সাম্রাজ্যবাদী মুনাফালোভীদের ক্ষমতার নিচে চাপা পড়ে রাষ্ট্র আর জাতীয় সঙ্গীতের চেতনা হারানোর বয়ান

1

খন্দকার রাক্বীব

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম আর জাতীয় মুক্তির বিষয়গুলোকে ইদানিং যে হারে সংস্কৃতি ইন্ডাস্ট্রির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে তা প্রতিরোধ করা জরুরী। প্রথম আলো-গ্রামীণফোন গোষ্ঠী সর্বপ্রথম আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের ভাষা আন্দোলনকে নিজেদের ব্যবসার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এই ন্যক্কারজনক বিকৃত সংস্কৃতি ইন্ডাস্ট্রির বাজার তৈয়ার শুরু করে। আস্তে আস্তে এর বিস্তার মহীরুহ ধারন করছে।

 

পুঁজিবাদী সমাজে সংস্কৃতির ধরণ ও গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যায় ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের দ্বারা বিনির্মিত এই সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রির বয়ান গত শতাব্দীর তিরিশ-চল্লিশের দশকের হলেও, এতদিন এটি বাংলাদেশের পঠন-পাঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। কিন্তু এটি এখন যে উপায়ে বিকশিত হচ্ছে তা রীতিমত ভয়ানক।এটি জানা কথা যে, সংস্কৃতি হলো ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সৃজনশীলতার প্রকাশধর্মী বিষয় এবং সহজাতভাবে ইন্ডাস্ট্রিবিরোধী। অথচ সংস্কৃতি ইন্ডাস্ট্রি প্রত্যয়ে সংস্কৃতিকে মানবিকিকরণ কিংবা মানবমুক্তির উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়না এবং একে মতাদর্শগত আধিপত্য বিস্তারের দায়িত্বপালনে নিয়োজিত করা হয় (W,adorno and Max Horkheimer, the dialectic of enlightenment, 1923)। আগে সংস্কৃতি সৃষ্টি হতো মানুষের আত্মার টান থেকে, ফলত তা ছিল অনেক উন্নত। আর এখন মুনাফা নির্ভর যে সংস্কৃতি গড়ে তার সর্বক্ষেত্রেই চলছে দেশীয় সংস্কৃতিকে হেয় অথবা বিকৃত করার ঘৃণ্য চক্রান্ত। জেমস পেত্রা তাঁর বিংশ শতাব্দীর নিমিত্তে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ(১৯৯৪) বইতে লিখেছিলেন রাজনীতির ময়দানে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ জনগণকে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি-মূল ও সংহতির ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে মিডিয়াকৃত আকাঙ্ক্ষা, যা প্রচারের দ্বারা নিয়মিত পরিবর্তন করা হয়, তার শরিক করে ফেলতে বিশাল ভুমিকা পালন করে এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণকে শ্রেণী ও লোকসমাজের যোগসূত্রগুলো থেকে উচ্ছেদ করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ও পারস্পারিক একক নিঃসঙ্গ মানুষে পরিণত করা। সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব বিশ্বজোড়া শোষণব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য মাত্রা, যার উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে আধিপত্যবাদি শ্রেণীর এক সুসংবদ্ধ অনুপ্রবেশ।… শোষিত জনগণের মূল্যবোধ, আচরণ, প্রতিষ্ঠান ও অভিন্নতা সাম্রাজ্যবাদী শ্রেণীদের স্বার্থের অনুকূল করে গড়ে তোলা 

 

প্রথম-আলো গ্রামীণফোনের দ্বারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে শুরু হওয়া এই সংস্কৃতি ইন্ডাস্ট্রি গণসংস্কৃতিরও ঊর্ধ্বে উঠে যেভাবে জাতীয় দিবস আর জাতীয় চেতনার আবেগের বিষয়গুলোকে নিজেদের মুনাফাবৃদ্ধি আর আধিপত্য তৈয়ারে ব্যবহার করছে তা ন্যক্কারজনক। প্রথম আলো- গ্রামীণফোন থেকে শুরু হতে হতে এই ইন্ডাস্ট্রিতে জড়িয়ে পড়ছে সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক,ফোরথোট পিআর, ডাচ বাংলা ব্যাংক আর রবি কোম্পানি। সম্প্রতি জাতীয় দিবসে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার নাম দিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নিজেদেরকে এই মুনাফালোভীদের পাতা ফাঁদে জড়িয়ে নিচ্ছে। আমার এক চাচা (যিনি বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে চাকুরিরত) আমাকে গত পরশু বললেন, বাংলাদেশ সরকার যে মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে কম অর্থ বরাদ্দ করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নিচের দিক থেকে তার দ্বিতীয় অবস্থানে। এই ‘বিতর্কিত সরকার’এর নয়া সংস্কৃতিমন্ত্রী নাকি এখন বরাদ্দ বাড়াতে কাজ করছেন। ভাল কথা, রাষ্ট্রের সংস্কৃতির উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ান জরুরী। তাই বলে এইভাবে জাতীয় সঙ্গীতকে মুনাফালোভীদের মত বাজারের পণ্যের মত করে হাজির করে অপমান করার অধিকার এই মন্ত্রণালয়ের নেই। জনাব কল্লোল মোস্তফা এই সাংস্কৃতিক ধান্ধাবাজি নিয়ে লিখেছেন “লাখো কন্ঠে সোনার বাংলার মূল উদ্যোক্তা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আর অর্থের বিনিময়ে এটি আয়োজনের দ্বায়িত্ব পেয়েছে এশিয়াটিক এর সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান ফোরথট পিআরনামের একটা পিআর এজেন্সি।  সংস্কৃতিমন্ত্রণালয়েরদ্বায়িত্বপ্রাপ্তমন্ত্রীজনাবআসাদুজ্জামাননূরআবারএইফোরথটপিআরনামেরপ্রতিষ্ঠানটিরব্যাবস্থাপনাপরিচালকবাম্যানেজিংডিরেক্টর! আসাদুজ্জামান নূর নিজেই সংবাদ মাধ্যমে জানিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠান আয়োজন করতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ৫০ কোটি টাকা খরচ হবে, অবশ্য তিনি বলেননি তার প্রতিষ্ঠান ফোরথট পিআর এর ভাগে ঠিক কত পড়েছে। জনাব নুর এর মাধ্যমে যে গুরুতর অপরাধ করেছেন তা হলো- সরকারি দ্বায়িত্বে থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদে থাকা এবং দেশপ্রেমের রেকর্ডের নামে এমন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাতে তার নিজের প্রতিষ্ঠান সরাসরি লাভবান হয়। ফলে লাখো কন্ঠে সোনার বাংলানামের আয়োজনটি কতটা দেশপ্রেম থেকে করা হয়েছে আর কতটা ব্যাবসায়িক ধান্দা থেকে করা হয়েছে সেই প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক“।

 

শুনলাম, প্রতিটা সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে, এই তথাকথিত গণসঙ্গীতে শামিল হতে। এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমাকে জানিয়েছেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়কর্তৃপক্ষ এই দিবসে অংশগ্রহণ করতে শিক্ষকদের নিয়ে দু’দুবার বৈঠক করেছে। এই গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের রাষ্ট্র জোরকরে মিটিংয়ে বসিয়ে তাদের যে সময় অপচয় করাচ্ছেন তা নিন্দনীয়।

 

অথচ রাষ্ট্র চাইলে বিজয়ের ৪৩ বৎসর বার্ষিকীতে বিশেষ কর্মসূচীর আওতায় ৪৩হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতো। রাষ্ট্র এখন নিজেই সাম্রাজ্যবাদী-মুনাফাখোর বাজিগরদের কবলে আক্রান্ত। রাষ্ট্রকে এই অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসা জরুরী।

 

সংস্কৃতি ইন্ডাস্ট্রি এতদিন মুনাফালোভী ও আধিপত্যবাদী পুঁজিবাদীদের প্রকল্প থাকলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যেভাবে নিজেদের এই প্রকল্পে জড়িয়ে নিচ্ছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে একরকম বিরল ঘটনা। জাতীয় মুক্তির ইস্যুতে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের ফরজ কর্তব্য।

Raquib_bdf@yahoo.com

One thought on “সাম্রাজ্যবাদী মুনাফালোভীদের ক্ষমতার নিচে চাপা পড়ে রাষ্ট্র আর জাতীয় সঙ্গীতের চেতনা হারানোর বয়ান

Leave a comment