সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ : বিপক্ষের যুক্তি

5

by শাফকাত রাব্বী অনীকঃ

প্রতি ৫ বছর পর পর সামরিক বাহিনীর দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা জাতি পৃথিবীতে কম আছে। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় প্রকার দুর্যোগে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ বাংলাদেশীরা খুব খুশি মনে মেনে নেন। রাজনৈতিক মতাদর্শের উভয় সাইডের পাবলিকদেরকে গত দশ বছরের কোন না কোন সময় সামরিক হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করতে দেখা গেছে। ফক-ইউ-আহমেদ-দের ২ বছরের শাসন আমলে দেশের সাধারণ মানুষদের একটি বড় অংশকে রীতিমতো সামরিক শাসন এনজয় করতেও দেখা গেছে।

শোনা যায় বর্তমানে দেশের একটা বড় জনগোষ্ঠি মনে প্রানে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। ধারণা করা যেতে পারে খোদ সরকারপন্থীদের অনেকেও সামরিক হস্তক্ষেপ মেনে নেবেন। তারপরেও তারা বিরোধী জোটের হাতে ক্ষমতা দেবেন না।

এখন প্রশ্ন হলো সামরিক বাহিনী কি ভাবছে? দেশের যে পরিমান ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে, যতো মানুষকে গুলি করে মারা হয়েছে, যতো মানুষ আগুনে পুড়েছে, যতো প্রকার নির্লজ্জ বিদেশী হস্তক্ষেপ হয়েছে, এবং সর্বোপরি জনমনে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা যতোটা বেড়েছে, সাধারণ দৃষ্টিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করার এর চাইতে বেশি যুক্তি সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন হবার কথা না । তারপরেও সামরিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে না কেন? রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে সামরিক বাহিনীর অনাগ্রহী হবার অনেকগুলো কারনের মধ্যে নীচের ইস্যু গুলো থাকবেঃ

– জেনেরালদের অনেকে মনে করেন প্রতি ৫ বছর পরপর সামরিক হস্তক্ষেপ করা কোন দেশের মিলিটারির দায়িত্ব হতে পারে না। আজকে এ দল নামাতে মাঠে নামলে, পাঁচ বছর পরে অন্য দল ঠেঙ্গাতে মাঠে নামা লাগবে। এর চাইতে চুপচাপ প্রফেশনালভাবে রাজনীতিবিদদের উন্মত্ততা দেখে গেলে এক সময় না এক সময় অযোগ্য রাজনীতিবিদরাই শেষ হয়ে যাবেন, অথবা নিজেদের অসুস্থ রাজনীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হবেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে।

– ১/১১ এর অভিজ্ঞতা সামরিক বাহিনীর জন্যে ভালো ছিল না। যদিও একথা সত্য যে সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ ১/১১ এর সময় বেশ বাড়াবাড়ি করেছিলেন। কেউ হয়তো নিজের ইচ্ছায় একটু বেশি এডভেঞ্চার করতে গিয়েছিলেন, আর কেউ হয়তো অন্য কারও হুকুমে নিরুপায় হয়ে বাড়াবাড়ি করেছিলেন। ২০০৮-এর পরে কয়েক ডজন বিভিন্ন পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাকে তাদের জীবনের নিরাপত্তায় বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এদের বেশীর ভাগই এখন আছেন আমেরিকায়। এরা কবে দেশে ফিরতে পারবেন কেউ জানে না।

– ১/১১ এর পেছনে আমেরিকা ও ইন্ডিয়ার ভুমিকা ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু আশ্রয় নেবার ক্ষেত্রে আমেরিকাকেই বেছে নিয়েছেন সামরিক বাহিনীর অনেকেই। আমেরিকানরা গ্রিন কার্ড কিংবা অন্যকোন বিশেষ ব্যাবস্থায়  নিয়ে গেছে ১/১১ এর বিতর্কিত মিলিটারি কর্মকর্তাদের। কিন্তু আমেরিকা তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেবার বাইরে আর বেশি কিছু দেয়নি। একারণে কর্মকর্তাদের অনেকেই ছোটখাটো কাজ করে আমেরিকায় কষ্টকর জীবন যাপন করছেন। একজন অত্যন্ত ক্ষমতাবান সামরিক ব্যাক্তি পিজ্জা ডেলিভারির কাজ করতে যেয়ে ক্যামেরা বন্দি হয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকায়। এসব অভিজ্ঞতা সামরিক বাহিনীর জন্যে সুখকর নয়।

– পরিবর্তিত সংবিধানে সামরিক হস্তক্ষেপের শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে। সামরিক বাহিনীর জেনেরালরা জানেন যে কোন না কোন দিন আজকে যাদের সরিয়ে দেয়া হবে, তাদের দল আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে। তখন এসে বিচার শুরু করলে, দেশের উভয় রাজনৈতিক দলের কাছ থেকেই কোন সাহায্য নাও পাওয়া যেতে পারে। সামরিক কর্মকর্তাদের চাকরি জীবনের ও ক্ষমতার রিটায়ারমেন্ট আছে। রাজনীতিবিদদের কোন রিটায়ারমেন্ট নেই। একারণে রাজনীতিবিদদের প্রতিশোধ নেবার সুযোগ ও সময় থাকে অফুরন্ত।

– বর্তমান বিএনপির উপর সামরিক বাহিনীর ডানপন্থীদের অনেকেই খুশি না। ফারুক-রশিদ-ডালিমদের পরিনতি সামরিক বাহিনী দেখেছে। বিএনপির শাসন আমলের পুরোটা সময় ফারুক-রশিদদের অনেককেই জেলে থাকতে হয়েছে। অনেকের দৃষ্টিতে ফারুক-রশিদদের সৃষ্ট ইতিহাসের পূর্ণ রাজনৈতিক বেনিফিট বিএনপি পেলেও, বিএনপি প্রতিদান স্বরূপ ফারুক-রশিদদের দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তাদের বিচার শুরু হয়ে যাবার পরে বিএনপির নিরবতাকে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এই ঘটনায় অনেকে মনে করেন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সুবিধাবাদিতা ফুটে উঠেছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, বর্তমান সময়ের বিভিন্ন ইস্যুতেও বিএনপি নিরবতাপালন করেই চলেছে। যা অনেকের চোখে সুবিধাবাদিতা হিসেবে ধরা দিচ্ছে। সামরিক বাহিনীর কেউ মনে করতেই পারেন বিএনপি কখনই সেই সব মানুষের পাশে দাঁড়ায় না, যারা এই দলটির জন্যে রিস্ক নেয়।

– সামরিক বাহিনীর জীবন সব সময়ই সিভিলিয়ানদের থেকে ঝামেলা মুক্ত ছিল। হরতাল অবরোধ হানাহানি তাদের স্পর্শ করতো না আগেও, এখনও করে না। এই নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে এখন যোগ হয়েছে বিদেশে যেয়ে হালাল টাকা রোজগারের উপায়। একারণে দেশীয় রাজনীতির ঝামেলায় জড়িয়ে পরার কোন কারণ সামরিক বাহিনীর অনেকে দেখেন না।

– বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রভাব বেড়েছে সামরিক বাহিনীর উপর। একটি দেশ না, একাধিক দেশ। জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণও বেড়েছে, কেননা জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর সার্ভিস নিয়ে থাকে। অনেক বেতন দেয়। জাতিসংঘ চায় না তাদের ভাড়া করা সেনাবাহিনী কোন দেশে ক্ষমতা দখল করুক। বিদেশী রাষ্ট্রের কিংবা গোষ্ঠির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সামরিক বাহিনীর রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো দুরূহ করে দিয়েছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনীতি বিমুখ হয়ে বাংলাদেশের সেনা বাহিনী যদি সত্যিই তাদের প্রফেশনাল ইমেজ বজিয়ে রাখতে পারে, তাহলে দেশের দীর্ঘ মেয়াদী লাভ হবে। তবে সেনা বাহিনীর উচিত হবে সব সময় খেয়াল রাখা তারা যেন পুলিশ, র‍্যাব, কিংবা বিজিবির মতো ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী হিসেবে কোনও রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা ব্যবহৃত না হন। সাধারণ মানুষকে কিংবা যে কোন দলের রাজনৈতিক কর্মীদের যেন তাদের হাতে কোনদিন গুলি খেয়ে মরতে না হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার একমাত্র স্তম্ভ হচ্ছে আমাদের সেনা বাহিনী। সকল দল ও মতের মানুষের সাথে সেনা বাহিনীর সুসম্পর্ক থাকা একারণে খুবই জরুরী।

আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর উচিত হবে কোন ভাবেই দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠির সাথে সরাসরি মারামারিতে জড়িয়ে না যাওয়া। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে হলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সাথে সেনা বাহিনীর নিবিড় আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন। কোন একটি রাজনৈতিক সরকারের হঠকারিতায় এই আস্থায় যেন চিড় না ধরে তা সেনা বাহিনীকেই নিশ্চিত করতে হবে।

5 thoughts on “সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ : বিপক্ষের যুক্তি

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s