শান্তি‬ ‪ও একচক্ষু‬ ‪‎হরিন‬

by Imtiaz Mirza

১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাস । একটি তরুনের বাবাকে পাকিবাহিনী হত্যা করেছে , মুক্তিকামী জনতাকে সরকারী অস্ত্রশস্ত্র বিলিয়ে দেয়ার জন্য ।
তরুনটি চিন্তা করে যুদ্ধে যাবে , পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিবে , দেশকে মুক্ত করবে অচলাবস্থা থেকে । কল্পনায় সে রাইফেল চালায় , পাকিদের মেরে খতম করে , রাজাকারদের ফুটো করে দেয় ।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে গুলির শব্দ শুনতে পায়, সচকিত হয়ে সে খেয়াল করে গুলির শব্দ কাছাকাছি কোথাও থেকেই আসছে ।
পাশের ঝোপের মধ্যে সে পালিয়ে যায় , কিছুক্ষন পর টের পায় , উষ্ণ জলধারা তার প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়েছে ।
ভিজে ভিজে গরম অনুভূতি নিয়ে সে অস্ফুটে বলে , যুদ্ধ নয় শান্তি চাই , একটুখানি শান্তি চাই , শান্তি মতো জলত্যাগের অধিকার চাই।
_____
১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাস , ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধ শুরু করেছে , প্যান্ট ভেজানো তরুন যুদ্ধে যায়নি বরং রাজাকার পীরের মুরীদ হয়ে , টুপি লাগিয়ে প্রানে বেচেছে ।
ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধটিকেই তরুনটি আসল যুদ্ধ মনে করে , সে মনে মনে ঠিক করে সে আসল যুদ্ধে যাবে , গেরিলা যুদ্ধের মতো ছিচকে যুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো গ্ল্যামারহীন যোদ্ধা হয়ে তার পোষাবে না । এর মাঝে সে সবাইকে বলে বেরিয়েছে , যুদ্ধ নয় শান্তি চাই , শ্রমিকরা ঘরে ফিরবে তাদের আপন জনের কাছে , তারা যুদ্ধ জানে না , তারা শান্তি চায় ।
মুক্তিযোদ্ধাদের শান্তির কথা বলবা মাত্র তাকে মেরে হাকিয়ে দিয়েছে তাকে , এই উত্তুঙ্গ সময়ে কেউ শান্তির কথা শুনতে চায় না ।

সে মনে মনে শান্তির জন্য যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে শুরু করলে , “মাত্র তের দিনের যুদ্ধে ” পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করে ।

______

প্যান্ট ভেজানো তরুন , ধীরে ধীরে একচক্ষু হরিনে পরিনত হয়েছে । সে সবাইকে গণতন্ত্রহীনতার কথা শিখাতে চেষ্টা করে । সে খুব সুন্দর করে বোঝাবার চেষ্টা করে , যে জগতে মাত্র পাচটা মানুষের পিএইচডি আছে , আর বাকী সবার ক্লাস ফাইভ ফেল করার অভিজ্ঞতা আছে , যেহেতু
ক্লাস ফাইভেই ফেল করেছে , তাই কারো পিএইচডি করতে চাওয়া উচিত না ।

অর্থ্যাৎ বিশ্বের পাচটা দেশে মৌলিক গণতন্ত্র আছে বিধায় , অন্যান্য দেশ গুলোতে নূন্যতম নির্বাচনও থাকা উচিত না ।

কারন আমরা কখনো পিএইচডি করতে পারবো না , কেন আমরা ক্লাস ফাইভের পরীক্ষা আবার দিবো ? আমরা দেশকে উন্নত করতে পারবো না কখনোই এইকারনে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নেই ।

সে সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করে গণতন্ত্র নয় , শান্তিই সবার প্রয়োজন ।
_______

১৯৭১ এ শান্তির দরকার ছিলো , ৬৯ এও ছিলো , ৫২ তে ছিলো , ৯০ তে ছিলো ,
শান্তি দরকার উন্নত জাতি হতে হলে । শান্তির প্রয়োজনীয়তাটা কখনো কম ছিলো না ।

কিন্তু প্যান্ট ভেজানো একচক্ষু হরিনের বক্তব্য মেনে নিলে , লাখ লাখ মানুষ মারার পরো ১৯৭১ এ শান্তির দায়ে , পাকিবাহিনীর ঘেটুপুত্র হয়ে বসে থাকা উচিত ছিলো । আইয়ুব খানের সীমিত গণতন্ত্র অর্থ্যাৎ এলিটদের গণতন্ত্র মেনে চুপ করে বসে থাকা দরকার ছিলো । রাষ্ট্রভাষা উর্দুর মেনে শান্তি মতো বাংলা চর্চার দরকার ছিলো । লম্পট স্বৈরাচারকে দেশ ভর্তি দুর্নীতি করতে দিয়ে
শান্তিকামী জনতার রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা দরকার ছিলো ।

প্রকৃতপক্ষে , যারা প্যান্টভেজানো একচক্ষু , যারা একটা দলকে নিজের ধর্মবিশ্বাসের চেয়ে পবিত্র মনে করে , দলের নেতাকে ধর্মাবতার জ্ঞান করে , তারা কখনো শান্তি আর অশান্তির পার্থক্য বুঝতে চায়নি । তাদের কাছে নিজের দল যেকোন মূল্যে ক্ষমতায় মানেই শান্তি।

প্রকৃতপক্ষে , হরতাল , অবরোধ , জ্বালাও-পোড়াও , গুলি , ক্রসফায়ার , বালুর ট্রাক , বিরোধী দলের মানুষ হত্যার পূর্বেও দেশে শান্তি ছিলো না , থাকতে পারে না । অশান্তি, ঘুনপোকার মতো দেশকে কাটছিলো , মানুষের হৃদয়মগজ খুড়ছিলো। অশান্তি মানুষের স্বাভাবিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিলো , মানুষের নায্য পাওনা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করছিলো । অশান্তি , অবৈধ সরকার হয়ে
মানুষের টাকা লুটপাট করে উলটো মানুষকে চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছিলো । অশান্তি , নূন্যতম নাগরিক অধিকার , মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলো । অশান্তি, বন্দুকে গুলি হয়ে শত শত বিরোধীদলের কর্মীকে হত্যা করেছিলো।
অশান্তি , মানুষকে তার অবেগে দিয়ে ব্লাকমেইল করিয়ে তার যাবতীয় অপকর্মকে শুদ্ধ করে নিচ্ছিলো ।

_______

শান্তি প্রয়োজন , শ্রমিকের , কৃষকের , নাগরিকের , পথশিশুর, অফিস যাত্রীর, গৃহিনীর ।
শান্তি আসবে দূর্নীতির ঘুণপোকা অশান্তি বিদায় নিলে, শান্তি আসবে অবৈধ স্বৈরাচারীর বুলেট স্তব্ধ হলে।

শান্তি আসবে তখনই যখন একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে , যেখানে সবার সমান সুযোগ থাকবে, কেউ নিজের পছন্দ মতো গদি আকড়ে থাকবে না ।

শান্তি আসবে শুধু মাত্র তখনই, যখন প্রতিটা নাগরিক ব্যালট বাক্স দিয়ে তাদের উপর অন্যায়-অত্যাচারের জবাব দিতে পারবে ।

https://www.facebook.com/sunno.aronnok

How to lose the history wars

by Jyoti Rahman

I said in the previous post:

They didn’t think much of him last winter. And since then, sporadic forays in our pathetic history wars have done nothing to improve his standing. They create media buzz, senior Awami League leaders end up looking quite stupid, and BNP rank-and-file feel fired up for a while. But what do they do to alleviate Mr Rahman’s extremely negative image?

Obviously, I don’t approve of the way Tarique Rahman is engaging in the ‘history wars’.  It occurs to me that I should elaborate and clarify.  Hence this post.  I don’t agree with Mr Rahman’s interpretation of history.  More importantly, from a partisan political perspective, I think they cause more harm than good for BNP.  And most frustratingly, a few solid points that BNP could make very usefully are utterly wasted.

Let’s start with the claim made about Sheikh Mujibur Rahman — that he was a Pakistani collaborator who compromised with the Yahya regime because he was after personal power.  I paraphrase, but this is the gist.  And this is about as sensible as the claim that Ziaur Rahman was a Pakistani spy.

Let me refer to GW Chowdhury, Abul Mansur Ahmed, and Moudud Ahmed.  Hardly disciples of the cult of Mujib, any of these men.  And yet, all three write how Mujib might have compromised on the Six Points at any time between the winter of 1968-69 and the summer of 1971, and become Pakistan’s prime minister.  Ayub and Yahya offered him the job in February 1969.  There was a general expectation that the Six Points were Mujib’s ambit claim, and he would compromise after the election.  ZA Bhutto calculated that.  Yahya Khan calculated that.

But Mujib did not.

In fact, by officiating a public ceremony where he led the Awami League legislators-elect to swear an oath on the Quran to never compromise on the Six Points, Mujib left himself little wiggle room to compromise even if he had wanted to.  What Mujib stood for in 1970 elections was abundantly clear, and he did not compromise from that.

Mujib wanted to compromise for personal gain — is Tarique Rahman trying to become the jatiyatabadi Omi Rahman Pial?

Of course, it gets worse.  What does one make of the claim that Mujib traveled on a Pakistani passport in January 1972?  I am sure Shafiq Rehman can conjure a brilliant political satire about the Heathrow immigration officer asking ‘Right, Sheikh eh, since when Pakis had Sheikhs’.  But the joke here is at the expense of anyone who believes Mujib would have needed a passport to pass through Heathrow that January.

And in this comedy, BNP loses a chance to score a sound political point.  No, Mujib wasn’t a Pakistani collaborator.  That’s nonsense.  What’s not nonsense, what’s undeniable, is that he did not prepare for an armed resistance, that he was absent from the war.  Now, it is possible to argue that Mujib did not want to lead a war of national liberation, and he had good reasons for taking the course he did — I have made that argument myself, and I stand by it.

But that’s just my interpretation of events.  And even if I am right, it’s legitimate to say that Mujib got it wrong big time.  Politically, the potent argument here is — the nation trusted Mujib with its future, and Mujib failed the nation in the dark night of 25 March 1971, not because Mujib was a bad guy, not because he was a collaborator, not because he was greedy or coward or anything, but far worse, he made the wrong judgment.

Salahuddin Quader Chowdhury once (in)famously made that point.  Repeatedly made, that would be a killer punch against the haloed Mujib myth.  What Tarique Rahman offers is not worth more than infantile facebook banter.

So, why does he do it?

Perhaps this passage from 2012 would provide some method behind this madness:

A blogger friend sounds a pessimistic note: ‘Our countrymen are maybe more blatant about it than most, but there is no “true” history anywhere in the world. It’s all air-brushed, covered with pancake makeup, and then dipped into rosewater.’ He suggests that these history wars are just a form of dialectic struggle, perhaps a healthy one at that.

That discussion was had at a time when Awami League cabinet ministers all the way to people like Muntassir Mamoon would routinely call Ziaur Rahman a Pakistani spy or sleeper agent.  Here is the full quote:

What will happen when BNP returns to power? Maybe what MM is doing is in anticipation of BNP returning to power. I mean, let’s face it, our countrymen are maybe more blatant about it than most, butthere is notruehistory anywhere in the world. It’s all airbrushed, covered with pancake makeup, andthen dipped into rosewater. Think of these “history wars” as a dialectic struggle, and whatever emerges out of this is what Bangladeshi children, fifty years on, will learn. And they won’t be any worse off for it.

Additionally, remember, when BNP comes to power, where MM leaves off is where BNP has to start. So the more AL-oriented the history is, the more effort BNP will have to put in to revert just back to the mid-point state, let alone make it pro-BNP.

So, calling Mujib a collaborator is perhaps the dialectic tat for the tit of Zia being a Pakistani spy.

Maybe.  And maybe in the long run this will all be washed out.  But right now, this isn’t doing Tarique Rahman any good.  Maybe if BNP ever came to power, it could start its version of history.  But right now, Tarique should remember what happened to Hasina Wajed in February 1991.

In the lead up to the parliamentary election of that month — the first one held after the fall of the Ershad regime — Mrs Wajed repeatedly launched personal attack on Zia, calling him a murderer and drunkard, including in her nationally televised (this was when there was nothing but the BTV) campaign speech.  Mr Rahman is old enough to remember how aghast the chattering classes were at Mrs Wajed.  This was a time when Zia was fondly remembered by our establishment.

Over the past quarter century, Zia’s image has faded, and Mujib’s has been given a new gloss.  Right now, the establishment reaction to Tarique is similar to the visceral reaction the Awami chief caused in 1991.

Mr Rahman seems to be learning the wrong lesson from Mrs Wajed.

So, what do I suggest?

Let me answer that with reference to why and how I believe BNP must engage in history wars:

BNP needs to win back today’s and tomorrow’s Saifur-Oli-Huda.  Without professionals, entrepreneurs, artists and intellectuals, BNP’s future will be dominated by the likes of Lutfuzzaman Babar. Winning the history wars is essential for avoiding that dark future.

…..

our history of political-social-economic struggles that predates 1971 and continues to our time.  This would not mean ignoring 1971, but to put that seminal year in its proper context.  …. our founding leaders like Fazlul Huq and HS Suhrawardy who came before Sheikh Mujibur Rahman and Ziaur Rahman, putting these men in their proper historical context.

….. we have struggled for a democratic polity, or social justice, from the time of British Raj.  Sometimes these struggles have been violent, at other times we had peaceful ‘ballot revolutions’.  Sometimes the leaders betrayed the trust people put on them.  Sometimes they made mistakes.  But overall, we have been making progress.  And ….. make the case for BNP in the context of that march of history.

That’s BNP’s overall challenge for the history wars.  And I do not suggest Mr Rahman has to fight a solo battle.  But if he must engage in political dog fight about dead presidents, I would suggest leaving Mujib alone, and focusing on restoring Zia.

Arguably, Tarique’s initial foray at the history wars was an attempt at this.  Unfortunately, he seems to have made a hash of it, losing the forest for the trees.

For a long time, BNP has tried to establish Zia as the one who declared independence.  In the process, the argument got to a minutae of who got to the radio station and held the mike first, completely missing the historical significance of Zia’s multiple radio speeches.  What was the significance?  The significance was that a serving major in Pakistani army publicly, in English, severed ties with Pakistan and called for an armed resistance.  The significance was not that it was a declaration of independence.  The significance was that it was a declaration of war.  That significance was completely lost.

Now the claim is that Zia was Bangladesh’s first president.  Well, in his first speech, Zia claimed that he was the head of the provisional government.  In the next version, he dropped that bit.  So, is he or isn’t he the first president?

Well, the founding legal document of the country is the Mujibnagar Proclamation, and that says:

We the elected representatives of the people of Bangladesh, as honour bound by the mandate given to us by the people of Bangladesh whose will is supreme duly constituted ourselves into a Constituent Assembly, and having held mutual consultations, and in order to ensure for the people of Bangladesh equality, human dignity and social justice,

Declare and constitute Bangladesh to be sovereign Peoples’ Republic and thereby confirm the declaration of independence already made by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman,

AND

do hereby affirm and resolve that till such time as a Constitution is framed, Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman shall be the President of the Republic and that Syed Nazrul Islam shall be the Vice President of the Republic

So we can have a nice legal argument that tries to make Zia the first president, and in the process lose a very important aspect of Zia’s action — something that is directly relevant in today’s Bangladesh.

Because Tarique said so, it’s now becoming BNP’s holy truth that Zia was the first president.  In the process, the fact that Major Zia swore allegiance and subservience to a democratically elected civilian political leadership is completely lost.  Zia’s bravery is March 1971 is to be lauded.  But for BNP, it’s also important to highlight his political maturity, and dedication to civilian, constitutional rule.  And that is exactly what he displayed on 15 August 1975, when he reminded Major General Shafiullah that the president might be dead, there was still a constitution and a vice president.  Whether in 1971 or 1975, Zia deferred to the civilian leadership and constitutionalism.   The relevance for an eventual post-AL Bangladesh is self-evident.

As it happens, Tarique Rahman was not the first person to claim that Zia is our first president.  In November-December 1987, Dhaka was rocked by a series of hartals that nearly brought down the Ershad regime.  Emergency had to be declared, and most opposition politicians were arrested.  Then, on 15-16 December, posters emerged around the city.  One had Mujib’s wireless message to Chittagong declaring independence, apparently sent before the midnight crackdown.  The other claimed Zia as the first president.

Oh, Ershad stayed in power for three more years.  How much more time is BNP’s history wars giving the current regime?

ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবি হত্যা, কিছু প্রশ্ন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে কতজন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়েছিলো? সাধারন বাংলাদেশীদের মনে সম্ভবত এই সংখ্যাটি বেশ বড়ো, তবে সেটা ব্যাক্তিভেদে যে কোনো কিছু হতে পারে। অনেকেই মনে করেন এই সংখ্যা শত শত, কিংবা হাজার হাজার। এই বিষয়ে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। কিছু কিছু তথ্য যা সহজে পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে,

১৯৭১ এর ডিসেম্বরে মে: জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডাইরীতে করা ২৫০ টি নামের তালিকা যাদেরকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছিলো(1)। বাংলাপেডিয়া’র বুদ্ধিজীবি গনহত্যা পাতায় বলা হয়েছে যে ১৬ই ডিসেম্বরের তিন চারদিন আগ থেকে বুদ্ধিজীবি হত্যার কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৪ই ডিসেম্বর রাতে ২০০ জনেরও বেশী বুদ্ধিজীবিকে তাদের বাসা হতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় (2)।এছাড়া আরো দেখা যায় ১৯৭১ এর ডিসেম্বর ২২ তারিখে আজাদ পত্রিকার একটি সংবাদ যেখানে ভারতের আকাশবাণীকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তা, রুহুল কুদ্দুস, বলেন যে কমপক্ষে ২৮০ জন পেশাজীবি ও বুদ্ধিজীবিকে ডিসেম্বরের ১৪ ও ১৫ তারিখে হত্যা করা হয়েছে ঢাকা, সিলেট, খুলনা ও ব্রাম্মনবাড়িয়ায়(3)।  এই রকম আরো কিছু তথ্যের ভিত্তিতে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে ডিসেম্বরের ১২-১৫ তারিখের মধ্যে ঢাকায় ও সারাদেশে কয়েকশত বুদ্ধিজীবি হত্যা করা হয়েছে।

আমরা মোটামুটি সবাই জানি যে ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবি হত্যায় সরাসরি অংশ নেয়া সবচেয়ে কুখ্যাত ঘাতক হলো সেই সময়ে ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা ও আল বদর নেতা চৌধুরী মইন উদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান।  এদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযোগ ও মামলা করা হয়ে এবং অভিযুক্তরা পলাতক অবস্থায় মৃত্যুদন্ড শাস্তি পায়। এই শাস্তিটি তাদের অপরাধ অনুযায়ী কোনক্রমেই অবাক করার মতো কিছু নয়, কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হলো যে ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবি হত্যায় নেতৃত্ব দেয়া এই দুই অপরাধীর বিরুদ্ধে যখন প্রসিকিউশন চার্জ গঠন করে তখন তাদের কে কেবল মাত্র ঢাকায় ১৮ জন বুদ্ধিজীবি হত্যায় অভিযুক্ত করা হয় (4)। প্রসিকিউশনের রিপোর্ট বলে যে এই ১৮ জন বুদ্ধিজীবির মধ্যে রয়েছেন ৯ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও তিন জন চিকিৎসক।

আমরা অনেক আগে থেকেই দেখে আসছি যে প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর আসলে শত বুদ্ধিজীবি হত্যার কথা বলা হয়, রাও ফরমান আলীর শত জনের লিস্টের কথা বলা হয়, কিন্তু পত্রিকায় নাম ও ছবি আসে ১৫ থেকে ১৯ জনেরই মাত্র। নামসহ যাদের ছবিটি উপরে দেয়া হয়েছে। আমরা আরো দেখলাম যে কোর্টে মামলার জন্যে যখন সুনির্দিষ্ট তথ্যের দরকার পড়লো তখন প্রসিকিউশন মাত্র ১৮ জনেরই একটা লিস্ট হাজির করলো, যে লিস্টটি খুব সম্ভবত প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বরে পত্রিকার লিস্টটির অনুলিপি মাত্র।

 

এই থেকে আমাদের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে ১৪ ই ডিসেম্বর কতজন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়েছে? এই ১৮ জন ছাড়া আর কাকে কাকে হত্যা করা হয়েছে? তাদের নাম, ছবি আমরা ১৪ই ডিসেম্বরে কেনো দেখি না? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আজকেই পত্রিকার পাতায় (১৪/১২/১৪)। আজকের New Age পত্রিকায় বলা হয়েছে পুরো ১৯৭১ এ কতো জন বুদ্ধিজীবি হত্যা করা হয়েছে এ সম্পর্কে জাতির কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ের কাছে কোনো পূর্নাংগ লিস্ট নেই তবে কিছু সরকারী ও ব্যক্তিগত এস্টিমেশন রয়েছে যার সংখ্যার রেন্জ ২৩২থেকে ১১১১ পর্যন্ত(5)। আজকের The Daily Star এ বলা হয়েছে যে এই বছর ৭ই ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগ সরকার পার্লামেন্টে ঘোষনা করেছিলো যে ২০১৪ এর জুন মাসের মধ্যেই ১৯৭১ এ শহীদ সকল বুদ্ধিজীবির একটি পূর্নাংগ তালিকা প্রকাশ করবে (3)। জুন পেরিয়ে এখন ২০১৪শেষ হবার পথে, তবে সেরকম কোনো লিস্ট দেখা যাচ্ছে না।

 

উপরে New Age পত্রিকায় যে ১১১১জনের কথা বলা হয়েছে সেটি সম্ভবত বাংলাপেডিয়ার এস্টিমেট। এই এস্টিমেট অনুযায়ী পুরো ১৯৭১ এ নিহত বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ২১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবি ও প্রায় ৯৫০ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাতীত বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক রয়েছেন(2)। তবে এটি একটি ব্যাক্তিগত এস্টিমেটই, কোনো নির্ভরযোগ্য তালিকা নয়। আজকের New Age পত্রিকায় স্বয়ং শাহরিয়ার কবিরই বলেছেন যে বুদ্ধিজীবি হত্যার কয়েকটি কেস ছাড়া অধিকাংশ তথ্য ও অভিযোগের উপরে কোনো রিসার্চ করা হয় নি (5)।

 

১৯৭১ এর পরে আরো তেতাল্লিশটি ১৪ই ডিসেম্বর আসলেও আমরা এখনো এই প্র্শ্নের উত্তর দিতে পারি না যে ১২-১৫ ই ডিসেম্বর কতো জন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়েছে? পরিচিত ১৮ জনের বাইরে আর কাদের হত্যা করা হয়েছে? তাদের নাম ছবি কেনো আমরা দেখি না কোনো ১৪ ই ডিসেম্বরে?

 

আমাদের দেশের লোকের একটু লিস্টের ব্যাপারে এলার্জি আছে এটা মেনে নিয়েও বলা যায় লক্ষ-মিলিয়নের লিস্ট না হোক, হাজার জনের লিস্ট তো করা যেতেই পারে, তাই না?

 

[ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবি হত্যা নিয়ে সমর্থিত-অসমর্থিত সকল রকম সংবাদ ও বিশ্লেষনের একটা ভালো সংগ্রহ রয়েছে চৌধরী মইনউদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান এর বিচারের রায়ে। দেড়শ পাতার এই রিপোর্টের পিডিএফ কপি রয়েছে এই লিংকে। https://www.dropbox.com/s/3xckpr73pyzap4p/bangladesh_tribunal_chowdhury_mueenuddin_judgment.pdf  ]

 

Reference

(1) http://www.genocidebangladesh.org/?page_id=32

(2) http://www.banglapedia.org/HT/K_0330.htm

(3) http://www.thedailystar.net/cold-killing-design-55227

(4) http://www.dhakatribune.com/bangladesh/2013/oct/31/mueen-ashraf-verdict-sunday

(5) http://newagebd.net/76478/no-complete-list-of-martyred-intellectuals-44-years-on/#sthash.PcYoLBRk.dpbs

দিয়েন বিয়েন ফু হতে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও একদল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগী..

By Watchdog BD

সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও দেশটার প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ যেদিন মারা যান সেদিন আমি সোভিয়েত দেশে। সময়টা বোধহয় ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসের কোন একদিন হবে। ১৯৬৪ সালে সেই যে ক্ষমতায় বসেছিলেন নড়াচড়ার নামগন্ধ কোনদিন উচ্চারিত হয়নি। জনগণ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত দেশের প্রধানও কোনদিন মরতে পারেন।

তাই এই নেতার মৃত্যু বড় একটা ধাক্কা হয়ে আঘাত হেনেছিল সোভিয়েত সমাজে। একজন বিদেশী হিসাবে দেশটার ক্ষমতায় কে বসবে আর কে বিদায় নেবে তা একান্তই সে দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসাবে গন্য করেছি। তাই এ নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে সেমিস্টারের মাঝপথে এ ধরণের রাষ্ট্রীয় মৃত্যু দু’একদিনের জন্য হলেও যে আমাদের জন্য ছুটি নিয়ে আসবে এ ব্যাপারে আশার অন্ত ছিলনা। সময়টা ভয়াবহ শীতের সময়। তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে চল্লিশ ডিগ্রির আশপাশে উঠানামা করছে। অতিষ্ঠ ছাত্রজীবনে অতিরিক্ত ছুটি অপ্রত্যাশিত বিশ্রাম ও স্বস্তি নিয়ে আসবে এমন একটা প্রত্যাশায় উন্মুখ থাকতাম ঘোষনার। কিন্তু হায়, দিন গড়িয়ে যায় ঘোষনা আর আসে না। ক্রেমলিনের সামনে রেড স্কয়ারে লাখো মানুষের লাইন, বিদেশ হতে শোক বার্তার মিছিল, পাশাপাশি স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক মিডিয়া তোলপাড় কোনকিছুই আমাদের আন্দোলিত করতে পারেনি। আমরা শুধু প্রহর গুনতাম ছুটি নামক মহেন্দ্র ক্ষণের। শেষপর্যন্ত কাঙ্খিত ছুটির দেখা পেলাম, তবে তার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র দু মিনিট। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করতে সপ্তাহ খানেক চলে যায়। তারপর শুরু হয় শেষ বিদায়। যে মুহূর্তে লাশ কবরে নামানো হয় থেমে যায় গোটা দেশ। দু মিনিটের জন্য যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে যায়। থেমে যায় গাড়ি, ট্রেন, বিমান সহ সব ধরণের যানবাহনের চাকা। কারখানা গুলো হতে দু মিনিটের জন্য বিরামহীন ভাবে বাজাতে থাকে সাইরেন। এভাবেই বিদায় নেন সোভিয়েত লৌহমানব লেনিন, স্তালিন ও ক্রুশেভের উত্তরাধিকারী লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ। ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভুত হন নতুন নায়ক কনসটানটিন উস্তিনভিচ চেরনেন্‌কো।

ছুটি বিহীন এ ধরণের মৃত্যু কিছুটা হলেও হতাশ ও অবাক করেছিল আমাদের। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমাদের বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদ বিষয়ের শিক্ষক ছোটখাট একটা লেকচার দিয়ে জানালেন জাতিকে ছুটিতে পাঠিয়ে মৃতকে সন্মান দেখানোর রেওয়াজ দেশটায় চালু নেই। বরং অতিরিক্ত উৎপাদনই হতে পারে নেতার প্রতি যথাযোগ্য সন্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তর্ক বিতর্কের দেশ ছিলনা সোভিয়েত সাম্রাজ্য, তাই এ নিয়ে ত্যনা পেঁচানোর সুযোগ ছিল সীমিত। সপ্তাহ না ঘুরতে ব্রেজনেভ পর্ব পিছনে ফেলে জাতি এগিয়ে গেল নতুন উদ্যমে। ১৮ বছর যে মানুষটার মুখের কথায় সাইবেরিয়া হতে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত উঠাবসা করত, ১৮ দিনের মাথায় সে মানুষ ঠাঁই নিল ইতিহাসে। আমরাও ভুলে গেলাম ছুটি না পাওয়ার কষ্ট। তবে এ নিয়ে আমার শিক্ষকের করা মন্তব্যটা কেন জানি মগজে গেথে রইল, এবং সারা জীবনের জন্য। ছুটি, সভা, সেমিনার, বোমা ফাটানো কলম ঝড়, মুখ ফাটানো স্তুতি বন্দনা বাইরে গিয়েও মানুষকে সন্মান, শ্রদ্ধা জানানো যায়, সোভিয়েত দেশে ব্রেজনেভের বিদায় ক্ষণ হয়ত তারই মাইলস্টোন।

প্রতিটা জাতির কিছুনা কিছু ঘটনা থাকে যাকে ঘিরে আবর্তিত হয় তার বর্তমান ও ভবিষৎ। বাংলাদেশের জন্য ১৯৭১ সাল ছিল তেমনি একটা বছর। স্বাধীনতার জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে সংগ্রাম হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে। দখলদার শত্রুকে পরাজিত করে বিজয়ী জাতি মাথা উঁচু করে পৃথিবীর বুকে পা ফেলেছে, ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্নতির দৌঁড়ে সামিল হয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, মাথার উপর ছাদ এবং স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর লড়াই করতে গিয়ে শত্রু-মিত্রের সমীকরণ নতুন করে কষতে হয়েছে। সভ্যতা এভাবেই এগিয়ে গেছে এবং সামনে হয়ত এভাবেই এগুতে থাকবে হাজার বছর ধরে। আমার বন্ধু নগুয়েন চি থানকে দিয়েন বিয়েন ফু হতে শুরু হওয়া যুদ্ধের দাবানল হতে সরাসরি পাঠানো হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য। তাদের জানা ছিল যুদ্ধ চিরস্থায়ী নয় এবং স্বাধীনতার আসল ফসল ভোগ করতে প্রয়োজন হয়ে যোগ্য মানুষের। কেবল গোটা পরিবারই নয়, নগুয়েনের নিজের শরীরের অনেকাংশ পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল মার্কিন নাপাম বোমার আঘাতে। এতগুলো বছর পর সে নগুয়েনের নাতিকে আসতে হচ্ছে মার্কিন মুলুকে। পোষাক শিল্পের বাজারের সন্ধানে ঘুরতে হচ্ছে ম্যানহাটনের ৫নং স্ট্রীটে। জানিনা নগুয়েনের শরীর হতে নাপাম বোমার ক্ষত গুলো ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে কিনা। হয়ত ক্ষত নিয়েই ওদের ঘুরতে হচ্ছে, এবং এমন একটা দেশে যে দেশের বি-৫২ বোমারু বিমানের কার্পেটিং বোমায় জ্বলে, পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল ভিয়েতনামের জনপদ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ৭১ সালে শেষ হয়নি। যুদ্ধ চলছে এবং চলতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। আমরা যারা যুদ্ধকে কাছ হতে দেখেছি, যুদ্ধের ভাল-মন্দের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হয়েছি তাদের কথা ও কাজে যতটা না যুদ্ধের প্রভাব তার চাইতে হাজার গুন প্রভাবে টইটম্বুর জাতির নতুন প্রজন্ম। অনেকটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত মুক্তিযুদ্ধ ও তার চেতনার বায়বীয় বেলুনে ভেসে বেড়াচ্ছে এ প্রজন্ম। নতুন এ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই পাকি ও রাজাকার ’পুন্দানী’, যুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি নিয়ে রাজনীতির মাঠ তথা সোস্যাল মিডিয়ায় লাখ লাখ কর্মঘণ্টা ব্যায়। অথচ চেতনার অপর পীঠে এ দেশে রাজত্ব করছে ভয়াবহ দুর্নীতি, হত্যা, গুম সহ লুটের সুনামী। স্ববিরোধী এসব দেশপ্রেম জাতির অসুস্থতারই বহিঃপ্রকাশ।

স্বাধীনতা তথা দেশপ্রেম কেবল জামাত, পাকিস্তান, রাজাকার অধ্যায় নিয়ে তোলপাড় আর যুদ্ধাপরাধী বিচার দাবির মধ্যেই সীমিত থাকার কথা নয়, এর বাইরেও জাতির কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। এসব চাওয়া পাওয়া চেতনার বেলুন হতে মাটির ধরণীতে নামিয়ে আনার জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। চাপাবাজি ও ফাঁকা স্টেটাসের বাইরে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধকে সন্মান করা যায়। একটা সুস্থ, সবল, ঐক্যবদ্ধ জাতি ও স্বাভাবিক জন্ম-মৃত্যুর নিশ্চয়তার সমাজ হতে পারে এর মাইলস্টোন।

বিচারাধীন মামলার গনযোগাযোগ সম্পর্কিত প্যারাডক্সঃ কামারুজ্জামান প্রসঙ্গে

1

By Ariful Hossain Tuhin

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট, মামলা চলাকালীন সময়ে, কোর্টরুমে ভিডিও ক্যামেরা নিষিদ্ধ করেছে অনেকদিন আগেই। এই নিয়মের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে জাস্টিস স্কালিয়া বলেন [১]

For every ten people who sat through our proceedings, gavel to gavel, there would be 10,000 who would see nothing but a 30-second take-out from one of the proceedings

প্রতিটি মামলার বিবরণ যেহেতু সকলের জন্য উন্মুক্ত, এমনকি যেকোন নাগরিক মামলা চলাকালীন সময়ে উপস্থিত থাকতে পারেন, সেহেতু সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরা, ক্যামেরা নিষিদ্ধের পেছনে যে চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে সেটি অবশ্যই গোপনীয়তা নয়। বিচারপতিরা ভাবছেন কেউ যদি আউট অফ কনটেক্সট ছোট একটি ভিডিও দেখেন তাহলে সুপ্রীম কোর্টের বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে ভুল ধারনা তৈরী হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

যেকোন মামলা একটি জটিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য প্রক্রীয়া। মামলা বোঝার জন্যে তাই শ্রম এবং একাগ্রতা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতিরা তাই কোর্টরুমে কাগজ কলম ছাড়া আর কোন কিছুই এলাউ করেন না। কাগজ কলম নিয়ে মনোযোগ দিয়ে মামলা শোনা ছাড়া রিপোর্টারদের তাই আর কোন কিছু করার নেই।
সুতরাং একটি বিচারাধীন মামলা একটি জটিল প্রক্রীয়া। একে খুব সহজেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, ভুলব্যাখ্যা কিংবা আউট অফ কনটেক্সট উদ্ধৃতি দিয়ে।

যেসকল দেশে জুরি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, সেখানে অনেক মনোযোগ দেয়া হয় যাতে জুরিরা কোর্টে উপস্থাপিত তথ্য প্রমাণাদির বাইরে কোন তথ্য দ্বারা প্রভাবিত না হন। তাদেরকে উপদেশ দেয়া হয় যাতে তারা নিজেরা এই ব্যাপারে স্বতপ্রনোদিত ভাবে কোন রিসার্চ না করে, পত্রিকা বা ইন্টারনেটে মামলা সংক্রান্ত খবর না দেখে, ইত্যাদি। কিন্তু সবসময়, বাস্তব সমস্যার জন্যেই এই ব্যবস্থা কাজ করে না।
দেখা যায় জুরিরা তাদের মামলা নিয়ে ইন্টারনেটে রিসার্চ করছেন।[২] এর ফলশ্রুতিতে অনেকসময় জুরিদের উপর কোর্ট বহির্ভূত প্রভাব পরে।
গনসংযোগ ক্যাম্পেইন(পি আর ক্যাম্পেইন) সাধারনত অভিযুক্ত আইনজীবির নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। কারন জনগনের মতামতের একটি পরোক্ষ প্রভাব বিচার প্রক্রীয়ায় থেকেই যায়। অন্যদিকে সরকারী প্রসিকিউটরদের কখোনো পি আর ক্যাম্পেইন চালাতে দেখা যায় না। পৃথিবীর সকল সরকারী কর্মচারীদের একটি সাধারন প্রবণতা হচ্ছে নিজেদের কাজের কোন “মার্কেটিং” না করা।

সরকারী কর্মচারীদের যে পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়, তা “মার্কেটিং” এর জন্যে উপযোগী নয়। এছাড়াও সরকারী কর্মচারীদের আসলে “মার্কেটিং” এর কোন ইনসেন্টিভ নেই। তাদের পেশাগত সাফল্য নিজেদের কাজের মার্কেটিং এর উপর নির্ভর করে না। একারনে অনেক বিখ্যাত মামলায় দেখা যায় অভিযুক্ত পক্ষ হতে একপাক্ষিক প্রচারণা চলছে।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটি সত্য। প্রধানত অভিযুক্ত এবং তার সহমর্মীরাই একপাক্ষিকভাবে বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারী পক্ষ থেকে পালটা প্রচারণার কোন উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের সমর্থক যারা, অনেক সময়েই তারা মামলার টেকনিক্যাল ডিটেইলগুলো বেশী চিন্তিত নন। অবশ্যই এর গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু যদি অভিযুক্তদের প্রচারণার
পরিধি বিচার করা হয় তাহলে আসলেই এ পর্যন্ত পালটা প্রচারণা অথবা বিভ্রান্তির অবসান করার জন্যে তেমন কিছুই করা হয়নি।

পত্রিকায় নিয়মিত মামলার প্রসিডিংস প্রকাশিত হয়। সেগুলোতে নজর রাখলে বেশ কিছু বিষয় চোখে পরে। যেমন প্রসিকিউটরদের আশ্চর্যরকম অদক্ষতা। নিয়মিতভাবে দেখা যায় সম্মানিত বিচারকরা , প্রসিকিউটরদের ভর্তসনা করছেন তাদের বিভিন্ন “ট্রিভিয়াল” ভুলের জন্যে। এত গুরুত্বপূর্ণ মামলা অবহেলায় চলছে এমনটা বললে অতিরঞ্জিত হবে কিনা সেটি নিয়ে নিশ্চিত হবার সুযোগ কমেই ক্রমে আসছে।

সুতরাং তদন্তকারী সংস্থা/প্রসিকিউটরদের বিভিন্ন দক্ষতার অভাব এর সাথে অভিযুক্তদের বিরামহীন বিভ্রান্তিকর প্রচারণা মিলে অনেক মানুষের মনেই বিভিন্ন প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে। এই প্রশ্নসমূহ অভিযুক্ত এবং তাদের রাজনৈতিক দল/মিত্রদের দাবীর লেজিটিমেসি তৈরী হবার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করছে।

উদাহরন হিসেবে কামারুজ্জামানের রায় উচ্চ আদালতে বহাল থাকার পর, দোষীর পক্ষে যেসকল প্রচারণা চালানো হয়েছে সেগুলো অনেকের মনে সন্দেহ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। দোষীদের প্রচারনার প্রধান কৌশল ছিল বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন anecdot উল্লেখ করে মামলাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়া।

এটি অত্যন্ত পুরোনো প্রক্রীয়া। প্রথমে দেখা যাক দোষী পক্ষের কিছু অভিযোগের নমুনা। আপিল বিভাগে চুড়ান্ত রায় প্রকাশের পরপরই কামারুজ্জামানের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়। সেখানে সোহাগপুর ঘটনার সাথে কামারুজ্জামানের কোন সম্পৃক্ততা নেই এই দাবী করে তার ছেলে হাসান ইকবাল বলেন[৩]

‘এই মামলার মুল সাক্ষীর তালিকায় ৪৬ জনের নাম ছিলো। তাদের মধ্যে ১০ জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার পর নতুন করে তিনজন মহিলাকে অতিরিক্ত সাক্ষী হিসেবে প্রসিকিউশন আদালতে উপস্থাপন করেন। ওই সাক্ষীরাও তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে প্রদত্ত জবানবন্দিতে গণহত্যার সময় আমার বাবা উপস্থিত ছিলেন এমন দাবি করেননি।’

মোটামুটি নির্দোষ দেখতে এই দাবীটির মাঝে বেশ কয়েকটি প্যাচ আছে। প্যাচগুলো একটি একটি করে আলোচনা করা যাক। প্রথমত সোহাগপুরের ঘটনার জন্যে রাষ্ট্রপক্ষ ঠিক কি ধরনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে এনেছিল তা দেখা যাক।

 

রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপির(ট্রাইবুনালের রায়) ২৯১ অনুচ্ছেদ থেকে আমরা জানি [৪]

 

Muhammad Kamaruzzaman has been charged for
participating, substantially facilitating and contributing to the commission of
offences of ‘murder as crime against humanity’ or in the alternative for
‘complicity to commit such crime’

চার্জের প্রধান গুরুত্ব ছিল “সহোযগিতার”। এই ব্যাপারটি ডিফেন্স কাউন্সিলও তাদের যুক্তিতে উল্লেখ করেছে [৫]

the accused has been
indicted for providing ‘advices’to his accomplices in launching the attack and
it does not describe that the accused accompanied the principal perpetrators

কামারুজ্জামানের সহযোগিতা প্রধানত প্রমান হয় ততকালীন সময়ের আলবদর সদস্য এবং আলবদর ক্যাম্পের গার্ড মনোয়ার মুন্সির সাক্ষ্যে [৬]

Md.
Monwar Hossain Khan @ Mohan Munshi (63), a member of Al-Badar was
attached to the camp set up at Suren Saha’s house as a guard as directed by the
accused Muhammad Kamaruzzaman and in this way he worked at the camp
for the period of 4-5 months and not exceeding 07 months. It has also been
proved that accused Muhammad Kamaruzzaman used to attend meetings on
the first floor of the Al-Badar camp and he [P.W.2] and his ‘sir’
Kamaruzzaman [accused] had fled together from the camp two days before
Sherpur was liberated. As regards the event of Sohagpur massacre P.W.2 does
not claim to have witnessed the event

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে মনোয়ার মুন্সীর কিন্তু দাবী করেনি সোহাগপুরেরে গনহত্যা প্রতক্ষ্য করার। এখন প্রশ্ন এসে যায় কেন এই সাক্ষীর গুরুত্ব বেশী, তা বোঝার আগে এই সাক্ষীর ব্যাপারে ডিফেন্স কাউন্সিল কি বলেছে একবার দেখা যাক। [৭]

the learned defence counsel has submitted that
the event of Sohagpur massacre is not disputed. But the witnesses who have
deposed in support of the charge implicating the accused are not credible.
P.W.1 and P.W.2 are hearsay witnesses

সুতরাং ডিফেন্সের প্রধান যুক্তি ছিল, মনোয়ার মুন্সি(PW2) ঘটনা (সোহাগপুরের গনহত্যা) নিজে দেখেনি(hearsay witness). মনোয়ার মুন্সির সাক্ষ্য সম্পর্কে দুই নম্বর চার্জের ক্ষেত্রে ডিফেন্স কাউন্সিলের যুক্তি ছিল [৮]

He has submitted
that P.W.3 cannot be relied upon as he stated inconsistent date of the event.
Statement made by P.W.2 and P.W.14 on some particulars is inconsistent. Due
to such inconsistencies it is immaterial to see whether the statement made by
them could be impeached by the defence through cross-examination.
Inconsistencies between statements of two witnesses by itself renders them
unreliable and tutored.

 

ডিফেন্স কাউন্সিল ঐ আলবদর ক্যাম্পে কামারুজ্জামানের উপস্থিতি ছিল না সেটি কি প্রমান করতে পেরেছে? সংবাদ সম্মেলনে বারবার হাসান ইকবাল সাহেব বিভিন্ন বই/প্রবন্ধের উল্লেখ করছিলেন যার মধ্যে কামারুজ্জামানের নাম নেই। নাম থাকা আর না থাকা সমান গুরুত্বের অধিকারী নয়। একটি গবেষণামূলক বইয়ে যদি একজনের বিরুদ্ধে কিছু তথ্য প্রমান উপস্থাপন করা হয় তাহলে তার অপরাধের “প্লজিবিলিটি” তৈরী হয়। কিন্তু কারও নাম উল্লেখিত না থাকা মানে এই না সে অপরাধ করেনি। কারন এটাও হতে পারে সে অপরাধ করেছে, কিন্তু “ডকুমেন্টেড” হয়নি। এই ক্ষেত্রে কামারুজ্জামানের পক্ষে এমন কোন শক্ত এলিবাই কি ডিফেন্স কাউন্সিল দাড়া করাতে পেরেছে যার ফলে প্রমান হয় কামারুজ্জামান ঐ টাইম ফ্রেইমে ঐ আল বদর ক্যাম্পে অবস্থান অসম্ভব ছিল? আমার মনে হয় না পেরেছে। তাদের প্রধান কৌশল ছিল প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের রিলায়েবিলিটি নষ্ট করা। যেমন একজন সাক্ষীর রিলায়েবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারন হিসেবে ডিফেন্স কাউন্সিল উল্লেখ করেছে,[৯]

The learned defence counsel next argued on charge no.2. He has submitted
that P.W.3 cannot be relied upon as he stated inconsistent date of the event

সমস্যা হচ্ছে আমার জীবনে খুব বড় ঘটনার তারিখ জিজ্ঞেস করলেও আমি ভুলভাল বলতে পারি। ডিফেন্স যেটি পারত তা হচ্ছে, ঐ সাক্ষীর, ঐ ঘটনা প্রত্যক্ষ দেখার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে প্রমান উপস্থাপন করতে পারত। সেটি ডিফেন্স কাউন্সিল কি পেরেছে?

হাসান ইকবাল খুব জোর দিয়েছেন, সোহাগপুরে তার বাবার অনুপস্থিতিকে। যেহেতু কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে গনহত্যার “সহোযোগিতা”র অভিযোগ আনা হচ্ছে, হত্যাকাণ্ড সংগঠনের সময় তার উপস্থিতি কতটুকু জরুরী? যুক্তরাষ্ট্রের স্টিফেন র‍্যাপের বিবৃতিটি অনেক জোরে শোরে বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে ছাপা হয়েছে/প্রচার হয়েছে। বাশেরকেল্লায় সম্ভবত একাধিকবার শেয়ার করা হয়েছে খবরটি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্টিভেন র‍্যাপের বিবৃতিটিতে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে যায় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে।

ডেভিড বার্গম্যানের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, [৯]

He stated that international law required in such aiding and abetting offences, that the Jamaat leader, knew that the [Al Badr] group was committing atrocities, that he provided assistance to the group with that knowledge. It was not necessary that he attend, but that the assistance that he provided needed to be substantial and in fact something that caused the atrocities committed

সুতরাং হাসান ইকবালের প্রধান দাবীটি, কামারুজ্জামান সোহাগপুরে উপস্থিত ছিলেন না, অপ্রয়োজনীয় হয়ে পরে। যেহেতু সোহাগপুরের গনহত্যার পরিকল্পনা আল বদর ক্যাম্পে হয়, (ডিফেন্স এর কোন বিরোধীতা করেনি), সেহেতু কামারুজ্জামানের এই চার্জ থেকে বাচার জন্যে একমাত্র এস্কেইপ হচ্ছে , তিনি সেখানে কোনভাবেই উপস্থিত ছিলেন না, এই ধরনের কোন প্রমান দাখিল করা।

 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বহির্বিশ্বে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। এর অন্যতম কারন অবশ্যই দোষী এবং অভিযুক্ত পক্ষের প্রচারণা। কিন্তু আমার মনে হয়না অভিযুক্ত পক্ষের প্রচারণা এককভাবে দায়ী। নিজেদের বিভিন্ন লিমিটেশন গুলোকে স্বীকার করেই বলতে হয়, অন্যতম প্রধান কারন হচ্ছে প্রাণদণ্ড। বর্তমান পৃথিবী প্রাণদণ্ডের ব্যাপারে অনেক সেন্সিটিভ হয়ে গিয়েছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ, হয় প্রাণদণ্ড আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করেছে, অথবা প্রাণদণ্ডদানে বিরত আছে।[১০] এই কারনেই বহির্বিশ্বে এই বিচার নিয়ে ঋণাত্নক মনোভাব তৈরী হচ্ছে। এই সমস্যাটি নুরেমবার্গ কিংবা আইখম্যানের বিচারের সময় ছিল না।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যামামলায় অনেক দোষীকে কখনই দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না কারন তাদের প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ দেশ , প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের ফেরত দেয় না। বুদ্ধিজীবি হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী চৌধুরী মাইনউদ্দিন কিংবা আশরাফুজ্জামানকেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না তাদের প্রাণদণ্ড হয়েছে বলেই।

 

প্রাণদণ্ডের একটি “ইমোশোনাল এপিল” আছে। ৭১ সালের গনহত্যা/ধর্ষণ ইত্যাদি আমাদের সমষ্টিক স্মৃতিতে একটি দগদগে ঘা। এই ঘায়ের মধ্যে স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও প্রলেপ দিতে পারে প্রাণদণ্ড। প্রাণদণ্ড প্রতিশোধমূলক শাস্তি। কিন্তু বর্তমানে পৃথিবীর অনেকেই প্রতিশোধ প্রবনতাকে রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাতারে ফেলতে চান না। রাষ্ট্রকে প্রতিশোধ প্রবণতার উর্ধে দেখতে চান। সেই কারনেই প্রাণদণ্ড ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে পৃথিবী জুড়ে।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, জামাত এবং অন্যান্য রাজাকার/আলবদর ইত্যাদির যেসকল অপরাধ করেছে তার প্রায় সমান গুরুত্বের দাবী রাখে এইসকল অপরাধের পেছনে যে মতাদর্শ কাজ করেছে। যেই ফ্যাসিবাদ প্রভাবিত রাজনৈতিক “থিওক্র্যাসি”তে জামাত এবং অন্যান্যরা আস্থা রাখত তা কোনক্রমেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিজের দেশের মানুষের উপর নেমে আসা এই মর্মান্তিক ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণের সময়ে যারা ঠাণ্ডা মাথায় পশ্চিম পাকিস্থানের পক্ষ নিতে পেরেছে, তাদের অপরাধের অংশীদারত্ব গ্রহন করেছে, তাদের সাইকোলজি অনেক ভয়ংকর এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্যে ক্ষতিকারক। সুতরাং তাদের অপরাধের শাস্তির সাথে সাথে তাদেরকে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মতাদর্শিকভাবে ধ্বংস করে দেয়া আমাদের জন্যে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্যে প্রয়োজন ছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ঐক্যমত্য।

আবারো বলছি বিভিন্ন রাজনৈতিক কারন এবং নেগেটিভ প্রচারণার মাঝেও আমার মনে হয়, আমরা যদি প্রাণদণ্ড অপশনটি টেবিল থেকে সরিয়ে নিতাম, তাহলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ঐক্যমতে পৌছানো আমাদের জন্যে অনেক বেশী সহজ হত। কিছু বৃদ্ধ রাজাকারকে ফাসিতে ঝুলিয়ে যে তাতক্ষণিক আনন্দ পাওয়া যাবে, তার চেয়ে জাতি হিসেবে আমাদের ইতিহাসের সাথে শেষবারের মত বোঝাপড়া করা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা আন্তর্জাতিক ভাবে অনেক সমর্থন পেয়েছি। এর অন্যতম কারন ছিল, ন্যায় এবং ন্যায্যতা আমাদের পক্ষে ছিল।

ন্যায় এবং ন্যায্যতার দাবী এখন পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে প্রাণদণ্ড ঢেকে ফেলছে বলেই আমার মনে হয়। এ প্রসঙ্গে অকালে চলে যাওয়া অধ্যাপক জালাল আলমগীরের বছর কয়েক আগে বলা কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করছি[১১]

 

We should recognise honestly that after decades of complexities, secret deals, and depraved politics, justice, though necessary and urgent, will be limited.
Such limited justice can be morally justified only by a long-term commitment to truth.
To prioritise truth, we must de-prioritise capital punishment. In 1941, years before the Nuremberg trials, Winston Churchill planned summary executions for fifty top Nazis at war’s end. He considered this punishment a political decision, not a legal matter. But Harry Truman, the American president, wanted a tribunal. Josef Stalin cast the deciding vote. As the human rights scholar Geoffrey Robertson explained, Stalin “loved show trials as long as everyone was shot in the end.”
And so a severely flawed tribunal was held at Nuremberg. It punished crimes against humanity by using inhuman standards: twelve Nazis were hanged first and then burnt in the ovens of Dachau, one of the German concentration camps.
Nuremberg’s moment of success was not in the verdict but in the courtroom, when the Nazis were shown reels of the horrors that they had created. Some of them wept and sat stunned, as they came to grips with the truth. The punishment from exposing openly and publicly what they had done to humanity was far more compelling than what Churchill’s planned executions might have produced. It is from this public record that the world’s aversion to genocide began and Nazism, as an ideology, received its death penalty. South African apartheid also received its capital punishment through the Truth Commissions pioneered by Nelson Mandela and Bishop Desmond Tutu

 

First Published in  http://aftnix.wordpress.com/

সুত্রঃ

[১]http://www.economist.com/blogs/democracyinamerica/2014/03/cameras-supreme-court

[২]http://news.bbc.co.uk/2/hi/8519995.stm

[৩]http://www.banglanews24.com/beta/fullnews/bn/339310.html

[৪]Article 291  of the verdict , accessed at : http://www.ict-bd.org/ict2/ICT2%20judgment/MKZ.pdf

[৫]Article 81, ibid

[৬]Article 255, ibid

[৭]Article 267, ibid

[৮]Article 80, ibid

[৯]http://newagebd.net/65600/us-calls-for-halt-to-kamaruzzaman-execution/#sthash.MRsTjDaj.AM96NvMP.dpbs

[১০]http://www.amnestyusa.org/our-work/issues/death-penalty

[১১]http://archive.thedailystar.net/forum/2010/june/truth.htm

মুক্তিযুদ্ধ ও গেসু-সাদু উপাখ্যান..

by Watchdog BD

ডঃ পিয়াস করিমক নিয়ে অবৈধ সরকারের ততোধিক অবৈধ আইনমন্ত্রী জনাব আনিসুল হক স্মৃতিচারণমূলক একটা লেখা লিখেছেন। স্বভাবতই পছন্দ হয়নি আওয়ামী প্রোপাগান্ডা মেশিনারিজের। এ আর খন্দকারের মত এই মন্ত্রীকেও রাজাকার উপাধি দেওয়া এখন সময়ে ব্যাপার। নিয়মিত গঞ্জিকা সেবক একদল তরুণ যাদের সাথে এ দেশের জন্মের কোন সম্পর্ক নেই তারা মুক্তিযুদ্ধের নবম ফ্রন্ট খুলে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। আর এসব সার্টিফিকেট যোগান দিচ্ছে গঞ্জিকা যোগানোর খরচাপাতি। ড্রাসাসক্ত যুবা তরুণের দল আজকাল মা-বাবাকেও খুন করছে ড্রাগ মানির জন্য। নবম ফ্রন্টের এসব জেনারেলদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ খুবই শক্তিশালী একটা ড্রাগ, যার ব্যবহার শরীর, মন ও মস্তিষ্ককে নেশা ছড়িয়ে দেয় অনেকটা পাগলা ঘোড়ার কায়দায়। বিশেষত্ব হচ্ছে এই ড্রাগ কেবল নেশাখোরদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনা বরং তার আমেজ গ্রাস করে নেয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একদল কিশোর, তরুণ ও যুবকদের। ইবোলা কায়দায় এই ড্রাগ দেশপ্রেম নামক সিফিলিস রোগের জন্ম দেয় যার জরায়ুতে জন্ম নেয় নতুন এক ভাইরাস, আওয়ামী জারজতন্ত্র। জনাব আনিসুলে হকের লেখাটা হঠাৎ করেই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল ৭১ সালে। স্কুল পড়ুয়া তরুণ হলেও সমাজ, সংসারের অনেক জটিল সমীকরণ বুঝে নিয়েছি ইতিমধ্যে। স্মৃতিচারণ এক ধরণের ছোঁয়াচে রোগ। এ মুহূর্তে আমিও আক্রান্ত এ রোগে। তাই পাঠকদের কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিয়ে যেতে চাই আগুন ঝরা ৭১’এর দিন গুলোতে। চলুন…

ঘটনা ১:

এপ্রিলের শুরুতে আকাশ পথে শুরু হল তাদের আনাগোনা। স্থলপথ ছিল ইপিআরদের দখলে। সকাল ১০টা হবে হয়ত। বাজার বন্দরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে কেবল। বাজ পাখির মত ছুটে এলো দুটো ফাইটার। বিকট শব্দে শুরু হল বোমা বর্ষণ। আমরা তখন ২০ মাইল দুরে দাদাবাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে। দুদিন আগে একদল বিহারীকে নদীর হাঁটু জলে নামিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করার পর অনেক আন্দাজ করেছিল ওরা আসবে। পেশায় চামার, মুচি ও নাপিত এসব নিরপরাধ বিহারীদের হত্যা করে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা কি ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিল তা বুঝা গিয়েছিল একদিন পরে। একে এক ১০টা ব্যাংক লুট করে সীমান্তের ওপারে পালিয়ে যায় ওরা। সাথে নিয়ে যায় বস্তা ভর্তি টাকা। যুদ্ধের নয় মাস তাদের কারও মুখ দেখা যায়নি ক্ষতবিক্ষত শহর-গঞ্জের জনপদে। শোনা যায় কোলকাতার বেহালায় বাইজী সহ বাসা ভাড়া করে বাদশাহ আওরাঙ্গেজেবের জীবন কাটিয়েছে অনেকে। সপরিবারে পলাতক আমরা। এর কিছুদিন পর গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার আঘাতে উড়ে যায় আমাদের বাড়ির কিয়দংশ। মে মাসের শুরুতে পাকি বাহিনীর পদভারে প্রকম্পিত হয়ে যায় আমাদের শহর। বাড়ি ফাঁকা হলেও বাড়ির একজনকে পলাতক বানানো যায়নি। সে আমাদের কাজের ছেলে গিয়াস উদ্দিন। ১৬ বছর বয়সী সদা চঞ্চল এই যুবক কাজের লোক হলেও পরিবারের স্থায়ী সদস্য ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলাম আমরা। তার হাতেই গচ্ছিত ছিল বাড়ির দায়িত্ব। আগস্টের মাঝামাঝি এক সময় নদীর গা ঘেঁষে অনেকটা গেরিলা কায়দায় হাজির হই ফেলে আসা বাড়িতে। উদ্দেশ্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে যাওয়া। বাড়িতে পা রেখে হতবাক। লুটের চিহ্ন¡ চারদিক। মূল্যবান সবকিছুই খোয়া গেছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাচ্ছে প্রায়। শুয়ে আছি প্রিয় বিছানাটায়। সদর দরজা তালা দেয়া। শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করলাম মূল দরজার কড়া নড়ে উঠছে। উপরে দিকে তাকাতে আত্মা শুকিয়ে গেল, রাইফেলের লম্বা বেয়নেট। পালানোর সবকটা রাস্তা ছিল বন্ধ। ধীরে ধীরে খুলে গেল ফটকের তালা। কেউ একজন ৩০৩ রাইফেল নিয়ে প্রবেশ করলো বাড়িতে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এ আমাদের গিয়াস উদ্দিন। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আলাপ করলাম তার সাথে। জানা গেল বাড়ি লুটের সাথে সেও জড়িত। তবে মূল উদ্যোক্তা স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার ও মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল জনাব আক্কাস আলী দেওয়ান। তার প্ররোচনায়ই নাকি সে রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়েছে। আসল কাজ চুরি ডাকাতি এবং ইতিমধ্যে বেশকিছু টাকাকড়ি জমাতে সমর্থ হয়েছে সে। ইচ্ছা যুদ্ধ শেষে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে একজোড়া হালের গরু কিনে তা ভাড়া খাটানো। দুপা ঝাপটে ধরে রইলো অনেকক্ষণ এবং অনুনয় করে জানালো গ্রামে গিয়ে কাউকে যেন না জানাই তার বর্তমান পরিচয়। সুযোগ পেলেই নাকি ফিরে যাবে লোকালয়ে এবং সাথে নিয়ে যাবে তার ৩০৩ রাইফেল ও প্রিন্সিপালের কল্লা।

১৬ই ডিসেম্বরের আগেই সে ফিরে গিয়েছিল। প্রিন্সিপালের কল্লা আর নিতে পারেনি তবে রাইফেল নিতে ভুল করেনি। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বরের পর ব্যাংক লুটেরা একদল আওয়ামী জেনারেল গিয়াস উদ্দিনকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখে চৌরাস্তার মুখে।

ঘটনা ২:

স্থান দাদাবাড়ি। শহর হতে পালিয়ে আমাদের মত আরও অনেক পরিবার লুকিয়ে আছে। গ্রামটায় আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া লাগতে তখনো একশ বছর বাকি। বাকি দুনিয়ার সাথে রাস্তাঘাটের সম্পর্ক নেই। কাছের রাস্তা হতে হেঁটে যেতে হয় প্রায় দশ মাইল। এমন একটা গ্রামে পাকি বাহিনীর আগমনের আশংকা ছিল খুবই কম। জুন মাসের মাঝামাঝি সময় তার উদয়। হাতে সেমি অটোমেটিক রাইফেল। পায়ে জলপাই রংয়ের কেডস। গ্রামের বেকার যুবক সাইদুল হোসেন সাদু এখন মুক্তিযোদ্ধা। কবে এবং কোথায় ট্রেনিং নিয়েছে তার কোন সদুত্তর তার কাছে ছিলনা। অবশ্য এ নিয়ে প্রশ্ন করার মতও কেউ ছিলনা। যুদ্ধের শুরুতে গ্রামের মুরুব্বিদের প্রায় সবাই ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক। এ নিয়ে মসজিদে মসজিদে দোয়াও করানো হত। বিশেষ করে জুমা নামাজের পর। এ ধরণের সমর্থনের কিছু ঐতিহাসিক কারণও ছিল। অবিভক্ত ভারতে এ এলাকায় হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে জর্জরিত ছিল মুসলিম প্রজারা। জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে হেটে গেলে জুতা হাতে নেয়া ছিল বাধ্যতামূলক। তা করতে ব্যর্থ হলে নেমে আসতো নির্মম অত্যাচার। কৃষি ও তাঁত ব্যবসার সাথে জড়িত জনগণকে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে নিরুৎসাহিত করা হত। মুসলমানদের শিক্ষা নিয়ে জমিদার তথা স্থানীয় হিন্দু বাসিন্দাদের মাঝে ঠাট্টা তামাশার অন্ত ছিলনা। অপমান হতে মুক্তি পেতে স্থানীয় অনেকেই সক্রিয় অংশ নেয় পাকিস্তান আন্দোলনে। তবে বর্ষার শুরুতে গঞ্জের বাজারে পাকিস্তানিদের গানবোটের আগমন বদলে দেয় অবস্থা। গ্রামের জনগণ শক্ত অবস্থান নেয় পাকিদের ঘৃণ্য তৎপরতার বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সাদুর সাথে যোগ দেয় আরও কজন। সবার হাতে অস্ত্র। সকাল বিকাল গ্রামের এ মাথা হতে ও মাথা মার্চ করে বেড়ায়। তবে রাত হলেই বদলে যায় তাদের চেহারা। গৃহস্থের দুয়ারে হানা দেয়। হাঁস, মুরগী, ছাগল সহ যা পায় তা ধরে নিয়ে আসে। প্রতি রাতে চলে তাদের বনভোজন। কদিন না যেতে তাদের চাহিদার আঙ্গিনা পা রাখে গ্রামের সোমত্ত মেয়েদের দিকে। পাকিস্তান সমর্থক হওয়ার কারণে মা-বাবাকে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে তাদের ভোগের পণ্য বানানো শুরু করে। যেদিন গঞ্জের বাজারে পাকিস্তানীরা হানা দেয় সেদিন সাদু ও তার দলবলকে একশ মাইলের কাছাকাছি কোথাও দেখা যায়নি।

যুদ্ধ শেষে সাদু ও তার বাহিনী জমিদার বাড়ি দখল সহ শত শত বিঘা ধানী জমি দখল করে কায়েম করেছিল অনাচার ও অবিচারের রাজত্ব। সাদু আজ বেচে নেই, কিন্তু তার কাজের ধারাবাহিকতায় আজও এলাকা চষে বেড়াচ্ছে একদল হায়েনা। ওরা খুন করছে, মা-বোনদের ঘর হতে উঠিয়ে নিচ্ছে, জমি দখল নিচ্ছে এবং গর্বভরে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক হিসাবে।

সব রাজাকারই যেমন খুনি রাজাকার ছিলনা তেমনি সব মুক্তিযোদ্ধাই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেনি। সবাইকে এক কাতারের ফেলে দেশকে বিভক্ত করে মুক্তিযুদ্ধকে বানানো হয়েছে গঞ্জিকা সেবনের উপকরণ। মৃত পিয়াস করিম উপাখ্যানও এ অধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ডেভিড বার্গম্যান, আদালত অবমাননা এবং তিরিশ লাখ

লরেন্স লিফশুলজ

একজন মানুষ ও একটি বিচারের ইতিহাস: ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে মামলা

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও তার সহকর্মীরা আগামী ১৩ অক্টোবর একটি একটি অসাধারণ ঐতিহাসিক বিতর্কের উপর সিদ্ধান্ত দিতে যাচ্ছেন। ইতিহাসের এই প্রশ্নটি কেন এবং কিভাবে আদালত অবমাননার ধারায় বিচারের আওতায় আসলো সেটি এক দুর্ভাগ্যজনক কাহিনী।

 

আইসিটি-২ এর বিচারকরা আইনের সাথে লতায়-পাতায় জড়িত এমন একটি বিষয়ে ভারসাম্যমূলক সিদ্ধান্ত দিতে যাচ্ছেন অবস্থাদৃষ্টে যেটি হয়তো তারা নিজেরাও প্রশংসাযোগ্য কাজ বলে মনে করেন না।     মামলারটির বিবাদী দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশে বসবাসকারী বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। একটি বিশেষ মামলায় ট্রাইবুনালের দেয়া ঐতিহাসিক রেফারেন্স নিয়ে বার্গম্যানের অনুসন্ধানী কাজের জন্য তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে।

 

মামলাটি অবশ্য ট্রাইবুনাল স্বতপ্রনোদিতভাবে করেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে ট্রাইবুনালের দেয়া রেফারেন্সকে অসম্মান করা হয়েছে উল্লেখ করে আবুল কালাম আজাদ নামে হাইকোর্টের একজন আইনজীবী তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পিটিশন আকারে এই মামলাটি দায়ের করেছিলেন।    আজাদ সাহেবের পিটিশন শুনানী শেষে ট্রাইবুনাল ডেভিড বার্গম্যানকে ‘কেন আদালত অবমাননাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হবে না?’ মর্মে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেন।

 

কিছু মানুষ আছে যারা ব্যক্তি বা গোষ্টি স্বার্থের প্রয়োজনে জাতীয়তাবাদকে কলঙ্কিত করতে দ্বিধা করে না; এই মামলার বাদী আবুল কালাম আজাদ তেমনই একজন লোক। অবশ্য স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ একটি শাখের করাতের মত বিষয় হবার কারণে এটিকে সহজেই খারাপ কাজেও ব্যবহার করা যায়।    ঔপনিবেশিক শাসন বা বিদেশী আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য সংগ্রামরত একটি নিপীড়িত জাতির জন্য জাতীয়তাবাদ অবশ্যই শক্তিশালী এবং প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতিতে এটা কখনো কখনো ধর্মান্ধতা ও সংকীর্ণ মতাদর্শগত অন্ধবিশ্বাসের জন্ম দেবার মত উর্বর ক্ষেত্রও হতে পারে।

 

উদাহরণ হিসেবে ১৯৯০ দশকের শুরুতে বসনিয়ায় সার্ব জাতীয়তাবাদীদের গণহত্যার কথা বলা যেতে পারে। বসনিয়ার মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর সে সময় সার্বরা যে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান চালিয়েছিলো তা সেখানকার বসনিয় মুসলিম এবং ক্রোয়াট ক্যাথলিক খ্রীষ্টানদের সাথে তাদের হাজার বছর ধরে টিকে থাকা শান্তিপূর্ণ আন্ত:সম্প্রদায়িক সহাবস্থানকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ছিলো।  কারাদজিক, ম্লাদিক, মিলোসেভিচরা ছিলো জাতীয়তাবাদ নামের শাখের করাতের উল্টো ধারের অংশ। ১৯৯৫ সালে বসনিয়ার সেব্রেনিৎসায় ৮হাজারের বেশি মুসলিম পুরুষ ও বালককে হত্যার অভিযোগে এখন হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কারাদজিক ও ম্লাদিকসহ বসনীয় সার্ব নেতাদের বিচার চলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিলো ইউরোপের মাটিতে সংঘটিত সবচেয়ে বড় একক গণহত্যাযজ্ঞ।

 

স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামের ইতিহাস প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদের এক অনন্য উদাহরণ। পাকিস্তানের সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ন ও অহিংস আন্দোলন করে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে অনুন্নত আঞ্চলিক বৈষম্যের নাগপাশ থেকে মুক্তি পাবার জন্য এই সংগ্রাম আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও সাহসী উদাহরণ।  কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক একনায়কতন্ত্র সেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে না নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার পথ বেছে নেয়। ফলে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মুক্তিযুদ্ধ।

 

এই ঐতিহাসিক পটভূমির সাথে ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার কী সম্পর্ক? দেখা যাচ্ছে সম্পর্ক ও তাৎপর্য রয়েছে বিপুল পরিমানেই।

 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘঠিত যুদ্ধাপরাধের বিচার যেভাবে এগিয়েছে তাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্প্রদায় ‘ক্রান্তিকালীন বিচারব্যবস্থা’ হিসেবে অভিহিত করে থাকে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘঠিত হবার কয়েক মাসের মধ্যেই একটি সমাজে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে এমনটা বোঝানোর জন্য ‘ক্রান্তিকালীন বিচারব্যবস্থা’ একটি কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক শব্দ। কারণ এর দ্বারা এটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে যারা সেই সময় ভয়ানক অপরাধগুলো করেছিলো তদেরকে বিচারের আওতায় আনার জন্য কার্যকর চেষ্টা করা হয়েছিলো।

 

কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান সেই প্রচেষ্টাকে বাঁধাগ্রস্থ করে। শেখ মুজিব হত্যার পরের সরকার এবং জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কুখ্যাত সহযোগীরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিরাপদে থেকেছে। কেউ কেউ সরকারী উচ্চ পদেও আসীন হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলেও এটা কোন দৈব ঘটনা ছিলো না। দেশের এই অবস্থাটি তৈরীর জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হয়েছিলো।

 

১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে প্রায় ৪০ বছর যাবৎ নিরবিচ্ছিন্যভাবে কাজ করতে হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। নি:সন্দেহে এটা একটা মহান তাত্পর্যপূর্ন পদক্ষেপ।

 

ট্রাইব্যুনালের যে সকল বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরী হয়েছে সেসব বিশদ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের উপযুক্ত স্থান বা সময় নয় এটা নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের লজ্জাজনক সহযোগিতায় কিভাবে পাকিস্তান জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি ট্রাবুনাল গঠনে বাঁধার সৃষ্টি করেছিলো সেসব বিশ্লেষণের সময়ও এটা নয়। সেগুলো নিয়ে আমি পরে কখনো লিখবো।

 

এখন যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন, সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ডেভিড বার্গম্যানকে আদালত অবমাননার দায়ে বিচার করছে। সেই ডেভিড বার্গম্যান, যে কিনা অসাধারণ রিপোর্টিং এর মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন কিভাবে ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীরা দায়মুক্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে বসবাস করছে। ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ডের চ্যানেল ফোর এ প্রচারিত যে ‘দি ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ নামের গবেষণামূলক তথ্যচিত্রটি ৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিষয়টি আবারো আলোচনায় এনেছিলো ডেভিড বার্গম্যান ছিলেন তার গবেষণা ও প্রযোজনা টিমের মূল সদস্য।  এই তথ্যচিত্রটির মাধ্যমে দেখানো হয়েছিলো কিভাবে জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় সদস্যরা ১৯৭১ সালে একাধিক গনহত্যা করার পরও কোনরূপ গ্রেফতারের ভয়-ভীতি ছাড়াই বৃটেনে বসবাস করছিলো। তথ্যচিত্রটিতে তুলে আনা প্রমাণগুলো ছিলো মর্মস্পর্শী।

 

বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগটি ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের সময় দেয়া আদেশের একটি বাক্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। ঐ আদেশে বলা হয়েছিলো যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লক্ষ লোক নিহত হয়েছে।

 

বার্গম্যান তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা গুলো সম্পর্ক বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন এবং সেগুলোর উপর নানা মন্তব্য করেছেন।

 

আদালতের কার্যক্রম, যুদ্ধপরাধের ব্যপকত্ব এবং যুদ্ধের বর্তমানকালীন তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা ও মতামত দেয়ার প্রসংগেই, ১৯৭১ সালে সত্যিকার অর্থেই কতজন মানুষ নিহত হয়েছিলেন সেই বিতর্কিত বিষয়টি তুলে আনেন বার্গম্যান। এটি অবশ্যই একটি স্পর্শকাতর অধ্যায়। তবে এই বিষয়টি কোনভাবেই সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের গুরুত্বপূর্ণ কোন অংশ নয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে দাখিলকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়।

 

এই বিষয়টি নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণে যেতে চাইলে আমি হয়তো একদম ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপট নির্বাচন করতাম, তবে ডেভিড বার্গম্যান সাঈদীর মামলার রায়ের পর্যালোচনার মধ্যে থেকেই বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর বার্গম্যান যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতির ঐতিহাসিক বিতর্কটি নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করেন। লেখায় তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে তাঁর জাত চিনিয়েছেন। বার্গম্যানের দক্ষতায় তাঁর লেখায় এই পুরো বিতর্কের প্রায় সকল অংশ সম্পূর্ণরূপে ফুঁটে উঠেছে। লেখাটি নিশ্চিতভাবেই অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ এবং চিন্তার খোরাক যোগায়।

 

আবুল কালাম আজাদ, যিনি বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনেছেন, তাঁর মতে ত্রিশলক্ষ শহীদের এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন এখতিয়ার কারও নেই। জনাব আজাদের সংকীর্ণ ‘জাতীয়তাবাদ’ এর মাপকাঠিতে যিনি এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তিনি অবশ্যই ‘জাতির শত্রু’, ‘দেশের শত্রু’ এবং ‘ট্রাইব্যুনালের শত্রু’।

 

এখানে আমরা অতি দুরূহ একটা বিষয়ের অবতারণা করছি। একটি ঐতিহাসিক বিতর্কের কোন অংশের ‘ঐতিহাসিক শুদ্ধতা’ নিরূপণ কি ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?

 

এই বিষয়ে আরেকটু বলতে হয়। ১৯৭৪ সালে আমি ছিলাম ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ-এর বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিবেদক। বাংলাদেশে আমার সাংবাদিকতা জীবনে আমি একজন ইন্টারেস্টিং মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিলাম।

 

যেহেতু তিনি আমার প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনের খবরের উৎস হিসেবে কাজ করেছিলেন তাই দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি তাঁর নাম উল্লেখ করতে পারছি না। আমি জানি না তাঁর সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায় কিংবা তিনি আদৌ বেঁচে আছেন কিনা।

 

আমার প্রতিবেদনগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সংবাদের উৎস হিসেবে কাজ করা ছাড়াও এই লোকটি আমাকে তাঁর কাজ সম্পর্কে আরও চমৎকার সব তথ্য দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে ফিরে যাই। তিনি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি গবেষকদলের সাথে কাজ করছিলেন যাদের উপর দায়িত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে পুরো দেশে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের ফলে যাবতীয় ক্ষয়ক্ষতির একটি খতিয়ান দাঁড় করানো।

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানের অন্যতম প্রচেষ্টা ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং তাদের দোসরদের হাতে ঠিক কতজন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁরা আরও জানার চেষ্টা করছিলেন কতজন মানুষ শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার পথে কিংবা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছানোর পর মারা গিয়েছিলেন। এদের অধিকাংশই ছিল শিশু এবং বয়োজ্যেষ্ঠ।

 

মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের দ্বারা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করেই অনুসন্ধান কাজ চালানো হয়েছিলো যেখানে গ্রামে গ্রামে গিয়ে পরিবারগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হতো যুদ্ধকালে সেই গ্রামগুলোতে ঠিক কতজন মানুষ, কিভাবে মারা গিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে তারা পুরো দেশের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র দাঁড় করাচ্ছিলেন। আমার সাথে তার পরিচয়ের সময় পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জেলায় তাঁদের জরিপ কাজ সমাপ্ত করেছিলো।

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আমার সেই তথ্যদাতা আমাকে জানিয়েছিলেন, তাঁদের হিসাব অনুসারে যুদ্ধকালে নিহত মানুষের মোট সংখ্যা ২,৫০,০০০। আমার যতদূর মনে পড়ে এই সংখ্যা শরণার্থী শিবির কিংবা উন্মত্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর থেকে  পালানোর সময় মৃত্যুবারণকারীদের বাদ দিয়েই হিসাব করা হয়েছিলো।

 

সশস্ত্র যুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু অবশ্যই একটি অত্যন্ত ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক ঘটনা। যাই হোক, আমার সেই তথ্যদাতা আমাকে জানান যে এই অনুসন্ধানকাজ আকস্মিকভাবে বন্ধ ঘোষনা করা হয়। কারণ হিসেবে জানা যায় যে এই জরিপের ফলাফল নিশ্চিতভাবেই মুক্তিযুদ্ধে এবং শরণার্থী শিবিরে মৃত্যুবরণকারীদের সঠিক সংখ্যা তুলে আনতো যা মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশলক্ষ মানুষের মারা যাওয়ার প্রচলিত ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

 

এর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকা ত্যাগ করে নয়াদিল্লীতে ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধির পদে যোগদান করায় আমি এই সংখ্যা কোনদিন প্রকাশ করতে পারিনি। সব সময় আমার একটি ইচ্ছা ছিল এই বিষয়ে কিছু লেখার কিন্তু ভারতে জরুরী অবস্থা জারি এবং আরও কিছু ঘটনা এই বিষয়টিকে সেই অল্প কয়েকটি প্রতিবেদনের একটিতে পরিণত করে যেগুলো নিয়ে আমি লিখতে চাইলেও আর লিখতে পারিনি।

 

ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে আনীত আদালত অবমাননার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার উল্লিখিত এই ঘটনাটি প্রাসঙ্গিক। কারণ ১৯৭৪ সালে সরকারের পরিচালিত অনুসন্ধানই ত্রিশলক্ষ শহীদের এই সংখ্যার যথার্থতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অপরাধে একজন সাংবাদিকের বিচার করছে।

 

নিশ্চিতভাবেই এই সংখ্যা নিয়ে একটা মারাত্মক বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। যদি বিচারপতি হাসান এবং তাঁর সঙ্গীরা বার্গম্যানকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তাহলে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা ডঃ এম এ হাসানসহ অন্যান্য গবেষক এমন কী আমাকেও আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে, কারণ মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ শহীদ হয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তর একটাই, যার উত্তর এখন ট্রাইব্যুনালকেই দিতে হবে।

 

গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত একটি যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রকৃত ভূমিকা অবশ্যই এমন হবার কথা নয়। সম্ভবত, এমন রুলিং এর তুলনা কেবলমাত্র উনিশ’শ ত্রিশের দশকের স্ট্যালিনীয় কোর্টগুলোর সাথেই করা যায় যেখানে বুখারিনের মত মানুষও অত্যাচারিত হয়ে আদর্শিক ত্রুটি স্বীকারে বাধ্য হয়েছিলেন। আবুল কালাম আজাদের মত মানুষদের মতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ঐতিহাসিক ‘সত্যের’ রক্ষকের ভূমিকাও পালন করতে হবে, তা সেই সত্য যত বিতর্কিতই হোক না কেন।

 

ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে সকল ফ্যানাটিক সমর্থকেরা মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং নৃশংস যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা; যে দায়মুক্তির চাদরে তাঁরা দিনের পর দিন বাংলাদেশ ও পৃথিবীর যাবতীয় আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বেঁচে আছেন তার অবসান ঘটানো। ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সহস্রাধিক ভুক্তভোগীর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর এক বিশাল দায়িত্ব আজ ট্রাইব্যুনালগুলোর উপর অর্পণ করা হয়েছে।

 

আমার দৃষ্টিতে কেউই জানেন না কোনটি সত্য, কিংবা কারও কাছেই প্রকৃত সংখ্যাটি কত তার কোন কোন খতিয়ান নেই। আমার মতে, মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১৯৭৪ সালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক চালানো জরিপটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত পাওয়া ২,৫০,০০০ সংখ্যার চেয়ে নিশ্চিতভাবেই বেশি।

 

২০১১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ তদন্ত বিভাগের পক্ষ থেকে আমাকে আমার বসনিয়ার অভিজ্ঞতা জানানোর জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

 

আমি রাবিয়া আলীর সাথে একটি বই লেখা এবং সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলাম যার নাম ছিল “Why Bosnia? Writings on the Balkan War”। আমি বসনিয়ার পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছি আর সারায়েভোসহ অন্যান্য শহরের এমন বহু উদ্যান কিংবা খেলার মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেছি যেগুলো মানুষের কবরে ছেয়ে গিয়েছিলো, যেখানে বেসামরিক মানুষদেরকে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের মধ্যে তড়িঘড়ি করে কবর দেয়া হয়েছিলো।

 

বইটির লেখকদের মধ্যে আমার বেশ কিছু বন্ধুও ছিল যারা বসনিয়ার গণহত্যার বিচারে গঠিত যুদ্ধাপরাধ আদালতের সাথে কাজ করেছিলেন। বসনিয়ায় যুদ্ধ শেষে প্রতিটি গণকবর চিহ্নিত করে পুনরায় খনন করা হয়েছিলো।

 

যাদের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিলো তাঁদের প্রত্যেকের ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয়েছিলো। তারপর তাঁদের সেই দেহাবশেষ যথাযোগ্য সম্মানের সাথে ততদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়েছিলো যতদিন পর্যন্ত না তাঁদের পরিবারের কোন জীবিত সদস্য সেই মৃতদেহ শনাক্ত করে পূনরায় দাফনের ব্যবস্থা করতে পারেন। এমনটা সেব্রেনিৎসাসহ পুরো বসনিয়াতেই করা হয়েছিলো।

 

প্রশিক্ষিত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে এমন বিরাট একটি কাজ করা অনেক ব্যয়বহুল হলেও জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বসনিয়া সরকার সেই খরচ বহন করেছিলো। পুরো কাজটা সম্পন্য করতে কয়েক বছর লাগলেও এটি ছিলো গণহত্যা পরবর্তী সময়ে একটি সমাজের নৈতিক দায়বদ্ধতা। এভাবে বসনিয়রা ঐ যুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা কত হতে পারে সেই সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়েছিলো। কিন্তু কেউই জানে না প্রকৃত সংখ্যাটা ঠিক কত। কারণ এইসব ক্ষেত্রে প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ অসম্ভব।

 

২০১১ সালে আমি যখন আমি বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনালের বিশেষ তদন্ত বিভাগের মুখোমুখি হই তখন আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, পুরো দেশে দুই শতাধিক গণকবরের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন এবং তখনও খুঁজছেন।

 

ডেভিড বার্গম্যান এই বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তার লেখায় ‘ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফইন্ডিং কমিটি’র আহবায়ক ড. এম এ হাসানকে উদ্ধৃত করেছেন। উল্লেখ্য যে, এরশাদ সরকারের পতনের পর ড. এম এ হাসান একটি গবেষক দল গঠন করে তাদের নিয়ে শহীদের সঠিক সংখ্যা ও তথ্য নির্নয় করতে পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছেন, গ্রামে গ্রামে গিয়েছেন।

 

ড. হাসান বার্গম্যানকে বলেছেন যে, তার ধারণামতে ৩০ লক্ষ একটি অতিরঞ্জিত সংখ্যা এবং সঠিক সংখ্যাটি সম্ভবত ১২ লক্ষের কাছাকাছি হবে। তিনি বার্গ্যানকে বলেছেন, “আমরা ৯৪৮টি বধ্যভূমি বা গণকবরের সন্ধান পেয়েছি। আমাদের গবেষণা অনুসারে প্রতি একটি গণকবরের বিপরীতে আরও চারটি গণকবর রয়েছে যার উপর পরবর্তীকালে স্থাপনা নির্মিত হয়েছে কিংবা যার হদিস পাওয়া যায় না।এই হিসেবে মোট গণকবরের সংখ্যা ৫০০০ বলে ধরে নেয়া যায়”।

 

ডঃ হাসান অনুমান করেন যদি প্রতিটি কবরে ১০০টি করে লাশ থাকে তবে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫,০০,০০০ যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেই ১৯৭৪ সালের অনুসন্ধানের ফলাফলেরও দ্বিগুণ। অবশ্য, ডঃ হাসানের এই অনুমান মোট মৃতের সংখ্যার ৩০ শতাংশের মত, কারণ তিনি গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার থেকে অনুমান করেছেন যে মোট নিহতের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষকে গণকবরে সমাহিত করা হয়েছিলো আর বাকীদের দেহ নদী-নালায় বা উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দেয়ায় তা পচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে।

 

এভাবে ডঃ হাসান, যিনি সম্ভবত এই বিষয়ে দীর্ঘসময় গবেষণাকারী একমাত্র বাংলাদেশী, অনুমান করেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ১২ লক্ষের মত হবে। অবশ্য, এই সংখ্যায় তাঁদের যোগ করা হয়নি যারা শরণার্থী শিবিরে কিংবা শিবিরে যাওয়ার পথেই মৃতুবরণ করেছিলেন।

 

সত্যি কথা বলতে কেউই জানেন না সঠিক সংখ্যাটা ঠিক কত হতে পারে, এমনকি অনুমানও করতে পারেন না। ডঃ হাসানের অনুমানই সম্ভবত প্রকৃত সংখ্যার সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছে। অবশ্য সংখ্যাটি যতই হোক না কেন নিশ্চিতভাবেই তা বেশ বড়। এই সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে সহস্রাধিক পরিবারের দুঃখ ও বেদনা যারা তাঁদের আপনজনকে মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছেন।

 

এই জটিল, দুরূহ আর আবেগময় অবস্থায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি-২) এমন একটি বিষয়ে রুলিং দিতে যাচ্ছেন যেখানে তাঁদের নিজেদের কাছেই কোন সঠিক উত্তর নেই।

 

আমাদের চিন্তাধারা কেমন হবে তা বলে দেয়ার জন্যে কোন আবুল কালাম আজাদ কিংবা কোন আদালতের প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে, তিনি নিজেই চারদশক ধরে চলে আসা এই বিতর্কে কোন অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশপ্রেমের ছদ্মবেশে মূর্খতা কি কাউকে জ্ঞানের পথে চালিত করতে পারে?

 

এখন কেউ শুধু এতটুকুই আশা করতে পারেন যে ট্রাইব্যুনাল যথেষ্ট বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবে যে এটি কোনভাবেই তাঁদের বিচার কার্যের আওতায় পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র আর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার এক লড়াই। মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূর্খতা, ঔদ্ধত্য আর সামরিক শাসকদের নিষ্ঠুর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক গণযুদ্ধ।

 

অতীতের মত এখনও বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেই এখন বোধোদয় জরুরী হয়ে পড়েছে।

 

আমার মতে, একটি বিজ্ঞ আদালত, অবশ্যই চিন্তা করবেন ফ্র্যাসোঁয়া-ম্যারি অ্যারোয়ে, যাকে আমরা ভলতেয়ার নামে চিনি, তিনি ভিন্নমত নিয়ে কি বলে গিয়েছিলেন। ভলতেয়ার ছিলেন ফরাসী বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ অষ্টদশ শতাব্দীর একজন দার্শনিক এবং লেখক। তিনি বলে গিয়েছেন, “তুমি যা বল তাঁর সাথে আমার দ্বিমত থাকতে পারে, তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তোমার সেই কথাটি বলার অধিকার রক্ষায় লড়াই করে যাবো”।

 

* * *

 

২০১১ সালের ২৩ মে, বিবিসির বাংলা বিভাগের উপ-প্রধান সিরাজুর রহমান ব্রিটিশ পত্রিকা দ্যা গার্ডিয়ানে একটি চিঠি পাঠান। তিনি ইয়ান জ্যাকের লেখা একটি প্রবন্ধ যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো, তার উপর নিজের মতামত প্রকাশ করেছিলেন। জনাব রহমান একটি ইতিহাস তুলে ধরেন সেখানে। তিনি লেখেন,

“১৯৭২ সালের জানুয়ারীর ৮ তারিখে, আমিই ছিলাম প্রথম বাংলাদেশী যিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করি। তাঁকে হিথ্রো থেকে লন্ডনের ক্ল্যারিজেসে আনা হয়… এবং আমি প্রায় সাথে সাথে সেখানে পৌঁছাই… তিনি যখন আমার কাছ থেকে জানতে পারেন যে তার অবর্তমানেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে এবং তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়েছে, তখন তিনি বিষ্মিত হন। দৃশ্যত তিনি লন্ডনে এসেছিলেন এই ধারণা নিয়ে যে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানিদের যেই স্বায়ত্বশাসনের জন্যে লড়াই করছিলেন পাকিস্তানিরা তা মেনে নিয়েছে।”

 

“সেইদিন আমি এবং অন্যরা তাঁকে যুদ্ধের একটি বিবরণ দেই। আমি তাঁকে জানিয়েছিলাম যে এখন পর্যন্ত যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির কোন সঠিক হিসাব জানা যায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে আমাদের অনুমান, কমপক্ষে তিন লাখ মানুষ মারা গিয়েছেন। আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম যখন তিনি ডেভিড ফ্রস্টকে বললেন ত্রিশ লক্ষ মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে। আমি জানি না কি কারণে তিনি এই সংখ্যাটি বলেছিলেন, হয়তো তিনি মিলিয়ন শব্দটির ভুল অনুবাদ করেছিলেন কিংবা তাঁর অস্থিরচিত্ত এর জন্যে দায়ী হয়ে থাকতে পারে। তবে আজও অনেক বাংলাদেশী বিশ্বাস করেন সংখ্যাটি আসলেই অতিরঞ্জিত।”

 

শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক ভালো গুণ ছিল। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে ভারত থেকে ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধীনে ফেলোশিপ শেষ করার পর ঢাকা সফরকালে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। আমরা দুইঘন্টা ধরে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে বসে কথা বলেছিলাম। তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ আমার আবারও হয়েছিল যখন আমি বাংলাদেশে কর্মসূত্রে ফিরে আসি। ১৯৭৫ সালের পর থেকে আমি বহুবছর তাঁর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে কাজ করে গেছি।

 

জীবনে কোন ভুল করেননি এমন কোন মানুষকে আমি খুঁজে পাইনি। তেমনি শেখ মুজিবও ভুল করেছিলেন। আমি বিশ্বাস করি তিনি ফ্রস্টের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভুল বকেছিলেন। বহু আগেই বিষয়টির সুরাহা হওয়া উচিৎ ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই সংখ্যাটি কিছু অন্ধবিশ্বাসী মানুষের বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।

 

প্রকৃতপক্ষে ডঃ হাসানের গবেষণার আলোকে দেখলে সিরাজুর রহমানের অনুমান সঠিক হয়, কিন্তু সিরাজুর রহমান বুদ্ধিমত্তার সাথে আরও বলেছিলেন যে এখনও “কোন সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি”। আগামী বছরগুলোতে আরও গবেষণা এবং বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়েই জানা যাবে স্বাধীনতার জন্যে বাংলাদেশীদের আত্মত্যাগের মাত্রার বিশালতা।

 

এই লেখাটি আমি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি ছোট প্রকাশনা সংস্থার ওয়েব সাইটে প্রকাশ করছি। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী এটি প্রকাশের অধিকার আমার আছে।

 

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এটি আমি বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যম থেকে প্রকাশ করতে পারছি না। কারণ কয়েকমাস আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা বিষয়টিকে ‘বিচারাধীন’ হিসেবে তাদের কর্তৃত্বাধীন বলে ঘোষনা করেছেন এবং তাদের সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত এই বিষয়ে সকল ধরণের আলাপ আলোচনা নিষিদ্ধ করেছেন। হয়তো এই কারণে আমার বাংলাদেশী সহকর্মীরা এটিকে তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করতে পারবেন না।

 

যাই হোক, আমি বিশ্বাস করি যে, এখানে প্রাসঙ্গিক তথ্য আছে এবং এগুলো গণমাধ্যমে প্রচার করে জনগণ ও আদালতকে তা জানার সুযোগ করে দেয়া উচিত। ১৯৭৪ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কর্তৃক সমীক্ষার বিষয়টি প্রথমবারের মত এখানে প্রকাশ করা হলো। আমার উদ্দেশ্য কোর্টের আদেশের প্রতি স্পর্ধা দেখানো নয়, বরং বিষয়টি জানানো।

 

৯ অক্টোবর, ২০১৪

স্টোনি ক্রিক, সিটি, ইউএসএ।

ইমেইল: OpenDoor.Lifschultz@gmail.com

Translated from Original English by A K M Wahiduzzaman

শামীম, নিজাম ও ইলিয়াস…একই জরায়ুতে জন্ম

By Watchdog BD

পরিচিত একজনের স্ট্যাটাসে তথ্যটা পড়ে যার পর নাই অবাক হলাম। নিজকে ধিক্কার দিলাম জন-গুরুত্বপূর্ণ এমন একটা তথ্য জানা নেই বলে। বিহারী ক্যাম্পে পুড়িয়ে মারা দশজনের সবাই নাকি গোলাম আজমের বংশধর এবং তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ভেতর অন্যায় কিছু নেই। ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হল এ হত্যা ৭১’এর হত্যারই প্রতিশোধ। প্রথমে ভেবেছিলাম নিহত দশজনের সবাই ছিল রাজাকার এবং ৭১’এর গণহত্যার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। রক্তের বদলা রক্ত, এ নতুন কোন ঘটনা নয়। সভ্যতা বিবর্তনের অলিগলি ঘাঁটলে ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে এ ধরনের প্রতিশোধের। কৌতূহলী হয়ে নিহতদের বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম। এবং খুঁজে পেলাম উপরের ছবিটা। অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন না হলে এ শিশুর রাজাকার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অবশ্য গোলাম আজমের বংশধর বলতে কেবল রাজাকার বুঝানো হয়েছে তাও নয় নিশ্চয়। হতে পারে বৃদ্ধ গোলাম আজমের সাথে শিশুটির মার অবৈধ সম্পর্ক ছিল অথবা হতে পারে জনাব আজমের ধর্ষণের ফসল এই শিশু। অথবা তার মা-বাবা গোলাম আজমকে দীক্ষা গুরু হিসাবে মানতেন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাতের কাজে শিশুটিকে ব্যবহার করতেন। এসব তত্ত্বের পক্ষে এ পর্যন্ত কেউ সাক্ষী প্রমাণ নিয়ে জাহির হননি। স্বভাবতই ধরে নেব শিশুটি যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত রাজাকার নয়, এবং কোন বিবেচনায়ই গোলাম আজমের বংশধর না। এতদিন জানতাম শিশু কেবল শিশুই, নিরপরাধ, ইনোসেন্ট এবং সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। চেতনার ভায়াগ্রা খেয়ে যারা জাতির পশ্চাৎ-দেশে নুর হোসেন আর আরিফ-তারিক নামক পতিতাদের ঢুকাতে ব্যস্ত, তাদের জন্য একবিংশ শতাব্দীর শিশু বিংশ শতাব্দীর রাজাকার হবে, খুব একটা অবাক হইনা।

ইলিয়াস মোল্লা। অবৈধ নির্বাচনের আরও এক জারজ ফসল। ৫ই জানুয়ারি দেশের বিভিন্ন এলাকায় জন্ম নেয়া তিনশ জারজ সন্তানদের একজন। অবশ্য নিজকে দাবি করেন মিরপুর এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে। নারায়ণগঞ্জের শামীম, ফেনীর নিজাম, কক্সবাজারের বদির মত এই জারজ সন্তানের জন্মও একই মায়ের জরায়ুতে। ভৌগলিক সীমা ও কাপড়ের পতাকাই যদি একটা দেশ ঘোষণার উপকরণ হয়ে থাকে বাংলাদেশ নিশ্চয় একটা দেশ। তবে মনুষ্যত্বের আরও কিছু চাহিদা ও দাবি থাকে যা পূরণে অক্ষম একটা জাতিকে জাতি বলা যায়না। আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তেমনি একটা দেশ। অক্ষম জাতির টিকে থাকার আবাসভূমি। ইলিয়াস মোল্লার জন্ম, উত্থান এবং আজকের অবস্থান নারায়ণগঞ্জের নুর হোসেনেরই কার্বন কপি। মাথায় ভাসানী টুপি, ক্লিন শেভ মুখ এবং ঠোঁটে দেলোয়ার হোসেন সায়েদী কায়দায় মুক্তিযুদ্ধের প্রলাপের আড়ালে লুকিয়ে আছে খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজী, দখল, উৎখাত সহ শত শত অপরাধের লৌমহর্ষক কাহিনী। একদল ক্ষুধার্ত খুনিদের নিয়ে চলাফেরা করেন। তাদের ভরন পোষণ করেন প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য। মিরপুরের প্রতিবেশী দুটি বস্তি। একটা কালসী। প্রতিবেশী বস্তিতে বিদ্যুৎ নেই। অসুবিধা কি, আছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ। অবৈধ সাংসদ ইলিয়াস মোল্লা তার ক্যাডারদের অতিরিক্ত আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হিসাবে কালসী বস্তি হতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেন প্রতিবেশী বস্তিতে। কিন্তু তাতে বাধ সাধে কালসী বস্তির বৈধ গ্রাহকরা। কারণ সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ এক বস্তির জন্যই যথেষ্ট ছিলনা। স্বভাবতই লোড সেডিং বাড়তে শুরু করে ঐ বস্তিতে। ইলিয়াস মোল্লার সশস্ত্র ক্যাডারদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায় বস্তিবাসী। দুয়েক জনকে ধোলাই দিতেও পিছপা হয়নি তারা। রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হন খোদ গডফাদার ইলিয়াস মোল্লা। আদেশ দেন অবৈধ সরকারের জারজ এমপি যা বলবে তাই এ দেশের আইন। তাতেও দমে যায়নি প্রতিবাদকারীরা। প্রতিবাদের এক পর্যায়ে হেনস্তা করে প্রফেশনাল মার্ডারর এই অবৈধ সাংসদকে। ঘটনাস্থল ত্যাগ করার আগে হুমকি দিয়ে যান দুদিনের ভেতর দেখে নেয়ার।

এবং কথা রাখেন ইলিয়াস মোল্লা। দুদিনের ভেতর বস্তিতে হাজির হয় সোহেল রানা। মন্ত্রীর ডান হাত। স্থানীয় যুবলীগের নেতা এবং প্রফেশনাল খুনি। এক পরিবারের সবাইকে জীবন্ত পুড়িয়ে বীর-দর্পে ফিরে যান রক্ষকের ডেরায়। তা ছাড়া রক্ষক ইলিয়াস মোল্লার অনেকদিনের চোখ বস্তির দিকে। জায়গাটা তার চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জরায়ুতে বলি দিতে চান বস্তির মাটি। তাইতো হত্যার অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে জারজ সাংসদ জানালেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্যই নাকি এসব অভিযোগ।

কালসী অথবা মিরপুরের বাকি বস্তির বাসিন্দাদের পরিচয়ে কোন রাখঢাক নেই। ওরা আটকে পড়া পাকিস্তানি। জাতিসংঘের শরণার্থী আইনে বাস করছে এ দেশে। নিজদের পরিচয়ের সাথে পাকিস্তানী গন্ধ মিশে আছে দিবালোকের মত। কিন্তু এ দেশকে পাকিস্তান বানানোর মিশন নিয়ে এ বস্তিতে গেরিলা গ্রুপ জন্ম নিয়েছে এমন সাক্ষী কেউ দিতে পারবেনা। ওরা খেটে খায়। কেউ আমাদের চুল কাটে, কেউবা জুতা সেলায়। দিনান্তে আর দশটা বাংলাদেশির মতই ঘরে ফিরে যায়। তবে সে ঘর আমার আপনার মত সাধারণ ঘর নয়, বস্তি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এসব বস্তিতে। ’৭১ এ দেশের স্বাধীনতায় যে সব বিহারী পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল তাদের প্রায় সবাইকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতার পর পর। আমরা স্বীকার করতে না চাইলেও এর পক্ষে বাজারে অনেক প্রমাণ বিক্রি হচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর একই অভিযোগে শিশুদের জ্ব্যান্ত পুড়িয়ে মেরে উল্লাস করার ভেতর সততা নেই, আছে পশুত্ব, আছে অসুস্থতার লক্ষণ।

কালসী বস্তির এ শিশুটির অপরাধ সে আটকে পরা পাকিস্তানী। তার আসল দেশ তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করছে। কেবল মাত্র এই অপরাধে শিশুটির পৈশাচিক খুনের বৈধতা দেয়াও অপরাধ। আমাদের বর্তমান জারজ প্রধানমন্ত্রীও জীবনের অনেকটা সময় নিজ দেশে অবাঞ্ছিত ছিলেন। আশ্রয়ের সন্ধানে পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন। বৈধ আয়ের বদলে আশ্রয়দাতার দয়ার উপর বেচে ছিলেন। ইলিয়াস মোল্লাদের এসব ইতিহাস জানা থাকার কথা। না জানলে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে জানানো উচিৎ।

http://www.amibangladeshi.org/blog/06-16-2014/1464.html

 

মানবতা মুছে ফেলো টিস্যুতে!

By: Aman Abduhu

‘একাত্তর ইস্যুতে/ মানবতা মুছে ফেলো টয়লেট টিস্যুতে’ স্লোগানটা বহু বছর আগে ব্লগে প্রথম দেখেছিলাম। চমকে উঠেছিলাম। আজ এতো বছর পরও মনে পড়ে, প্রথমবার দেখে সেদিন কেমন থমকে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো এর জের বহুদূর টানতে হবে বাংলাদেশকে। একটা গোষ্ঠীর চিন্তার প্রকাশ যদি এমন হয়, এবং তা সমাজের শিক্ষিত অংশের মাঝে সমাদৃতও হয়, তবে তার পরিণতি কারো জন্য ভালো হওয়ার কথা না। হয়ওনি। এরপরের বছরগুলোতে শাহবাগিদের প্রিয় সে স্লোগানটা বিভিন্ন উপলক্ষে বারবার, অসংখ্যবার মনে পড়েছে। আজ আবার মনে পড়লো বিহারী পল্লীর হত্যাকান্ডের ঘটনায়।

ঢাকার বিহারী পল্লীতে যুবলীগ নেতাদের নেতৃত্বে উম্মত্ত জনতা আগুনে পুড়িয়ে আর পুলিশ গুলি করে এগারো জন মানুষকে মেরেছে। বেশিরভাগ শিশু আর নারী। শবে বরাতের রাতে আতশবাজি জ্বালানোর মতো তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে। এবং তারপর বীর বাঙালী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উল্লাসে ফেটে পড়ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলায় জিতে আবার মুক্তিযুদ্ধ জয়ের মতো অর্বাচীন সে উল্লাস। সবার সে কি আনন্দ। নিজের অপরাধবোধ আর পশুবৃত্তিকে ঢেকে রাখার কি নিদারুণ চেষ্টা। বিহারী মারলে অসুবিধা নেই। বরং ভালো হয়েছে। এরা স্বাধীনতার শত্রুদের বংশ। এগুলোকে এভাবেই মারা দরকার!!

বাঙালীর এ আনন্দ-উল্লাস দেখে মনে পড়ে বইয়ে পড়া গহীন অরণ্যের আদিম নরখাদক জংলী গোষ্ঠীর উল্লাসের কথা। আগুনে পোড়ানো হচ্ছে কিছু নারী আর শিশুকে। তাদের চামড়া পুড়িয়ে আগুন আরো ভেতরে যাচ্ছে, জ্বালাচ্ছে। চুল পুড়ছে, হাত পুড়ছে, পা পুড়ছে। শ্মশানের পাশে যেমন গন্ধ পাওয়া যায়, সেই মাংসপোড়া গন্ধ ভাসে বাতাসে। আর তাদের চারপাশ ঘিরে ফেসবুকের জঙ্গলে উল্লাসে হৈ হৈ করে নাচছে, লাফাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আপ্লুত বাঙালীর দল। আদিম সেই উল্লাস, খাদ্য জুটছে তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ অন্ধ মনের।

একাত্তরের চেয়ে মানবতা অনেক বড় একটা বিষয়। আর কয়েক জেনারেশন পর একাত্তর স্রেফ অতীতের একটা ঘটনা হয়ে যাবে। কয়েকশ বছর পরে থাকবে বই এর পাতায়। কিন্তু পৃথিবীর শেষ মানুষটা বেঁচে থাকা পর্যন্ত মানবতা একটা দরকারী বিষয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী একাত্তরে মানবতার তোয়াক্কা করেনি বলেই তারা এতো ঘৃণিত।

বিহারী পল্লীর এ ঘটনায় একাত্তর কোনভাবে প্রাসঙ্গিকই না। তারপরও তা টেনে এনে নাচানাচি করা বিকৃত মানসিকতা। যে বিকৃতি আজ বাংলাদেশে মহামারীর মতো। আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় বুদ্ধিজীবি আর শাহবাগির দল সে বিকৃতিকে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের বড় একটা অংশের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। হেডোনিস্টিক ভোগবাদি জীবন যাপনের পাশাপাশি এইধরণের খেলা বা খুনের ঘটনায় এরা দেশপ্রেমের দায়িত্ব পালনের তৃপ্তি পায়।

তাই গত কয়েকবছর ধরে যে অবিচার আর অমানবিকতা চলে আসছে, তাতে মানুষের আর বিকার হয় না। পুলিশ যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে নির্বিকার খুন করে ফেলতে পারে, ছাদ থেকে ফেলে দিতে পারে, গুম করতে পারে, কোন বিচার নাই। ছাত্রলীগ যুবলীগও যা ইচ্ছা খুন ধর্ষন চালিয়ে যেতে পারে, কোন সমস্যা নাই। বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে কুপিয়ে মারা ছাত্রলীগ নেতা সবার সামনে উঁচু গলায় তার পরিবারকে জানিয়ে দেয়, সমস্যা হবে না কোন। গ্রেফতার টেফতার এগুলো ফরমালিটিজ। নারী শিশুদেরকে পুড়িয়ে মারার পর সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হাসিমুখে বলতে পারে, এটা নিছক দুর্ঘটনা। একই দিনে শেখ হাসিনার কথা বলার বিষয় হলো খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিষোদগার। বিহারী পল্লীতে না হয়ে এতজন মানুষ ক্যান্টনমেন্টে মারা গেলে হাসিনা দৌড়ে যেতো, তাদের পরিবারের ভরণপোষনের দায়িত্ব নেয়ার রেডিমেইড নাটকও মঞ্চস্থ হয়ে যেতো এতোক্ষণে।

সমসাময়িক বাংলাদেশে মানবতার এ দুর্দশা শুরু হয়েছিলো আঠাশে অক্টোবরে পল্টনে লগি-বৈঠার সেই ঘটনায়। যেদিন হাসিনার নির্দেশের ফলে মানুষকে আর মানুষের সম্মান দেয়া হয়নি। পশুর মতো পিটিয়ে মারা হয়েছে, প্রকাশ্য দিবালোকে। এবং তার কোন বিচার হয়নি। সে ঘটনার মানসিক প্রভাব ছিলো সুদূরপ্রসারী। আওয়ামী মাফিয়া লীগের লোকজন জেনে গেছে, তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। প্রফেশনাল দুবৃত্ত, চোর-ডাকাত, খুনী-ছিনতাইকারীরা বুঝে নিয়েছে, আওয়ামী লীগের সাথে থাকলে তাদের প্রফেশনাল কাজকর্মের কোন সমস্যা নাই। মীরপুরের ঘটনা এলাকার যুবকদের মারামারি হলেও, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে যুবলীগ নেতা রানা, সেন্টু, শরিফুল। বাংলাদেশে এখন কোন ঘটনাই রাজনৈতিক ছত্রছায়া ছাড়া ঘটে না।

কোন একজন মানুষও কি মনে করেন, এ ঘটনার কোন বিচার হবে? এভাবে নারী আর শিশুদেরকে পুড়িয়ে মারলো যারা, তারা শাস্তি পাবে?

বরং আঠাশে অক্টোবরের সে ঘটনা থেকে শুরু করে বড় বড় ঘটনাগুলোর ন্যায়বিচার না হলে, আজকের বিহারী পল্লীতে ঘটে যাওয়া এই ধরণের গণউন্মাদনার মতো পশুবৃত্তি কখনোই বন্ধ হবে না। কাল বিহারী পল্লীতে এগারোজন মরলো। কয়েকবছর আগে শবে বরাতে আমিনবাজারে ছয় ছাত্র মারা গিয়েছিলো। কয়েক বছর পরে অবশ্যই আমি আপনি মারা যাবো। আগুনে পুড়তে পুড়তে, অথবা মব হিস্টিরিয়ার গণপিটুনিতে দুমড়ে মুচড়ে হোক, কিংবা আওয়ামী দুবৃত্তদের উদ্ভাবিত নতুন কোন উপায়ে। আর গণভবনে বসে রক্তপিপাসু ডাইনী হাসিনা এসব মৃত্যুর খবর পেয়ে সবার সামনে চোখের পানি দেখানোর আগে জিন্দেগী জিন্দেগী গানের তালে একটু নেচে নেবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা!! হাহ!

ফুটনোটঃ একাত্তর নিয়ে আমরা যেই সরল গল্প-কাহিনী জানি, তার বাইরেও কিছু অলটারনেটিভ কথা আছে। আজকের বাঙালীদের এ উল্লাস দেখে মনে হয়, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের লেখা ‘একাত্তরের স্মৃতি’ বইয়ে যুদ্ধের আগে বিহারীদের উপর গণহত্যা চালানোর যে ঘটনাগুলো আছে, তা সত্যও হতে পারে। আমাদের বাবা-দাদারাই তো ছিলেন।

কাকু,আব্বু, আমি ও বাকি ত্রিশ লাখ…

by Watchdog BD

খবরে প্রকাশ নতুন করে আদমশুমারী করতে যাচ্ছে সরকার। শীঘ্রই এ ব্যাপারে লোকবল ও অর্থ বিনিয়োগ সংক্রান্ত ঘোষনা দেয়া হবে। যে কোন উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক পরিসংখ্যান। হোক তা উন্নত বিশ্বে অথবা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে। আমাদের পরিসংখ্যান খাত বাকি দশটা খাতের মতই দুর্নীতির মহামারিতে আক্রান্ত। বিনিয়োগকৃত অর্থ পকেটস্থ করার উদ্দেশ্যে অনেক পরিসংখ্যানই জন্ম নেয় টেবিলে। গরু ঘাস খায়, গাধা ঘাস খায়, সুতরাং গরু = গাধা, এ ধরনের উদ্ভট ম্যাথমেটিক্যাল মডেলিং কায়দায় সমাধান করা হয় পরিসংখ্যান বিষয়ক সমীকরণ। যার দরুন দেশের মোট জনসংখ্যা নিয়ে রয়েছে বহুমুখি সন্দেহ। লিমিট মডেলিংয়ে সংখ্যাটার উপরের ভ্যালু পনের হলে নীচেরটা হবে সতের। অর্থাৎ পনের কোটি হতে সতের কোটির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের মোট জনসংখ্যা। আমদানী নির্ভর একটা দেশের অর্থনীতির জন্য এ ধরণের উঠানামা খুবই ভয়ংকর যা বিশ্ব অর্থনীতির সমসাময়িক বাস্তবতায় খাদ্য ও জ্বালানী নিরাপত্তায় ডেকে আনতে পারে নজিরবিহীন বিপর্যয়। এসব নিয়ে ক্ষমতাসীনদের আদৌ কোন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়না। বাস্তবতা হল, এখানে রাজনীতিকে অর্থনীতি ডমিনেট করেনা, বরং তার উল্টোটাই বাংলাদেশের বেলায় প্রযোজ্য। তারও আছে বহুবিধ কারণ। যেমন, ক্ষমতা ধরে রাখা অথবা ফিরে পাওয়ায় এ দেশে অর্থনীতির কোন ভূমিকা নেই। সকাল-সন্ধ্যা বিরামহীন ব্যক্তি বন্দনাই মসৃণ করে ক্ষমতার সিঁড়িঁ । আদমশুমারী সংক্রান্ত সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের পেছনেও হয়ত রয়ে গেছে ব্যক্তি বিশেষের নতুন ইচ্ছা অথবা অভিপ্রায় বাস্তবায়নের নীলনকশা। এটাই আমাদের রাজনীতি, এটাই আমাদের অর্থনীতি। এবং এমনটাই আমাদের নিয়তি। আদমশুমারী নামক গৌরি সেনের টাকায় নতুন শ্রাদ্ধের সাথে চাইলে নতুন একটা ইস্যু যোগ করা যায়। এর জন্য নতুন কোন বাজেটের যেমন দরকার হবেনা, তেমনি দরকার হবেনা অতিরিক্ত কোন লোকবল অথবা বাহুবলের। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে নিহত ত্রিশ লাখ শহীদ ও তিন লাখ ধর্ষিতা বীরাঙ্গনার একটা তালিকা। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আসুন পরিসংখ্যান নিয়ে আরও কিছুটা সময় ব্যায় করি।

10314583_10203911655491247_6497602888689130159_n

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ হতে ১৬ই ডিসেম্বর। মাসের হিসাবে ৮ মাস ২৩ দিন। দিনের হিসাবে ২৬৭দিন। ঘন্টার হিসাবে ৬৬৭৫ ঘন্টা, মিনিটের হিসাবে ৪,০০০,৫০০ মিনিট এবং সেকেন্ডের হিসাবে মোট ২,৪০,৩০,০০০ সেকে¨। বলা হয় ২৬৭ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তানিরা মোট ৩০,০০,০০০ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছিল। এবার আসুন যোগ বিয়োগ, পুরন ভাগ দিয়ে সংখ্যাটার একটা ফ্রিকোয়েন্সি দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। যা বেরিয়ে আসবে তাতে দেখা যায় পাকিস্তানিরা প্রতিদিন মোট ১১,২৩৬ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছিল। ঘন্টার হিসাবে তা হবে ঘন্টায় ৪৫০জন, মিনিটে ৭।৫ জন এবং সেকেন্ডের হিসাবে ০।১২ জন। এবার আসুন এই ত্রিশ লাখ শহীদের লাশের একটা বিহিত করার চেষ্টা করি। বলা হয় প্রতিটা মুসলমানকে দাফন করতে মোট সাড়ে তিন হাত মাটির প্রয়োজন হয়। এ হিসবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ১,০৫,০০০,০০ হাত জায়গার প্রয়োজন হয়েছিল ত্রিশ লাখ দাফনের জন্য। আমরা যদি গজের হিসাবে দুই হাত সমান এক গজ ধরি তা দাঁড়াবে ৫২,৫০,০০০ গজে। যদি ভুল না হয় ৫,২৮০ গজ সমান এক মাইল। এ হিসাবে মোট গজকে মাইলে নিয়ে গেলে তা হবে ৯৯৪ মাইল। এবং কিলোমিটারের হিসাবে ১৫৯০ কিলোমিটার। ৫৪ হাজার বর্গমাইল আয়তনের একটা দেশে ত্রিশ লাখ লাশ দাফন করতে কত বর্গমাইল জায়গার দরকার তা বের করার দায়িত্বটা পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম। অনেকে বলবেন ত্রিশ লাখের সবাইকে দাফনের ব্যবস্থা করা গেছে এমনটা নয়। অনেকে আবার প্রশ্ন তুলবেন শহীদদের অনেকেই ছিল অমুসলিম এবং স্বভাবতই তাদের দাফন করার প্রশ্ন আসেনি। খুবই যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন। এটাও সত্য ত্রিশ লাখ শহীদদের কাউকেই বাংলাদেশের বাইরে হত্যা করা হয়নি। দাফন না করা গেলে তাদের মৃতদেহ কোথাও না কোথাও ঠাঁই পেয়েছিল। যদি স্বতন্ত্রভাবে সবাই দাফন করা সম্ভব না হয়ে থাকে প্রশ্ন উঠবে শত শত গণকবরের। হিন্দুদের ব্যাপারটা খুব সোজা। ৭১সালে বাংলাদেশের কোথাও কোন চিতায় আগুন জ্বলেনি। পাকিস্তানিরা জ্বলতে দেয়নি। তাদের লাশও কংকাল হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে কোথাও না কোথাও ঠাঁই পেয়েছে। পরিসংখ্যান গুলো একত্র করলে একটা প্রশ্ন জন্ম নিতে বাধ্য, আট মাস তেইশ দিনে আসলেই কি সম্ভব ছিল ত্রিশ লাখ হত্যা করার? নিশ্চয় অসম্ভব কিছু নয়। আমরা যদি সমসাময়িক সময়ে আফ্রিকার রুয়া¨ায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার দিকে চোখ ফেরাই তাহলে একবাক্যে স্বীকার করবো বাংলাদেশেও সম্ভব ছিল। ১০০ দিনের গৃহযুদ্ধে ১০ লাখ রুয়া¨ান প্রাণ হারিয়েছিল, যা ছিল দেশটার মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড গোটা পৃথিবীর সামনে ঘটেছে। লাশের মিছিল ট্রাকে করে ময়লা আবর্জনার মত গণকবর দেয়া হয়েছে। যুদ্ধ শেষে সে সব গণকবরের সন্ধান করে দেশটার সরকার তথা গোটা বিশ্ব নিহতদের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করেছে।

৭১’এ পাকিস্তানিরা এ দেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সংখ্যা এদিক ওদিক করে এ অপরাধ লঘু করার কোন উপায় নেই। বর্বরদের বর্বরতা ইতিহাস কোনদিন ক্ষমা করেনা, আমারাও করবো না। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, এই যে ত্রিশ লাখের কথা বলছি তার কোন তালিকা তৈরীর কেন চেষ্টা করছিনা? নাকি খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবেনা এ সংখ্যা? পরিচিত এক আওয়ামী নেতা আমাকে বলেছিলেন মৃতদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে নাকি পাপ হয়। আত্মারা অভিশাপ দেয়। আপাদমস্তক একজন চোরের মুখে হঠাৎ করে পাপের কথা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। আমি অবশ্য অবাক হয়নি, বরং চমকিত হয়েছি। লাশের সংখ্যাকে রাজনৈতিক উপাদান বানিয়ে ক্ষমতার বাজারে মুনাফা লোটা খুব সোজা। বিশেষ করে ৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের জন্য এ সংখ্যা ঈশ্বরের ওহী বাণীর মত কাজ করতে বাধ্য। যার প্রতিফলন দেখা যায় আজকের সোস্যাল মিডিয়ায়। ত্রিশ লাখ সংখ্যার প্রবর্তক আওয়ামী লীগ জেনশুনে কাজটা করে থাকলে সাধুবাদ জানাতে হয় তাদের সুদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনার জন্য। জাতিকে একটা বিশেষ পরিবারের সেবাদাস বানাতে এর চাইতে ভাল অস্ত্র দলটা হাতে পাবে বলে মনে হয়না। একবার ভেবে দেখুন, প্রতিবেশী একটা দেশের পানি আগ্রাসনে আমাদের নদী গুলো এখন সর্বশান্ত। নদী তীরের জীবন এখন ইতিহাস। খা খা করছে ফসলের মাঠ। ওরা সীমান্ত হতে আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পশু পাখির মত হত্যা করছে, পাশবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। যাকেই দরকার নিজেদের গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে খোদ রাজধানী হতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অসম বানিজ্যিক ভারসাম্যের বোঝা কাধে চাপিয়ে জাতিকে করেছে বিকলাঙ্গ। ড্রাগ এবং অস্ত্রের পাশাপাশি উন্মুক্ত তথ্য প্রবাহের সুযোগ নিয়ে নিজেদের বিকৃত সংস্কৃতি দিয়ে লন্ড ভন্ড করে দিচ্ছে আমাদের সামাজিক ভারসাম্য। এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে ত্রিশ লাখ শহীদের মায়াকান্নায় সমাহিত করে দিচ্ছে আজকের বেচে থাকা। লুটেরার দল দেশ লুটছে, খুন করছে, গুম করছে, করছে ভোট ডাকাতি। এবং দিন শেষে পাপ মোচন হিসাবে ব্যবহার করছে ত্রিশ লাখ শহীদের লাশ।

বাস্তবতা হচ্ছে ৭১’এ ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়নি এ দেশে। কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা এ ধরণের পাইকারি সংখ্যা। মিনিটে ৭ জনের লাশ পরেনি এ দেশে। অন্তত আমরা যারা ৭১’এ দেশে ছিলাম এমনটা দেখিনি। মাটি খুঁড়লেও পাওয়া যাবেনা এত লাশ। হাজার হাজার লাশের গণকবরও নেই আমাদের দেশে। কারও সন্দেহ থাকলে আসুন নিজের পরিবার হতে শুরু করি এর যাচাই। কজন প্রাণ হারিয়েছিল আপনার পরিবারে? গ্রামে অথবা শহরে? সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার ত্রিশ লাখ মানে শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন বাংলাদেশির ৪জন করে প্রাণ হারিয়ে ছিল সে যুদ্ধে। সে হিসাবে আমাদের প্রত্যেকের হাতে থাকার কথা স্বজন হারানোর তালিকা। আছে আপনার হাতে? তাহলে প্রকাশ করুন। এ সংখ্যার ফয়সালা জরুরি পাকিদের পাপ হাল্কা করার জন্য নয়, বরং একদল ক্ষমতালোভী রাক্ষসদের লাশ বানিজ্য বন্ধ করার জন্য। সোস্যাল মিডিয়া হতে পারে এ শুরুর আসল প্ল্যাটফর্ম। আসুন ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধে নিহত প্রতিটা লাশের পরিচয় লিপিবদ্ধ করি। এ সংখ্যা যদি ত্রিশ লাখে দাঁড়ায় সেটাই হবে আমাদের আসল সংখ্যা। শ্রদ্ধাভরে সন্মান জানবো সে সংখ্যাকে। কিন্তু আমরা প্রত্যেক শহীদের নাম জানতে চাই। জানতে চাই তার যাপিত জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এ দেশের রাস্তাঘাটের নাম দেখতে চাই এ সব শহীদদের নামে। এক শেখ মুজিবের নাম গোটা বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাট, নদী-নালা, মুতখানা, লঙ্গরখানা কভার করার জন্য যথেষ্ট নয়। চাই আরও নাম। যুদ্ধের প্রথম প্রহরে যে ব্যক্তি শত্রু ক্যাম্পের মেহমান হয়ে নিজের রাজনৈতিক চামড়া বাচাতে সচেষ্ট ছিলেন তার নামের বন্যায় গোটা দেশ ভেসে যাবে, আর বাকি ত্রিশ লাখ কেবল মায়াকান্নার উপাদান হিসাবে রয়ে যাবে তা হতে পারেনা।

এবারের আদমশুমারী হতে পারে শহীদ সংখ্যা তালিকাভুক্ত করার মোক্ষম মাধ্যম। শুমারির কাজে সরকারী লোকজন দেশের প্রত্যেকটা দুয়ারে কড়া নাড়বে। মাথা গুনবে মোট জনসংখ্যা নির্ধারণের অংশ হিসাবে। একই লোকজন পাশাপাশি আরেকটা তথ্য বের করে আনতে পারে, আর তা হল ৭১’এর শহীদদের নাম, ধাম ও পরিচয়। মনে আছে হুমায়ুন আহমেদের ’বহুব্রীহি’ নাটকের শেষ পর্বের কথা? আবুল হায়াত গরুর গাড়িতে চড়ে অজানার পথে বেরিয়ে পরছেন নতুন এক দায়িত্ব নিয়ে। সে দায়িত্ব ছিল ত্রিশ লাখ শহীদের পরিচয় উদ্বারের দায়িত্ব। কাউকে না কাউকে নিতে হবে সে দায়িত্ব।

http://www.amibangladeshi.org/blog/04-27-2014/1454.html

ফ্যাসীবাদের প্রেরণা -গুরু’র নতুন বাণী

6

আজকের বাংলাদেশে যে আওয়ামী ফ্যাসীবাদ পূর্নশক্তিতে জাকিয়ে বসেছে তার পিছনে মূল প্রেরণা হিসেবে রয়েছে কোনো বিশাল নেতা অথবা নেত্রী নয়, কোনো খ্যাতনামা রাজনীতির তাত্বিক নয়, রয়েছে একজন স্ব-আখ্যায়িত শিশুসাহিত্যিক। ফ্যাসীবাদের মূল নিয়ামক কিন্তু একজন ভয়ংকর কতৃত্ববাদী একনায়ক, একটি সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক দল কিংবা গনদলনে সিদ্ধহস্ত পুলিশবাহিনী নয়। যেকোনো ফ্যাসীবাদের মূলে থাকে একটি কঠোর ও বিশুদ্ধ আইডিওলজী। পৃথিবীতে অনেক দেশেই নানারকম টিনপট ডিক্টেটরশীপ, একপার্টির রাজত্ব দেখা গেছে গত একশ বছরে কিন্তু প্রকৃত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের সাথে এসব হীরক রাজার দেশগুলির মূল পার্থক্য হলো একটি ফ্যাসিস্ট আইডিওলজী। জনগনের গনতান্ত্রিক অধিকারকে সম্পূর্নভাবে নসাৎ করে এবং সেই সাথে জনগনের একটি বড়ো অংশের নি:শর্ত আনুগত্য বজায় রাখতে কেবল বিশাল পুলিশবাহিনী কিংবা বিদেশী সাহায্য যথেষ্ট নয়, এর জন্যে প্রয়োজন হয় একটি কঠোর ও জনপ্রিয় আইডিওলজীর। বাংলাদেশে ২০১৩-১৪ সালে যে নতুন ফ্যাসীবাদের সূচনা হয়েছে তার মূলের রয়েছে একটি আইডিওলজী, সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বর্তমানে এই আইডিওলজীর মূল প্রেরণা-গুরু হলো মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

575468_10151728328535653_444069226_n

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেমন করে বাংলাদেশে ফ্যাসীবাদের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এটি বোঝার জন্যে প্রেরনা গুরুর সর্বশেষ লেখাটিই খুব ভালো উপকরন হতে পারে। এই লেখায় এই নতুন ফ্যাসীবাদের ভিত্তিগুলি পরিষ্কারভাবেই উঠে এসেছে যারা বুঝতে সক্ষম তাদের জন্যে। “স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর” শীর্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের এই লেখাটিতে (http://www.priyo.com/2014/03/28/61144.html) অনেক কথাই রয়েছে, তবে আসল বক্তব্য রয়েছে কয়েকটি লাইনেই।

” শুরুতে বলেছিলাম দেশটাকে এগিয়ে নিতে হলে মূল কিছু বিষয়ে সবার একমত হতে হবে, বঙ্গবন্ধু যে এই দেশের স্থপতি সেটি হচ্ছে এরকম একটি বিষয়। এই দেশটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে পাওয়া একটি দেশ। তাই মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশটি শুরু করা হয়েছিল সেই স্বপ্নকে ভিত্তি করে তার ওপর পুরো দেশটি দাঁড় করানো হবে, এই সত্যটিও সেরকম একটি বিষয়। আমরা আজকাল খুব ঘন ঘন গণতন্ত্র শব্দটি শুনতে পাই, যখনই কেউ এই শব্দটি উচ্চারণ করেন তখনই কিন্তু তাকে বলতে হবে এই গণতন্ত্রটি দাঁড় করা হবে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির ওপরে।

আমরা মুক্তিযদ্ধের ভিত্তি সরিয়ে একটা গণতন্ত্র তৈরি করব, সেই গণতন্ত্র এই দেশটিকে একটা সাম্প্রদায়িক দেশ তৈরি করে ফেলবে, সকল ধর্মের সকল বর্ণের সকল মানুষ সেই দেশে সমান অধিকার নিয়ে থাকতে পারবে না সেটা তো হতে পারে না।

কাজেই ধর্ম ব্যবহার করে রাজনীতি করা গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করা হলেও সেটি কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সাথে খাপ খায় না।” (2014/03/28/)

এই পুরো লেখাটিতে অনেক কথাবার্তার ভীড়ে মূল পয়েন্ট রয়েছে তিনটি। সেই তিনটি পয়েন্ট আলাদা করে বিশ্লেষন প্রয়োজন এটি বুঝতে যে কেমন করে জাফর ইকবাল আজকে আওয়ামী ফ্যাসীবাদের প্রধান প্রেরনাগুরু হয়ে উঠেছেন।

এই লেখায় তিনি বারবার এটা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবার এই ঐক্যমত্যে আসতে হবে যে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি। একথা ঠিক যে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে হলে সমাজের সদস্য-নেতৃত্ব সবাইকে নুন্যতম কিছু ভিত্তির উপরে কনসেনসাসে পৌছতে হয়। আগেরকার রাজতন্ত্রিক দেশগুলোতে সেই ভিত্তি ছিলো রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা। আধুনিক যুগে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ব্যবস্থায় নানারকম নুন্যতম ঐক্যমত দেখা গেছে। যেমন সবার সমান অধিকার, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক সমতা এরকম আরো কিছু। কিন্তু এই সব কিছুর উপরে আধুনিক রাষ্ট্রে যে ঐক্যমত্যে দেশের সকল নাগরিক ও রাজনীতিবিদদের একত্রিত হতে হয় সেটি হলো আইন ও সংবিধানের শাসন। দেশের মানুষ ও রাজনীতি আইন ও সংবিধানের বিভিন্ন ধারার বিরোধিতা করতে পারে, সেটি নিয়ে রাজনীতি করতে পারে, কিন্তু যতক্ষন আইন ও সংবিধান বলবৎ রয়েছে সেটি মেনে চলবে এবং তা ভংগ করলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে, এটিই হলো আধুনিক দেশশাসনের মূলভিত্তি।

রাষ্ট্রে কোনো একজন ব্যাক্তি অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা চেষ্টা ফ্যাসীবাদ প্রতিষ্ঠারই অন্যতম পদক্ষেপ। শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্থপতি কিংবা জাতির পিতা, এটি কোনো ঐতিহাসিক সত্য নয় এটি একটি ঐতিহাসিক মত। শেখ মুজিব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর্কিটেকচারাল  ব্লুপ্রিন্ট প্রস্তুত করে সেটি জাতিসংঘ থেকে পাশ করিয়ে আনেন নি কিংবা নিজ ঔরস থেকে কোটি কোটি বাংলাদেশীর জন্ম দিয়ে বার্থ সার্টিফিকেট নেন নি।আমাদের বুঝতে হবে যে জাতির পিতা, মহাবীর, দ্বিগ্ধীজয়ী, বিদ্যাসাগর, বিশ্বকবি এই রকম খেতাবগুলি কোন ঐতিহাসিকভাবে প্রাপ্ত সনদ নয় বরং ইতিহাসে অনেক মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে দেয়া টাইটেল মাত্র। এই খেতাবগুলির সারবত্তা নিয়ে যেমন ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে তেমনি এগুলির বিরূদ্ধে মতপ্রচারের পূর্ন অধিকারও রয়েছে। কোন দেশের প্রতিষ্ঠায় কে সবচেয়ে বড়ো, কার অবদান ছাড়া রাষ্ট্র জন্মই নিতো না, এই ধরনের মতামতগুলি কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজের মূল ঐক্যমত্যের ভিত্তি হতে পারে না। এই ধরনের ব্যাক্তিকেন্দ্রিক দাবী তোলাও আজকের দিনে হাস্যকর। আজকের পৃথিবী ব্যাক্তি বা বংশ-কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে অনেক আগেই উত্তরিত হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পড়লে অধিকাংশ সুস্থির মতের মানুষই এই সিদ্ধান্ত নেবেন যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যে মানুষটির একক অবদান সবার চেয়ে বেশী তিনি শেখ মুজিবুর রহমান। তারা এটাও বলবেন যে তার অবদানের ধারে কাছে কেউ নেই। কিন্তু এই ব্যাপক সমর্থন থাকা স্বত্তেও শেষ পর্যন্ত এটি একটি ঐতিহাসিক মত, ঐতিহাসিক সত্য নয়। অবদান, ভূমিকা, এসবই সাবজেক্টিভ ব্যাপার, অবজেক্টিভ নয়। এই ধরনের ব্যাপক প্রচলিত মত সম্পর্কে দ্বিমত করারও অবকাশ রয়েছে এবং যেকোন সভ্য রাষ্ট্রে সেই দ্বিমত করার সুযোগও অবশ্যই থাকতে হবে।

আমেরিকার রাজনীতির ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৪৪ জন প্রেসিডেন্ট এর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ এবং কার অবদান সবচেয়ে বেশী এ নিয়ে বিতর্ক, র‍্যাংকিং লিস্ট করা এসব ইতিহাসবিদ এবং জনগন সবারই একটি বহু পুরাতন এবং নিয়মিত অভ্যাস। এই বিষয় নিয়ে প্রায় প্রতি বছরই কোনো না কোনো লিস্ট বের হয়। এই সব লিস্টে প্রায় অবধারিতভাবেই যে তিন জনের নাম এক, দুই ও তিন এর মধ্যে থাকে তারা হলো প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন, ষোড়শতম আব্রাহাম লিংকন এবং বত্রিশতম ফ্র‍্যাংকলিন রুজেভেল্ট। এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশীবার শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আব্রাহাম লিংকন। ১৯৪৮ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত করা বিশেষজ্ঞদের ১৭ টি বিভিন্ন সার্ভেতে লিংকন শ্রেষ্ঠতম বিবেচিত হয়েছেন ১০ বার, দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠতম ৫ বার এবং তৃতীয় ২ বার। উইকিপিডিয়াতে এই আর্টিকেলটি বিস্তারিত রয়েছে (http://en.wikipedia.org/wiki/Historical_rankings_of_Presidents_of_the_United_States#Scholar_survey_results)। অর্থাৎ আমেরিকার প্রায় আড়াইশত বছরের ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকন যে শ্রেষ্ঠতম নেতা কিংবা শ্রেষ্ঠের খুবই কাছাকাছি, এ বিষয়ে ইতিহাসবিদরা মোটামুটি একমত। শুধু ইতিহাসবিদরাই নন, এমনকি আমেরিকার সাধারন ও জনপ্রিয় ইতিহাসে আব্রাহাম লিংকন মোটামুটি প্রায় অতিমানবীয় অনন্য একজন সাধু-দার্শনিক-নেতা হিসেবেই পরিচিত, তার কাছের অবস্থানেও কেউ নেই।

এই যে মহান আব্রাহাম লিংকন, সেই লিংকনকে আমেরিকার দক্ষিন অংশ-যে দক্ষিনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সিভিল ওয়ারে উত্তরের নেতৃত্বে ছিলেন লিংকন- গত দেড়শত বছর ধরে কি ভাবে দেখা হয়? সোজা ভাষায় বলা যায় যে আমেরিকার দক্ষিনের শ্বেতবর্নের রক্ষনশীলেরা -যারা এখনো দক্ষিনের সবচেয়ে বড়ো এবং প্রভাবশালী অংশ- আব্রাহাম লিংকনকে শয়তানের সাক্ষাৎ অবতার হিসেবে মনে করে। এই মতামত শুধু দক্ষিনের সাধারন নাগরিকেরা নয়, দক্ষিনের রাজনীতিবিদরাও অকপটে প্রকাশ্যে বলতে কোনো দ্বিধা করে না। আমেরিকার রক্ষনশীলেরা এবং অন্যান্য অনেকেই প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন বই-গবেষনা প্রকাশ করে যেখানে তুলে ধরা হয় যে আব্রাহাম লিংকন কিভাবে একটি অনাবশ্যক যুদ্ধের সূত্রপাত করে আমেরিকার জনগনের উপরে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক অধ্যায়কে চাপিয়ে দিয়েছেন। এসব আমার মতামত নয় বরং অনেক আমেরিকান রক্ষনশীলের মত। তারা লিংকনকে ঘৃনা করার পেছনে যুক্তি হিসেবে কি বলে তা বোঝার জন্যে ২০১০ এ প্রকাশিত Abraham Lincoln: The Southern View (http://www.amazon.com/Abraham-Lincoln-The-Southern-View/dp/0982770006) বইটির সারসংক্ষেপের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা যেতে পারে।

লেখক Lochlainn Seabrook এই বইটিতে দক্ষিনের চোখে যে লিংকনকে তুলে ধরেছেন সেই লিংকন একজন – “an unscrupulous demagogue and anti-Christian liberal who broke hundreds of laws; ignored and even subverted the Constitution; used money from the Yankee slave trade to fund his war; sanctioned the murder of both Southern blacks (who would not enlist in the Union army) and harmless Southern noncombatants (including women and children); had tens of thousands of innocent Northerners arrested, imprisoned, and sometimes tortured and executed without charge or trial; rigged the 1860 and 1864 elections; confiscated and destroyed private property; censored governmental debate over secession; and more. Throughout all of this, Southern historians estimate that some 3 million Americans, of all races, died in direct consequence of his actions.”

বলাই বাহুল্য লিংকনের শ্রেষ্ঠত্ব অথবা লিংকনের নিকৃষ্টতা, এই সবই ইতিহাসের ফ্যাক্ট নয় এগুলি ইতিহাসের মতামত। আর মতামত নিয়ে বিভাজন থাকতেই পারে।

এখন প্রশ্ন হলো যে আব্রাহাম লিংকন এর নেতৃত্ব ও তার উত্তরাধিকার নিয়ে আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিনের এর তীব্র বিভাজনের জন্যে কি আমেরিকার রাজনীতির ক্রমাগত বিবর্তন ও উন্নয়ন থেমে রয়েছে? কোনো ভাবেই নয়, এই বিভাজনকে নিয়েই আমেরিকার গনতন্ত্র দিনে দিনে আরো বিস্তৃত ও সংহত হয়েছে। সিভিল ওয়ারে বিজয়ের পরে বিজয়ী উত্তর দক্ষিনকে এই আদেশ করে নি যে সবাইকে লিংকনের নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌছতে হবে। প্রতিটি মানুষ ও রাজনৈতিক সংগঠনের রয়েছে নিজস্ব মত ধারন ও প্রচারের অধিকার। কিন্তু সবাইকে দেশের আইন ও সংবিধান মেনে চলতে হবে। আমেরিকার দক্ষিন যুদ্ধে পরাজয়ের পরে মৌলিক নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে প্রদেশের উপরে ফেডারেল ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছে, সেটি মন থেকে মেনে নিয়েছে নাকি তার বিরুদ্ধে এখনো প্রচার করছে এটি দেশের সরকারের কোনো বিবেচনার বিষয় নয়, দেশের আইন মেনে চলছে কিনা এটিই সরকারের একমাত্র বিবেচ্য।

শুধু লিংকনই নয়, আজকের আমেরিকায় যদি কেউ বলে যে আমেরিকায় রাজনীতি করতে হলে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের শ্রেষ্ঠ ভূমিকা স্বীকার করতে হবে, তবে তাকে মানুষ পাগলের চেয়েও যুক্তিবিহীন বলে মনে করবে। আর সেই দেশে দীর্ঘদিন থেকে, সেই দেশ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ সেজে মুহম্মদ জাফর ইকবাল ফতোয়া দেন যে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে ‘ বঙ্গবন্ধু এই দেশের স্থপতি ‘ এই বিষয়ে সবার একমত হতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতি আলোচনায় আমেরিকা-বৃটেন এর তুলনা আনলেই অনেকে হারে রে করে তেড়ে ওঠেন যে এই দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির সাথে ঐসব দেশের যোজন যোজন পার্থক্য সুতরাং এই ধরনের তুলনার মাধ্যমে কোনো ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা অনর্থক বাতুলতা মাত্র। ঠিক আছে। তাহলে এবার এমন একটি দেশের ইতিহাস-রাজনীতিই দেখা যাক যেটি মাত্র ৬০ বছর আগেও অর্থনীতি ও রাজনীতিতে আমাদের দেশের অবস্থানের খুব কাছেই ছিলো।

পার্ক চুং হি (Park Chung-hee) একজন জেনারেল যিনি একটি ক্যু এর মাধ্যমে ১৯৬১ সালে দ: কোরিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এবং এর পরে প্রায় একনায়কের মতোই ১৮ বছর দ: কোরিয়া শাসন করেন, যে শাসনের অবসান ঘটে ১৯৭৯ সালে আততায়ীর হাতে পার্ক নিহত হবার পরেই। পার্ক চুং হি তার শাসনামলেই আধুনিক কোরিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তাকে একারনেই বিশ্বজুড়ে Father of Korean Economic Miracle বলা হয়। টাইম ম্যাগাজিন তাদের মিলেনিয়াম প্রকাশনায় পার্ক চুং হি কে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দশজন এশিয়ানদের একজন হিসেবে নির্বাচন করেছিলো। আজ পর্যন্ত দ: কোরিয়ার ডানপন্থী রাজনীতির সমর্থকেরা পার্ককে তীব্র ভক্তির সাথে স্মরন করে। অনেকটা তার স্মৃতির উপরে ভর করেই পার্কের কন্যা পার্ক গুন হেই (Park Geun-hye) ২০১৩ সালে দ: কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

পার্ক চুং হি যেমন একদিকে দেশের বিপুল অংশের কাছে দেবতুল্য ভক্তির ধারক তেমনি আরেক বৃহৎ অংশের কাছে তীব্র ঘৃনার পাত্র। পার্ক তার শাসনের সময়ে বামপন্থী ও গনতান্ত্রিক রাজনীতি ও কর্মীদের উপরে চরম অত্যাচার ও নিষ্পেষন চালিয়েছেন। দেশের শ্রমিকদের অধিকারকে দলন করে বড়ো কোম্পানীগুলিকে সবরকমের সুবিধা দিয়েছেন। তার সময়ে কোরিয়ার নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার বলতে কিছু ছিলো না। কোরিয়ার জনগনের পার্কের সময় হতে শুরু করে আরো অনেক দিন পর পর্যন্ত একের পর এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করে অবশেষে সেখানে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এরকম আরো অনেক কারনেই দ: কোরিয়ার বিপুল অংশের কাছে পার্ক চুং হি একটি ঘৃন্য নাম।

দ: কোরিয়ার জনগনের মধ্যে তাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রধানতম ব্যাক্তিত্ব নিয়ে যে এই বিশাল দ্বিভাজন, তার কারনে কি তাদের উন্নতি, প্রগতি বাধাগ্রস্থ হয়েছে? ১৯৭০ সালেও যখন দ: কোরিয়া আর উত্তর কোরিয়ার মাথাপিছু আয় একই সমান ছিলো সেখানে আজকে দ: কোরিয়ার মাথাপিছু আয় বাকশালী-ঐক্যমত্যের দেশ উ: কোরিয়ার চেয়ে প্রায় বিশগুন বেশী।

বস্তুত ইতিহাস নিয়ে ঐক্যমত্য ছাড়া এগুনো যাবে না এই ধরনের কথাবার্তার কোন সারবত্তা নেই। তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত দেশগুলির ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাবে যে যেসব দেশে মুক্তি সংগ্রামের গৌরবোজ্বল ইতিহাস নেই, যারা ঔপনিবেশিক প্রভুদের সাথে হ্যান্ডশেক করার মাধ্যমে নতুন দেশ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে, তারাই অর্থনীতি ও সমাজে বেশী উন্নতি করেছে। দেশের উন্নতির জন্যে ইতিহাস বা মতবাদ নিয়ে একমত হবার জন্যে যারা বেশী সরব তাদের অন্য কোন এজেন্ডা থাকে। এই এজেন্ডা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হলো দেশে ঘৃনার চাষ করে দ্বিভাজন সৃষ্টি করা। আর আমরা বার বার দেখেছি যে এই ঘৃনার দ্বিভাজন ও কৃত্রিমভাবে মতবাদের ঐক্যমত্যের চেষ্টাই গত কয়েক দশকে একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও গনহত্যার জন্ম দিয়েছে।
এই ইতিহাস নিয়ে ঐক্যমত্যের উপরেই রয়েছে জাফর ইকবালের দ্বিতীয় ও মূল পয়েন্ট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জাফর ইকবাল বাংলাদেশে যেই ফ্যাসীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রাণাতিপাত করে চলেছেন সেই ফ্যাসীবাদের মূল ভিত্তিই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (বা স্বপ্ন, যে নামেই বলুন জিনিষটি একই)। এই লেখাতে এবং এর আগেও তিনি স্পষ্ট করেছেন যে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের চেয়ে বড়ো কিছুই নেই।

“তাই যারা প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে এই দেশটা এনে দিয়েছে তার যে স্বপ্ন দেখেছিল সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই এই দেশের রাজনীতি হোক, অর্থনীতি হোক, লেখাপড়া হোক, চাষ আবাদ হোক, গানবাজনা হোক, সুখ-দুঃখ মান-অভিমান হোক, কোনো কিছুই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাইরে হতে পারবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে ‍মুক্তিযুদ্ধ। যারা এটিকে অস্বীকার করে তাদের এই দেশে রাজনীতি করা দূরে থাকুক, এই দেশের মাটিতে রাখার অধিকার নেই।” (০১/১৭/২০১৪)
http://www.priyo.com/2014/01/17/49312.html

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাইরে এই বাংলাদেশে একটি গাছের পাতাও নড়তে পারবে না এই বিশ্বাস হলো জাফর ইকবাল আর তার লক্ষ লক্ষ ভাবশিষ্যের ইমানের মূল স্তম্ভ।  কিন্তু এখানে শুভংকরের সবচেয়ে বড়ো ফাকি হলো যে এই যে অতীব গুরুত্বপূর্ন মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, সেই স্বপ্নটি আসলে কি তার কোনো কংক্রীট বিবরন এই সব ফ্যাসিস্ট প্রফেটদের কাছে আপনি কখোনই পাবেন না। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে এই দেশের বিভিন্ন মত, বিভিন্ন বিশ্বাসের লক্ষ কোটি যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী আর যুদ্ধ পলাতক মিলে কিভাবে একটিই বিশুদ্ধ আর মৌলিক স্বপ্ন দেখে ফেললো আর সেই স্বপ্নের খাবনামাও সেই সকলের কাছেও তর্কাতীত ছিলো, এই রহস্যের কোন ব্যাখা আপনি পাবেন না। ম্যাজিশিয়ানের ট্রিকের মতো মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নও দূর থেকে দেখা আলো আধারির স্টেজ শো, কাছে গিয়ে বিশ্লেষন করলেই সেটা আর স্বপ্ন থাকে না।

বেশী চেপে ধরলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের দিশারীরা অবলম্বন করেন ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতিকে এবং তার ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তাসের ঘর নির্মানের চেষ্টা করেন তারা। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চার মৌলিক উপাদানেই তৈরী মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নের ভিত্তির উপরেই বাংলাদেশের রাজনীতি দাড় করাতে হবে এটাই শেষ পর্যন্ত দাবী করা হয়। এই দাবীটি যখন স্পষ্টভাবে বলা হয় তখনই এর শুভংকরের ফাকিটিও সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

জাতীয়তাবাদ নিয়ে এখানে বেশী কথা বলার দরকার নেই। জাতীয়তাবাদ নিয়ে এই দেশে এত লক্ষ লক্ষ পাতা আর শতকোটি শব্দ ব্যয় করার পরও জাতীয়তাবাদ নিয়ে সবার মাঝে যে কনফিউশন রয়ে গেছে তার বিন্দুমাত্র লাঘব ঘটে নি। ভৌগলিক, রাজনৈতিক, সাংষ্কৃতিক, নৃতাত্বিক, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের এই নানারূপের গোলোকধাধায় কোন একটি coherent মতবাদ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এই দাবী অনায়াসেই করা যায় যে বাংলাদেশে এখন এমন দুইজন শিক্ষিত নাগরিক পাওয়া যাবে না যারা জাতীয়তাবাদ বলতে পুরো একই রকম একটি বিশ্বাস ধারন করেন।

এরপরেই আসে মুক্তিযু্দ্ধের স্বপ্নের সবচেয়ে স্পষ্ট Achilles Heel সমাজতন্ত্রের কথা। লক্ষ্যনীয় যে এই সমাজতন্ত্র মানে পরবর্তীতে আরোপ করা সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক মুক্তি,  সোশ্যাল ডেমোক্র‍্যাসী এই ধরনের নির্দোষ, নিরীহ শ্লোগান নয়। ১৯৭২ এর সমাজতন্ত্র মানে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। সেই সংবিধানেই স্পষ্ট বলা আছে,

“১০/ মানুষের উপর মানুষের শোষন হইতে মুক্ত ন্যায়নুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশিত করিবার উদ্দ্যেশ্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।”

এই সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আরো বিশদ বলা হয়েছে ১৩ অনুচ্ছেদে।

Somaj

সমাজতন্ত্র নিয়ে বিশদ আলোচনা করাও এই লেখার উদ্দ্যেশ্য নয়। শুধু একটি কথাই বলা যেতে পারে যে আজকের বাংলাদেশে কতোজন লোক মনে করে যে এই দেশের অর্থনীতির প্রধান ক্ষেত্র গুলি, যেমন শিল্প, গার্মেন্টস এই সবের জাতীয়করন করা প্রয়োজন? কারা মনে করে দেশের জন্যে দরকার আরো অনেক ‘দোয়েল ল্যাপটপ’ প্রজেক্ট? কয়জন মনে করে যে সমবায়ের ভিত্তিতে কৃষিকে পরিচালনা করতে হবে? কারা বিশ্বাস করে যে সারা দুনিয়ায় কালেক্টিভ অর্থনীতি ফেল মারার পরে এই বাংলাদেশেই সমাজতন্ত্র তার সমুজ্বল ভবিষৎ নির্মানের সূচনা করবে? সমাজতন্ত্র যদি মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন হয়ে থাকে তবে সেই স্বপ্ন এইদেশে অনেক আগেই টুটে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের নামে যেই মতবাদটির যাবতীয় তর্ক-বিতর্কের মূলে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আধুনিক, গনতান্ত্রিক, যুক্তিসম্মত আদর্শ। যে কোন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যাক্তিই এর বিরোধিতা করতে দ্বিধা করবে। ১৯৭২ এর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝানো হয়েছে,

dhormo

এখানে (ক), (খ) এবং (ঘ) অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই বললেই চলে। এমনকি যারা ধর্মীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন তারাও এই নীতিগুলির সরাসরি বিরোধিতা করবেন না বরং সমর্থনই করবেন। মূল বিতর্ক (গ) অনুচ্ছেদ নিয়ে। পৃথিবীর কোনো গনতান্ত্রিক দেশে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাজনীতি করার অধিকার খর্ব করা হয় নি। প্রতিটি গনতান্ত্রিক দেশে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাজনীতির অধিকার রয়েছে কারন এটি রাজনীতি করার মৌলিক অধিকার প্রশ্নেই অংগাগীভাবে জড়িত। কিন্তু এই বাংলাদেশেই, এই মূর্খ ফ্যাসীবাদীরা, এক অনন্য হবুচন্দ্র মার্কা রাজত্ব কায়েমের জন্যে এই ফ্যাসীবাদী মতকে দেশের উপরে চাপিয়ে দেবার জন্যে বদ্ধপরিকর।

ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে এই ক্ষুদ্র, এলিটিস্ট গোষ্ঠী যে ফ্যাসীবাদী মতকে দেশের উপরে চাপিয়ে দিতে চান তার সাথে বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কোন আত্মিক সংযোগ নেই। এটা ১৯৭১ এ ছিলো না, ১৯৭২ এও ছিলো না, আজকে আরো নেই। এই প্রসংগে আবুল মনসুর আহমেদ এর সেই ক্ল্যাসিক লেখা “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” এর লেখা স্মর্তব্য,

অথচ প্রকৃত অবস্থাটা এই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানও ভাংগে নাই “দ্বিজাতিতত্ত্ব”ও মিথ্যা হয় নাই। এক পাকিস্তানের জায়গায় লাহোর-প্রস্তাব মত দুই পাকিস্তান হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন। তারা আমাদের কৃতজ্ঞতার পাত্র। দুই রাষ্ট্রের নামই পাকিস্তান হয় নাই, তাতেও বিভ্রান্তির কারণ নাই। লাহোর প্রস্তাবে “পাকিস্তান” শব্দটার উল্লেখ নাই, শুধু ‘মুসলিম-মেজরিটি রাষ্ট্রের’ উল্লেখ আছে। তার মানে রাষ্ট্র-নাম পরে জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়ার কথা। পশ্চিমা জনগণ তাদের রাষ্ট্র-নাম রাখিয়াছে “পাকিস্তান”। আমরা পূরবীরা রাখিয়াছি “বাংলাদেশ”। এতে বিভ্রান্তির কোনও কারণ নাই।

—         ইংরেজ আমলের আগের চারশ বছরের বাংলার মুসলমানের ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। সেখানেও তাদের রুপ বাংগালী রুপ। সে রুপেই তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সৃষ্টি করিয়াছে। সেই রুপেই বাংলার স্বাধীনতার জন্য দিল্লীর মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছে। সেই রুপেই বাংলার বার ভূঁইয়া স্বাধীন বাংলা যুক্তরাষ্ট্র গঠণ করিয়াছিলেন। এই যুগ বাংলার মুসলমানদের রাষ্ট্রিক, ভাষিক, কৃষ্টিক ও সামরিক মণীষা ও বীরত্বের যুগ। সে যুগের সাধনা মুসলিম নেতৃত্বে হইলেও সেটা ছিল ছিল উদার অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-বৌদ্ধরাও ছিল তাতে অংশীদার। এ যুগকে পরাধীন বাংলার রুপ দিবার উদ্দেশ্যে “হাজার বছর পরে আজ বাংলা স্বাধীন হইয়াছে” বলিয়া যতই গান গাওয়া ও স্লোগান দেওয়া হউক, তাতে বাংলাদেশের জনগণকে ভুলান যাইবে না। আর্য্য জাতির ভারত দখলকে বিদেশী শাসন বলা চলিবে না, তাদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, রাজপুত, কায়স্থকে বিদেশী বলা যাইবে না, শুধু শেখ-সৈয়দ-মোগল-পাঠানদেরই বিদেশী বলিতে হইবে, এহেন প্রচারের দালালরা পাঞ্জাবী দালালদের চেযে বেশী সফল হইবে না। এটা আজ রাষ্ট্র-বিজ্ঞানের সর্বজন-স্বীকৃত সত্য যে, কৃষ্টিক স্বকীয়তাই রাষ্ট্রীয় জাতীয় স্বকীয়তার বুনিয়াদ। কাজেই নয়া রাষ্ট্র বাংলাদেশের কৃষ্টিক স্বকীয়তার স্বীকৃতি উপমহাদেশের তিন জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম সমতা-ভিত্তিক স্থায়ী শান্তির ভিত্তি হইবে॥”

– আবুল মনসুর আহমদ / আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর ॥ [খোশরোজ কিতাব মহল – ডিসেম্বর, ১৯৯৯ । পৃ: ৬৩২-৬৩৮]

আসলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের নামে জাফর ইকবাল এবং তার শিষ্যদের সকল আহাজারির মূলেই রয়েছে একটি জিনিষ, সেটি হলো গনতন্ত্র। তারা ভালোভাবেই জানে যে তারা যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন দেখেন সেই স্বপ্ন বাংলার জনগন ১৯৭১ এ দেখেনি আজও দেখে না। এই কারনেই গনতন্ত্রকে তাদের এতো ভয়। একারনেই নানারকম ছলছুতো, শর্ত দিয়ে গনতন্ত্রকে পর্দার আড়ালে ফেলতে তাদের এতো প্রচেষ্টা। জাফর ইকবাল যে গোষ্ঠীর প্রেরণাগুরু, মন্ত্রী-এশিয়াটিক ডিরেক্টর আসাদ্দুজ্জান নূর যেই গোষ্ঠীর যোগানদার, শামীম ওসমান-তাহের গং যে গোষ্ঠীর সিপাহসালার এবং শাহবাগীরা যেই গোষ্ঠীর ফুট সোলজার, সেই গোষ্ঠীর একটিই লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে আওয়ামী ধর্মের একছত্র রাজত্ব কায়েম করা।

এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে তারা দেশের জনগনকে সরাসরি বাধ্যতামূলক প্রেসক্রিপশনও দিয়ে রেখেছেন। প্রথমেই আপনাকে শেখ মুজিবের নবুয়ত স্বীকার করতে হবে। এরপরে আওয়ামী আদর্শগুলিতে ইমান আনতে হবে। তারপরে সকল আওয়ামী বিরোধীকে ঘৃনাভরে বর্জন করতে হবে। এই প্রেসক্রিপশন মেনে নেয়ার পরেই আপনি যত ইচ্ছা রাজনীতি করতে পারেন। এর আগে রাজনীতি-গনতন্ত্র এসব কোনকিছুই বিবেচনা করা যাবে না।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সময়ে সবচেয়ে বড়ো বাস্তবতা যে দেশের ভাগ্য জনগনের হাতে নেই। একটি চরমপন্থী গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বার্ষিক ১৫০ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির একটি আস্ত রাষ্ট্রকে কুক্ষীগত করে ফেলেছে। এই বাস্তবতা হতে চোখ ফিরিয়ে, জনগনের অক্ষমতাকে ভুলিয়ে দিতে ফ্যাসীবাদের প্রেরনাগুরু গনতন্ত্রকে তুচ্ছ করে একের পর এক ঐশীবাণী দিয়েই যাবেন প্রতিটি মাসে একের পর এক উপলক্ষকে আশ্রয় করে। আর সেই বাণী সোৎসাহে প্রচার করতে থাকবে চেতনায় বুদ হয়ে থাকা বাংলাদেশী হিটলার ইয়ুথ (Hitlerjugend)। স্টেডিয়ামে পতাকা নিষেধাজ্ঞা, বৃহত্তম পতাকা, লক্ষকন্ঠে জাতীয় সংগীত, এইসব Fascist Mass Spectacle এই প্রোগ্রামেরই অংশ।

18w91xufbk7ayjpg

পরিশেষে পুনরায় আবার মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বা চেতনা নিয়ে অতুলনীয় আবুল মনসুর আহমেদ এর ই আরেকটি বক্তব্য।

 “… জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার মহান আদর্শই আমাদের বীর জনগণকে মুক্তি-সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল। তথ্য হিসাবে কথাটা ঠিক না। আওয়ামী লীগের ছয়-দফা বা সর্বদলীয় ছাত্র একশন কমিটির এগার-দফার দাবিতেই আমাদের মুক্তি-সংগ্রাম শুরু হয়। এইসব দফার কোনটিতেই ঐ সব আদর্শের উল্লেখ ছিল না। ঐ দুইটি ‘দফা’ ছাড়া আওয়ামী লীগের একটি মেনিফেস্টো ছিল। তাতেও ওসব আদর্শের উল্লেখ নাই।

বরঞ্চ ঐ মেনিফেস্টোতে ‘ব্যাংক-ইনশিওরেন্স, পাট ব্যবসা ও ভারি শিল্পকে’ জাতীয়করণের দাবি ছিল। ঐ ‘দফা’ মেনিফেস্টো লইয়াই আওয়ামী লীগ ৭০ সালের নির্বাচন লড়িয়াছিল এবং জিতিয়াছিল। এরপর মুক্তি সংগ্রামের আগে বা সময়ে জনগণ, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের পক্ষ হইতে আর কোনও ‘দফা’ বা মেনিফেস্টো বাহির করার দরকার বা অবসর ছিল না। আমাদের সংবিধান রচয়িতারা নিজেরা ঐ মহান আদর্শকে সংবিধানযুক্ত করিযাছিলেন। তাই জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ঐ ভুল তথ্য পরিবেশন করিয়াছেন।

রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের মতাদর্শকে জনগণের মত বা ইচ্ছা বলিয়া চালাইয়াছেন বহু বার বহু দেশে। সবসময়েই যে তার খারাপ হইয়াছে, তাও নয়। আবার সব সময়ে তা ভালও হয় নাই। পাকিস্তানের সংবিধানের বেলায় ‘ইসলাম’ ও বাংলাদেশের সংবিধানের বেলায় ‘সমাজতন্ত্র, জাতীয়তা ও ধর্ম-নিরপেক্ষতা’ও তেমনি অনাবশ্যকভাবে উল্লিখিত হইয়া আমাদের অনিষ্ট করিয়াছে। আমাদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু জটিলতার সৃষ্টি করিয়াছে। এসব জটিলতার গিরো খুলিতে আমাদের রাষ্ট্র-নায়কদের অনেক বেগ পাইতে হইবে॥”

– আবুল মনসুর আহমদ / আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর ॥ [খোশরোজ কিতাব মহল – ডিসেম্বর, ১৯৯৯ । পৃ: ৬২০-৬২১]

[আবুল মনসুর আহমেদ এর book excerpts are courtesy of FB blogger Kai Kaus   https://www.facebook.com/kay.kavus?fref=ts    ]

 

 

 

 

যুদ্ধ পূজারীর হাতে জিম্মি স্বাধীনতা

3

By শাফকাত রাব্বী অনীকঃ

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আজকাল আর বেইল নেই। বেইল শুধু যুদ্ধ-পুজারীদের।

যোদ্ধারা যুদ্ধ করে, গুলি চালায়, রক্ত দেয়, জীবন হারায়। মরলে হয় শহীদ, আর বাঁচলে গাজী । সেদিক থেকে যুদ্ধ-পুজারীর ঝক্কি ঝামেলা কম। পুজারীর দল যুদ্ধকালে ধরা দেয়, পালায়; তা না পারলে চুপচাপ সুশীল হয়ে বসে থাকে। কেউ কেউ শত্রুর চাকরিও কন্টিনিউ করে। তারপরে যুদ্ধ শেষে এই পুজারীর দল প্রকৃত যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, বীরত্ব-গাঁথা আর রক্তের হিসেব নিকেশ নিয়ে সত্য-মিথ্যা গল্প ফাঁদে। যুদ্ধের পুজা বসায়। যার মন্ডপে যতো লোক, সে হয়ে যায় ততো বড় যুদ্ধ-পুজারী।

উপরের বাস্তবতায়, বন্দুক হাতে যুদ্ধ করা প্রেসিডেন্ট জিয়া আজ হয়ে গেছেন রাজাকার। কাদের সিদ্দিকী জামাতি। আর মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরী রাজনৈতিক দল হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি।

অন্য দিকে যুদ্ধকালে পীরের বাড়িতে লুকানো ব্যাক্তি, শত্রু সেনার মুরগি সাপ্লাইকারী, শত্রুর চাকরি-পালনকারী, কিংবা যুদ্ধের পুরোটা সময় পালিয়ে বেড়ানো ব্যাক্তিদের দল হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। এই পরিনতির পিছনে মুক্তিযোদ্ধাদের দোষ ছিল একটাই। তারা যুদ্ধটা ফাটিয়ে করতে পারলেও, যুদ্ধের পুজোটা ভালো দিতে পারেননি।

যোদ্ধা আর পুজারীর কাজের পার্থক্যও বিস্তর। যোদ্ধার কাজ হলো যুদ্ধ করা। একারণে যুদ্ধ শেষ, যোদ্ধার কাজও শেষ। আর পুজারীর কাজ শুরু হয় ঠিক সেখানে, যেখানে যোদ্ধার কাজ হয় শেষ।

যোদ্ধার চোখে যুদ্ধ বড়ই নির্মম, হিংস্র, এবং অমানবিক। যোদ্ধা যুদ্ধকে ভাবে এমন এক বাস্তবতা, যা সে চায় না তার প্রিয় কেউ কখনও দেখুক। অন্যদিকে যুদ্ধ-পুজারীর কাছে যুদ্ধ হলো রূপকথার বীরত্ব-গাঁথা। কিছুটা রসালো ফেইরি টেইলের মতো। এমন কিছু যা বেঁচে খাওয়া যায়। গল্পে বিভোর কোন ফ্রিকের কাছে যুদ্ধ হয়ে যেতে পারে মিস হয়ে যাওয়া, না দেখা এক তামাশা। তাই পূজারিদের কেউ কেউ রিওয়াইন্ড করে সেই তামাশা দেখতে চায়। মানুষকে দেখাতে চায়।

যোদ্ধার কাছে যুদ্ধের সমাপ্তি খুবই কাং্খিত, রিলিভিং। যুদ্ধের সমাপ্তি যোদ্ধার কাছে কোন ভাবেই কম গর্বের কোন বিষয় নয়। পুজারির কেইস এক্ষেত্রে ভিন্ন।পুজারিদের যেহুতু যুদ্ধ ফুদ্ধ করা লাগে না, তাদের চোখে যুদ্ধ যতোবেশী স্থায়ী হবে, পুজোর ব্যাবসা ততোটাই জমবে। গল্প ফান্দার প্লটও বাড়বে।

প্রকৃত যোদ্ধারা যুদ্ধকে এড়িয়ে চলতে চান। নিতান্ত বাধ্য না হলে যুদ্ধের ডাক দেন না। কেননা তিনি জানেন যুদ্ধ কি জিনিস। পুজারিদের কিন্তু এতোটা দায়িত্ববান হবার ঝামেলা নেই। কেননা তারা যুদ্ধ করেন না। একারনে দু’দিন পরপর নতুন নতুন যুদ্ধের হাক-ডাক দিতে পিছ পা হননা যুদ্ধ-পুজারীর দল। যে কাজ নিজে করা লাগে নাই, তার হাওয়া তুলে মানুষকে লাড়িয়ে বেড়ানোর শিশুতোষ আনন্দে তারা বিহ্বল হন।

প্রকৃত যোদ্ধাদের অনেকেই যুদ্ধের গল্প বলতে চাননা। কেননা শত্রুর হাঁতে নিজের সহ-যোদ্ধার মৃত্যু তাকে পিড়া দেয়। আবারএকই ভাবে তার স্মৃতিতে পিড়া দেয় সহযোদ্ধা হত্যার প্রতিশোধ তুলতে গিয়ে নিজের হাঁতে হত্যাকৃত শত্রু সেনার বীভৎস লাশ । একারণে যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা বলেন যে প্রকৃত যোদ্ধার চোখে যুদ্ধ হলো মানব-মনের সবচাইতে পরিত্যাজ্য, অনাকাঙ্ক্ষিত, ভয়াবহ এবং হিংস্র এক বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে প্রকৃত যোদ্ধারা কখনও তাদের ভাগ্যের পরিনতি, কিংবা কখনও দেশপ্রেম বা দায়িত্ববোধের আলোকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেন বাকীটা জীবন।

যুদ্ধ পূজারীরা এখত্রেও অনেক লাকি। তাদের যুদ্ধ বিষয়ক এত্তসব কমপ্লেক্স ফিলিংস নিয়ে বাঁচতে হয়না। প্রকৃত যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা কিংবা শত্রুর হিংসাত্মতার গল্প দাঁত কেলিয়ে, বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে পূজা জমানোতেই ব্যাস্ত থাকেন পূজারীর দল । শুধু মুখে মুখে যুদ্ধের গল্প, কবিতা, কাব্য আউড়িয়ে চেতনার ফেনা তুলে যুদ্ধ-পুজোর মন্ডপে লোকের সমাগম বাড়ানোই থাকে পুজারির মূল লক্ষ্য। মন্ডপে লোক জমানোর বিশ্ব রেকর্ড করতে পারলেতো কথাই নেই।

আমি জানি যুদ্ধ-পুজারীদের ভয়ানক ভিড়ে দেশে এখনও বেঁচে আছেন প্রকৃত যোদ্ধার বংশধরেরা। তাদের অনেকেই হয়তো হাসেছেন যুদ্ধ-পুজোরীর কান্ড দেখে। কেননা তারা জানেন, যদি আবার যুদ্ধ লাগে, এই যুদ্ধ-পূজারীর দল তাদের পূর্ব-সুরীর মতোই পীরের আস্তানায় পালাবে, ধরা দেবে, সুশীল থাকবে, না হয় শত্রু-প্রভুর চাকরিটাই কন্টিনিউ করবে।

আবারও যুদ্ধে যাবে তারাই, যাদের পুর্বসুরীরাও যুদ্ধে গিয়েছিল। কেননা যোদ্ধারা হলো একটা বিশেষ জাতের মানুষ। তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যোদ্ধাই থেকে যায়। যোদ্ধার রক্ত যার গায়ে, তাকে আবারো যোদ্ধা হতে আবৃতির আসর কিংবা কোরাস গানের মচ্ছব বসানো লাগে না।

কোনদিন সেই প্রকৃত যোদ্ধারা আবারও জেগে উঠবেন। সেই প্রত্যাশাতেই আছি। সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

 

মুক্তিযুদ্ধঃ জাতীয়তাবাদী আর সেকিউলার আধিপত্যের সাতকাহনে যেখানে ইতিহাস কারখানায় প্রান্তজনরা বিতাড়িত

খন্দকার রাক্বীব

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিনির্মাণে যে জাতীয়তাবাদী আর সেকিউলার ঢোপ গিলানো হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরী। কেননা, ইতিহাসের লক্ষণ হচ্ছে পরিপ্রেক্ষিতের বিচার। যার শুরু বর্তমান উত্থাপিত প্রশ্নের মীমাংসার সূত্র ধরেই। বর্তমান থেকে অতীতে যাওয়া তখনই, যখন অতীত সম্পর্ক অতীত পরিপ্রেক্ষিত – বর্তমান সম্পর্ক বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতকে ব্যাখ্যা করে। যা নির্মাণ করে ধারাবাহিকতা আর নির্দেশ করে ভবিষ্যতের। তাই বলা চলে, ইতিহাস হলো পরিপ্রেক্ষিতায়ন। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতায়নে ইতিহাসের চেতনা ক্ষমতানিরপেক্ষ বিষয় নয়। কারণ যুগে যুগে ইতিহাসের নির্মাতারা ছিল আধিপত্যবাদী। আধিপত্যবাদীদের তৈয়ার করা ইতিহাস ক্ষমতাধর এলিট শ্রেণীদের ভাবাদর্শিক বৈধতা-ই উৎপাদন করে। প্রান্তিক আর মজলুম মানুষদের অস্তিত্ব, তার চেতনা আর প্রতিরোধ সব-ই মুছে যায় বিদ্ব্যত সমাজের বয়ানে।

images

ইতিহাস চর্চায় এইভাবে আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক সাব-অল্টার্নদের আড়াল করার অপচেষ্টাকে প্রথম নতুন উসুল তথা তত্ত্বের মুখোমুখি দাঁড় করান রণজিৎ গুহ। ভারতবর্ষের ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে তিনি দেখেন এখানকার ইতিহাস বিনির্মাণকালে নিম্নবর্গদের কিভাবে আড়াল করা হয়েছে। ‘on some aspects of the historiography of colonial india’ এবং ‘elemaentary aspects of peasant insurgency in colonial india’ নামক দু’টি গবেষণাকর্মে তিনি দেখান- ভারতবর্ষে আধুনিক ইতিহাসচর্চার শুরু হয় ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন থেকে নয়, বরং ইংরেজ শাসন ব্যবস্থা থেকে। রনজিতের অভিমত, ইংরেজরা পাশ্চাত্য শিক্ষার আদলে আমাদের দিক্ষিত করতে ইতিহাস বিদ্যার আমদানি ঘটায়নি, ভারতবর্ষের ইতিহাস ইংরেজ শাসনের হাতিয়ার হয়েছে আরও আগে। যখন ইংরেজরা দেওয়ানি লাভ করে তখন তারা তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে এখানকার স্থানীয় ভূ-স্বামী আর রাজকর্মচারীদের নিজেদের অনুগত করে ফেলে। ১৮শতকের ব্রিটিশ সমাজের আদর্শ অনুযায়ী, ইংরেজরা বুঝেছিল এখানকার স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী আর ভূস্বামীদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হলেই রাজস্ব আদায় ও প্রশাসন সমস্যা মিটে যায়। যার ফলে স্থানীয় জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের স্বার্থ ও সুবিধা একই সঙ্গে স্বীকৃতি পায় ঔপোনিবেশিক রাষ্ট্রনীতিতে ও ঔপোনিবেশিক ইতিহাসবিদ্যায়। ফলত ‘ঔপোনিবেশিক উচ্চবর্গ’ আর ‘বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী’দের হাত ধরেই রচিত হয় ভারতবর্ষের ইতিহাস। রণজিতের বক্তব্য “এই ইতিহাস বিদ্যার জন্ম ইংরেজ রাজশক্তির ঔরসে এবং ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই তা ঔপোনিবেশিক শাসনকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠে। যারা এই ধারায় প্রথম ইতিহাস লিখেন তারা সরকারের কর্মচারি কিংবা সরকারের মদদপুষ্ট। তারা যে ইতিহাস লিখেন, তার উদ্দেশ্য হয় সরকারি শাসন ব্যবস্থাকে সিদ্ধ করা কিংবা বেসরকারি রচনা হলেও তার সাহায্যে ব্রিটিশ প্রভুশক্তি ও প্রভু সংস্কৃতিকে আরও জোরদার করা”। আর এদেরই তৈয়ার করা ইতিহাসে এখানকার দরিদ্র কৃষক, মজলুম সিপাহি আর প্রান্তিক মুসলমানদের খুব হীনভাবে আড়াল করা হয়। তাদের আবেগ, অনুভুতি আর প্রতিরোধের ইতিহাস চাপা পড়ে আধিপত্যবাদিদের ক্ষমতার নীচে।

 

রণজিৎ গুহের এই বয়ানটি উসুল আকারে হাজির করলেই আমরা দেখব, কিভাবে জাতীয়তাবাদী আর সেকিউলার আধিপত্যের সাতকাহনে ইতিহাস কারখানায় প্রান্তজনরা বিতাড়িত হয়েছে। জাতীয়বাদী আর সেকিউলার ঢোপ গিলিয়ে মুন্তাসির মামুন আর শাহরিয়াররা এদেশের মুক্তিযুদ্ধ চর্চার এজেন্ট বনে গেছে, যাদের বয়ানে এখানকার প্রান্তিক মুসলিমরা থাকে অবহেলিত। হাজার হাজার গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক আর উলেমারা অংশগ্রহণ করে এই যুদ্ধে। কিন্তু জামায়াত ইসলামিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর এই প্রতিরোধ সংগ্রামকে আজ একেবারেই লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। সুফিয়া কামালের ‘একাত্তরের ডায়েরি’ কিংবা সংকলিত ‘একাত্তরের চিঠি’গুলো পড়লেই বুঝা যায়, মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে ইসলামের সাম্য আর জালিমের বিরুদ্ধে জেহাদের ডাকে শামিল হয়েছিল। আধিপত্যবাদি সেকিউলার গোষ্ঠী মহান মুক্তিযুদ্ধে ইসলামের এই সাম্য আর ইনসাফের বয়ানকে আড়াল করে মৌলবাদি ইসলামের জুজু দেখিয়ে রাষ্ট্রকে ডি-ইসলামাইজেশন করছে।

 

অনুপস্থিত রেখেছে নারীদের লড়াকু প্রতিরোধকে। মুক্তিযোদ্ধার বদলে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দ দিয়ে আড়াল করা হয়েছে বাঙালি নারীদের প্রতিরোধের ইতিহাসকে। ধর্ষিত নারীদের যুদ্ধ শিশুর কথা বলার সাথে সাথেই এই রাষ্ট্রের জাতির জনক কর্তৃক বলা হল ‘এই সব দূষিত রক্তকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দাও (আমি বীরঙ্গনা বলছি, নীলিমা ইব্রাহিম)।

তথাকথিত জাতীয়তাবাদী বয়ানে রাষ্ট্রকে মাতৃভূমি বানিয়ে রাষ্ট্র আর নারীকে সমান্তরালে নিয়ে আসে। নারীর ইজ্জত মানেই রাষ্ট্রের ইজ্জত! নারী যখন ধর্ষিত হয়, রাষ্ট্রের নাকি তখন ইজ্জতে কালিমা লাগে। এই কালিমা দূর করতে রাষ্ট্র এই ধর্ষিত নারীকে আর জাতীয়তাবাদী সমাজে মেনে নিতে চায়না! বিচিত্র বয়ান আসে তখন।

 

‘মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস’ বয়ানের মাধ্যমে আড়াল করা হয় আদিবাসি সাঁওতাল, গারো আর পাহাড়িদের প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাস। চারু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে চাকমা আর মং রাজার নেতৃত্বে যেভাবে মারমারা যুদ্ধে নেমেছিল, তা আজ ইতিহাসে একরকম উপেক্ষিত। মাঝে মাঝে সামন্তবাদী প্রভুগোষ্ঠী ত্রিদিভ রায়দের উসুল হিসেবে ধরে রাষ্ট্র আদিবাসীদের এই সংগ্রামের বয়ান অন্যদিকে প্রবাহিত করে। সামন্তপ্রভুদের দোষে পুরো নিরীহ জাতিগোষ্ঠীদের রাষ্ট্র ঔপোনিবেশিক কায়দায় উপজাতি বানায়া রাখতে চায়। মানে তাদের কোন জাত নাই…!!

 

আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের বয়ান রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্ন নয়, ঔপোনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক শাসনের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে একটি স্বাধীন রিপাবলিক গঠনের সোচ্চার উচ্চারণ। রুশোর ভাষায় যেটা একটা সামাজিক চুক্তি, এবং যে সামাজিক চুক্তির ভিত্তি হচ্ছে জনগণের সাধারণ ইচ্ছা। স্বাধীন রিপাবলিক হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের এই সাধারণ ইচ্ছাটি সংজ্ঞায়িত হয় কেমন করে?   বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একেবারে গোড়ার গলদটাই হচ্ছে সাধারণের ইচ্ছা ব্যতিরেকে বিশেষের ইচ্ছায় রাজনৈতিক সংস্থা গঠন। আধিপত্যবাদী সেকুলাররাই এই রাষ্ট্রের সাধারণ ইচ্ছাকে সংজ্ঞায়িত করেছে। একটি গণবিপ্লবের পর সমাজে ক্রিয়াশীল গণ সংগঠনগুলোকে বাদ দিয়েই রচিত হয়েছে জনগণের সামাজিক চুক্তির দলিল।, বাংলাদেশের সংবিধান। গন্তন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতিয়তাবাদের লেবেলে এঁটে কেমন করে স্বৈরতন্ত্রী সংবিধান রচনা করা যায়, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের সংবিধান। যেখানে বাঙালি মৌলবাদীরা নিজেদের বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠি বলেনা, কিন্তু অপরকে ঠিক-ই বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। চেপে যেতে চায়, প্রান্তিকদের বয়ান।

raquib_bdf@yahoo.com

 

 

ফাঁসি,পাকিস্তানফোবিয়া ও বাংলাদেশের সঙ্কট

2

রেজাউল করিম রনি

It is crucial to address the issue on these three distinctive levels, which are the exploitation, politicization and institutionalization of Islamophobia at various levels. In the present globalized world, peaceful and harmonious coexistence among diverse religions and cultures is not an option but the only means to enduring human cohabitation. The objective of the protagonists of Islamophobia is none other than to create division between the West and theMuslim World.

[SIXTH OIC OBSERVATORY REPORT ON ISLAMOPHOBIA October 2012 – September 2013]

noose

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে

সাম্প্রতিক সময়ের কূটনৈতিক ঝগড়া এমনভাবে উদাম হয়েছে যে, রাজনীতির ব্যাপারে একদম উদাসীন গৃহবধূরাও জানেন, আমাদের কোনো সংকটের সমাধান দেশের রাজনীতিবিদদের মর্জির ওপর নির্ভর করে না। মার্কিন ও ভারতের পররাষ্ট্র-লড়াই এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, একে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ প্রশ্নে এক দিকে ভারত অন্যদিকে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব। আর এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বা লক্ষ্য করবার বিষয় হল, এই প্রথম পাকিস্তান সরব ভূমিকায় হাজির হয়েছে। পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ায় এখন পর্যন্ত মার্কিন নীতির সবচেয়ে অনুগত বন্ধু। এই আনুগত্যই ধর্মযুদ্ধের সম্ভাবনাকে পাঁকিয়ে তুলতে সাহায্য করবে। কিভাবে সেটা ঘটবে আমরা জানি না। আমরা কেবল কয়েকটি লক্ষণ পর্যালোচনা করতে পারি।

ফাঁসির ব্যাপারটা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটা চাপা অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। অপরাধীর বিচার হবে-এটা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ কোনো আপত্তি কখনও করেনি। আপত্তিটা উঠেছে মূলত গণআকাঙ্খার সাথে সরকারের কৌশলী আচরণকে কেন্দ্র করে। বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে শুরু থেকে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আন্দাজ করা যাচ্ছিল। নির্বাচনের সব রকম প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তথাকথিত সাংবিধানিক নিয়মে আওয়ামী লীগ যেভাবে ক্ষমতালিপ্সার নজিরবিহীন রাজনীতি শুরু করেছে, তাতে বিচারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কালিমা এড়াতে পারেনি।

জামায়াত স্বাভাবিকভাবেই এটাকে জুডিশিয়াল কিলিং আখ্যায়িত করে ব্যাপক সহিংসতার পথ ধরে। ফাঁসির পরে সারা দেশে যেন লাশের উৎসব শুরু হয়। সরকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন অংশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে নির্মূলের রাজনীতি বাস্তবায়ন করতে নেমে পড়েছে তা দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। পাল্টা আক্রমণের কৌশল দেখে স্পষ্টতই মানুষ বুঝে গেছে দেশে শুরু হয়েছে গৃহযুদ্ধ। এই অবস্থায় কোনোকিছু নির্বিকারভাবে পর্যালোচনার স্থিতিশীলতাও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। যথারীতি শাহবাগ আগের ভূমিকায় আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু এবারের ফিরে আসাটা আরও ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। এই দিকটি নিয়ে আমরা কিছু কথা বলব আজকে।

বাংলাদেশ কিম্বা বর্তমান বিশ্বের কেউ আর ‘৭১ সালের বাস্তবতায় নেই। কিন্তু তাই বলে ‘৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা যাবে না তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিচার আমরা চাই। বিচার হতে হবে। কিন্তু সেটা বিচারই হতে হবে। কোনো প্রেশার গ্রুপকে সংযুক্ত করে বিচার নিয়ে রাজনীতি হলে সেটা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বেইমানি। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সীমাহীন সম্ভাবনা চিরতরে বিনষ্ট হয়। জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে চলমান রাজনৈতিক ক্ষমতার হিংসার আলোকে। ফলে জাতীয় চেতনার নামে একতরফা জবরদস্তি বা যেটাকে আমরা ফ্যাসিবাদ বলে জানি তা হাজির হয়। এর মধ্যে কোনো ইসলামী দলের নেতাকে ফাঁসি দিয়ে চেতনার জোয়ার তুলে ক্ষমতার রাজনীতি যে বিভাজন তৈরি করে তা ধর্মযুদ্ধের পরিবেশ প্রস্তুত করে দেয়। তখন মুখোমুখি দাঁড়ায় ইসলাম ও জাতীয় চেতনা।

কিন্তু এটা এত সরলভাবে ঘটলে আতংকিত হওয়ার মহান কোনো কারণ ছিল না! ব্যাপারটা আমদের নিজেদের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। মার্কিন রাজনীতির ছক অনুযায়ী আমরা যদি ব্যাপারটা খেয়াল করি তাইলে পরস্থিতি যা ইঙ্গিত করে তাতে আঁতকে না উঠে উপায় নাই।

আমরা দেখেছি, ওয়ার অন টেররের প্রজেক্টে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন ইন্টারভেনশন হয় ইসলামপন্থি জাতীয়তাবাদীদের কাজে লাগিয়ে। সরকারের ফ্যাসিবাদি আচরণের কারণে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার রাজনীতি করা একটি দলকে নির্মূল করবার কারণে সমাজে একটা বদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধী দলকে তুরুপের তাসের মত উড়িয়ে দিচ্ছে লীগ সরকার। এই জবরদস্তিতে কৌশলে সেনাবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সৈনিক মর্যাদার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই সতর্ক। কিন্তু এখকার সেনাবাহিনীর পুলিশি ভুমিকা সেনার ইজ্জতের দিক থেকে যেমন হুমকি, তেমনি জনমানুষ এই সেনাকে সরকারের খেয়ালখুশির পুতুল বলে মনে করবে। দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর এই ভূমিকায় আহত বোধ করবে সন্দেহ নাই।

এই অবস্থায় পাল্টা প্রতিরোধ যেটা গড়ে উঠবে বা যারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়াইয়ে শামিল হবে সেটা কোনো না কোনো ভাবে ইসলামী শক্তি। তার নাম যাই হোক তার সাথে ইসলামের কোনো না কোনো যোগ আছে। এই ধারার ইসলামী আন্দোলন যেন মার্কিন আধিপত্যকে কোনোভাবেই হাল্কা করতে না পারে তার জন্য ৯/১১-এর পরে আমেরিকা একটা প্রকল্প চালু করে এর নাম ‘র‍্যান্ড’ প্রজেক্ট। এতে সালাফিস্ট ধারাকে উৎসাহিত করা হলেও মূলত প্রাধান্য দেয়া হয় পশ্চিমা ধাচের গণতন্ত্র মেনে যেন মুসলিম দেশগুলো একটা আধুনিকতাবাদি পুঁজিবাদের অনুকূলে রাষ্ট্রকাঠামো দাঁড় করাতে পারে।

সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন এনজিওগুলোকে ব্যাপক তহবিল সবারহ করা হয়। এর টেস্ট কেইস আকারে ঘটানো হয় আরব স্প্রিং। বলাই বাহুল্য এই  ‘র‍্যান্ড’ প্রকল্প ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। আরব স্প্রিং আধুনিকতাবাদি পথ ধরে মুসলিম দেশগুলোকে পরিচালনার কাজে হাত না নিয়ে সেখানে বরং বিভিন্ন জেহাদি গ্রুপ শক্তিশালী ভিত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এটা উল্টা ফল ফলেছে।

শুরুতে অনেকে শাহবাগকে ‘র‍্যান্ড’ প্রজেক্টের সাথে যুক্ত বলে অনুমান করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতেই পরিষ্কার হল, এই অনুমানের কোন ভিত্তি নাই। বরং গেইমটা উল্টা দিক থেকে দেখা যেতে পারে। শাহবাগ না এখন বিবেচনায় চলে আসবে শাপলা। অবশ্যই অগ্রভাগে থাকবে জামায়াত। যদিও আমরা জানি, জামায়াত আর হেফাজত এক না। কিন্তু আদর্শের দ্বন্দ্ব আর লড়াইয়ের মাঠ এক না -এটাও আমরা জানি। কিন্তু কোনো মার্কিন ছক হুবহু কাজে আসবে না তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি। কারণ অলরেডি জিহাদি সংগঠন তালেবান গণজাগরণকে থ্রেট করে বসেছে। সাম্প্রতিক এক ভিডিও ভাষণে আলকায়েদা প্রধান আইমান আল জাওয়াহিরী বাংলাদেশ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এই ঘটনা অবশ্যই অতি গুরুত্বের সাথে আমাদের আমলে নিতে হবে। তিনি সেখানে বলছেন, “বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেখানে সরকার আলেমদের শহীদ করছে, তাদেরকে জেলে বন্দী করে রাখছে, নবী করিমকে (সা.) নিয়ে কটুক্তিকারীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, হাজার হাজার সাধারণ মুসলমানদেরকে শহীদ করা হচ্ছে।’’ [http://www.youtube.com/watch?v=2CryRD4OTb8]

ফলে  ‘র‍্যান্ড’ প্রজেক্ট এর মতো কোনোকিছু বাংলাদেশে করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবে এই বিষয়ে আগাম কথা বলার কিছু নাই। মাঠের লড়াই তো আর সবসময় বইয়ে ত্তত্ব মেনে হয় না। গ্র্যান্ড ডিজাইনের সাথে পরিচয় থাকাটাই আমাদের জন্য প্রাথমিক কাজ। এই প্রজেক্ট যে কোনো কাজে আসবে না তা আল-জাজিরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইউসুফ আল কারযাভী পরিষ্কারভাবে বলে দেন, “আমেরিকা তার সুবিধার জন্য একটা ইসলাম চায়। কিন্তু সেটা আর ইসলাম হবে না। সেটা হবে আমেরিকান ইসলাম।”

তিনি আরও বলেন, চরমপন্থা ৯/১১-র ঘটনার আগে থেকেই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। চরমপন্থীরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। শুধু মুসলমানদের মধ্যে চরমপন্থা আছে, এটা মোটেও ঠিক নয়। চরমপন্থীরা ইহুদীদের মধ্যেও আছে। চরমপন্থীরা রবিনকে হত্যা করেছে। চরমপন্থার আরো বড় বড় উদাহরণ রয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা দুর্ঘটনা। ব্রিটেন, জাপান, ভারতসহ দেশে দেশে চরমপন্থীরা রয়েছে। তাহলে কেন মূলত ইসলামের সাথে চরমপন্থা ও সহিংসতার অপবাদ জুড়ে দেয়া হচ্ছে? এটি ভয়াবহ অবিচার” [আল-কারযাভী: আল-জাজিরা,বিন কিন্নাহ-এর সাথে আলাপ]

সেই দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশের ব্যাপারে একটা নীতিগত অবস্থান আমেরিকার আছে। এটা বোঝা যায়, জামায়াতের সাথে তাঁদের সম্পর্কের ধরণ দেখলে। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের উত্থান এই সম্পর্কের ধরণে নতুন ডাইমেনশান তৈরি করেছে। ফলে বাংলাদেশের ইসলাম যখন রাজনৈতিক ময়দানে হাজির এবং গৃহযুদ্ধের অবস্থা বিরাজ করছে, এই অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদের নীতি আমাদের ছেড়ে দিবে না তা হলফ করে বলতে পারি।

ইতিমধ্যে ২৫ নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পর থেকে ১১৫ জন নিহত হয়েছে। এদের বেশিরভাগ জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। অন্যদিকে বাংলাদেশে ইসলামের কোনো ধরণের জাগরণ হলে এর প্রভাব পড়বে গোটা বিশ্ব-ব্যবস্থায়। সবচেয়ে হুমকিতে পড়বে ভারত। আমেরিকা ৯/১১ এর পরে মুসলমানদের ব্যাপারে কোনো একতরফা বিবেচনা আর বজায় রাখেনি। ইসলামের সেকুলার ধারাকে ক্ষমতার রাজনীতে সে বরাবরই উৎসাহিত করে আসছে। এখন কী ভুমিকা নেবে তা দেখবার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে, বলা যায় দুইটা অপশন সামনে আছে, এক.হাসিনাকে যে কোন মূল্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা এবং বিএনপি-জামায়াত জোটকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। ২. শেখ হাসিনা যদি নির্মূলের পথ থেকে সরে না আসে তাহলে যে ইসলামী জাগরণের সৃষ্টি হবে তার সুযোগে ওয়ার আন টেররের প্রকল্পের আদলে বাংলাদেশে মার্কিন খবরদারি বৈধ করা। প্রথম সমাধানের দিকে এখনও পশ্চিমা দেশগুলো বেশি মনযোগী।

আর দ্বিতীয় ধাপটি চূড়ান্ত অ্যাকশন হিসেবে বিবেচনায় আসবে। কিন্তু কোনোভাবেই ভারতের হাতে দক্ষিণ এশিয়ার খবরদারি দেয়া যাবে না। ভারতের ব্যাপারে কঠোর মার্কিন মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেবযানীকে উলঙ্গ (স্টিভ সার্চ) করা নিয়ে ভারতের প্রতিবাদের প্রতি ভ্রক্ষেপ করেনি আমেরিকা। ভারতের সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়েছে। মার্কিনীদের এই কঠোর অবস্থান অনেককে অবাক করেছে। কিন্তু তাঁদের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে বিষয়টাকে আর অস্বাভাবিক মনে হবে না। বিখ্যাত মার্কিন পররাষ্ট্র ব্যাক্তিত্ব হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর সুবিদিত ডিপ্লোমেসি বইতে বলেন, “Almost as if according to some natural law, in every centuty there seems to emerge a country with the power, the will, and the intellectual and moral impetus to shape the entire international sestem in accordance with its own values.”

[The New world Order, DIPLOMACY; Henry Kissinger: SIMON&SCHUSTER PAPERBACKS, NEWYORK edition]

এই শতাব্দী মার্কিন আধিপত্যের শতাব্দী এটা তাঁরা প্রাকৃতিক নিয়মের মতোই মনে করে। বলাই বাহুল্য এই শিক্ষা ইউরোসেন্ট্রিক শিক্ষা। পরে কিসিঞ্জার ইউরোপের অন্য দেশগুলোর আধিপত্যের ফিরিস্তি হাজির করে এখনকার মার্কিন আধিপত্য যে গোটা বিশ্বব্যবস্থার জন্য খুব স্বাভাবিক -এই আলোচনা করেন। এই সাম্রাজ্যিক বাসনার দিকে যদি আমরা খেয়াল রাখি তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব আগামী দিনে আমাদের সামনে যে লড়াই হাজির হচ্ছে তাতে মার্কিন হস্তক্ষেপ অবধারিত। এই লড়াইয়ে আমরা কী করব তাই দেখবার বিষয়। আরামপ্রিয় দ্বি-দলীয় ক্ষমতা বৃত্তের বাইরে এই প্রথম বাংলাদেশে নয়া বাস্তবতা বড়ই অসময়ে হাজির হচ্ছে।

ফলে এই জাতীয় প্রতিরোধ ইসলামের চেহারা যেমন নিবে, এর সাথে দুনিয়ার অন্য ইসলামী লড়াকু শক্তিও শামিল হবে। এটাকে থামাতে এবার পরাশক্তির হস্তক্ষেপের পথে আর কোনো বাঁধা থাকবে না। ফলে যতই মনে হোক জামায়াতের পক্ষে আমেরিকা আছে, বিএনপির পক্ষেও আছে। খোলা চোখে যতই মনে হোক এক ভারত ছাড়া আর সবাই তাদের পক্ষে আছে, ব্যাপারটা তেমন সরল না। মার্কিন আধিপত্য কোনো সুযোগকে হাতছাড়া করবে -এমনটা মনে করার কোন কারণ নাই। এটা আমি বলছি ইতিহাসের শিক্ষা থেকে। বাংলাদেশে হুবহু একই ঘটনা ঘটবে তা বলছি না। প্রত্যেক ঘটনার কিছু সৃষ্টিশীল ডাইমেনশান থাকে, যা আগাম বলে দেবার কিছু নাই। তারপরেও এখনকার ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করলে আমরা বিষয়গুলো পরিষ্কার ধরতে পারব।

ফাঁসি ও জাতীয় চেতনার ফাঁদ

একটা ছোট চায়ের দোকান। ১২.১২.১৩ ইং, রাত ১১টায় টিভিতে ইমরান এইচ সরকার কথা বলছিলেন নিউজ বাইটে। ফাঁসির খবরে তখন শাহবাগ আনন্দে ভাসছে। সেই আনন্দে দোকানের কিছু লোকও দেখলাম হাসতেছে। হঠাৎ দোকানদার বলতেছে- ‘হালারা কেমুন, জিন্দা একটা মানুষ মইরা গেল আর হালারা নিটকাইতেছে কেলাই দিয়া খবর দেখতাচে’ একটু আগেও মানুষটা জীবীত ছিল।‘ অবাক হইলাম, সে যে রাজাকার ছিল তা তো দোকানদার একবার বলতেছে না । এটা তো তার মনে আইল না। কেন? সমস্যা কী?

আর রাতে ফেসবুক-ব্লগে আনন্দ আর বেদনার পাল্টাপাল্টি জোয়ার ছিল। আর যারা একাত্তরকে ক্রিটিক্যালি দেখেন সেই সব মানুষের মধ্যে এক চাপা অস্বস্তি বিরাজ করছিল। জামায়াত কাদের মোল্লাকে সাইয়েদ কুতব অব বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে ফাঁসির সাথে সাথে। তাঁরে ইসলামের জন্য শহীদ ঘোষণা করেছে। সেই মোতাবেক পরদিন জুমার নামাজের পর ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যাপক সহিংসতা ঘটায় দলটির বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মিরা। এই আগুন ছড়িয়ে পরে সারা দেশে, শুরু হয় পাল্টাপাল্টি খুনাখুনি। খবরের কাগজ লাশের খবরে ভরে ওঠে।

অবাক হয়ে খেয়াল করি, কাদের মোল্লার ফাঁসি জনসমাজে একটা ভুতুড়ে অবস্থা তৈরি করেছে। সাধারণ পাবলিক প্রশ্ন করছে, আচ্ছা লোকটা না অপরাধী ছিল তাইলে তাঁর জন্য যে আবার আন্দোলন হচ্ছে? সে নাকি চিঠি দিয়ে কইছে কসাই কাদের আর সে এক না। মরার আগে মানুষ তো আর মশকারি করে না?

আমরা যদি এই জনমনোভাবকে বুঝবার চেষ্টা করি, তাইলে অনেকগুলো বিষয় বুঝতে সুবিধা হবে। এক. ৭১ এর ন্যারেশন কি আদতেই একটা মধ্যবিত্ত ন্যারেশনে পরিণত হয় নাই এত দিনে? কারণ কসাই ইমেজ তো মধ্যবিত্তের বাইরে খুব বেশি কমিউনিকেটিভ হচ্ছে না। দুই. এই চেতনার প্রতি তো সরকারের অবস্থানের কারণেই মানুষের আর আস্থা নাই। এই অবস্থায় শাহবাগ যদি প্রবল প্রতাপ গড়ে তুলতে না পারে তাইলে তো সরকার বিপদে পড়ে যাবে। তাই শাহবাগ আছে সরব ভুমিকায়।

স্কাইপে কেলেংকারি আর বিচারপতিদের খামখেয়ালি তো মানুষ জানে। আদালতের প্রতি কোন সুস্থ মানুষের তো আস্থা নাই। ফলে দুর্বল জাতীয়তাবাদী চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে এই ধরণের একটা ফাঁসি আওয়ামী লীগের জন্য অনেক ঝুঁকির হয়েছে সন্দেহ নাই। এখন একাত্তরের ন্যারেশনকে খুব শক্তিশালীভাবে হাজির করতে হবে। কোনো গাফিলতি করা চলবে না।

এই হাজিরা বলাই বাহুল্য, একাত্তরের আকাঙ্খা মেটাতে পারবে না। এটা কাজ করবে সাংবিধানিক ফ্যাসিজম কায়েম করতে। এইটা বিনা মুশকিলে হলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু ঝামেলা হয়ে গেছে, জামায়াত কাদের মোল্লাকে ইসলামের জন্য শহীদ ঘোষণা করে ফেলেছে। মোল্লাও বলে গেছেন তাঁর রক্তের বিনিময়ে যেন ইসলাম কায়েম করা হয়। ফলে ইসলামের ন্যারেশনের সাথে ‘৭১ এর আওয়ামী ন্যারেশনের লড়াই শুরু হয়ে গেল। জামায়াতের ইসলাম একমাত্র ইসলাম না, এটা আমরা সবাই জানি। জামায়াতের বাইরেই আছে ইসলামের মূল ধারা। কিন্তু জামায়াত ইসলামের নামে রাস্তায় যখন মার খাবে, তখন ধর্মযুদ্ধ শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।

লীগের বা বামদের ইসলামকে পশ্চাৎপদ মনে করার যে কালচারাল এটিচুড তা মানুষ এতদিনে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ফেলেছে। ফলে এই অবস্থার মধ্যে লড়াইয়ে কালচারাল শক্তিটা যে প্রতিরোধের মুখে পড়বে তা এখনও আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। যারা এখনও রাজাকারী ডিসকোর্স নিয়ে আছে, এটা তাদের বুঝবার কথাও না। রাজনীতি বহু আগেই রাজাকারের পরিমণ্ডল পার করে ফেলেছে।

ক্ষমতার ব্যবহারিক বা এখনকার বাস্তব প্রশ্নটাই মানুষ আগে বিচার করছে। শুধু বুদ্ধিজীবিরা স্মৃতি কাতর হয়ে আছেন এখনও। ফলে মানুষের মনে ফাঁসিকে কেন্দ্র করে ‘৭১-এর মতোই অস্বস্তি আবার ফিরে আসল। এতে সরকারের পক্ষে লোক থাকবে না বা সরকার ভ্যানিশ হয়ে যাবে -এটা মনে করার কোন কারণ নাই। আমি শুধু বলছি, এই গুমট মনোভাবের মধ্যে ভায়োলেন্সের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়ে আছে তা নতুন রাজনীতি দিতে না পারলেও (নতুন রাজনীতির তো এজেন্সি হাজির নাই -এটাই সঙ্কট) এই প্রথম, সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্নে বাংলাদেশে রক্তারক্তি হতে যাচ্ছে।

আর এতে নানা কারণে ইসলাম ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ মুখোমুখি দাঁড়ানো। এই অবস্থায় কূটনৈতিক বুঝের সমাধান যে কোন কাজে আসছে না তা আমরা ধারাবাহিক ভাবে দেখছি। পিল্লাই সতর্ক করেছেন, তারানকো ব্যার্থ হয়ে ফিরে গেছেন। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সবাই চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে বাংলাদেশের ব্যাপারে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে বাংলাদেশ এখন গৃহযুদ্ধ কবলিত এমন খবরই ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। এই অবস্থা আমাদের কোনো শুভ পরিণতির দিকে যে নিয়ে যাচ্ছে না তা পরিষ্কার বুঝা যায়।

এর কারণ হল, ৭১ এর চেতনাকে আমরা গণবিচ্ছিন্ন ক্ষমতার কাজে ব্যবহার করেছি। এই চেতনার প্রকৃত অর্থে কোন সামাজিকীকরণ করিনি। বরং উপনিবেশি সাংস্কৃতিক ও জীবনদৃষ্টি উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে এমন একটা ভাব পয়দা করেছে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ভোগবাদী জীবনচর্চা মিশে একাকার হয়ে গেছে। এর সাথে আধুনিকতার উগ্র ইসলাম বিদ্বেষ যুক্ত হয়ে প্রগতিশীলতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে ইসলামকে। এই একরোখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখন মরণ ফাঁদ হয়ে নেমে আসছে। মোহনায় দাঁড়িয়ে উৎসের দিকে ফিরে তাকাতে হয়-এটা আমরা স্বাধীনতার বেয়াল্লিশ বছরেও করিনি।

ইতিহাসকে দলীয় ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করে বিভাজন জিয়িয়ে রেখেছি। বিভাজনটা সমাজে পরিষ্কার হয়ে গেছে। শাহবাগ আর শাপলা। শাপলার ভাগে আছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ যারা সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তথাকথিত মূলধারার চেতনার চেয়ে পিছিয়ে আছে। তাদের আমরা সমাজের বাইরে আলাদা রেখে নিজেরা একতরফা চেতনার অনুসারী হয়ে আধুনিকতার জীবনদৃষ্টিকে কবুল করে নিয়েছি। ওদের বলেছি মধ্যযুগীয়, বর্বর পশ্চাৎপদ। কারণ তিনারা আজও ধর্মতত্বের আদর্শকে জীবনের মূল আদর্শ মনে করে। আমরা ইসলামের সাথে বাংলার সামজিক বিকাশের সম্পর্কের আলোকে নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে গড়ে উঠিনি। অতি ক্ষুদ্র শ্রেণীস্বার্থে ব্যবহার করেছি ‘৭১-এর চেতনাকে। মুক্তিযুদ্ধের তাবত অবদানকে স্বাধীনতার পরপরই কুক্ষিগত করেছি নিজ নিজ স্বার্থে। স্বাধীনতার সামাজিকীকরণ হয় নাই বাংলাদেশে। তাই সবার অংশ গ্রহণে ‘৭১ হলেও শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা হয়ে উঠেছে এলিটিস্ট মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা গণচেতনা করে তুলতে পারিনি। কেন পারিনি তার হদিস খুব কঠিন কিছু না। নানা কারণের একটা হল সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছি শুরু থেকেই।


পাকিস্তানফোবিয়া

পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে আর্ন্তজাতিক মনযোগের কেন্দ্রে আছে গত কয়েক দশক ধরেই। সেনাবাহিনীর সাথে পাকিস্তানের জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে অনেক বড় বড় গবেষণা হয়েছে। পাকিস্তানের বিভিন্ন গোত্র ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে আলাদা আলাদা ডাইমেনশান নিয়ে হাজির আছে। পশতুন জাতীয়তাবাদের প্রভাবের কারণে আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক শুধুমাত্র কৌশলগত নয়। আমরা দেখেছি, পাকিস্তান একই সাথে আলকায়েদা, তালেবান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক বজায় রেখে নিজের তৎপরতা জারি রেখেছে ওয়ার অন টেরর প্রকল্পে। বিশ্বরাজনীতিতে পাকিস্তানের এখনকার ভূমিকা গ্লোবাল রাজনীতিতে অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়।

আমরা একাত্তরে যে ঘাতক সামরিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। সেই পাকিস্তান আর আগের জায়গায় স্থির নেই। কিন্তু আমরা পাকিস্তানের জান্তা নিপীড়নের প্রতি যে ঘৃণা ধরে রেখেছি তা গোটা পাকিস্তান সম্পর্কে আমাদের চিন্তাকে বর্ণবাদি ক্ষুদ্র জায়গায় আটকে রেখেছে। চলমান বিশ্ব রাজনীতিতে পাকিস্তান এর ভূমিকাকে র্নিমোহভাবে দেখবার কোনো গরজ আমরা অনুভব করি না। এটা আমাদের জন্য খুবই অনুতাপের বিষয়।

এবারের ওআইসি সম্মেলনে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে একটা রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামোফোবিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিকভাবে এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যে, পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ইসলামের বিভক্তিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর এই কাজের জন্য যে ভুমিকে পশ্চিমারা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে তার নাম ‘পাকিস্তান’ / ফলে আামাদের এখানে পাকিস্তানফোবিয়া আর ইসালোমোফোবিয়া একই অর্থ বহন করে। আর এটাকে উস্কে দেবার জন্য আছে অতীত পৈশাচিক শাসকদের প্রতি ঘৃণাকে পাকিস্তানের নামে ছড়িয়ে দেয়ার কূট-রাজনীতি। পাকিস্তান নিয়া এখানে আলাপের অবসর নাই। আমি কয়েকটা পয়েন্টে বাংলাদেশে পাকিস্তান -সম্পর্কে দৃষ্টি ভঙ্গি ও সাম্প্রতিক পারিপার্শিকতা তুলে ধরব মাত্র।

এক. পাকিস্তান সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল শ্রেণী ঘৃণার। ৯/১১ -এর পরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে ইসলামোফোবিয়া। এখন পাকিস্তানফোবিয়ার দুই মৌল উপাদান হল : ১. একাত্তরের শাসকদের প্রতি ঘৃণা থেকে উৎসারিত ঘৃণা। পাকিস্তান মানেই বর্বর, অসভ্য, ধর্ষক ইত্যাদি রটনার রাজনীতি। ২. পাকিস্তান আধুনিক গণতন্ত্রের পথে কোনো সফলতা হাসিল করতে পারেনি। এটা তালেবানের ঘাঁটি। এরা আলকায়দার মদদদাতা। লাদেনকে এরা পালে। এরা জঙ্গি। এদের কোনো ভবিষ্যৎ নাই। ওরা নিকৃষ্ট।

এই দুইটা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে প্রচারণার প্রভাব ছাড়া আর কিছু নাই। একাট্টা পাকিস্তান বলে কিছু নাই। সেখানে নানা শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত আছে। ইসলাম প্রশ্নেও সমাজিক ও রাজনৈতিক নানা ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি আছে। কিন্তু সমাজে ইসলামের একটা প্রভাব সেখানে বরাবরই ছিল। এবং এখনও আছে। যা হোক শাসক শ্রেণী আর পাকিস্তানের জনগণ এক না। এটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। একাত্তরে পাকিস্তান সরকারের ভুমিকা আজকের সরকারের মতই ছিল। পাকিস্তান কী করেছে তা বুঝার জন্য একাত্তরে জন্ম নেবার দরকার নাই। লীগ ও যৌথবাহিনী এখন যা করছে পাকিস্তান ও তাদের অনুসারীরা একই কাজ করেছে। তবে তখন কিছু কিছু কাজের লক্ষ্য ছিল মানুষকে বাঁচানো। এখন একমাত্র লক্ষ্য হল মারা। হিংসার আগুনে জ্বলছে জনপদ।

দুই. ‘৭১-এ যাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই ছিল সেই পাকিস্তানি শাসক আর এখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্র এক জিনিস নয়। এখনকার পাকিস্তান বিশ্ব-রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমি বলি, আমেরিকা যদি হয় সন্ত্রাসের আব্বা, তাহলে পাকিস্তান তার পালক পিতা। ওয়ার অন টেরর প্রজেক্টে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এবং এই অংশীদারি গোলামীর মত নয়। সে মাঝে মাঝেই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড শো করছে। যেটা আমলে নেবার মত বিষয়। ( এই প্রজেক্টে- র, সিআইএ, আইএসআই, গলায় গলায় ভাব বজায় রেখে বাংলাদেশে ফাংশন করেছে, এখন এজেন্সিগুলা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ভারতের একতরফা জবরদস্তির কারণে এটা ঘটছে। অলরেডি ভারত-আমেরিকা কূটনৈতিকভাবে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। নারী কূটনীতিক দেবযানিকে স্ট্রিপ সার্চ করে আমেরিকাই প্রচার করিয়েছে যে, ন্যাংটা করে তল্লাশি করা হয়েছে। আর ইন্ডিয়া তো আত্নপীড়ায় ভুগছে। পাল্টা পদক্ষেপও নেয়ার হুমকি দিয়েছে। আমাদের মিডিয়াও বেশ রসিয়ে এই খবর প্রচার করছে। এতে কূটনেতিকভাবে আমরিকা যে মেসেজ দিছে তার সরল মানে হল, ‘তুমি মাতবরি করলে ন্যাংটা কইরা ছাইড়া দিব’ যাহোক কূটনৈতিক লড়াইয়ে অনেক প্রতীকী ব্যাপার থাকে যার গুরুত্ব অপরিসীম। এখানেও তাই হইছে। আর দেবযানী আজ যে প্রতীকী অপমানের শিকার হয়েছেন তার জন্য বাংলাদেশ নিয়ে আমরিকার সাথে সুজাতার বেয়াদবী দায়ি -এটা ভারতের কূটনীতি বিশ্লেষকরা স্বীকার করেছেন। সূত্র: বিডিনিউজ)

তিন. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বেহুদা পাকিস্তানফোবিয়া ছড়ানো হয়েছে। পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষের সাথে আমাদের শত্রুতা থাকতে পারে না। হাসিনাও শাসক, ইয়াহিয়াও শাসক। ‘৭১ কইরা আমরা কী করলাম? বিদেশি লোক বাদ দিয়া দেশি বোনের অত্যাচার মেনে নিচ্ছি -এখন এই তো অবস্থা।

চার. যে প্রজন্ম আজ লীগের কূটনৈতিক গেইম না বুঝে পাকিস্তান বিদ্বেষ ছড়ানোকে চেতনার দায়িত্ব আকারে নিয়েছে, তাদের বলি পাকিস্তান কি চিজ তা যদি বুঝতা তাইলে আর এই আরামের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করতা না। পাকিস্তানকে জড়ানোর কূটনৈতিক তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। তার পুরোটা এখনই আমরা বলতে পারব না। তবে যে লক্ষণ হাজির হয়েছে তা ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে তা বুঝতে কাজে লাগে। এর মধ্য দিয়ে তালেবানের ইন্টারভেনশন নিশ্চিত হয়ে পড়ল। তালেবান হুমকি দিয়েছে গণজাগরণ বন্ধ না করলে পাকিস্তানে বাংলাদেশের দূতাবাস উড়িয়ে দেয়া হবে [সূত্র: পরির্বতন ডটকম]

যুদ্ধটা জাতীয় চেতনা বনাম ইসলামী চেতনার দিকে যাচ্ছে। এর সাথে বিদেশি অস্ত্রধারী সংগঠন যোগ হলে ঘটনা কোথায় যাবে তা আপনাদের অনুমান করতে পারার কথা। তালেবান যখন একে-৪৭ ধরে বলবে, ”গাওতো চেতনার গান”/ রবীন্দ্র সঙ্গীত কি আমাদের রক্ষা করতে পারবে? ফলে সাংস্কৃতিক ঘৃণার পার্ট আকারে যারা পাকিস্তান মানেই বর্বর আর খারাপ এই রকম রেসিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি পালন করেন তাদের বলব, পশ্চিমা একাডেমিতে গিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন। পাকিস্তান একবাল আহমেদের মত দুনিয়া কাঁপানো তাত্ত্বিকদের জন্ম দিতে পারে, ইংরেজি সাহিত্যে হাল আমলের অনেক শক্তিশালী লেখক পাকিস্তানের জঙ্গিদশার মধ্যেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেখানে বাংলাদেশ তো এখনও অনেক নবিশ।

আমি তুলনামূলক আলোচনার জন্য কথাটা বলিনি। বা এইগুলো করতে পারলেই জাতি মহান হয়ে যাবে, আমি তাও মনে করি না। যাস্ট অমূলক ঘৃণার চেতনাটা দেখাতে কথাটা বলা। এবং যারা পাকিস্তানকে ঘৃণা করেন, কিন্তু নিজেরা আবার পশ্চিমা দুনিয়ায় আসন পেতে চান, পাকিস্তান তাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে আছে। এটা কেমনে সম্ভব হল বিবেচনা করবার বিষয় বটে।

পাঁচ. ক্ষমতার রাজনীতির দিক থেকে এখনকার এই কূটনীতিক গেইমের মর্ম হল, ইউএস লবিকে বুঝানো যে, যেই পাকিস্তান এত দিন র, সিআইএ’র সাথে একইতালে বাংলাদেশে কাজ করেছে তাকে তো আমি কিছু বলি নাই। এখন দেশে চেতনার জোয়ার চলছে। জনগণ ক্ষ্যাপা। আমি অসহায়। প্রতিদিন গণজাগরণের সমাবেশে ক্রমাগত লাঠিপেটা করেও তো থামানো যাচ্ছে না। দেশে তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জোয়ার। আমি কী করব?

মানুষ আমারে চায়… দেখ দেখ দূতাবাস পর্যন্ত পাবলিক খায়া ফেলতে চাইতেছে। আমি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। -সরকারের ওপর ক্রমাগত বিদেশি চাপকে পাশকাটানোর জন্য এই গেইম সরকারের দিকে থেকে ভাল। আমি এর প্রশংসা করি। এতে লাভ দুইটা। ১. পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণাটা উস্কে দেয়া চেতনার ফ্যান্টাসিটা আবার ছড়ানো। ২.আন্তর্জাতিক মহলকে নিজের পিপল বেইস যে মজবুত তা জানান দেয়া।

বলাই বাহুল্য, এই দুইটাই ফ্যাসিবাদের দামি কৌশল। ক্লাসিক কৌশল। কিন্তু ফ্যাসিবাদের জন্য যে ন্যাশনাল ভিত লাগে তা বাংলাদেশের নাই। বাংলাদেশের এই ফেনোমেনাকে আমি বরাবরই কালচারাল ফ্যাসিজম বলেছি। এই কালচারাল ফ্যাসিজম সাম্রাজ্যবাদি রাজনীতির কৌশলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে অক্ষম। ফলে এই একরোখা গণবিচ্ছিন্ন ক্ষমতার জেদ শেষ পর্যন্ত বুশের ধর্মযুদ্ধকে দেশে ডেকে আনবে, এতে কোন সন্দেহ নাই। মজার ব্যাপার হল, গণজাগরণের কর্মিদের সরকারী এসাইনমেন্টে হেনস্থা করা হচ্ছে। গণজাগরণের কর্মি জাগরণকন্যা লাকী বলছিলেন, পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে নাস্তিকের বাচ্চা, মালাউনের বাচ্চা বলে গালি দিতে দিতে। এই ঘৃণার আগুণ এখন সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। হাসিনা কোনোভাবেই এই অবস্থায় জনগণের কাম্য নেতা হতে পারেন না।

ছয়. পাকিস্তানের প্রতি বর্ণবাদি আচরণের কোন মানে হয় না। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা পাকিস্তানকে একটা দানব আকারে হাজির করছেন তাদের বলা দরকার, এটা ‘৭১ সাল না। এখন পাকিস্তান অনেক কমপ্লেক্স গেইমে নিজেরে শামিল রাখছে। রিজিওনাল গেইমে পাকিস্তানরে কোনোদিন হম্বিতম্বি করতে দেখবেন না। কিন্তু সে আছে, তার ভুমিকা সমেত আছে। আইএসআই আর সিআইএর দোস্তি তো সুবিদিত। এখন কাদের মোল্লার ব্যাপারে অন্য দেশগুলা যা করছে, পাকিস্তান তাঁর চেয়ে বেশি কিছু করেছে বলে মনে হয় না।

তুরষ্ক বাংলাদেশের সরকারকে দ্বিতীয় ইসরায়েল বলেছে। কেরিও ক্ষেপছেন। তাহলে পাকিস্তানের দোষটা এত বেশি কেন হইছে? কারণ এই তথাকথিত প্রজন্মকে তো পাকিস্তান আক্রমণের স্বাদ দেয়া যাবে না। তাই দূতাবাসমুখি ক্ষিপ্র গমনের মধ্যে একটা যুদ্ধের স্বাদ দেয়া। এটা নগদ লাভ। কিন্তু সাম্রজ্যবাদী চাল তো নগদ লাভে চলে না। তার পরিকল্পনা সুদূর প্রসারী। ‘১৪ সাল এর পরে আফগানিস্তান মিশন শেষ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন উপস্থিতির জন্য বাংলাদেশ অতি গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক দিন আগে খবরে প্রকাশ হাতিয়া দ্বীপ এলাকায় যৌথ সামরিক উপস্থিতির জন্য বিশাল ভূমি নির্বাচন করা হয়েছে। এটা নিয়ে পরে আর কোনো ফলোআপ দেখিনি।

সাত. আমরা বলতে চাই, খামাখা পাকিস্তানঘৃণার কোনো কারণ দেখি না। বরং পাকিস্তানের নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শামিল হবার জন্য আমাদের প্রস্তুতি দরকার। জালেম শাসক তা যত মহান চেতনারই হোক, তার বিরুদ্ধে আমি মজলুম জনগোষ্ঠির ঐক্যের পক্ষে। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার।

শ্রেণী ঘৃণা..জাতি ঘৃণা আমাদের অমানুষে পরিণত করে ফেলবে। মানবিক সত্তার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে জাত-পাত শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে নিজেদের চৈতন্যকে বিকশিত করতে না পারলে আগামী দিনের বিপ্লবী লড়াইয়ে বাংলাদেশ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। নিজেদের জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক উত্থানের সাথে এই উদার মানসিকতার চর্চাও অতিজরুরি।

ভারতের এনডিটিভি খবরে জানিয়েছে, ২০১৪ সালের টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বাংলাদেশে আসা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভারত-পাকিস্তান উদ্বোধনী ম্যাচ বাংলাদেশে না হলে ২৫ ভাগ আয় থেকে বঞ্চিত হবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। খেলাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব পুঁজির যে প্রসার, তাতে বাঁধ সাধল রাজনৈতিক কারণে উস্কে দেয়া পাকিস্তান বিদ্বেষ। এর ফলে বাংলাদেশ যে রাজনৈতিক ভাবে জঙ্গি অবস্থায় নিপতিত হয়েছে, বিশ্ব মিডিয়ায় সেই খবর ঘটা করে প্রচার করা হবে। এটা আমাদের ইমেজের জন্য ভয়াবহ সংঙ্কট সন্দেহ নাই।

এখনকার সংকট

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটকে এতদিন যারা হাসিনা খালেদার ক্ষমতার লড়াই আকারে দেখেছেন, তাদের গণধিক্কার দিতে হবে। এই ধারা বিচার-বিশ্লেষণের ঐতিহ্য আমাদের রাজনৈতিক পর্যালোচনার পরিমণ্ডলকে যথেষ্ট সংকীর্ণ করে রেখেছে। আমরা গ্লোবালাইজড কথাটা মুখে বলি বটে কিন্তু এর সাথে আমাদের সম্পর্কের ধরণ ও নিজেদের অবস্থানকে কখনও বিচার করে দেখি না। ফলে বাংলাদেশ কিভাবে বিশ্বরাজনীতির সাথে সম্পর্কিত তার সমগ্র পরিচয়টি আমাদের সামনে ধরা পড়ে না। কিছু মুখস্ত কথাবার্তা শুনেই আমরা কাজ চালিয়ে নেই।

যা হোক সেনাবাহিনী নামবে এই রব অনেক আগেই জারি হয়েছে। সেনা নেমেছে ঘোষণা দিয়েই। খবরে প্রকাশ, ‘নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এবার সশস্ত্র বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্য মোতায়েন করা হবে। এরা ভোটগ্রহণের পরও বেশ কয়েক দিন মাঠে থাকবেন। এ কারণে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত বাজেটও দ্বিগুণ করা হচ্ছে। [প্রথম আলো ২১-১২-২০১৩]

সেনাবাহিনী এখন পুলিশি ভুমিকায় নামল। এতে যে আমাদের দেশের মানুষের কাছে সৈনিকের মর্যাদা আর আগের জায়গায় থাকল না তা আমাদের জন্য অনুতাপের বিষয়। আমাদের সেনাদের সৈনিক মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এ ব্যাপারে গণসচেতনতার খামতি অপরীসীম। এটা নিয়ে আলাদা লিখব।

বাংলাদেশের এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার রিপোর্টিংয়ের ধরণ খুব মনযোগ দিয়ে খেয়াল করবার বিষয়। ফাঁকে বলে নিই, এর আগে এক লেখায় (বিচার নিয়ে রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আর্বিভাব : আমার দেশ) বলেছিলাম, মার্কিন দেশের সাথে জামায়াতের মিত্রতার কৌশলগত দিক খতিয়ে দেখা দরকার। তাঁরা একদিকে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায়, আর অন্যদিকে মানবাধিকারের দাবি তুলে জামায়াতকে উস্কে দিচ্ছে। জে র‍্যাপের সফরের সময়ই ব্যাপারটা আঁচ করা গিয়েছে। এখন এই সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে পশ্চিমা মিডিয়া যে স্টাইলে বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্টিং করছে তা দেখলে পরিষ্কার হবে যে আমি কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা বলছি না।

শাহবাগ উত্থানের পরে প্রথম যে লেখাটি লেখি তার শিরোনাম ছিল-গণহত্যার রাজনীতি ধর্মযুদ্ধে প্রবেশ (চিন্তা ডটকম, ৬ মার্চ ২০১৩)/  তাতে জামায়াতের রাজনীতিকে জঙ্গিবাদি রাজনীতি আকারে হাজির করে নির্মূলের তাৎপর্য ব্যাখ্য করার চেষ্টা করেছিলাম। পরে ঘটনাটা সেই দিকে ধিরে ধিরে বাঁক নিলে বিষয়গুলো আরও পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ক্ষমতাধর সাময়িকী ইকোনোমিস্ট সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে লিখেছে,

“আওয়ামী লীগ জিতবে, তবে বাংলাদেশ হেরে যাবে। ইকোনোমিস্টের অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নিজের শাসনকাল বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেগুলোকে একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক ‘ধাপে ধাপে চলা অভ্যুত্থান’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রধান বিরোধী দল ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে। এ সুযোগে নিশ্চিত জয়ের পথে চলছে শেখ হাসিনার দল। বৈধতার প্রশ্ন এখানে বাহুল্যমাত্র।”

[www.economist.com/news/asia/21591887-ruling-party-will-win-bangladeshs-election-country-will-los]

এই অভ্যুত্থান কে করছে? সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের লাইনে বিএনপি তো নাই। বিএনপি টেবিল রাজনীতির সমাধানে অনেক বেশি আগ্রহী। সাথে চাপ প্রয়োগের জন্য ধারাবাহিক অবরোধ চলছে। গণঅভ্যুত্থান তাইলে কে ঘটাবে? বলাই বাহুল্য, জামায়াত জীবন-মরণ লড়াইয়ে নিপতিত হয়েছে। গ্রামে গ্রামে যেভাবে লীগ-যৌথবাহিনী ও জামায়াত যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে তাতে ‘মর না হয় মারো’ এমন পরিস্থিতি তৈয়ার হয়েছে। দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। সামনে এটা আরও বেগবান হবে নানা ডাইমেনশান তৈয়ার হবে তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। অভ্যুত্থান হবে সেটা গণ না কী তা বলা যাচ্ছে না।

গণঅভ্যুত্থান কল্পনার জিনিস না। তার জন্য সমাজে গণরাজনীতির ভিত মজবুত করতে হয়। এন্টি ইম্পেরিয়াল ও ভারতের আধিপত্যকে যারা সশস্ত্র পদ্ধতিতে মোকাবেলা করতে ভূমিকা রাখতে পারতো সেই সব বিপ্লবী রাজনীতির নেতাকর্মীদের গত বিএনপির সময় ক্রসফায়ার নাটকের মাধ্যমে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। সমূলে তাদের অস্তিত্ব বিনাশ করে দেয়া হয়েছে। এই কাজটি করার ফলে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদের নকশার বাইরে লড়াকু আর কোনো শক্তি সমাজে হাজির রইল না।

অন্যদিকে ইসলামের নামে যারা লড়াই করবে তাদের কারণে ধর্মযুদ্ধ দেশি পরিমন্ডল ছাড়িছে দ্রুতই এটা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হবে।

একই প্রতিবেদনে ইকোনোমিস্ট বলছে, “সংঘাতময় পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, ভারতের মিত্র আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী হিসেবে দেখানোর সম্ভাবনাও তত বাড়ছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতা কুক্ষিগত করাকে সমর্থন করলে তা ভারতের জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। তা হবে ‘অপেক্ষাকৃত উগ্র ও কম সেক্যুলার বাংলাদেশ।” (প্রাগুক্ত; ইকোনোমিস্ট)

এই অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা কোন কাগুজে আশার বালী শোনাতে পারছি না। বাস্তবত এটা সম্ভব না। আমরা দেখেছি, হেফাজতের উত্থানের সময় এখানকার তথাকথিত সুশীলরা বাংলাদেশে মার্কিন হস্তক্ষেপ কামনা করে বড় বড় সেমিনার সিম্পেজিয়াম করেছেন। বিশাল প্রবন্ধ লিখেছেন, ন্যাটোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এই অবস্থায় বাংলাদেশের সংকট ত্রিমূখী রূপ নিয়েছে। একদিকে হাসিনা সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হাস্যকর সব আয়োজন, ২. চেতনার ডামাডোলে বিচারিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে ফাঁসির রাজনীতি। ৩. চলতি গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিযোগিতার গ্রাউন্ড তৈরি করে সব দল মিলে নির্বাচন করে আবার কোন দলকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আনা।

কিন্তু জনঅসন্তোষ যে চরম রূপ নিয়েছে তাতে শান্তিপ্রিয় সমাধানের পথ কঠিন হয়ে গেছে। সরকারী দলের নেতারা ঢাকার বাইরে যেতে পারছেন না। তাদের আচমকা আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। সহিংস অবস্থার চরম বিস্তার ঘটেছে। এর মধ্যে সরকারের তরফে বিরোধীদের দমনের মাত্রাও নানাভাবে বাড়ানোর ঘোষণা আসছে ক্রমাগত। এই অবস্থায়ও শেষের পয়েন্টেই সুশীল প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু । কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যে এমটি হওয়া কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

সবচেয়ে বড় কথা হল এটা বাংলাদেশের জন্য কোন সমাধানও নয়। আমাদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে গড়ে উঠবার জন্য ধর্ম, বিশ্বাস, জাত, শ্রেণী -নির্বিশেষে যে জনঐক্য ত্বরান্বিত করা দরকার সেটাই এখনকার রাজনৈতিক কাজ। পুরানা চালের সাংবিধানিক রাজনীতি বারবার সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্রই বয়ে আনছে। জনগণের মুক্তির আকাঙ্খা কাগজের পৃষ্ঠায় বন্দি করে গণতন্ত্রের নামে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের লুটপাটের রাজনৈতিক বিধান উচ্ছেদ করেই বাংলাদেশ নতুন জন্মের গৌরব নিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারে। তার জন্য চাই জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের আপসহীন ঐক্য। আমরা যদি সর্বময় ঐক্য গড়ে তুলতে না পারি তাইলে জাতীয় আন্দোলনে ইসলামকে সামনে রেখে যারা লড়বেন তাদের ধর্মযুদ্ধের সৈনিক বা জঙ্গি যাই বলুন তাতে কিচ্ছু হেরফের হবে না। নতুন ক্ষমতা কাঠামো তৈরি হবে ধর্মের আশ্রয়েই। ফলে সাংস্কৃতিক ও শ্রেণী ঘৃণার ঘেরাটোপ পার হয়ে আমাদের দ্রুত ঐক্যের পথ খোঁজা ছাড়া উপায় নাই। দেশি-বিদেশী নিপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য মজলুমর ঐক্যের বিকল্প নাই।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

নতুন বাংলাদেশের সন্ধানে… আমিও থাকবো এ কাফেলায়!

1

by Watchdog BD

ঠিক আছে মেনে নিলাম ৭১’এর যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারের দলই আমাদের আসল সমস্যা। চারিদকে রব উঠছে এদের নির্মূল করলেই নাকি দেশের সব সমস্যায় ম্যাজিকেল চেঞ্জ আসবে। আসুন এবার এ সমস্যরা স্থায়ী সমাধানের দিকে চোখ ফেরাই। যুদ্ধাপরাধীদের নির্মুল এখন সময়ের ব্যপার মাত্র। এ নিয়ে নতুন কোন তেনা প্যাচানোর সুযোগ নেই। বাকি রইল রাজাকারের দল। এখানে আমাদের মূখ্যমন্ত্রীর বয়ান আমলে না নিলে দেশদ্রোহির খাতায় নাম লেখাতে হবে। এই যেমন তিনি বলেছিলেন ‘সব রাজাকারই যুদ্ধাপরাধী নয়’…বক্ত্যবের সাথে দ্বিমত করার কারণ দেখিনা। ৭১’সালে আমাদেরর বাড়ির কাজের ছেলে গিয়াস উদ্দিন নাম লিখিয়েছিল রাজাকারের খাতায়। সে বছর সেপ্টেম্বরের দিকে তার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাড়ি হতে চুরি যাওয়া জিনিসগুলোর একটা হদিস করা। গিয়াস উদ্দিন গালভরা হাসি দিয়ে জানিয়েছিল চুরির ব্যপারটা তারই কাজ। তবে সে একা করেনি অপকর্মটা। সাথে জড়িত ছিল স্থানীয় রাজাকারের কমান্ডার। ডিসেম্বরের শেষ দিকে গেসুকে আটকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন। বড় ধরনের চাঁদার দাবি মেটাতে না পারার কারণে তার গলা কেটে ঝুলিয়ে রাখা হয় শহরের মূল চত্বরে। গেসুর মত এমন অনেক রাজাকার ছিল যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিবেচনা করা যায়না। যেমন যায়না আমাদের মূখ্যমন্ত্রীর বেয়াইকে(এই বেচারা কেন রাজাকারে নাম লিখিয়েছিল তা এখনো পরিস্কার হয়নি)… ওদের অনেকে পেটের দায়ে অথবা দাও মেরে ঝটপট মাল কামানোর উদ্দেশ্যে নাম লিখিয়েছিল শত্রু ক্যাম্পে। তর্কের খাতিরে এবং দেশের সুশিল সমাজের দাবি মেটাতে ধরে নিলাম এরাও রাষ্ট্রদ্রোহি এবং গণনির্মুলের আওতায় আনা হবে। ভুলে গেলে চলবেনা আমরা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিয়ে কথা বলছি। এবার আসা যাক বাকিদের প্রসঙ্গে। ধরে নিলাম ৭১’এর পরে জন্ম নেয়া জামাত-শিবিরের সদস্যরাও রাজাকার অথবা দেশকে পাকিস্তান বানানোর এজেন্ডা বাস্তবায়নের অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহি। রাষ্ট্রদ্রোহিদের নির্মুল আইনের চোখে বৈধ। তালিকায় এদেরও নাম থাকবে।

এভাবে খুঁজতে থাকলে সংখ্যাটা কত দাঁড়াবে? অনেকে বলেন প্রায় ১ কোটি। মাদ্রাসার ছাত্র হতে শুরু করে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনদেরও বাদ দেয়া যাবেনা। কারণ তারাও রাজাকার তৈরীর ফ্যাক্টরীর সক্রিয় সদস্য। এবার আসুন এদের সবাইকে সমাজ হতে আলাদা করি। দ্ধিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সৃষ্ট কনসেনষ্ট্রেশন ক্যাম্পের আদেলে ক্যাম্প বানাই। মাসের পর মাস অনাহারের অর্ধাহারে রেখে দুর্বল করার মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেই। দেশে গ্যাসের সমস্যা থাকলে কেন্দ্র (ভারত) হতে গ্যাস এনে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারি। এভাবে একদিন দেশ হতে রাজাকার, দেশদ্রোহি, রাজাকার তৈরীর মেশিনারীজ সহ সবকিছু নির্মুল হয়ে যাবে। ১ কোটি লাশ মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইল এলাকায় কবর দিতে অসুবিধা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওসামা বিন লাদেনের লাশ দাফন করায় ওবামা প্রশাসনের পথ অবলম্বন করলে কাংখিত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিতে হবে এসব লাশ। হাঙ্গর, কুমির, কুকুর, বেড়াল, হিংস্র মাছের শিকার হয়ে একদিন পৃথিবী হতে মুছে যাবে এদের উপস্থিতি। সমস্যার পাকাপোক্ত সমাধান চাইলে দেশের অলিগলিতে গজিয়ে উঠা মসজিদ, মাদ্রাসা গুলোও গুড়িয়ে দিতে হবে। যারা ধার্মিক হয়ে বেঁচে থাকতে চাইবে তাদের জন্মনিয়ন্ত্রনের আওতায় এনে স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব বাধ্যতামূলক করতে হবে। এবার আসুন কল্পনা করি এবং স্বপ্ন দেখি এমন একটা বাংলাদেশের। ধরে নেই বাংলাদেশ এখন শাহরিয়ার কবির ও গণজাগরন মঞ্চের স্বপ্নের দেশ।

এ এক নতুন বাংলাদেশ। এখানে মৌলবাদের খুটি হয়েছে উৎপাটিত। জঙ্গিবাদ এখানে ইতিহাস শিক্ষার অধ্যায়। তার বদলে এখানে প্রবাহিত হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্নিগ্ধ বাতাস। এখন মঙ্গল প্রদীপের আলোতে সন্ধ্যা নামে। সকাল বেলা আযানের ধ্বনিতে কলুষিত হয়না শহর, বন্দর, নগর, হাট, মাঠ, ঘাটের বাতাস। পাখিরাও কিচির মিচির শব্দে উচ্চারণ করেনা মৌলবাদী হামদ ও নাথ। বরং তাদের মুখে কবি গুরুর কবিতা ও গান। গৃহবধুদের জন্যও এখানে স্বামীর পাশাপাশি নাগর রাখার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এমন একটা সুজলা, সুফলা সোনার বাংলাদেশের জন্য আমার একটাই প্রশ্ন থাকবে, এখানে লুটেরাদের স্থান কি হবে? যে নেতা নেত্রীরা চেক দিয়ে চাঁদাবাজি করলেন হবে কি তাদের বিচার? পদ্মাসেতু খেকো আবুল চোরা, রেলখেকো সুরঞ্জিত চোরা, হলমার্ক ও ডেসটিনি খেকো রাজনীতিবিদ, আমলাদের পরিচয় কি হবে? দিনের পর দিন বছরের পর ধরে যারা জনগনের পকেট কেটে নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন তাদের কি আনা হবে বিচার আওতায়? যে হায়েনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে মূখ্যমন্ত্রীর তকমা লাগালেন তার পরিণতিই বা কি হবে? বিচার হবে কি এসব অন্যায়, অনাচার আর কুকর্মের? যদি তা হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে আমিও নাম লেখাতে চাই এ কাফেলায়। অন্যায় কেবল রাজাকাররাই করেনি, অন্যায় করেছে এ দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, উকিল, বিচারক সহ লাখ লাখ রক্তখেকো পশু। কাদের মোল্লার রুমমেট বানাতে তাদেরও কি পাঠানো হবে ম্যানিলা রশির দুয়ারে? যদি তা নিশ্চিত হয়, আমিও আছি জাতীয়তাবাদের কাতারে। তবু সুন্দর হউক আমাদের জন্মভূমি। কলংকমুক্ত হউক এ দেশের মাটি, আকাশ, বাতাস…
http://www.amibangladeshi.org/blog/01-14-2014/1437.html

Is Nazism rising in Bangladesh ? -1

2

by M Chowdhury

Comparative discussion of the characteristics of historic Nazi regime and current Bangladesh regime

I wrote earlier, how the propaganda strategy adopted by the current regime in Bangladesh is stunningly similar to that of the Nazis in 1930s and 40s; I held this view long before the rise of Shahbag.

As a result, I have often receive few kinds words from fellow “sushils” who seems to think of this as a political blasphemy. In my personal opinion this sheer horror is generated by most sushil getting Fascism confused with dictatorship ( a hated one, that is) ; because I often get asked if I have any doubt about the massive public support AL  commanded. “Hey, Hitler was popular too” – is always my simple answer.  The point is, a Fascist regime does not necessarily need have zero public support, in the contrary history shows us that Fascist regime can start off with significant public support or the delusion of so.

19799175316C741A87

Fascism as an ideology is quite hard to define, however it has been proven to display some common characteristics. A close observation of these characteristics, with comparison of current Bangladeshi regime can that the fear of rising fascism in Bangladesh might not be yet another political claim.

“Extreme” Nationalism

Extreme Nationalist, combined with a totalitarian authority is Fascism’s distinctive property. Fascist regimes, throughout the history made constant use of extreme nationalism. This serves the purpose of creating the common ground for creating a “mass movement” in which the middle-class can prevail. This also creates a sense of comradeship, a mindset of being in a “war” with the political opponents and a sense of sacrifice for the mission of  national regeneration.

In post-world war 1 Germany, Hitler’s Nazi used the national regeneration theme with colossal success and sold Nazi party to be the only viable option to regain the lost Germanic pride. While the Nazis used nationalism in the backdrop of a lost war and “humiliating” Versailles Treaty, Bangladesh’s fascist could not have used such tactics in their ground for mass movement because of two problems. Firstly, we don’t have a lost war, we have a war where we were valiantly victorious against all odds.

130234080557829814

The second and much bigger one is that of India; any self-respectful patriotic or nationalist movement is bound to be vocal about the biggest and greatest aggressive entity the nation has been facing for over four decades, in Bangladesh’s case which is India with its border aggression and BSF brutality, water sharing issues and economic and cultural aggression etc. As India also happens to be AL’s greatest foreign ally, the AL intelligentsia needed to conceive a different type of nationalism.

18494650003E86C7CF18391768406C741A87

As a result, a fusion is created where AL, the leftists parties, liberation war, 71, Father of the Nation etc are jumbled in to a fallacy called 71’s “chetona” and the fascist propaganda machine played its part in sanctifying this so called chetona. This does a lot of good for a fascist movement in rise; it gives them a ground for mass movement, takes the focus of any patriotic sentiment away from India, gives AL the right to identify anyone as the enemy of the chetona and gives the young hot-blooded recruits a shadow war to fight against the so called enemies.

18614982557829814

The young generation trapped into this fallacy grows up learning that the chetona is sacred, so much so that a regime can do it whatever it likes in the name of 71. They never stops to ask  why the leftist party leaders today becomes the guardian of 71 when they stayed away from the liberation war describing it as the fight of two dogs, they never ask how media censorship is aligned with the spirit of free democratic Bangladesh. They never hesitate  to call Kader Siddiqui, the 71 war hero as a “razakar” and idolizes certain sci-fi author as national hero and forgets to ask him why wasn’t he in the war front in 1971.  These ultra nationalists are so lost in their fallacy that they forget to demand justice for Bishyajit, they chant “Fashi ” and not “Justice”   and while in the nation is in turmoil, they are happy setting the world record for creating the biggest flag.

This patriotism is extreme, blind and delusive; it teaches young men to dresses up in green and red the regime is killing democracy; it teaches them to shut their eyes and rejoice the coming back of the saviour of chetona while the regime is self electing itself for a second term and moving towards a total authoritarian structure.

-13900090983E86C7CF

Another important aspect of the German Nazi ultra-nationalist is its display through paraphernalia. There were slogans, mottos, songs and flags. A similar trend can be observed in Bangladesh, especially in regime backed rallies, gathering etc; there is a inclination of creating this delusion of unity and a silent  effort of  fuelling the urge to join the common ground of chetona.

-1404623626056FEACD

The way the current regime has created the fallacy of Nationalist and were able to create a cult culture around it is very similar to the ultra nationalist extremism created by Nazi regimes in the past and it does make one to wonder, Is Nazism rising in Bangladesh ?

( Thanks to work of R. Verma and Emilio Gentile)

চেতনার মর্মবাণী জাগাও প্রাণে

নিরীহ পাবলিক

২৭ ডিসেম্বর ২০১৩/ দুই দিন আগেও যেই সরকার আর্মি, পুলিশের সশস্ত্র পাহারায় জোর পূর্বক গাড়ি চলাচলে বাধ্য করছিলো তারাই এখন আবার সেই আর্মি, পুলিশ দিয়েই জোর পূর্বক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকার আবাসিক হোটেলগুলোর কর্তৃপক্ষকে সরকারীভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তারা যেন অপরিচিত কাউকে রুম ভাড়া না দেয়। হোটেল ওয়ালার জ্ঞাতী গোষ্টি ছাড়া কেউ যদি থাকতে না পারে তাহলে তাকে হোটেক বলার মানে কি? সরকারের এইসব ভাঁড়ামো কর্মকান্ডে এমন নিদারুণ পরিস্থিতেও নিরীহ পাবলিক কৌতুক বোধ করে। কিন্তু যাদের সব দেহছিদ্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঠাসা তারা নিশ্চয় এসবের মর্মার্থ বুঝতে পারেন, বুঝতে পেরেই মনে মনে তাদের চেতনাবাদী নেত্রীর প্রশংসা করেন। গত চল্লিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নানান দিক নিত্যনতুন আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে। বিগত কিছুদিন যাবত এই চেতনা উপচে পড়ছে। চেতনায় উদ্ভাসিত এইসব কর্মকান্ডে কৌতুকবোধ না করে বরং এগুলোকে সরবে বা নিরবে আত্নস্ত্ব করার মধ্যেই প্রকৃত বাঙ্গালীত্ব নিহিত আছে। এছাড়াও চেতনাপন্থী বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিকদের গত চার দশকের কর্মকান্ডে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কতিপয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা রাজাকার ব্যতীত সকল বাঙ্গালীরই গলাধঃকরন করা কর্তব্য। চেতনার তিন লক্ষণঃ

১/ মিথ্যাচারঃ যে যত বেশী মিথ্যা বলতে পারবে সে তত বড় চেতনাধারী। গাঁজাখুরি গল্পের আবেগী বয়ান বিশেষভাবে চেতনা বর্ধক। শুনেছিলাম গ্রামদেশে পলাতক মুক্তিযোদ্ধার কৌতুক প্রচলিত আছে- যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া যুবক এখন গর্বের সাথে নিজের বীরত্ব জাহির করে বেড়ায়, ‘আমিতো পাঞ্জাবীদের সাথে একবার মুখোমুখি যুদ্ধ করেছি, সে-কি গোলাগুলি! হঠাৎ একটা বুলেট আমার কানের পাশ দিয়ে সাঁই করে চলে যাচ্ছিলো, তাকাইয়া দেখি বুলেটের গায়ে লেখা ‘মেইড ইন চায়না’/ আমাদের চেতনাবাদী পলাতক মুক্তিযোদ্ধারাও এমন গল্প করেন এবং সেগুলোই চেতনাবাদীদের চেতনার মূল উপজীব্য, মুক্তিচেতনা জাগিয়ে রাখার একমাত্র ভাবসম্পদ। আর আমাদের চেতনাবাদী শাসকগোষ্ঠির মিথ্যাচার তো এখন মহাকাব্যের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

২/ গুম, খুন, লাশোল্লাসঃ গুম করে খুন করা কিংবা খুন করে গুম করা। সদল বলে পিটিয়ে কোন নিরস্ত্র মানুষকে লাশ বানানো, লাশ নিয়ে মানুষখেকো জংলী কায়দায় লাফালাফি করে উল্লাস করা এসবই এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অংশ হয়ে গেছে। চেতনাপন্থীদের রাজত্ব আর কিছু দিন চললে ডিসকোভারী চ্যানেল আমাজন জংগল ছেড়ে ঢাকা শহরে আসবে মানুষখেকোদের ভিডিও দৃশ্য ধারন করতে। হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ দূরত্বে বসে তারা ভিডিও করবে আর চেতনাপন্থী লগী বৈঠা বাহিনী রক্ত মাখা দাঁত বের করে অট্টহাসি দেবে টিভির পর্দায়।

৩/ ভারতের দালালীঃ ভারতের দালালী না করে কেউই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাধারী হতে পারে না। ভারতের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র বানানো হবে, দেশে দূর্ভিক্ষ লাগিয়ে হলেও ভারতের স্বার্থে বাঁধ নির্মান করা হবে, ভারতকে ট্রানজিট দিতে নদীর মাঝখানে রাস্তা বানিয়ে দেয়া হবে, ভারতীয় বাহিনী যাকে যখন খুশি গুলি করে মেরে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখবে। একমাত্র রাজাকার ছাড়া কেউ এসবের বিরুদ্ধে কথা বলবে না, বলতে পারে না। এজন্যই এর আগে যখনই ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন মিছিল সমাবেশ হয়েছে তাতে চেতনাধারী বাহিনী হামলা করেছে। করাই স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে ভারতের শাসকগোষ্ঠির সেবাদাসী হিসেবে টিকে থাকার জন্য। বন্ধু রাষ্ট্রের গুলিতে সীমান্তে বীর বাঙ্গালী বেঘোরে প্রান দিবে-এটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অংগীকার, জাতির পিতার স্বপ্ন। বন্ধুরাষ্ট্রের দেয়া বাঁধে বাংলার জনতা পানির অভাবে আর্সেনিক খেয়ে মরবে এটাই আমাদের গৌরবের অর্জন। এই সত্য যারা এখনো বুঝতে পারে নাই তারাই ভারতের বিরোধীতা করে- তারাই রাজাকার। মূর্খরা ভাবে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করেছে। চেতনাধারীরা ঠিকই জানে এইদিন বাংলাদেশের অধীনতা পাকিস্তানের কাছ থেকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে মাত্র।

 

 

 

 

 

 

 

টিক্কা খানের আসনে আওয়ামী লীগ!

by Watchdog Bd
কাদের মোল্লার ফাঁসির তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে ডেডিকেটেড আওয়ামী একটিভিষ্টরা অনলাইনে যেসব গান গাইছে তা এখন লাশ নিয়ে গোরস্তানে যাওয়ার গানের মত শোনাচ্ছে। মিহি সুরের এসব গানে আগের মত প্রাণ নেই। গলায়ও নেই তেমন জোর। অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারকে ডিফেন্ড করার বাংলা শব্দের ভান্ডার খুব ধনী নয়। লম্বা সময় ধরে এসব সীমিত শব্দের ব্যবহার খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা তৈরী করে মাত্র। ছাগল, ছাগু ও পাকি, এই তিন শব্দের কীর্তন এ মুহূর্তে নেতিয়ে পরা চেতনা উজ্জীবিত করার জন্য যথেষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছেনা। কারণ আওয়ামী লীগ এখন ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খানের আসনে। আর আপনারা যারা এদের নিয়ে নাচতে গিয়ে অন্তর্বাস খুলে ফেলছেন তারা বসেছেন কাদের মোল্লা, আমিনি, নিজামীদের চেয়ারে। অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারের কোন দেশ, কাল, পাত্র থাকেনা। সব দেশে সব কালে এরা খুনি, তস্কর ও লুটেরা হিসাবেই চিহ্নিত হয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের জন্য এ মুহূর্তে নতুন কোন সংজ্ঞা তৈরী হবে তার সম্ভাবনাও কম। আপনাদের লীগ এখন মরা হাতী। যারা কাকের মত কা কা সুরে এই হাতির ঘুম ভাঙ্গাতে চাইছেন তাদের চেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা একবারেই শূন্য। মরা হাতী এক সময় লায়াবিলিটি হয়ে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াবে এবং শেষ পর্যন্ত কেউ না কেউ উদ্যোগ নিয়ে ছুড়ে ফেলবে ভাগাড়ে। আরও কটা দিন হয়ত হাতে রাইফেল নিয়ে পুলিশের তাফালিং চলবে, অন্ধকারে চোখে কালো চশমা লাগিয়ে র‌্যাব নিজেদের র‌্যাম্বো ভাবতে থাকবে, সেনাবাহিনীর কামানে চড়ে হানিফ, লতিফ, ইনু, হাসানদের টেংরা মাছের নাচ অব্যাহত থাকবে।

৭১’এ কাদির কসাইরাও একই নাচ নেচেছিল। কিন্তু হায়, নাচের সমুদ্র এক সময় নদী হয়ে যায়, নদী হয় পুকুর এবং পুকুর রূপান্তরিত হয় ডোবায়। ডোবার টেংরা মাছ অক্সিজেনের অভাবে চিতপটাং দিয়ে নেচে নেয় শেষ নাচ এবং বিদায় নেয় ইহজগৎ হতে। ৭৫ সালে ক্ষমতার দাপট এবং তা চিরস্থায়ী করার লিপ্সা হতে শেখ মুজিব যে ভুল করেছিলেন দল হিসাবে সে ভুলের মাশুল আওয়ামী লীগকে গুনতে হয়েছিল অনেকদিন। এবং অনেক গুলো বছর। ২০১৩’তে এসে শেখ হাসিনা যে ভুল করলেন তার মূল্য দল হিসাবে আওয়ামী লীগকেই শোধ করতে হবে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা। আওয়ামী ছিল জনগণের দল। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল তাদের ভাগ্য। পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরশাসক, ৭১’এর ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্র, এরশাদ চক্রের নয় বছর হতে মুক্তির লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ ছিল অগ্রপথিক। কিন্তু একজন মহিলা তছনছ করে দিল এ ঐতিহ্য। নিজের ইচ্ছা, পারিবারিক স্বার্থ আর প্রতিবেশী দেশের তাবেদারি করতে গিয়ে খেয়াল খুশিমতো দলকে ব্যবহার করলেন এবং টেনে আনলেন এমন একটা অবস্থায় যেখান হতে দলীয় পরিচয়ে নেতা কর্মীরা জনগণের কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে। কারণ তাদের জন্য দেশের অলিগলিতে পাতা আছে মৃত্যু ফাঁদ। এ ফাঁদ কেবল জামাতি ফাঁদ নয়, সাধারণ জনগণেরও ফাঁদ। বন্দুকের নলের মুখে দেশ শাসন ইয়াহিয়া টিক্কা খানদের শোভা পায়, আওয়ামী লীগের মত জনগণের দলকে নয়।

জামাতি, পাকি আর রাজাকার বচন হয়ত ক্ষণিকের আনন্দ দেয়, উল্লাস করতে খোরাক যোগায়। কিন্তু তা ক্ষতির জায়গায় ইট-সুরকি সিমেন্ট বসাতে সহায়তা করেনা। রাজনীতি করতে নেতা-নেত্রীর পাশাপাশি জনগণ লাগে। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সব আছে। আছে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী, একদল নেত্রীকানা দলদাস। কেবল নেই জনগণ। প্রমান চাইলে সব ছেড়েছুড়ে নির্বাচনে গিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করে আসুন। দুঃখ পাবেন, কষ্ট লাগবে। জান নিয়ে পালিয়ে আসতে পারলে নিজেদের ভাগ্যবান মনে করবেন।
http://www.amibangladeshi.org/blog/12-27-2013/1428.html

 

রাজাকার : ‘৭১ বনাম ২০১৩ এডিশন

razakar 3

ভারতীয় অলিখিত ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদি আধিপত্যকামীদের একটা স্থুল কৌশল হল _ এভাবেই বার বার ‘৭১ এর ধূয়া তুলে পাকিস্তান জামাত-শিবির ইত্যাদি জুজু দেখিয়ে চলমান রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ‘বর্তমানের চালচিত্র’ কে আড়াল করে রাখার ধুরন্ধর এক অপকৌশল। ‘৭১ এর রাজাকারদের তুলনায় ২০১৩ এর রাজাকাররা অত মোটাদাগের নয়, অনেক বেশি চিকনদাগের সুক্ষবুদ্ধিসম্পন্ন ক্রিমিনাল। আগের মত মোটাদাগের অপরাধ করে ধরা খাওয়া বা জাতীয়-আন্তর্জাতিক-ঐতিহাসিকভাবে নিন্দিত হওয়ার বিপদ এড়িয়ে ধুরন্ধর ডিজিটাল কৌশলে ‘সাংবিধানিক’ উপায়ে রাজাকারির নিত্যনত্যুন পন্থা যেমন আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে, তেমনি সেগুলোকে মহিমান্বিত করার প্রয়াসে সাংষ্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক বিদূষকসুলভ চাটুকারিতা একটি আলাদা শিল্পের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমি কার পক্ষ নেব ? ‘৭১ এর প্রেক্ষাপটে আমি পশ্চিমা হানাদার ও তদীয় দোসরদের পক্ষ নিতে পারি না কারণ তারা অবর্ণনীয় জুলুম করেছে নিরস্ত্র নিরীহ সাধারণ জনগণের ওপর, মতাদর্শিক ভিন্নতার কারণে তো বটেই, সেই রাগ তুলতে গিয়ে যারা কোন দলের ছিল না সেই আপামর সিভিলিয়ান জনগণ তথা গোটা জাতির ওপরই শ্বাপদসুলভ রক্তলোলুপ হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। ‘ভারতীয় হিন্দু’ ‘পাকিস্তানের দুশমন’ ইত্যাদি জুজু দেখিয়ে সেই অজুহাতে বিরোধীদমনের নামে চলছে শহরে বন্দরে-গ্রামে গঞ্জে-মাঠে প্রান্তরে নির্বিচারে চালিয়েছে গুলি, বসতবাটি ধ্বংস-অগ্নিসংযোগ, অবিশ্রান্ত হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের ক্রমাগত দীর্ঘমেয়াদী কালোরাত্রির অদ্ভূতুড়ে আঁধারে ঘেরা অমাবস্যা।

সেই কারণে আমি একজন অতি সাধারণ, অতি নগণ্য মুসলিম হিসেবে ‘৭১ এর নরঘাতক জালিমদের সমর্থন করি না, করতে পারি না।

আজ এই ২০১৩ তে একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমি কার পক্ষ নেব ? আজকের প্রেক্ষাপটে আমি ভারতীয় হানাদার ও তদীয় দোসরদের পক্ষ নিতে পারি না কারণ তারা ‘৭১ এর পশ্চিমাদের মত নগ্নভাবে না হলেও সুক্ষ কৌশলে আরো ভয়ংকরভাবে খামচে ধরেছে আমার মাতৃভূমির প্রিয় লাল-সবুজের পতাকার বুক। সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদি ভারতীয় হিন্দুদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দেশীয় দালালবাহিনী একে একে দেশের সম্পদ সব তুলে দিচ্ছে তাদের প্রভুর হাতে, দেশের প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, মানুষের ধন-মান-প্রাণ সবই অনায়াসে কুক্ষিগত করতে সহযোগীর অক্লান্ত ভূমিকায় পালন করে চলেছে তারা। ভারত থেকে লোক এনে দেশের মানুষকে হত্যা করাচ্ছে তারা। ‘জঙ্গি’ ‘জামাত-শিবির’ জুজু দেখিয়ে সেই অজুহাতে বিরোধীদমনের নামে চলছে শহরে বন্দরে-গ্রামে গঞ্জে-মাঠে প্রান্তরে নির্বিচারে চালিয়েছে গুলি, বসতবাটি ধ্বংস-অগ্নিসংযোগ, অবিশ্রান্ত হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের ধারাবাহিকতার ‘সূচনা’ হতে দেখছি। সাতক্ষীরায় ‘৭১ এর মতই হত্যা-লুটপাট-বসতবাটিতে অগ্নিসংযোগ _ এমনকি বুলডোজার নিয়ে গিয়ে বাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে আসা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে ৫০ জনের অধিক নারী সমভ্রম হারিয়েছেন, সমভ্রম হারানোর ভয়ে গ্রামত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক নারী।

তাহলে ২০১৩ তে জালিম কারা আর মজলুমই বা কারা সে প্রশ্ন নিজেকে কখনো করেছি ? ‘৭১ এর ব্যাপারে আমি যদি পূর্ব পাকিস্তানের আপামর মজলুম জনসাধারণের পক্ষ নিয়ে থাকি _ ২০১৩ তে এসে আমি নতুন মোড়কে প্যাকেট হয়ে আসা জালিম ভারতীয় রাজাকারদের পক্ষ নিতে যাব কেন ?

razar 2

অনেকে বলেন ‘৭১ এ পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধাবস্থা ছিল সে কারণে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অগণিত সিভিলিয়ান হত্যা-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ-নির্বিচারে গুলি-ধর্ষণ এসব হয়েই থাকে, সেটা যুদ্ধেরই অঙ্গ। কিন্তু এই মাটির সন্তান হয়ে যারা এই দেশমাতৃকাকে, দেশমাতৃকার সহোদর-সহোদরাদের পিশাচসুলভ নীচতায় বিদেশী হানাদারদের হাতে হত্যা-ধর্ষণের জন্য তুলে দিতে পেরেছিল _ তাদের ক্ষমা করা অতি অতি দুঃসাধ্য ব্যাপার। ভাল কথা, তাহলে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ক্ষমতা হাতে পেয়েও কেন তাদের উপযুক্ত বিচার করা হল না ? কেন তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে এত সহজে ছেড়ে দেয়া হল ? ৪২ বছর ধরে রক্তবীজ থেকে বাড়তে বাড়তে বিশাল অরণ্যে রুপান্তরিত হতে দেয়ার পর এত যুগ পর এখন কেন এই প্রজন্মের ওপর এত বিশাল বিভক্তি-ধ্বংসযজ্ঞ-গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হল ? ‘৭১ ধূয়া বার বার তুলে প্রতারণাপূর্ণভাবে ২০১৩ এ এসে ভারতের সেবাদাসত্ব করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ১২টা যারা বাজাচ্ছে চোখের সামনে ভারত কর্তৃক নির্মমভাবে সবকিছু লুন্ঠিত হতে দেখেও সুশীলসমাজ এবং মানবতাবাদিরা নিশ্চুপ কেন ? কেন তারা বর্তমান এবং ভবিষ্যত বাংলাদেশের নৃশংস হত্যা দেখেও অন্ধের মত চোখ বন্ধ রেখে বার বার ৪২ বছর আগের অতীতের কথা নিয়ে এসে নাটকীয়তা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায় ?

আজ যেসব যুবক-কিশোর-তরুণ জামাতশিবির করছে তারা কি ‘৭১ এ রাজাকার ছিল ? তাদের তো জন্মও হয় নি সেদিন। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পর পাইকারী হারে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষনা করে, ১৯৯৬ এ জামাতের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতার স্বাদ নেয়, একমাত্র বিএনপির সাথে জামাত জোটবদ্ধ হওয়ায় ‘রাজনৈতিক’ কারণেই কি তারা অনেকাংশে জামাতের বিরোধিতা করছে না ? চেতনার হোলসেলাররা যদি আদৌ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হত তাহলে অন্যান্যদের মত তাদেরও একেকজন রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুকুরচুরি করে কেউ শতগুণ কেউ সহস্রগুণ ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি করে কিভাবে ? এই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ? তাহলে আর ১০টা চোরবাটপাড়ের সাথে তাদের পার্থক্য সূচিত হয় ঠিক কোন জায়গায় ?

আজ বাংলাদেশে ‘৭১ এর মত কোন ঘোষিত যুদ্ধাবস্থা নেই ঠিকই, কিন্তু ভারতীয় সাংষ্কৃতিক-সামরিক-রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক হানাদার দস্যুদের অঘোষিত কিন্তু ভীষণভাবে পরিচালিত এই আগ্রাসনে যারা দেশীয় তাঁবেদারের ভূমিকায় নির্লজ্জভাবে অবতীর্ণ হয়ে নিজের দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে বীভৎস বিশ্বাসঘাতকের মতো দাঁড়িয়েছে _ আমার কাছে তাদের সাথে ‘৭১ এর রাজাকারদের কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য এতটুকুই যে ‘৭১ এর ঘটনা সম্পূর্ণভাবে ঘটে কালের আবর্তে মিলিয়ে গেছে, ২০১৩ এর রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকতা-নির্যাতন-লুটপাট রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে আমাদের চোখের সামনে ঘটছে।

‘৭১ আমাদের পূর্বসূরীদের অতীত _ ২০১৩ আমাদের রক্তাক্ত বর্তমান। যে সঙ্গীন মানবতাবিরোধী অপরাধে ‘৭১ এর অপরাধী নরাধমদের বিচার দাবি করছি, সেই একই যুক্তিতে ২০১৩ এর নব্য রাজাকারদের দুঃশাসন-গুম-খুন-হত্যারও আশু প্রতিকার চায় বাংলার জনগণ। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়তো জনগণ নিজের হাতেই আইন তুলে নিতে বাধ্য হবে, যেমনটি হয়েছিল ‘৭১ এ, রাষ্ট্রের কাঠামো তখন চুর চুর করে চোখের সামনে ভেঙে পড়তে থাকবে তাসের ঘরের মত, মিলিয়ে যেতে থাকবে কর্পূরের মত আমাদের সাধারণ জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়া ৪২ বছরের অর্জন, অনিশ্চয়তার অজানা চোরাবালিতে অসহায়ভাবে তলিয়ে যেতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতকে ঘিরে দেখা শত স্বপ্নের স্বর্ণজাল _ কাজেই তার আগেই সচেতনভাবে জেগে উঠতে হবে বাস্তব দেশপ্রেমের মধুর জ্বালাময় কষাঘাতে _ অদেখা পূর্বসূরীদের প্রাগৈতিহাসিক গৌরবগাঁথায় নয়, নিজেদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বর্তমানের ঘূর্ণিতে সটান যোদ্ধার মত দুঃসাহসিক আগুনের পরশমণি বুকে নিয়ে।

নির্বাচনী হলফনামা ও চেতনার পাইকারী ব্যবসা…

মনোনয়নপত্র জমা দিতে তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে এলাকায় গেলেন এবং জমা শেষে একই ফ্লাইটে ঢাকা ফিরে এলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ এক নতুন সংযোজন এবং মনে হচ্ছে তা টিকে থাকার জন্য এসেছে। পরিবর্তনের এ ধারা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছিলাম শেষবার বাংলাদেশ বেড়াতে গিয়ে। এক বছর আগের ঘটনা। জর্জ (ছদ্ম নাম) আমার ছোটবেলার বন্ধু। তার বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য। মারা যাওয়ার আগে জীবনের শেষ পাঁচটা বছর ভাগ্যের সাথে অসফল লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। দলের তখন ভাদ্র মাস। চারদিকে নাই নাই ভাব। টেবিলে তিন বেলা খাবার যোগার দিতে রীতিমত হিমসিম খেতে হয়। আয় বলতে কেবল শহরের বানিজ্যিক এলাকায় মার্কেট ভাড়া। জীবন যুদ্ধের এ কঠিন বাস্তবতা আগে কোনদিন মোকাবেলা করতে হয়নি বনেদি এ পরিবারকে। নিউ ইয়র্কে বসে খবর পাই জর্জের বাবার মৃত্যুর। তত্ত্বাবধায়ক নামক ঝামেলার শেষে আওয়ামী লীগ যেদিন ক্ষমতার শপথ নেয় সেদিন আমি দেশে। বাবা নেই, তাই বলে জর্জ বসে থাকেনি। সুদিনকে স্বাগত জানাতে গুলসান এলাকায় মাসিক ৭৫ হাজার টাকায় ফ্লাট ভাড়া নিতে অসুবিধা হয়নি। কারণ জিজ্ঞেস করতে রহস্যজনক হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেল সে প্রসঙ্গ। কিছুটা হলেও ধারণা ছিল কি হতে যাচ্ছে এর পর।

২০১২ সালে দেশে গিয়ে যা জানার জানলাম, যা দেখার তাই দেখলাম। ছুরির মত ধারালো শরীরের স্বল্প বসনা এক তরুণী আমাকে ওয়েটিংরুমে বসিয়ে ভেতরে গেল বসের সন্ধানে। চারদিক ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। রূপকথার মত মনে হল সবকিছু। শান সৈকতের এমন জটিল ও ভয়াবহ সমাহার কেবল কল্পলোকেই সম্ভব। সবকিছু সাজানো গোছানো। চারদিকে মৃতপুরীর স্বব্দতা। মাঝে মধ্যে ফাইল হাতে দুয়েকজন এদিক সেদিক করছে। তাও খুব সন্তর্পণে। বাবার মতই বদমেজাজ ছেলের। সামান্য কিছুতে রেগে যায় এবং ছোটবড় কারও উপর হাত তুলতে দ্বিধা করেনা। এ অফিসের কিসের ব্যবসা হয় জানিনা, কিন্তু কর্মচারীদের চেহারা দেখলে আন্দাজ করতে পারি এ আমার বন্ধু জর্জের ব্যবসা। আমরা একসাথে বড় হয়েছি। পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমন করেছি। অনেক ভ্রমর হতে একসাথে মধু পান করেছি। কিছুটা হতাশ হলাম বন্ধুর দর্শনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে। আগে কখনও এমনটা হয়নি। সাধারণত তাকেই অপেক্ষা করতে হয়েছে। মন হল মেয়েটা ইচ্ছা করে নিতম্ব দোলাচ্ছে। স্কার্টের উপর সাদা শার্টের দুটা বোতাম খোলা রাখছে বিশেষ উদ্দেশ্যে। তার বাবার কথা মনে পড়ল। ভদ্রলোকের চরিত্রও ছিল ভেজালে ভর্তি। ব্যবসায় সুন্দরী সেক্রেটারি তার অন্যতম। পর নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক অনেকটা খোলামেলা ভাবেই প্রকাশ করতে পছন্দ করতেন। এ নিয়ে স্ত্রীর সাথে টানাপোড়নের অন্ত ছিলনা। আমি ছিলাম তাদের ভেতরের মানুষ। সব পক্ষই আমাকে স্বাক্ষী মানতে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করত। নিতম্বের শেষ দোলাটা আমার ঠিক মুখটার কাছে এসে শেষ হল। যান্ত্রিক একটা হাসি দিয়ে জানাল একটু দেরি হবে, স্যার এখন ব্যস্ত। আমার নিজেরও সময় ছিলনা। তাই উঠতে হল। নামটা জিজ্ঞেস করে একটা ম্যাসেজ রেখে দরজার দিক পা বাড়ালাম। হয়ত গলার আওয়াজেই হুস হল বন্ধুর। ঝড়ো গতিতে বেরিয়ে এল এবং আমাকে দেখে উল্লাসে ফেটে পরল। কর্মচারীরা মনে হল ভূত দেখার মত কিছু একটা দেখল তাদের অফিসে।

বিশেষ একটা কক্ষ। থরে থরে সাজানো লাল নীল বোতল। এক কোনায় সিংহাসনের মত একটা খাট। পূর্ব লন্ডনের একটা সরকারী ফ্লাট কটা দিন একসাথে শেয়ার করেছি বন্ধুর সাথে। তখনই তার মুখে শুনতাম হবু ব্যবসার স্বপ্নীল কাহিনী। অফিস এবং সাথে সাজানো গোছানো একটা রুম। পুরনো মদের কালেকশন এবং যৌবনা নারী। কাজ আর আনন্দে কেটে যাবে জীবন। কোন কিছুই বাদ রাখেনি স্বপ্নপূরীর সে অফিস হতে। খুব দ্রুত পরিচয় করিয়ে দিল সখের মদ কালেকশনের সাথে। অন্তরঙ্গ মুহুর্তে নতুন করে পরিচয় হল একটু আগে দেখা মেয়েটার সাথে। তার রক্ষিতা। খুব উঁচু পরিবারের কেউ না হলেও ট্রেনিং দিয়ে তাকে উঁচুতে উঠানো হয়েছে। ব্যবসায়িক মনোরঞ্জন তার মূল পেশা। তবে সবকিছুই হয় বিদেশে। থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া সহ ইউরোপের অনেক দেশে তার যাতায়াত। লাভের অংক আশাতীত হওয়ার পরই কেবল উপঢৌকন হিসাবে কদিনের জন্য ছেড়ে দেয়া হয় ক্লায়েন্টের হাতে। শর্ত একটাই, দেশের বাইরে। দু দুটা অসফল বিয়ের পর বন্ধু এখন একা। মনে হল এ নিয়ে খুশির অন্ত নেই তার। যৌন মিলনের ঝাঁপিটা খোলার আগেই থামাতে হল তাকে।

ব্যবসা প্রসঙ্গ আসতে বদলে গেল সবকিছু। তালিকাটা লম্বা। যোগ বিয়োগ শেষে যা বুঝাতে চাইল তার পরিমান মাসিক ২ হতে ৩ কোটি টাকা নীট মুনাফা। এলাকায় অনেককে পালন করতে হয়, তাই লাভের অংশ এতটা ’কম।’ দুয়েকজন কমন বন্ধুর তুলনা দিয়ে জানাল তাদের মাসিক আয় ১০-১৫ কোটির উপরে। দুয়েকটা উপরওয়ালার নাম চাইলে বন্ধু সজাগ হয়ে গেল এবং কৌশলে এড়িয়ে গেল। অবশ্য না বললেও আমি জানি তাদের। কারণ তার বাবার মুখেই শুনেছি কারও কারও নাম। বন্ধু তার পুরানো আক্ষেপটা নতুন করে প্রকাশ করল। আমি দেশে থাকলে তার আয় রোজগার নাকি দশ গুনা বাড়ানো সম্ভব ছিল। মগজ এবং কানেকশনের সমাহার অনেক কিছু বদলে দেয় বাংলাদেশে, চাইলে আমরা দুজনে হতে পারতাম তার চমৎকার উদাহরন। এসব কথাবার্তায় কোন চমক ছিলনা আমার জন্য। টাকা পয়সা আর বিত্ত বৈভবের গল্প বেশিক্ষন শোনা যায়না। বিরক্ত লাগে। এক সময় ক্রোধ এসে জড়ো হতে থাকে। কক্সবাজার ঘুরে আসার প্রস্তাবটা বন্ধুই দিল। পুরানো স্মৃতি রোমন্থন নাকি আসল উদ্দেশ্য। সময় এবং ট্রাফিক জ্যামের কারণ দেখিয়ে এড়াতে চাইলে হো হো করে হেসে উঠল। একটু অবাক হলাম তার অপ্রাসঙ্গিক হাসির জন্য। উওরে জানাল ট্রাফিক কোন সমস্যা নয়, আমরা হেলিকপ্টার ভাড়ায় নিয়ে যাবো। কেবল তখনই কিছুটা হলে আন্দাজ করতে পারলাম বন্ধুর সম্পদের পরিমান। নিউজিল্যান্ডের রটোরোয়া বলে একটা হট স্প্রীং এলাকা আছে। হেলিকপ্টারে চড়ার অভিজ্ঞতা ওখানেই সেরে নিয়েছি জানাতে বন্ধু দমে গেল। রাতে একটা প্রাইভেট ক্লাবে আসার দাওয়াত দিল। অনেক সিনে ও টিভি তারকাদের খোলামেলা জীবনের সাথে চাইলে নাকি পরিচিত হওয়া যাবে। এসব আমার জন্য সব চাইতে অনাকাঙ্খিত উপাদান। তাই ধন্যবাদ জানিয়ে প্রত্যাখান করলাম। বিদায়টা খুব সুখকর হলনা। বন্ধু বুঝতে পারল আমি বিরক্ত হচ্ছি। খালাম্মার কথা জিজ্ঞেস করে অনেকটা গায়ের জোরে বিদায় নিলাম।

গুলসানের এ এলাকাটা খুব অপরিচিত লাগল আমার কাছে। বাড়ি ঘর, রাস্তা ঘাট সবকিছু মনে হল এক একটা অর্থ কামানোর ফ্যাক্টরি। এক সময় জর্জের সাথে প্রতিটা রাস্তা চষে বেড়িয়েছি। অমাবশ্যা জোৎস্না রাতে গলির ধারের ট্রলি হতে ফুচকা খেয়েছি। মিটমিটে আলোর রেষ্টুরেন্ট হতে গরম গরম পরোটা ও ভাজি দিয়ে রাতের খাবার সেরেছি। আর্থিক কষ্ট নিয়ে দুজনের কেউই আমরা বড় হয়নি। কিন্তু সম্পদের সীমাবদ্ধতা ছিল। তাই সবকিছু শেয়ার করেছি। মাঝে মধ্যে রিক্সা ভাড়া নিয়ে দ্বিধায় পরেছি, তর্ক করেছি। আবার হাতে পয়সা এলে দুহাত উজার করে খরচ করেছি। কিন্তু এত বছর পর কোথায় যেন একটা ছন্দপতন অনুভব করলাম। আমার সব চাইতে কাছের বন্ধু এখন কয়েক শ কোটি টাকার মালিক। এবং বয়স তার মাত্র ৪৩ বছর। রাজনীতি নামক ক্যান্সার সমাজের পরতে পরতে চষে বেড়ায় জানতাম, কিন্তু তা এত কাছে আসতে পারে কল্পনা করিনি। বন্ধুর নারায়ণগঞ্জ বাসার তিন তলার ছাদে কত রাত আমরা জোৎস্না দেখেছি, নির্জন শহর দেখার লোভে হাটতে বেরিয়েছি। কিছুই মেলাতে পারলাম না আজ। মনে হল রাজনীতি আসলে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, যার ছোঁয়ায় রাতকে দিন আর দিনকে রাত করা যায়। আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমে অখ্যাত শহরে আমার বাড়িটার কথা মনে পড়ল। রক্ত পানি করা কামানো অর্থের কিছুটা আগাম দিয়ে বাড়িটা কিনতে হয়েছে। বাকিটা শোধ করতে হয়ত আমার এক বছরের ছোট কন্যাকেও এক সময় হাল ধরতে হবে। কর্পোরেট আমেরিকার মাসে দুবার করে পে-চেকের অংকটার কথা মনে হতে দ্বিধায় পরে গেলাম। আমি কি তাহলে জীবন নামক দৌড়ে ব্যর্থ!

পাঠক, নির্বাচনী হলফনামা বলতে প্রার্থীদের যে আমলনামা বেরিয়েছিল তা পড়তে গিয়ে আপনার কি নিজেকে একবারও ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা বলে মনে হয়নি? ওরা রাজনীতির চাক হতে চুকচুক করে মধু লুটছে আর আপনি সে লোটায় উদ্বেলিত হয়ে তালি দিচ্ছেন, একবারও কি এরকম কিছু মনে হয়নি? স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের চেতনা, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, কাদির মোল্লা, খালেদা জিয়ার জন্মদিন, ফাঁসি – এসব কথন একবারও কি মনে হয়নি বাংলাদেশ নামক দেশটাকে নেংটা করার সিসিম ফাঁক মন্ত্র মাত্র? পড়ে থাকলে মনে আছে কি আলীবাবা চল্লিশ চোরের সে গল্প? আমার কিন্তু মনে আছে। কারণ আমার বন্ধু জর্জদের বাসায় আমি দেখেছি চেতনা বিকাশের এসব সৈনিকদের তৎপরতা। ১৫ই আগষ্ট ওদের বাসায় রান্না বন্ধ থাকে। ২১শে ফেব্রুয়ারী কেটে যায় শহীদ মিনারের পাদদেশে। ১৬ই ডিসেম্বর আসে মহোৎসবের প্রলয় নিয়ে, দলবেঁধে ছুটে যায় জাতীয় শহীদ মিনারে। ওরা রাজাকার নিধনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, খালেদা জিয়া উৎখাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আবার ১লা বৈশাখের সকাল কাটে পানি পান্তায়। কিন্তু দিনশেষ ওদের কুলায় ফিরতে হয়। এবং নামতে হয় বিরামহীন ধান্ধায়। এ ধান্ধা যেনতেন ধান্ধা নয়, দেশকে উলংগ করার ধান্ধা, ধর্ষনের ধান্ধা। তেতাল্লিশ বছর বয়সে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক বনতে চাইলে বাংলাদেশে রাস্তা একটাই, চেতনার পাইকারি ব্যবসা। বাকি সব ধাপ্পাবাজি, ধোকাঁবাজি, চাপাবাজি, ছলচাতুরি, ফটকাবাজি ।