সুধী সমাজ

সুধী সমাজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান সত্যি কিন্তু সেটা এজন্য না যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীটা ন্যায্য কিংবা এ পথে খুন-জখম কম হবে বরং এজন্যে “নিরপেক্ষতা” সুধী সমাজে খুব ফ্যাশনেবল জিনিস। তারা চান বিএনপি প্রয়োজনে কেয়ামত পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী করুক কিন্তু সেটা করতে হবে টেলিভিশনে, সংসদে। যে দাবী দেশের অন্তত ৮২ ভাগ মানুষের দাবী (প্রথম আলো জরিপ, সেপ্টেম্বর ২০১৩) এবং যে ন্যায্য দাবীর কারণেই এতো হানাহানি সে দাবী লীগ না মানলে কী হবে – এ প্রশ্ন করলে তারা মাথা চুলকে দার্শনিক ভাবে উত্তর দেন, “কী জানি ভাই আর ভাল্লাগে না এতো হানাহানি; আর পারছি না নিতে।”

তারা আবার বিস্মৃতিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসেন – খুব। খালেদা জিয়া যে মাসের পর মাস ধরে সরকার দলকে আলোচনা করার আহবান করেছেন সে সত্যটা ভুলে যাওয়াটাও দেশে খুব ফ্যাশনেবল।

তিনি আলোচনার দাবী জানালে বলা হয় যে বিএনপির আন্দোলনের মুরোদ নেই আবার আন্দোলন করলে বলা হয় আমরা তো বিএনপির কাছে এমন কিছু আশা করি না।

স্ল্যাভয় জিজেক তার Pervert’s Guide সিরিজের psychoanalysis এর জন্য খুবই বিখ্যাত। এতোটাই যে তাকেই একমাত্র রকস্টার দার্শনিক বলা যেতে পারে আজকের পৃথিবীতে। তাকে বিএনপিকে নিয়ে সুধী সমাজের এই মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করলে তিনি তার স্বভাবসুলভ ম্যানারিজম বহাল রেখে উত্তর দিলেন, “বিএনপির আসল সমস্যা এই না যে তারা সংলাপে বসতে চাইছেন কিংবা চাইছেন না। এমনটাও না যে সুধী সমাজ বিএনপিকে হরতাল দেয়ার কারণে আস্থায় নিচ্ছে না। আসল কারণ হলো বিএনপি যথেষ্ট পরিমাণে হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে না। যেদিন বিএনপি এক ডাকে এক হাজার মানুষ খুন করতে পারবে কেবল সেদিনই সুধী সমাজ বিএনপিকে যথেষ্ট সুধী মনে করবে।”

Image

ওয়েল ফোকস, স্ল্যাভয় জিজেক এর সাথে এই কথোপকথন সম্পূর্ণই কাল্পনিক। কিন্তু এই লাইনের psychoanalysis সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। ইন ফ্যাক্ট বাংলাদেশের ইতিহাস খেয়াল করলে দেখবেন যে সুধী সমাজ বরাবরই সবলের পক্ষ নিয়েছেন, যারা পুরো দেশে ত্রাস সৃষ্টি করতে পেরেছেন (অল্প ত্রাস সৃষ্টি করলে হবে না, সেক্ষত্রে আপনাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা হবে), যারা রক্ত বইয়ে দিতে পেরেছেন রাজপথে – তাদেরকেই ভালোবেসেছেন মন ভরে।

৭১ সালের এক অতি সরলীকৃত ইতিহাসের খুব কদর বাংলাদেশে কিন্তু যারা ৭১ এর ২৬শে মার্চ ঢাকায় ছিলেন তাদের অনেকের মুখেই আসল ইতিহাস শুনতে পাবেন। গণহত্যার পরের দিন সকালে পুরো ঢাকা “পাক্কা মুসলমান” হয়ে গিয়েছিলো জিনাহ টুপী পরে (এর ইঙ্গিত আছে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসে)। প্রতিরোধের যে ইতিহাস – সেটা অসুধী সমাজের, সুধী সমাজ ব্যস্ত ছিলো ২৬শে মার্চ শেখ মুজিবের পিণ্ডি চটকাতে। এই ফকিন্নীদের লীডারের জন্যেই দেশটা শেষ। পারবা তুমি পাঞ্জাবীদের সাথে ফাইট করতে? যা পারো না, কী দরকার তার শুরু করার? বেটে বামন বাঙালি কি পারবে কোনোদিন তাগড়া পাঞ্জাবীদের সাথে?

এই সুধী সমাজ যেদিন তাদের প্রাণপ্রিয় মুজিব ভাইয়ের পরিবারের ওপর রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া হয় তার ২৪ ঘন্টা পরেই কেবল উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে তাদের প্রিয়তম আদতে বঙ্গবন্ধু না, ফেরাউন ছিলেন।

আমার কোনোই সন্দেহ নাই কোনোদিন যদি এদেশে খোমেনীর মতো উন্মাদ ইসলামিস্ট (কিন্তু ক্লীন শেভড হতে হবে এবং অথেন্টিক ব্রিটিশ/এমেরিকান/অস্ট্রেলিয়ান একসেন্টে ইংরেজি বলতে হবে) পুরো দেশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, সবার আগে সুধী সমাজই তাকে স্বাগতম জানাবে। বলবে, “তোমারই জন্যেই হে বীর্যবান অপেক্ষা করেছে এ নিষ্ফলা ধরণী। তুমিই পারবে, তুমিই পারবে কেবল অরুনোদয়ের সন্ধান দিতে হে মহামতি। লও হে শক্তিমান – ন্যায়দণ্ডের গুরুভার ” – এ লাইনের বাংলাবাজি।

অনুপস্থিত দেখে বাংলাদেশের সুধী সমাজকে নিয়ে কৌতুক বোধ করার আমোদটুকু প্রশ্রয় দেই। পৃথিবীতে বাংলাদেশের সুশীল সমাজের মতো প্রিটেনশাস এবং কনফিউজড ক্লাস আছে হয়তো, আমার কাছে তার সন্ধান নেই। সারা পৃথিবীতেই সিভিল সোসাইটি, লিবারেল ভ্যালুজের ধারক বলে দাবী করেন। ঐ যে আছে না ভলতেয়ারের বাণী I do not agree with what you have to say, but I’ll defend to the death your right to say it – এইসব ভ্যালুজ আর কি। আমাদের সুধী সমাজও কী সব দাবীর সাথে একমত যেন – I do not agree with what you have to say, but I’ll put you to the death to say it – এই ধরনের কিছু।

উদাহরণ দেবো? বাংলাদেশে ক্রিকেটার ছাড়া সব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ডিভাইসিভ। বলাই বাহুল্য ফরহাদ মজহার তাদেরই একজন। তাকে অপছন্দ করার এবং সমালোচনা করার একশ একটা কারণ থাকতে পারে কিন্তু তিনি চোর, ঘুষখোর, খুনী এ ধরনের অপরাধী নন – এ কথা মনে হয় অস্বীকার করা যাবে না। তিনি ঠিক আমাদের সাথে ইয়ার্কি করার বয়সেরও নন। মতের অমিল থাকার কারণে হাটুর বয়েসী ছেলেরা তাকে গাধা বলছে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে। এবং এই ছেলেমেয়েরাই ভবিষ্যতের সুশীলপতি – কেউ পিএইচডি তো কেউ ডাক্তার।

কয়েক মাস আগে আমার দেশ বিচারপতির ফোনালাপ প্রকাশ করলে কেউ জার্মানি, কেউ ইংল্যান্ড তো কেউ শাহবাগ থেকে বলছিলেন বিচারপতি তো আরেক আইনজীবীর সাথে কথা বলতেই পারেন, আমার দেশ সেটা প্রকাশ করেই মহাপাপ করে ফেলেছে। সেই একই মানুষেরা আবার হাসিনা-খালেদার ফোনালাপ প্রকাশিত হওয়াটাকে জাতির ক্রান্তিলগ্নে প্রয়োজন বলে মনে করেন। এই ফোনালাপের কোনো এক ফাঁকে বাই চান্স যদি হাসিনা খালেদাকে মাতারী বলে বসতেন – এই একই গ্রুপ আবার এই একই ফোনালাপ প্রকাশকে মহাপাপ বলে জ্ঞান করতেন।

বাংলাদেশের সুধী সমাজ এই কাজটিই ভালো করেন, তারা অনবরত গোলপোস্ট সরাতেই ব্যস্ত – উস্তম-পুস্তম স্পীডি গনজালেস।

অভীক কুমার মৈত্রর কার্টুন ওয়েব থেকে নেয়া

Leave a comment