by: Aman Abduhu
দেশপ্রেম দিয়ে গিনেজ রেকর্ড করার বালখিল্যতা নিয়ে লিখেছিলাম। আমার বক্তব্য ছিলো, কোন ব্যাতিক্রমী মানুষ বা প্রতিষ্ঠান সাধারণত এইসব রেকর্ড করে পরিচিতি বাড়ায়। কিন্তু কোন রাষ্ট্র এর পেছনে দৌড়াচ্ছে, পুরো দেশের মানুষ মিলে বানর নাচ নেচে যাচ্ছে, এমনটা অভূতপূর্ব।
ফেসবুকের সে লেখাতে একজন দেশপ্রেমিক বাঙালী এসে আলগোছে মন্তব্য করেছেন “আপনি বাংলায় স্ট্যাটাস দিয়েছেন। বাঙ্গালী বলে মনে হয়। আসলে কি তাই?”
এমনিতে মনে হয় প্রশ্নটা খুবই নীরিহ। নরম সুরে কোমলভাবে উত্থাপন করা ভয়ংকর এ প্রশ্নটা আমাকে আনন্দ দিয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন মাতৃজঠরে থেকে সম্প্রতি ভুমিষ্ঠ হওয়া বাঙালী-চেতনাধর্মের ফ্যাসিবাদী দাঁতালো চেহারা আবারও বের হয়ে এসেছে। ঐ ধর্মাবলম্বী ভদ্রলোকটি আমাকে হাতের নাগালে পাচ্ছেন না বলে অন্তর্জালে চমৎকার এ নিরীহদর্শন প্রশ্নটি করেছেন। সামনে পেলে এবং তার ক্ষমতা থাকলে প্রশ্নের ধরণ হতো অন্যরকম।
আমি নিজে সাধারণ একজন নাগরিক, এবং হাজার হাজার ফেসবুকারের একজন। কিন্তু যখন কোন উল্লেখযোগ্য মানুষ এসে সে চেতনায় আঘাত করে বসেন, এ প্রশ্নটা আর হালকা কোন প্রশ্ন হয়ে থাকেনা। তখন ফ্যাসিজম তার আসল চেহারা দেখায়। তখন গুম হয়ে যেতে হয়, গালিগালাজ ও অপমানের তোপের মুখে পড়তে হয়, অথবা মাহমুদুর রহমানের মতো জেলখানায় পঁচতে হয়। এমনকি মিনা ফারাহ’র মতো নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। কারণ ফ্যাসিজম কখনো ইনক্লুসিভ হয়না। ঐ পথে হাটা এদের এ বাঙালী ধর্মও হয়নি। কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাকে সমাজচ্যুত করা এ ধর্মের বৈশিষ্ট্য। এবং ভদ্রলোক তার সহফেসবুকার আমাকে সমাজচ্যুত করার সে তাড়না থেকেই তার নিরীহদর্শন প্রশ্নটি করে বসেছেন।
বড় কথা হলো, প্রশ্নটি দেখে আমি দু’জন মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেছি। হিটলার এবং মুসোলিনী। এ দুই ফ্যাসিষ্ট ডিক্টেটর ইতিহাসে এমন সব কাজ করে গেছেন, শেখ হাসিনার মতো নব্য ফ্যাসিষ্ট ও তার শাহবাগি অনুসারীদের কাজের বিশ্লেষণ করতে গেলে উদাহরণ খুঁজে পেতে সমস্যা হয়না। বুঝতে কষ্ট হয়না।
বাঙালীয়ানা থাকা না থাকার প্রশ্ন উত্থাপনে মনে পড়লো দুইটা আইনের কথা; দুটাই ছিলো জাতীয়তা এবং সংশ্লিষ্ট অধিকার থাকা না থাকা সংক্রান্ত। ১৯৩৫ সালে জার্মানিতে হিটলার বাস্তবায়ন করেন ন্যুরেমবার্গ রেইস ল, এবং ১৯৩৮ সালে ইটালিতে তার শিষ্য মুসোলিনি বাস্তবায়ন করেন মেনিফেস্টো অভ রেইস। এ দুই আইনের মূলকথা ছিলো, খাটি আর্য/আরিয়ান জাত ছাড়া অন্য কেউ জার্মানি এবং ইটালির পূর্ণ অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক না। এবং ইহুদিরা কোন নাগরিকই না।
আলেক্সান্ডার ডি গ্রান্ড তার ‘জুইশ ইন ইটালি আন্ডার ফ্যাসিস্ট এন্ড নাজি রুল’ বইয়ে ইটালির ঘটনাগুলো বিস্তারিত লিখেছেন। আমাদের জাফর ইকবালের মতো তাদেরও সেসময় তাত্ত্বিক পন্ডিতেরও অভাব ছিলো না। এইসব জ্ঞানীগুণীরা তখনও শিশুর মতো সরল মন নিয়ে সাদাসিধে ভাবে ফ্যাসিজমের সেবা করে গিয়েছেন, বিভেদ-বৃক্ষের গোড়াতে আপনমনে পানির সেচ দিয়ে গেছেন।
ড. গুইডো লন্ড্রা নামে এক এনথ্রোপলজিস্ট বিজ্ঞানী গবেষণা করে তখন এক বৈজ্ঞানিক নীতিমালা প্রণয়ন করেন। ইটালির সে চেতনা ফিল্টারের নাম ছিলো ‘মেনিফেষ্টো অভ রেইসাল সায়েন্টিস্টস’, খাঁটি আর্যরা সে ফিল্টারের ভেতরে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে নাগরিক হয়ে বের হতো। আর রক্তে সমস্যা থাকলে অথবা চেতনায় ঘাটতি থাকলে ফিল্টারে আটকে যেতো। ফ্যাসিজমের বিরোধীতা করা মানুষরা আর ইহুদিরা আটকে যেতো, তাদের খাঁটি ইটালিয়ানত্ব এবং খাঁটি জার্মানত্ব বাতিল করা হতো। তারপর তাদেরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে, শ্রমিক বানিয়ে, নির্যাতন করে, এবং হত্যা করে চেতনার বাস্তবায়ন করা হতো।
ফ্যাসিজম এমনই। যুগে যুগে ঘুরে ফিরে আসে। এসে এসে জাতীয়তা এবং আত্মপরিচয়ে কত আনা খাদ আছে তা যাচাই করতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে। চেতনা ধর্মে অন্ধ এই মানুষগুলো এতো বেশি স্পর্ধা পেয়ে যায় যে, তারা দেশের সর্বোচ্চ স্থান থেকে শুরু করে বাসায় বাসায় ঢুকে যেখানে সেখানে তাদের চেতনার এসিড টেষ্ট শুরু করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের মতো বিশাল প্রতিষ্ঠানের সামনে দাড়িয়ে তাদের ছোট ছোট পিচকালো চেতনা প্রদর্শন করে। আবার পথ চলতে সামনে কাউকে পেলে জিজ্ঞাসা করে বসে, আপনি কি বাঙালী?
এরা বুঝতে অক্ষম, সাময়িক সময়ের জন্য শক্তির জোরে এইসব বাঙালী চেতনা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা যায়, লাখো কণ্ঠে অর্থহীন রেকর্ড করে রাষ্ট্রকাঠামোর সম্মান ও মর্যাদাকে খেলো করা যায়, কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের স্থান হয় ইতিহাসের ভাগাড়ে। ঘৃণিত হতে হয়।
আমাদের সামনে দুইটা পথ আছে। এইসব ছোট ছোট পিচকালো চেতনাধারীদের সাথে তর্ক করে সময় কাটাতে পারি। কোন লাভ হবে না। এদের চ্যাতনা অন্ধত্ব কাটবে না, কিন্তু ঝগড়াঝাটি করে গালিগালাজ দিয়ে কিছুটা হয়তো দমানো হবে। অন্য আরেকটা পথ হলো হিটলার ও মুসোলিনীর মতো ফ্যাসিষ্টদের সাথে শেখ হাসিনা ও তার শাহবাগি চ্যাতনাজীবি অনুসারীদের মিল ও অমিল, এবং কখনো বরং বাড়াবাড়ির বিষয়গুলো, খুঁজে বের করে ইতিহাসের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
আমার মনে হচ্ছে প্রথম কাজটা পুরোপুরি বাদ দেয়া না গেলেও, দ্বিতীয় কাজটা অনেক বেশি দরকারী।
Reblogged this on Emrul Mahmud.
প্রথমটা করা না করা সমান , দ্বিতীয় টা করা জরুরী ।