সেনা অভ্যুত্থানঃ মুসলিম জাতিরাষ্ট্র প্রেক্ষাপট

আজ ১৯ আগস্ট । রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট অগাস্টাস (যার নামে ইংরেজী অগাস্ট মাসের নামকরণ করা হয়েছে) এর ২০০০তম মৃত্যুবার্ষিকী । তিনি জুলিয়াস সিজার পরবর্তী বিশৃঙ্খল অবস্থায় প্রথমবার পাক্স রোমানা (শান্তিপূর্ণ রোম) প্রতিষ্ঠা করেন এবং সম্রাট নামে নিজেকে ঘোষণা না দিয়ে প্রিন্সেপস্ সিভিতাতিস (রাষ্ট্রের প্রথম নাগরিক) হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন । ধারণা করা হয় নিজ স্ত্রী লিভিয়ার প্রয়োগ করা বিষপানে তিনি ১৪ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান । তবে অগাস্টাসের মৃত্যুবার্ষিকী স্বরণ করা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয় । আজকের দিন আরো একটি ঐতিহাসিক এবং শিক্ষণীয় ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে । ১৯৫৩ সালে ঠিক এই দিনে (১৯ আগস্ট) ইরানের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেগ সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন । তার এই পতনে সরাসরি জড়িত ছিলো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (অপারেশন অ্যাজাক্স) এবং বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স (অপারেশন বুট) । ব্রিটেনের একটি কোম্পানী দীর্ঘদিন ইরানের তেল সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের পকেট ভরেছে । কিন্তু মোহাম্মদ মোসাদ্দেগ যখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাদের কর্মকান্ডের হিসাব চাইলেন তারা সহায়তা করতে অস্বীকার করলো । এরপর মোসাদ্দেগ সরকার ইরানের সকল প্রাকৃতিক সম্পদ রাষ্ট্রিয় মালিকানায় নিয়ে যাবার পর ব্রিটেন এবং আমেরিকা তাকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেয় । এই অভ্যুত্থান নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে দেখা যায় কিভাবে দেশের প্রথম শ্রেণীর বুদ্ধিজীবি এবং পেশাজীবিরা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে রাতারাতি বিদেশী শক্তিকে দেশের ভার তুলে দেয় । সেই সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় একটি সেনাবাহিনী কিভাবে ক্ষমতা কাড়াকাড়ি করার অভ্যুত্থানে হঠাৎ বীরত্ব দেখাতে থাকে এটাও পরিষ্কার হবে । এই লেখায় মুসলিম বিশ্বের সেনা অভ্যত্থান গুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা থাকবে ।

ইদানীংকালে মিশরের সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে । পাকিস্তান, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া প্রভৃতি দেশগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছে শুধুমাত্র পর্যায়ক্রমিক সেনাশাসনের কারনে । এখন তিউনিসিয়া অথবা তুরস্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও মুসলিম বিশ্বে- বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের মাঝে ব্যাপক উৎকন্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । মিশরের ২০১৩ সেনা অভ্যুত্থান না হলে হয়তো ফিলিস্তিনে ২০১৪ গণহত্যা এড়ানো যেতো । আবার তুরস্কের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোগানের বিরুদ্ধে যেভাবে সকল শক্তি একজোট হয়েছে, তিনি কতোদিন সেনা অভ্যুত্থানের হুমকি মোকাবেলা করে টিকে থাকতে পারবেন সেটাও ক্যালকুলেশন করা দরকার আছে । এসব বিষয় বিবেচনা করেই সেনা অভ্যুত্থান পর্ব অধ্যয়ন করা প্রয়োজন মনে করেছি ।

প্রথমেই বলে নেয়া যাক সেনা অভ্যুত্থানের সংজ্ঞা কি । ফরাসি coup d’état শব্দটির অর্থ হচ্ছে কোন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত সরকার বা শুধুমাত্র সরকার প্রধানের পদচ্যুতি ঘটানোর চেষ্টা । একটি মিলিটারী ক্যু তখনই সফল বলে ধরে নেয়া যাবে যখন সাবেক সরকারপ্রধান পদত্যাগের বাধ্য হবেন বা নিহত হবেন । তবে মিলিটারীর পাশাপাশি অভিজাত সম্প্রদায় বা সুশীল সমাজেরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে । পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বড় বড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা রয়েছে । জুলিয়াস সিজার থেকে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট পর্যন্ত অনেক প্রভাবশালী শাসক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আরোহন করেছিলেন । তবে অধিকাংশ সময়েই সেনা অভ্যুত্থান রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়েছে । যাইহোক, আমাদের আলোচনা মুসলিম বিশ্বে সীমিত থাকবে ।

মুসলিম বিশ্বে প্রথম সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ১৯০৮ সালে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের সময় । তিনি ছিলেন শেষ অটোমান সুলতান এবং ইসলামী খিলাফতের ৯৯তম শাসক । ইয়ং তুর্কি মুভমেন্ট নামে একটি অভ্যুত্থানে তিনি ১৯০৯ সালে পদত্যাগে বাধ্য হন । এরপর আরো কিছুদিন কয়েকজন নামমাত্র সুলতানের অধীনে থেকে ১৯২৪ সালে খিলাফত সমাপ্ত হয় । এরমধ্যে আতার্তুক কামাল পাশা আধুনিক তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন ১৯২৩ সালে । অন্যদিকে পারস্য সাম্রাজ্যে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রেজা খান পাহলভী ক্ষমতায় আসেন ১৯২১ সালে । এই দুইজনের অধীনে শিয়া এবং সুন্নী অধ্যুষিত অঞ্চল সমূহে সেনা অভ্যুত্থানের সূচনা হয় । এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৬ সালের অক্টোবরে ইরাকে জেনারেল বকর সিদ্দিকীর নেতৃত্বে একটি সেনা অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী ইয়াসিন আল হাশিমী পদচ্যুত হন । তিনি সিরিয়ায় পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন । পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে চারজন কর্ণেলের নেতৃত্বে গোল্ডেন স্কয়ার নামে ইরাকি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের একটি দল ইরাকে অভ্যুত্থান করে । এতে নাৎসি জার্মানীর অনুসারী রশিদ আলী গিলানী ক্ষমতায় আসেন এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যের অনুগত শাহানশাহ জর্ডানে পালিয়ে যান । রাজতন্ত্র বিলুপ্তির জন্য ১৯৪৮ সালে ইয়েমেনে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় ।

পরবর্তী সেনা অভ্যুত্থান হয় সিরিয়ায় ১৯৪৯ সালে । ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জেনারেল হোসনী আল জাইম সিরিয়ায় প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন কায়েম করেন । এই অভ্যুত্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুস্পষ্ট মদদ পরিলক্ষিত হয় । ক্ষমতায় এসে জেনারেল হোসনী আল জাইম মহিলাদের বোরখা নিষিদ্ধ করেন । ইসরাঈলের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেন । ইসরাঈলের সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায় ফিলিস্তিনি উদ্ধাস্তুদের জন্য সিরিয়ায় বসতি করে দেন । মাত্র সাড়ে চারমাস পর এই সেক্যুলার জেনারেল তারই সহকর্মী সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত এবং বন্দি হন । একমাসের মধ্যেই তাকে হত্যা করা হয় । পরবর্তী সেনা অভ্যুত্থানের ইতিহাস আমাদের ভারতবর্ষে । ভারত পাকিস্তান পৃথক হবার পরপর কাশ্মীরে ১৯৪৭ সালে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে যুদ্ধ হয় । এখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা যুদ্ধ করে পুরো কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছিল । যুদ্ধের মাঝামাঝি অবস্থায় ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সরকার ভারতের সাথে যুদ্ধবিরতি ঘোষনা করে । এটি অনেক সেনা কর্মকর্তা মেনে নিতে পারেননি । তারা ১৯৫১ সালে জেনারেল আকবর খানের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন । কিন্তু জেনারেল আইয়ুব খান এই পরিকল্পনা সরকারকে অবহিত করেন এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন । এই অভ্যুত্থান চেষ্টা ‘রাওয়ালপিন্ডি চক্রান্ত’ নামে পরিচিত । অভিযুক্ত জেনারেলদের পক্ষে আদালতে লড়াই করেন প্রখ্যাত বাঙালী আইনজীবি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি । অনেকের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড হয় । পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাদের সাজা মওকুফ করেন ।

মিশরে প্রথম সেনা অভ্যুত্থান হয় ১৯৫২ সালে । রাজা ফারুককে সরিয়ে দিতে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে চক্রান্ত করেন জেনারেল মোহাম্মদ নাগীব । তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হবার একবছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে আরেক জেনারেল জামাল আব্দেল নাসের তাকে গৃহবন্দী করেন এবং নিজে প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করেন । ১৯৫৪ সালে একটি হত্যাপ্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরের চক্ষুশূল হয় এবং ব্রাদারহুডের উপর নেমে আসে চরম নির্যাতনের কালো অধ্যায় । পূর্বেই বলেছি ইরানে প্রথমবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ১৯৫৩ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন । তিনি ইরানের তেল বৃটিশ আধিপত্যে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন বিধায় সিআইএ এবং এমআইসিক্স যৌথ উদ্যোগে সেনা অভ্যুত্থান ঘটায় । এতে নেতৃত্ব দেন সাবেক সম্রাট রেজা খান পাহলভীর ছেলে রেজা শাহ পাহলভী । ক্ষমতায় এসে রেজা শাহ পাহলভী ইরানকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র বানাতে ব্যপক উদ্যোগ নেন । যার ফলশ্রুতিতে ধর্মপ্রাণ মানুষ ইসলামী বিপ্লবের পথে এগিয়ে যায় । ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন । একই বছরে ইরাকে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশাহ ফয়সল গদিচ্যুত হন এবং ইরাক রিপাবলিকের আত্মপ্রকাশ ঘটে ।

১৯৬০ সালে সেনা অভ্যুত্থানে তুরস্কের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দারিস ক্ষমতাচ্যুত হন । তুরস্কের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যাকে ফাঁসি দেয়া হয় । তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি পররাষ্ট্রনীতিতে পাশ্চাত্যকে বাদ দিয়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছিলেন । যে সকল সেনা কর্মকর্তা মেন্দারিসকে হত্যা করে, তারা ন্যাটোর প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করে রেডিওতে বিবৃতি দিয়েছিলো । ১৯৬২ সালে ইয়েমেনে সেনা অভ্যুত্থান হয় যা প্রায় আটবছর গৃহযুদ্ধে রুপ নেয় । এখানে রাজকীয় বাহিনীকে সৌদি আরব, জর্ডান, বৃটেন সমর্থন দেয় । বিপ্লবীদেরকে সমর্থন দেয় মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল নাসের এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন । ১৯৬৩ সালে ইরাকে সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কমিউনিজম বিরোধী বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে । সাবেক সেনাশাসক আব্দুল করিম কাসিম (যে নিজেও ছিলো অভ্যুত্থানে ক্ষমতাপ্রাপ্ত) ব্রাশফায়ারে নিহত হয় । একই বছর সিরিয়ায় মিলিটারী ক্যু ঘটিয়ে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে । এর পর থেকে প্রায় প্রতি বছর কোন না কোন মুসলিম দেশে সেনা অভ্যুত্থান হতেই থাকে । একের পর এক সাদ্দাম- গাদ্দাফী- মোবারক- আসাদ- ইয়াহিয়া- এরশাদ- মোশাররফ দের আগমন রোধ করা কোন মুসলিম দেশেই সম্ভব হয়নি । তবে মজার ব্যপার হচ্ছে- গণতন্ত্রের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্র এবং রাজতন্ত্রের স্বর্গ যু্ক্তরাজ্য প্রতিটি মুসলিম দেশের সেনা অভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলো । বিশেষ করে ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলিম দেশগুলোতে সেনা অভ্যুত্থান পরিচালনা করে অস্থিতিশীল রাখাই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি বলে মনে হয় । এক্ষেত্রে গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, আধুনিকতা ইত্যাদি বুলি শুধু মুখোশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে । এই সেনা অভ্যুত্থান নামক বিষবাষ্পের সর্বশেষ সংস্করণ আজকের মিশর । জেনারেল সিসি সেখানে ইসরাঈলের জাতীয় বীর উপাধী নিয়ে নব্য ফেরাউন হয়ে বসেছে । সম্ভবত এই তালিকায় ভবিষ্যতে নাম আসতে পারে পাকিস্তানের । কারণ সেখানে নির্বাচনের মাত্র এক বছরের মাথায় নওয়াজ শরীফ সরকারের বিরুদ্ধে ইমরান খান এবং তাহিরুল কাদরী যেভাবে বিক্ষোভ শুরু করেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এতো বড় সুযোগ মিস করবে বলে মনে হয়না । অথবা আইএসআই এটা মিস করলেও সিআইএ কিছুতেই মিস করবেনা । তবে আমার আশংকা হলো তুরস্কের বিষয়ে । কারণ এরদোগান প্রায় একযুগের সাধনায় পলিটিক্যাল ইসলামের যে প্রাসাদ দাঁড় করিয়েছেন, যদি আরেকটি অভ্যুত্থানে এই প্রাসাদ ভেঙ্গে পড়ে তবে মুসলিম উম্মাহর জন্য হতাশার সীমা থাকবেনা ।

সেনা অভ্যুত্থানে প্রথমেই নিজদেশের মানুষের সাথে সেনাবাহিনীর একটি অপূরনীয় দূরত্ব তৈরি হয় । এছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষতি, দুর্নীতি, সমাজের নৈতিক অধঃপতন তো থাকেই । তারপর গণহত্যা থেকে গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায় । মিশরে এখন পর্যন্ত প্রায় তিনহাজার মানুষ নিহত এবং বিশহাজার আহত হয়েছে । সিরিয়াতে সামরিক শাসক আসাদ দেশটিকে শেষ করে ছেড়েছে । আরো হতাহতের ঘটনা আগামী দিনেও অপেক্ষা করছে । আমরা দেখেছি, মিডিয়া কিভাবে একটি দেশের জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করে । আমরা দেখেছি, সেনাবাহিনীতে ভুল সমরনীতি কিভাবে নিজ দেশে গণহত্যার পরিবেশ তৈরি করে । অথচ মুসলিম বিশ্বের ইসলামপন্থী কোন শক্তি একটি সুদক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে পারেনি । এল বারাদী দের বিদেশী ডক্টরেট আর গোল্ড মেডেল যেভাবে তাদেরকে নির্লজ্জ সেক্যুলার এবং ভোগবাদী হিসেবে তৈরি করছে, একমেলেদ্দীনরা যেভাবে বহির্বিশ্বকে বন্ধু ভেবে নিজদেশের দেশপ্রেমিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তেমনি মুসলিম দেশগুলোর সেনা কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত বিদেশী অনুশীলন আর মিশন তাদেরকে কতটুকু দেশপ্রেম শেখায় বা জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তা মিলিটারী ক্যু এর ইতিহাস ঘাটলেই চোখে পড়বে । এছাড়া সুষ্ঠু পররাষ্ট্রনীতির অভাবে শুধু সরকারই নতজানু হয় তাই নয়, বরঞ্চ পুরো সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি নতজানু এবং পরাশ্রয়ী হয়ে উঠে । অতএব মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দ যদি সত্যিকার অর্থে বিদেশী আধিপত্য নামক বিষপান করতে না চান, তাদের প্রধান দায়িত্ব হবে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে সম্পূর্ণরুপে জনগণের ইচ্ছাকে বিবেচনায় নেয়া । দূতাবাসে ব্রেকফাস্ট করতে নেতাদের হুড়োহুড়ি দেখার মতো । অথচ তারা একবারও ভাবে না – দূতাবাসে রাতের আঁধারে অন্য কেউ ডিনার করছে কিনা ।

পরিশেষে বলতে চাই- বাংলাদেশ, সিরিয়া, মিশর, ইরাক, লিবিয়া, সৌদি, আমিরাত, ইয়েমেন প্রভৃতি মুসলিম দেশে গণতন্ত্র মুক্তি পাক । অবৈধ-অগণতান্ত্রিক শক্তির হাত থেকে দেশ বাঁচুক, মানুষ বাঁচুক । নয়তো এই মুসলিম দেশগুলো মানচিত্রে নামমাত্র টিকে থাকলেও এখানে মনুষ্য সভ্যতার অস্তিত্ব বিলীন হতে বেশিদিন লাগবে না । পাহলভীদের ভূত মুসলিম জাতির ঘাড় থেকে চিরতরে বিদায় হোক, আজকের দিনে এটাই প্রত্যাশা ।

চির উন্নত মম শিরঃ আগষ্ট বিপ্লব প্রসঙ্গ

এমন একটি সেনাবাহিনী কল্পনা করুন, যারা সদ্য একটি যুদ্ধ শেষ করে ব্যারাকে ফিরেছে । তাদের ফায়ার আর্মস বা মিলিটারী টেকনোলজি বেশ প্রাচীন আমলের । কিন্তু সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার মতো জ্ঞান, সাহস এবং দৃঢ়তা তাদের আছে । আবার কল্পনা করুন এমন একটি সেনাবাহিনী যারা জীবনে কখনো যুদ্ধই দেখেনি । প্রতিসপ্তাহে কমপক্ষে তিনটা করে পার্টিতে অ্যাটেন্ড করে, আনুষ্ঠানিকতায় দেশের মধ্যে শীর্ষে তাদের অবস্থান, সবার কাছে স্যার-স্যার শুনতে থাকে প্রতিনিয়ত । অবশ্য তাদের প্রশিক্ষণ আছে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার বিষয়ে । আপনাকে যদি বলা হয় দুটি সেনাবাহিনীর মধ্যে দায়িত্বশীলতার তুলনা করতে, আপনি অবশ্যই প্রথম দলকে এগিয়ে রাখবেন যদি সত্যিকার অর্থে সেনাবাহিনীর মূল্যায়ন করার মতো শিক্ষা আপনার থাকে ।

১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে কারো অজানা নয় । এ বিষয়ে যথেষ্ট ইতিহাস লেখালেখি হয়েছে, কলাম পড়া হয়েছে, ডকুমেন্টারি দেখা হয়েছে, ফেসবুকে নোট/স্ট্যাটাস পড়া হয়েছে । আমিও এটা নিয়ে লিখতে যাচ্ছি না । এতোবড় ঘটনার নিখুঁত বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা যেমন আমার নেই, তেমনি সস্তা মকারি করে রম্য লেখারও উদ্দেশ্য নেই । বরং আমি এখনো আগস্ট বিপ্লবের প্রকৃত তাৎপর্য এবং সাফল্যের শিক্ষণীয় দিকটি বুঝতে চেষ্টা করি । যতোবার আগস্টের গল্প শুনি বা আগস্ট মাসে শোক প্রকাশের কালো পতাকা দেখি, আমার মনে একটা অদ্ভুত রকমের ডিলেমা তৈরি হয় । সেটা শেয়ার করাই আমার লেখার মূল প্রেরণা ।

বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একধরণের অচলাবস্থা চলছে এটা সত্য । সম্ভবত ৭৫ সালেও প্রায় একই অচলাবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছিলো । যেহেতু বাংলাদেশের কোন নিরপেক্ষ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি, আমরা কোন এক বা একাধিক লেখকের বই পড়ে বা কয়েকটা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখে অথবা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নিয়ে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সত্যিকার তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম হবো- এটা ভাবাই বাতুলতা । তাহলে আমরা যারা এই প্রজন্মে বড় হয়েছি, তাদের সামনে একটিমাত্র পথ খোলা থাকে । সেটা হলো নিজেদের স্বশিক্ষিত বিচারবোধ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের প্রিম্যাচিউর বার্থ থেকে শুরু করে ৭৫ সালের দিনগুলো পর্যন্ত বুঝে বুঝে ১৫ আগস্টের মূল্যায়ন করা । আপাতত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সময় নষ্ট না করে প্রথমেই দেখে নেয়া যাক আগস্ট বিপ্লবের চারটি লক্ষ্য মূলত কি ছিলোঃ

১। রুশ-ভারতের নাগপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা ।

২। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ।

৩। ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ নামে বাকশাল ও মুজিব সরকারের প্রতারণামূলক কার্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা ।

৪। কৌশলগত কারণে স্বল্প সময়ের জন্য সংসদকে বলবৎ রেখে সাংবিধানিকভাবে একটি দেশপ্রেমিক (সর্বদলীয়/র্নিদলীয়) অস্থায়ী সরকার গঠন করা ।

চলুন দেখে নিই অস্থায়ী সরকারের কাজগুলো কেমন হবার কথা ছিলোঃ

১। বাকশাল প্রণোদিত শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশোধনী, সংবাদপত্র ও প্রকাশনা আইন, রক্ষীবাহিনী আইন, আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আইনের পরিপন্থী শ্রমিক আইন ও অন্যান্য কালা-কানুন বাতিল করা ।

২। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে দেশে অবিলম্বে প্রকাশ্য রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ।

৩। সকল রাজবন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া ।

৪। সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা ।

৫। জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকি মোকাবেলা করার জন্য ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলা ।

৬। সমাজতন্ত্রের নামে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ, স্বেচ্ছাচারী একনায়কত্ব ও সরকারি সহযোগিতায় জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন, কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, চোরাচালান ও অবাধ দুর্নীতির ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে যে অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটিয়ে বিপর্যস্ত দেউলিয়া অর্থনীতির পূর্ণবিন্যাসের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ।

৭। জাতীয় জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বিচার বিভাগের পুর্ণ স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশে আইনের শাসন প্রবর্তন করা ।

৮। প্রশাসন কাঠামোকে দুর্নীতিমুক্ত করা ।

৯। রাষ্ট্রীয় নীতিসমূহে বাংলাদেশী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জীবনাদর্শের প্রতিফলন নিশ্চিত করার সাথে সাথে সংখ্যালঘু নাগরিকদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা ।

১০। ভারতের সাথে পঁচিশ বছরের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করা ।

আরেকবার এক থেকে দশ পর্যন্ত পড়ে দেখুন । বর্তমানকালের সাথে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার এই নির্দেশিকায় কি খুব একটা পার্থক্য ধরা পড়ছে ? বর্তমান আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে যেসকল শক্তি আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে, তারা কি ঠিক একই অভিযোগ এবং অভিপ্রায় প্রদর্শন করছে না ? তাহলে দীর্ঘ চল্লিশ বছর পার করে আগষ্ট বিপ্লবের ফায়দা কি দাঁড়ালো ! তখনকার আওয়ামী গডফাদার গাজী গোলাম মোস্তফা যেভাবে লেডিস ক্লাব থেকে মেজর ডালিম এবং তার স্ত্রী নিম্মীকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করতে পারতো, এখনকার জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমানরা কি এমন দুঃসাহস দেখাচ্ছেনা ? ১৯৭৩ সালে যেভাবে শেখ কামাল পুলিশের গুলি খেয়েছিলো ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে, এখনকার ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করার জন্য কি একই গ্রুপ কাজ করছেনা ? তাহলে বিপ্লব কিভাবে বলি ১৫ আগস্ট কে ! এটাই আমার কাছে প্যারাডক্স ।

শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমরা প্রথমেই যে ভুলটা করি তা হলো- এটাকে নিছক একটা রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হিসেবে চিন্তা করি । যা সম্পূর্ণরুপে একটা সিভিলিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি । অথচ সম্পূর্ণ সামরিক সিদ্ধান্তে, সেনাকর্মকর্তাদের দ্বারা এই ফেইট আকমপ্লি সংঘটিত হয়েছে । আমরা আওয়ামী বিরোধী মহল কথায় কথায় শেখ মুজিবকে ফেরাউনের সাথে তুলনা করি- যেনো হত্যাকান্ডের পক্ষে একটা ধর্মীয় আবহ তৈরী হয় । তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যারা মুজিব হত্যার পর রাতারাতি চেহারা পাল্টে জানরক্ষায় নিয়োজিত হয়েছিলো- তাদের কর্মকান্ডকে বার্ডেন অব প্রুফ ধরে আমরা ১৫ আগস্টের আলোচনা করি । একারণে বিষয়টির গভীরে আমরা যেতে পারিনা এবং প্রতিবছর শোক দিবসের একপেশে বিরোধিতা করতে থাকি ।

আরেকটি সমস্যা হলো দেশের অধিকাংশ জনগণ কর্তৃক রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীকে দেবজ্ঞান করে এড়িয়ে চলা । একারণে টকশোতে যেমন বুদ্ধিজীবিরা সেনাসদর/আইএসপিআর নিয়ে কোন সমালোচনা করতে বিব্রতবোধ করেন, আমজনতাও সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডকে স্বর্গীয় নজরে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে । ফলস্বরুপ সেনাবাহিনী একটা পুতুল নাচের মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । তারা রাজনীতির মাঠে নিষ্কৃয়তার প্রমাণ দিতে গিয়ে বিদেশী আগ্রাসনের মুখেও মুখ খুলতে পারেনা । ভারতের সেনাপ্রধান দলবীর সিং যতোটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাকিস্তানী সেনাপ্রধান রাহিল শরীফ কে হুমকি দিতে পারেন, ইরানী কমান্ডো চীফ কাসেম সোলায়মানি যেভাবে প্রকাশ্যে গাজা হত্যাকান্ডের জন্য ইসরাঈলের নিন্দা জানাতে পারেন, বাংলাদেশী সেনাপ্রধান ততোটা  জোর গলায় নিজদেশের পাহাড়ি জঙ্গিগোষ্ঠি জেএসএস বা ইউপিডিএফ কেও ধমক পর্যন্ত দিতে পারেন না । বিজিপি বা বিএসএফের বিরুদ্ধে মুখ খোলা তো অলীক কল্পনা !

অথচ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিলো অনেক বেশি স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ । মানুষের হৃদয়ে সেনাবাহিনীর প্রতি একটা গভীর সহানুভূতি কাজ করতো । তাদের সাহসিকতা এবং প্রতিশোধ পরায়নতার ওপর মানুষ এতোটাই আস্থা রাখতো যে, রক্ষীবাহিনীর সমস্ত অপরাধের খবারখবর সাধারণ মানুষ নিজ থেকেই সেনাবাহিনীকে অবহিত করতো । কোন সেনাকর্মকর্তার সাথে বা সেনা পরিবারের সাথে সংঘটিত অপরাধের জন্য স্বয়ং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে ক্ষমা চাইতে হতো । আর এযুগে পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন বলে কখনো শুনিনি । আমাদের যুগে এমনও ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের কথা শোনা যায় যিনি তার মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন । শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজের লম্পট শিক্ষক যখন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বসে ছাত্রীদের পর্ণো ভিডিও বের করে তখনো পুলিশের আশায় বসে থাকা ছাড়া সেনাবাহিনীর করার কিছু থাকেনা । অপরদিকে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভাড়াটে খুনী হওয়ার বিষয়টি না হয় এড়িয়েই গেলাম । অথচ যে সেনাবাহিনী আগস্ট বিপ্লবের সিদ্ধান্ত নেবার মতো দৃঢ়তা এবং সাহস দেখিয়ে ইতিহাস রচনা করেছে তাদের এমন অসহায়ত্ব শুধুুমাত্র শোক দিবসকে তাচ্ছিল্য করেই বোঝা সম্ভব নয় ।

আমাদের দেশে যখনই সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা সম্পৃক্তি নিয়ে কথা হয়, বড় বড় দলগুলো সবসময় এটিকে টালবাহানা করে এড়িয়ে যায় । ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, রাজনৈতিক নেতারা যতোবার ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন, ততোই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্ররাজনীতি জেঁকে বসেছে । দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য যতোবার ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠান গুলোকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখার বুলি সম্প্রচার হয়েছে, ততোই যেনো ব্যাবসা-বাণিজ্যে রাজনৈতিক মেরুকরন তীব্রতর হয়েছে । তেমনিভাবে সেনাবাহিনীর ব্যাপারে যতোই মধুর বাণী বর্ষন করা হোক না কেনো, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক কাঠামোর উত্থান-পতনে (একাত্তর থেকে এক-এগারো পর্যন্ত) সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা । এমনকি পিলখানা হত্যাকান্ডের পর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাকুঞ্জে গেলেন স্বান্তনা সভায়, তখনো সেনাবাহিনীতে রাজনৈতিক মেরুকরণের ভয়াবহতা উঠে এসেছে । অথচ সম্পূর্ণ বিষয়টিকে স্পর্শকাতরতার চাদর পড়িয়ে বদহজম বাড়ানোর নীতি কোন পক্ষই ছাড়তে পারেনি ।

মোটাদাগে যদি আগষ্ট বিপ্লবের দুটি পক্ষ ধরা হয়, একটি হবে আওয়ামী লীগ- যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দ্বারা সর্বদা নিয়ন্ত্রিত, আরেকটি হবে সেনাবাহিনী- যাদের প্রতি মানুষ বরাবরই বিশ্বাস রাখতে পছন্দ করে । বর্তমানে দুটি পক্ষের কার্যক্রম তুলনা করলেই বিগত চল্লিশ বছরে আগষ্ট বিপ্লবের সাফল্য/ব্যর্থতা বোঝা সহজ হয়ে যায় । এক মুজিবের লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে তৈরি না হলেও প্রতিটি পাড়ায়/মহল্লায় অন্তত একটি করে মুজিবের অনুসারী গডফাদার তৈরি হয়ে গিয়েছে এতোদিনে । মানুষজন বিপদে পড়লে যেমন তাদের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়, ইফতার মাহফিলে যেমন তাদেরকে প্রধান অতিথি রাখতে হয়, মসজিদ কমিটিতে পর্যন্ত তাদের আইনে মানুষ চলে । শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার বলেই দায় এড়াবেন কিভাবে ! দেশের রাষ্ট্রপতি কে বিদায় করেও আগষ্ট বিপ্লবের নায়কেরা দেশের একনায়কতান্ত্রিক অনাচার এবং ভারতমাতার দাসত্ব রুখতে পারেনি । এদিক থেকে দেখলে সহজেই বোঝা যায়- রাষ্ট্রপতি মুজিব শেষপর্যন্ত মরণোত্তর বিজয়ী হয়েছেন । আমরা যতোই ভাঁড়ামো/চটুলতার আশ্রয় নিই, বাস্তবতা এড়াতে পারবোনা । অপরদিকে সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখুন । জেনারেল জিয়ার মতো এমন সেনাপ্রধান আর পায়নি বাংলাদেশ । আ ল ম ফজলুর রহমানের মতো বিডিআর প্রধানও পায়নি । সেনাবাহিনীর মান নিয়েও তৈরি হয়েছে যথেষ্ট প্রশ্ন । রেশমা নাটকের হোতা সারওয়ার্দিরা উঠে যায় আকাশে । আব্দুল্লাহ আযমীদের বরখাস্ত হতে হয় অযথা । গুলজারদের মৃত্যু হয় প্রতিশোধবিহীন । একটা উদাহরণ দেই- দেশের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যদি সার্ভে করা হয়, ক্লোজ আপ ওয়ান তারকা এবং লাক্স সুপার স্টারদের মাস কিভাবে চলে, দেখা যাবে প্রতিদিন ক্যান্টনমেন্টগুলোতে কোন না কোন উপলক্ষে গানের কনসার্ট চলছেই, দেশের প্রায় সবগুলো এলিট ক্লাবে সেনাকর্মকর্তা দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা চালানো হয়, ইসরাঈলী আইডিএফ কেও এতোটা আনন্দঘন পরিবেশে রাখা হয় কিনা জানিনা । শেখ হাসিনার দলীয় অনুষ্ঠানেও অনেক সময় বাহিনী প্রধানদের হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় । কারা আমাদের সেনাবাহিনীর বন্ধু, কারা তাদের শত্রু, এটা নির্ণয় করা যেনো গোলকধাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । অথচ পৃথিবীর অন্য কোন সেনাবাহিনীর সমরনীতি এতোটা অস্পষ্ট এবং ঘোলাটে থাকে বলে মনে হয়না ।  ডিওএইচএস এর মালিকানা নিয়ে দরদাম চলছেই, বৈষয়িক হিসাব নিকাশে ভীষণ অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে ডিফেন্স ফোর্স । তাহলে সেভেনটি ফাইভ এর সেনাবাহিনী আজকের যুগে কিভাবে আশা করেন ! ‘তৃতীয় শক্তি’ নামের কাগুজে বাঘ হিসেবে শুধু পত্রিকার কলাম আর টিভি টকশোতেই সেনাবাহিনীর ক্ষমতার আভাস দেয়া হয় । একজন সামান্য প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত সেনাবাহিনীর কোন চাপ অনুভব করেন বলে মনে হয়না । ‘চির উন্নত মম শির’ চেতনার পরিস্ফুটন ইদানিংকালের সেনাবাহিনী খুব একটা দেখাতে পেরেছে বলেও প্রমাণ নেই । অর্থাৎ আগস্ট বিপ্লবের দ্বিতীয় পক্ষ, অথবা বিজয়ী পক্ষ বলেও যাদেরকে ধরা হয়- তাদের নৈতিক অস্তিত্ব আজ ভীষণ সংকটে ।

আমি বলছিনা যে, সেনাবাহিনীতে ভোটাভুটি চালু করাই এ সংকটের সমাধান । সেনাবাহিনীকে দলীয় ভাগাভাগির ব্যালেন্স অব পাওয়ার বানানোর কথাও বলছিনা আমি । বরং গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনীর সমরনৈতিক অবস্থানটি সুস্পষ্ট এবং প্রকাশিত রাখার পক্ষেই আমি অভিমত দিচ্ছি । আপনারা কি বলতে পারেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিলেবাসে এখন কি কি বিষয় পড়ানো হয় ? যে সেনাবাহিনী আফ্রিকার মাটিতে ভয়ংকর অপরাধীদের সাথেও শান্তিরক্ষীর আচরণ করতে পারে, তারা দেশীয় জনগণকে ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ হিসেবে পরিত্যাজ্য মনে করার সাইকোলজি কেনো ধারণ করে এটা নিয়ে কি কোন গবেষণা হয়েছে ? বিএমএ কমিশন্ড অফিসার হিসেবে আগামী লং কোর্স থেকে দুই বছরের স্থলে চার বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ চালু হচ্ছে এই কথা কি সবাই জানতেন ? এখন থেকে সেকেন্ড ল্যাফটেন্যান্ট নয়, সরাসরি ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম হচ্ছে, এটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে সেটা নিয়ে কি আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করেছে কেউ ? এমনিতেই সেনাবাহিনী অনেকটা যুদ্ধবিমুখ হয়ে পড়েছে, তার উপরে যদি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতোই তাদেরকে বই-পুস্তক গিলিয়ে বিদ্যাবাগীশ করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়, তবে সেটা আমাদের ভূরাজনৈতিক প্রক্ষাপটকে কিভাবে প্রভাবিত করবে তার রিপোর্ট কি দেশের নেতানেত্রীদের কাছে আছে ? গত দশ বছরের মধ্যে লেঃ কর্ণেল বা মেজর পদবি ধারণ করেই বিপুল সংখ্যক প্রতিভাবান সেনাকর্মকর্তা স্বেচ্ছা অবসরে চলে গিয়েছে কেনো, তা নিয়ে কোন গবেষণাপত্র কি জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে ? হাসান সারোয়ার্দিরাই কেনো জেনারেল হয় সেটা বুঝতে হলে কি এ ব্যাপারে আরো তীক্ষ্ন নজর রাখার প্রয়োজন ছিলো না ? আমাদের ছেলেমেয়েরা অষ্টম শ্রেণির বইয়ে “নিজেকে জানো” শিরোনামে মূলত কি শিখছে সেটা জানা এবং লক্ষ্য রাখার অধিকার যেমন জনগণের আছে, তেমনি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ভাইবোনেরা সমরনীতি চর্চায় কোন কোন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধান পাচ্ছে সেটা লক্ষ্য রাখার অধিকার কি জনগণের নেই ? আমার মনে হয় ১৫ আগস্টকে বোঝার জন্য সেনাবাহিনীর তখনকার অবস্থান এবং এখনকার অবস্থানের তুলনাটাই মুখ্য বিষয় । তাহলেই আমরা বুঝতে পারবো- একনায়ক শেখ মুজিব নিহত হওয়াতে যতটুকু বিজয় আমরা অনুভব করেছি, তলে তলে আরো বেশি হেরে গিয়েছি ।

অনেকে ধারণা করতে পারেন- আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারলেই এ সংকটের সমাধান হয়ে যাবে । সততার সাথে একবার ভেবে দেখুনতো- বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল গুলো কি জন্মদিন পালন করা ছাড়া ১৫ আগষ্টের আর কোন মূল্যায়ন করেছে কখনো ? যদি আবারো বিশ দলীয় ঐক্যজোট ক্ষমতায় আসে তবে হয়তো দিবসটিকে তাচ্ছিল্য করার জন্যে হিসাব করে ১৫ আগষ্টের দিন এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করতে পারে যেনো সেদিনের শিরোনামটি উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থীরা দখল করে নেয় । কিন্তু এর বেশি কিছুই তারা করতে পারবেনা । কারণ ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের চাইতে- ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ যে আরো ক্ষতিকর এবং ভয়ংকর এটা সেনাবাহিনী যেমন জানে, বিরোধী দলগুলোও জানে । অতএব আগস্ট বিপ্লব নিয়ে অতো আয়োজন করে বিভ্রান্ত হবার প্রয়োজন নেই ।

তাহলে করণীয় কি হতে পারে ! হ্যাঁ, করণীয় অত্যন্ত স্পষ্ট । প্রথমেই আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে ১৫ আগস্ট ছিলো বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের পক্ষে একটি যথার্থ বিপ্লব । ঝড়ে বক মরবে আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করবো আমরা, এমন মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে । সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের পক্ষে সুবিধা করে দেবে আর আমরা সবটুকু সুখভোগের পর তাদেরকে বিপথগামী নাগরিক খেতাব দিয়ে নিজেদের খোলসে আবার হারিয়ে যাবো, এমন লুকোচুরি বন্ধ করতে হবে । নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢেকে ঢেকে সামরিক অভ্যুত্থানের আশায় ঈদের পর ঈদ গুনতে থাকার প্রবৃত্তিও বাদ দিতে হবে । আগস্ট বিপ্লবের যথাযথ স্বীকার্য প্রদানের পর দেখতে হবে আগস্ট বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলো কি কি ! বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন হুমকি মোকাবেলা করার জন্য ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠন করা এবং জরুরী ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম ছেলে-মেয়েদের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অবকাঠামো গড়ে তোলার যে অঙ্গীকার ছিলো তা পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে । এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দিয়ে ব্যাপক ক্যাম্পেইন চালানো যেতে পারে । রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরে “র‌্যাব বিলুপ্তির আহবান”, “উপজেলা ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি”, “নাগরিক অধিকার আদায় কমিটি”, “সম্প্রচার নীতিমালা স্থগিত করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার কমিটি”, “একতরফা নির্বাচন প্রতিরোধ কমিটি” এসব হাজারটা শিশুসুলভ আন্দোলন-আন্দোলন খেলা বাদ দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠনই সময়ের দাবি । সম্ভবত হুমায়ুন আহমেদের ‘দেয়াল’ এমন একটি নিরাপত্তা সূচক দেয়ালের অভাব অনুভব করেই লেখা । সম্ভবত কারারুদ্ধ মাহমুদুর রহমান এটা চিন্তা করেই ‘আমার দেশ’ অফিসে পাঠচক্রের আয়োজন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন । যদি এতোদিনে একটি সত্যিকার নিরাপত্তা পরিষদ আমাদের থাকতো- হয়তো ফেলানীদেরকে মরতে হতোনা, পিলখানা ট্রাজেডী এড়ানো যেতো, একতরফা নির্বাচন কেন্দ্রিক কোটি কোটি টাকার লুটপাট থেকে জাতি রক্ষা পেতো । রানা প্লাজা ধ্বস, পিনাক লঞ্চডুবি, ডেসটিনির অর্থচুরির বিষয়ে অভিযোগ করার মতো মানুষের আরো একটি আশার জায়গা থাকতো ।

অনেক কথা বলা হলো । তবু কিছুই হবেনা এটা প্রায় নিশ্চিত । তারপরেও দিন বদলায়- মানুষ বদলায় । আশা ধরে রাখতেই হয় । শাপলা চত্বর থেকে শাহবাগ চত্বর পর্যন্ত দেখার অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের তরুণদের হয়েছে । সাগর-রুনি হত্যাকান্ড দেখার অভিজ্ঞতা এ প্রজন্মের সাংবাদিকদের হয়েছে । আমিনুল হত্যা থেকে দেলোয়ার খালাস পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ দেখা হয়েছে এ প্রজন্মের শ্রমিক ভাইবোনদের । আমাদের প্রজন্মের মাঝে এতোদিনে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদঘাটনের একটা দৃঢ় প্রত্যয় এসেছে বলেও মনে হয় । হপ-স্টেপ নেবার পর এখন শুধুই জাম্প দেবার অপেক্ষা । যদি সে দীর্ঘ অপেক্ষার পালা নিকট ভবিষ্যতে সমাপ্ত হয়, তবেই আগষ্ট বিপ্লবের সাফল্য তার চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছাবে বলে বিশ্বাস করি ।