by Jahid Islam
দেশের একজন সাহসী চিন্তাবিদ ছিলেন আহমদ ছফা। তাঁর চিন্তায় স্বচ্ছতা ছিল। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন, লিখতেন। এতে কে খুশি হল, কে বেজার হল সেটার প্রতি খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করতেন বলে মনে হয় না। তাঁর লেখা একটা চমৎকার প্রবন্ধ হল, “বাঙ্গালী মুসলমানের মন”। এখানে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন- “বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি। সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসাভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সঙ্কুচিত। বাঙ্গালি মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত, সবচেয়ে মজার কথা এ-কথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না।”
এ প্রবন্ধের শেষ প্যারায় লিখেছেন-“বাঙ্গালি মুসলমানের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙ্গালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুণ তার মনের ওপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত হয়ে রয়েছে,সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে। দু’ বছরে কিংবা চার বছরে হয়তো এ অবস্থার অবসান ঘটানো যাবেনা, কিন্তু বাঙ্গালী মুসলমানের মনের ধরন-ধারণ এবং প্রবণতাগুলো নির্মোহভাবে জানার চেষ্টা করলে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ হয়তো পাওয়াও যেতে পারে।”
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের সোল এজেন্ডা মুক্তিযুদ্ধ ও সেকুলারিজম। তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একমাত্র ধারক ও বাহক হিসেবে মনেপ্রাণে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। প্রগতির কথা বলে শিক্ষিত মিডেল ক্লাসের কাছে আবেদন রাখতে চায়। সেকুলারিজম এবং আঞ্চলিক জঙ্গিবাদের উথানের ভয় দেখিয়ে বাইরেরর দুনিয়ার সমর্থন আদায় করতে চায়। শাহবাগে হাজার লোকের সমাগম দেখে তারা ভাবে এবার জোয়ার এসেছে, আর ঠেকায় কে ! এই বারের চোটে রাজীব হায়দার (থাবা বাবা) কেও শহীদ ঘোষণা করে দেয় শেখ হাসিনা। শাহরিয়ার কবিররা ভাবেন- “কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠা করা না গেলেও যেহেতু বাহাত্তরের সংবিধানের কাছাকাছি কিছু একটা এখন আছে যাতে মূলনিতী হিসেবে ‘কম্যুনিজম’ এর কথা উল্লেখ আছে, সংবিধান থেকে আল্লাহর নাম বাদ পড়েছে,শাহবাগে হাজার হাজার মানুষ এসেছে, এবারে অন্তত ধর্ম নামের আফিমের হাত থেকে মুক্তি মিলবে।”
বাস্তবতা হল এরকম যে, বাঙ্গালী মুসলমান শাহবাগে জড় হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে যদি শবে বরাত হয় (শবে বরাত পালন সহিহ কিনা সেটা অন্য তর্ক) সে তার পুরোনো পাঞ্জাবীতে শান দিয়ে, টুপি মাথায় দিয়ে হাজির। নফল ইবাদতের মাধ্যমে ভাগ্য বদলের জন্য দোয়া করে সারারাত। হয়ত পরের দিন থেকেই আবার নামাজ পড়ে না। কিন্ত আওয়ামী লীগের উগ্র সেকুলারিজমে সে বিশ্বাস করে না। নবীজিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে শুনে শাহবাগ থেকে সে হাত গুটিয়ে নেয়। সংবিধানে আল্লাহর নাম নিয়ে কাটা ছেঁড়াও তার বিশেষ পছন্দ না। কম্যুনিজম এবং উগ্র সেকুলারিজমের প্রধান মুফতি শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসির মামুন শবে বরাতের রাতে নামাজকে আদিখ্যেতা মনে করে। মনে মনে বলে, “ শালার বাঙ্গালী। আবার মসজিদে যাও না ! এত্ত বুঝাই তাও কাম হয় না !”।
আবার আল্লামা শফির ডাকে হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় এসেছে অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে। সাধারণ পথচারীরাও প্রিয় নবীজিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে শুনে এতে শামিল হয়েছে। ইসলামপন্থীরা ভাবে এবার বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া কেবলই সময়ের ব্যাপার। তবে এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা হল, যেই বাঙ্গালী নিয়ে আল্লামা শফি বা জামায়াতে ইসলামি, দেশে ইসলামি শাসনের স্বপ্ন দ্যাখেন/দ্যাখে সেই বাঙ্গালী মাজারে যায়। পীরের মুরিদ হয়, মৃত ব্যক্তির কবরে সিজদা করে, গলায় তাবিজ দেয়, মিলাদ পড়ে। এছাড়াও আরও অনেক রকম শিরক করে, বিদআতি কাজ কর্ম করে।
আবার এটাও ঠিক যে, সে ইসলামকে ভালবাসে। শুক্রবারের জুম্মার খুতবায় হুজুরের ওয়াজ “ভাইয়েরা আমার, ইসলাম-ই একমাত্র মুক্তির পথ”, শুনে সে মাথা নাড়ায় এরপর ঘরে এসে আরাম করে বসে শুক্রবারের সিনেমা দেখে। সে যে ইসলামকে ভালবাসে, সেটা সে প্রকাশ করে মসজিদের হুজুরকে দাওয়াত দিয়ে ঘরে এনে খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে। সকালে সে তার ছেলে মেয়েকে আরবী পড়তে মক্তবে পাঠায়। শহর হলে হুজুর বাসায় এসে পড়ায়। ছেলে মেয়েরা কোরআন পড়া শিখে, নামাজের নিয়ম কানুন শিখে । সে মনে করে ব্যস-এই ত ইসলাম, আর কি ?
সে পলিটিক্যাল ইসলামে কনভিন্সড না। মসজিদের হুজুরকে সে নামাজের মিম্বরে কিংবা ওয়াজের জায়গায় চিন্তা করতে পারে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী/এমপির সিটে না। তার কাছে রাজনীতি একটা খারাপ জায়গা। হুজুরের সেখানে কি কাজ ? জামায়াতের নেতাদের ক্ষেত্রে, যে কোন মূল্যে তাদের ফাঁসি হোক এটা সে চায় না (এটা আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর কথা না, সাধারণ মানুষের কথা)। তবে ৭১ এ তারা ছিল দেশ বিরোধী এটাই সে বিশ্বাস করে । তাই তাদেরকেও ভোট দিতে সে খুব একটা উৎসাহি না, অন্তত জামায়েতের ব্যানারে না। সেকুলারিজম, কম্যুনিজম, জাতীয়তাবাদ কিংবা ইসলামি শাসন এগুলো সব ইন্টেল্যকচুয়াল কনভিকশন। সে এত কিছু বোঝে না। আমি বাজি ধরে বলতে পারি দেশের অন্তত ৫০ ভাগ লোক দেশে কয়টি সেক্টরে যুদ্ধ হয়েছে, বা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস কবে বলতে পারবে না। ৮০ ভাগ বা তার চেয়েও বেশি লোক সহিহ উচ্চারণে কোরআন পড়তে পারে না।
সে যে ৫ বছর পর পর সুইং ভোট দিয়ে সরকারের পতন ঘটায় এটা এ জন্য না যে, ৫ বছর পর একদিন আচমকা ঘুম থেকে উঠার পর তার মাথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের খায়েশ জাগে । অথবা দেশকে ভালবেসে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে । অথবা একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ থেকে আর নামাজ ক্বাযা নয়। এবার থেকে পুরোপুরি সে ইসলামি পথই অনুসরণ করবে। সে এটা করে দুই দলের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে। তার এত কিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় নাই। সে ছোটে পেটের তাগিদে। এরপর যতটুকু পারে ধর্ম কর্ম করে। মূলত তার নামাজ জুম্মার নামাজ, ঈদের নামাজ আর জানাজার নামাজে সীমাবদ্ধ। আর ইসলামি জ্ঞানের একমাত্র সম্বল হল শুক্রবারের ওয়াজ।
সেকুলারিজম বা ন্যশনালিজম বা পলিটিক্যাল ইসলাম আবার কি ! এত হ্যাভিওয়েট ডেফিন্যাশন সে জানবে কোথা থেকে ? এটা হল পিউর বাস্তবতা। কোন সুগার কোটিং নাই। আপনি সেকুলারিজম, কম্যুনিজম, জাতীয়তাবাদ কিংবা ইসলামি শাসন যাই কায়েম করতে চান এটা ভাল মত বুঝে এরপর শুরু করতে হবে। এটাই কাজ শুরুর প্রথম ধাপ।এরপর সে অনুযায়ী মডেল বানাতে হবে। এখানে ভারত বা ফ্রান্সের সেকুলারিজম, ব্রিটিশ ন্যশনালিজম অথবা মিশর কিংবা তুরস্কের ইসলামি মডেল চলবে না। চীন রাশিয়ার প্রেতাত্মা ত আগেই দূর হয়েছে। এদেশে স্রেফ একটাই চলবে, সেটা হল –“বাংলাদেশি মডেল”। এতে অন্যান্য মডেলের কনসেপ্ট থাকতে পারে, তবে সবশেষে হতে হবে একেবারে কাস্টমাইজ করা দেশী জিনিস । “কমরেড” বা “ইয়া আখি” টাইপ পরিভাষা এখানে চলবে না। অন্তত শুরুতে না। পরিস্থিতির বাস্তবতা বুঝে যে যত রিয়েলিস্টিক মডেল বানাতে পারে তার মডেল তত ভাল কাজ করবে। প্রথমে প্র্যাকটিক্যাল কেস থেকে শুরু করে এরপর এটাকে আস্তে আস্তে ক্যালিব্রেট করতে হবে আইডিয়াল মডেলের দিকে।