খন্দকার রাক্বীব, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
raquib_bdf@yahoo.com
ক্ষমতার প্রশ্নে খুব বড় দু’জন তাত্ত্বিক হলেন গ্রামসি আর ফুকো। গ্রামসির বক্তব্য ছিল হেজেমনিক লোকরা দলিত শ্রেনির লোকদের উপর ক্ষমতাবান। ফুকো এই মতবাদ খারিজ করে দিয়ে বলেন ‘সাব-অল্টার্ন’রাও ক্ষমতাবান হইতে পারে। তার বিখ্যাত উক্তি ছিল ‘পাওয়ার ইজ ইভরিহোয়ার’।
ফুকোর এই বক্তব্য আমার চিন্তার নতুন ধার খুললো। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে বসে ওরিয়েন্টাল ডিসকোর্স খারিজ করে পশ্চিমা কিছু তাত্ত্বিকের তত্ত্ব নির্ভর করে আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করি তা যথার্থ না। আমাদের জানা কথা যে উপমহাদেশে ‘মেইনস্ট্রিম’ শিক্ষাধারার বাইরে মাদ্রাসা শিক্ষার ‘ইন্সটিটিউশনালাইজেশন’ শুরু হয় মূলত ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পরে, এক ধরনের উপনিবেশবিরোধি আন্দোলনের মোড়কে। ১৮৩১ সালে বালাকোটের যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলিম শিক্ষাবিদরা এবং ফারায়েজিরা একটা বিশাল ধাক্কা খায়। পরবর্তিতে ১৮৫৭সালে সিপাহি বিপ্লবে ফারায়েজি মুসলিমরা উপনিবেশবাদবিরোধী সিপাহি আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করে আবার পরাজিত হয়। যে পরাজয়ের মাশুলও তাদের দিতে হয় চরমভাবে। শেরশাহ’র ‘সড়ক-ই-আজম’ এর পাশে এমন কোন গাছ ছিলনা যার পাশে মুসলিম উলামাদের লাশ ঝুলানো ছিলনা।
উপনিবেশবাদি শক্তির বিরুদ্ধে মুসলিম উলামারা যখন এভাবে টিকতে ব্যর্থ হচ্ছিল তখন তারা উপনিবেশবিরোধি আন্দোলনের চিহ্ন আর নিজস্ব স্বকিয়তা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে সমাজের মূল স্রোতধারার বাইরে চলে যায়। ফারায়েজিদের সহায়তায় নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। অসংখ্য মাদ্রাসা-মক্তব তৈরি করে। মাওলানা নানুতবি এসময়ে তৈরি করেন দেওবন্দ মাদ্রাসা।
তারা উপনিবেশবাদবিরোধি সংগ্রামে পর্যদুস্ত হয়ে এক ধরণের রেসিস্ট্যান্স মনোভাব নিয়ে ‘প্রান্তিক’ পর্যায়ে চলে যায়। আজো তারা ফিরে আসেনি। আমরাও তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছি, কখনো কাছে টানার চেষ্টা করিনি, সংকীর্ন রাজনৈতিক কারণ আর একান্ত প্রয়োজন ছাড়া। তাদের সুযোগ-সুবিধা, সুখ-দুঃখ তাদের ভাষায় না বুঝে আমাদের ভাষায় বুঝতে চেয়েছি। আমরা নিজেদের ‘কেন্দ্র’ ভেবে ওদের ভাবলাম ‘প্রান্তিক’ হিসেবে। প্রান্তের ক্ষমতায়ন অস্বীকার করলাম, যেমন করি প্রান্তে যেতেও। যেটা ছিল আমাদের মারাত্মক ভুল।
পবিত্র কুরআনে ‘সূরা ইয়াছিনে’ পড়েছিলাম ‘‘জনপদের প্রান্ত থেকে এক লোক শহরবাসির কাছে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল ‘হে আমার জনপদের লোকেরা তোমরা দয়াময় আল্লাহ্র এ রসুলদের অনুসরণ কর। এরা এমন রসুল যারা তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চায় না।’ যারাই তার অনুসরণ করবে তারাই হবে হেদায়াত প্রাপ্ত। ……আফসোস যদি আমার জাতি এটা জানতে পারত(আয়াত-২০-২৬)’’
উপরের এই আয়াত সমূহ আমাকে খুব ভাবিয়েছে এই যুক্তিতে যে, এখানে পষ্টভাবে প্রান্তিক শক্তির কথা বলা হয়েছে। আমরা যারা নিজেদের কেন্দ্রের মানুষ ভাবি, আমাদের জানার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি থাকে, যা আল্লাহ’র ভাষায় ‘আফসোস যদি কেন্দ্রের লোকরা এটা জানত’। এটাও পষ্ট যে, প্রান্তিকরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রের থেকেও ভালো যানে, এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলও বেশী। যা আমরা বুঝতে পারি না, অনেক ক্ষেত্রে অস্বীকার করি। আজ আমাদের মাঝে কেন্দ্রে যাবার প্রবনতা বেশী, কেউ প্রান্তিক হতে চায় না। অথচ আরাফাতের ভাষণের পর ইসলাম ধর্মের প্রচারকরা সবাই প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে। উপনিবেশবাদি আর সাম্রাজ্যবাদীদের দেখি তারাও প্রান্তে প্রান্তে ছড়ানো। মার্কিন গবেষকদের একটা বিশাল অংশ আছে যারা কখনো তাদের নিজ দেশের রাজধানী শহরেও যায়নি, কিন্তু ঠিক-ই মধপ্রাচ্যের কোন একটা অঞ্চলে এসে আরবি ভাষা শিখে নিজের থিসিস দেশে গিয়ে জমা দিচ্ছে। আমাদেরও প্রান্তে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমেরিকা না, আফ্রিকাতেও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করা যায় সে চেতনা লালন করা দরকার।
মাদ্রাসা শিক্ষিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাই বলা চলে নিজেদের অবস্থান থেকেও ক্ষমতাবান। মনে রাখা দরকার, একরোখা চিন্তা অনুকরণে আমরা যখন এগ্রিকালচারকে এগ্রিবিজনেসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি, তখন তারা আজও আমাদের সে আবহমান ‘গ্রামীণ’ সংস্কৃতি আর এগ্রিকালচারকে টিকিয়ে রেখেছে।
রেনেসাঁ যুগে অসংখ্য পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের অনেকের লেখায় দেখেছি, আমাদের ভারতীয় মুসলিমদের লেখার উদ্ধৃতি দিতে। আমাদের মনে রাখা দরকার ১৮৩৫সালের আগে এখানকার মুসলিমদের ভাষা ছিল ফার্সি আর উর্দু। মুসলিমরা ঐ সময়ে সাহিত্য-কলা-সমাজ-বিজ্ঞান-আইন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অসংখ্য বই লিখেছে আরবি-ফার্সি-উর্দু ভাষায়। যেগুলো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সম্পদ, আমাদের গর্ব। এগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, যা সংরক্ষন করা জরুরী। রাজা রামমোহনের পরে এগুলো নিয়ে খুব কম লেখালেখি হয়েছে। আমাদের জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক একসময় আফসোস করেছিলেন আমাদের মাঝে ‘আরবি-ফার্সি-উর্দু’ ভাষা চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে বলে। মাদ্রাসা শিক্ষিতরা এখনো এগুলো ধারণ করে-লালন করে, কিন্তু প্রকাশ খুব কম-ই করে।
সম্প্রতি তাদের সরকারি স্বীকৃতির কথা উঠেছে, কিন্তু আমরা আবার আগের ভুল করছি। আমাদের মত করে তাদের সমস্যা ব্যাখ্যা করছি, তাদের উপর আমাদের চিন্তা চাপিয়ে দিচ্ছি। তাদের সুযোগ-সমস্যা তাদের মত বুঝতে চাই নি। তাদের সমস্যা তাদের মুখে শুনতে হবে, তাদের মত করে তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের মত করে ‘মেইনস্ট্রিম’ না ভেবে তারা কিভাবে তাদের ‘মেইনস্ট্রিম’ ভাবছে সেটা বিবেচনা করতে হবে। তবেই প্রান্তিকতার বয়ান একটা সুনির্দিষ্ট যথার্থ জায়গায় নিজেকে সমাসীন করতে পারবে।
Curious: Should Hathazari madrasah become a university like Al Azhar? What do you think?