নির্বাচনমুখী আন্দোলন বনাম লতিফ কার্ড!

|| এ.কে.এম ওয়াহিদুজ্জামান ||

১৭ বছর আগে নিজে হাজ্জ্ব পালন করার পরও গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকা সফরের সময় হাজ্জ্ব নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। বিএনপিসহ এবং ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো তখন তাকে মন্ত্রীসভা থেকে অপসারণ এবং বিচার করার দাবী জানিয়েছিলো। সরকার সেটা মেনেও নিয়েছে। লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাকে মন্ত্রীসভা এবং আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। সেই গ্রেফতারী পরোয়ানা মাথা নিয়ে দেশে ফেরা এবং গ্রেফতার এড়িয়ে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করার পর হেফাজতে ইসলামীর হরতাল এবং ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচী বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন বিএনপিসহ গণতান্ত্রিক দলগুলো নির্বাচনমূখী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিএনপি’র সামনে এখন দুইটা পথ; লতিফ ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করা অথবা লতিফ ইস্যুকে উল্টো সরকারের কোর্টে ঠেলে দিয়ে নির্বাচনমূখী আন্দোলনটাই গড়ে তোলার চেষ্টা করা। ৯০ দশকে কম্যুনিজম বিরোধী স্বস্তা সেন্টিমেন্টের মৃত্যুর পর ইসলামী জঙ্গী বিরোধী স্বস্তা সেন্টিমেন্টের বাজার দর এখন চড়া। বিএনপি যদি এখন হেফাজতে ইসলামী এবং জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে লতিফ সিদ্দিকী ইস্যুতে আন্দোলন শুরু করে, তাহলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক বাজারকে কেবল আরেকবার দেখিয়ে দেবে যে, বিএনপি গণতন্ত্র নয় বরং জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রয়োজনে ৬মে ২০১৩’র মত আরেকটা ঘটনা ঘটিয়ে প্রমানও করে দেবে যে, বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঠেকাতে কেবলমাত্র আওয়ামী লীগই উপযুক্ত দল।

দ্বিতীয় পথ অনুসরণ করে বিএনপি যদি লতিফ ইস্যুকে উল্টো সরকারের কোর্টে ঠেলে দিয়ে বলে যে- সরকার তার বিচার করবে বলেছিলো এখন বিচার করুক, যদি বিচার না করে তাহলে সেটা সরকারের ব্যার্থতা। তাহলে বলটা সরকারের কোর্টে যাবে। সরকারকে তখন হয় লতিফ সিদ্দিকীর বিচার করতে হবে কিম্বা তাকে দিয়ে ভুল স্বীকার করিয়ে ক্ষমা প্রার্থনাশেষে তওবা করানোর ব্যবস্থা নিতে হবে, অথবা তাকে বিচারের আওয়তায় না এনে ইসলামিস্টদের আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে।

প্রথম ক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলামীর দাবী মেনে নিয়ে সরকার লতিফ সিদ্দিকীর বিচার করে, বা লতিফ সিদ্দিকী নিজেই হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় গিয়ে তওবা করে পুনরায় কলেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে একটা চমক সৃষ্টি করতে পারেন। যদিও এটা খুবই দুর্বল একটা সম্ভাবনা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ লতিফ সিদ্দিকী অনেক কাঠ-খড়-কেরোসিন পুড়িয়ে নিজের যাবতীয় দুর্নীতি ও অপকর্মের আলোচনা ধামাচাপা দিয়ে এখন সুশিল সমাজের মাধ্যমে দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীনের পাশে স্থান করে নিয়েছেন। এই স্থান থেকে সরে এসে নিজের দুর্নীতি ও অপকর্মের মামলাগুলোকে নিশ্চই তিনি প্রাধান্য দিয়ে আলোচনায় আনতে চাইবেন না।

Untitled-1

এমতাবস্থায় দ্বিতীয় বিকল্প অনুযায়ী, হেফাজতে ইসলামীর দাবী না মেনে নিয়ে সরকার তাদেরকে আন্দোলন করার সুযোগ করে দিতে পারে। যার নমূনা আজ ২৪ নভেম্বর দেখা গেছে। বিএনপির কোন সংগঠন পুলিশের গ্রেফতার-পিটুনীর কারণে রাস্তায় মিছিল করতে না পারলেও হেফাজতে ইসলামী মিছিল করতে পারছে। মানে সরকার তাদেরকে মিছিল করার সুযোগ দিচ্ছে। এটাকে তারা সাফল্য ভেবে চুড়ান্তভাবে ঢাকা অবরোধের ডাক দিলেও সম্ভবত সরকার সেটা করতে দেবে। এতে দ্বিমুখী লাভ। প্রথমত: এতে করে সরকার বিরোধী আন্দোলন করার মত শক্তিকে দ্বিখণ্ডিত করা যাবে, যাতে লাভবান হবে আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয়ত: জঙ্গীবাদ তত্ত্ব প্রচার ও প্রমান এবং দমনের দক্ষতা প্রমাণের মোক্ষম সুযোগ। সরকার আগের মতই বিনাবাঁধায় হেফাজতে ইসলামী ও অন্য ইসলামিস্ট দলগুলোকে মিছিল, সমাবেশ এবং ভাংচুর করতে দিয়ে সেই দৃশ্য টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করে প্রথমে বর্হিবিশ্বকে জঙ্গীবাদের উত্থান দেখাবে, তারপর তা কঠোর হাতে দমন করে নিজেদের সক্ষমতা দেখাবে।

কিছুদিনের মধ্যেই নেপালে নরেন্দ্র মোদীর সাথে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ হবে। তারপর দেশে আসবেন নিশা দেশাই বিসওয়াল। সেই সময় মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রসঙ্গে আলোচনা এড়ানোর জন্য জঙ্গী ইস্যুর চেয়ে গরম ইস্যু আর কোনটা হতে পারে? মোদি সরকার আওয়ামী লীগের সাথে সাধারণ বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষা করলেও ভারতের পলিসিমেকার সাউথ ব্লক এখনো আওয়ামী লীগেরই কট্টোর সমর্থক। লতিফ সিদ্দিকী সেই ভারত হয়েই বাংলাদেশে ফিরেছেন। কাজেই তিনি আগুনে ঝাঁপ দিতে নয়, বরং আগুন নিয়ে খেলা করতে এসেছেন। এখন তার লেজে আগুন দিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধানো দেখার অপেক্ষা।

খালেদ জিয়ার ভাষন এবং আরো কিছু আলোচনা।

মাহবুব মিঠু।

এক।।

সরকারের তোপের মুখে পড়ার ভয়ে কিম্বা সরকারের কাছ থেকে মন্ডা মিঠাই খাওয়ার লোভে দেশের অধিকাংশ মূল ধারার মিডিয়া কেন জানি বিএনপির প্রতি বিমাতাসুলভ। বিএনপি যখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে তখন এই শ্রেণীটা বলে, দলটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এভাবে কি সরকারের পতন সম্ভব?

ওনারা মূলতঃ ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনের কথা দাঁতের মাঝে আটকে রেখে বুঝাতে চান। ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি, কোন স্বৈরাচারী সরকার কিম্বা ফ্যাসিবাদী সরকারকে হঠাতে একমাত্র উপায় কঠোর আন্দোলন। সেটা সহিংস আন্দোলনেও রূপ নিতে পারে সরকারী পেটোয়া বাহিনীর কাজের উপর নির্ভর করে। যেমন ধরুন, সিরিয়ার আসাদ কিম্বা লিবিয়ার সাবেক এক নায়ক গাদ্দাফীর মতো শাসকদের  হঠানো কি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সম্ভব?

যে প্রসঙ্গে আলাপ করছিলাম, যখন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকেও আওয়ামিলীগ সরকার পুলিশ এবং দলীয় গুন্ডাদের লেলিয়ে দিয়ে পন্ড করে যাচ্ছিল, তার প্রতিক্রিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলন এক সময়ে সহিংস রূপ নেয়। এটাই হয়তো চাচ্ছিল উল্লেখিত চিহ্নিত মিডিয়াগোষ্ঠী। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবার তারা বলতে থাকে, সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বিরোধীজোট জাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

কি তাজ্জব কথা! এই সেদিনও তারা বিরোধীজোটের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এখন তাদের মুখে ভিন্ন সুর। আসলে এটা একটা অপকৌশল, যার মাধ্যমে বিরোধীজোটের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে দিয়ে সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করা। নব্বইর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও হরতাল, ভাঙচুর, মারামারি ছিল তৎকালীন জাতীয় পার্টি এবং তার অঙ্গ সংগঠনদের সাথে। ওটাও কি ‘সহিংস’ আন্দোলন ছিল? শান্তিবাদী আন্দোলনে এরশাদকে হঠানো সম্ভব হোত? বর্তমান এবং তখনকার পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য কতোটুকু? বরঞ্চ মিডিয়াগুলো যদি সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার উন্মাদনার প্রতিবাদ করতো, তাহলে সরকারের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে খুব সহজেই তারা একটা নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হোত। এর ফলে দেশের অর্থনীতি হরতালের কবল থেকে যেমন মুক্তি পেত, ঠিক তেমনি দেশের মানুষের জীবনও বিপন্ন হোত কম। সরকারের এই একগুঁয়েমি মনোভাব সৃষ্টিতে এই শ্রেণীর মিডিয়ার একটা প্রবল ভূমিকা রয়েছে।

 

দুই।।

৫ই জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের পরে তৎকালীন ১৮দলীয় জোটের (বর্তমান ১৯দলীয় জোট) আন্দোলন জোরালো হবার পরিবর্তে মুখ থুবড়ে পড়ে। এটা নিয়েও একই মহল বিরোধীদলীয় জোটকে বিভ্রান্ত করতে ছাড়েনি। আন্দোলন দুর্বল হবার কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে, বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়াকে। এটাও একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার মাধ্যমে দল বা জোটের ভিতরে নির্বাচন বিষয়ে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করা। খালেদা জিয়া গত ৪ঠা ফ্রেব্রুয়ারীর ভাষনে এই অভিযোগকে সরাসরি উড়িয়ে দেন।

বিতর্কিত নিবাঁচনের পরে আন্দোলন থিতিয়ে যাবার পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচনের পরপর এক ভাষনে খালেদা জিয়া রাজপথের তীব্র আন্দোলন থেকে সরে এসে যে গতানুগতিক আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষনা করেন, এতে দলের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, ১৮দলীয় জোট কি তবে পরোক্ষভাবে এই বিতর্কিত নির্বাচনকে মেনে নিল? এই বিষয়টা তখন পরিস্কার না হলেও একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিরোধীজোট আপাততঃ সরকারের কৌশলের কাছে পরাস্ত।

কেন এমনটি হোল? বিরোধীজোট জমে ওঠা আন্দোলনকে টেনে নিতে পারল না কেন?

অনেকেই মনে করেন, বিরোধীজোটের অতিমাত্রায় কূটনীতিক নির্ভর রাজনীতিই তাদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এই মূল্যায়নটা মিথ্যে নয়। তবে এটা আসল কারণ নয়। এটা দ্বিতীয় স্তরের কারণ; অর্থাৎ এই কারণ সৃষ্টিতে আরো অনেকগুলো কারণ কাজ করেছে। সম্ভবতঃ খালেদা জিয়া বাধ্য হয়েছিলেন কূটনৈতিক নির্ভর হতে। বাঙলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এতোটা গভীরভাবে অতীতে আর কখনো বহিঃশক্তির দ্বারা নিয়ন্রিত হতে সম্ভবতঃ দেখা যায়নি। ভারত নিজেদের স্বার্থে বাঙলাদেশের রাজনীতিতে আপত্তিকরভাবে যু্ক্ত হয়ে পড়ে। প্রতিবেশী শক্তিশালী দেশের পরোক্ষ এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামি সরকার অনেকটা দুর্দমনীয় হয়ে পড়ে। সে কারণেই বিরোধীজোটকে বাইরে বিকল্প শক্তিকে মটিভেট করা প্রয়োজন ছিল।

সেটা করতে গিয়ে এতোটা কূটনীতিক নির্ভর না হলেও চলতো। কিন্তু অন্য কারণে সেটা হয়তো সম্ভব হয়নি। কথিত অভিযোগ মোতাবেক, বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা হামলা মামলার ভয়ে সরকারের সাথে আঁতাত করে। এরাই আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করে। দলের স্বিদ্ধান্ত খুব সহজেই প্রতিপক্ষের কাছে চলে যেত। কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণ না থাকলেও ঢাকা বাদে সারাদেশে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। সরকারীদলের কোন নেতা এলাকায় পর্যন্ত যেতে সাহস করতো না। ঢাকায় বিরোধীজোটের  করুণ পরিণতির জন্য দায়ী কিছু কেন্দ্রীয় নেতাদের কাপুরুষতা এবং আপষকামীতা। অন্যদিকে, সাদেক হোসেন খোকার সাথে মির্জা আব্বাসের ব্যাক্তিগত দ্বন্দ্বও বড় ভূমিকা রাখে। সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপিদলীয় কমিশনার আলমকে হত্যা এবং গুম করে যে গুমের রাজনীতি শুরু হয়, ইলিয়াস আলীকে কথিত হত্যা এবং গুমের মাধ্যমে তার ষোলকালা পূর্ণ হয়। বিরোধীজোটের নেতাদের মনে গুমের আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়ে সরকার তাদের ঘরে বসিয়ে রাখে। সরকারের অনমনীয়তা এবং এর কারণে সহিংসতা বৃদ্ধি পেলে আবারো অনির্বাচিত সরকার জাতির কাঁধে চেপে বসতে পারে, এই আশঙ্কায় বিরোধীজোট অনেকটা ধীরে চলো এবং কূটনীতিকদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা করে।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ জোটের মধ্যে বিশেষ করে বিএনপি এবং জামাতের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। এটা হয়েছে মূলতঃ জামাতের দলীয় স্বার্থে জোটের কমসূচীকে ব্যবহার করার জন্য। সরকার বিরোধী আন্দোলন এবং জামাতের যুদ্ধপরাধী নেতাদের বিচারের রায় একটা পর্যায়ে সমান্তরালে চলতে থাকে। একের পর এক জামাতের কেন্দ্রীয় নেতাদের ফাঁসীর রায় তাদেরকে বেপরোয়া করে তোলে। জোটের অন্যতম শরীক দল হিসেবে এর কিছুটা দায়ভার বিএনপির কাঁধেও চাপে। জামাত দলগতভাবে সহিংসতার পাশাপাশি জোটের কর্মসূচীতেও কৌশলে তাদের দলীয় অর্থাৎ যুদ্ধপরাধী ইস্যুকে ঢুকিয়ে দেয়। জোটের যে কোন কর্মসূচীতে আগেভাগে মঞ্চের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে তারা চিহ্নিত কিছু যুদ্ধপরাধীদের ছবি সম্বলিত পোষ্টার ব্যানার নিয়ে প্রচারণার সাথে সাথে মুক্তির দাবীতে শ্লোগান তুলে। এভাবেই জোটের কর্মসূচীতে মূল দাবী আড়াল হয়ে পড়ে যুদ্ধপরাধীদের মুক্তির ইস্যুটা জামাতশিবিরের কারণে মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারীদল এই সুবর্ণ সুযোগটার অপেক্ষায় ছিল। সমর্থিত মিডিয়ার মাধ্যমে তারা প্রচারণায় সফল হয় যে, ১৮দলীয় জোটের সমস্ত কর্মসূচী মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে জামাতের যুদ্ধপরাধী নেতাদের বাঁচানোর চেষ্টা। সকলকে একটা বিষয় বুঝতে হবে, যুদ্ধপরাধী ইস্যুকে সরকার বিরোধীদলকে দমানোর জন্য ব্যবহার করার কারণে এবং প্রশ্নবিদ্ধ ট্রাইবুনালের জন্য অনেকে বিচার প্রক্রিয়াকে মেনে না নিলেও দেশের সিংহভাগ মানুষ যুদ্ধপরাধীদের বিচার চায়। নিজামী, গোলাম আযমদের মতো বিতর্কিত ব্যাক্তিদের পক্ষে প্রচারণা তাই জোটের বড় দল বিএনপির অনেক কর্মী সমার্থকরাও ভাল চোখে দেখেনি।

 তিন।।

৫ই জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের পরবর্তী খালেদা জিয়ার প্রথম ভাষন শুনে যারা আন্দোলনের গতি প্রকৃতি নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, ওনাদের গত ৪ঠা ফ্রেব্রুয়ারীর ভাষনের পর সেই হতাশা অনেকটা কেটে যাবার কথা।  এই ভাষনটি নানাভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এখানে খালেদা জিয়া বেশ কিছু ইঙ্গিত দেন। তিনি উল্লেখ করেন, বিরোধীজোটের বর্তমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। দাবী মানার জন্য সরকারকে আরেকটু সময় দেয়া। একগুঁয়েমি পরিত্যাগ না করলে খুব তাড়াতাড়ি আবারো কঠোর কর্মসূচীতে ফিরে যাবে। এই ফাকে তারা দল এবং জোটকে গোছানোর কাজগুলো হয়তো সেরে নেবে। উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিএনপি স্থানীয় পর্যায়ে দলকে পুণরুজ্জীবিত এবং চাঙ্গা করার কাজ হাতে নিয়েছে। এই নির্বাচনে বিরোধীজোট যদি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের মতো ফলাফল দেখাতে পারে, তাহলে একদিকে যেমন জোটের নেতাকর্মীরা মনোবল ফিরে পাবে এবং তার উল্টোটা ঘটবে প্রতিপক্ষের শিবিরে।

আরো কিছু কাজ তিনি দলের পক্ষ থেকে হাতে নিয়েছেন এবং তার ফলাফলও ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছেন। মামলায় আক্রান্ত নেতাকর্মীদের জামিনের ব্যবস্থা করে আটকে পড়া নেতাকর্মীদের আন্দোলনে ফিরিয়ে আনছেন। তিনি দলীয় কর্মীদের উপর হামলা মামলা নির্যাতন এবং হত্যা ও গুমের যে ডাটাবেজ করেছেন, সেটা আন্তর্জাতিক মহলকে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সাহায্য করবে।  ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালতে সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার কয়েকটি মামলা হয়েছে। এই ডাটাবেজ ভবিশ্যতে এই মামলার রায়কে তথ্য উপত্য দিয়ে সাহার্য করবে। তাছাড়া কর্মীদেরকে আশ্বস্ত করবে তাদের আত্নত্যাগ বৃথা যাবে না। দল কিম্বা জোট ক্ষমতায় এলে এর বিচার তারা পাবে। দলে তাদের ত্যাগ স্বিকারের যথাযথ মূল্যায়ন হবে।

 

৪ তারিখের ভাষনের শেষ পর্যায়ে জনৈক সাংবাদিকের জামাত বিষয়ক প্রশ্নের জবাব খালেদা জিয়া যেভাবে দিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে জামাত বিরোধীজোটে শেষ পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে। তবে কিছুদিন আগে জামাত প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থানের সাথে সর্বশেষ অবস্থান মূল্যায়ন করলে বুঝা যায়, কিছু বিষয়ে জামাতের সাথে বিএনপির একটা বোঝাপড়া হয়েছে। ইতিপূর্বে জামাত যেভাবে জোটের কর্মসূচীতে তাদের যুদ্ধপরাধী নেতাদের মুক্তির ব্যাপারটা সামনে নিয়ে আসত, সেটা থেকে তারা হয়তো বিরত থাকবে। জোটে থেকে জোটের বাইরে দলীয় কর্মসূচীতেও এই ইস্যুতে তারা আগের মতো সহিংসতায় যাবে না। ভিন্ন একটা মামলায় নিজামীর বিরুদ্ধে ফাঁসীর রায়ের পরবর্তীতে জামাতের তৎপরতা দেখে সে কথার প্রমাণ মেলে।

সরকারীদলের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে বিএনপিকে জামাতের সঙ্গ ছাড়তে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই উপদেশ দেবার নৈতিক কোন অধিকার তাদের আছে কি? ইতিপূর্বে ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে আওয়ামিলীগ জামাতকে সাথে নিয়ে নির্বাচনে গিয়েছিল। ৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছে তারা। বিরোধীদলে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা নিজে বলেছিলেন, তিনি জাতীয় পার্টি এবং জামাতেরও নেতা। অতীত এই জামাত সম্পৃক্ততার জন্য আওয়ামিলীগ কিম্বা শেখ হাসিনা কি ক্ষমা চেয়েছেন?

দেশের মূলধারার মিডিয়াগুলো রাজাকার এবং যুদ্ধপরাধী বিষয়ক সরকারীদলের সম্পৃক্ত থাকার কথা চেপে গেলেও নানান সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সেটা কিন্তু চাপা থাকেনি। বিএনপির সাথে জামাতের সম্পর্কচ্ছেদ নিয়ে আওয়ামিলীগের অতি মাত্রায় আগ্রহকে তাই অনেকেই ভিন্ন নজরে দেখছেন। তাছাড়া তত্ত্বাবধায়ক এবং যুদ্ধপরাধী দু’টো ভিন্ন বিষয়। এটা কোন শর্ত সাপেক্ষ বিষয় নয়। জামাতের সাথে রাজনৈতিক জোট করে বিএনপি রাজাকার যুদ্ধপরাধী ইস্যুতে যে অন্যায় কাজটি করেছে, আওয়ামিলীগ তারচেয়েও বেশী অন্যায় কাজ অতীতে যেমন করেছে, ঠিক এখনো সেগুলো করে যাচ্ছে। প্রথমতঃ শেখ হাসিনার মেয়ের শ্বশুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধের জোরাল অভিযোগ আছে। সোস্যাল মিডিয়াতে প্রচার পাওয়া একটা ছবিতে দেখা যায়, উনি তার বেয়াইকে চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে যত্ন আত্নি করে খাওয়াচ্ছেন। ওনার নিজ দলে বর্তমানেও অনেক নেতা আছেন যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ছিলেন এবং সেই সাথে অনেকের বিরুদ্ধে যুদ্ধপরাধের অভিযোগও আছে। ৯০ এর স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে এখনো ওনার গাঁটছাড়া সম্পর্ক।

 

সব মিলিয়ে বিএনপির আপাততঃ আন্দোলন থেকে সরে আসা পরাজয় নয়, বরং বাস্তবতার নিরীখে এটা সাময়িক পশ্চাদপসরন। খালেদা জিয়ার সর্বশেষ ভাষন, নেতাকর্মীদের অনেক আশংকা কাটিয়ে দেবে। হতে পারে এটা সরকারী হামলা মামলায় বিপর্যস্ত নেতাকর্মীদের জন্য মৃতসঞ্জীবনী।