শাহবাগঃ বখরা নিয়ে নখরা

by: Aman Abduhu

তথাকথিত গণজাগরণের শাহবাগিরা টাকার ভাগ নিয়ে মারামারি শুরু করছে। এবং এতে আমরা আনন্দ প্রকাশ করছি। কিন্তু, হাড্ডি নিয়ে কুকুরদের কামড়াকামড়ি দেখে আসলেই কি অ-শাহবাগি অথবা বাংলাদেশর সুস্থ মানুষদের খুব বেশি আনন্দিত হওয়ার কিছু আছে?

যে কোন আন্দোলন বা সম্মিলিত কাজ করতে গেলে টাকার দরকার হয়। এটা কোন অপরাধ না। অপরাধ হলো টাকাটা যে কাজে খরচ করার কথা, তা না করে আত্মসাৎ করা। যে কাজটা খুব স্বাভাবিকভাবে করেছে গাজামঞ্চ।

তো? তাদের এই দুর্নীতি কি খুব বেশি অপ্রত্যাশিত ছিলো? বাংলাদেশে এ কাজ কি শুধু শাহবাগিরাই করেছে?

শাহবাগিরা একটা জায়গায় গিয়ে এখনো নিজেদের পরিচয় অস্পষ্ট রেখে দিয়েছে। এটা কি কোন রাজনৈতিক দল? না কি গাঁজাখোর হতাশাগ্রস্থ সুযোগসন্ধানীদের ক্লাব, এটা তারা পরিস্কার করেনি। দু’ নৌকাতে পা দিয়ে যতদিন চালানো যায়। আরেক শাহবাগি সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিন যখন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভিতে এ প্রসঙ্গে চেপে ধরেছিলো, মঞ্চের পান্ডারা এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছে। কথা ঘুরিয়ে দিয়েছে।

তবে বাংলাদেশে সব শ্রেণীতেই দুর্নীতি আছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি থেকে শুরু করে জাগপা, ন্যাপ, সিপিবি সব রাজনৈতিক দলেই এটা কম বেশি আছে। অথবা এফবিসিসিআই থেকে শুরু করে মহল্লার দুর্বার ক্লাব পর্যন্ত।

সর্বব্যাপী এ অসততা আর শয়তানি বন্ধ করার, নিদেনপক্ষে কিছুটা চেক দেয়ার, বড় একটা উপায় হলো জবাবদিহীতার ভিত্তিতে হিসাব রক্ষণ। পুরো পৃথিবীর মানুষ এটা মানে, শুধু বাংলাদেশের না। আর এখানে এসেও শাহবাগিরা তাদের চরম পশুসুলভ চরিত্র প্রকাশ করেছে। একজন সুস্থ মানুষ যদি কোন খারাপ কাজ করে, তাকে বুঝানো যায়। কিন্তু একটা পশু যদি কোন খারাপ কাজ করে, তাকে বুঝাতে গেলে উল্টা কামড় খেতে হয়।

শাহবাগিদের বড় একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তারা যে কোন খারাপ কাজ করে পুরোপুরি নির্দ্বিধায়, খোলা গলায় সে খারাপ কাজটাকে ভালো ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বলে যেতে থাকে। এটা তারা তাদের অবৈধ জন্মদাতা আওয়ামী লীগ থেকে জেনেটিকালি পেয়েছে।

শাহবাগি এক পান্ডা, ঘৃণ্য যৌনকর্ম সম্পর্কিত লেখক ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিদ তার স্ট্যাটাসে লিখেছে “একটা সময় শেখ রেহানা আপার কাছ থেকে টাকা পয়সা নেওয়া হতো আমার ব্লগের খরচপাতি দেখায়া যে অনলাইনে এইটা আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করতেছে। এখন আর কে কে দেয় কে জানে। দিন বদলাইছে, এখন অনুদান দিলেও সেইটা আবার ফেরত চাওয়ার নিয়ম শুরু হইছে। লোকজন মালিকানার কাগজ দাখিল এবং অনুদানের হিসাব চাওয়া শুরু করলে খেলাটা কেমন হবে ভাবতেছি”।

10173192_10203726617785331_1435056657_n

কথা দীর্ঘ না করে, তিনটা অনুসিদ্ধান্ত।

১. শাহবাগ আন্দোলন প্রসব হওয়ার আগেই, গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে শেখ পরিবার সরাসরি এর পরিচর্যা করে আসছে।

২. হাসিনা রেহানা বোনদ্বয়ের এতোই টাকা আছে যে, কিছু লাফাঙ্গা কুকুরের সামনে হাড্ডি হিসেবে থোক থোক টাকা দেয়া কোন ব্যাপার না।

৩. শাহবাগিরা যেখানে সরাসরি বাংলাদেশের রাজপরিবারের সদস্য থেকে টাকা নিতে পেরেছে, সেখানে বিভিন্ন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা, অফিস আদালত, সংগঠন আর ব্যাক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা তাদের জন্য কোন ব্যাপার না।

এ তিনটা অনুসিদ্ধান্তের পর শেষ একটা শাহবাগি মোরাল।

টাকা দিবেন, কিন্তু কোন জবাবদিহীতা আশা করলে আপনি স্বাধীনতা বিরোধী। স্বচ্ছতা ও সততা প্রত্যাশার অর্থ হলো আপনি চেতনাগুরু স্যার জাফর ইকবালের ফিল্টার পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ।

ষাঁড়ের আদর্শ আসলেই ব্যাতিক্রমী, অভূতপূর্ব। যুদ্ধ যেমন অস্ত্র দিয়ে হয়না, অমিত সাহস দিয়ে হয়। এই বাংলাদেশে চেতনার বাস্তবায়নও তেমনিভাবে সততা দিয়ে হয়না, লাল পর্দার আড়ালে পকেট ভর্তি করা দিয়ে হয়।

Omi Pial’s complete Status 4/10/2014

Omi Rahman Pial
সুশান্ত যে আমার ব্লগের মালিকানা সত্যিই বিক্রি করছে সেইটা একটু দেরিতে গিয়া বুঝতে পারছি। যদিও তার ইঙ্গিত সে অনেক আগেই দিছিলো, পোস্ট দিয়াও ঘোষণা দিছে যে সে এইটা বিক্রি করতেছে। এটিমের গ্রুপ মেইলে সে বলছিলো সে ঘটনাটা সাজাইতেছে এইটা আবঝাব ব্লা ব্লা ব্লা। কিন্তু আচমকাই আমার ব্লগের নীতিমালায় পরিবর্তন দেইখা বুঝতে পারলাম এইটা এখন তার হাতে নাই। গত চারবছর আমি আমার ব্লগে লেখছি, শুধু আমার ব্লগেই, অনেকের অনুরোধেও কোথাও স্বনামে ব্লগিং করি নাই্,বেনামে তো প্রশ্নই ওঠে না। এই একক আনুগত্যের কারণ স্রেফ একটা চুক্তিনামা: আমার ব্লগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে কোনোরকম মতবাদ কিংবা স্বাধীনতাবিরোধী কোন পোস্ট প্রমোট করবে না। হঠাৎ সেইখানে দেখি ছাগুদের রমরমা, অ্যাসঅফ আইসা পোস্ট লেখে ছদ্মনামে, ঘ্যাংয়াররা সব রাতারাতি দেখি ব্লোজবার থিকা বোলোগার হ্ইয়া গেছে। 

নীতিমালার এই পরিবর্তনটা চোখে পড়ছে শাহবাগে গণজাগরণ শুরু হওয়ার পরপর।হঠাৎ আইজু খেইপা উঠলো এই জাগরণের বিরুদ্ধে। আর রাতারাতি দেখি সুশান্তের টোন চেইঞ্জ। এইটা আরো শক্ত হইলো যখন সামু ব্লগ সরকারের তোপে, সচল নেহাতই এক সুশীল ব্লগ, ছাগুদের আশাভরসার সোনার বাংলা ব্লগ বন্ধ। ওইসময় আমার ব্লগের ট্রাফিক ভালো। ব্লগের দুই কোর ব্লগার আমি আর আরিফ জেবতিক শাহবাগে। তো যেইখানে আমার একটা পোস্টের সার্বিক হিট এদের সবার (আইজু সুশান্ত আমার ব্লগের মঞ্চবিরোধী মোর্চা এবং ঘ্যাং) মোট হিটের থেকেও বেশী থাকে আমার একটা প্রিভিলেজ তো পাওয়ারই কথা এই বিষয়ে। আইজুরে বললাম এইসব বালছাল বইলা আমাদের বিব্রত না করতে। বাহ, আমার ব্লগে দেখি আমারই এক্সেস ব্যান। তখন বুঝলাম সত্যিই মালিকানা বদলাইছে।

এখন শিয়াল পন্ডিত এবং কুমীরের সাতটি ছানার গল্পটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার? ছয়টারে খাইয়া সে একটারেই সাতবার দেখাইছিলো কুমীররে। আমি এইখানে তেমনই একটা গন্ধ পাইতেছি। কারণ আইজু বাকোয়াজ দেয় আমার ব্লগ এখন তার, শারুণ আমারে আগে বলছে আমার ব্লগে তার শেয়ার আছে, কয়দিন আগে শুনলাম মাসকাওয়াথ ভাইও আমার ব্লগ কিনছেন, কানাডার এক এ টিমারও শুনছি আমার ব্লগ কিনছে. আবার ব্লগারদের একটা জোটও নাকি আমার ব্লগের মালিক, শোনা যায় আওয়ামী লীগের দুইজন মন্ত্রী নাকি আমার ব্লগের মালিক। লন্ডনের নাস্তিক জোটও নাকি আমার ব্লগ কিনছে। হোয়াট দ্য ফাক ম্যান। আমার ব্লগ তুমি আসলে কার? তাইলে ওইখানে আমার লেখা পোস্টগুলা কার? আমার নাকি তাগো? যে যার খুশী মতো কোনো এক এএসপিরে বেইচা দিবো কোনো ডিলের বিনিময়ে!!!

পুনশ্চ: একটা সময় শেখ রেহানা আপার কাছ থেকে টাকা পয়সা নেওয়া হতো আমার ব্লগের খরচপাতি দেখায়া যে অনলাইনে এইটা আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করতেছে। এখন আর কে কে দেয় কে জানে। দিন বদলাইছে, এখন অনুদান দিলেও সেইটা আবার ফেরত চাওয়ার নিয়ম শুরু হইছে। লোকজন মালিকানার কাগজ দাখিল এবং অনুদানের হিসাব চাওয়া শুরু করলে খেলাটা কেমন হবে ভাবতেছি … — feelingcurious.

শাহবাগীদের দেশপ্রেম

19

এই শিরোনামের জন্য আমি লজ্জিত এবং দুটো ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে মনে করি। প্রথমত: শাহবাগী বলতে হালকাভাবে যাদের বোঝানো হয় তারা অনেকেই এই নামে ডাকাটাকে অপমানজনক মনে করেন। তবে এই বিশেষ গোষ্ঠীকে এছাড়া অন্য যেসব শব্দে বিশেষায়িত করা হয় যেমন চেতনা-ব্রিগেড, চেতনাইজড – সেগুলো আরো আপত্তিকর মনে হয়েছে। তাই এ লেখায় অপেক্ষাকৃত কম আপত্তিকর বিশেষ্যটায় আস্থা রাখা হোলো – আশা করি আপনারা ব্যাপারটা স্পোর্টিংলি নেবেন।

দ্বিতীয়ত: অনেকেই আশা করেন যে কারো দেশপ্রেম নিয়ে ক্রিটিক করতে হলে নিজের দেশপ্রেম স্পষ্ট করাটা জরুরী। এই প্রসঙ্গে ভণ্ডামীর  কোনো অবকাশ যেন না থাকে সেজন্য প্রথমেই বলে রাখি, আমি নিজেকে দেশপ্রেমিক বলে দাবী করি না। আধুনিক কালে যেই বিশেষায়িত আবেগকে “দেশপ্রেম” হিসাবে হাজির করা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, আমি তার ঘোরতর বিরোধী – কিন্তু সেটা ভিন্ন আলাপ। যারা দেশপ্রেমের সাগর কেচে ফেলেন অনুদিন, তারা যে স্ট্যান্ডার্ডকে দেশপ্রেম বলেন – কথা দিচ্ছি আমি কেবল সেই স্ট্যান্ডার্ড নিয়েই কথা বলবো। নিজের বিশ্বাস টেনে এনে ঘোট পাকাবো না – এটা আমার প্রতিশ্রুতি।

প্রথম নোক্তা: কারা শাহবাগী?

অনেকগুলো মেয়ের মজলিশে সুন্দরীতমাটি কে – এটি সনাক্ত করা খুব সহজ – সবাই ঠিক জেনে যায় পলকেই – কিন্তু ব্যাখ্যা করাটা কঠিন। শাহবাগী কে, এটাও ব্যাখ্যা করা সহজ না – you just know it। কিন্তু প্রয়োজন আছে ব্যাখ্যা করার। আমি একটা এসিড টেস্ট বের করেছি – শাহবাগী শনাক্ত করবার। অনেকটা সাইকোলজিকাল টেস্টের মতোন একটা প্রশ্ন।

ধরা যাক (আবারও বলছি – ধরা যাক। বাস্তবে এই অবস্থা তৈরী হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই) সৌদী আরব বললো যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে হবে। যদি না করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব শ্রমিকদের দেশে ফেরৎ পাঠানো হবে। কথার কথা হিসাবে ধরে নিচ্ছি যে বাংলাদেশের রেমিটেন্সের ৮০ ভাগ আসছে সৌদি আরব থেকে এবং রেমিটেন্স বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত – অঙ্কের হিসাবে জিডিপির ৫০ শতাংশ। এমন অবস্থা হলে আপনি কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার পক্ষে থাকবেন?

আমার পরিচিত যে কজন শাহবাগীকে জিজ্ঞেস করেছি সবাই বলেছেন যে না, বিচার বন্ধ করা যাবে না। বাকীরা স্বাভাবিক অবস্থায় যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইলেও এমন অবস্থায় পিছু হটবেন। (দয়া করে এটাকে আক্ষরিক অর্থে এসিড টেস্ট মনে করবেন না – এটি আমার পর্যবেক্ষণ মাত্র)

অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের বিচারকে শাহবাগীরা স্থান, কাল, পাত্র, বাস্তবতা এসবের ঘেরাটোপে বাঁধতে রাজী নন, এই দাবী এবং এই প্রসঙ্গটি তাদের কাছে একটি আইনী প্রসঙ্গ যতোটুকু তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী একটি “পবিত্র” বিষয়, “চেতনার” বিষয়। স্পষ্টতই যে অপরাধ তারা নিজেরা করেন নি (অর্থাৎ চল্লিশ বছর ধরে বিচার না হওয়াটা) সে অপরাধের দায়ভার নিজেদের ওপর চাপিয়ে তারা উচ্চ নৈতিকতায় আক্রান্ত হন (তারা প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন) এবং সেই অপরাধের শাস্তি চাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধ/পবিত্র করে তুলতে চান। পুরো ব্যাপারটাকে তারা প্রচুর ও প্রচুর সিম্বলিজম এবং শক্তিশালী সংস্কার সহযোগে ধর্মাচারের খুব কাছাকাছি নিয়ে যান।

Image

আমি এই মানুষগুলোকে খুব গুরুত্বসহকারে ও কৌতুকভরে পর্যবেক্ষণ করি, বোঝার চেষ্টা করি। যে বিশেষত্ত্ব আমি সবসময় লক্ষ্য করি তা হলো – দেশ, ৭১, গণতন্ত্র, জামাত, পাকিস্তান, বঙ্গবন্ধু এবং ছাগু – এসব শব্দের উপূর্যপুরি ব্যবহার, অবিরাম ব্যবহার। যেকোনো সচেতন পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে তারা গণতন্ত্র, পশ্চিমা “উদারনৈতিক” মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমকে খুবই উচ্চ আদর্শ মানেন এবং সে মতে অনুশীলনও করেন।

কিন্তু বাস্তবটা ভিন্ন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে তাদের প্রায় সবার প্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে যে শেখ হাসিনা একটি এক ব্যক্তির আজ্ঞাবহ গোত্রে পরিণত করেছেন তার বিরুদ্ধে অন্তত একটা বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান নেয়ার কথা ছিলো। আওয়ামী লীগের হয়ে এলেকশান করা এক রাজনীতিবিদ আমাকে বলেছেন যে শেখ হাসিনার চেয়ে বড় একনায়ক ভারতবর্ষের ইতিহাসে কখনো আসে নি। যতোবড় একনায়কই হোক, অন্তত পার্টি-মেন কিংবা জেনারেলদের সাথে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত দেন। সিনিয়র মেম্বারদের মতামত আপনি নেবেন কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ কিন্তু একনায়করা অন্তত আলোচনা করেন। শেখ হাসিনা এ প্রয়োজনটুকুও বোধ করেন না। দলের মহাসচিবও জানেন না তিনি কী করবেন।

তাদের প্রিয় দলের নেত্রী যে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুরো দেশটাকে বিস্ফোরণমুখ করে ফেলেছেন এবং এর দায়ভার যে প্রায় এককভাবে তার (আওয়ামী লীগের বহু দায়িত্বশীল নেতা পার্টির ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের বিরোধিতা করেছেন বলে তাদের দায়ভার কম) – এই কথা কোনো সুস্থ মানুষ অস্বীকার করতে পারবেন বলে মনে হয় না, কিন্তু বিস্ময়করভাবে নন-রেসিডেন্ট শাহবাগী, যাদের অনেকেই খুব ভালো পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ডিগ্রী করছেন তারাও কোনো উচ্চ-বাচ্য করেন না। এমন কি অনেকে এখনো এই বিষয়ে হাসিনাকে সমর্থনও করেন। এত মানুষ মারা যাচ্ছে এক ব্যক্তির এরকম গোয়ার্তুমির কারণে – দেশপ্রেমিক হলে এই অবস্থা জাস্টিফাই করার কথা ছিলো না।

এ পর্যবেক্ষণ থেকে আমি প্রথমত এই সিদ্ধান্তে আসি। আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন কোনো ভুলই করা সম্ভব না যার কারণে শাহবাগীরা তাদের সমর্থন তুলে ফেলবেন এবং বিএনপির পক্ষে এমন কোনোই ভালো কাজ করা সম্ভব না যার কারণে তাদের সমর্থন করা যায়। চল্লিশ বছর আগে যে যা করেছেন সেটিই চূড়ান্ত ও পরম। অনুভব করি যে অন্তত রাজনৈতিক সমর্থনের ব্যাপারে তারা ধার্মিকদের মতোন আচরণ করতে সচ্ছন্দ।

Image

কিন্তু এটা কোনো অভিনব বিষয় না। বিএনপির সমর্থকদের মধ্যেও আমি এ ধরনের মানুষ দেখেছি। আমার কাছে অভিনব লেগেছে দেশ ও দেশপ্রেম – এই বিষয়গুলোকে তারা কীভাবে দেখেন – এই ব্যাপারগুলো। শ্রদ্ধেয় এবং আমার দেখা মেধাবীতম বাঙালিদের একজন আবেদ চৌধুরীর ভাষা ধার করে বলি – যারা MIT’র ল্যাবে বসে পৃথিবী বদলে দেয়ার বদলে ৭১ এর জুলাই মাসে মেহেরপুরে কতো রাউন্ড গুলি করা হয়েছিলো – এই চিন্তায় দিনগুজার করেন তারা আর যাই হোক, সুতীব্র অনুভুতি যে পোষণ করেন – এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।
তা এই অনুভূতিকে কি আমরা দেশপ্রেম বলবো?

কোনমতেই না। কারণ এই একই মানুষ ঘটমান বর্তমানে নিজের দেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর পুলিশ বাহিনীর গুলি চালানোকে মনে করেন কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ, এই একই মানুষ ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী পালন করেন অথচ সেই দিনেই বিরোধী মতের রাজনীতিবিদ গুম হলে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেন না। শুধুমাত্র বিএনপি কিংবা জামাত করার কারণে রাষ্ট্র এখন বহু সাধারণ কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা ক্ষেত্র বিশেষে ৭১ এর চেয়েও ভয়াবহ কিন্তু এসব ব্যাপারে তারা মতিকন্ঠ করেন।

দেশের অর্ধেক মানুষকে বাদ দিয়ে “দেশপ্রেম” করা যায় কি?

তাহলে তারা যা করেন সেটা কি?

আমার ধারণা শাহবাগীরা তাদের পছন্দের একটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ডে থাকেন। এই “থাকার” একটা বিশেষত্ত্ব আছে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে তাদের কিছু আইডিয়া, কিছু টোটেম, কিছু মাসকট, কিছু ইভেন্ট আছে যেগুলোকেই তারা বাংলাদেশ বলে মনে করেন। ব্যাপারটা বোঝানো একটু কঠিন – তবু চেষ্টা করি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন – এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু শাহবাগীদের সাইকোএনালিসিস করলে আমার ধারণা দেখা যাবে যে দাড়িপাল্লার এক পাশে বাংলাদেশ, আরেক পাশে মুক্তিযুদ্ধ রাখলে তারা মুক্তিযুদ্ধ নামক “ইভেন্ট”টিকে বাংলাদেশের চাইতেও বড় মনে করবেন। আরো গহীনে গেলে আমার মনে হয় দেখা যাবে যে ৭১ এর আসল ঘটনা না, মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভটাই তাদের কাছে সবচেয়ে প্রেশাস। কারণ মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস কি তার চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হোলো এই ন্যারেটিভটাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে তারা নিজেদের পবিত্র, নৈতিক, মহান – এসব মনে করতে পারেন। তারা তাদের “দেশের” এমন “আলাদা বিষয়গুলোকে” প্রবলভাবে ভালোবাসতে সক্ষম কিন্তু বিষয়গুলো এক করতে পারেন না – সেজন্যই সেটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ড।

কেন এমন হয়?

আমার ধারণা “বাংলাদেশ” নামক রাষ্ট্রটিকে দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে ভালোবাসা খুব কঠিন – বিশেষ করে এখন যাদের বয়স ৩০ এর কম তাদের জন্য। কোনো অসুন্দর জিনিস দীর্ঘদিন ভালোবাসা যায় না। যারা আগ্রহী তারা ষাট, এমন কি আশির দশকের ঢাকার স্টিল ফটোগ্রাফ দেখতে পারেন। অপূর্ব সুন্দর, ছিমছাম এক নগরী। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বইয়ে (প্রকাশকাল জুন ‘৭১ – সম্ভবত) কাজী আনোয়ার হোসেন ঢাকাকে উল্লেখ করছেন “রমনীয়” ঢাকা বলে। সুন্দরকে ভালোবাসা যায়, ভালোবাসতেই হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না আমাদের বাবাদের প্রজন্ম যে যুদ্ধ করেছিলেন তার মূল কারণ ছিলো তারা তাদের মেমোরীকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, যে মেমোরী হোলো তাদের শৈশব ও কৈশোরের “সুন্দর” একটা দেশ, যাকে রক্ষা করা যায়, করতে হয়। কিন্তু আজকের ঢাকা কুৎসিত, পুরো দেশে শুধু মানুষ আর মানুষ, চারদিকে শুধু কংক্রিট। মানুষগুলোও বদলে গেছে – মুদির দোকানী থেকে প্রধানমন্ত্রী, সবাই অকারণে যখন-তখন মিথ্যা বলছেন। টিভি খুলবেন – বাজে খবর, পত্রিকা খুলবেন তো ভয়ঙ্কর খবর। শহরটাকে যে একটু অন্য চোখে তাকাবেন, সেই সময়টুকুও নেই।

কার্যকারণের সমন্বয় খুঁজতে গেলে এই দেশকে ভালোবাসা, রীতিমতোন এক এইচএসসি পরীক্ষা।

কিন্তু স্কুলে আপনাকে প্রাইম করা হয়েছে দেশকে ভালোবাসার জন্য। ইসলাম শিক্ষায় পড়েছেন “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ”, বাংলা বইয়ে পড়েছেন “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা”/ নিজের ভাইকে যদি আপনি ভালো না বাসেন আপনি বড়জোর হৃদয়হীন মানুষ, কিন্তু খারাপ নন। অন্য দিকে নিজের দেশটাকে যদি ভালো না বাসেন, আপনি “অনৈতিক” মানুষ। “দেশপ্রেম না থাকা” আর “বিশ্বাসঘাতকতা” বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি বিষয়।

আপনার মনের শিক্ষিত অংশ বলছে দেশকে ভালোবাসতে হবে কিন্তু ইনসটিংটিভ অংশ প্রশ্ন করছে এই দেশকে কি ভালবাসা যায়?

তা এই টানাপোড়েনের প্রতিক্রিয়া কী? আপনি পেছনে তাকাবেন এবং এমন কিছু ব্যক্তি, ইভেন্ট ও ধারণা বেছে নেবেন যার একটা অতি সরল ন্যারেটিভ আছে এবং এই ইন্ডিভিজুয়াল বিষয়গুলোকেই বাংলাদেশ বলে ভাবতে শুরু করবেন (সেহেতু তা “রক্ষা” করা যায়) / এটাই দেশপ্রেম, এটাই চেতনা।

আমার ধারণা শাহবাগীরা এই ভাবেই দেশটাকে দেখেন।

এর একটা খুব বড় সুবিধা আছে। যেহেতু আপনার “দেশ” আসলে আলাদা আলাদা কিছু ইভেন্ট এবং যেহেতু এই ইভেন্টগুলো বাস্তবতার উর্ধ্বে (আপনার কাছে) সেহেতু এই ইভেন্টগুলো নিজেরা খুবই ফ্লুয়িড। যেকোনো ব্যাখ্যা, যে কোনো নির্দেশ যতোক্ষন আপনার পক্ষে যায়, মনে হবে যে এটাই সত্যি। আগ্রহীরা হয়তো দেখেছেন যে দেওয়ানবাগী পীর ওয়াজে বলছেন যে তার স্ত্রী আসলে বিবি ফাতিমা এবং যেহেতু বিবি ফাতিমা তার “ভেতরে” আছেন সেহেতু তার সাথে রাসুলের একটা “যোগাযোগ” তৈরী হয়েছে এবং এই যোগাযোগের কারণেই তার মুরীদেরা তাকে রাসুল হিসাবে স্বপ্নে দেখেন। মজার ব্যাপার হোলো এই কথাগুলো যখন তিনি বলেন তখন তার ভক্তরা তাকে তীব্রভাবে সায় দেয়। ধার্মিকেরা যখন এই ভিডিও দেখেন তখন অগ্নিশর্মা হয়ে যান এবংসহজ প্রশ্নটি করতে ভুলে যান যে ভক্তদের কাছে কেন এটা রিয়ালিটি বলে মনে হয়?

কারণ দেওয়ানবাগীর ভক্তদের কাছে দেওয়ানবাগী একটা “প্রটেকটেড ইভেন্ট” – তাকে বাস্তবতার ধার ধরতে হয় না। আর যখন কোনো ইভেন্টকে আপনি বাস্তবতার উর্ধ্বে উঠিয়ে ফেলতে পারেন তখন এই ইভেন্ট “ইতিহাস” থাকে না, একটা অর্গানিজমে পরিণত হয় – সেল্ফ সার্ভিং অর্গানিজম। আমি একবার একটা সামান্য পরীক্ষা করেছিলাম, ঘটনাটা খুবই ইন্টারেস্টিং। আমার এক তীব্র আওয়ামী সমর্থক বন্ধুকে একটা গল্প বলেছিলাম, দেওয়ানবাগীর গল্প থেকে খুব আলাদা না। আমি খুব সিরিয়াসলি তাকে বলা শুরু করলাম যে মাত্র নয় মাসে যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে এর আসল কারণ বঙ্গবন্ধু। তিনি যে লায়ালপুর কারাগারে ছিলেন এটা পুরোপুরি সত্য না। প্রথমে বন্দী থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ সময় তিনি মস্কোতে ছিলেন এবং মস্কোতে তিনি ইস্টার্ন ব্লকের হয়ে দর কষাকষি করছিলেন আমেরিকার সাথে। গল্পটা বিশ্বাস করানোর জন্য প্রচুর নথিপত্রের উল্লেখ করলাম, বললাম যে – পুরোপুরি স্বীকার না করলেও প্রাভদা এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস এর অমুক তারিখের এডিটরিয়ালে এর উল্লেখ আছে।

আমার এই বন্ধুটি সম্ভবত বাসুদা এবং মেজবাহ আহমেদের পর্যায়ের শাহবাগী নন কিন্তু মজার সাথে লক্ষ্য করলাম যে একটিবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করলেন না যে পাকিস্তান কেন বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেবে মস্কোতে যাওয়ার জন্য এবং মস্কো থেকে তিনি পাকিস্তানে ফেরতই বা আসলেন কী করে?

এটাকেই আমি বলেছি “ফ্লুয়িড” এবং ফ্লুয়িড বলেই পুরো ঘটনা আর কোনো ঐতিহাসিক ইভেন্ট থাকে না – হয়ে যায় একটা অর্গানিজম। এখানে একজন লাকীর প্রয়োজন হবে স্লোগান দেয়ার জন্য, একজন মাহবুব রশীদ দেবেন ফেসবুক স্টেটাস, মেসবাহ আহমেদ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার ফাঁকে এসে আমাদের জানাবেন এক দেশে দুই আইন থাকার বিপদ এবং বাসুদা অনুরোধ করবেন সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য। ইতিহাস আর কোনো ঘটনা থাকে না, হয়ে যায় একটা প্রাণী – যে বদলে যায়, সরে যায়। যে অরক্ষিত হতে পারে এবং যার সম্ভ্রমহানিও হতে পারে।

Image

শুধুমাত্র – আবারও বলছি – শুধুমাত্র “চেতনা”ই পারে এই প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। কেন?

কারণ চেতনা হোলো এক গোছা বিশ্বাস যাকে আপনি যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বে প্রায়োরিটি দেন। আপনি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে এই বিশ্বাসগুলোই আপনার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই শেষ না – আপনার সামনের মানুষটিকেও চেতনা করতে হবে – কেননা আপনি তাকে বিচার করবেন আপনরা চেতনা দিয়ে। ওইজা বোর্ডে যেমন আপনার অবচেতনের শক্তি আঙ্গুল নাড়িয়ে ডেকে আনে আত্মা, ঠিক তেমনি চেতনার সমস্মর, নিয়ন্ত্রণ করে ইতিহাস নামক প্রাণীটিকে। বর্তমানে বসে আপনি বদলে দেন অতীত। পারেন না বদলাতে শুধু বর্তমান।

এই যে আপনার ধর্মের মতো বিশ্বাস যাকে আমি ধর্মই বলি, শাহবাগীরা ভালোবেসে তার নাম দিয়েছে দেশপ্রেম।

photo credit: Maciej Dakowicz, Zakir Hossain Chowdhury    

শাহবাগ আমাদের টলারেন্স আর র‍্যাশনেলকে কতটুক প্রভাবিত করেছে?

shahbag-rationale-intolerance

কেমব্রিজ, ২৬ অক্টোবার ২০১৩

শাহবাগের সাফল্য যথারীতি জটিল আলোচনা। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই যদি এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে জমায়েত হয়ে একটা জায়গায় দিনের পর দিন বসে থাকা কোন অ্যাপ্রোচ হওয়ার কথা না। কারণ বিচার হচ্ছে আদালতের ব্যাপার, সাক্ষ্য প্রমাণের ব্যাপার। বিত্তবান খুনী জনপ্রতি পাঁচশো টাকা ধরে মোট দশ কোটি টাকা খরচ করে দুই লক্ষ লোককে দিয়ে আদালত ঘেরাও করলেও যেমন ন্যায়বান বিচারকের রায় বদলাবে না, তেমনি কারও কাছে সাক্ষ্য থাকলে সে আদালতে না গিয়ে জাফর ইকবালের মত শাহবাগে গিয়ে বসে থাকলেও বিচারের কোন সুবিধা হবে না।Continue Reading