নাটকে ভরা নির্বাচন এবং জনগণের প্রজ্ঞা

election

যায়নুদ্দিন সানী

বেশ নাটকীয় একটা নির্বাচন হচ্ছে। বাঙালির জীবনে বিনোদনের সাম্প্রতিক ঘাটতি মেটাতে এই নাটকীয় নির্বাচন বেশ বিনোদন এনে দিয়েছে। হরতাল অবরোধ নিয়ে যখন বিএনপির বেশ ত্রিশঙ্কু অবস্থা, না পারছে তুলে নিতে, না পারছে চালিয়ে যেতে, ঠিক সেই সময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল নির্বাচন কমিশন। মেয়র ইলেশানের এই ঘোষণা বিএনপির সাথে সাথে দেশবাসীকেও বেশ স্বস্তি এনে দেয়। বিএনপি স্বস্তি পায় কারণ হরতাল অবরোধ প্রত্যাহারের একটা সুযোগ পেলো বলে আর দেশবাসীর স্বস্তি, এই দুই নেত্রীর জেদাজেদির হাত থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে বলে।

আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও যেমন নাটক করতে জানেন, আমাদের জনগণও এই নাটক তেমন উপভোগ করতে জানেন। বিএনপি যদিও প্রথমে ভাব দেখাচ্ছিল, ‘নির্বাচন করবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় আছে।‘ ‘লন্ডন থেকে অনুমুতির অপেক্ষায় আছে’। তবে জনগণের বুঝতে সমস্যা হয়নি, ব্যাপারটা নাটক। বিশেষকরে যখন দেখা গেল হঠাৎ করে বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক বলতে শুরু করেছে ‘কৌশল’ হিসেবে এই নির্বাচনে যাওয়া উচিৎ তখনি সবাই বুঝে গেল সামনে আরও নাটক আসছে। আর শুরু হতে যাচ্ছে এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা—‘নির্বাচন’।

তবে অন্য যেকোন নির্বাচনের চেয়ে, এবারের নির্বাচনে, নাটকীয়তার পরিমাণ অনেক বেশি। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ বেশ নাটকীয়তা দিয়েই নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন নির্বাচন কমিশন। তার আগে অবশ্য কিছুদিন পত্র পত্রিকায় নাটকের কানাঘুষা প্রচার হল। ‘সিটি কর্পোরেশানের নির্বাচন হতে পারে’ জাতীয় খবর প্রকাশ হল ‘বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে’। এরপরে নাটকের প্রথম পর্ব প্রচারিত হল। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। এবং বল চলে গেল বিএনপির ‘কোর্টে’। আবার ৫ই জানুয়ারী টাইপ নির্বাচন না দুইদলের অংশগ্রহণে নির্বাচন।

উত্তর সরাসরি আসবে এমন প্রত্যাশা কেউই করেনি। নাটক হবে, সবাই জানতো। এবং হলোও। ঠিক একটা নাটক না, বলা যায় নাটকের সিরিজ শুরু হল। একটার পর একটা নাটকীয়তা আসছে তো আসছেই। বিএনপি আসবে কি আসবে না, অবরোধের কি হবে, হরতালের কি হবে, আন্দোলনের কি হবে, তত্ত্বাবধায়ক সাহেবেরই বা কি গতি হবে—এমন দারুণ সব সাসপেন্সে প্রথমে আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হল।

আমাদের নেতারা যে সরাসরি উত্তর দেবেন না, তা জনগণ জানে। ফলে সবাই অপেক্ষা করে থাকল, নাটক মঞ্চায়নের জন্য। এবং জনগণকে নিরাশ না করে একে একে বেশ নাটকীয় স্টাইলে উত্তরগুলো আসতে শুরু করল। বিএনপি নির্বাচন করবে। আর এমন সিদ্ধান্ত নিতে সবচেয়ে বেশ প্রভাব ফেলল আগের দফায় সিটি কর্পোরেশান নির্বাচনে জয়ের স্মৃতি। টিপিক্যাল কিছু ছোটখাট নাটকীয়তা সেরে বিএনপি ঝাঁপিয়ে পড়ল নির্বাচনে। এবং শুরু হল নাটকের দ্বিতীয় পর্ব।

মিন্টু সাহেব ছোটখাট একটা নাটক দেখালেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রার্থী হওয়ার জন্য সাধারণতঃ নাটক হয়, তবে এবার উল্টো ঘটনা ঘটল। মিন্টু সাহেব প্রার্থী হবেন না। আবার সেকথা ম্যাডামকে মানাতেও পারছেন না। ফলে নাটক করতে হল। এবার ম্যাডাম মানলেন। মাঝে কিছুদিন মাহী সাহেব দৌড়ঝাঁপ করলেন। তবে শিকে ছিঁড়ল না। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করবেন কি না, তা নিয়ে কিছু নাটক হল এবং অবশেষে জানালেন, ‘করবেন না’।

কাহিনী ভালোই এগোচ্ছিল। তবে নাটকে আওয়ামীরা পুরোপুরি খুশি কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। ‘বিএনপি নির্বাচনে আসুক’ কথাটা মুখে বললেও সত্যি সত্যি তাঁরা কি চায়, তা নিয়ে কিছু সাস্পেন্স ছিল। কটাক্ষ, শ্লেষ যেমন চলছিল তেমনি চলছি ধরপাকড়। বিএনপির বহু প্রার্থীই পলাতক কিংবা আটক। এদেশে মামলা দেয়া যেহেতু কোন ব্যাপার না, তাই ব্যাপারটা পরিকল্পিত না ‘আইনের নিজস্ব গতিতে চলা’ তা নিয়ে কিছু সংশয় অনেকের মনে দেখা যাচ্ছে। অন্ততঃ বিএনপি চাইছে যেন ‘সংশয়’টা দেখা যায়।

এরমাঝে গাড়িবহরে হামলা হল। দুই পক্ষই দাবী করল নাটক। ভিডিও ফুটেজে সেই নাটক সবাই দেখল। নিজ নিজ রাজনৈতিক মত অনুযায়ী দুই দলই একে অন্যকে নাট্যকার আখ্যা দিলেন। আওয়ামী নেত্রী ছবি দেখালেন। এদেশে নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম বলে যেহেতু কিছু নেই, তাই জনগণও আর কারো ভাষ্য বিশ্বাস করে না। সবাই নিজের নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, ‘নাটকটা কার লেখা’। হামলা অবশ্য একটায় থামল না। মাহী আর রতন সাহেবের ওপরও হল। এবং যথারীতি সেই নাট্যকার বিতর্ক হল। কাউই মানতে রাজী না এতো সুন্দর নাটকের তিনিই নাট্যকার। ফলে জনগণের প্রজ্ঞাই ভরসা।

ওদিকে মীর্জা সাহেব সামনে আসবেন কি না, জামিন হবে কি না, কেস চলবে কি না, বিএনপি শেষ পর্যন্ত কি করবে, এমন ছোটখাট সাসপেন্স থাকলেও বিএনপি যে নির্বাচন করবে তা নিয়ে খুব একটা সন্দেহ কারো মনেই ছিল না। তবে নির্বাচনের পরে কি হবে তা নিয়ে এখনও সাসপেন্স আছে। পরাজয় হলে সেই ‘টিপিক্যাল’ কারচুপি ফর্মুলা যে হাজির হবে, তা অনেকটাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে বোঝা যাচ্ছে না, বিএনপি জিতলে কি হবে কিংবা ঢাকার দুই অংশে দুইজন জিতলে কি হবে।

যাক, গতকিছুদিন সময়টা বেশ ভালোই কাটল। বিজয়ী প্রার্থী নগরের জন্য আদৌ কিছু করবেন কি না, তা নিয়ে কেউ সত্যিকার অর্থে কেউ ভাবিত না। নির্বাচনে জয়ের পরে যে প্রার্থীর টিকির দেখা পাওয়া যাবে না, একথা কমবেশি সবাই জানেন। এসব রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কোন রকম প্রত্যাশা বহু কাল আগেই তিরোহিত হয়েছে। এখন জনগণের কাজ একটাই, হিসাব করা—‘কে জিততে পারে’। তবে এই নির্বাচন আরও একটি চিন্তার খোরাক যুগিয়েছে, ‘নির্বাচনের পরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কি হবে?’

‘বিশ্বকাপ এবং বিরোধীদলের আন্দোলন’— শিরোনামে থাকবার লড়াই

world cup1

by zainuddin sani

বিএনপির জন্য সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। না, সরকারী কঠোর মনোভাব কিংবা জ্বালানো পোড়ানো নিয়ে তৈরি নেতিবাচক প্রচারণাকে সমস্যা বলছি না। সমস্যা তৈরি করবে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এতোদিন পর্যন্ত যেভাবেই হোক, বিরোধী দলের আন্দোলন ব্যাপারটা সংবাদের শিরোনামে ছিল। নেত্রীর গৃহবন্দী অবস্থা কিংবা পুত্রের মৃত্যু, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না করা— কোন না কোনভাবে টিভি চ্যানেল আর পত্রিকার লীড নিউজে তাদেরকে রেখেছিল। টেলিফোন আলাপ থেকে শুরু করে সরকারী বক্তব্য কিংবা পাতি নেতাদের হুঙ্কার, সব কিছুই সাহায্য করছিল তাঁদের প্রচারণায়। শিরোনামে রাখছিল বর্তমান পরিস্থিতিকে। বোঝা যাচ্ছিল, দেশে এখন স্বাভাবিক অবস্থা চলছে না। হরতালে রাস্তায় প্রচুর বাস কিংবা প্রাইভেট গাড়ী দেখা গেলেও, শিরোনামে থাকতো ৭২ ঘণ্টা হরতাল।

খুব দ্রুত পরিস্থিতি না পাল্টালে, সেখানে অচিরেই ছেদ পড়বে। এবং বেশ ভালভাবেই পড়বে। শিরনাম হতে তখন টক্কর দিতে হবে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সঙ্গে। ক্রিকেট পাগল এই জাতির জন্য তখন, বিরোধী দলের একঘেয়ে আন্দোলনের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় বিষয় হবে, ক্রিকেট। সঙ্গে যদি যোগ হয় বাংলাদেশের জয়, তবে তো কথাই নেই। বাঙালির উন্মাদনা তখন হবে দেখার মত। আফগানিস্তানের সঙ্গে হারলেও, শিরোনাম চলে যাবে ক্রিকেটের দখলে। তখন বাঙালির গালিগালাজও হবে আকাশচুম্বী। ভারত পাকিস্তান খেলা নিয়েও যে বাজার গরম হয়ে উঠবে, তা নিয়েও সন্দেহ নেই। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এই উন্মাদনা চলবে পুরো দেড় মাস, মার্চের শেষ নাগাদ।

যেভাবে একটা দুটা ঝলসানোর খবরে আমরা অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি, মনে হয় না, খুব মর্মান্তিক কিছু না ঘটলে, তা তখন শিরোনামে আসবে। শুনতে খারাপ লাগলেও, এটিই অমানবিক সত্য— এই জ্বালাও পোড়াও আর বার্ন ইউনিটের দগ্ধ মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে আমরা ধীরে ধীরে অভ্যস্থ হতে শুরু করেছি। এখন অনেক সহজেই আমরা পাতা উল্টিয়ে পরের খবরে চলে যাই। আর তেমনটা হতে শুরু করলে, সম্পাদক সাহেবরাও আর সেগুলোকে শিরোনামে রাখবেন না। নেতিবাচক হোক আর ইতিবাচক হোক, বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রচারণায় তখন ছেদ পড়বে।

শিরোনাম করতে আমরা কতোটা মরিয়া তাঁর জলজ্যান্ত প্রমাণ এসব ঝলসানো নিয়ে শুটিং, কিংবা খাওয়া থেকে উঠিয়ে ছবির জন্য পোজ দেয়ানো। অসভ্য আচরণ মনে হলেও, খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা এটি। যতই তিরস্কার করি, বিশ্বজিতের কোপানোর দৃশ্য যে সাংবাদিক বা ভিডিওম্যান খুব ভালভাবে ধারণ করতে পেরেছে, সে কিন্তু সেদিন তাঁর সম্পাদকের বাহাবা পেয়েছে। চ্যানেলগুলোর ভেতর সেদিন ছিল, সেই দৃশ্য দেখানোর প্রতিযোগিতা। আগুনে পোড়ানো নিয়েও আমার মনে হয় না ব্যতিক্রম হচ্ছে। পোড়ানো নিয়ে একদিকে যেমন বিরোধীদলকে সমানে ধিক্কার জানিয়ে একরাশ খবর ছাপা হচ্ছে, ঠিকই আবার সেই খবরগুলোকে শিরোনাম করা হচ্ছে। সেসব আক্রান্তদের নিয়ে হৃদয় বিদারক রিপোর্টিং যেমন হচ্ছে, আক্রমণকারীদের চোদ্দ গুষ্টি যেমন উদ্ধার হচ্ছে, তেমনি এটাও সত্য, সেই রিপোর্ট ছাপানোর সময় নৃশংস একটি ছবির খোঁজও হচ্ছে। আর যেসব ফটোগ্রাফার সেসবের ছবি যারা জোগাড় করছেন, ‘গ্রেট জব’ বলে একটা পিঠ চাপরানি কিন্তু তারাই পাচ্ছেন।

যা বলছিলাম, এই মুহূর্তে আন্দোলনের সাফল্যের মূলমন্ত্র হচ্ছে, শিরোনামে থাকা। যেভাবেই হোক, যত নৃশংস কাজ করেই হোক, শিরোনামে থাকা চাই। প্রথম খবরটাই যেন হয়, বিরোধী দলের আন্দোলন সংক্রান্ত। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় লিড হওয়া মানেই, পিছিয়ে পড়া। আর একবার পেছনের পাতায় চলে গেলে, আন্দোলন শেষ। ফলে এখন ২৪ ঘণ্টার হরতাল আর ডাকা হচ্ছে না। কারণ এতো ছোট হরতাল আর এখন শিরোনাম না। ৭২ ঘণ্টার হরতালকেও শিরোনাম পেতে ঘাম ঝরাতে হচ্ছে। বরং শিরোনাম হয়, কিংবা মনে প্রশ্ন জাগে, সপ্তাহের বাকী দিন বাদ দিল কেন? হরতালের ডাক শিরোনামে ফিরে আসে, যখন হরতাল প্রলম্বিত করে ৬ দিন করা হয়।

শান্তিপূর্ণ হরতাল, নিঃসন্দেহে বিরোধী দলকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিবে। প্রচুর গাড়ী চলছে এমন কোন হরতালের ছবি পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হওয়া বিরোধী দলের জন্য একটি অশনি সংকেত। কোন হরতালে ভাঙচুর না হলে, ‘এটা কোন হরতালই হয়নি’— ক্যাডাররা রাস্তায় নেই, জনসমর্থন নেই, বিরোধী দল আন্দোলন তৈরিতে ব্যর্থ। অবরোধ, হরতালে দেশের কি অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে কেউই কিছু বলছেন না। অবরোধের কারণে চাষীরা কি মর্মান্তিক অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে, কিভাবে সস্তায় তাদেরকে পণ্য বিক্রি করে দিতে হচ্ছে, তা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। কিংবা বললেও, শিরোনাম করছেন না। কারণ, সেখানে নৃশংসতা নেই বা পাবলিক খাবে না।

বিএনপির গেমপ্ল্যান ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আপাততঃ লাগাতার হরতাল আর সপ্তাহ জুড়ে হরতাল দিয়েই কাজ চালাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষা পেছানো, এবং সেই ব্যাপারটা শিরোনাম হওয়া, আপাততঃ এটাই তাঁদের টার্গেট। পরীক্ষা হতে না পারলে, সরকারকে সবাই যত অথর্ব মনে করবে, পরীক্ষা হতে পারলে বিরোধী দলকে ততোটাই অকর্মণ্য ভাববে। সরকারী দল চাইছে, জনগণ ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বিরোধী দলের ওপর ক্ষেপে উঠুক আর বিরোধী দল চাইছে, সরকারী দলকে কিংবা রাষ্ট্রকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে। আর এই জেদাজেদিতে কে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তা নিয়ে কারোরই মাথা ব্যাথা নেই। এদেশের সরকার এবং বিরোধী দুই দলেরই যেহেতু দূরদৃষ্টি বলে কিছু নেই, তাই ধরে নেয়া যায়, এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে কেউই এগিয়ে আসবে না।

সরকার যেভাবে শুক্রবারে পরীক্ষা নিয়ে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে, মনে হচ্ছে শিরোনামে থাকবার জন্য অচিরেই হয়তো শুক্রবারেও হরতাল আসবে। জ্বালাও পোড়াও যদিও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তারপরও শিরোনামে টিকে থাকবার লোভে, সেই কাজেও বিরাম আসবে না। হয়তো নিজের নেতা কর্মীকে দিয়ে না করিয়ে, ভাড়াটে সেনার আমদানী হবে। দরদ দেখানো বুদ্ধিজীবীদের নড়াচড়া শুরু হয়ে গেছে। তাঁদের বক্তব্য নিজেদের পক্ষে না গেলে, মনে হয় না তাঁদের সঙ্গে কোন দল সহযোগিতা করবে।

এই মুহূর্তে যে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ গেম চলছে, সেখানে বিরোধী দলের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে আসবে, ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আর সে কারণে শিরোনামে থাকবার সুযোগ হাতছাড়া হলে, হয়তো তখন আলোচনায় যোগ দিতে রাজী হবে বিরোধী দল। সরকারী দলও সুযোগটা নেবে বলেই ধারণা। আলোচনা আলোচনা খেলা খেলে যদি কিছু সময় পার করা যায়, তবে আন্দোলনে ভাটা পড়বে। আর একবার আন্দোলনে ভাটা পড়লে, বিরোধী দলের পক্ষে আর উঠে দাঁড়ান সম্ভব হবে না। সামনে কিছুদিনের ভেতরই বিরোধী দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আন্দোলন কিভাবে আর কতদিন চালাবে। সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নের সমাধান করতে হবে তা হচ্ছে, বিশ্বকাপের সময় কিভাবে বিরোধীদল শিরোনামে থাকবে।

কবে প্রভুরা ঠিক করবেন, ‘কে হবে আমাদের প্রভু।‘

download (2)

by zainuddin sani

প্রায় মাস খানেক হতে চলল, দুই পক্ষের জেদাজেদির কারণে দেশ স্থবির হয়ে আছে। একে অপরকে হারাতে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু সাধন নিয়ে আসছে। এই সিরিজে অংশ হিসেবে, বাজারে নতুন এসেছে এক পক্ষের নেত্রীর ফোনালাপের অডিও। সেখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে বেশ কর্কশ ভাষায় নির্দেশ দেয়া আর রাস্তায় থাকবার তাগিদ দেয়া। বিতর্ক দেখা দিয়েছে, ‘রাস্তায় থাকা’ মানে কি—তা নিয়ে। কারো মতে এটাই নাশকতার নির্দেশ, কারো মতে এটি আন্দোলন করার নির্দেশ। আর হুকুম দেয়াটার সাথে মেলানোর চেষ্টা হচ্ছে ‘জেনারেলের স্ত্রী’ ব্যাপারটাকে। ফোনালাপগুলো কিভাবে ইউটিউবে আসল, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। ধরেই নেয়া হচ্ছে, কোন না কোন ভাবে সরকার এর সঙ্গে জড়িত।

কোকোর মৃত্যুর পরে, কোকোর স্ত্রী এবং দুই কন্যা বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিছুদিনে আগে, এক পক্ষের নেত্রীকে একা রেখে তাঁরা ফিরে গেছেন। কোকো কন্যা এবং তাঁর স্ত্রীর মালয়েশিয়া ফেরত যাওয়া নিয়েও বেশ কটাক্ষ চলছে। কটাক্ষের কারণ, তাঁদের পরীক্ষার কারণে তাঁরা গিয়েছে। আর এদেশের এসএসসি পরীক্ষা অনিশ্চয়তার মুখে রয়েছে। আর তা হয়েছে একপক্ষের নেত্রী বা তাঁদের দাদীর ডাকা হরতাল আর অবরোধের কারণে। ব্লগ, ফেসবুক আর মিডিয়ায় চলছে ব্যাপারটাকে কতোটা মশলা মাখিয়ে উপস্থাপন করা যায়। ‘নিজের নাতনীদের পরীক্ষা দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন আর দেশের লাখ লাখ পরীক্ষার্থী যে পরীক্ষা দিতে পারছে না, সেদিকে খেয়াল নেই।‘

খেলা কে জিতছে, তা এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, খেলা ধীরে ধীরে ক্লাইমেক্সের দিকে এগোচ্ছে। একজন বলছে আর এক সপ্তাহ। অন্যদিকের বক্তব্য হচ্ছে ১৩ই ফেব্রুয়ারী। ফেসবুক, ব্লগ আর পত্রিকার কলামে এখন রীতিমত চামচাগিরির প্রতিযোগিতা চলছে। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের আপাততঃ মনোযোগ ‘পেট্রোল বোমা’ আর অন্যদিকের মনোযোগ নেত্রীর ওপর চালানো নির্যাতন। একদিকের ইউএসপি হচ্ছে ‘পোড়া লাশ’ আর অন্যদিকে ‘নেত্রীর বিদ্যুৎ সংযোগ’। কোনদিকে জনসমর্থন বেশি, তা নিয়েও বুদ্ধিজীবী মহল নিজ দলের গুণ গাইছেন। এককথায় পরিস্থিতি এখন, ‘ক্লোজ টু ফিনিশ’ পর্যায়ে রয়েছে।

একটা ব্যাপারে অবশ্য সবাই একমত, সমাধান এদেশ থেকে আসবে না। আসবে ওপর থেকে। এতদিন এদেশের প্রভুত্বের দ্বায়িত্বে ছিল একটি দেশ। সম্প্রতি সেই দেশটি অপর একটি দেশের সান্নিধ্য লাভের জন্য বেশ উৎসুক। আর এই সান্নিধ্য পেতে যদি তাঁদের হাতে বাংলাদেশকে তুলেও দিতে হয়, দেশটি ‘না’ বলবে না। এমনই যখন অবস্থা, সেই সময় ঘটল মজার এক ঘটনা। ঘটনাটা খুব সাধারণ হলেও, মজার বলছি কারণ, এই নিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের লম্ফঝম্ফ ছিল দেখার মত। মানসিকভাবে আমরা যে কত অনায়াসে এই দেশগুলোর প্রভুত্ব মেনে নিয়েছি, তা এতো স্পষ্টভাবে বুদ্ধিজীবীরা আগে বলেননি।

প্রভু হিসেবে পরিচিত, আমাদের পাশের দেশের পররাষ্ট্র সচিবের বরখাস্তের পরে মনে হয়েছিল, এক পক্ষের জয় এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। মনে হয়েছিল, তাঁর চাকরী যাবার একমাত্র কারণই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর নগ্ন হস্তক্ষেপ কিংবা অপর পক্ষকে জয় পাইয়ে দেয়া। আমেরিকার বিরুদ্ধে গিয়ে এদেশের ৫ই জানুয়ারীকে সমর্থন করার খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে। তাঁরা ধারণা করছেন সম্প্রতি ওবামা এসে সেই প্রভু দেশকে ধমক দেয়ার কারণেই সচিব মহাশয়কে অফিস খালি করতে হয়েছে। এখন ধমক খাওয়ার পালা এদেশের প্রধানমন্ত্রীর। নরেন্দ্র মোদীর বিজয়ের পরে এই সম্ভাবনাই দেখেছিল এক পক্ষ। আর তা এখন সত্যি হতে চলেছে। অতএব, সেই পক্ষের জয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। বুদ্ধিজীবীদেরও সময় হয়ে গেছে, দল পাল্টাবার কিংবা বুঝে শুনে কথা বলবার।

ভারতীয় কিছু টিভি চ্যানেল আর ভারতীয় ব্লগেও এই বরখাস্ত নিয়ে আলাপ চলছে। তবে সেখানে ঘটনার ব্যাখ্যা বেশ অন্যরকম। মাত্র দুদিনের জন্য তিনি এই চাকরি হারিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর কাজ করার যে স্টাইল, সেই অনুসারে তিনি চান সব এলাকায় নিজের বিশ্বস্ত লোক। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য তাঁর নির্বাচিত এই বিশ্বস্ত লোকটি হচ্ছেন সুব্রমনিয়াম জয়শঙ্কর। এই ভদ্রলোককে, মোদীর পূর্বসূরি, মনমোহন সিংও পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোনিয়া গান্ধীর ইচ্ছার কারণে তা হয়নি। তাঁকে নিয়োগ দিতে হয় সুজাতা সিংকে। আর সেখানকার নিয়ম অনুসারে, পররাষ্ট্রসচিবের কার্যকাল হচ্ছে ২ বৎসর। এই বছর, জুলাই মাসে তাঁর সেই মেয়াদ শেষ হত। হয়তো তিনি সেই সময় পর্যন্তই থাকতেন। তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল জয়শঙ্করের বয়স। আর মাত্র দুইদিন পরেই তাঁর সরকারী চাকুরীর বয়সসীমা শেষ হয়ে যাবে। তাই এই মুহূর্তে তাঁকে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগটি না দিলে, তা আর দেয়া সম্ভব হত না। তাই ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মত কোন পররাষ্ট্রসচিবকে বরখাস্তের ঘটনা ঘটল।

কিছু আভ্যন্তরীণ রাজনীতিও কাজ করেছে। ভারতীয় জনতা পার্টিতে চলা দলীয় কোন্দলের এক অংশে রয়েছে নরেন্দ্র মোদী আর অন্য অংশে রয়েছে লাল কৃষ্ণ আদভানী। আদভানী লবি এই মুহূর্তে রয়েছে বেশ কোণঠাসা অবস্থায়। সেই লবী থেকে মন্ত্রীসভায় সুযোগ পাওয়া নেত্রী হচ্ছেন, সুষমা স্বরাজ। আর তাঁর দায়িত্বে রয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মোদী সাহেব, অনানুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন। সাম্প্রতিক হয়ে যাওয়া সকল বিদেশ সফরে, সুষমা স্বরাজের চেয়ে বেশি দেখা গেছে নরেন্দ্র মোদীকে। অনেকেই বলা শুরু করেছেন, সুষমা হচ্ছেন, ডামী। এবার মোদী আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বসাতে চাইছেন, নিজের বিশ্বস্ত লোক। যেন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সব সিদ্ধান্তের খবরই তিনি পান। কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্র্যাক্টিক্যালি তাঁর নির্দেশেই চলে।

ভারতীয় রাজনীতিতে ভবিষ্যতে কি হবে, তা এই মুহূর্তে বোঝার উপায় নেই। তবে আপাততঃ বিজেপি এবং ভারত সরকার পুরোটাই মোদীর ইচ্ছেমত চলছে। দলীয় নীতি কিংবা সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই। তাঁর কথাই, শেষ কথা। আর তাঁর ইচ্ছায়ই সুজাতা সিংয়ের চাকরি ‘নট’ হয়েছে। বাংলাদেশ কিংবা ওবামা খুব বড় কোন ইস্যু এখানে ছিল না। তবে এটাও ঠিক, বাংলাদেশ প্রশ্নে কোন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না—এমন কথাও কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। সব চোখ এখন তাই নতুন পররাষ্ট্রসচিবের দিকে। তিনি কি বক্তব্য দেন বাংলাদেশকে নিয়ে।

ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, আমাদের ভবিষ্যৎকে আমরা অনেক আগেই অন্য প্রভুর হাতে সঁপে দিয়েছি। এখন আর তা হয়তো আমাদের হাতে নেই। আমরা নামে গণতন্ত্র হলেও, এখানে কে ক্ষমতায় বসবেন, কে যাবেন, সেই সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে নেই। আমাদের কাজ শুধু আগুনে পোড়া, সরকারের ‘এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে’ শোনা, বুদ্ধিজীবীদের দলীয় ব্যাখ্যা শোনা আর দিন গোনা, কবে প্রভুরা ঠিক করবেন, ‘কে হবে আমাদের প্রভু।‘

‘আচ্ছা বলো, কোন অ্যানিম্যাল সবাইকে উঠাতে পারে?’

download (2)

by zainuddin sani

প্রসঙ্গটা নিয়ে লিখবো না ভেবেছিলাম। এমনই একটি ব্যাপার, দুঃখ প্রকাশ ছাড়া আর তেমন কিছু বলার নাই। তবে এদেশের রাজনীতিবিদদের যা মেধা এবং যে মনোবৃত্তি, তাতে ব্যাপারটা নিয়ে যে রাজনীতি হবে, তা ভেবেছিলাম। কতোটা হবে আর কতদিন ধরে হবে, সেটা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চিত ছিলাম। এই ব্যাপারটা নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ি করতে কবে নাগাদ আমাদের রুচিতে বাঁধবে, তা নিয়েই ছিল আমার সবচেয়ে বেশি শঙ্কা। আমার শঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে এখনও দুই দল এবং তাদের চামচা বাহিনী যথারীতি কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি করে যাচ্ছেন।

আমাদের যে মন মানসিকতা এবং দলকানা স্বভাব, তাতে ব্যাপারটা এতো সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্ততঃ যতদিন পত্রিকা খবরগুলোকে ঝাল মশলা সহযোগে পরিবেষণ করছে, ততদিন তো অবশ্যই না। মনে হচ্ছে, খবরটি এখন জনপ্রিয়তার দিক থেকে ‘যে পাঁচটি কথা স্ত্রীকে কখনই বলবেন না’ জাতীয় খবরের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। শুধু প্রত্যাশা করেছিলাম, দুই দলে অন্ততঃ কিছু বুদ্ধিমান লোক আছেন, হয়তো তাঁরা ব্যাপারটা আরও নোংরা হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবেন। দেখতেই পাচ্ছেন, আমার আশার গুড়ে এই মুহূর্তে বালি কিচকিচ করছে। প্রায় প্রতিদিনই দুই দলের দলকানা সমর্থক আর নেতা কর্মীদের অতি উৎসাহী বক্তব্যে এই মুহূর্তে ব্লগ, ফেসবুক আর পত্রিকা ভাসছে।

ভাবছি, এই ঝগড়ার ভেতর প্রবেশ না করে, বরং আজকে বাড়িতে কি রান্না হয়েছে কিংবা পুত্রকে হোম ওয়ার্ক করাতে গিয়ে কি কি সমস্যায় পরেছি তা নিয়ে একটা কলাম লিখি। কিংবা আজকে বুয়ার সঙ্গে সহধর্মিণীর যে বচসা হয়েছে তার বিবরণ। কিছুদিন আগেও গিন্নির ধারাবাহিক নালিশ পর্ব চলছিল। বিষয় ছিল সন্তানদের স্কুল শেষে, বছর শেষে পাওয়া ছুটিতে এবার কারা কারা কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছে তাঁদের লিস্টি। সঙ্গে আরও যোগ হচ্ছিল সেই আনন্দ ভ্রমণের সময় তাঁরা কি কি আনন্দ করেছে তার বিবরণ। সেই অনুযোগ এখন থেমেছে। এখন পরিস্থিতি বেশ উল্টো। এখন আমার বুদ্ধিমত্তার জয় জয়াকার চলছে। কারণ ইদানীং তিনি যেসব গল্প শুনছেন সেখানে আনন্দ ভ্রমণের চেয়ে ভোগান্তির গল্পই বেশি। বেশ কয়েকজন অবরোধের কারণে সেখানে আটকেছে। এখন অবশ্য তার কণ্ঠে আনন্দের বন্যা, ‘ঠিক হয়েছে।‘ সঙ্গে যোগ হচ্ছে, ‘আমাদেরও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দেশের অবস্থা দেখে যাইনি। এখন দেখছি ভালোই করেছি।‘ টপিক হিসেবে এটাও মন্দ না।

পত্র পত্রিকা দেখে মনে হচ্ছে, এদেশে সত্যিকার অর্থেই ‘স্টোরি’র আকাল চলছে। একটা কোন কাহিনী পেলে তা নিয়ে টানা হেঁচড়া করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সেই কবে থেকে যে শুরু হয়েছে ‘যে পাঁচটি কথা কখনও প্রেমিকাকে বলবেন না’ জাতীয় লেখা— বোধহয় পত্রিকাগুলো নিজেও বলতে পারবে না। থামাথামির নাম তো নেইই, বরং প্রতিদিন এই জাতীয় লেখা এখন অত্যাবশ্যকীয় হয় দাঁড়িয়েছে। অবিরাম এই ধরনের খবরের ‘সাপ্লাই’ দেখে মনে হচ্ছে এসব খবর পাবলিক বেশ ভালোই খাচ্ছে। তাই এসব তথ্যের সম্প্রচার বেশ বিরামহীন ভাবেই চলছে।

প্রায় প্রতিটি অনলাইন পত্রিকা খুললে, এজাতীয় কিছু লেখা পাওয়া পাওয়া যাবেই। লেখাগুলো যে নিজেদের রিসার্চ প্রোডাক্ট, তা কিন্তু না। অনলাইনে প্রচুর ওয়েব সাইট আছে, যেখানে এধরনের প্রচুর তথ্য গিজগিজ করছে। সেসব থেকে বেছে বেছে কিছু তথ্য অনুবাদ করে এনে হাজির করা হচ্ছে। নর নারীর প্রেম কিংবা সম্পর্ক সম্বন্ধীয় কথাবার্তা গুলোই বেশি অনুদিত হচ্ছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত কিছুটা যৌন নির্দেশক তথ্য আসছিল। ইদানীং সেখানে যৌনতার মিশাল বাড়ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, আমরা আসলে এগুলোই চাই। গুগলে পর্ণ সার্চে আমরা এখনও পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে আছি। বোধহয়, খুব বেশি দেরী হবে না, ওদেরকে পিছে ফেলতে।

আসলে খবর হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করে থাকি দুটো ব্যাপার। হয় ঝগড়াঝাটি, মারামারি, কাটাকাটি এসব আর নয়তো যৌনতা। কোকোর মৃত্যু পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে যেভাবে দুই দলের সাঙ্গপাঙ্গরা মেতে উঠল, তা দেখে মনে হচ্ছে, সবাই বেশ খুশি। ঝগড়ার বিষয় পাওয়া গেছে। এই দল ঐ দলকে গালি দিচ্ছে। ঐ দল অন্য দলকে অভদ্র বলছে। বুদ্ধিজীবীরা সারাংশ আবিস্কার করছে। ‘কার দোষ বেশি’। কোথায় যেন একধরনের আনন্দ বিরাজ করছে সবার মনে। ‘লাগুক ঝগড়া, মজা দেখা যাবে’। অচিরেই হয়তো আরেকটা লেখা বাজারে আসবে, ‘যে পাঁচটি কারণে একজন মানুষ ঝগড়া দেখে আনন্দ পায়।‘

আরও একটি খবর আসা উচিৎ। ‘যে পাঁচটি কারণে বাসায় পুরনো খাবার খেতে হয়।‘ তার একটি বলে দিতে পারি। মাইক্রোওয়েভ। আজকে আমার তেমনই একটি দিন গেল। খাবার টেবিলে একমাত্র উৎসাহিত ব্যক্তি আমার পুত্র। সে আজকে নতুন একটি ধাঁধা শিখেছে। ‘আচ্ছা আব্বু, বল দেখি, একজন অ্যাস্ট্রোনট রকেটে করে সূর্যে গেল কিন্তু পুড়ল না, কিভাবে হতে পারে।‘ যদিও ধাঁধাটার উত্তর আমি জানি না, তারপরও এধরনের পরিস্থিতিতে আমার আপাততঃ কাজ একটাই, ইচ্ছে করে হেরে যাওয়া। কিছুক্ষণ চিন্তার ভান করে বললাম, জানি না। আমার পরাজয় দেখে পুত্র যারপরনাই আনন্দিত। ‘প্রিন্সিপ্যাল স্যারকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, পারেনি।‘ আমার বোকামি কিছুটা জাতে উঠল। এবার আমার কাজ, উত্তরটা শুনে অবাক হওয়া কিংবা পুত্রর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশংসাসূচক কিছু বলা।

‘কারণ অ্যাস্ট্রোনট রাতের বেলা গিয়েছিল।‘ উত্তর আসবার পরে একবার ভাবলাম আহ্নিক গতি ব্যাপারটা বোঝাই। রাত হওয়া মানে এই না যে সূর্যের তাপ কমে গেছে। তারপরে ভাবলাম, দরকার কি। শুধু শুধু ওর আনন্দ মাটি করে। পরাজয় মেনে নিলাম। বিজয়ী পুত্র সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় প্রশ্ন শোনাল। ‘আচ্ছা বল, কোন অ্যানিম্যাল সবাইকে উঠাতে পারে?’ এবারও আমার কাজ, ইচ্ছে করে পরাজিত হওয়া। উত্তরটা এবারও আমার অজানা। কিছুক্ষণ চেস্টার ভান করলাম। ধাঁধাটায় মূল সমস্যা সম্ভবতঃ ‘ডাবল মিনিং’ কোন একটি শব্দ কিংবা বাক্যের অন্য কোন অর্থ দাঁড়ায়। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে চালাকী। কিছুক্ষণ সত্যিই চেষ্টা করলাম। ‘উঠাতে পারা’ মানে কি? শক্তিশালীতম প্রাণী? তিমি বা তেমন কিছু?

কিছুক্ষণ চিন্তা করে পরাজয় মেনে নিলাম। আবার সেই বিজয়ীর হাসি। ‘উত্তর হচ্ছে মোরগ। মোরগই তো সবাইকে ঘুম থেকে উঠায়।‘ কাহিনী বোধহয় এখানেই থামবে না। এই প্রশ্নগুলো হয়তো সে আবার কাউকে করবে। তাঁর বিবেচনায় যে মানুষগুলো বুদ্ধিমান, তাঁদের সবাইকেই সম্ভবতঃ সে একে একে প্রশ্নটা করবে আর লিস্টি শোনাবে, পৃথিবীর কোন কোন বুদ্ধিমান প্রাণী তার এই সহজ প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারেনি।

আমাদের সবার ভেতরই সম্ভবতঃ এই শিশুটি বেঁচে আছে। আরেকজনকে হারাবার মধ্য দিয়েই নিজের জয় খোঁজা শিশু। কখনও এরা সত্যিই জেতে কখনও সামনের মানুষের ইচ্ছাকৃত পরাজয়ে যেতে। কিন্তু শিশুটির হাসিটিতে যে দুজনেরই জয় হয়, এই তথ্য হয়তো শিশুটি বোঝে না। এই শিশুটি যখন বাবা হবে, হয়তো সেও এমনটিই করবে। ইচ্ছে করে হারবে। আরেকটি শিশুর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। আর বাবা হিসেবে হয়তো একটি কথা বলতে গিয়েও থেমে যাবে। হয়তো বলবে না, মোরগ সবাইকেই ঘুম থেকে ওঠাতে পারে না। জেগে জেগে ঘুমানো দলকানা নেতা আর সমর্থকদের ঘুম থেকে ওঠানোর সাধ্য কারো নাই। আর পরাজয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জয় দেখবার চোখ ও এসব দলবাজদের নেই। আর তাই আমাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কেউই হাসিমুখে পরাজয় মেনে নেবে না।

শুধু জানান, আমাদের এই জিম্মি অবস্থার অবসান কবে

download (2)

by zainuddin sani

দেশের অবস্থাকে ঠিক কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায়? দাবা খেলার ‘স্টেলমেট’ না টেস্ট ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার ‘ড্র’। খেলার সঙ্গে তুলনা করার একটি সমস্যা আছে। কিছু খেলায় সময় নির্ধারিত আছে, এখানে নেই। কেউই জানে না কবে নাগাদ একটা ফয়সালা হবে। সেদিক দিয়ে ভাবলে দাবার সঙ্গে তুলনা করা যায়। কারণ এখানে খেলায় সময় নির্ধারিত নেই, তবে সেখানে খেলার অবস্থা বুঝে ‘ড্র’ মেনে নেয়ার মত সুযোগ আছে। তবে দেশের বর্তমান অবস্থায় ‘ড্র’য়ের কোন সুযোগ নেই। প্রাচীন রোমের ‘গ্ল্যাডিয়েটর’দের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মত অবস্থা বলা যায়। বিশাল এক দর্শক শ্রেণীও যেমন আছে, একজনের পরাজয়ের ভেতর দিয়ে খেলা শেষ হওয়ার নিয়মও তেমনি আছে। সময়ের কোন সীমানা নেই। তবে সেখানে তৃতীয় একজনের জেতার সম্ভাবনা নেই। রাজনীতির এই খেলায় এই ব্যাপারটা আবার আছে।
খুব সাধারণ কিসিমের একজন জনতাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু হচ্ছে না কেন? উনি উত্তর দিলেন, টেস্ট ক্রিকেট চলছে, এখানে তো টি টুয়েন্টির মত দ্রুত রেজাল্ট এক্সপেক্ট করতে পার না। তুলনাটা খারাপ লাগলো না। তারপরও, পুরোপুরি মেনে নিতে পারছি না। যদিও টেস্ট ক্রিকেট, ক্রিকেটের ‘লঙ্গার ভার্সান’ তারপরও এর একটি লিমিট আছে। খেলাটা তো আর অনির্দিষ্ট কালের জন্য খেলা হয় না। বর্তমান অবস্থার মেয়াদ তো বোঝাই যাচ্ছে না। কখনও মনে হচ্ছে, আজকেই শেষ হয়য়ে যাবে, আবার মনে মনে হচ্ছে, থামবেই না।
খেলাটায় যদিও লাশ পড়ছে, মানুষ পুড়ছে, তারপরও বলা যায়, দুই দলের সমর্থকরা গোঁয়ারের মত বসে আছে, ‘চলুক খেলা, দেখি কে জেতে’। দোষ কার তা নিয়ে দুই দলের সমর্থকরা কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি করছে আর এই বিশ্বাস নিয়ে এখনও ফেসবুক আর ব্লগে আশাবাদ জানিয়ে যাচ্ছে ‘জয় আমাদের হবেই’। শুধু কি তাঁরা, দেশবাসীও কিছুদিন আগে পর্যন্ত চাইছিল, চলুক খেলা। হয়য়ে যাক একটা হেস্তনেস্ত। যদিও এই মুহূর্তে বোঝার কোন উপায়ও নেই কে জিতছে, যদিও বোঝার উপায় নেই কোন এক পক্ষের জয় নিয়ে দেশবাসীর খুব বেশি মাথাব্যাথা আছে কি না, তবে একটি ব্যাপার নিশ্চিত, আর তা হচ্ছে দেশবাসীর খেলা দেখার শখ মিটে গেছে। প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়য়ে ওঠা দেশবাসীর এখন একটাই প্রত্যাশা, যে ই জিতুক, একজন কেউ জিতুক।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ঘটনা আটকে আছে তো আছেই। কোন পরিণাম নেই, ফলাফল নেই। কেউই জিতছেও না, হারছেও না। অবস্থা এমন হয়েছে যে, তা দেখে ভবিষ্যৎবাণী করবার উপায়ও নেই, কে জিতবে বা কে হারবে?
কে জিতবে তা নিয়েও চলছে সাসপেন্স। জয় ব্যাপারটা পেন্ডুলামের দোলকের মত দুলছে আর বেশ ভালভাবেই দুলছে। একসময় আওয়ামীদের দিকে তো অন্যদিন বিএনপির দিকে। একবার মনে হচ্ছে, আওয়ামীদের পেছানো ছাড়া উপায় নেই, পর মুহূর্তেই মনে হচ্ছে বিএনপির আর কোন আশা নেই। আবার কেমন করে যেন দুই দলই প্রতিযোগিতায় ফিরে আসছে। এখন পর্যন্ত, ‘কেহ নাহি কম যায় সমানে সমান’ চলছে। মনোবল দুই দলের নেতাকর্মীরই চাঙ্গা। জনতা, যারা দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষায় ছিল খেলাটির একটি ‘নেইল বাইটিং’ ফিনিশ দেখবার জন্য, তাঁদের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তাঁদের এখন একটি ব্যাপার নিয়েই মাথা ব্যাথা, আর তা হচ্ছে, কতদিন ধরে চলবে এই খেলা। কিংবা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে একটি ‘ডিসাইসিভ’ ফলাফল।
সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন, খেলা কি এই গতিতেই চলবে? উত্তরটা হয়তো সামনের কিছু দিনের ভেতরেই বোঝা যাবে। সরকার হার্ডলাইনে যাবে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। কিছু ক্রস ফায়ার হয়েছে, প্রায় সাত হাজার গ্রেফতার। হার্ড লাইনের ভেতর আর কি পড়ে বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবতঃ বিএনপির যেকয়জন নেতা বাইরে আছে, তাঁদের একটা গতি করা। আর সেই মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন, ম্যাডামকে গ্রেফতার করা হবে কি না। কার্যালয়ে অন্তরীন রাখার সিদ্ধান্তের যেভাবে হঠাৎ করে ইতি ঘটল, তাতে মনে হচ্ছে না সরকার সেদিকে পা বাড়াবে।
অন্যদিকেও বেশ বড়সড় একটা প্রশ্ন বোধক চিহ্ন ঝুলছে। বিএনপি এভাবে কতদিন চালাবে? যত দিন যাচ্ছে, জ্বালাও পোড়াও ব্যাপারটা ব্যাকফায়ার করছে। যদিও তাঁরা বলছে, পেট্রোল বোমা আর ককটেল তাঁরা ছুঁড়ছে না, তবে পুরোটা বিশ্বাস মনে হয় না করাতে পারছে। আওয়ামী স্যাবোটাজ হয়তো কিছু হচ্ছে, তবে বিএনপি একটাও কক্টেল ছুঁড়েনি, তা বোধহয় পাবলিককে গেলানো যাবে না। ফলে তাঁদেরও এই চিন্তা তাড়িয়ে নিচ্ছে, আর কি করা যায়।
দুই বড় দলের মানসিকতা এমন হয়েছে যে একদল জিতলে, অন্যদল সংসদে যাবে না, একদল যা চাইবে, অন্যদল ঠিক তাঁর উল্টোটা চাইবে, একজন ক্ষমতায় থাকা কালীন নির্বাচন দিলে অন্যদল নির্বাচনে যাবে না। জনগণ এ ও জানে, দুই দলের নেত্রীর এই দা কুমড়া সম্পর্ক নিয়েই দেশবাসীকে চলতে হবে। ক্ষমতায় থাকা কালীন পাঁচ বছর, বিরোধীদল শীতকাল আসলেই কিছু আন্দোলন করবে আর সারা বছর মোটামুটি খুচরা কিছু হরতাল আর অবরোধ দিবে, আর আমাদের এসব মেনে নিয়েই চলতে হবে।
দুই নেত্রীর প্রতিই আমাদের প্রত্যাশা এখন এতোটাই কমেছে যে এই মুহূর্তে শুধু একটাই প্রত্যাশা, শুধু আমাদের জানান যে এই জিম্মি অবস্থা থেকে আপনারা কবে নাগাদ আমাদের মুক্তি দিবেন।

এঞ্জয় দ্যা গ্ল্যাডিয়েটরিয়াল ফাইট

roman-gladiators-5

by zainuddin sani

‘সো? হু ইজ উইনিং?’ এই মুহূর্তে সবার মনে কেবল এই একটাই প্রশ্ন। নেতা নেত্রীদের কথার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সবাই এই একটা প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন। সমঝোতার কথা কে বেশি বলছে? তার মানে সে হারু পার্টি। পাতি নেতাদের কাজই হচ্ছে জ্বালাময়ী কথা বলা। বিএনপির পাতি নেতারা ‘দাঁত ভাঙ্গা জবারে’র কথা বলে বলে নিজেদেরই দাঁত ক্ষয় করে ফেলেছেন আর আওয়ামী পাতি নেতারা সারাক্ষণ হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন ‘তাঁরা চাইলে বিএনপির কি দুর্গতি করতে পারেন’। এবং যথারীতি কোন পক্ষই কিছু করতে পারছে না। ফলাফল হচ্ছে, সাধারণ মানুষ কেউই আর এইসব পাতিনেতাদের কথা পাত্তা দিচ্ছেন না।

সব চোখ এখন বড় দুই নেত্রীর দিকে। হার্ডলাইনে যাওয়া থেকে সরে আসবার কোন কথা কি নেত্রী বলছেন? কিংবা আন্দোলন আরও বেগবান না করে আলোচনা করার কথা কি নেত্রী বলছেন? বাক্যের শব্দগুলো কত কর্কশ কিংবা কত মোলায়েম তা দেখে সবাই ঠিক করে নিচ্ছেন, বল এখন কার কোর্টে। বাকি যত দর্শক আছেন, সুশীল থেকে কুশিল, দেশি হোক আর বিদেশী, সবার মুখে এখন একই নামতা, ‘আলোচনা কর’। এদের পাত্তা দেয়ার তেমন কিছু নেই। এরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই কথা বলে আসছেন, আর আমাদের নেতারা তাঁর তোয়াক্কা না করেই নিজেদের গোঁয়ার্তুমি যথারীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। মূল যে প্রভু, তিনি যতক্ষণ কোন একটি দলের সঙ্গে আছেন, অন্য কেউ তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না। তাঁরা অবশ্য প্রকাশ্যে কিছু বলেন না, নেতা নেত্রীদের মুখের ভাষা শুনে বুঝে নিতে হবে, বাতাস ঘুরে গেছে কি না।

আওয়ামীরা যে লাইনে ফাইট দিচ্ছে তা হচ্ছে হরতাল অবরোধে হওয়া মৃত্যুগুলোকে হাইলাইট করার চেষ্টা করে যতটা ফায়দা লোটা যায়। ভয়াবহতম মৃত্যুগুলোকে নিয়েই সবেচেয়ে সেন্টিমেন্টাল ফায়দা হাসিল করা যায়। পত্রিকায়, টিভিতে কিংবা টক শোর আলোচনায় যত বেশিবার এই টপিক আসবে, ততো বেশি সুবিধা আওয়ামীদের। নিজেদের পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলে তাই বারবার এই বিষয়গুলো আনবার চেষ্টা হচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির এই মুহূর্তের প্রধান চিন্তা, আন্দোলনে যেন ছেদ না পড়ে। লাশগুলো কিছুটা ব্যাকফায়ার করছে, তবে অবরোধ আর হরতাল তাঁর ইমপ্যাক্টও ফেলছে। সরকারকে যে বিচলিত করে ফেলেছে তা আওয়ামী পাতি নেতাদের লম্ফঝম্ফ দেখে আন্দাজ করে নেয়া যাচ্ছে।

তবে দুই দলেরই মূল সমস্যা হচ্ছে ‘দীর্ঘসুত্রিতা’। আন্দোলন দীর্ঘ হলে আওয়ামী বিএনপি দুদলেরই সমস্যা। আওয়ামীদের সমস্যা হচ্ছে, প্রমাণ হয়ে যাবে তাঁরা অথর্ব, এই আন্দোলন দমানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। অন্যদিকে অবরোধ আরও কিছুদিন চললে বিএনপিও ঝামেলায় পড়বে। দেশের অর্থনীতির ওপর শুরু হওয়া চাপ এবং সেকারণে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া জনগণ কিছুটা হলেও তাদেরকে দায়ী করবে। আর মানুষের দেয়ালে পিঠ থেকে গেলে, তাঁরা ঠিক কি করবে, বোঝা ভার। দেশের হওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতি সম্পর্কে দুই দলই সচেতন, তবে এটাও জানে, ছাড় দিলেই অবধারিত মৃত্যু।

আওয়ামীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এবং বড় দুর্বলতার নাম আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। অবরোধে হওয়া জন দুর্ভোগ কিংবা জ্বালাও পোড়াও থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে আপাতত তাঁরা ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা ঘোচাতে যা তাঁরা করতে পারে, তা হচ্ছে, ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো। তেমন করবার ইচ্ছে জানাতে গিয়ে পুলিশ, বিজিবি আর র‍্যাব প্রধান বেশ ঝামেলায় পড়ে যান। অতি দ্বায়িত্বশীলতা দেখাতে গিয়ে এমন কিছু কথা বলে ফেলেন, যে পরের দিন তাঁদের আবার ব্যাখ্যা দিয়ে জানান দিতে হয় যে তাঁরা রাজনীতি করেন না। সারাংশ হচ্ছে, যদি তাঁরা অ্যাকশানে যান এবং বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের লাশ পড়ে, তখন পরিস্থিতি কি হবে, তাঁরা নিজেরাও তা আঁচ করতে পারছেন না, আর সেকারণেই চাইছেন, ব্যাপারটা যেন সে পর্যন্ত না গড়ায়। হুমকি ধামকিতে কাজ হলে সবকুলই রক্ষা পায়।

এমন ‘স্টেলমেট’ অবস্থায় সরকারী বাহিনী তাই আপাতত গ্রেফতার পর্যন্তই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন। হুঙ্কার, হুমকি চলছেই, তবে সত্যিই তেমন হার্ডলাইনে তাঁরা যাবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ করছেন। অন্যপক্ষও খুব আরামে নেই। বিরোধী দলের প্রায় সব বড় নেতাই চোদ্দ শিকের পেছনে। আত্মগোপনে থাকা কিছু কিংবা সরকারের সঙ্গে মৃদু লিয়াজো করে চলা কিছু নেতা এখনও বাইরে আছেন। ওপর মহল থেকে প্রতি মুহূর্তের নির্দেশনা না আসায়, কর্মীরা বুঝে উঠতে পারছেন না কি করবেন। অতি উৎসাহে জ্বালাও পোড়াও করবেন? লুকিয়ে থাকবেন? না গ্রেফতার হয়ে নিজেদের অকুতোভয় প্রমাণ করবেন? ফলে দেখা যাচ্ছে, সরকারী দলের ওপর মহলের মত বিরোধী দলের তৃণমূলও এখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।

একে অপরের ওপর করা গুপ্তচরবৃত্তিতে, মনে হচ্ছে এখন একটি স্থিতি অবস্থা বিরাজ করছে। বিএনপির কি হতে যাচ্ছে পরবর্তী সিদ্ধান্ত, তা ম্যাডাম আর তারেক সাহেব ছাড়া আর কেউ জানে না। অন্যদিকে আওয়ামীদের সিদ্ধান্ত বা গেম প্ল্যান প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানে না। বিভিন্ন পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেল, ‘জানা যায়’ কিংবা ‘বিশ্বস্ত সূত্রের খবর’ বলে যা প্রচার করছে, এই মুহূর্তেই সেটারই কদর সবচেয়ে বেশি। কাকে বেশি চিন্তিত দেখাচ্ছে, কে বেশি হাসিখুশি, কে সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে কথা বলছেন, এসবই হচ্ছে এখন ‘ব্রেকিং নিউজ’।

বালুর ট্রাক সরানো কিংবা পুলিশ ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলা কিসের ইঙ্গিত, তা নিয়ে সবাই এনালাইসিস শুরু করে দিয়েছেন। ভাইবার, ট্যাঙ্গো, হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞায় জনগণের ভোগান্তির চেয়ে বেশি আলোচ্য হয়ে উঠছে, কেন সরকার এমনটা করল। ব্রিটেনে পাঠানো চিঠি কিংবা ‘সেনাবাহিনী নামানোর সময় এখনও হয়নি’ এসব ব্যাপার সরকারের আত্মবিশ্বাস প্রমাণ করছে না ‘নার্ভাসনেস’, তা সময়ই বলে দেবে। বিএনপিরও যে হরতাল আর অবরোধের বাইরে আর কিছু করার কোন ক্ষমতা নেই, তা আবার প্রমাণ করেছে। জনগণকে সাথে যুক্ত করবার তেমন কোন প্রচেস্টাই তাঁদের নেই। তাকিয়ে আছে জামায়াতের দিকে।

পাল্লা কোন একদিকে হেলে পড়ছে, তা বলবার সময় বোধহয় এখনও আসেনি। এই ‘স্টেলমেট; অবস্থা আর কতদিন চলবে, আর কত লাশ পড়বে, দেশের অর্থনীতির কত ক্ষতি হবে, তা সময়ই বলে দেবে। রোমের সেই গ্ল্যাডিয়েটর ফাইটের মত হয়েছে এদেশের দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থা। কোন একজনের জয় ছাড়া এই যুদ্ধ থামবে না। যতক্ষণ যুদ্ধ শেষ না হয়, ততক্ষণ যেমন রোমের অধিবাসীরা উত্তেজিত হয়ে সেই ফাইট দেখত, এদেশের সাধারণ মানুষের এই মুহূর্তে একটাই কাজ, আমাদের দুই রাজনৈতিক নেত্রীর এই ‘গ্ল্যাডিয়েটরিয়াল ফাইট’ দেখা আর সম্ভব হলে ‘উপভোগ করা’।

আলোচনা? কাদের মধ্য? দুই দলের না দুই প্রভুর?

obamamodi

by zainuddin sani

সুশীল সমাজ যদিও তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, তারপরও এই ধরনের অবস্থায় তাঁরা ঘ্যান ঘ্যান করতে এগিয়ে আসে। সাম্প্রতিক কিছু লেখা পড়ে মনে হচ্ছে তাঁরা আবার হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে আসছেন। বক্তব্য তেমন নতুন কিছু না, সেই পুরনো আবদার। ‘আলোচনা করুন’। তাঁদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের বুদ্ধি এই দলগুলোর নেই, তাই উপদেশটা দিতে হচ্ছে। ব্যাপারটা কি তাই? এদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায়, আলোচনা করতে চাওয়া মানে, আমার আন্দোলন করার ক্ষমতা নাই কিংবা আমার ক্ষমতা নাই, এই আন্দোলন দমাবার। আর তাই এদেশে কোন দলই সেধে আলোচনার প্রস্তাব দেয় না, বিশেষ করে অপর পক্ষ যখন দুর্বল অবস্থায় থাকে। এরপরও সুশীল সমাজের বুদ্ধিতে পূর্বে কিছু আলোচনা, চিঠি চালাচালি, আলোচনার জন্য বসাবসি, সবই হয়েছিল, এবং যথারীতি সেসবে কোন ফল আসেনি।

বাস্তবতা হচ্ছে, আন্দোলন করে দাবী আদায়ের ক্ষমতা না থাকলে, এদেশের কোন সরকারী দলই বিরোধী দলের দাবী মেনে নেয় না। আর আন্দোলন দমাবার ক্ষমতা থাকলে, সরকারী পক্ষ সেই আন্দোলনকে দমাবার কোন চেষ্টাই বাদ রাখেন না। তাই আন্দোলন করে দাবী আদায় করতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে, আন্দোলন কত জোড়ালো হচ্ছে আর অন্য পক্ষ কতোটা শক্তহাতে তা দমন করতে পারছে এই দুইয়ের ভারসাম্যের ওপর। বহুকাল হল, এদেশের কোন আন্দোলনে, সাধারণ জনতা অংশ নেয় না। ফলে এই মল্লযুদ্ধ মুলতঃ চলে সরকারী বাহিনী আর পিকেটারদের ভেতরে।

গত ছয়বছর, এই পিকেটারের সাপ্লাইয়ে বেশ ঘাটতি ছিল। আর তাই, কোন আন্দোলনেই বিরোধী দল জুত করতে পারছিল না। যা তাঁরা করছিল কিংবা আন্দোলন চালাবার জন্য যা জরুরী হয়ে পড়েছিল, তা ছিল জনগণকে আন্দোলনের কর্মসূচীতে যোগ দিতে বাধ্য করার। এমন কোন কার্যক্রম, যেখানে জনগণ অংশ নিতে বাধ্য। হরতাল আর অবরোধ করতে আপনি বাধ্য। গাড়ী না চললে আপনি উঠবেন কোন বাহনে। আপনার গাড়ী ভাঙবে জানবার পরও আপনি নিশ্চয়ই গাড়ী বের করবেন না। ব্যাস হয়ে গেল, হরতাল সফল।

বর্তমান পরিস্থিতি ঠিক কার অনুকুলে, এখনও বোঝা যাচ্ছে না। দেশ গোল্লায় গেলেও, এই দুই দলের কারোরই কিছু যায় আসে না। তাঁদের একটাই চাওয়া, আর তা হচ্ছে, নিজের জয় বা অপর পক্ষের পরাজয়। এই যুদ্ধ এর আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে, এখন আমরা অভ্যস্থ হয়ে গেছি। তবে যে অংশকে নিয়ে বেশি টেনশানে থাকি, যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ংকর যে অবস্থা, তা হচ্ছে ‘স্টেল মেট’। দাবা খেলার সেই অবস্থা, যেখান থেকে কারোরই বিজয় অর্জন সম্ভব না। টেস্ট ক্রিকেট কিংবা দাবায় যেমন ‘ড্র’ বলে একটা ব্যাপার আছে, রাজনীতিতে তেমনটা নেই। এখানে একজনের জয় কিংবা অন্যের পরাজয়, কোন একটা হতেই হবে। আর সেটা না আসা পর্যন্ত, অর্থাৎ এই ‘স্টেলমেট’ অবস্থা আমাদের সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। যারা আবদার করছেন, আলোচনার, তাঁরা ভালো করেই জানেন, কিছুই হবে না।

তারপরও এই আবদারগুলো জানানো হয়, এবং সাধারণতঃ তা জানানো হয় বেশ কিছু লাশ পড়ার পরে। আগেও বলা হয়, তবে দায়সারা ভাবে, এবং যথারীতি সেই আবদারে কেউ কর্ণপাত করেন না, মিডিয়ায় আসে না, পত্রিকায় কেউ কলাম লেখেন না। লাশ পড়া মানেই, অবস্থা গুরুতর। দুই পক্ষই বেশ শক্তিশালী। একদল সহিংস আন্দোলন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে আর অন্যদল সেই আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহারের প্রয়োজন বোধ করছে। তবে বর্তমান আন্দোলন অতিসম্প্রতি যেসব লাশ সরবরাহ করেছে, তাঁর পুরোটাই নিরুপায় জনতার লাশ। বিরোধীদলের আন্দোলনের আদেশ অমান্য করার কারণে লাশ। এই লাশ উৎপাদনের কৃতিত্ব এখনও কেউ নিচ্ছেন না, একে অন্যকে দায়ী করছেন। তবে এই লাশগুলো দেখে দুই দলের কারোরই এমন কোন বিবেক জাগছে না।

এসব আন্দোলনের জন্য খুব জরুরী হচ্ছে, আন্দোলনকারীদের লাশের যোগান। সেটাও আবার বড়সড় কোন নেতার। সেটা এখনও হয়নি, এবং ধারণা করা যায় আপাততঃ যোগান হবেও না। বড় সব নেতা আত্মগোপনে কিংবা চোদ্দ শিকের পেছনে। ওদিকে রাষ্ট্রীয় শক্তি, মাঠে নামব, নামব করছে। হুমকি, হুংকার দিচ্ছে, তবে এখনও অ্যাকশানে নামেনি। সেটা নামলে, আর তখন আরও কিছু লাশের যোগান হলে, সম্ভবতঃ খেলা জমে উঠবে। ‘স্টেল মেট’ অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।

খেলা অন্যদিকেও হচ্ছে। কূটনৈতিক পাড়ায় দৌড়ঝাপ শুরু হয়ে গেছে। নিজ নিজ প্রভুর কাছে গিয়ে আর্জি পেশ করা হয়েছে, ‘আমাকে বাঁচান’। তাঁরাও ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপ বক্তব্য দিচ্ছেন। সুশীল সমাজ মুলত এই ধরনের অবস্থার জন্যই অপেক্ষা করে। কারণ এই ধরনের অবস্থায়ই তাঁদের কথা মিডিয়ায় একটু পাত্তা পায়। যে কয়জন সুশীলের গায়ে এখনও দলীয় তকমা লাগেনি, এই সময় তাঁদের কিছুটা কদর হয়। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলাম লিখে তাঁরা জানান দেন, অবস্থা এখন গুরুতর, দেশের বেশ ক্ষতি হচ্ছে, অতএব এবার আলোচনা করা যেতে পারে। আগে বলিনি কারণ তখন আমার কথা কেউ পাত্তা দিত না।

আলোচনা আদৌ হবে কি না, আর হলে সেখান থেকে কোন ফল আসবে কি না, তা নিয়ে সব দলই নিজ নিজ বক্তব্য দিচ্ছেন। সেই বক্তব্য অবশ্য আসল বক্তব্য না। সেটা ‘মেন্টাল গেম’। হুমকি দিয়ে অপর পক্ষকে ঘায়েল করা। আগামী কিছুদিনের ভেতর সম্ভবতঃ বড় নেতারা পরিষ্কার করবেন, আলোচনার নাটক করতে তাঁরা রাজী কি না। আরও কিছু ব্যাপার এখনও পরিষ্কার হয়নি। প্রভুরা কি সিদ্ধান্ত নেবেন, কোন প্রভু এবার নিজের দাবীতে অনড় থাকবেন কিংবা দুই প্রভুর কোনজন এবার বাংলাদেশকে অন্যজনের ঝুলিতে দেবেন, তা এখনও তাঁরা পরিস্কার করছেন না। প্রভু দুইজন ২৬শে জানুয়ারী ভারতে মিলিত হবেন। সেখানে যদি দয়া করে তাঁরা কোন সিদ্ধান্ত নেন, তবে রক্ষা, আর নয়তো কপালে আরও ভোগান্তি আছে।

দুই পক্ষই হুমকি দিয়ে রেখেছেন, খেলা আরও জোরদার হবে ২০ তারিখের পরে। অর্থাৎ দুই পক্ষই কোমর বাঁধবেন। আর এটাও ঠিক, তার আগে পর্যন্ত এই ভোগান্তি চলবে। ফেব্রুয়ারিতে অসহযোগের ডাক দেয়া হয়েছে। ওদিকে সেই সময়ে রয়েছে এসএসসি পরীক্ষা। আগেকার আন্দোলন গুলোতে সাধারণতঃ শুক্র শনিকে রেহাই দেয়া হত, এখন সেটাও দেয়া হচ্ছে না। বিশ্ব ইজতেমার জন্যও তেমন কোন ছাড় দেয়া হয়নি। বেশ অনেক জেলায় জ্বালানী সংকট শুরু হয়েছে। অন্যদিকে বিজিবি দিয়ে পণ্য আর যাত্রীবাহী যানবাহন চলাচল করানোর চেষ্টা চলছে। কতদিন চালানো সম্ভব, সময়ই বলে দেবে। জনগণকে জিম্মি করা এই নেতাকর্মী বিহীন আন্দোলন কতদিন টানা যাবে, সেটাও যেমন দেখবার বিষয় তেমনি সবাই অপেক্ষা করছে, সরকারী বাহিনী গুলি ছুঁড়লে আর লাশ পড়লে, খেলার দিক পরিবর্তন হয় কি না।

আপাততঃ আন্দোলনের ‘স্টেলমেট’ অবস্থার যে পরিবর্তন হবে না, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। আলোচনাও যে সমাধান এনে দেবে না, সেটাও সবাই জানে। আমাদের প্রভুরা, এবং তাঁদের নিয়োগ দেয়া কূটনীতিকরা কি করবে কিংবা অন্য কোন সমাধান আসবে কি না, তাঁর দিকেই সবাই তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তের মিলিয়ন ডলার যে প্রশ্ন তা হচ্ছে, ‘সমাধান কোন পথে?’ এই দুই দলের আলোচনায় না দুই প্রভুর আলোচনায়?

আমাদের জন্য এই মানুষগুলো লাশ হয়েছে

hartal

by zainuddin sani

লাশ আসতে শুরু করেছে। প্রায় প্রতিদিনই একটি দুটি করে আসছে। প্রায় পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। তবে সেই ম্যাজিক লাশের দেখা এখনও কেউ পায়নি। ডাঃ মিলন কিংবা নুর হোসেন অথবা সেই লগি বৈঠার আঘাত বা বিশ্বজিৎ। কিছু লাশ সরকারের পক্ষে যায় কিছু যায় সরকারের বিপক্ষে। কিছু লাশ বিরোধী দলের আন্দোলনকে চাঙ্গা করে দেয় কিছু লাশ বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে দেয়। আজকের কিংবা কালকের লাশটি কার পক্ষে যাবে কেউই জানি না। তবে এ ব্যাপারটি নিশ্চিত, সুযোগ পেলে সেই লাশ নিয়ে রাজনীতি করতে কেউই পিছপা হবে না।

পেট্রোল বোমার এখন ফ্যাশান চলছে। কক্টেলে এখন আর সেই বিভীষিকাময় ইফেক্ট দেয় না। এখানে সেখানে ঝলসে যায় কিছুটা, হয়তো মাংসে গেঁথে থাকে কিছু স্প্লিন্টার। তবে আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়া বীভৎস লাস পেতে হলে চাই পেট্রোল বোমা আর নয়তো গান পাউডার। শিশুর লাশের ইমপ্যাক্ট সবচেয়ে ভালো। মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যাওয়া শিরশিরে অনুভুতি, ইস, আহা, উহু— সবমিলিয়ে বাজারদর এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে এসব আগুনে পোড়া শিশুদের। এরপরে সম্ভবতঃ শিশুকে বাঁচাতে যেয়ে মায়ের মৃত্যু কিংবা অশীতিপর বৃদ্ধা নারী। পুরুষ মানুষের বাজারদর একটু কম। সঙ্গে কিছু রোমহর্ষক কিংবা করুণ গল্প থাকলেও, বাজারদর খারাপ হয়না। বরং শুরু হয় পত্রিকাগুলোর শিরোনামের খেলা।

লাশ যেমনই হোক, তা থেকে ফায়দা লুটতে দুই দলই নেমে পরে। সরকার নামে আবেগের ঝোলা নিয়ে। ‘দেখো দেখো, কি বীভৎসভাবে খুন করছে বিরোধী দল।‘ যত বীভৎস ততো প্রচারণা। টেলিভিশনে বার বার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো। স্বজনদের আহাজারি। ‘কি দোষ ছিল এই শিশুটির?’ কিংবা ‘এই বাবা এখন কি নিয়ে বাঁচবে?’ জ্বলন্ত গাড়ী কিংবা পথচারীদের মতামত। যা কিছু সরকারের পক্ষে যাবে বলে মনে করে, কাজে লাগাবেই সরকার। ব্লগ, ফেসবুক এবং সেখানে তাঁদের পেটোয়া বাহিনীতো আছেই। আলোচনাকে যতটা সম্ভব মুখরোচক করে তোলা হবে।

এই ধরনের লাশ নিয়ে বিরোধী দলের বক্তব্যও বেশ গৎবাঁধা। ‘সরকারী দলের ষড়যন্ত্র’ কিংবা ‘এর পূর্বে যখন আপনারা বিরোধী দলে ছিলেন তখন কি করেছিলেন, তা কি ভুলে গেছেন?’ তবে তাঁদের মুখপাত্র যে ব্যাখ্যা সাংবাদিকদের সামনে পড়ে শোনাবেন সেখানে তিনি লাশের চেয়ে বেশি আগ্রহী হবেন, কেন এই হরতাল কিংবা অবরোধ ডাকতে হল, তাঁর ব্যাখ্যায়। রাজ্যের আবেগ ঢেলে দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করবেন, দেয়ালে তাঁদের পিঠ থেকে গিয়েছিল। হরতাল দেয়া ছাড়া আর তাঁদের কোন উপায় ছিল না। এরপরে আসবে সেই চিরাচরিত গণতান্ত্রিক অধিকারের গল্প, ‘হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার।‘

এই লাশগুলো বিরোধী দলের একেবারেই কাজে আসে না, এমন কিন্তু না। সাহায্য করে, তবে উল্টো পথে। লাশগুলো চিৎকার করে দেশবাসীকে বলে, বিরোধীদলের আন্দোলন, আদেশ, হুমকির পরোয়া করিনি বলে আমাদের এই দশা। তোমরা এই ভুল কর না। লাশের এই ইফেক্টটা বিরোধীদলের সত্যিকারের প্রত্যাশা, তবে তাঁরা সেকথা মুখ ফুটে বলে না। তাঁরা আবার এটাও বলে না, হে আমার দলের সমর্থকরা, তোমরা পিকেটিং কর না। আসলে এই লাশগুলো, বাহ্যিকভাবে বিরোধীদলের কিছুটা অপকার করে, ভেতরে ভেতরে উপকারই করে বেশি। আর সেকারণেই, বীভৎস এই লাশগুলোকে বাহ্যিকভাবে অপছন্দ করলেও, প্রতিটি বিরোধী দলই চায়, লাশ পড়ুক।

যে লাশগুলো বিরোধীদলকে সবচেয়ে বেশি প্রমোদ দেয়, তা হচ্ছে নুর হোসেন বা ডাঃ মিলন টাইপের লাশ। সরকারী পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে ঝড়ে পড়া কোন লাশ। আর সেটাও যদি আসে, সরকার বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই সময়ে, তবে তো আর কথাই নেই। সেই লাশ নিয়ে গল্প, কবিতা, কলাম সব কিছুই হবে। আঁকিয়েরা ছবি আঁকবে, কার্টুনিস্টরা ব্যঙ্গ করবে। বিরোধীদল সেই লাশ দেখিয়ে দেখিয়ে বলবে, ‘দেখো কি করছে সরকার’। আর সরকার বলবে, দেশের আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, এই কাজটা জরুরী ছিল।‘

লাশের এই রাজনীতি কি আদৌ বন্ধ হবে? কিংবা হরতাল, অবরোধের রাজনীতি? সৎ উত্তর হচ্ছে ‘না’। এই লাশ যতদিন রাজনৈতিক দলগুলোকে মুনাফার যোগান দিবে, ততোদিনতো অবশ্যই না। রাজনৈতিক দলগুলোকে একতরফা দোষও দিতে চাই না। একটি মিছিল কিংবা কিছু আহত, এমন রিপোর্ট আমরা নিজেরাই পড়ি না। লাশ না পড়লে আমরা নিজেরাও ভাবি না, বিরোধী দল সিরিয়াস। হরতালে কোন গাড়ী না পুড়লে, ভাংচুর না হলে, আমরা ধরেই নি, বিরোধী দল কোণঠাসা। আন্দোলনের ক্ষমতা নেই। টক শোতে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনাদের পিকেটিং করার লোক কৈ?’

সমস্যা সরকারী দলেরও। যদি তাঁরা বিরোধী দলকে সমাবেশ করতে দেয়, আর সেখানে বিশাল লোকের সমাগম হয়, তখন প্রশ্ন শুনতে হবে, ‘সরকারের প্রতি আস্থা কি কমে গেছে?’ কিংবা ‘বিরোধীদল কি বেশি জনপ্রিয়?’ ফলে শুরু হয়, হালুয়া রুটির বিনিময়ে লোক এনে সমাবেশ ভর্তি করা। একদিন সরকারী দল সিঙ্গারা খাওয়ায় তো আরেকদিন বিরোধী দল মিষ্টি খাওয়ায়। আজ সরকারী দল গালি দেয় তো কাল বিরোধী দল গালি দেয়। আমরাও বসে থাকি, বেশি ভালো গালি দিতে পারে, তা দেখবার জন্য। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, আমরাই বাধ্য করছি এই দুই দলকে, ‘শুরু কর মুষ্টিযুদ্ধ’ ‘দখল কর এই দেশ’।

এই মুহূর্তে কোন দলের পক্ষেই পেছানো সম্ভব না। বা সম্মান নিয়ে পেছানো সম্ভব না। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, যে পেছাবে, তারই পরিনতি হবে ভয়াবহ। আমরা জনগণ, তাকেই গালি দিব, ‘ব্যাটা পারিস না তো লাগতে যাস কেন?’ নতুন কোন লাশ যেন আর তৈরি না হয়, যেন শান্তি ফিরে আসে, এই উদ্দেশ্যে যে কেউ এক পা এগোবে, আমরা ধরে নেব, সেই দলই হারল। সরকারের তত্ত্বাবধায়কের দাবী মানা, মানেই সরকার হারল। কখনই ভাবব না, এই সিদ্ধান্ত কত উপকার করল। কখনই ভাবব না, এই সিদ্ধান্তের কারণে, কত মানুষ লাশ হওয়া থেকে বেঁচে গেল। উল্টোটাও ঠিক। বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচনে রাজী হলে, ‘বিরোধী দলের মুরোদ নাই আন্দোলন করার’।

এই লাশের মিছিল চলবেই। আমাদের জন্যই চলবে। আমাদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা দেখার অভ্যাসের জন্যই চলবে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, বুঝে কিংবা না বুঝে, আমরাই নিরন্তর উসকে দিচ্ছি এই লাশের উৎপাদন। পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশানে দেখে আঁতকে ওঠার আগে আমাদের একবার ভেবে দেখা উচিৎ, এই লাশের পেছনে আমাদের নিজেদের দায় কতোটুকু।

প্রভু, ফোনে না বলে প্রকাশ্যেই বলুন

amit shah

by zainuddin sani

দুজনেই হুমকি দিয়ে রেখেছেন, বিশ্ব ইজতেমা শেষ হলে, তারপর শুরু করব। এই কথার আরেকটি অর্থ হচ্ছে, আমাদের সাধারণ মানুষকে আপাততঃ ১৯ তারিখ পর্যন্ত এই জেদাজেদি সহ্য করতে হচ্ছে। কেউই পিছিয়ে আসবে না। সরকারও ম্যাডামকে মুক্ত করবে না আর বিরোধী দলও অবরোধ তুলবে না। বিএনপিরও ক্ষমতা নেই তাঁদের নেত্রীকে মুক্ত করার আর ওদিকে সরকারেরও ক্ষমতা নেই অবরোধ বন্ধ করার। দেশবাসীর এই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা নিয়ে দুই দলের কেউই বিচলিত না। দুইজনেরই চাই বিজয়।

যুদ্ধটা কারো পক্ষেই হারা সম্ভব না। বিএনপি পিছিয়ে আসা মানে তাঁদের সমুহ পতন। আগামী চার বছর তাকিয়ে তাকিয়ে এই সরকারের দেশ পরিচালনা দেখতে হবে আর হাত কামড়াতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামীরা হারলে এই ছয় বছরের অত্যাচারের প্রতিশোধ কড়ায় গণ্ডায় উসুল করবে বিএনপি জামাত জোট। দুই দলেরই থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বসে গেছে, পরবর্তী করনীয় নিয়ে অংক কসতে। বিএনপি হিসাব কষেছে, এভাবে আরও কিছুদিন চালাতে পারলে, সরকারের পতন হবেই। আওয়ামীরা অংক কষছে, হার্ড লাইনে গিয়ে, বিএনপির মেরুদণ্ড একবার ভেঙ্গে ফেলতে পারলে, আর সমস্যা হবে না।

পাল্লা কোন দিকে ভারী, এনিয়ে কথা বলার বেশ বড়সড় বিপদ আছে। অবস্থা এমন, ‘উইথ মি ওর এগেন্সট মি’। আওয়ামীরা সঠিক পথে আছে—এমন কিছু বলেছেন মানেই আপনি অবধারিতভাবে ওদের দলে। বিএনপি ঠিক করছে বললেও বিপত্তি আছে—আপনি বিএনপি করেন। দুজনেরই দোষ, এমনটা বললে, আপনাকে কেউ ডাকবেও না, আপনার কথা কেউই শুনবেও না, বলবে ধান্ধাবাজ, এখন দুই দিকেই তাল দিচ্ছে, যে টিকবে তাঁর দিকে হেলবে। কিংবা তখন হিসেব করবে, আগে আপনি কোন দিকে ঘেঁষে ছিলেন, কবে কি লিখেছিলেন বা বলেছিলেন। কিংবা পালটি মারবার ধান্ধায় আছেন কিনা। টক শো এখন হয়ে গেছে বুদ্ধিজীবীদের দলবাজি করার মোক্ষম জায়গা। আগে পত্রিকায় কলাম লিখে বোঝাতেন, ‘আপনিই আমার হুজুর’ আর এখন দুই দলের হয়ে ঝগড়া করে বোঝাচ্ছেন, ‘আমি আপনারই পা চাটি’।

সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সাধারণ মানুষের। তাঁরা কার দিকে তাকাবে? কার কাছে প্রত্যাশা করবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। দুই দলের কেউই তাঁদের কথা ভাবে না, এই তথ্য তাঁরা জানে। এও জানে, ভোট এদের দুজনের একজনকেই দিতে হবে। তথ্যটা এই দুই দলও জানে। তাঁদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীরা ইদানীং এই সুরেই কথা বলা শুরু করেছেন। ‘দেখুন দুই দলই চোর। টাকা উপার্জনের জন্যই এই পেশায় আসা। ফলে যাকেই বসান আপনার বা দেশের কোন উন্নতি হবে না। এরা দুর্নীতি করবেই, টেন্ডারবাজী করবেই। এখন বেছে নিন, কাকে চান।‘ এরপরে দুই দল দুই কথা বলছে। একদল বলছে, গনতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে আর অন্য দল বলছে দেশে গনতন্ত্র দিলে দেশবাসী এমন এক দলকে বেছে নেবে যার সঙ্গে রাজাকার ফ্রি, তাই গনতন্ত্র হত্যা জরুরী।

ফলে ঘুরে ফিরে বিতর্ক মজার এক যায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে, এদেশের লোক এখনও গনতন্ত্র বুঝতে শেখেনি। তাঁরা ভালো আর মন্দের পার্থক্য বুঝতে শেখেনি, ভোটের মুল্য বুঝতে শেখেনি। এখানে এখনও ‘হামগের ছাওয়াল’ শুধু এই কারণে একটি দলকে ভোট দেয়া হয়, নেতার জন্মস্থানের কারণে একজন একটি এলাকার ভোট পান, কেউ বা ভোট চান এলাকার পুত্রবধু হিসেবে। তাই আপাততঃ এদেশের লোকের জন্য গনতন্ত্র না। ব্রিটিশদের কাছে স্বাধীনতা চাওয়ার সময় কমবেশি এরকমই একটি কথা তাঁরা বলেছিল, ‘ইউ কান্ট রুল দাইসেলফ’। নিজেদের শাসন করার যোগ্যতা তোমাদের এখনও হয়নি। তাই তোমাদের শাসন করার ভার আমাদের হাতেই থাক।

সরাসরি না হলেও আমরা পর্দার আড়ালে এই কথাটি মেনে নিই। বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে গিয়ে নিজেদের ইন্টারভিউ দিই। বলি, ‘আমি ওর চেয়ে ভাল, এবার আমাকে দয়া করে ক্ষমতায় বসান। আপনি যা চাইবেন, সব পাবেন। একবার সুযোগ দিয়ে দেখেন। আগেরবার কিছু ভুল করেছিলাম, তবে এবার আর হবে না‘ অন্য দল বলে, ‘একদম বিশ্বাস করবেন না ওর কথা। আর আমাকে পালটাবার দরকার কি। ও যা দিবে বলছে, আমিও তো তা দিচ্ছি। শুধু শুধু ঝুঁকি নেয়ার দরকার কি?’

বিদেশীরাও উপদেশ দেন, সার্টিফিকেট দেন আর অবশেষে চিন্তা ভাবনা করে একজনকে ক্ষমতায় বসিয়ে সবার উদ্দেশ্য বাণী দেয়, ‘এ হচ্ছে দেশবাসীর পছন্দ’। সত্যি বলতে, আমাদের এই ফর্মুলায়ও তেমন কোন আপত্তি নেই। হেসে খেলে এই বক্তব্য আমরা হজম করি। আমাদের নেতা নেত্রীরাও বেশ গর্ব করে বলেন, অমুক দেশ আমাদের সরকারকে অভিনন্দন করেছে। অন্য দল আবার জানান দেয়, মিথ্যা বলছে, আমাদের আসল প্রভু আমেরিকা এখনও অভিনন্দন দেয়নি।

সম্প্রতি প্রতিবেশি দেশের বেশ কদর বেড়েছে। শীতল যুদ্ধ শুরুর কারণেই হোক আর দক্ষিন এশিয়ায় শক্ত অবস্থান তৈরির উদ্দেশ্যেই হোক, প্রতিবেশি দেশটির স্নেহ না পেলে এদেশের ক্ষমতায় আরোহণ সম্ভব না। ফলে শুরু হয়েছে কেবলা পরিবর্তন। কে কার চেয়ে বেশি পা চাটতে পারেন, তার প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি হওয়া ফোনালাপ, কিংবা বলা উচিৎ, ফোনালাপের গুজব নিয়ে দুই দলের কর্মী, নেতা এবং তাঁদের বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা যেমন কাদা ছোঁড়াছুড়ি করলেন, তা দেখতে বেশ মজাই লাগল।

ফোনালাপ আদৌ হয়েছিল কি না, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ফোনালাপের কথা ঘটা করে বলবার কি আছে? সবাইকে বোঝানো, আমার দিকে প্রভুর সুনজর আছে? আর অন্য দলের চামচা বাহিনীর উল্লাস ছিল দেখবার মত। ফেসবুক, ব্লগ, পত্রিকা, টক শোতে ছিল উল্লাসের ছড়াছড়ি। গর্বিত কণ্ঠে বেশ উল্লাস করে বলছে, ‘আরে দূর, ভয় পাওয়ার কিছু নাই, ফোন করেই নি।‘ আচ্ছা, এই উল্লাসের কারণ কি? ‘প্রভু এখনও মত পাল্টান নি?’

যদি তাইই হয়, তবে আমাদের ভোট দেয়ার দরকার কি? আপনারা ঠিক করুন, কে কে আমাদের প্রভু। বরং তাঁদের ভেতর একটি ভোট করুন। অবস্থা যদি এমনই হয়, যে আমাদের প্রভু কথিত সেই ব্যক্তি, তাঁর সিদ্ধান্তেই যে সব কিছু ঘটছে। আর সেটাও যখন ‘ওপেন সিক্রেট’ তবে আর লুকোছাপা কেন? তাঁর ভোট দানকে প্রকাশ্য করে দিতে সমস্যা কোথায়? ফোনে না বলে সর্ব সম্মুখেই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে বলুন, তাঁর ভোট দানকেও প্রকাশ্য করে দিন। সবার জন্য নির্দেশনা জারী করুন, যে দলের জন্য তিনি ভোট দিবেন, সে গদিতে বসবে।

এতে দল দুটিও বাঁচে, জনগণও বাঁচে। তাঁরা তখন শুধু শুধু জনগণের কাছে বিভিন্ন উন্নয়নের মিথ্যা ওয়াদা না করে সেই প্রভুর কাছে নিজেদের সত্যি ওয়াদা পেশ করবে। যিনি বেশি মুখরোচক ওয়াদা করে প্রভুর মন জয় করতে পারবেন, তার জন্য বরাদ্দ হবে গদি। আমরাও পাব আগামী পাঁচ বছরের জন্য একটি গণতান্ত্রিক সরকার। আর প্রভুরাও পাবে একজন আজ্ঞাবাহী ভৃত্য।

আওয়ামীদের হাড়ে কি আবার কাঁপন লেগেছে?

lig2-300x200

by zainudin sani

বাজারে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আওয়ামীরা হঠাৎ ঘাবড়ে গেল কেন? গত একবছর তো বেশ সাহসের সাথেই চালাল। হঠাৎ এতো আগ্রাসী হয়ে ওঠার দরকার কি? কি হত একটা সমাবেশ করতে দিলে। গাজীপুরেরটাই বা আটকানোর দরকার কি ছিল। ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’এর সাথে ছন্দ মিলিয়ে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পয়দা করার দরকারই বা কি ছিল। নিজেদের ম্যোরাল বিজয় দেখানো? মুখে যত বড়বড় কথাই বলুক, আওয়ামীরা বুঝিয়ে দিয়েছে, তাঁরা বেশ বিচলিত। মনে মনে প্রত্যাশা করছে, ভালোয় ভালোয় এই শীতকাল যেন পার হয়ে যায়।

২০০৮এ নির্বাচিত হওয়ার পর যেভাবে আওয়ামীরা দেশ চালিয়েছিল, তাতে দুটো ব্যাপার বেশ পরিষ্কার ছিল। যে যাই বলুক, আমরা নিজেদের মত চলব, প্রয়োজনে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে। স্বৈরতান্ত্রিক তাঁরা আগেও ছিল, তবে এবার তিন চতুর্থাংশ পেয়ে সম্ভবতঃ তাঁদের মাথা আরও বেশি বিগড়াল। বিএনপির ৩২ দেখে ভাবল, ওদের আর কোন আশা নেই। দ্বিতীয়টি যে ব্যাপারটি স্পষ্ট ছিল তা হচ্ছে রাজাকার ইস্যু থেকে যতটা ফায়দা তোলা যায়, সেটা তোলা। দ্বিতীয় প্ল্যানটা খারাপ না হলেও প্রথম দিকে খুব কাজে দিচ্ছিল না। ব্যাপারটাকে অনেকটা বিএনপি জামায়াত বিভেদ তৈরির প্ল্যান হিসেবে দেখছিল সবাই। ভেতরে কি ঘটছিল তা নিয়ে মতামত দেয়া সম্ভব না, কারণ বিচারালয় নিয়ে প্রশ্ন করা সম্ভব না। তবে সবার মনেই সন্দেহ ছিল, জামায়াতের সাথে ভেতরে ভেতরে কোন আঁতাত হচ্ছে। তারপর ঘটনাটা ঘটল।

কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন আর তার বিজয় সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখানো, বিস্ফোরণ ঘটাল। এমন যে ঘটবে বা ঘটতে পারে, তা আওয়ামীরা স্বপ্নেও ভাবেনি। গণজাগরণকে প্রথমে পাত্তা না দিলেও, অচিরেই তাঁদেরকে পাত্তা দিতে বাধ্য হল। রাজাকারদের বিচার চলাকালীন রাস্তায় বিচার বিরোধী অবস্থানই দৃশ্যমান ছিল। বিচারের সমর্থনে তেমন কিছুর দেখা মিলছিল না। তাই একটি রায়ের বিরুদ্ধে এতো বড় সমাবেশ হবে, সরকার নিজেও বোঝেনি। কোন মিছিল মিটিং হরতাল ছাড়া, কেবল অবস্থান দিয়ে যে সরকারের হাড়ে কাঁপন ধরান সম্ভব, ব্যাপারটা প্রথম অনুধাবন করল আওয়ামীরা।

ব্যাপারটা বেগতিক হতে পরে দেখে তা ধ্বংসের প্ল্যান করতে হল। এমনও একটা কিছু যে আবার এই ধরনের অবস্থান তৈরি না হতে পারে। যদিও অবস্থানটি ছিল সরকারের আঁতাতের বিরুদ্ধে, তারপরও আওয়ামীরা অচিরেই বুঝে গেল, এই আন্দোলন পকেটে ঢোকান সম্ভব। আর এই সোজা কাজটা ছাত্রলীগ করে দিল। প্রথমে মঞ্চ ক্যাপচার, এরপরে সাধারণ জনতার মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অবশেষে, হালুয়ারুটির ভাগাভাগি নিয়ে দ্বিখণ্ডিত করন। পুরো ঘটনার যে সারাংশ দাঁড়াল, ‘এই ধরনের আন্দোলন তৈরিই হয় বিক্রি হওয়ার জন্য’ আন্দোলনটির এমন একটি ছবি চিত্রায়িত হল। দুটো সুবিধা হল, রাজাকার প্রশ্নে, আওয়ামীরা তাঁদের নিজ ফর্মুলায় ফিরে যেতে পারল আর এটাও নিশ্চিত করতে পারল যেন এরপরে যুব সমাজ আর কখনই এই ধরনের কোন ডাকে সাড়া না দেয়।

সরকারের হাড়ে দ্বিতীয় কাঁপনটি জাগিয়েছিল, হেফাজত। ফর্মুলা একই। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান। বেশিদিন চালাতে পারলে, সরকারের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা শুরু হয়ে যেত। এদের সামলানোর জন্য একই ফর্মুলা চলবে না, সেটা আওয়ামীরা বুঝেছিল। ধর্ম ব্যাপারটার সঙ্গে আওয়ামীদের সখ্য খুব বেশি না। ফলে ছাত্রলীগ দিয়ে এই আন্দোলন কব্জা করা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে মুল সুবিধা ছিল অন্য জায়গায়। এই আন্দোলনে আসা জনতার অনভিজ্ঞতা। তাঁদের মনে হয়েছিল, জ্বালাও পোড়াও মানেই বিজয়। যে শিশুদের নিয়ে এই অবস্থান আন্দোলন তৈরি হয়েছিল তাঁদের সাহস ব্যাপারটাও ছিল একটি ইস্যু। আর সেই রাতের অতর্কিত আক্রমণও ছিল অপ্রত্যাশিত, বা হয়তো তাঁদের নেতাদের কাছে প্রত্যাশিত এবং প্রকাশিত। যাই হোক অপারেশান সাকসেসফুল।

এই দুই ঘটনার পর থেকে, সরকারের অবচেতনে একটি ব্যাপারই তাড়া করছিল, আর তা ছিল অবস্থান আন্দোলন। ঢাকার প্রবেশ মুখে একবার যদি বিরোধী দল অবস্থান শুরু করতে পারে, তবে কাহিনী পাল্টাতে সময় লাগবে না। আর সেই অবস্থানে যদি ম্যাডাম স্বয়ং থাকেন, তবে তো পরিণতি আরও ভয়ানক হয়ে যাবে। অন্তর্কলহ আর একরাশ মামলা দিয়ে যত সহজে বিএনপি নেতাদের কাবু করা গেছে, একবার অবস্থান আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে, তাঁরাও পকেট থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে। বিএনপি নেত্রীকে মামলা দিয়ে থামানো যাবে না, জানতো। ফলে নতুন কোন প্ল্যানিং জরুরী ছিল। তবে গনতান্ত্রিকভাবে তা করা সম্ভব না, এটাও জানত। রাস্তা একটাই ছিল, তাঁকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে দেয়া। কিংবা একাকী করে দেয়া।

সত্যিকারের নির্বাচন হলে যে হারবে, আওয়ামীরা সেটা জানতো। আবার এও জানতো, আন্দোলন করে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী তাঁরা মানাতে পারবে না। হোলও তাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার জবাই করবার পর থেকে বিএনপি কোন আন্দোলনই দানা বাঁধাতে পারেনি। হরতাল আর অবরোধ, সেই অর্থে আর রাজনৈতিক হাতিয়ার নেই। আর দুইএকদিনের এমন কর্মসূচীতে আজকাল আর সরকার কর্ণপাতও করেনা। আর তাই গতবছরের ৫ই জানুয়ারির পর থেকে সরকার বেশ আরামেই ছিল। আওয়ামীদের জন্য ভয়ের সময় বলতে এই শীতকাল। এটা পার হলেই, পরিস্থিতি আবার নিয়ন্ত্রণে। আর বিএনপির জন্যও আশার সময় এই শীতকাল। যা করার এই সময়েই করতে হবে। মামলা আর অন্তুর্কলহের কারণে বিএনপি এখন পর্যুদস্ত। টিমটিম করে আশার যে বাতিটি জ্বলছে, তা জ্বালিয়ে রেখেছেন বিএনপি নেত্রী।

আওয়ামীরা ঠিক করল, নেত্রীর ওপরও আঘাত হানবে। মামলার দিন পড়তে লাগল। মামলায় কাজ হবে না, আওয়ামীরা জানে। তবে কিসে কাজ হবে, সেটা জানে না। এদিকে হরতালও যে কাজে দেবে না, সেকথা বিএনপিও জানে। কিসে কাজ হবে, সেব্যাপারেও তাঁরা বেশ অনিশ্চিত। সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে, আওয়ামী সরকারের হাড়ে কাঁপন ধরাতে পেরেছিল কেবল অবস্থান আন্দোলন। আর সেটা যদি হয়, ঢাকার প্রবেশ মুখে। আওয়ামীদের ভেতর সেই জুজুর ভয় ছিলই। তাই সম্ভবতঃ তাঁরা ঠিক করে রেখেছিল, ঢাকার প্রবেশ মুখে সমাবেশের কোন সুযোগ দেয়া হবে না। প্রয়োজনে ‘নেড়িকুত্তা’ ইফেক্ট দিতেও তাঁরা রাজী ছিল। নেত্রীকে ঢাকার বাইরে সমাবেশ করতে দিলেও, ঢাকার প্রবেশ মুখের আশে পাশে করতে দেয়ার ঝুঁকি নিতে রাজী ছিল না আওয়ামীরা। সেই ফর্মুলার প্রথম প্রকাশ দেখা গেল গাজীপুরে।

সমাবেশের পরবর্তী প্ল্যান বিএনপি করেছিল ৫ই জানুয়ারী। সেটা আটকাবার ফর্মুলা হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করল, ‘মার্চ ফর ডেমক্রেসি’র পুরনো ফর্মুলা। ম্যাডামকে অন্তরীন রাখা। আর সেটা করবার জন্য সেই বালুর বস্তা। হয়তো প্রত্যাশা ছিল, আবার রেগে গিয়ে ‘গোপালি’ বলবেন। টুই তোকারি করবেন। তবে এবার তিনি শান্ত ছিলেন। তবে বরাবরের মত সমালোচনা হল, বিএনপির অন্য নেতাদের মেরুদণ্ডহীনতার। মামলার ভোয়ে আত্মগোপনে যাওয়ার। প্রথম দিকে সরকারকে বিজয়ী মনে হলেও, পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করেছে মনে হচ্ছে।

আসলে ৫ই জানুয়ারী নিয়ে আওয়ামীদের প্ল্যানিং বেশ অগোছাল মনে হয়েছে। বালি, খোয়ার ট্রাকের মত হাস্যকর ফর্মুলা, ইচ্ছে করে নেয়া, না ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ আটকাবার ফর্মুলার রিপিট টেলিকাস্ট, বোঝা যাচ্ছে না। কারণ যেটাই হোক, আগেরবার ফর্মুলাটা কাজে দিয়েছিল। তবে এবার কাজটা যেভাবে বিদেশী মিডিয়ায় এসেছে, আর তালার যে দৃষ্টিকটু ব্যবহার হয়েছে, তা সরকারের জন্য খুব সুখকর হয়নি। এই মুহূর্তে ব্যাপারটা বেশ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছে তালা খুলে দিতে, না পারছে তালা লাগিয়ে রাখতে। তারচেয়েও বড় সমস্যা, খুব যুক্তিযুক্ত কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারছে না এই ‘তালা’র। সবার সামনে স্বীকার করতে পারছে না, ম্যাডামকে ছাড়লে, আর তিনি একটি সমাবেশকে অবস্থান আন্দোলনে পরিণত করতে পারলে, আমাদের গদি নড়ে উঠবে। গণজাগরণ আর হেফাজতের পরে সম্ভবতঃ প্রথমবারের মত আবার আওয়ামীদের হাড়ে কাঁপন লেগেছে। দেখা যাক এবার কি হয়।

বিএনপির ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন, বিএনপি নিজেই

bnp-final1

by zainuddin sani

হচ্ছি হচ্ছি করেও বিএনপির কিছু হচ্ছে না। আন্দোলনকে অংকুরে বিনাশের যে স্ট্র্যাটেজি আওয়ামীরা নিয়েছে, তাতে ভালোই কাজ দিচ্ছে। সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব আওয়ামীদের দেয়া ঠিক হবে না। কিছুটা কৃতিত্ব অবশ্য বিএনপিরও। নিজেদের অন্তর্কলহ থেকে শুরু করে নেতৃত্বের থাকা দুই জেনারেশানের একে অপরকে অবিশ্বাস, আওয়ামীদের কাজ আরও সহজ করে দিয়েছে। যেমনটা সাধারণতঃ হয়, অতি আত্মবিশ্বাস পতন ডেকে আনে, তেমনটা সম্ভবতঃ হতে যাচ্ছে, আওয়ামীদের। তাঁরা ভেবে বসে আছে, বিএনপি মাঠে নেই এই তথ্য যত প্রচারিত হবে, বিএনপির জন্য তা ততো ক্ষতিকর হবে। তবে ঘটনা সম্ভবতঃ তেমনটা ঘটছে না।

সহানুভূতি ব্যাপারটা বোধহয় কিছু নিয়ম মেনে চলে। তার একটা হচ্ছে অত্যাচারিতের দিকে ধাবিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এই মুহূর্তে বিএনপির জন্য সবচেয়ে বেশি যে ব্যাপারটা কাজ করছে, তা হচ্ছে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে যে তথ্য জনগণ পাচ্ছে, তা এমন একটি ছবি প্রকাশ করছে যে বিএনপি ভয়ানক অত্যাচারের শিকার। তাঁদের নেত্রী একটি সমাবেশ করতে চাইছে, তাঁকে সেটা করতে দেয়া হচ্ছে না। অফিস থেকে বেরোতে চাইছে, তাও দেয়া হচ্ছে না। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে বালু আর খোয়ার ট্রাক এর আগমন সবকিছু মিলিয়ে সহানুভূতি এই মুহূর্তে পুরো মাত্রায় চলে যাচ্ছে বিএনপির ঝুলিতে।

আওয়ামীদের বদান্যতায় কিংবা নির্বুদ্ধিতায় পাওয়া এই সুবিধাগুলো পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না বিএনপি। প্রথম সারির নেতারা বেশ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, গ্রেফতার হতে তাঁরা রাজী না। হুমকি ধামকি দিতে বলেন, আমি আছি কিন্তু রাস্তায় মিছিল বের করতে পারব না। কোন সমাবেশে ভাষণ দিতে পারবো না। হরতালের দিনে রাস্তায় থাকতে পারবো না। তাই বলে আমাকে বা আমার চামচাদের কোন কমিটিতে রাখবেন না, তাও করতে দেব না। নতুন কোন নেতাদের আমদানী করবেন, সেটাও বরদাশত করব না। ফলে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বিএনপির রাজনীতি পুরোপুরি নেত্রী নির্ভর হয়ে বসে আছে।

প্রথম সারির নেতাদের এই স্বার্থপরতা দৃষ্টিকটু দেখালেও, তাঁদের এই অবস্থানের একটি নিজস্ব যুক্তি তাঁদের কাছে আছে। তাঁরা বেশ ভালো করেই জানেন, বিএনপি এই আন্দোলনে জিতলে, তাঁদের পায়ের তলায় আর কোন মাটি থাকবে না। বিএনপির ক্ষমতায় আরোহণ মানেই লন্ডন প্রবাসী নেতার প্রত্যাবর্তন। আর তিনি ফিরে দলের দ্বায়িত্ব নিলেই যাত্রা শুরু হবে তার নতুন ‘টীমে’র। আর সেই টীমে, পুরনোদের জায়গা হবে না। উপদেষ্টা জাতের কিছু আলংকরিক পদ দেয়া হতে পারে, তবে কর্তৃত্ব বলে কিছু থাকবে না। তাঁদের চোখের সামনেই তাঁদের এলাকায় নতুন আরেকজন নেতার উদয় হবে। দেখতে দেখতে তাঁদের চোখের সামনেই তাঁদের রাজনৈতিক মৃত্যু হবে। ফলে পুরনো নেতাদের এক বিশাল অংশ চাইছেন না, সেকেন্ড ইন কমান্ড দেশে ফিরুক।

এই মুহূর্তে বিএনপি দ্বিতীয় যে সমস্যায় আছে তা হচ্ছে, বিশ্ব ইজতেমা। সেকারণে অবরোধে ছাড় না দিলেও সমস্যা আবার দিলেও সমস্যা। ছাড় না দিলে, বিশাল এক জনতা অভিমান করবে। ভাববে, আমাদের কষ্টের কথা একবারও ভাবল না? আর অবরোধের কারণে যদি তাঁরা যোগ দিতে না পারে, তবে সেই অভিমান নতুন মাত্রা পাবে। দেশের অবস্থা ভেবে অনেকে মেনে নিলেও, সংখ্যায় তাঁরা হবেন বেশ কম। ওদিকে অবরোধে একবার ছাড় দিলে, আন্দোলনে আবার গতি আনা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। হয়তো অসম্ভবও। আর তেমনটা হলে, এই বছরের মত আন্দোলনের ইতি। এরপরের বছর আবার কিছু করবার চেষ্টা করলে, এই বছরের ব্যর্থতা তাঁদের পিছু ছাড়বে না।

এতোসব সমস্যার মধ্যে যুক্ত হয়েছে বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবী আর তার্কিকের আকাল। তাঁদের পক্ষ হয়ে লেখার জন্য নেই তেমন কোন কলামিস্ট, টক শো তে গিয়ে তাঁদের হয়ে ঝগড়া করবার জন্য নেই তেমন কোন তার্কিক। সঙ্গে যোগ হয়েছে, বিএনপি পন্থী চ্যানেল আর পত্রিকার অভাব। যাও দুএকটা ছিল, আপাততঃ বন্ধ আর নয়তো কেউই সেসব দেখে না বা পড়ে না। ফলে মিডিয়া ফ্রন্টে তাঁরা তাঁদের কথা, বলতেও পারছে না। আর যাদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তাঁদের পারফর্মেন্স বেজায় ভয়ংকর। সঙ্গে যোগ হয়েছে তারেক রহমানের বাণী। দলের কার্যক্রমকে যদিওবা কোন ভাবে ‘ডিফেন্ড’ করছে, ‘রাজাকার’ ইস্যু একেবারেই তাঁদের নাকাল করে ছেড়েছে। পুরনো নেতারা এখন আত্মগোপনে, নতুন নেতারা এখনও ভালো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেননি।

এমন একটা ফাঁকা মাঠ আওয়ামীদের জন্য মজার এক সমস্যা তৈরি করে দিয়েছে। নিশ্চিত জয় দেখতে পেয়ে তাঁরা এই মুহূর্তে খেলার বদলে উল্লাসের দিকেই মনোযোগী হয়ে উঠেছে বেশি। সারাক্ষণ শ্লেষাত্মক কথা, বিএনপি নেত্রীকে অপমান করা, বাকি নেতাদের ‘নেড়িকুত্তা’র মত পিটুনি দিতে চাওয়া, এসবের ভেতরে তাঁরা তাঁদের জয় দেখতে পাচ্ছেন। গায়ের জোরে পাওয়া বিজয়কেই তাঁরা রাজনৈতিক বিজয় ভাবছেন। ভুলে যাচ্ছেন, রাজনীতির খেলায় সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে জনগণের বিবেচনা। তাঁরা কি ভাবছে, সেই ব্যাপারটা মাথায় রাখা। আর বিরোধী দলের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হতে না দেয়া। ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে গিয়ে, তাঁরা বিরোধী দলকে অত্যাচারিত একটি দল হিসেবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করে ফেলছে।

এতো কিছুর পরও হয়তো কিছু নাও হতে পারে। বিএনপির যে দৈন্য দশা, হয়তো তাঁরা আন্দোলনে বিফলও হতে পারে। বলা যায়, এদেশের সব আন্দোলনই বিফল। এক ৯৬ ছাড়া বাকী সব আন্দোলনই একটি কাজ করেছিল, আর তা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই আন্দোলনগুলোর কোনটিই হয়তো সফল হত না, যদি না সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলে আগ্রহী হত। তবে ১/১১এর পরে নিজেদের যেভাবে তাঁদের গুটিয়ে নিতে হয়েছে তাতে এই মুহূর্তে তাঁরা তেমনটা আর করবেন বলে মনে হচ্ছে না।

ঘুরে ফিরে বিএনপির এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বন্ধু হচ্ছে আওয়ামীরা এবং তাঁদের অতি আত্মবিশ্বাস। বিএনপির দৈন্য দশা, বিএনপির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা তাঁদের ইনফর্মাররা, যেভাবে প্রতিনিয়ত বিএনপির আন্দোলনকে ‘স্যাবোটাজ’ করছে আর তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে অচিরেই তাঁরা বিএনপির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুতে পরিণত হতে যাচ্ছেন। আর শত্রু কিংবা বলা যায় ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন হচ্ছে, বিএনপি নিজে। এই নতুন শত্রুর সঙ্গে কিভাবে মোকাবেলা করবে, কিভাবে আন্দোলন এগিয়ে নেবে, সেটাই এখন দেখার ব্যাপার।

দ্যা গ্রেট বিএনপি ফ্লপ শো

bnp-final1

by zainuddin sani

শো টা যে ফ্লপ করবে, কিছুই যে করতে পারবে না, তা কমবেশি সবাই জানতো। তারপরও দলীয় নেতা কর্মীরা টিভি সেটের সামনে বসেছিল। সারকারী অঘোষিত হরতাল না হলেও, মনে হয় না তাঁরা ঢাকায় যেতেন। সাধারণ জনতার যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। অলৌকিকভাবে ‘নুর হোসেন’ জীবিত হলে, সেও নিশ্চিত যেত না। শুধু বিএনপির আন্দোলন না, ‘গনতন্ত্র উদ্ধার’ মার্কা কোন আন্দোলনেই যেত না। নব্বইয়ে একবার উদ্ধার করে শখ মিটে গেছে। তবে রাজনীতি প্রিয় বাঙালির, রাজনীতি নিয়ে কথা বলা হয়তো থামাবে না। রাস্তায় নামবার ভুল এখন আর কেউ করে না। দলবাজি এখন সবাই করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে।

সমর্থক যে নেই, তা কিন্তু না। তবে তাঁরা সব কিছু দেখে, খেলা দেখার মেজাজ নিয়ে। টিভি সেটের সামনে বসে, নিজ নিজ দলের হয়ে উল্লাস করার জন্য। আর সাধারণ জনগণ বসেছিল গত বছরের স্মৃতি রোমন্থন আর ‘যে কোন মুল্যে’র মানে কি তা বোঝার জন্য। মানেটা গাজীপুরের দিনও বুঝেছিল, তবে ভেবেছিল, সেখানকার দুই নেতার দ্বন্দ্বের কারণে, একটি লোকাল কারণে, শো ফ্লপ হয়েছিল। এবার ঘটনা ঢাকায়, নেতা কর্মীরাও আছে, বড় বড় হুশিয়ারি আসছে, অতএব এবার কিছু একটা হবে।

বিনোদন দেয়ার আওয়ামীদের ক্ষমতা নিয়ে কারোরই তেমন কোন সন্দেহ ছিল না। শ্লেষ মেশানো কথা বলায় কেউই কম যায় না। তবে বর্তমানে এবিষয়ে আওয়ামীরা একধাপ এগিয়ে আছে। সেসব শোনার পরের দৃশ্য ছিল রাজপথ। পুলিশ আর ছাত্রলীগের ‘ডেডলি কম্বিনেশান’ গাজিপুরের মত এখানেও খেল দেখাবে, তা সবারই জানা ছিল। একেবারে ‘কপি ক্যাট’ হলে দর্শক কমে যাবে দেখে মনোরঞ্জনের নতুন কিছু রসদও রাখা হয়েছিল। মায়া সাহেবের লুঙ্গি কিংবা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ এর সংযোজন হল। সবাই না হলেও অনেকেই এই নিয়ে আশাবাদী ছিল— কিছু নতুন মনোরঞ্জন আসছে।

সেই আশার গুড়ে অচিরেই বালি পড়ল। আওয়ামী নেত্রীর সেই পুরনো ঘ্যানঘ্যান আবার শোনালেন। সঙ্গে নতুন যা ছিল, তা হচ্ছে বিএনপি নেত্রীর নাটকের পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনালেন। এছাড়া আওয়ামীদের তরফ থেকে বড় ধরনের তেমন কোন নতুনত্বের দেখা পাওয়া যায়নি। হয়তোবা তাঁরা দেখাতে চায়ও নি। এক বালুর বস্তা দিয়েই যদি কুপোকাত করা যায়, তবে আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখাবার দরকার কি? তারপরও, কিছুটা ছিল।

আগেরবার ছিল বালুর বস্তা, এবার আর বস্তায় বালু ঢোকাবার প্রয়োজন বোধ করেনি। বালুর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছিল খোয়া, মাটি এসবের ট্রাক আর তাদের ড্রাইভারের মুখে মজার সব গল্প। দরজার তালাটিকেও নতুন সংযোজন বলা যেতে পারে। এবারের সত্যিকারের নতুনত্ব ছিল ‘স্পাই থ্রিলার’। আওয়ামীদের প্ল্যান আগে থেকে জেনে যাচ্ছিল বিএনপি আর বিএনপির প্ল্যান তৈরির সাথে সাথে চলে যাচ্ছিল আওয়ামী নেত্রীর কানে। এই প্লট আর কাউন্টার প্লটের খেলাটা এবার সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য হয়েছে।

বিএনপির তরফ থেকে নতুনত্বের অভাব থাকলেও সময়টা খারাপ কাটেনি। পিকাপ ভ্যানে করে কয়টা কম্বল, কয়টা ম্যাট্রেস আসল, কোন ঘরকে ম্যাডামের বেডরুম বানানো হল, এসব খবর একেবারেই আনকোরা। আসলে সবাই গতবছরের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ র সঙ্গে ঘটনা মেলাচ্ছিলেন। ‘ডায়ালগ বাই ডায়ালগ’, ‘সিন বাই সিন’। ম্যাডাম এবার একেবারে হুবহু নকল করেননি। সেবারের তুলনায় এবার একটু মুডে ছিলেন। রাগে গড়গড় করতে করতে সেই ‘গোপালি’ আর ‘তুই তোকারি’ ছেড়ে এবার ‘ক্যান রে ভাই’ এ এসেছেন। কিছুটা হলেও নতুনত্ব।

খেলায় কে জিতল তা নিয়ে আপাতত কিছুদিন ‘টক শো জীবীরা’ গলা ফাটাবেন। দলের নেতারা আসলে দুই ম্যাডামের গুণগানে কিছুদিন কান পাতা দায় হবে। একে অপরকে গালিগালাজও হয়তো করবেন। ‘গনতন্ত্র হত্যা’ ‘রাজাকারদের দোসর’ ‘ট্রেন মিস’ ‘২০১৯’ ‘সংবিধান রক্ষার নির্বাচন’— মোটামুটি এই থাকবে আগামী কিছুদিনের আলোচনার বিষয়। সাংবাদিকরা আসলে সবাই লক্ষ্য রাখবে, কে কোন দিকে ঘেঁসে কথা বলছেন। যদিও সাংবাদিকরাও দল বেছে ফেলেছেন এবং কি কি বলবেন, তাও সবাই জানে। তারপরও হয়তো দেখবেন। দুই দলকেই গালি দিলে আমরাই হয়তো বলব, ‘এই ব্যাটা কিন্তু ধান্ধাবাজ, দুই দিকেই তাল দিচ্ছে’। এরপর হয়তো চ্যানেল পাল্টাবো আর নয়তো ‘জলসা’ না দিলে স্বামীকে খুন করব।

খেলা আরও চলতো কি না, সত্যিকার অর্থে বোঝার উপায় নেই। মিছিলের নাম পাল্টে বিক্ষোভ মিছিল করলেও সেই মিছিল করবার জন্য কেউ আসবে না, তা সবাই জানে। নেতারা টাকা খেয়ে যেভাবে প্ল্যান উগড়ে দিচ্ছেন তাতে মনে হয় না ঢাকা শহরে আর কোন সমাবেশ করতে দিবে। বাকী থাকে হরতাল আর অবরোধ। ভোঁতা এই দুই অস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া তাদের আর তেমন কিছু করারও নেই। সেটাও হয়তো আর দুইদিন ডাকতে পারবে কারণ বিশ্ব ইজতেমার জন্য সেটাও স্থগিত করতে হবে। আর দিন দশেকের গ্যাপ পড়লে, নতুন করে আন্দোলন (এটাকে আন্দোলন না বলতে চাইলে, আমি আপত্তি করবো না) চাঙ্গাও করতে পারবে না। দলের নেতাদেরও সুবিধা। সম্ভবতঃ তাঁরা এটাই চাইছেন। শুধু শুধু আত্মগোপন করতে হবে না, এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।

এই শীতের আন্দোলন সম্ভবতঃ শেষ। কিছু খুচরা চেষ্টা হয়তো হবে। যদি কিছু লাশ পড়ে, তবে হয়তো কিছু মিছিল হবে। বিশ্ব ইজতেমা শেষ হওয়ার পরে হয়তো আবার কিছু অবরোধ আসবে। এবং যথারীতি মার্চের পরে সব কিছু ইতি। বিএনপির নেতারাও হয়তো অপেক্ষায় আছেন, কবে আসবে এপ্রিল। তাদের আর আত্মগোপনে থাকতে হবে না, মাঠে নামতে হবে না। তবে আওয়ামীদের কাছ থেকে পাওয়া মাসোহারায় হয়তো টান পড়তে পারে। আন্দোলনের প্ল্যান জানিয়ে যে আয় তাঁরা করছিলেন, সেই আয় হয়তো আপাততঃ বন্ধ হয়ে যাবে।

‘৭ দফা কি পরাজয়? না পরিকল্পনা?’

by zainuddin sani

দেশের রাজনীতিতে কি হচ্ছে বা কি হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সবাই বেশ বিভ্রান্ত। বিএনপির হুমকি ধামকি দেয়া, আর আওয়ামীদের সেসবে কর্ণপাত না করা, ব্যাপারটা অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। সকালের পত্রিকার দুটি অবধারিত শিরোনাম থাকতো দুই দলের কোন না কোন নেতার শ্লেষাত্মক বক্তব্য। কেন যেন ব্যাপারগুলোকে অনেক বেশী রীতি মাফিক মনে হচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল কি হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে— ‘আওয়ামীরা ২০১৯ পর্যন্ত চাইলে নির্বিঘ্নে থাকতে পারবে’। সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণার পরে, সত্যিকারের প্রত্যাশা কারোরই তেমন ছিল না। কমবেশি সবারই ধারণা হয়েছিল, ৫ই জানুয়ারিকে ঘিরে কোন কর্মসূচি এবং সেই কর্মসূচিতে বাঁধা দিলে কি হবে, তার হুমকি সম্বলিত একটি বক্তব্য আসছে। তার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামীরা কি বলবে, তাও সবাই আন্দাজ করে নিয়েছিলেন। পুরোপুরি তেমনটা হল না, সেদিনের ঘটনা, এদেশের রাজনীতির টিপিক্যাল ফর্মুলার ব্যত্যয় ঘটাল।

আপাত দৃষ্টিতে বিএনপি নেত্রীর ৭ দফা তেমন নতুন কিছু না। এতোগুলো দফার ভেতর মুল দফা একটিই। বাকী দফাগুলোর বেশ অনেকগুলোই সাধারনতঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই করে থাকে। আর কিছু খুচরা দফা দেয়া হয়েছে, সম্ভবতঃ নেগসিয়েশানের সময় বাদ দিতে রাজী হবার জন্য, সবাইকে বলা যাবে, ‘সমঝোতার খাতিরে আমরা তিনটি দাবী ছেড়ে দিলাম।’ তবে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তৈরি হচ্ছে অন্য কারণে, এই সময়ে এসে, এমন নরম অবস্থান কেন? যে দাবী গত ছয় বছরে আওয়ামীরা মানেনি, তাদেরকে আবার নতুন করে সেই দাবীর কথা জানানো কেন?

৭দফাকে বেশ নির্বিষ মনে হলেও, কেন যেন সবাই তেমনটা ভাবছে না। সবাই বেশি করে ভাবছেন, এতো মোলায়েম স্বরে কেন কথা বলছেন বিএনপি নেত্রী? তারচেয়েও বড় কথা, আল্টিমেটাম নেই কেন? দফা না মানলে কি হবে, সে সম্পর্কেও নেই কোন ভবিষ্যৎবাণী। বড় জাতের আরও কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন বিএনপির গেম প্ল্যান তাহলে কি? সবাই ভাবছেন এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। আর সেই উদ্দেশ্য কি, তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে চলছে কানাঘুষা। কেউ ভাবছেন, ‘নিশ্চয়ই বিএনপি কোন সিগন্যাল পেয়েছে’।

বোদ্ধা মহলকেও খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। তাঁদের এসব কথা ভাববার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। আসলে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে পদক্ষেপগুলোকে বেশ পরাজয় বলে ভাবা হয়, তার একটি হচ্ছে দাবী জানানো। বিশেষ করে সেই দাবীর সংখ্যা যদি থাকে একাধিক। আর সেই দাবী পূরণ না হলে, সরকারের কি অবস্থা হবে, সে সম্পর্কে যদি কোন হুশিয়ারি না থাকে, তবে তো অবধারিতভাবে ধরে নেয়া হয়, এই দাবীসমূহের প্রস্তাবকারী হয় সিরিয়াস না কিংবা তাদের তেমন কোন শক্তি নেই।

অন্যদিকে সাহসী পদক্ষেপ ভাবা হয় আন্দোলন কিংবা হুমকিকে। ‘এক দফা এক দাবী’র ও আলাদা একটা দাম আছে। তবে তেমন কিছু একবার বলে ফেললে কিছু একটা করে দেখানো জরুরী। নইলে আবার শুরু হয়ে যাবে অন্য হিসাব। যেমনটা হয়েছিল আওয়ামীদের ‘স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাও আটকাতে পারবে না’ হুমকির পরে। আর ইদানীং কালে, বিএনপি সম্পর্কে।

আন্দোলন করে কোন দাবী আদায়ের রেকর্ড বিএনপির খুব একটা নেই। তবে দাবীতে অনড় থাকবার একটা রেকর্ড ছিল। ফলে আগে যখন হুমকি ধামকি দিলেও সেগুলোকে কিছুটা সিরিয়াসলি নেয়া হত। ভাবা হত, সফল না হলেও, কিছু একটা অন্তত করবে। নিজেদের তৈরি করা ‘গুড উইল’এ সম্প্রতি তাঁরা ফাটল ধরিয়েছে। হুমকির অধিক ব্যবহার এবং কিছু করতে না পারা, তাঁদের দেয়া হুমকি সম্পর্কিত এই ধারণায় কিছু পরিবর্তন এনেছে।

এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ফর্মুলা অনুযায়ী ৭ দফাকে নিশ্চিতভাবেই পরাজয় কিংবা পিছু হটা ভাবা যায়। বিশেষ করে গাজীপুরে যেভাবে পিছিয়ে আসলো, তারপরে। ৫ই জানুয়ারীর মত ‘সিম্বোলিক’ দিনে সবাই যেমনটা ভেবেছিলেন, তাঁরা তেমন কিছু করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এটাও ঠিক, তাঁদের যা সাংগঠনিক অবস্থা, তাঁদের কাছ থেকে ততোটা কেউই প্রত্যাশা করছেন না। আবার এতো নরম কর্মসূচী দিবে, এটাকেও কেউ স্বাভাবিক ঘটনা ভাবতে চাইছেন না। সবার মনে তাই একটি সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, ‘পর্দার আড়ালে কিছু ঘটছে কি না।’

বিএনপি যেভাবে একের পর বিভিন্ন জাতের হুমকি দিয়েও কিছু না করার একটা ট্র্যাডিশান তৈরি করে ফেলেছিল, তাতে কমবেশি সবাই ভাবতে শুরু করেছিল, এই সরকারকে হটাবার ক্ষমতা বিএনপির নেই। আর ইতিহাস বলে, সরকারকে বাধ্য করতে না পারলে, বিরোধী দলের দাবী মেনে নেয়ার মত ঘটনা ঘটে না। আর নরম স্বরে বললে তো নিশ্চিতভাবেই ঘটবে না। এই দাবীর তাই একটি স্বাভাবিক মানে হচ্ছে, হুমকি দিয়ে কিছু না করে নিজেদের ইমেজের যে বারটা বাজিয়েছি, তা আর কন্টিনিউ করতে চাই না। এবার স্বীকার করে নিতে চাই, আমরা অথর্ব। দল হিসেবে, সংগঠন হিসেবে আমরা বেজায় অগোছালো। আন্দোলন করে দাবী আদায়ের ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই এই অনুরোধ ফর্মুলা।

এই স্বাভাবিক ব্যাখ্যার বদলে সবাই কেন যেন অন্য কিছু ভাবছেন। হয়তো ১/১১এর উদাহরণ এর জন্য দায়ী। এদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিদেশ নির্ভরতা এর জন্য দায়ী। হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকী কারো কাছ থেকে সমর্থন আদায়ে এই সরকারের ব্যর্থতা এর জন্য দায়ী। আবার হতে পারে পর্দার আড়ালে এমন কিছু ঘটবার আভাস তাঁরা পেয়েছেন, যা থেকে মনে হয়েছে, এদেশ একটি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। আর তাই, কঠোর আন্দোলনের পথ ছেড়ে, নরম আর সমঝোতা ধাঁচের পথে হাঁটতে রাজী হয়েছেন, বিএনপি নেত্রী।

ধাঁধা আরও আছে। বিএনপির বেশ কিছু বড় নেতার বক্তব্য থেকে বোঝা গেছে, ৭ দফার এই সিদ্ধান্ত নেত্রীর একক সিদ্ধান্ত। সব দলের সাথে আলাপও করেননি। এমনকি নিজ দলের অনেককেও অন্ধকারে রেখেছিলেন। ঘাড়ের ওপর মামলা, বিভিন্ন আন্দোলনে দলীয় বড় নেতাদের পালিয়ে বেড়ানোর মানসিকতা এমন অনেক ব্যাপারকেও এর কারণ ভাবা যেতে পারে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বড় কারণ হিসেবে সবাই ভাবতে শুরু করেছেন, বিদেশী প্রভুদের ইচ্ছেকে।

৭দফা নিয়ে বোদ্ধা মহলের এই প্রতিক্রিয়া দেখে এই প্রশ্নই সবার মনে জাগছে, কি এমন ঘটল যে ম্যাডাম এরকম ‘সফট’ কর্মসূচী দিলেন। কোন আশ্বাস কি পেয়েছেন? আওয়ামীরা নরম হবে কিংবা এভাবে দাবী জানালে মেনে নেবে— এমন কোন আভাস? ১/১১ এর মত কোন ঘটনার আভাস? আওয়ামীদের ওপর থেকে বিদেশী প্রভুদের আশীর্বাদের হাত তুলে ফেলার আভাস? কিংবা প্রতিবেশী দেশের ওপর অন্য কোন বৃহৎ দেশের চাপ প্রয়োগের আভাস? সম্ভবতঃ আর কিছুদিনের ভেতরেই সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটবে। তখন স্পষ্ট হবে, ‘৭ দফা কি পরাজয়? না পরিকল্পনা?’

তত্ত্বাবধায়ক সরকার— অ্যা পোস্ট মর্টেম

ctggby zainuddin sani  আমার মৃত্যুটাকে ঠিক আচমকা মৃত্যু বা ‘সাডেন ডেথ’ বলা যায় না। দীর্ঘ রোগ ভোগের পরের মৃত্যু বলাটাও ঠিক হবে না। খুন বলা যেতে পারে, তবে মৃত্যুটা হয়েছিল আমার ওপর আসা উপর্যুপরি আঘাতের বেশ অনেক বছর পরে। ছোট খাট ঝড় ঝাপটা গেলেও আমি মোটামুটি বহাল তবিয়তেই টিকে ছিলাম। তিন তিনটে নির্বাচনও করলাম। বিরোধী পরাজিত দল ছাড়া বাকী সবাই বলল নির্বাচন ভালোই হয়েছে। বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও ঘুরে দেখে বলেছিলেন, নির্বাচন ভালোই হয়েছে। রিপোর্ট কার্ডে একশোতে একশো না দিলেও কমবেশি সবাই নব্বইয়ের ওপরেই নম্বর দিয়েছিলেন। এরপরও আমার শেষরক্ষা হল না। বলা যায়, সেটাই আমার কাল হল।

আমার ওপর প্রথম বেশ বড়সড় আঘাত এসেছিল বিএনপি আমলে। মানে বিএনপির দ্বিতীয় আমলে। সেবার মউদুদ সাহেব সংবিধানে একটি সংশোধন করেন। সেই সংশোধনের ফলাফল যা দাঁড়াল, তাতে দেখা গেল একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি, যিনি একসময় বিএনপির সদস্য ছিলেন, তিনি হয়ে যাচ্ছেন আমার প্রধান। ঠিক তাঁকে প্রধান করার জন্যই এই পরিবর্তন, না সত্যিই বিচারক সংকটের জন্য এই পরিবর্তন, তা হলফ করে কারো পক্ষে বলা সম্ভব না। আর এদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে একটি দলের দেয়া ব্যাখ্যা আরেকজন মেনে নেবে, প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। প্রায় বললাম, কারণ নিজেদের বেতন বৃদ্ধি আর শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির জন্য কেবল এরা একমত হয়।

যাই হোক, সেই সংশোধনীর পরে আওয়ামীরা ভাবল, সেই হাসান সাহেবকে প্রধান করার জন্য এই কাজ করেছে বিএনপি। তাই তাঁরা আন্দোলনে নামলো। প্রচুর হরতাল দিল। জ্বালাও পোড়াও ও কম করল না। তারপরও তেমন কিছু করতে পারল না। বহু জল ঘোলা করে অবশেষে আমার প্রধান হিসেবে আসলেন রাষ্ট্রপতি। কাজটা ঠিক হল কি না তা নিয়ে বেশ বিতর্ক হলেও আওয়ামীরা মেনে নিল। ঠিক সেই সময়টায় সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতির অধীনে থাকবার কারণে হয়তো আওয়ামীরা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে সাহস করেনি। এরপরে বেশ যাচ্ছেতাই ভাবে আমাকে ব্যবহার করতে লাগলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব। আমার বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাও পদত্যাগ করলেন।

এর কিছুদিন পরে আসলো সেই যুগ সন্ধিক্ষণ। অনেকের মতে আমার মৃত্যুর সেটাও একটি কারণ। ১১ই জানুয়ারী, আমার পরিচালনায় হতে যাওয়া চতুর্থ নির্বাচনটির মাত্র কিছুদিন আগেই আমার প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলেন বা করানো হল। নতুন প্রধান হিসেবে আসলেন, ফখরুদ্দিন সাহেব। নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ হল। তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন শেষ করার বাধ্য বাধকতা থাকলেও, আইনের কিছু ফাঁক গলে, নির্বাচন অনুষ্ঠান পেছানো হল। এই ফাঁকে বেশ সাহসী কিছু পদক্ষেপও নেয়া হল। দুই দলের তাবৎ বড় বড় নেতাকে আটক করা হল। কারো মতে, ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার মাধ্যমে দেশের দুই বড় দলের যবনিকা পতনের চেষ্টা হল।

এরপরে অনেক ঘটনা ঘটল। দুই বড় দলের বেশ কিছু নেতা বিদ্রোহ করল। শীর্ষ পদ দখলের জন্য, কিংবা দল দুটিকে ধ্বংস করার জন্য, বেশ অনেকেই একত্রিত হল। তবে সফল হল না। আমার শীর্ষ পদে থাকা মানুষগুলো ঠিক কি চেয়েছিল, জানি না। তবে প্রথম প্রথম তাঁরা যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, কিংবা দুই বড় নেত্রীকে গ্রেফতারের পরেও যে মৌন সম্মতি তাঁরা পেয়েছিল, তা ধরে রাখতে পারল না। বাগাড়ম্বর আর দুরাভিসন্ধি তাঁদের কাল হয়ে দাঁড়াল। ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করে ক্ষমতায় আরোহণের চেষ্টা শুরু করেছে কি না তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিল। ফলাফল যা হল, দুই দলের সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও ক্ষেপিয়ে তুলল আমার বিরুদ্ধে।

সেই দুই বছর পার করে অবশেষে আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করলাম। আগের তিনবারের মত এবারও বেশ স্বচ্ছ নির্বাচন হল। পরাজিত দল ছাড়া বাকী সবাই এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিল। মনে হচ্ছিল এই যাত্রা হয়তো বা আমি বেঁচে গেলাম। কিন্তু তা হল না। আমার কারণে অন্য আরেকটি যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেই কারণ দেখিয়ে আমার মৃত্যু সনদ জারী করা হল। সুপ্রিম কোর্ট একটি রায়ে জানাল, আমি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমার কারণে বিচারালয় ধ্বংস হতে বসেছে। আওয়ামীরা সুযোগটা লুফে নিল। দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁদের ছিলই। রায়ের বাহানায়, আমার মৃত্যু নিশ্চিত করতে সংবিধানে সংশোধনী আনা হল। অনেকটা আমার আদল রাখলেও, শীর্ষ পদে, নির্বাচন কালীন সময়ে, দল নিরপেক্ষ ব্যক্তির পরিবর্তে একজন দলীয় লোক রাখবার ব্যবস্থা করা হল।

আমার মৃত্যু যদিও অবস্বম্ভাবী ছিল, তারপরও এতো দ্রুত হবে, সেটা অনেকেই ভাবেনি। দুই দল যে কেবল চর দখলের জন্যই নির্বাচন করে, এই তথ্য জনগণ বুঝে গেলেও, মেনে নিয়েছিল। একের পর এক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে হওয়া কারচুপি আর তারপরে হওয়া সহিংস কিংবা অহিংস রাজনীতি দেখতে দেখতে ক্ষুব্ধ দেশবাসী আমাকে পেয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ভেবেছিল, দুই দল তাঁদের জন্য কিছু করুক আর না করুক, নির্বাচন এবং নির্বাচন নিয়ে হওয়া সহিংসতা থেকে তো অন্ততঃ রেহাই পেলাম। তাঁদের কপালে সেই সুখ সইল না।

যদিও আমার মৃত্যুর দিন ক্ষণ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেউ ভাবেন চতুর্দশের পরেই মৃত্যু হয়েছে, কেউ বলেন ১/১১র কারণে, আবার কারো মতে পঞ্চদশের কারণে। আসলে আমার মৃত্যুর বীজ লুকিয়ে আছে, আমার অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলোর ফলাফলে। সেই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে তেমন কোন প্রশ্ন না থাকলেও যে সমস্যাটা দেখা দিল তা হচ্ছে প্রত্যেকবারই তৎকালীন বিরোধী দল জয়লাভ করল। এমন একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেল, তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন মানেই, নিশ্চিত বিরোধী দলের বিজয়। বিরোধী দলের সুনিশ্চিত বিজয়, সেই নির্বাচনের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা আর সর্বোপরি সুষ্ঠু নির্বাচন করার এই সক্ষমতাটিই হয়ে দাঁড়াল আমার মৃত্যুর মৃত্যুর কারণ। ‘আপনা মাংসে হরিণ বৈরী’।

৯৬এ আমার অধীনে হওয়া দ্বিতীয় নির্বাচনে পরাজয়ের পরই সম্ভবতঃ বিএনপি ঠিক করেছিল, আমার ওপর ‘সার্জারি’ করার। ২০০১এ ক্ষমতা পাওয়ার পরেই, খুব ভালমতোই জানতো, ২০০৭এ আমার অধীনে নির্বাচন হলে, সেখানে তাঁদের শিকে ছিঁড়বে না, আবার আওয়ামীরা আসবে। আর সেই পরিস্থিতি আটকাবার জন্য, আইনগত ভাবে তাঁদের করণীয় তেমন কিছু ছিল না। আমাকে বাতিল করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ৯৬এ তেমন কাজ করতে যেয়ে তাঁরা বেশ ভুগেছে।

বিচারবিভাগে দলীয়করণ শুরু করলেও তার সুফল পেতে এখনও ঢের দেরী। সেই মুহূর্তে তাঁদের মাথাব্যাথা ছিল ২০০৭। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে। স্বাভাবিকভাবে চললে নিজেদের পছন্দের লোক আমার প্রধান হতে পারবে না। তাই আপাততঃ যে ফর্মুলার আমদানি করল তা ছিল বিচারকের বয়স বৃদ্ধি। ২০০১এ দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়াতে, সুযোগটাও তাঁরা পেয়ে গেল। গলা টিপে না মারলে, বেশ মারাত্মক আঘাত আসল আমার ওপর। তবে বিএনপির শেষরক্ষা হল না। ১/১১ আসল।

১/১১এর পরে মনে হয়েছিল আমার ওপর থেকে দুর্যোগের মেঘ সরে গেছে। আমার ওপর ‘সার্জারি’ করতে গিয়ে বিএনপি যেভাবে ভুগল, তাতে মনে হয় না আমাকে আর কাঁটা ছেঁড়ার সাহস কেউ দেখাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হল না। ১/১১এর সময় আমার দ্বায়িত্বে থাকা মানুষগুলো যেভাবে দুই নেত্রীকে শ্রীঘরের হাওয়া খাওয়ালো, তারপর আমাকে শৃঙ্খলিত কিংবা নখদন্তহীন করার একটা চেষ্টা যে হবে, বোঝাই যাচ্ছিল। তবে একেবারে মেরে ফেলা হবে, কেউই হয়তো বোঝেনি। যাই হোক, সেই সময়ের শাসনকাল কিংবা বিরোধী দলের বিজয়ের গ্যারান্টি, যেকারনেই হোক, আমাকে আমার পরিণাম ভোগ করতেই হল।

আমার মৃত্যু নিয়ে আমার তেমন কোন নালিশ নেই। আমাকে ছাড়াও পৃথিবীর অনেক দেশে নির্বাচন হচ্ছে, এবং বেশ ভালভাবেই হচ্ছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এদেশেও আমাকে ছাড়া নির্বাচন হবে। তবে সেজন্য জরুরী রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাস। ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে বিরোধী দলের প্রতি মর্যাদাপূর্ণ আচরণ। দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বস্তরে নিজেদের লোক বসানোর মানসিকতার পরিবর্তন। সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে, পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিকতা।

যে কাজগুলো করে আমি সুষ্ঠু নির্বাচন করতাম তার বেশির ভাগ কাজই নির্বাচন কমিশনকে দিয়েই করানো যায়। সেখানে প্রধান হিসেবে কে নিয়োগ পাবে, তার যদি একটি সুষ্ঠু উপায় বের করা যায়, সরকার, বিরোধী দল সহ আরও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তৈরি একটি প্যানেলের মাধ্যমে এর প্রধান নির্বাচন করা যায়, নির্বাচনকালীন সময়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাঁদের অধীনে রাখা যায়, প্রশাসনের রদবদলের কিছু ক্ষমতা তাঁদের হাতে রাখা যায়, তবে হয়তো আমাকে আর প্রয়োজনই পড়বে না।

বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না, তেমন কিছু হবে। আওয়ামীরা যেভাবে আমার অবসান চাইছে, নিতান্ত বাধ্য না হলে, মনে হয় না আমাকে আর জীবিত করবে। বিএনপির যা অবস্থা, আমাকে বাঁচাবার আন্দোলন করবার তেমন কোন ক্ষমতাও ওদের নেই। সুশীল সমাজের উচ্চবাচ্য নিয়েও অনেকে সন্দেহ করছে। ভাবছে, আমার মাধ্যমে কিছুদিনের জন্য ক্ষমতা পাওয়ার লোভে তাঁরা এসব চিৎকার চেঁচামেচি করছে। ফলে, স্বাভাবিকভাবে আমার জীবিত হওয়ার তেমন কোন পথ নেই। জানিনা আমার কি হবে। পুনরায় জীবন ফিরে পাব, না আমার চিরস্থায়ী মৃত্যু হয়েছে, সময়ই বলে দেবে। আমাকে নিয়ে আরও কিছু আন্দোলন, আরও কিছু মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে, আওয়ামীদের নতুন ফর্মুলায় সবাই সায় দেবে, তার অপেক্ষায় আছে দেশবাসী। এই শীতকালের মধ্যে কিছু একটা না ঘটলে, মনে হচ্ছে, ২০১৯এর আগে আমার ব্যাপারে নতুন কোন সিদ্ধান্ত হবে না। কি আছে আমার ভাগ্যে তা দেখার জন্য, আপনাদের মত আমিও অপেক্ষায় আছি।

বিএনপি কি বোঝে না, সেটাই বোঝে না

bnp-final1

by zainuddin sani  বেশ একটা যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপি। তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই নড়বড়ে দল নিয়ে ভাঙাচোরা একটা আন্দোলন চালাবে? না জনগণকে সম্পৃক্ত করার নতুন কোন প্রচেষ্টা নেবে। জনগণ আশার আলো দেখতে পায়, এমন কিছু করবে। এখন পর্যন্ত তাঁরা যা করেছে, তা ছিল গতবছরের সেই হরতাল আর অবরোধ দিয়ে শীতকাল পার করবার চেষ্টার একটি ব্যর্থ ফটোকপি। সবার মনে তাই প্রশ্ন, এভাবেই চালাবে? না মাথায় নতুন কোন প্ল্যানিং আছে? প্রশ্ন অবশ্য আরও একটা আছে, নতুন কিছু করবার মতো মেধা কিংবা ক্ষমতা তাঁদের আদৌ আছে কি না? ছাত্র সংগঠন কিংবা দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব বলে তাঁদের কিছু আছে কি না? কিছু উত্তর দেশবাসী পেয়ে গেছে, বাকীটা সম্ভবতঃ আগামী কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

বিগত কিছুদিনের কার্যক্রমে আন্দোলনে কিছুটা গতি এসেছিল। আর সেকারণে, অনেকেই গাজীপুরের দিকে তাকিয়েছিল। তবে ২৭শে কি হবে, এই নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য উৎসাহ জাগানো ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারেনি বিএনপি। এভাবে পিছু হটবে, সম্ভবতঃ বিএনপির অনেক নেতাকর্মীও ভাবেনি। ফখরুল সাহেবের হুমকি যে সিরিয়াসলি নেয়াড় মত কোন জিনিস না, তা দেশবাসী বুঝে গেছে। যতটুকু যা আস্থা ছিল, তা ছিল বিএনপি নেত্রীর প্রতি। ধারণা করা হচ্ছিল, তিনি তাঁর সেই পুরনো মূর্তিতে ফিরে আসছেন। যেভাবে তিনি মাঠে নেমেছিলেন, একের পড় এক সমাবেশ করছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল, এবার আর বালির বস্তা দিয়ে আটকানো যাবে না।

ভুল ভাঙতে সময় লাগল না। আন্দোলন থামাতে এবার বালির বস্তাও লাগলো না। বাহ্যিকভাবে যদিও মনে হচ্ছে ১৪৪ ধারা আর ছাত্রলীগের ‘নেড়ি কুত্তা’ হুমকিই খেল দেখাল। তবে ভেতরের খবর আরও করুণ। গাজীপুরের নেতাদের ‘অসম সাহস(?)’ আর দলীয় কোন্দল এবার আওয়ামীদের কাজ সহজ করে দিয়েছে। বালির বস্তা আনবার খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে বক্সী বাজারের ‘নেড়ি কুত্তা’র ইফেক্টও কাজে দিয়েছে। দল হিসেবে বিএনপির তেমন কোন সম্মানজনক অবস্থান না থাকলেও, বিএনপি নেত্রীর ছিল। সেই দৃঢ় ইমেজে এবার বেশ বড়সড় ধাক্কা লাগলো।

দল হিসেবে বিএনপির এই অসম্মানজনক অবস্থান একদিনে তৈরি হয়নি। পুরো আওয়ামী আমলটাতেই, সরকার বিরোধী আন্দোলনে, বিএনপির ‘পারফর্মেন্স’ ছিল বেজায় হতাশাজনক। প্রথম আওয়ামী আমলে তেমন কোন আন্দোলন কিংবা সাফল্য না থাকলেও তাঁদের সমস্যা এতো প্রকট হয়ে দেখা দেয়নি। সেই অসফল আন্দোলন তেমনভাবে কারো চোখেও পড়েনি আর তাতে তেমন কোন সমস্যাও হয়নি, কারণ পরবর্তী নির্বাচনে জয় এসেছিল। সেই যাত্রা পার পেয়ে গেলেও দুর্বলতাটা থেকেই গিয়েছিল। এবারের আন্দোলনেও তাঁরা তেমন কোন নতুনত্ব আনতে পারেনি। যা করেছে, তা হচ্ছে আওয়ামীদের আন্দোলনের ফটোকপি। সেই হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর আর জ্বালাও পোড়াও। হরতালের বাজারদর কমে যাওয়া আর ভাংচুর এবং পেট্রোল বোমায় সাধারণ মানুষের মৃত্যু, এবার সমস্যায় ফেলেছে বিএনপিকে।

হরতালের বদলে দেয়ার মত হাতে তেমন নতুন কোন কর্মসূচিও নেই। মানব বন্ধন কিছু দিয়েছিল, তবে সেখানে তেমন কোন গ্ল্যামার নেই, ওটা অনেকটা সুশীল সমাজ সুশীল সমাজ ভাব এনে দেয়। খুব ভালো কাভারেজও জোটে না, ফলে সেই লাইনে এগিয়েও খুব বেশি সাফল্য আসেনি। সমাবেশের নাম পাল্টে, বিক্ষোভ সমাবেশ করেও তেমন কোন লাভ হয়েছি কিনা সন্দেহ। ফলে ঘুরে ফিরে সেই হরতাল আর মিছিল। আর অতি ব্যবহারে এই মহার্ঘ অস্ত্রের প্রতি জনগণ আর দলীয় কর্মীদের মধ্যে এসেছে এক বেশ দায়সারা ভাব। হরতালের এই কর্মক্ষমতা হারানো আর বিকল্প কিছু না পাওয়া, সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে বিএনপিকে।

চিন্তার দৈন্যতার চরম প্রকাশ করলেন বিএনপির জনৈক নেতা। আওয়ামীদের ‘লগি-বৈঠা’ নকল করে ‘দা-কাস্তে’ বলে বেশ বড়সড় ঝামেলা বাঁধালেন। এরপরে বেশ কিছুদিন তিনি লাপাত্তা হয়ে থাকলেন। বিএনপির নেতারা, ‘নিজস্ব মতামত’ বলে দূরত্ব তৈরি করলেন। ঢাকা মহানগরে আগে থেকেই দলীয় কোন্দল ছিল, সেখানে কিছু হাওয়া লাগলো। খোকা সাহেবকে কোণঠাসা করবার এই সুযোগ, অন্য পক্ষ হাতছাড়া করল না। পুরো ঘটনার সারাংশ যা দাঁড়াল, তা হচ্ছে, দলীয় কোন্দলের সাথে সাথে বিএনপির চিন্তার দৈন্যতা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠল।

এদেশে আন্দোলন করবার সময় হচ্ছে এই শুষ্ক মৌসুমটা। হাতে আছে আর বড়জোর তিনমাস। এই সময়ের ভিতর বিএনপি কিছু করতেন না পারলে পিছিয়ে যাবে এক বছর। কারো কারো মতে পুরো চার বছর। যত সময় যাচ্ছে, ততোই প্রশ্ন জাগছে, এই শীতকালে কিছু করতে বিএনপি কি পারবে? কিছুদিন আগের ‘কতোটা সফল হবে’ থেকে আলাপ আলোচনা সেই প্রথম ধাপেই ফিরে এসেছে ‘বিএনপি আদৌ কিছু করতে পারবে কি না?’ ২৭ তারিখের পরে, এই উত্তর কমবেশি এখন সবাই জানে। টক শো আর বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় বেশ অনেক বুদ্ধিজীবীই এখন ভবিষ্যৎ করনীয় নিয়ে উপদেশ দেয়া শুরু করেছেন। আসলে বিভিন্ন ভাবে বলার চেষ্টা করেছেন, এভাবে হবে না। হয়তো বিএনপি নিজেও জানে, তাঁদের কিছু করার ক্ষমতা নাই। তবে যেটা জানে না, তা হচ্ছে, এর কারণ।

একথা ঠিক যে আওয়ামীদের এমন কোন জনপ্রিয়তা এখন নেই। ৫ই জানুয়ারী নির্বাচনকে প্রথমে বেশ কিছুদিন সফল নির্বাচন বলে চালানোর চেষ্টা করলেও সম্প্রতি তাঁরা সুর পাল্টেছে। এখন তাঁরা সেই গণতন্ত্র হত্যাকে সাংবিধানিক বাধ্য বাধকতা বলে চালানোর চেষ্টা শুরু করছেন। ভাষার এই পরিবর্তন থেকে হয়তো কিছুদিন আগেও বিএনপির মনে আশা জেগেছিল, হয়তো ভাবছিল, আন্দোলন ভালমত করতে পারলে, কপালে শীকে ছিঁড়তে পারে। এখন পর্যন্ত তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না আর বোদ্ধা মহলও বলছেন, বিএনপির যে সাংগঠনিক অবস্থা আর দলীয় কোন্দল, তাঁদের দিয়ে তেমন কোন আন্দোলন সংগঠিত হওয়া সম্ভব না।

এর আগের বিভিন্ন সরকার বিরোধী আন্দোলনে, সাধারণ জনতা, হয় নিজেই মাঠে নেমেছিল আর নয়তো মৌন সম্মতি দিয়েছিল। এবার দুটোর কোনটাই ঘটছে না। পুরো আন্দোলনকে তাঁরা দেখছে, দুই দলের ক্ষমতায় যাওয়ার কামড়াকামড়ি হিসেবে। চর দখলের এই প্রতিযোগিতায় কেউই অংশ নিতে রাজী না। আন্দোলন করে, আওয়ামীদের গদি থেকে নামাবার পরে কি? কি পাবে তাঁরা? এই উত্তরে জনগণ দেখতে পাচ্ছে সেই একই হতাশা। আরেকটি স্বৈরাচারী সরকার, শুধু নেত্রীর নাম পরিবর্তন।

জনগণকে যদি পাশে পেতে চায়, বিএনপিকে প্রথমে বুঝতে হবে, জনগণ কি চায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁদের নেতার অবস্থান মুখস্থ করানো নিয়ে জনগণ বেজায় বীতশ্রদ্ধ। প্রয়াত নেতাদের পূজা করা এবং জনগণকে সেই পূজা করতে বাধ্য করার এই প্রবণতার একটি ইতি টানবার চেষ্টা তাঁরা দেখতে চায়। ছাত্র সংগঠনের উদ্দাম অস্ত্র নৃত্য কিংবা দুর্নীতির কড়াল গ্রাস থেকে মুক্তি চায়। ক্ষমতায় গেলে করব, এই ফর্মুলা থেকে বেড়িয়ে এসে, এখনই কিছু করার প্রচেষ্টা দেখতে চায়। ‘ওদের আমলে কি হয়েছে?’ এই যুক্তিতে নিজেদের অন্যায় চালিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতার অবসান দেখতে চায়।

অলৌকিক কিছু না ঘটলে, এই সাংগঠনিক অবস্থানিয়ে বিএনপির পক্ষে সফল কোন আন্দোলন করা সম্ভব না। এই তথ্যটা বিএনপি বুঝে গেছে। তবে যেটা বোঝেনি, তা হচ্ছে, কেন তাঁদের এই অবস্থা। জনগণের আকাঙ্ক্ষা বোঝার যে অক্ষমতা আওয়ামীদের ভেতর এখন কাজ করছে, তা তাঁদের ভেতরেও কাজ করছে। গদি থেকে আওয়ামীদের সরিয়ে বিএনপিকে বসাতে কেউই আগ্রহী না। স্বৈরতান্ত্রিক ফরম্যাটের সরকারের শুধু নেত্রী পরিবর্তনের জন্য কোন জনগণই মাঠে নামবে না। বিএনপির কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা জনগণের এই সরল প্রত্যাশাটা এখনও বোঝেনি। বিএনপির এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, তাঁরা কি বোঝেনা, সেটাই বোঝেনা।

‘বিএনপি – জিয়া পরিবারের প্রতিনিধি = ???’

by zainuddin sani

এদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল মুখে যতই গণতন্ত্রের জন্য নাকি কান্না কাঁদুক, একটা ব্যাপারে দুই দলই একমত, রাজতন্ত্র ছাড়া দল টেকানো সম্ভব না। সমস্যাটায় প্রথম পড়েছিল আওয়ামীরা। যে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু সহ তাঁদের শীর্ষ চার নেতার নিধন হল, তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় শীর্ষ পদ দখলের কামড়াকামড়ি। প্রায় চার টুকরা হওয়ার পথে রওয়ানা দেয় দলটি। নৌকার হাল ধরতে অবশেষে আসতে হয় শেখ বংশের জীবিত দুই বংশধরের একজনকে।

এর কিছুদিন পরেই একই সমস্যায় পড়ে, দেশের অপর বৃহৎ দলটি। তাদেরও কমবেশি একই অবস্থা হয়েছিল। ম্যাডাম এসে কাস্তে হাতে তুলে না নিলে দলটি টুকরো হতো না ‘ভ্যানিস’ হতো তা হলফ করে কেউ বলতে পারবে না। তবে সেযাত্রা বেঁচে যায় এবং এরপর থেকে ঝড় ঝাপটা এলেও দলটি টিকে ছিল।

এরশাদ সাহেবের বদান্যতায় প্রায় নয় বছর ক্ষমতার বাইরে থাকলেও দল দুটির অনুগামীর সংখ্যায় যেমন কমতি হয়নি তেমনই নেতৃত্ব নিয়েও তেমন কোন ঝামেলা হয়নি। যদিও বিভিন্ন পদে কে অধিষ্ঠিত হবেন তা দল দুটির শীর্ষ নেত্রী কর্তৃক নাজিল হত কিংবা কাউন্সিল হলেও কোন কর্মীই সাহস করে জানাতেন না, তিনি নেতা হতে চান। ফলে দল দুটির দ্বিতীয় শীর্ষ পদ বলে তেমন কিছু ছিল না।

দল পরিচালনার জন্য যে একনায়কতন্ত্রকে সমাধান হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন দুই নেত্রী, সেই সমাধানই সমস্যা হয়ে আবির্ভূত হল, ১/১১তে। দুই শীর্ষ নেত্রী বন্দী হলেন। একটি দলে তখন হবু উত্তরাধিকারী চলে এসেছিল, তিনিও বন্দী হলেন। শীর্ষ পদ ফাঁকা হওয়ায় নেতা হতে আগ্রহী সেইসব নেতাদের হঠাৎ করে বিবেক জাগল। মনে পড়ল, ‘আরে তাইতো, দলে তো গণতন্ত্র নেই! কিছু একটা করা দরকার।’

সমাধান হিসেবে যা আসলো, তা ছিল দল দুটির ওপর আসা পুরনো সমস্যার নতুন এডিশান। সেই দুই পারিবারিরক প্রতিনিধিদ্বয় আসবার পূর্বে যে সমস্যা হয়েছিল, তা আবার ঘটবার সম্ভাবনা দেখা দিল। কাহিনী একটু বেশি আঘাত হানলো বিএনপিকে। হয়তো এখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতার সংখ্যা বেশি ছিল কিংবা তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিমাণ বেশি ছিল। ঘটনা বেশ অনেকদূর গড়াল। তবে শেষরক্ষা হল রাজতন্ত্র দিয়ে। ম্যাডাম ফেরত এসে দলকে আবার ‘একটি দল’ বানালেন।

আওয়ামীদের অবস্থাও খুব ভালো কিছু ছিল না। বেশ বড় বড় নেতার ভেতরেই বিবেক জেগেছিল। আওয়ামীদের দুঃসময়ে যারা ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কামড়াকামড়ি করেছিলেন, সম্ভবতঃ নিজেদের ভেতর ভাগ বাটোয়ারা নির্ধারণ করে, তাঁরাও নেমে পড়েছিলেন শূন্য হওয়া শীর্ষ পদ দখল করতে। পরেননি, এবং তাঁদের এই অসম সাহস তাঁদের পরবর্তী জীবনও বেশ দুর্বিষহ করে দেয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুই বড় দলই সেই ‘এপিসোড’ থেকে শিক্ষা নেননি। কেউই দলে কোন সেকেন্ড ম্যান গণতান্ত্রিক ভাবে নির্ধারণের ঝুঁকি কিংবা প্রচেষ্টা নেননি। তবে তাঁর ফলাফল এখনও আওয়ামীরা ভোগ করেননি। কারণ তাঁদের ওপর সেই অর্থে বড় কোন দুর্যোগ আসেনি। উপনেতা কিংবা সাধারণ সম্পাদকও দলীয় নেত্রীর ইচ্ছামাফিক হয়েছে। কাউন্সিল হলেও কেউ আর এখন মুখ খোলে না। কেউই জানান না, তিনি কোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। নেত্রীকে অধিকার দিয়ে দেন, কোন পদে কে বসবেন, সেই হুকুম নাজিল করার। এবং যথারীতি ‘লিস্টি’ আসে শীর্ষ নেত্রীর মুখ থেকে।

১/১১ পরবর্তী সময়ে হওয়া নির্বাচনে আওয়ামীরা ক্ষমতায় আসায়, তাঁদের সেই অর্থে বড়সড় কোন সমস্যা হয়নি। ‘বিবেক জাগা’ সেইসব নেতাদের দলে রাখলেও বেশ অপ্রয়োজনীয় করে রেখেছেন। তবে নেত্রী, মূল সমস্যার কোন সমাধান করেননি। দলে গণতন্ত্র তো আনেনই নি, বরং সবাইকেই জানিয়ে দিয়েছেন, দলটি ‘বিক্রি হওয়া কিছু মানুষ দিয়ে তৈরি’। তাই কাউকে ‘সেকেন্ড ম্যান করা সম্ভব না। যদি কেউ হয়, সে হবে ‘আমেরিকা প্রবাসী পরিবারের মানুষটি’।

১/১১ সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেয় বিএনপিকে। একে তো নির্বাচনে পরাজয় হয়, তারওপর দলে দেখা দেয় অন্তর্কলহ। ঢাকা দখল নিয়ে দুই গ্রুপে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। পুরনো নেতা আর নতুন নেতাদের মধ্যে লড়াই। ফলে মহাসচিব পদে আবার আনা হয়, ম্যাডাম কর্তৃক ‘নির্বাচিত’ ব্যক্তি। পছন্দের লোক বসানোর বসানোর অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসবার কোন ইচ্ছে নেত্রী দেখালেন না। সেই মহাসচিবের মৃত্যুর পরও যাকে ভারপ্রাপ্ত করা হল, তিনিও সেই একই ফর্মুলায় নাজিল হলেন। ফলাফল হল ভয়ঙ্কর। ম্যাডামের অবর্তমানে কে হবেন দলের কান্ডারী, তা কেউ জানে না।

‘জিয়া অরফ্যানেজ’ আর ‘জিয়া চ্যারিটেবল’ এই দুই মামলা ট্রাম্প কার্ড হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন, আওয়ামী নেত্রী। ব্যাপারটা ব্যবহার করবেন কি না তা নিয়ে সম্ভবতঃ বিএনপি কিছুটা দ্বিধায় ছিল। হয়তো ভেবেছিল, এতোটুকু ভদ্রতা অন্ততঃ আওয়ামীরা দেখাবে। হয়তো ভেবেছিল, শীর্ষ নেত্রীকে গ্রেফতারের মত সিদ্ধান্ত নিবে না। হয়তো ভেবেছিল, ‘কখন পরস্থিতি পাল্টে যায়, এই ভেবে’ হয়তো আওয়ামীরা শীর্ষ নেতৃত্বকে ছেড়ে কথা বলবে।

মঙ্গলবারে যখন তড়িঘড়ি আয়োজন করা সাংবাদিক সম্মেলনের খবর আসলো, তখন মনে হয় না সাংবাদিকদের বুঝতে বাকী ছিল, সেই আশার গুড়ে বালি পড়তে যাচ্ছে। সম্ভবতঃ আওয়ামীদের ভেতরে থাকা তাঁদের গুপ্তচররা জানিয়েছে, আওয়ামীরা তাঁদের সেই ‘ট্রাম্প কার্ড’ দেখিয়ে ‘ব্ল্যাকমেইল’ না করে সরাসরি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপি যেভাবে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, তাতে ম্যাডামকে বাইরে রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ভাবছে।

মূল যে সমস্যা দল দুটির ভেতরে আগেও ছিল এবং এখনও আছে, তা হচ্ছে, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, দ্বিতীয় আর কোন নেতা নেই। দলে গণতন্ত্র না থাকায়, কোন নেতা কতোটা জনপ্রিয় তা কেউই জানেও না। কোন কাজ করার সুযোগ না থাকায়, কেউই জানেন না, ‘স্ট্রেটেজি’ তৈরিতে কে কতোটা দক্ষ। ফলে সেই পুরনো সমস্যা নতুন করে বেশ বড়সড় বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।

‘ট্রাম্প কার্ড’ সম্ভবতঃ অচিরেই ব্যবহার হবে। তবে সেই পরিস্থিতিতে কি করবে, কিভাবে তাঁরা দল চালাবেন, কিভাবে আন্দোলন করবেন, তা যে তাঁরা জানেন না তা যেভাবে ‘শুকনো মুখ’ নিয়ে বিএনপির দ্বিতীয় সারির নেতারা হাজির হলেন, তা দেখে বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। তাই যখন তাঁরা আওয়ামী প্ল্যান জানালেন, তখন একটি ব্যাপার বেশ স্পষ্টভাবে তাঁদের চেহারায় জ্বলজ্বল করছিল, তাঁদের অসহায় মুখ বলছিল, ‘ম্যাডাম গ্রেফতার হলে বিএনপির কি হবে?’

সময় হয়তো হাতে খুব বেশি নেই। ৫ই জানুয়ারী আসছে। সেই সময়ে কিছু করতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও মনে হচ্ছে, আওয়ামীরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। তাই শীতকালটা কোন ঝামেলা ছাড়াই পার করতে যেকোন দিন আসতে পারে আওয়ামী আঘাত। এবং সেই আঘাত কিভাবে মোকাবেলা করবে, কে নেতৃত্ব দিবে, তা এখনও খুব একটা স্পষ্ট না। সেকেন্ড ইন কম্যান্ডও দেশে নেই এবং তাঁর মাথায়ও ঝুলছে মামলা, তাই তিনিও মনে হয়না ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরবেন। ফলে জিয়া পরিবারের প্রতিনিধির অবর্তমানে নেতৃত্বের কি হবে ব্যাপারটা বিএনপি স্পষ্ট করবে, না সাসপেন্স থ্রিলার গল্পের মতো দেশবাসীর মনে জাগিয়ে রাখবে সেই জটিল প্রশ্ন, ‘বিএনপি – জিয়া পরিবারের প্রতিনিধি = ???’