ডোনাল্ড ট্রাম্পের র‍্যালি থেকে ফিরে (ছবি ও ভিডিও সহ)

1

শাফকাত রাব্বীঃ

ডোনাল্ড ট্রাম্পের র‍্যালি দেখার খুব শখ ছিল। দেখতে গিয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন ডালাস শহরের একটা নাইট ক্লাবে। আমার টিকেট ছিল না, একারনে নাইট ক্লাবের ভিতরে ঢুকতে পারা যায় নাই। ক্লাবের বাইরে দাঁড়িয়ে শত শত সাপোর্টার আর প্রতিবাদকারীদের চিৎকার চেঁচামেচি, নাচা নাচি, গালাগালি, আর স্লোগান উপভোগ করে বাড়ি ফিরেছি।

13453014_10153505275905653_1716457272_o

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইলেকশনের অবস্থা ভালো না। আর মাত্র ৪ মাস পরে ইলেকশন। ডালাস-ফোর্টোয়ার্থ এলাকা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৪র্থ বৃহত্তম জনবহুল এলাকা। এত গুরুত্বপূর্ন একটা এলাকায় ইলেকশনের মাত্র ক’মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে র‍্যালি করতে দিতে  বড় কোন ভেন্যু নাকি রাজী হয়নি। এই কারনে ডালাসের দক্ষিন দিকের বাজে একটা এলাকার নাইট ক্লাবে ট্রাম্পকে তাঁর র‍্যালি করতে হয়েছে।

র‍্যালির এলাকায় গিয়ে দেখি এলাহী কারবার। শত শত পুলিশ। আকাশে ৫ টা হেলিকপ্টার উড়ছে, দুটা হেলিকপ্টার পুলিশের আর তিনটা মিডিয়ার। ঘোড়ার গাড়ি, বাই সাইকেল, মোটর সাইকেল, মোপেড, গাড়ী আর পায়ে হেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন সাজ সোজ্জার পুলিশ। উঁচা বিল্ডিং গুলোতে স্নাইপার রাইফেল নিয়ে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন। আমি এর আগে ডেমক্রাট পার্টির বার্নি স্যান্ডারস এবং রিপাব্লিকান পার্টির মার্কো রুবিও এর র‍্যালিতে গিয়েছি। কারো র‍্যালিতে এতো সিকিউরিটি এবং পুলিশি বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করিনি।

13441854_10153505279685653_1651228186_o

র‍্যালি এলাকার মধ্যখানে পুলিশ কাধে কাধ দিয়ে হিউম্যান ব্যারিকেড দিয়েছে।  এক পাশে ট্রাম্প সাপোর্টার আর অন্য পাশে প্রতিবাদকারীর দল। কেউ কারো দিকে বেশী এগিয়ে গেলেই পুলিশ বাঁধা দিয়ে দূরে সড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে থেকেই কোন কোন প্রতিবাদকারী হাটতে হাটতে অন্য সাইডে চলে যাচ্ছে, উত্তেজক দু চারটা কথা বলে ফিরে আসছে। ধরতে পারলে পুলিশ ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিচ্ছে। তখন আবার প্রতিপক্ষ খুশিতে স্লোগান দিচ্ছে।

র‍্যালির ঢুকার মুখেই দেখলাম একদল টেক্সাস মিলিশিয়া  দাঁড়িয়ে আছে। টেক্সাসে যে কোন সাধারন মানুষ তাঁর বন্দুক নিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘুরাফিরা করতে পারে, মিলিশিয়া গঠন করতে পারে। এটা তাঁদের নাগরিক অধিকার। এটাকে বলে “ওপেন ক্যারি”।  র‍্যালির শুরুতেই ৭-৮ জন মিলিশিয়া বিশাল বিশাল বন্দুক, আর্মির মতো পোশাক, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, সান গ্লাস পড়ে এই অধিকার ফলাচ্ছেন। এদেরকে পাহাড়া দিচ্ছে ১০-১২ জন পুলিশ যারা কিনা মিলিশিয়ার থেকে হাল্কা অস্ত্র শস্ত্র বহন করছে।

13410729_10153505281075653_912270260_o

একজন পিস লাভিং পাগলাটে লোক এই মিলিশিয়াদের মরে যাওয়া গাঁদা ফুল টাইপের একটা ফুল দিবার অনুমতি চাইল। মিলিশিয়ারা গম্ভীরমুখে অনুমতি দিল। পাগলাটে লোকটা বন্দুকের নলে গাঁদা ফুল পড়িয়ে দিল। আমরা সবাই ছবি তুললাম।

13446317_10153505279360653_1135201895_o

প্রতিবাদকারীদের এলাকার মধ্য খানে বিশাল একটা মেক্সিকোর পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল একজন মেক্সিকান আমেরিকান। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল বাদবাকী প্রতিবাদকারীরা নানা ধরনের ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে। প্রতিবাদ কারীদের হাতে  অনেকগুলো মেক্সিকান পতাকা এবং সমকামীদের রেইনবো পতাকা দেখলাম। বড় সাইজের কোন আমেরিকান পতাকা চোখে পড়েনি। হয়তো আমি যখন ছিলাম তখন বড় পতাকা ওয়ালা প্রতিবাদকারী কেউ এসে পৌছায়নি।

13461317_10153505280130653_859908887_o

ট্রাম্পের সাপোর্টারদের মধ্যে  সাদা, খুবই আটো সাটো পোশাকের কয়েকজন তরুনী ছিল। দেখতে ভালো, এবং খুবই এগ্রেসিভ। বুঝাই যায় যে ট্রাম্প মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার মালিক।  নানা ধরনের শরীরি কসরতের মাধ্যমে এই  ট্রাম্প গার্লরা স্লোগান দিচ্ছিল। একজন পরীর মতো উড়ে বেড়ানোর একটা ভঙ্গিমা করছিল। এই পরী ইচ্ছা করে প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল বারবার।

আমি পরীর সাথে কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম ট্র্যাম্পের মহিলা বিষয়ক নানাবিধ মন্তব্য তাকে বদার করে কিনা। পরী উত্তরে বলল, ” আই ডোণ্ট গিভ আ শিট”। আমি বললাম ট্রাম্পের কোন জিনিসটা তোমার সবচাইতে ভালো লাগে? পরী জানালো, “বাকি সব ক্যান্ডিডেট হলো একদল পুসি”। প্রতিবাদকারীদের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “এই যে এদের মতো। আর ট্রাম্প-ই  হলো একমাত্র আসল পুরুষ।”

13453188_10153505281520653_862247741_o

আমার কথা বলার মুহুর্তে একজন কালো একটা ছেলে এসে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো সে ঠিক ঠাক আছে কিনা। অর্থাৎ আমি পরীকে ডিস্টার্ব করছি কিনা। মেয়েটা বললো না। আমি মানে মানে সটকে পড়লাম।

এমন সময় দেখা হলো “ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস” নামে কালোদের সিভিল রাইট আন্দোলনের এক কর্মীর সাথে। আমি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ড শেইক করলাম।  ছেলেটা পুরা র‍্যালিতে একমাত্র কালো মানুষ যে বন্দুক নিয়ে ওপেন ক্যারি করছে। অর্থাৎ সাদা মিলিশিয়াদের সাথে শেয়ানে শেয়ান পাল্লা দিয়ে এই কালো ছেলেটাও একটা বিশাল বড় বন্দুক নিয়ে এসেছে, ওপেন ক্যারি করার জন্যে। আমি তাঁর সাথে কিছু আলাপ সেড়ে তাঁর একটা ছবি তুললাম। খুব খুশী মনে ছবি তোলার পোজ দিল।

black lives

এখানে উল্লেখ্য, মাত্র ক’দিন আগে এধরনের একটা বিশাল বন্দুক দিয়েই  ৫০ জন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে ফ্লোরিডাতে।

13453305_10153505281060653_1680943089_o

এর পরে এক খুবই ইমশনাল ঘটনা ঘটলো। আমি খেয়াল করে দেখলাম একজন ৫০-৬০ বছরের মহিলা ফুটপাতে বসে কাঁদছেন। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে ঠিক আছে কিনা। মহিলা জানালেন সে ঠিক আছেন, কিন্তু তাঁর ছাত্রের কথা মনে পড়ছে। যার জন্যে সে প্রতিবাদ করতে এসেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম ছাত্রের কি হয়েছে। জানালো পুলিশ মেরে ফেলেছে। ছাত্রটি কালো ছিল। তাঁর ভাষায় অসম্ভব মায়াবী একটা ছেলে ছিল,  পৃথিবীর সব চাইতে বড় হৃদয়বান, আর  ভালো ছেলে। বলতে বলতে মহিলা কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন। আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না পুলিশ মেরেছে কেন। মহিলার নাম সুজান।

সুজান জানালেন সে ডালাসের কালো আর হিস্প্যানিক অধ্যুষিত একটা এলাকায় হাই স্কুলের টিচার। তাঁর বাবা মা দু’জন ডাক্তার। পরিবারের সবাই রিপাব্লিকান। সুজান ইচ্ছা করে মাত্র ৫০ হাজার ডলার বেতনের চাকরী নিয়েছেন, ডালাসের সব চাইতে খারাপ একটা এলাকায়।

সুজান জানালেন তিনি কাদছেন মানুষে মানুষের মধ্যে ঘৃনা দেখে। এতো ঘৃনা সে আগে কখনও দেখে নাই। সুজান বললেন পুলিশের দোষ নাই। পুলিশদের মধ্যে এতো ঘৃনা জোগাড় করে দেয় ট্রাম্পের মতো পলিটিশিয়ানরা। আরো অনেক কথা হলো সুজানের সাথে। আমি সুজানকে জানালাম তাঁর মতো মানুষ আছে বলেই আমেরিকান মাইনরিটিরা এখনও আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে।

এমন সময় পুলিশদের সাপোর্ট করা পোস্টার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একজন। সুজান আমাকে বললেন, সরি, তুমি আমার থেকে এখন একটু নিরাপদে দূরে গিয়ে দাড়াও। আমি এই পুলিশের সাপোর্টারের সাথে এখন ঝগড়া করবো। আমি সড়ে দাড়ালাম। মহিলা দেখলাম আস্তে আস্তে ঝগড়া শুরু করলেন। ঝগড়া শেষে আমাকে জানালেন সিচুয়েশন কোন কারনে খারাপ হলে তাকে জানাতে, তাঁর বাসা কাছেই একটা আপার্ট্মেন্টে, শেল্টার নিতে পারবো। আমি হাসি মুখে বললাম, “ওকে জানাবো তোমাকে”।

পুরো র‍্যালির ট্রাম্প সাপোর্টারদের সবাই সাদা। কিছু ভাড়া করা গুন্ডা টাইপের কালো ছেলেও ছিল। তাদের একজন প্রকাশ্যে চিৎকার করে সবাইকে জানাচ্ছিল যে কোন ট্রাম্প গার্ল-এর গায়ে কেউ যদি হাত দেয়, তাহলে তারা ফিস্ট ফাইটের জন্যে প্রস্তুত। এই কালো গুন্ডা গুলোর একজনই আমার সাথে কথা বলার সময় সেই পরীকে জিজ্ঞেস করেছিল সে ঠিক ঠাক আছে কিনা।

13446215_10153505279840653_523999363_o

প্রতিবাদকারীদের মধ্যে বেশি ভাগই দেখলাম হিস্প্যানিক আমেরিকান। তাদের সাথে প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছিল ইংরেজি সিনেমার গিক কিংবা ইন্টেলেকচুয়ালদের মতো দেখতে অনেকগুলো সাদা ছেলেমেয়ে। এদের সাথে ছিল ওয়ার্কিং ক্লাসের অনেক কালো মানুষ। এই প্রতিবাদকারীদের যেই বর্ননাটা দিলাম, এটাই হলো লিবারেল আমেরিকান কোয়ালিশন। সারা আমেরিকার যেকোন সিটিতে ইস্লামোফোবিয়া, এলজিবিটি, মেক্সিকান, ইমিগ্রেশন ইস্যু এই সব কিছুতে এই কোয়ালিশনটাকেই একশনে দেখা যায়।

ট্র্যাম্প সাপোর্টারদের স্লোগান ছিল বেশ বোরিং। স্লোগানের ভাষা কথা একটাই — “ইউ এস এ, ইউ এস এ”।  প্রতিবাদকারীদের ভাষার কারুকাজ অনেক আকর্ষনীয়, তবে মূল বক্তব্য  একটাই। সেটা হচ্ছে,  নো মোর হেইট , বা আর ঘৃনা নয়।

আমি র‍্যালিতে থাকার বেশির ভাগ সময়ই  ট্রাম্প সাপোর্টারদের সাইডেই ছিলাম। এটা করেছি প্রতিবাদকারীদের ছবি সামনে থেকে ভালো  ভাবে তোলার তাগিদ থেকে।  ছবি তোলার ফাকে,  অনেক ট্রাম্প সাপোর্টারের সাথে কথা হলো। একে বারে মুর্খদের মতো দেখতে যারা তাদের থেকে শুরু করে ভদ্র টাইপের অনেকের সাথেই। সবাই বেশ ফ্রেন্ডলি ব্যাবহারই  করলো।

এক ফাকে বন্দুক ধারী মিলিশিয়াদের কাছেও গেলাম। দু চারটি কথা বলে সরে গেলাম, এতো বড় বড় বন্দুক ওয়ালা সিভিলিয়ান দেখতে কেমন জানি আন কম্ফোর্টেবল লাগলো।

13467638_10153507611695653_325156753_o

আরো অনেক কিছুই বলার ছিল, কিন্তু লেখাটা  বিশাল হয়ে যাচ্ছে। র‍্যালিতে অংশগ্রহণকারীদের  দেখে যা বুঝলাম, “নো মোর হেইট” এই মেসেজটা খুবই পাওয়ারফুল একটা মেসেজ।  এই মেসেজকে হারাতে ট্রাম্পের অনেক সমস্যা হবে।  কেননা আমেরিকার সাধারন মানুষগুলো খুবই সাদামাটা এবং ফেয়ার।

13461296_10153505279975653_2140286623_o

 

13441985_10153505280245653_2065440672_o

13446305_10153505280285653_594990252_o

One thought on “ডোনাল্ড ট্রাম্পের র‍্যালি থেকে ফিরে (ছবি ও ভিডিও সহ)

  1. আপনার মাধ্যমে ট্রাম্প ও তার সাপোরটার দের ব্যাপারে জানতে পারলাম ,ধন্যবাদ,

Leave a comment