শাহবাগীদের দেশপ্রেম

19

এই শিরোনামের জন্য আমি লজ্জিত এবং দুটো ব্যাখ্যা প্রয়োজন বলে মনে করি। প্রথমত: শাহবাগী বলতে হালকাভাবে যাদের বোঝানো হয় তারা অনেকেই এই নামে ডাকাটাকে অপমানজনক মনে করেন। তবে এই বিশেষ গোষ্ঠীকে এছাড়া অন্য যেসব শব্দে বিশেষায়িত করা হয় যেমন চেতনা-ব্রিগেড, চেতনাইজড – সেগুলো আরো আপত্তিকর মনে হয়েছে। তাই এ লেখায় অপেক্ষাকৃত কম আপত্তিকর বিশেষ্যটায় আস্থা রাখা হোলো – আশা করি আপনারা ব্যাপারটা স্পোর্টিংলি নেবেন।

দ্বিতীয়ত: অনেকেই আশা করেন যে কারো দেশপ্রেম নিয়ে ক্রিটিক করতে হলে নিজের দেশপ্রেম স্পষ্ট করাটা জরুরী। এই প্রসঙ্গে ভণ্ডামীর  কোনো অবকাশ যেন না থাকে সেজন্য প্রথমেই বলে রাখি, আমি নিজেকে দেশপ্রেমিক বলে দাবী করি না। আধুনিক কালে যেই বিশেষায়িত আবেগকে “দেশপ্রেম” হিসাবে হাজির করা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, আমি তার ঘোরতর বিরোধী – কিন্তু সেটা ভিন্ন আলাপ। যারা দেশপ্রেমের সাগর কেচে ফেলেন অনুদিন, তারা যে স্ট্যান্ডার্ডকে দেশপ্রেম বলেন – কথা দিচ্ছি আমি কেবল সেই স্ট্যান্ডার্ড নিয়েই কথা বলবো। নিজের বিশ্বাস টেনে এনে ঘোট পাকাবো না – এটা আমার প্রতিশ্রুতি।

প্রথম নোক্তা: কারা শাহবাগী?

অনেকগুলো মেয়ের মজলিশে সুন্দরীতমাটি কে – এটি সনাক্ত করা খুব সহজ – সবাই ঠিক জেনে যায় পলকেই – কিন্তু ব্যাখ্যা করাটা কঠিন। শাহবাগী কে, এটাও ব্যাখ্যা করা সহজ না – you just know it। কিন্তু প্রয়োজন আছে ব্যাখ্যা করার। আমি একটা এসিড টেস্ট বের করেছি – শাহবাগী শনাক্ত করবার। অনেকটা সাইকোলজিকাল টেস্টের মতোন একটা প্রশ্ন।

ধরা যাক (আবারও বলছি – ধরা যাক। বাস্তবে এই অবস্থা তৈরী হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই) সৌদী আরব বললো যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে হবে। যদি না করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব শ্রমিকদের দেশে ফেরৎ পাঠানো হবে। কথার কথা হিসাবে ধরে নিচ্ছি যে বাংলাদেশের রেমিটেন্সের ৮০ ভাগ আসছে সৌদি আরব থেকে এবং রেমিটেন্স বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়ের খাত – অঙ্কের হিসাবে জিডিপির ৫০ শতাংশ। এমন অবস্থা হলে আপনি কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার পক্ষে থাকবেন?

আমার পরিচিত যে কজন শাহবাগীকে জিজ্ঞেস করেছি সবাই বলেছেন যে না, বিচার বন্ধ করা যাবে না। বাকীরা স্বাভাবিক অবস্থায় যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইলেও এমন অবস্থায় পিছু হটবেন। (দয়া করে এটাকে আক্ষরিক অর্থে এসিড টেস্ট মনে করবেন না – এটি আমার পর্যবেক্ষণ মাত্র)

অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের বিচারকে শাহবাগীরা স্থান, কাল, পাত্র, বাস্তবতা এসবের ঘেরাটোপে বাঁধতে রাজী নন, এই দাবী এবং এই প্রসঙ্গটি তাদের কাছে একটি আইনী প্রসঙ্গ যতোটুকু তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী একটি “পবিত্র” বিষয়, “চেতনার” বিষয়। স্পষ্টতই যে অপরাধ তারা নিজেরা করেন নি (অর্থাৎ চল্লিশ বছর ধরে বিচার না হওয়াটা) সে অপরাধের দায়ভার নিজেদের ওপর চাপিয়ে তারা উচ্চ নৈতিকতায় আক্রান্ত হন (তারা প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন) এবং সেই অপরাধের শাস্তি চাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের পরিশুদ্ধ/পবিত্র করে তুলতে চান। পুরো ব্যাপারটাকে তারা প্রচুর ও প্রচুর সিম্বলিজম এবং শক্তিশালী সংস্কার সহযোগে ধর্মাচারের খুব কাছাকাছি নিয়ে যান।

Image

আমি এই মানুষগুলোকে খুব গুরুত্বসহকারে ও কৌতুকভরে পর্যবেক্ষণ করি, বোঝার চেষ্টা করি। যে বিশেষত্ত্ব আমি সবসময় লক্ষ্য করি তা হলো – দেশ, ৭১, গণতন্ত্র, জামাত, পাকিস্তান, বঙ্গবন্ধু এবং ছাগু – এসব শব্দের উপূর্যপুরি ব্যবহার, অবিরাম ব্যবহার। যেকোনো সচেতন পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে তারা গণতন্ত্র, পশ্চিমা “উদারনৈতিক” মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমকে খুবই উচ্চ আদর্শ মানেন এবং সে মতে অনুশীলনও করেন।

কিন্তু বাস্তবটা ভিন্ন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হলে তাদের প্রায় সবার প্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে যে শেখ হাসিনা একটি এক ব্যক্তির আজ্ঞাবহ গোত্রে পরিণত করেছেন তার বিরুদ্ধে অন্তত একটা বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান নেয়ার কথা ছিলো। আওয়ামী লীগের হয়ে এলেকশান করা এক রাজনীতিবিদ আমাকে বলেছেন যে শেখ হাসিনার চেয়ে বড় একনায়ক ভারতবর্ষের ইতিহাসে কখনো আসে নি। যতোবড় একনায়কই হোক, অন্তত পার্টি-মেন কিংবা জেনারেলদের সাথে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত দেন। সিনিয়র মেম্বারদের মতামত আপনি নেবেন কি না সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ কিন্তু একনায়করা অন্তত আলোচনা করেন। শেখ হাসিনা এ প্রয়োজনটুকুও বোধ করেন না। দলের মহাসচিবও জানেন না তিনি কী করবেন।

তাদের প্রিয় দলের নেত্রী যে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুরো দেশটাকে বিস্ফোরণমুখ করে ফেলেছেন এবং এর দায়ভার যে প্রায় এককভাবে তার (আওয়ামী লীগের বহু দায়িত্বশীল নেতা পার্টির ভেতরে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের বিরোধিতা করেছেন বলে তাদের দায়ভার কম) – এই কথা কোনো সুস্থ মানুষ অস্বীকার করতে পারবেন বলে মনে হয় না, কিন্তু বিস্ময়করভাবে নন-রেসিডেন্ট শাহবাগী, যাদের অনেকেই খুব ভালো পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ডিগ্রী করছেন তারাও কোনো উচ্চ-বাচ্য করেন না। এমন কি অনেকে এখনো এই বিষয়ে হাসিনাকে সমর্থনও করেন। এত মানুষ মারা যাচ্ছে এক ব্যক্তির এরকম গোয়ার্তুমির কারণে – দেশপ্রেমিক হলে এই অবস্থা জাস্টিফাই করার কথা ছিলো না।

এ পর্যবেক্ষণ থেকে আমি প্রথমত এই সিদ্ধান্তে আসি। আওয়ামী লীগের পক্ষে এমন কোনো ভুলই করা সম্ভব না যার কারণে শাহবাগীরা তাদের সমর্থন তুলে ফেলবেন এবং বিএনপির পক্ষে এমন কোনোই ভালো কাজ করা সম্ভব না যার কারণে তাদের সমর্থন করা যায়। চল্লিশ বছর আগে যে যা করেছেন সেটিই চূড়ান্ত ও পরম। অনুভব করি যে অন্তত রাজনৈতিক সমর্থনের ব্যাপারে তারা ধার্মিকদের মতোন আচরণ করতে সচ্ছন্দ।

Image

কিন্তু এটা কোনো অভিনব বিষয় না। বিএনপির সমর্থকদের মধ্যেও আমি এ ধরনের মানুষ দেখেছি। আমার কাছে অভিনব লেগেছে দেশ ও দেশপ্রেম – এই বিষয়গুলোকে তারা কীভাবে দেখেন – এই ব্যাপারগুলো। শ্রদ্ধেয় এবং আমার দেখা মেধাবীতম বাঙালিদের একজন আবেদ চৌধুরীর ভাষা ধার করে বলি – যারা MIT’র ল্যাবে বসে পৃথিবী বদলে দেয়ার বদলে ৭১ এর জুলাই মাসে মেহেরপুরে কতো রাউন্ড গুলি করা হয়েছিলো – এই চিন্তায় দিনগুজার করেন তারা আর যাই হোক, সুতীব্র অনুভুতি যে পোষণ করেন – এ কথা অস্বীকার করা যাবে না।
তা এই অনুভূতিকে কি আমরা দেশপ্রেম বলবো?

কোনমতেই না। কারণ এই একই মানুষ ঘটমান বর্তমানে নিজের দেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর পুলিশ বাহিনীর গুলি চালানোকে মনে করেন কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ, এই একই মানুষ ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী পালন করেন অথচ সেই দিনেই বিরোধী মতের রাজনীতিবিদ গুম হলে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেন না। শুধুমাত্র বিএনপি কিংবা জামাত করার কারণে রাষ্ট্র এখন বহু সাধারণ কর্মীদের ওপর যে অত্যাচার চালাচ্ছে তা ক্ষেত্র বিশেষে ৭১ এর চেয়েও ভয়াবহ কিন্তু এসব ব্যাপারে তারা মতিকন্ঠ করেন।

দেশের অর্ধেক মানুষকে বাদ দিয়ে “দেশপ্রেম” করা যায় কি?

তাহলে তারা যা করেন সেটা কি?

আমার ধারণা শাহবাগীরা তাদের পছন্দের একটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ডে থাকেন। এই “থাকার” একটা বিশেষত্ত্ব আছে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে তাদের কিছু আইডিয়া, কিছু টোটেম, কিছু মাসকট, কিছু ইভেন্ট আছে যেগুলোকেই তারা বাংলাদেশ বলে মনে করেন। ব্যাপারটা বোঝানো একটু কঠিন – তবু চেষ্টা করি। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন – এতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু শাহবাগীদের সাইকোএনালিসিস করলে আমার ধারণা দেখা যাবে যে দাড়িপাল্লার এক পাশে বাংলাদেশ, আরেক পাশে মুক্তিযুদ্ধ রাখলে তারা মুক্তিযুদ্ধ নামক “ইভেন্ট”টিকে বাংলাদেশের চাইতেও বড় মনে করবেন। আরো গহীনে গেলে আমার মনে হয় দেখা যাবে যে ৭১ এর আসল ঘটনা না, মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভটাই তাদের কাছে সবচেয়ে প্রেশাস। কারণ মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস কি তার চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হোলো এই ন্যারেটিভটাকে আঁকড়ে ধরে থাকলে তারা নিজেদের পবিত্র, নৈতিক, মহান – এসব মনে করতে পারেন। তারা তাদের “দেশের” এমন “আলাদা বিষয়গুলোকে” প্রবলভাবে ভালোবাসতে সক্ষম কিন্তু বিষয়গুলো এক করতে পারেন না – সেজন্যই সেটা মেক-বিলিভ ওয়ার্ল্ড।

কেন এমন হয়?

আমার ধারণা “বাংলাদেশ” নামক রাষ্ট্রটিকে দীর্ঘদিন ধরে গভীরভাবে ভালোবাসা খুব কঠিন – বিশেষ করে এখন যাদের বয়স ৩০ এর কম তাদের জন্য। কোনো অসুন্দর জিনিস দীর্ঘদিন ভালোবাসা যায় না। যারা আগ্রহী তারা ষাট, এমন কি আশির দশকের ঢাকার স্টিল ফটোগ্রাফ দেখতে পারেন। অপূর্ব সুন্দর, ছিমছাম এক নগরী। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বইয়ে (প্রকাশকাল জুন ‘৭১ – সম্ভবত) কাজী আনোয়ার হোসেন ঢাকাকে উল্লেখ করছেন “রমনীয়” ঢাকা বলে। সুন্দরকে ভালোবাসা যায়, ভালোবাসতেই হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না আমাদের বাবাদের প্রজন্ম যে যুদ্ধ করেছিলেন তার মূল কারণ ছিলো তারা তাদের মেমোরীকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, যে মেমোরী হোলো তাদের শৈশব ও কৈশোরের “সুন্দর” একটা দেশ, যাকে রক্ষা করা যায়, করতে হয়। কিন্তু আজকের ঢাকা কুৎসিত, পুরো দেশে শুধু মানুষ আর মানুষ, চারদিকে শুধু কংক্রিট। মানুষগুলোও বদলে গেছে – মুদির দোকানী থেকে প্রধানমন্ত্রী, সবাই অকারণে যখন-তখন মিথ্যা বলছেন। টিভি খুলবেন – বাজে খবর, পত্রিকা খুলবেন তো ভয়ঙ্কর খবর। শহরটাকে যে একটু অন্য চোখে তাকাবেন, সেই সময়টুকুও নেই।

কার্যকারণের সমন্বয় খুঁজতে গেলে এই দেশকে ভালোবাসা, রীতিমতোন এক এইচএসসি পরীক্ষা।

কিন্তু স্কুলে আপনাকে প্রাইম করা হয়েছে দেশকে ভালোবাসার জন্য। ইসলাম শিক্ষায় পড়েছেন “দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ”, বাংলা বইয়ে পড়েছেন “ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা”/ নিজের ভাইকে যদি আপনি ভালো না বাসেন আপনি বড়জোর হৃদয়হীন মানুষ, কিন্তু খারাপ নন। অন্য দিকে নিজের দেশটাকে যদি ভালো না বাসেন, আপনি “অনৈতিক” মানুষ। “দেশপ্রেম না থাকা” আর “বিশ্বাসঘাতকতা” বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি বিষয়।

আপনার মনের শিক্ষিত অংশ বলছে দেশকে ভালোবাসতে হবে কিন্তু ইনসটিংটিভ অংশ প্রশ্ন করছে এই দেশকে কি ভালবাসা যায়?

তা এই টানাপোড়েনের প্রতিক্রিয়া কী? আপনি পেছনে তাকাবেন এবং এমন কিছু ব্যক্তি, ইভেন্ট ও ধারণা বেছে নেবেন যার একটা অতি সরল ন্যারেটিভ আছে এবং এই ইন্ডিভিজুয়াল বিষয়গুলোকেই বাংলাদেশ বলে ভাবতে শুরু করবেন (সেহেতু তা “রক্ষা” করা যায়) / এটাই দেশপ্রেম, এটাই চেতনা।

আমার ধারণা শাহবাগীরা এই ভাবেই দেশটাকে দেখেন।

এর একটা খুব বড় সুবিধা আছে। যেহেতু আপনার “দেশ” আসলে আলাদা আলাদা কিছু ইভেন্ট এবং যেহেতু এই ইভেন্টগুলো বাস্তবতার উর্ধ্বে (আপনার কাছে) সেহেতু এই ইভেন্টগুলো নিজেরা খুবই ফ্লুয়িড। যেকোনো ব্যাখ্যা, যে কোনো নির্দেশ যতোক্ষন আপনার পক্ষে যায়, মনে হবে যে এটাই সত্যি। আগ্রহীরা হয়তো দেখেছেন যে দেওয়ানবাগী পীর ওয়াজে বলছেন যে তার স্ত্রী আসলে বিবি ফাতিমা এবং যেহেতু বিবি ফাতিমা তার “ভেতরে” আছেন সেহেতু তার সাথে রাসুলের একটা “যোগাযোগ” তৈরী হয়েছে এবং এই যোগাযোগের কারণেই তার মুরীদেরা তাকে রাসুল হিসাবে স্বপ্নে দেখেন। মজার ব্যাপার হোলো এই কথাগুলো যখন তিনি বলেন তখন তার ভক্তরা তাকে তীব্রভাবে সায় দেয়। ধার্মিকেরা যখন এই ভিডিও দেখেন তখন অগ্নিশর্মা হয়ে যান এবংসহজ প্রশ্নটি করতে ভুলে যান যে ভক্তদের কাছে কেন এটা রিয়ালিটি বলে মনে হয়?

কারণ দেওয়ানবাগীর ভক্তদের কাছে দেওয়ানবাগী একটা “প্রটেকটেড ইভেন্ট” – তাকে বাস্তবতার ধার ধরতে হয় না। আর যখন কোনো ইভেন্টকে আপনি বাস্তবতার উর্ধ্বে উঠিয়ে ফেলতে পারেন তখন এই ইভেন্ট “ইতিহাস” থাকে না, একটা অর্গানিজমে পরিণত হয় – সেল্ফ সার্ভিং অর্গানিজম। আমি একবার একটা সামান্য পরীক্ষা করেছিলাম, ঘটনাটা খুবই ইন্টারেস্টিং। আমার এক তীব্র আওয়ামী সমর্থক বন্ধুকে একটা গল্প বলেছিলাম, দেওয়ানবাগীর গল্প থেকে খুব আলাদা না। আমি খুব সিরিয়াসলি তাকে বলা শুরু করলাম যে মাত্র নয় মাসে যে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে এর আসল কারণ বঙ্গবন্ধু। তিনি যে লায়ালপুর কারাগারে ছিলেন এটা পুরোপুরি সত্য না। প্রথমে বন্দী থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ সময় তিনি মস্কোতে ছিলেন এবং মস্কোতে তিনি ইস্টার্ন ব্লকের হয়ে দর কষাকষি করছিলেন আমেরিকার সাথে। গল্পটা বিশ্বাস করানোর জন্য প্রচুর নথিপত্রের উল্লেখ করলাম, বললাম যে – পুরোপুরি স্বীকার না করলেও প্রাভদা এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস এর অমুক তারিখের এডিটরিয়ালে এর উল্লেখ আছে।

আমার এই বন্ধুটি সম্ভবত বাসুদা এবং মেজবাহ আহমেদের পর্যায়ের শাহবাগী নন কিন্তু মজার সাথে লক্ষ্য করলাম যে একটিবারের জন্যেও জিজ্ঞেস করলেন না যে পাকিস্তান কেন বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দেবে মস্কোতে যাওয়ার জন্য এবং মস্কো থেকে তিনি পাকিস্তানে ফেরতই বা আসলেন কী করে?

এটাকেই আমি বলেছি “ফ্লুয়িড” এবং ফ্লুয়িড বলেই পুরো ঘটনা আর কোনো ঐতিহাসিক ইভেন্ট থাকে না – হয়ে যায় একটা অর্গানিজম। এখানে একজন লাকীর প্রয়োজন হবে স্লোগান দেয়ার জন্য, একজন মাহবুব রশীদ দেবেন ফেসবুক স্টেটাস, মেসবাহ আহমেদ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার ফাঁকে এসে আমাদের জানাবেন এক দেশে দুই আইন থাকার বিপদ এবং বাসুদা অনুরোধ করবেন সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য। ইতিহাস আর কোনো ঘটনা থাকে না, হয়ে যায় একটা প্রাণী – যে বদলে যায়, সরে যায়। যে অরক্ষিত হতে পারে এবং যার সম্ভ্রমহানিও হতে পারে।

Image

শুধুমাত্র – আবারও বলছি – শুধুমাত্র “চেতনা”ই পারে এই প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। কেন?

কারণ চেতনা হোলো এক গোছা বিশ্বাস যাকে আপনি যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বে প্রায়োরিটি দেন। আপনি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে এই বিশ্বাসগুলোই আপনার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই শেষ না – আপনার সামনের মানুষটিকেও চেতনা করতে হবে – কেননা আপনি তাকে বিচার করবেন আপনরা চেতনা দিয়ে। ওইজা বোর্ডে যেমন আপনার অবচেতনের শক্তি আঙ্গুল নাড়িয়ে ডেকে আনে আত্মা, ঠিক তেমনি চেতনার সমস্মর, নিয়ন্ত্রণ করে ইতিহাস নামক প্রাণীটিকে। বর্তমানে বসে আপনি বদলে দেন অতীত। পারেন না বদলাতে শুধু বর্তমান।

এই যে আপনার ধর্মের মতো বিশ্বাস যাকে আমি ধর্মই বলি, শাহবাগীরা ভালোবেসে তার নাম দিয়েছে দেশপ্রেম।

photo credit: Maciej Dakowicz, Zakir Hossain Chowdhury    

19 thoughts on “শাহবাগীদের দেশপ্রেম

  1. অদ্ভুত সুন্দর এক ব্যবচ্ছেদ শাহবাগীয় দেশপ্রেমের !! সুনিপূণভাবে একে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লেখকের মুন্সীয়ানা অস্বীকার্য।

  2. I feel that the central contention of this post – that the self-proclaimed-Liberal-extremists of Bangladesh are highly conservative (even bigoted, if you will) – is spot on. The excessive-glorification & mythification of ’71 may also hold true to many (though the need for a central myth may be argued). The point made about intra-party democracy (or lack thereof, to be specific) is also applicable for both major parties. In addition, I have two minor comments.

    Firstly, I don’t subscribe to the idea that Bangladesh cannot be loved over a long period of time. It assumes that such love would be a rational response to the socio-economic standing of the country. A country is more than the sum of its people, land, infrastructure, GDP etc. This contention weakens the central argument. Secondly, inclusion of patriotic ideas in curriculum has been made to sound like mindless brainwashing in the post. But while, Indoctrination is frowned upon in the West, nurturing basic morals & values has long served us well. In fact, many suggest that it may be what’s supporting the much-hyped Rise of Asia.

    I thought the title of the post unnecessarily misleading. Most people who have been to Shahbagh (and they are not all BAL supporters) still associate themselves with the term/name. By the time, we understand that the writer actually means Chetona Extremists, a lot of readers will have been turned-off. It is likely the more off-putting option compared to ‘chetonized’ and the such. And this choice of nomenclature completely ignores the fact that there was also an authentic spirit of Shahbagh: a spirit that cannot be branded or co-opted. Why are rational centrists repeatedly ignored in mainstream politics? Answer that, and we will know why so many thousands thronged to Shahbagh.

  3. অসাধারণ সুন্দর একটি লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। সত্যি দারুণ মুগ্ধ হলাম আপনার যুক্তির শান দেখে। শাহবাগীদের অন্তসারশূন্য চেতনার ব্যবচ্ছেদ করতে আপনার মতো বহু লেখক দরকার।

  4. A bunch of fanatics, who demand Specific Verdict, as opposed to Fair Trial, cannot be “Centrists”. No civil society can welcome a lynch mob on a matter that is Sub-Judis. No delusional fool can think himself or herself a rebel or a revolutionary when a armed guards protect their “rebellion”. Those who went to shahabagh to watch what’s going on, are not “Shahabaghis”. They are simple On-Lookers. Every family has on-lookers, who went to Shahbagh, but not every family is a SHahabaghi.

    • Anik bhai, your words are almost as harsh as the ones this post mocks 😀

      Regardless, the ones you trivialize as ‘onlookers’ are the same ones I called ‘centrists’. If you’ve been to Shahbagh during the early 2/3 days, you may have realized that there was more than the attraction of a spectacle. There was a desperate search for unifying themes. If Shahbagh symbolized even one of those, I would embrace that. Not demean such sentiments.

      It’s easy for us to devise little definitions in our heads and think it culturally-shared meaning. Shahbaghi means X, Nastik means Y, Jihadi means Z. But, unfortunately, we’re not arbiters of cultural meanings. Eventually, it’s the communicator who must consider the audience, not the other way round.

      • Adnan… I think its about time someone from ourside define what we, the nationalists, mean by Shahabaghis…..will get going on that… as you can guess I dont care about the shahabaghis from their day 1-2-3 perspective, I see them as a delusional bunch of idiots who are now waiting in silence as the country is losing its sovreignity in both technical and literal terms.

      • Adnan, I can understand the naive romanticism that moved the early participants of Shahbagh. I understand that they looked for something pure that can deliver Bangladesh out of the Gordian Knot of despair. I sympathize with their naivete although I have no respect for that. But just after few weeks their eyes should have been opened about what Shahbagh is turning out to be all about. What we are seeing now before our eyes is the real progeny of the spirit of Shahbagh. A fascistic, undemocratic, genocidal cult that will gladly do away with half the country to see that their idea conforms to reality. So, Shahbaghi is a eminently suitable term and the spirit of Shahbagh is a principal target.

        In history, some of the most heinous incidents of mass suffering were initiated by well meaning but foolish people. Their naivete is no defense for their culpability. .

  5. প্রথেমে লেখকে ধন্যবাদ জানাই তার সুন্দর বিশ্লেষন ধমী লেখার জন্য। তার সাথে তাকে আরো অনুরোধ জানায় সাইবার জগতে সুক্ষ বুদ্ধি দিয়ে একটি লেখা পড়া ও তা বুঝার সাথে সাথে আত্মস্থ করার মত মানুষ খুবই কম। তাই তাকে আরো সহজ ভাবে অর্থাৎ আমরা একে অপরের সাথে যেভাবে পারস্পরিক কথা বলি সেভাবে বর্ণনা করলে আরো সহজ হবে তাদের বুঝার জন্য। এরকম আরো আত্ম উপলব্ধিমুলক লেখা এবং তা প্রচারের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

    • সৌমিক ভাইয়ের সাথে একমত। লেখার ভাষা আরও একটু সহজ হলে ভালো হতো।

    • Sorry, can’t really agree with you, some time some words express exactly what you feel, so I don’t see the point ‘try to make it easier’ when it might not ‘exactly expressing what I am trying to say’.
      I understand that a writer should consider reader’s ability while writing but to me it’s “Puujibadi badi manoshikota” (capitalist mentality ?…maybe) towards writing. One shouldn’t write to make it ‘marketable’ – sometime one writes only for oneself.

  6. মুদির দোকানী থেকে প্রধানমন্ত্রী, সবাই অকারণে যখন-তখন মিথ্যা বলছেন।

  7. “কারণ চেতনা হোলো এক গোছা বিশ্বাস যাকে আপনি যুক্তি-তর্কের উর্ধ্বে প্রায়োরিটি দেন। আপনি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে এই বিশ্বাসগুলোই আপনার অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখানেই শেষ না – আপনার সামনের মানুষটিকেও চেতনা করতে হবে – কেননা আপনি তাকে বিচার করবেন আপনরা চেতনা দিয়ে।”
    অসাধারণ কিছু অভিব্যাক্তি। 🙂

  8. অনেক সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করে লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। কেউ ভিন্ন মত পোষণ করে থাকলে কোন আজেবাজে কথা না লিখে তিনিও উপযুক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ উল্লেখ করুণ।

  9. মাশাল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ, ভাল লিখছেন। কিন্তু মুহতারাম, এই দিকে দেশে দীন ইসলামের পতাকা যাঁরা এতদিন ধরে আগলে রেখেছিলেন, সেই বঙ্গ শার্দূল, ইসলামের বাগানের ফুটন্ত গোলাপ, আর বাকি সব আলেমদেরকে তো এক এক করে এই বাকশালী হিন্দুত্ববাদী সরকার ফাঁসিতে চড়িয়ে দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধেতো কোন লেখাই পাই না।

Leave a comment