
ভারতীয় অলিখিত ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদি আধিপত্যকামীদের একটা স্থুল কৌশল হল _ এভাবেই বার বার ‘৭১ এর ধূয়া তুলে পাকিস্তান জামাত-শিবির ইত্যাদি জুজু দেখিয়ে চলমান রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ‘বর্তমানের চালচিত্র’ কে আড়াল করে রাখার ধুরন্ধর এক অপকৌশল। ‘৭১ এর রাজাকারদের তুলনায় ২০১৩ এর রাজাকাররা অত মোটাদাগের নয়, অনেক বেশি চিকনদাগের সুক্ষবুদ্ধিসম্পন্ন ক্রিমিনাল। আগের মত মোটাদাগের অপরাধ করে ধরা খাওয়া বা জাতীয়-আন্তর্জাতিক-ঐতিহাসিকভাবে নিন্দিত হওয়ার বিপদ এড়িয়ে ধুরন্ধর ডিজিটাল কৌশলে ‘সাংবিধানিক’ উপায়ে রাজাকারির নিত্যনত্যুন পন্থা যেমন আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে, তেমনি সেগুলোকে মহিমান্বিত করার প্রয়াসে সাংষ্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক বিদূষকসুলভ চাটুকারিতা একটি আলাদা শিল্পের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমি কার পক্ষ নেব ? ‘৭১ এর প্রেক্ষাপটে আমি পশ্চিমা হানাদার ও তদীয় দোসরদের পক্ষ নিতে পারি না কারণ তারা অবর্ণনীয় জুলুম করেছে নিরস্ত্র নিরীহ সাধারণ জনগণের ওপর, মতাদর্শিক ভিন্নতার কারণে তো বটেই, সেই রাগ তুলতে গিয়ে যারা কোন দলের ছিল না সেই আপামর সিভিলিয়ান জনগণ তথা গোটা জাতির ওপরই শ্বাপদসুলভ রক্তলোলুপ হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। ‘ভারতীয় হিন্দু’ ‘পাকিস্তানের দুশমন’ ইত্যাদি জুজু দেখিয়ে সেই অজুহাতে বিরোধীদমনের নামে চলছে শহরে বন্দরে-গ্রামে গঞ্জে-মাঠে প্রান্তরে নির্বিচারে চালিয়েছে গুলি, বসতবাটি ধ্বংস-অগ্নিসংযোগ, অবিশ্রান্ত হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের ক্রমাগত দীর্ঘমেয়াদী কালোরাত্রির অদ্ভূতুড়ে আঁধারে ঘেরা অমাবস্যা।
সেই কারণে আমি একজন অতি সাধারণ, অতি নগণ্য মুসলিম হিসেবে ‘৭১ এর নরঘাতক জালিমদের সমর্থন করি না, করতে পারি না।
আজ এই ২০১৩ তে একজন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সাধারণ মুসলিম হিসেবে আমি কার পক্ষ নেব ? আজকের প্রেক্ষাপটে আমি ভারতীয় হানাদার ও তদীয় দোসরদের পক্ষ নিতে পারি না কারণ তারা ‘৭১ এর পশ্চিমাদের মত নগ্নভাবে না হলেও সুক্ষ কৌশলে আরো ভয়ংকরভাবে খামচে ধরেছে আমার মাতৃভূমির প্রিয় লাল-সবুজের পতাকার বুক। সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদি ভারতীয় হিন্দুদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দেশীয় দালালবাহিনী একে একে দেশের সম্পদ সব তুলে দিচ্ছে তাদের প্রভুর হাতে, দেশের প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, মানুষের ধন-মান-প্রাণ সবই অনায়াসে কুক্ষিগত করতে সহযোগীর অক্লান্ত ভূমিকায় পালন করে চলেছে তারা। ভারত থেকে লোক এনে দেশের মানুষকে হত্যা করাচ্ছে তারা। ‘জঙ্গি’ ‘জামাত-শিবির’ জুজু দেখিয়ে সেই অজুহাতে বিরোধীদমনের নামে চলছে শহরে বন্দরে-গ্রামে গঞ্জে-মাঠে প্রান্তরে নির্বিচারে চালিয়েছে গুলি, বসতবাটি ধ্বংস-অগ্নিসংযোগ, অবিশ্রান্ত হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের ধারাবাহিকতার ‘সূচনা’ হতে দেখছি। সাতক্ষীরায় ‘৭১ এর মতই হত্যা-লুটপাট-বসতবাটিতে অগ্নিসংযোগ _ এমনকি বুলডোজার নিয়ে গিয়ে বাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে আসা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে ৫০ জনের অধিক নারী সমভ্রম হারিয়েছেন, সমভ্রম হারানোর ভয়ে গ্রামত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক নারী।
তাহলে ২০১৩ তে জালিম কারা আর মজলুমই বা কারা সে প্রশ্ন নিজেকে কখনো করেছি ? ‘৭১ এর ব্যাপারে আমি যদি পূর্ব পাকিস্তানের আপামর মজলুম জনসাধারণের পক্ষ নিয়ে থাকি _ ২০১৩ তে এসে আমি নতুন মোড়কে প্যাকেট হয়ে আসা জালিম ভারতীয় রাজাকারদের পক্ষ নিতে যাব কেন ?

অনেকে বলেন ‘৭১ এ পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধাবস্থা ছিল সে কারণে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অগণিত সিভিলিয়ান হত্যা-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ-নির্বিচারে গুলি-ধর্ষণ এসব হয়েই থাকে, সেটা যুদ্ধেরই অঙ্গ। কিন্তু এই মাটির সন্তান হয়ে যারা এই দেশমাতৃকাকে, দেশমাতৃকার সহোদর-সহোদরাদের পিশাচসুলভ নীচতায় বিদেশী হানাদারদের হাতে হত্যা-ধর্ষণের জন্য তুলে দিতে পেরেছিল _ তাদের ক্ষমা করা অতি অতি দুঃসাধ্য ব্যাপার। ভাল কথা, তাহলে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ক্ষমতা হাতে পেয়েও কেন তাদের উপযুক্ত বিচার করা হল না ? কেন তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে এত সহজে ছেড়ে দেয়া হল ? ৪২ বছর ধরে রক্তবীজ থেকে বাড়তে বাড়তে বিশাল অরণ্যে রুপান্তরিত হতে দেয়ার পর এত যুগ পর এখন কেন এই প্রজন্মের ওপর এত বিশাল বিভক্তি-ধ্বংসযজ্ঞ-গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হল ? ‘৭১ ধূয়া বার বার তুলে প্রতারণাপূর্ণভাবে ২০১৩ এ এসে ভারতের সেবাদাসত্ব করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ১২টা যারা বাজাচ্ছে চোখের সামনে ভারত কর্তৃক নির্মমভাবে সবকিছু লুন্ঠিত হতে দেখেও সুশীলসমাজ এবং মানবতাবাদিরা নিশ্চুপ কেন ? কেন তারা বর্তমান এবং ভবিষ্যত বাংলাদেশের নৃশংস হত্যা দেখেও অন্ধের মত চোখ বন্ধ রেখে বার বার ৪২ বছর আগের অতীতের কথা নিয়ে এসে নাটকীয়তা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালায় ?
আজ যেসব যুবক-কিশোর-তরুণ জামাতশিবির করছে তারা কি ‘৭১ এ রাজাকার ছিল ? তাদের তো জন্মও হয় নি সেদিন। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পর পাইকারী হারে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষনা করে, ১৯৯৬ এ জামাতের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতার স্বাদ নেয়, একমাত্র বিএনপির সাথে জামাত জোটবদ্ধ হওয়ায় ‘রাজনৈতিক’ কারণেই কি তারা অনেকাংশে জামাতের বিরোধিতা করছে না ? চেতনার হোলসেলাররা যদি আদৌ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হত তাহলে অন্যান্যদের মত তাদেরও একেকজন রাষ্ট্রীয় সম্পদ পুকুরচুরি করে কেউ শতগুণ কেউ সহস্রগুণ ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি করে কিভাবে ? এই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ? তাহলে আর ১০টা চোরবাটপাড়ের সাথে তাদের পার্থক্য সূচিত হয় ঠিক কোন জায়গায় ?
আজ বাংলাদেশে ‘৭১ এর মত কোন ঘোষিত যুদ্ধাবস্থা নেই ঠিকই, কিন্তু ভারতীয় সাংষ্কৃতিক-সামরিক-রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক হানাদার দস্যুদের অঘোষিত কিন্তু ভীষণভাবে পরিচালিত এই আগ্রাসনে যারা দেশীয় তাঁবেদারের ভূমিকায় নির্লজ্জভাবে অবতীর্ণ হয়ে নিজের দেশমাতৃকার বিরুদ্ধে বীভৎস বিশ্বাসঘাতকের মতো দাঁড়িয়েছে _ আমার কাছে তাদের সাথে ‘৭১ এর রাজাকারদের কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য এতটুকুই যে ‘৭১ এর ঘটনা সম্পূর্ণভাবে ঘটে কালের আবর্তে মিলিয়ে গেছে, ২০১৩ এর রাজাকারদের বিশ্বাসঘাতকতা-নির্যাতন-লুটপাট রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে আমাদের চোখের সামনে ঘটছে।
‘৭১ আমাদের পূর্বসূরীদের অতীত _ ২০১৩ আমাদের রক্তাক্ত বর্তমান। যে সঙ্গীন মানবতাবিরোধী অপরাধে ‘৭১ এর অপরাধী নরাধমদের বিচার দাবি করছি, সেই একই যুক্তিতে ২০১৩ এর নব্য রাজাকারদের দুঃশাসন-গুম-খুন-হত্যারও আশু প্রতিকার চায় বাংলার জনগণ। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে হয়তো জনগণ নিজের হাতেই আইন তুলে নিতে বাধ্য হবে, যেমনটি হয়েছিল ‘৭১ এ, রাষ্ট্রের কাঠামো তখন চুর চুর করে চোখের সামনে ভেঙে পড়তে থাকবে তাসের ঘরের মত, মিলিয়ে যেতে থাকবে কর্পূরের মত আমাদের সাধারণ জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়া ৪২ বছরের অর্জন, অনিশ্চয়তার অজানা চোরাবালিতে অসহায়ভাবে তলিয়ে যেতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতকে ঘিরে দেখা শত স্বপ্নের স্বর্ণজাল _ কাজেই তার আগেই সচেতনভাবে জেগে উঠতে হবে বাস্তব দেশপ্রেমের মধুর জ্বালাময় কষাঘাতে _ অদেখা পূর্বসূরীদের প্রাগৈতিহাসিক গৌরবগাঁথায় নয়, নিজেদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বর্তমানের ঘূর্ণিতে সটান যোদ্ধার মত দুঃসাহসিক আগুনের পরশমণি বুকে নিয়ে।
Recent Comments