শৃংখলা” রক্ষা করতে চায়। মূলত এর পেছনে থাকে তথাকথিত সন্ত্রাস দমন, জঙ্গীবাদ নির্মূল সহ এধরনের অন্যান্য উদ্দেশ্য; যদিও অধিকাংশ থেকে এটা করা হয়ে থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন বা মানবাধিকার নিশ্চিতকরনের মত বাহ্যয় মহৎ কার্যক্রমের ছদ্মাবরনে।

 

উল্লেখযোগ্য কিছু দেশে সোফা চুক্তিঃ

 

আফগানিস্তানঃ

সেপ্টেম্বর ১১ এর হামলার পর আল ক্বায়েদা ও তালেবানের মূলোতপাটনের লক্ষে আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা চালায়। এরই সূত্র ধরে ২০০২ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত আফগান পুতুল সরকারের সাথে আমেরিকা কতগুলো পত্রবিনিময়ের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আফগানিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখার যাবতীয় বন্দোবস্ত সেরে ফেলে। আমেরিকান ভিন্ন দেশকে সাহায্য প্রদান আইন ১৯৬১ মোতাবেক আফগানিস্তানে আর্থিক সাহায্য দেয়ার শর্তসাপেক্ষে উক্ত চুক্তি আফগানিস্তানে সামরিক প্রশিক্ষন থেকে শুরু করে অপারেশন, এমনকি ঘাটি স্থাপনের সুযোগ করে দেয়। একারণে খুব সহজেই আফগানিস্তানকে তারা সামরিকভাবে কব্জা করে নিতে পারে। এই চুক্তির ধারামতে আমেরিকার সকল প্রতিনিধি আফগানিস্তানের সকল ফৌজদারী আইনের আওতার বাইরে থাকবে। অর্থাৎ আমেরিকার মনোনীত কোন ব্যক্তি যদি আফগানিস্তানে খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধও করে তবুও আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় আইনে তার বিচার করা যাবে না। এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ন ধারা হল যে, অন্য কোন দেশ থেকে কোন আমেরিকান নাগরিক যদি কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয় নেয় তাহলে আফগানিস্তান সরকার সেই অপরাধীকে সেই দেশের কাছে তুলে দিতে পারবে না। আফগান সরকার সরাসরি ও প্রকাশ্যে আমেরিকার এই চুক্তিকে মেনে নেয়।

২০০৫ সালের ২৩মে তে হামিদ কারজাই ও বুশের মধ্যকার একটি যৌথ ঘোষনাপত্রের মাধ্যমে আফগানিস্তান ও আমেরিকার পারস্পরিক ভবিষ্যত পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়, যার মাধ্যমে আমেরিকান সেনারা আফগানিস্তানে পূর্ন নিয়ন্ত্রনাধিকার তো পাবেই উপরন্ত এই চুক্তির মাধ্যমে তারা আফগান সৈন্যদেরকেও নিজস্ব কর্মকান্ডে ব্যবহার করতে পারবে। সরকারের কাছে এরুপ প্রস্তাব করা হয় যে আফগানিস্তানের জনগনকে বুঝাতে হবে যে তারা এখনো নিজ দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়ে উঠেনি; তাই নিজেদের স্বার্থেই তাদের উচিত হবে আমেরিকান সৈন্যদের কাছ থেকে প্রশিক্ষন গ্রহন করা, যাতে তারা ভবিষ্যতে তালেবান থেকে ‘নিরাপদ’ থাকতে পারে।

 

জার্মানিঃ

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে জার্মানির মত ক্ষমতাবান একটি দেশ আমেরিকার সাথে এমন লজ্জাস্কর একটা চুক্তিতে আবদ্ধ! জার্মানির ন্যাটোতে যোগদানের চার বছর পর আমেরিকার সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যা ন্যাটো সোফা চুক্তি ১৯৫৩ নামে খ্যাত। এই চুক্তির আওতায় আমেরিকা-জার্মানির মধ্যে একটি সামরিক সম্পর্কের সেতু স্থাপিত হয়। চুক্তির ধারাসমূহ বেশ বিস্তৃত এবং প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার সুবিশাল পরিসরের। এর মাধ্যমে জার্মানির অভ্যন্তরে আমেরিকা অপারেশান চালানোর সুযোগ পায়।

জাপানঃ

জাপানের সাথে আমেরিকার এই চুক্তির মাধ্যমে জাপানের অভ্যন্তরে কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত আমেরিকান বিনা বাধায় পার পেয়ে যেতে পারবে। ১৯৫৭ সালে একজন আমেরিকান সেনা কর্মকর্তা একজন জাপানি নাগরিককে হত্যা করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। তবে চুক্তিতে আবদ্ধ থাকার কারনে আমেরিকা তার সৈন্যের পক্ষে জোর দাবি জানিয়ে বলতে সক্ষম হয় যে, এই হত্যাকান্ড ছিল তাদের সামরিক কার্যক্রমেরই একটা অংশমাত্র। জাপান সরকার এটিকে ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে প্রমান করার জন্য সকল জোড়ালো প্রমান উপস্থাপনের কারণে আমেরিকা এটি মানতে বাধ্য হয় এবং তাকে জাপানের হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত ঐ সেনা কর্মকর্তা নিজের পক্ষে আমেরিকার ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব কলম্বিয়াতে রীট করে। ঐ রীটটি খারিজ হয়ে গেলেও ঐ সামরিক কর্মকর্তার পক্ষে আমেরিকান সরকার জাপান সরকারকে বিচার কাজ না চালাবার জন্যে চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে ঘটনাটি আমেরিকান সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।

ইরাকঃ

২০০৩ এর মার্চ থেকে শুরু করে ২০১০ এর আগস্ট মাস পর্যন্ত ইরাকের অভ্যন্তরে আমেরিকা বহু সামরিক অপারেশন পরিচালনা করে। প্রথমত এর উদ্দেশ্য ছিল সাদ্দাম হুসেনের অপসারন, যদিও পরবর্তীতে তাদের আরো অনেক উদ্দেশ্য প্রকাশ পায়। ইরাকের সাথে আমেরিকার চুক্তির কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলঃ

এই চুক্তির আওয়াতায় আমেরিকা ইরাকী সরকারকে ‘সহায়তা’ করবে; ইরাকী নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষন দিতে পারবে; তাদেরকে প্রয়োজনীয় সাজ সরঞ্জাম ও আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে। ইরাকী সরকারকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী’ যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্যে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে যাতে তারা আল কায়েদা ও এর মত ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। পাশাপাশি পূর্বেকার অপরাধী সরকারগুলোর অবশিষ্ট কোন বাহিনীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালাতে পারে। সর্বোপরি ইরাকে বহির্বিশ্বের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা হবে এবং ইরাকের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা হবে।

উল্লেখ্য যে ইরাকের সাথে আমেরিকার এই চুক্তি আইনী দিক থেকে সকল বিধি-নিষেধের উর্ধ্বে এবং এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক একটি চুক্তি, যার মাধ্যমে ইরাকের নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এমনকি আইন প্রয়োগ সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলির উপরও আমেরিকা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে।

এসবের সাথে আরো যুক্ত ছিল যে, ইরাকের অভ্যন্তরে আমেরিকার যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে ইরাক সরকারকে অবশ্যই সম্মত হতে হবে এবং তার নিজ বাহিনী দ্বারা আমেরিকাকে পূর্ন সহযোগিতা করতে হবে। চুক্তির প্রতিটি ধারাই নগ্নভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও অনেক গোড়া আমেরিকান সামরিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, এটি আমেরিকার স্বার্থ আদায়ের জন্য যথেষ্ট নয়।

এছাড়াও আর যেসব দেশের সাথে আমেরিকার এই চুক্তি রয়েছে তার মধ্যে ফিলাপাইন্স ও দক্ষিন কোরিয়ার নাম প্রনিধানযোগ্য।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সোফা চুক্তিঃ

Cold war পরবর্তী সময়ে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ যেন হঠাত করেই বেড়ে যায়। এই অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লাগে। এখানকার কোন দেশে পারমানবিক শক্তিকেন্দ্র স্থাপিত হবে, কোন দেশের সাথে কোন দেশের কী ধরণের ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদিত হবে ইত্যাদি সকল কাজেই আমেরিকার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি লক্ষনীয়। কৌশলগত ভৌগলিক গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার এই আগ্রহ যেন একটু বেশিই।

প্রথমত সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের যা অবস্থা, তাতে এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে শুরু করে শেষ শস্যদানাটুকুও যদি আমেরিকা হাইড্রলিক পাম্প লাগিয়ে নিয়ে নিতে চায় সেক্ষেত্রে চুপচাপ তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের হয়তো কিছুই করার থাকবে না।

SOFA-05

দ্বিতীয়ত, এই দেশের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে দক্ষিন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের উপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়। বাংলাদেশে আমেরিকার “প্রফিট” এর সম্ভাবনা যথেষ্ঠ। এটা বুঝতে কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমেরিকার ইতিহাস থেকে এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে বৃহৎ কোন স্বার্থ ছাড়া আমেরিকা কোন দেশের পেছনে এভাবে সময় বা সম্পদ কখনোই ব্যয় করে না।

বাংলাদেশে সোফা চুক্তির সূচনা হয় ১৯৯৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের সময়; যদিও বিএনপি-জামাত সরকার পরবর্তিতে মোটেই এর বিরোধিতা করেনি; যা এ চুক্তির প্রতি তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থনই প্রমাণ করে। আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট বিল রিচার্ডসন এর সূচনা করেন এবং পরবর্তীতে ততকালীন আমেরিকান সেনাপ্রধান বাংলাদেশ সফরে এসে চুক্তিটি কার্যকর পর্যায়ে নিয়ে যান।

১৯৯৮ সালে যখন প্রথম এই চুক্তিটি সূচনা করা হয় তখন এর ধারাগুলো এত সুবিস্তৃত ও গভীর ছিল না; তখন এটা শুধু আমেরিকান সেনাবাহিনীর সাথে যৌথ সামরিক মহরার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে চুক্তির ধারাগুলো যখন স্পষ্ট করা হয় তখন দেখা যায় যে তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য এক সুস্পষ্ট হুমকি। চুক্তির ধারাগুলো নিম্নরুপঃ

১. ‘জরুরী প্রয়োজনে’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর বিনা বাধায় প্রবেশ পারবে
২. আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তারা এদেশের পাসপোর্ট ও ভিসা-নীতির উর্ধ্বে থাকবে
৩. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেকোন ধরনের সরঞ্জাম (যুদ্ধাস্ত্র বা সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার্য যন্ত্রাদি) কাস্টমস ছাড়াই বিনা বাধায় প্রবেশ এবং পরিবহনের পূর্ন অধিকার থাকবে।
৪. প্রশিক্ষন ও মহড়ার জন্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমেরিকান সৈন্যদের স্বশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশের অধিকার থাকবে।
৫. প্রশিক্ষন ও মহড়া চলাকালীন সময়ে তাদের দ্বারা রাষ্ট্রের কোন ক্ষতি হলে তার কোনো দায়ভার তারা বহনে বাধ্য থাকবে না।
৬. বাংলাদেশে অবস্থানরত সামরিক সদস্যদেরকে দেশের আইন ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে রাখা।
৭. অন্য কোন দেশে কোন অপরাধ সংঘটন করে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর কেউ যদি বাংলাদেশে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় চায় তাহলে তা দিতে হবে এবং তাকে সে দেশের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না।
৮. দেশের যে কোন স্থাপনাসমূহে আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তাদের বিনা বাধায় প্রবেশাধিকার থাকতে হবে।
৯. এদেশের যে কোন নাগরিকের পেছনে গোয়েন্দাগিরী,  তাকে গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ, এমনকি তাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার অধিকার থাকবে আমেরিকার সামরিক কর্মকর্তাদের।

এই চুক্তির আওতায় আমেরিকান সৈন্যরা বাংলাদেশে যখন খুশী তখন বিনা বাধায় আসতে পারবে এবং বাংলাদেশী সৈন্যরা শর্ত সাপেক্ষে প্রশিক্ষনের জন্যে আমেরিকায় যেতে পারবে, তবে কোনভাবেই বাংলাদেশী সৈন্যদের জন্যে সেসব সুবিধার কিছুই প্রযোজ্য হবে না যে সুবিধাগুলো আমেরিকা সৈন্যরা এদেশে ভোগ করতে পারবে।

এদেশের সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ের কেবল ততটুকুই জানে যতটুকু সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে জানতে দেয়া হয়। এই কথাটি আমেরিকার জনগণের ক্ষেত্রে আরো বেশি বাস্তব। এজন্যে উভয় দেশের নাগরিকরাই নিজ সরকারের এমন হীন পদক্ষেপগুলোর ব্যপারে অন্ধকারে থেকে যাচ্ছে, ফলে প্রতিবাদ তো দূরে থাকুক, এসব বিষয়ে জনমতও গড়ে উঠছে না। টিকফা বা অন্যান্য চুক্তি নিয়ে কিছু কথা-বার্তা কেউ কেউ বললেও তার চেয়ে হাজারো গুন মারাত্মক ভয়াবহ চুক্তি সোফা নিয়ে তেমন কারো মাথাব্যথাই দেখা যায় না। অন্যদিকে এমন কিছু প্রো আমেরিকান সংগঠনের অস্তিত্বও এদেশে আছে যারা এই চুক্তিকে সমর্থন জানায় এবং একে দেশের জন্য কল্যাণকর হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করে। তাদের বক্তব্যমতে আমেরিকা বাংলাদেশের বন্ধু এবং দুই দেশের পারস্পারিক সম্পর্কোন্নয়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশের উন্নতি সম্ভব। শাহারিয়ার কবির নামক তথাকথিত এক দেশপ্রেমিক তো বলেই দিয়েছে “জঙ্গি মৌলবাদ দমনে আমেরিকার সহায়তা প্রয়োজন।” গত ২০১৩ এর ৬ই জানুয়ারির ভয়েজ অফ আমেরিকার বাংলা অনলাইন সংস্করণে তা প্রকাশও হয়েছে। (লিঙ্কঃ http://www.voabangla.com/content/interview-with-shahriar-kabir-on-his-film-against-jihad-06-january-2013/1578761.html)

Shahariar-Kabir-VOABangla

উল্লেখ্য যে সোফা চুক্তির এই ভয়াবহ ধারাগুলো ২০০৯ পরবর্তী শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই যুক্ত হয়েছিল। ২০১২ তে আমেরিকান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর এই চুক্তি নবায়ন হয়। আওয়ামীলীগের সাথে হাজারো বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও এক্ষেত্রে বিএনপি-জামাত কিন্তু নিজেদের মুখে কুলুপ এটে রেখেছিলো।

দেশ ও জাতি তথা বিশ্বের কাছে আত্মমর্যাদাহীন ও পরাজিত ব্যর্থ সরকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আশঙ্কা ছাড়াও এই চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার আরও কিছু জটিলতার সম্মুখীন হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

১. বাংলাদেশে অন্য কোন দেশের সৈন্য প্রবেশের নিরঙ্কুশ অধিকার অনুমোদন করার বিষয়টি শুধু আইনী বা রাজনৈতিক দিক থেকেই অসমীচীন নয় বরং এদেশের সংবিধানেরও সুস্পষ্ট পরিপন্থী একটা ব্যাপার।

২. “সার্ক” ভুক্ত দেশ হবার কারণে বাংলাদেশ সার্ক এর কিছু নীতিমালা মেনে চলতে বাধ্য, যার মধ্যে অন্যতম হল স্থানীয় সীমারেখায় বহিরাগতদের প্রবেশাধিকারের উপর নিয়মতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রন আরোপ করা। সোফা চুক্তির আড়ালে আমেরিকাকে এই অবৈধ সুবিধা প্রদান করা মানেই সার্কের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা।

এসমস্ত ভয়াবহ পরিনতির কথা বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে এই চুক্তির বিষয়টি শুধুমাত্র নীতিনির্ধারক মহল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এবং জাতীয় নিরাপত্তার আড়ালে বিষয়টি জনগনের কাছে গোপন করা হচ্ছে।

আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্ক ১৯৮০ সালের পর থেকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই পেয়েছে। সেসময় ৩০০ জনেরও বেশি বাংলাদেশী সামরিক কর্মকর্তা আমেরিকায় প্রশিক্ষন নিয়েছেন এবং তখন থেকেই আমেরিকা-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে অনেক অপারেশান ও মহড়া হয়ে আসছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাইক্লোনকে কেন্দ্র করে অপারেশন সী এঞ্জেল।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দুটি প্রধান আন্তর্জাতিক দ্বন্ধে আমেরিকাকে সামরিকভাবে সমর্থন দিয়েছে।

ক) ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধ, যাতে বাংলাদেশ প্রায় ২৩০০ সৈন্য পাঠায়

খ) ১৯৯৪ সালের হাইতি মিশন, যাতে বাংলাদেশের কন্টিনজেন্ট প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত ছিল

আমেরিকান নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তারা সোফা চুক্তির পেছনে তাদের যেসব প্রধান উদ্দেশ্যের কথা প্রকাশ করেছেন তা নিম্নরূপ-

১. মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে কার্যক্রম জোরদার করা

২. প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে ত্রানসাহায্য সরবরাহ করা

৩. জল ও আকাশ পথে উদ্ধারকাজ চালনা ও অপারেশন পরিচালনা করা

৪. স্কুল স্থাপন ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন

৫. চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করা ও প্রশিক্ষন

প্রকাশ্যে এধরণের মানবিক সাহায্যের কথা বলে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ বরাবর বুঝাতে চেয়েছে যে সোফা কোন সামরিক চুক্তি নয় এবং এর পেছনে আমেরিকার ও মানবিক সাহায্য প্রদান ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যই নেই। তারা কখনই সোফা চুক্তির পেছনে লুকায়িত স্বার্থের কথা প্রকাশ করে না। উপরন্ত তারা এমন প্রস্তাবও করেছে যে এধরনের “লাভজনক” একটি চুক্তি করা থেকে বিরত থাকা মানে বাংলাদেশের নিজেরই ক্ষতি করা। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিয়েগো গার্সিয়ার পর বাংলাদেশের মত একটা সুইট স্পটে সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপন করার ব্যাপারে তারা সত্য-মিথ্যা যেকোন কিছুরই আশ্রয় নিবে এটাই স্বাভাবিক।

Hillary Rodham Clinton with Bangladeshi Prime Minister Sheikh Hasina and Foreign Minister Dipu Moni

হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের অব্যবহিত পরেই ডেইলি স্টার পত্রিকা সোফা চুক্তির ব্যাপারে স্বল্প পরিসরে কিছুটা আলোকপাত করেছিলো। একথা স্পষ্ট যে সোফা চুক্তিতে আবদ্ধ হবার মানেই হচ্ছে আমেরিকার কাছে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেওয়া। কারন এই চুক্তির ধারা মোতাবেক দেশের মধ্যেও কোন আমেরিকানের উপর দেশের আইন বলবত থাকছে না। তাছাড়া এই চুক্তির মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ন তথ্যাদির উপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।

US Secretary of State Hillary Rodham Cllinton

সোফা চুক্তির ব্যাপারে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নীরবতা সত্যিই অদ্ভূত। এমনকি হিলারি ক্লিনটনের সরাসরি টিভি সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত সাংবাদিকদের সোফা চুক্তির বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নিরবতা বিস্ময়কর। আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির সাথে যারা একটু হলেও পরিচিত তারা খুব ভালভাবেই জানেন যে, কিভাবে একটি দেশকে আমেরিকা ধীরে ধীরে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। অতীতে এর অসংখ্য উদাহরন রয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত আছে। জাতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলের অবাক করা নীরবতা রাজনীতিবিদদের স্বার্থান্বেষী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকাকে সন্তষ্ট করতে নিজ দেশের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে দিনশেষে বাংলাদেশের লাভের খাতায় যে কিছুই থাকবে না, বরং যা ছিল তার সবই যাবে—এই সহজ সমীকরনটা বুঝতে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা যত দেরী করবেন দেশ ও দেশের জনগণ ততই নিরাপত্তা হারাবে।

 

 
 

Wassalam,
Banda Reza ul Kabir
…until I taste what Hamza bin Abdul Muttalib (RA) tasted

Read me @ www.bandareza.com

Subscribe my videos on www.youtube.com/bandareza313