সহজিয়া বাংলার লাঠিয়াল

By Ariful Hossain Tuhin

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম থিসিস সুপারভাইজরের সাথে দেখা করতে। গিয়ে দেখি লাঠি সোটা নিয়ে ছাত্রলীগের ছাত্ররা ক্যাম্পাস দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম আজ কোন একটি গ্রুপকে পেটানো হচ্ছে। হয়ত অন্য রাজনৈতিক দলের সদস্যদের অথবা নিজেদের রাজনৈতিক দলেরই অন্য কোন গ্রুপকে আজ পেটানো হয়েছিল।

আমার মধ্যবিত্ত চিন্তাভাবনা প্রধানত “আপনি বাচলে বাপের নাম” দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং আপাতত যেহেতু আজকে ছাত্রলীগ দ্বারা মার খাবার সম্ভাবনা আমার নেই তাই আমি আমার কাজে চলে গেলাম। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে যে গভীর উদ্বেগ হবার কথা, তার কিছুই হল না। থিসিসের ক্যালকুলেশনগুলো কোনদিকে যাচ্ছে সেটাই তখনকার চিন্তার বিষয় হয়ে দাড়ালো।

কাজ শেষে অফিসে আশা পর্যন্ত জনাপঞ্চাশেক ছেলের লাঠি নিয়ে দৌড়াদৌড়ির দৃশ্যটি আর মনে ছিল না। সম্ভবত কিছুদিন আগে তারেক রহমানের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই মারামারির উদ্যোগ। “রোল রিভার্সাল” হলে এই পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হবে না। তখন হয়ত সজীব ওয়াজেদ জয়ের বক্তব্য কেন্দ্রকরে লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি হবে।

নিজেদের নেতার মানসম্মান রক্ষার জন্যে এধরনের উদ্যোগ আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের এই দেশে সকল বিখ্যাত এবং কুখ্যাত লোকেরই খুবই ঠুনকো ভাবমূর্তি রয়েছে। হোক সে ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক নেতা। সকল ক্ষেত্রেই তাদের মানসম্মান রক্ষার জন্যে সেই নেতার অনুসারীদের বিপুল তোড়জোড় দেখা যায়। এত নাজুক যাদের ভাবমূর্তি তাদের প্রতি করুণার উদ্রেক হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এত বিপুল শক্তি এবং মনোযোগের সাথে তাদের ভাবমূর্তি ২৪ ঘন্টা ৭ দিন পাহাড়া দেয়ার প্রপঞ্চটিও আমার কাছে বেশ দুঃখজনক লাগে। তবে আমি দুঃখ পাই এইজন্যে নয় যে দেশ এবং জাতির অনেক “মানব ঘন্টা” তুচ্ছ কাজে নষ্ট হচ্ছে। প্রথমত যারা লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে থাকেন, তাদের কাছে বিষয়টি অবশ্যই তুচ্ছ নয়। আর এই দৌড়াদৌড়ি বাদ দিলে যে মানব ঘন্টা একাজে ব্যবহার হয় তা অন্যকোন উতপাদনশীল কাজে ব্যবহার হত সেই বিশ্বাস আমার নেই। তাছাড়া সবকিছুতে অর্থনৈতিক হিসেব কষা এবং দেশ ও জাতির উন্নতির কথা অর্থনৈতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রীয়ার মাঝে একধরনের যান্ত্রিকতা যা আমার ঠিক রোচে না। কারো লাঠি নিয়ে দৌড়াতে ইচ্ছে করলে দৌড়াবে। আমার মাথায় না মারলেই হল। আমার দুঃখবোধ হয়, এই দৌড়াদৌড়ির মত কাজে জীবন ব্যয় করে বেচারাদের একধরনের একঘেয়েমি আসার কথা। বাংলাদেশের সরকারী দলগুলো ৫ বছরে দৌড়াদৌড়ি করে হাঁপিয়ে পরে। যদিও আওয়ামী লীগ এইবার কিছুটা দীর্ঘসময় ধরে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের দৌড়ের মধ্যে অবসাদের লক্ষণ স্পষ্ট। মাঝে মাঝেই তাদের দৌড়াদৌড়ির প্রধান কারন হয় প্র্যাকটিস। কিন্তু কাঁহাতক প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলা যায়?

যাই হোক, অফিসে এসে আমার আর এস এস রিডারে বিভিন্ন জিনিসের এলার্ট ঘাটছি। একটি পেপারের দিকে নজর ফিরল[১]। পেপারের বিষয় একটি পপুলেশনে কিভাবে গোত্র তৈরী হয় তার গাণিতিক মডেল।

সামাজিক পদার্থবিজ্ঞান , পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারনা সামাজিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করে। এই পেপারটিও সেই ধারার অন্তর্ভুক্ত।

এখানে যা প্রয়োগ করা হয়েছে তা আমাদের চিরপরিচিত পারিসাংখ্যিক বলবিজ্ঞানের ধারনা। পারিসাংখ্যিক বলবিজ্ঞানে কোন সিস্টেমে কণাগুলোর আলাদা করে গতি হিসেব না করে তাদের গতির একটি সম্ভাবনাভিত্তিক অনুমান গ্রহন করা হয়। দেখা যায় সাধারন সেই অনুমান থেকে ম্যাক্রোস্কোপিক বিভিন্ন বৈষিষ্ট্য যেমন তামমাত্রা ইত্যাদি উদয় হয়।

যেহেতু একজন ব্যক্তিমানুষের জন্যে তার ব্যবহারের কোন সুনির্দিষ্ট তত্ব দাড়া করানো কঠিন, তাই তার ব্যবহারের কিছু সাধারন অনুমান গ্রহন করে দেখা হয় পপুলেশন লেভেলে কি ধরনের বৈশিষ্ট্য emerge করে।

এই পেপারে আলোচনা করা হয়েছে মতামতের ডাইনামিক্স। দেখার চেষ্টা করা হয়েছে কিভাবে স্বতপ্রণদিতভাবে নেতা তৈরী হয়। গবেষণার ফলাফল বেশ মজার। দেখা গেছে ধীরে ধীরে পপুলেশনে একটি “সেকেণ্ড অর্ডার ফেইজ ট্রানজিশন”(সেকেণ্ড অর্ডার ফেইজ ট্রানজিশনের সহজ উদাহরন ফেরোম্যাগনেট, যেখানে ডোমেইন তৈরী হয়) হয়। এর ফলে বেশ কিছু গোত্র তৈরী হয় তারা পরস্পরের থেকে মতামতের ব্যপারে আলাদা।

যেহেতু এই প্রবণতা জেনারালাইজড পপুলেশনের জন্যে, সেহেতু গোত্র তৈরী, এবং এক গোত্রের অন্য গোত্রের প্রতি লাঠি নিয়ে দৌড়ানো দেখে অবাক হবার কিছু নেই। আমাদের মধ্যবিত্ত মন হয়ত এইসব লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি দেখে সামান্য আহত হতে পারে। কিন্তু এই আহত হওয়া অনেকটা প্রাকৃতিক বর্জ্যের মত। প্রাকৃতিক বর্জ্যের গুরুত্ব আমরা কেউই অস্বীকার করিনা। কিন্তু চোখের সামনে দেখলে আমাদের ভদ্রতা শুচিতা ইত্যাদি আহত হয়। তেমনি লাঠিসোটার ঝংকার যা ইতিহাসের শুরুথেকেই আমাদের প্রজাতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সেটিকেও অস্বীকারের কোন কারন নেই। শুধু চোখের সামনে না ঘটলেই হল।

এই অঞ্চলের লোকজন প্রকৃতিবিরুদ্ধ “মানবাধিকার”, “সম অধিকার”, “বাকস্বাধীণতা” ইত্যাদিকে গ্রহন করতে প্রস্তুত নয়। প্রধান কারন অবশ্যই এইগুলো সত্যিকার অর্থে প্রাকৃতিক নিয়ম নয়। এই যায়াগায় টমাস জেফারসনের সাথে দ্বিমত করতেই হচ্ছে। এইসব অধিকার আমরা জন্মের সাথে সাথে পেয়ে যাই না। ইদুড়ের কোন অধিকার যেমন বিড়াল স্বীকার করে না, তেমনি আমাদেরও ইনট্রিনসিক কোন প্রণোদনা নেই অন্যমতের বা অপছন্দের মানুষের অধিকার স্বীকার করার মাঝে।

লাঠালাঠিই আমাদের আসল চেহারা। সেই চেহারার পরিবর্তন চাইলে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেতে হয়। অনেক জাতি কিছুটা সেই বিরুদ্ধযাত্রার পথে যাচ্ছে। আমরা অনেক প্রকৃতির কাছে বসবাস করি। আমদের দার্শনিকরা বলেন যে আদিকালে মুসলমানরা এবং নিম্নবর্গের অচ্ছুত দলিতরা সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখত না, সে আদিকালে আমাদের সহজিয়া ভাবান্দোলন ছিল যা প্রকৃতি এবং প্রতিবেশের জন্যে একই সাথে মমতা এবং দ্রোহের প্রতীক। সুতরাং আমাদের সহজিয়া হওয়া উচিত এবং প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে এবং সহজিয়া যুগের মাঝে আমাদের আত্নপরিচয় আবিস্কারের মাধ্যমে অন্য গোত্রের মাথায় দুই বেলা লাঠির বাড়ি বসানো উচিত। নাহলে আমাদের প্রাকৃতিক উতস এবং তার সাথে সংযুক্ত দেহবাদী ভাবান্দোলনের অপমান হয়।

[১] Mosquera-Donate, G. & Boguna, M. Follow the Leader: Herding Behavior in Heterogeneous Populations. arXiv (2014)
http://arxiv.org/abs/1412.7427

Leave a comment