এঞ্জয় দ্যা গ্ল্যাডিয়েটরিয়াল ফাইট

roman-gladiators-5

by zainuddin sani

‘সো? হু ইজ উইনিং?’ এই মুহূর্তে সবার মনে কেবল এই একটাই প্রশ্ন। নেতা নেত্রীদের কথার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সবাই এই একটা প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। সমঝোতার কথা কে বেশি বলছে? তার মানে সে হারু পার্টি। পাতি নেতাদের কাজই হচ্ছে জ্বালাময়ী কথা বলা। বিএনপির পাতি নেতারা ‘দাঁত ভাঙ্গা জবারে’র কথা বলে বলে নিজেদেরই দাঁত ক্ষয় করে ফেলেছেন আর আওয়ামী পাতি নেতারা সারাক্ষণ হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন ‘তাঁরা চাইলে বিএনপির কি দুর্গতি করতে পারেন’। এবং যথারীতি কোন পক্ষই কিছু করতে পারছে না। ফলাফল হচ্ছে, সাধারণ মানুষ কেউই আর এইসব পাতিনেতাদের কথা পাত্তা দিচ্ছেন না।

সব চোখ এখন বড় দুই নেত্রীর দিকে। হার্ডলাইনে যাওয়া থেকে সরে আসবার কোন কথা কি নেত্রী বলছেন? কিংবা আন্দোলন আরও বেগবান না করে আলোচনা করার কথা কি নেত্রী বলছেন? বাক্যের শব্দগুলো কত কর্কশ কিংবা কত মোলায়েম তা দেখে সবাই ঠিক করে নিচ্ছেন, বল এখন কার কোর্টে। বাকি যত দর্শক আছেন, সুশীল থেকে কুশিল, দেশি হোক আর বিদেশী, সবার মুখে এখন একই নামতা, ‘আলোচনা কর’। এদের পাত্তা দেয়ার তেমন কিছু নেই। এরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই কথা বলে আসছেন, আর আমাদের নেতারা তাঁর তোয়াক্কা না করেই নিজেদের গোঁয়ার্তুমি যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। মূল যে প্রভু, তিনি যতক্ষণ কোন একটি দলের সঙ্গে আছেন, অন্য কেউ তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না। তাঁরা অবশ্য প্রকাশ্যে কিছু বলেন না, নেতা নেত্রীদের মুখের ভাষা শুনে বুঝে নিতে হবে, বাতাস ঘুরে গেছে কি না।

আওয়ামীরা যে লাইনে ফাইট দিচ্ছে তা হচ্ছে হরতাল অবরোধে হওয়া মৃত্যুগুলোকে হাইলাইট করার চেষ্টা করে যতটা ফায়দা লোটা যায়। ভয়াবহতম মৃত্যুগুলোকে নিয়েই সবেচেয়ে সেন্টিমেন্টাল ফায়দা হাসিল করা যায়। পত্রিকায়, টিভিতে কিংবা টক শোর আলোচনায় যত বেশিবার এই টপিক আসবে, ততো বেশি সুবিধা আওয়ামীদের। নিজেদের পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে তাই বারবার এই বিষয়গুলো আনবার চেষ্টা হচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির এই মুহূর্তের প্রধান চিন্তা, আন্দোলনে যেন ছেদ না পড়ে। লাশগুলো কিছুটা ব্যাকফায়ার করছে, তবে অবরোধ আর হরতাল তাঁর ইমপ্যাক্টও ফেলছে। সরকারকে যে বিচলিত করে ফেলেছে তা আওয়ামী পাতি নেতাদের লম্ফঝম্ফ দেখে আন্দাজ করে নেয়া যাচ্ছে।

তবে দুই দলেরই মূল সমস্যা হচ্ছে ‘দীর্ঘসুত্রিতা’। আন্দোলন দীর্ঘ হলে আওয়ামী বিএনপি দুদলেরই সমস্যা। আওয়ামীদের সমস্যা হচ্ছে, প্রমাণ হয়ে যাবে তাঁরা অথর্ব, এই আন্দোলন দমানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। অন্যদিকে অবরোধ আরও কিছুদিন চললে বিএনপিও ঝামেলায় পড়বে। দেশের অর্থনীতির ওপর শুরু হওয়া চাপ এবং সেকারণে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া জনগণ কিছুটা হলেও তাদেরকে দায়ী করবে। আর মানুষের দেয়ালে পিঠ থেকে গেলে, তাঁরা ঠিক কি করবে, বোঝা ভার। দেশের হওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতি সম্পর্কে দুই দলই সচেতন, তবে এটাও জানে, ছাড় দিলেই অবধারিত মৃত্যু।

আওয়ামীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এবং বড় দুর্বলতার নাম আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। অবরোধে হওয়া জন দুর্ভোগ কিংবা জ্বালাও পোড়াও থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে আপাতত তাঁরা ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা ঘোচাতে যা তাঁরা করতে পারে, তা হচ্ছে, ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো। তেমন করবার ইচ্ছে জানাতে গিয়ে পুলিশ, বিজিবি আর র‍্যাব প্রধান বেশ ঝামেলায় পড়ে যান। অতি দ্বায়িত্বশীলতা দেখাতে গিয়ে এমন কিছু কথা বলে ফেলেন, যে পরের দিন তাঁদের আবার ব্যাখ্যা দিয়ে জানান দিতে হয় যে তাঁরা রাজনীতি করেন না। সারাংশ হচ্ছে, যদি তাঁরা অ্যাকশানে যান এবং বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের লাশ পড়ে, তখন পরিস্থিতি কি হবে, তাঁরা নিজেরাও তা আঁচ করতে পারছেন না, আর সেকারণেই চাইছেন, ব্যাপারটা যেন সে পর্যন্ত না গড়ায়। হুমকি ধামকিতে কাজ হলে সবকুলই রক্ষা পায়।

এমন ‘স্টেলমেট’ অবস্থায় সরকারী বাহিনী তাই আপাতত গ্রেফতার পর্যন্তই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন। হুঙ্কার, হুমকি চলছেই, তবে সত্যিই তেমন হার্ডলাইনে তাঁরা যাবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ করছেন। অন্যপক্ষও খুব আরামে নেই। বিরোধী দলের প্রায় সব বড় নেতাই চোদ্দ শিকের পেছনে। আত্মগোপনে থাকা কিছু কিংবা সরকারের সঙ্গে মৃদু লিয়াজো করে চলা কিছু নেতা এখনও বাইরে আছেন। ওপর মহল থেকে প্রতি মুহূর্তের নির্দেশনা না আসায়, কর্মীরা বুঝে উঠতে পারছেন না কি করবেন। অতি উৎসাহে জ্বালাও পোড়াও করবেন? লুকিয়ে থাকবেন? না গ্রেফতার হয়ে নিজেদের অকুতোভয় প্রমাণ করবেন? ফলে দেখা যাচ্ছে, সরকারী দলের ওপর মহলের মত বিরোধী দলের তৃণমূলও এখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।

একে অপরের ওপর করা গুপ্তচরবৃত্তিতে, মনে হচ্ছে এখন একটি স্থিতি অবস্থা বিরাজ করছে। বিএনপির কি হতে যাচ্ছে পরবর্তী সিদ্ধান্ত, তা ম্যাডাম আর তারেক সাহেব ছাড়া আর কেউ জানে না। অন্যদিকে আওয়ামীদের সিদ্ধান্ত বা গেম প্ল্যান প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানে না। বিভিন্ন পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেল, ‘জানা যায়’ কিংবা ‘বিশ্বস্ত সূত্রের খবর’ বলে যা প্রচার করছে, এই মুহূর্তেই সেটারই কদর সবচেয়ে বেশি। কাকে বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে, কে বেশি হাসিখুশি, কে সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে কথা বলছেন, এসবই হচ্ছে এখন ‘ব্রেকিং নিউজ’।

বালুর ট্রাক সরানো কিংবা পুলিশ ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলা কিসের ইঙ্গিত, তা নিয়ে সবাই এনালাইসিস শুরু করে দিয়েছেন। ভাইবার, ট্যাঙ্গো, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞায় জনগণের ভোগান্তির চেয়ে বেশি আলোচ্য হয়ে উঠছে, কেন সরকার এমনটা করল। ব্রিটেনে পাঠানো চিঠি কিংবা ‘সেনাবাহিনী নামানোর সময় এখনও হয়নি’ এসব ব্যাপার সরকারের আত্মবিশ্বাস প্রমাণ করছে না ‘নার্ভাসনেস’, তা সময়ই বলে দেবে। বিএনপিরও যে হরতাল আর অবরোধের বাইরে আর কিছু করার কোন ক্ষমতা নেই, তা আবার প্রমাণ করেছে। জনগণকে সাথে যুক্ত করবার তেমন কোন প্রচেস্টাই তাঁদের নেই। তাকিয়ে আছে জামায়াতের দিকে।

পাল্লা কোন একদিকে হেলে পড়ছে, তা বলবার সময় বোধহয় এখনও আসেনি। এই ‘স্টেলমেট; অবস্থা আর কতদিন চলবে, আর কত লাশ পড়বে, দেশের অর্থনীতির কত ক্ষতি হবে, তা সময়ই বলে দেবে। রোমের সেই গ্ল্যাডিয়েটর ফাইটের মত হয়েছে এদেশের দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থা। কোন একজনের জয় ছাড়া এই যুদ্ধ থামবে না। যতক্ষণ যুদ্ধ শেষ না হয়, ততক্ষণ যেমন রোমের অধিবাসীরা উত্তেজিত হয়ে সেই ফাইট দেখত, এদেশের সাধারণ মানুষের এই মুহূর্তে একটাই কাজ, আমাদের দুই রাজনৈতিক নেত্রীর এই ‘গ্ল্যাডিয়েটরিয়াল ফাইট’ দেখা আর সম্ভব হলে ‘উপভোগ করা’।

Leave a comment