Quasicrystals, মুসলিম স্থাপত্য, এবং একটি নোবেল প্রাইজ

২০০৫ সালে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট পিটার ল্যু (Peter J. Lu) উজবেকিস্তান ভ্রমণে গিয়ে বুখারায় পঞ্চদশ শতকে নির্মিত একটি মাদ্রাসার সুদৃশ্য মোজাইকে Quasicrystal নামক জটিল জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাদৃশ্য দেখতে পান। ১৯৭০ এর দশকে আধুনিক গণিতবিদরা প্রথম এই জটিল প্যাটার্নের ধারণা দেন। পরবর্তীতে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ Paul J. Steinhardt সহ Science জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে Lu দেখান যে পাশ্চাত্যে Quasicrystal এর সঠিক গাণিতিক ধারণা আবিষ্কারের অন্তত ৫০০ বছর আগে দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে মুসলিম স্থাপত্য শিল্পে Quasicrystal প্যাটার্নের প্রায় নিখুঁত ব্যবহার ঘটে।

Quasicrystal হচ্ছে এমন একটি প্যাটার্ন যা একটি স্থানকে ভরাট করে কিন্তু True crystal এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী translational প্রতিসাম্য এতে থাকে না। দ্বিমাত্রিক ধারণায় এর অর্থ হল এই প্যাটার্নটির একটি exact copy slide করা হলে তা কখনোই exact match তৈরি করবে না, তবে প্যাটার্নটি rotate করা হলে তা exact match তৈরি করতে পারে। ১৯৭০ এর দশকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গাণিতিক Sir Roger Penrose তাঁর বিখ্যাত Penrose Tiles এর মাধ্যমে এর প্রথম গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন। এরও প্রায় এক দশক পর ১৯৮৪ সনে ইসরায়েলের Technion University এর প্রফেসর Dan Schechtman একটি সংকর ধাতুর পরমাণুর অবস্থানে quasicrystalline কাঠামো আবিষ্কার করেন, যে কাজটির জন্য (‘For the Discovery of Quasicrystals’) ২০১১ সালে তিনি কেমিস্ট্রিতে নোবেল প্রাইজ পান। এরপর থেকে প্রকৃতিতে বিভিন্ন রকমের অসংখ্য quasicrystals আবিষ্কৃত হয়েছে।

Darb-i Imam Mosque Portal

২০০৭ সালে মার্কিন পদার্থবিদ Paul J. Steinhardt এবং Peter J. Lu তাঁদের গবেষণাপত্রে ১৪৫৩ সালে ইরানের ইস্পাহানে নির্মিত Darb-i Imam স্থাপনাটিতে Penrose টাইলস দ্বারা আচ্ছাদনের একটি ‘প্রায় নিখুঁত’ ব্যবহার তুলে ধরেন। এর আগে প্রচলিত ধারণা ছিল, মধ্যযুগীয় মুসলিম স্থাপত্যবিদরা সরাসরি straightedge রুলার এবং কম্পাসের সাহায্যে একটি zigzag লাইনবিশিষ্ট নেটওয়ার্ক অঙ্কনের মাধ্যমে মুসলিম স্থাপত্যে বহুল ব্যবহৃত জ্যামিতিক তারকা ও বহুভুজ সম্বলিত Girih (Persian: گره‎, ‘knot’) প্যাটার্ন তৈরি করতেন, যে পদ্ধতি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর। এ ধারণার বিপরীতে Lu এবং Steinhardt দেখান যে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে মুসলিম স্থাপত্যশিল্পে একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তিগত পদ্ধতির ব্যুৎপত্তি ঘটে যার দ্বারা কতিপয় সরল-রেখাঙ্কিত সমবাহুবিশিষ্ট বহুভুজ টাইলস বা girih tiles এর tessallation (এক বা একাধিক জ্যামিতিক আকারের টাইলস দ্বারা কোনও ফাঁক ও ওভারল্যাপ ছাড়া একটি সমতলকে আচ্ছাদন করার পদ্ধতি) এর মাধ্যমে জটিল girih প্যাটার্ন তৈরির পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছিল। পাশ্চাত্যে এর গাণিতিক ধারণা আবিষ্কারের অন্তত ৫০০ বছর আগে পঞ্চদশ শতকের ভেতরে tessallation এর সাথে self-similar transformations এর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে প্রায় নিখুঁত quasi-crystalline Penrose প্যাটার্ন তৈরির পন্থা উদ্ভাবিত হয়। Darb-i-Imam Shrine এ ব্যবহৃত ৩৭০০ টাইলের মধ্যে শুধুমাত্র ১১টি টাইলে্র অভিযোজনে Lu এবং Steinhardt সূক্ষ্ম ত্রুটি দেখতে পান, কেবল ওরিয়েন্টেশনের সামান্য পরিবর্তনেই যা নিখুঁত quasi-crystalline Penrose প্যাটার্ন তৈরি করে, যা কাকতালীয় হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নির্মানকালীন সময়ে অথবা পরবর্তীকালে মেরামতের সময় এই সামান্য সংখ্যক ভুল সংযোজিত হয় বলে Lu ধারণা করেন।

Gunbad-i Kabud

২০০৯ সালে physics world এ প্রকাশিত খবরে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের Texas Tech University এর স্থাপত্য বিশারদ Rima Ajlouni মুসলিম স্থাপত্যে quasicrystal প্যাটার্নের অন্ততঃ তিনটি নিখুঁত এবং নির্ভুল ব্যবহার খুঁজে পেয়েছেন। প্রথমটি সেলজুক স্থাপত্যে বহুল ব্যবহৃত একটি প্যাটার্ন, ইস্পাহানের Darb-i-Imam shrine এ যার সুনির্দিষ্ট ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় প্যাটার্নটি মরক্কোর ফেজ(Fez) নগরীতে ১৩২৩ সালে নির্মিত Madrasa al-‘Attarin এর ভেতরে দেয়ালে, এবং তৃতীয় নিখুঁত প্যাটার্নটি ১১৯৭ সালে ইরানের Maragha তে নির্মিত Gunbad-I Kabud টাওয়ারের বাইরের দেয়ালে খুঁজে পাওয়া যায়।


হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট মিউজিয়ামের ডিরেক্টর Tom Lentz এর ভাষ্যে,”কলা বিশারদরা বহু আগে থেকেই মুসলিম স্থাপত্যে জ্যামিতিক প্যাটার্নের পেছনে গণিতের জটিল ব্যবহার রয়েছে বলে ধারণা পোষণ করেছেন, কিন্তু এর চুলচেরা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এর আগে কখনও হয়নি।” সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। মুসলিম স্থাপত্যে জটিল জ্যামিতিক নকশা ও প্যাটার্নের কম্পিউটার মডেলিং এর উপরেও কাজ করছেন অনেকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে দেখুন –

1. Ancient Islamic architects created perfect quasicrystals – physicsworld.com
2. The Tiles of Infinity
3. Lu, Peter J.; Steinhardt, Paul J. (2007). Decagonal and Quasi-crystalline Tilings in Medieval Islamic Architecture. Science 315 (5815)
4. Quasicrystals in Medieval Islamic Architecture, Harvard Physics Colloquium Lecture

http://spacetimefactorbangla.wordpress.com/

জর্জ সেল – এর কোরান

Thomas Jefferson

২০০৭ এর জানুয়ারিতে আমেরিকান কংগ্রেসের প্রথম নির্বাচিত মুসলিম সদস্য কীথ এলিসন (Rep. Keith Ellison, D-Minn) লাইব্রেরী অফ কংগ্রেস থেকে সংগৃহীত কুর’আনের যে কপিটির উপর হাত রেখে কংগ্রেসে শপথ নেন, তার মূল স্বত্বাধিকারী ছিলেন আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, টমাস জেফারসন (Thomas Jefferson). জেফারসন বিবিধ কারণে ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন যা ডেনিস স্পেলবার্গ (Denise A. Spellberg) তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘Thomas Jefferson’s Qur’an’ এ তুলে ধরেছেন। ১৭৬৫ সালে আইনের ছাত্র থাকা অবস্থায় তরুণ জেফারসন যে কুর’আনটি কেনেন, তা ছিল সরাসরি আরবি থেকে ইংরেজি ভাষায় কুর’আনের প্রথম অনুবাদ। জর্জ সেল নামক একজন তরুণ ইংরেজ ল’ইয়ারের করা এ অনুবাদটি ছিল প্রায় দুইশ বছর পর্যন্ত পাশ্চাত্যে কুর’আন বিষয়ক গবেষণা ও ধারণার অন্যতম প্রধান উৎস।

প্রেক্ষাপট: ইউরোপীয়দের ইসলাম বিষয়ক আগ্রহ

মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয় (এ বিষয়ে আমার আগের লেখাতে কিছুটা আলোচনা করেছি)। ইউরোপে যখন ‘অন্ধকার যুগ’ চলছিল, তখন এশিয়া, ইউরোপ, নর্থ আফ্রিকার বড় অংশ জুড়ে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়। আনাতোলিয়া, আরব ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অটোমান সাম্রাজ্য, পারস্যে সাফাভিদ সাম্রাজ্য, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের মতো সভ্যতাগুলো কেবল প্রবল পরাক্রমশালী হিসেবেই নয়, বরং তাঁদের সঙ্গীত, কবিতা, বাগান, মৃৎশিল্প, বস্ত্রশিল্প-সহ পরিশীলিত শিল্প-সংস্কৃতির কারণেও বিশ্বজুড়ে সুবিদিত ছিল। একই সাথে বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার সেই সময় আরবি ভাষায় সংরক্ষিত ছিল। শুধু বিজ্ঞান বা দর্শন বা বাণিজ্যই নয়, আরবি সাহিত্যও ইউরোপীয় অনুবাদকদের উৎসাহিত করেছে। ১৭০৪ সালে একজন ফরাসী আরবি থেকে ‘সহস্র রজনীর গল্প’ প্রথম অনুবাদ করেন যা সেই থেকে আজ পর্যন্ত ইউরোপীয়দের কাছে রোমাঞ্চকর ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত।

তবে সব কিছুর উপরে ইসলাম ধর্ম বিষয়ক অনুসন্ধান ও গবেষণা বিবিধ কারণে অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের আগ্রহের কারণ হয়ে ওঠে। সপ্তম শতাব্দীতে আরব উপদ্বীপ থেকে আসা স্বল্প-সংখ্যক মুসলিম কি করে এত দ্রুত সময়ের মধ্যে জানা বিশ্বের এত বড় অংশ জয় করে নিয়েছিল, ইউরোপীয়দের জন্য তা একই সাথে ছিল গভীর বিস্ময়, অনেকটা অস্বস্তিরও কারণ। ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ার (Voltaire) এবং ইংরেজ ইতিহাসবেত্তা এডওয়ার্ড গিবন (Edward Gibbon) একে বিশ্ব-ইতিহাসের অন্যতম বড় প্রশ্ন হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এছাড়াও, অনেক ইউরোপীয় দার্শনিক এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী খ্রিস্টান ইসলামে স্রষ্টার একত্ববাদ সম্পর্কিত মূলনীতি বা মতবাদকে খ্রিস্টধর্মের জটিল ত্রিত্ববাদ (Trinity) অপেক্ষা যুক্তিপূর্ণ মনে করেছেন। এসব বিবিধ কারণে ইউরোপে ইসলাম এবং তার মূল আরবি ভাষার উপরে আগ্রহ তৈরি হয়।

ইংরেজি অনুবাদ

ইউরোপে কুর’আনের প্রথম অনুবাদটি হয় লাতিন ভাষায়। ১১৪৩ সনে ইংরেজ রবার্ট অফ কেটন (Latin: Robertus Ketenensis) কর্তৃক ধর্মীয় মোহান্ত (abbot) পিটার দ্য ভেনারেবল (Peter the Venerable) এর নির্দেশে করা Lex Mahumet pseudoprophete (‘The law of Mahomet the false prophet’) শীর্ষক অনুবাদটি ছিল অতিরঞ্জিত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে অপ্রীতিকর অর্থ বা মন্তব্য সম্বলিত, যার মূল উদ্দেশ্য এর শিরোনামেই প্রতিফলিত। খ্রিস্টান চার্চে বহুল প্রচলিত লাতিন ভাষার এ অনুবাদটি দুঃখজনকভাবে পরবর্তী কয়েকশ বছর ধরে পাশ্চাত্যে কুর’আনের অর্থ এবং সে হিসেবে ইসলামের মর্মার্থ অনুধাবনের একমাত্র উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মূল আরবিতে না গিয়ে বরং লাতিন ভাষার এই কাজটিকে এর ভুল বা বিকৃতিসহ পরবর্তীতে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়। ১৬৪৯ সালে রাজা প্রথম চার্লস এর চ্যাপলেইন Alexander Ross ফরাসী Sieur du Ryer এর অনুবাদ L’Alcoran de Mahomet কে প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘The Alcoran, Translated out of Arabic into French. By the Sieur du Ryer, Lord of Malezair, and Resident for the French King, at ALEXANDRIA. And Newly Englished, for the satisfaction of all that desire to look into the Turkish Vanities’। শিরোনামের শেষাংশটি লক্ষণীয়।

প্রায় একশ বছর পর ১৭৩৪ সালে জর্জ সেল (George Sale 1697-1736) নামক জনৈক ইংরেজ আইনজীবী ও ওরিয়েন্টালিস্ট মূল আরবি থেকে সরাসরি ইংরেজি ভাষায় কুর’আন অনুবাদ করেন। কাজটির শিরোনাম ছিল ‘Koran, commonly called the Alcoran of Mohammed, tr. into English immediately from the original Arabic; with explanatory notes, taken from the most approved commentators. To which is prefixed a preliminary discourse’. বলা হয়, সেল তাঁর অবসর সময়ে আরবি ভাষা অধ্যয়ন করেন এবং কোনও মুসলিম দেশে তিনি ভ্রমণ করেননি, যদিও অনেকে বলে থাকেন তিনি ২৫ বছর আরবে ছিলেন। সেল নিজেই তা অস্বীকার করে লিখেছেন, “I am but too sensible of the disadvantages, one who is neither a native, nor ever was in the country must lie under, in playing the critic in so difficult a language as the Arabick.” Society for the Promotion of Christian Knowledge in London এর পৃষ্ঠপোষকতায় সিরিয়ান খ্রিস্টানদের জন্য নিউ টেস্টামেন্ট-এর একটি আরবি অনুবাদ তৈরির উদ্দেশ্যে জর্জ সেল আরবি ভাষা শিখেছিলেন বলে ধারণা।

কুর’আন অনুবাদের কারণ হিসেবে জর্জ সেল লেখেন,

“If the religious and civil Institutions of foreign nations are worth our knowledge, those of Mohammed, the lawgiver of Arabians, and founder of an empire which in less than a century spread itself over a greater part of the world than the Romans were ever masters of, must need to be so.”

An Ottoman Qur’an manuscript

অনুবাদ কাজে সেল ১৬৯৮ সালে কাউন্টার-রিফর্মেশন রোমে প্রকাশিত Louis Maracci এর করা লাতিন অনুবাদের সাহায্য নেন। এছাড়াও লন্ডনের ডাচ চার্চে সংরক্ষিত কুর’আনের একটি হস্তলিখিত কপিও তিনি সংগ্রহ করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তাম্বুলে তৈরি এই manuscript টি ১৬৩৩ সালে একজন ডাচ বণিক লন্ডন চার্চকে দান করেন। চার্চের লাইব্রেরিতে পড়ে থাকা কুর’আনের এই হস্তলিখিত কপিটি প্রায় একশ বছর পর সেল তাঁর অনুবাদ কাজে ব্যবহার করেন। কুর’আনের হস্তলিখিত কপিটি ঠিক কি কারণে সংগ্রহ করা হয়েছিল বা লন্ডনে আনা হয়েছিল, তা জানা যায় না। তবে, ইসলামের ধর্মগ্রন্থকে সে সময়ে আরবি ভাষার একটি কালেক্টেবল হিসেবে ধরা হতো এবং পড়তে না পারলেও অনেকে তা কেবল মূল্যবান বস্তু হিসেবে সংগ্রহ করতেন। সেল সরাসরি না বললেও ধারণা করা হয় যে তিনি কুর’আনের এই বিশেষ কপিটিকেই তাঁর অনুবাদ কাজে ব্যবহার করেছিলেন। কারণ ইস্তাম্বুলের কুর’আনটিতে কিছু শব্দের যে বিশেষ রূপ এবং মেইনস্ট্রীম অটোমান সাম্রাজ্যে সুপ্রচলিত কমেন্টারি দেখা যায়, সেল এর অনুবাদ এবং নোট এ তার রেশ পাওয়া যায়।

জর্জ সেল এর পূর্বে ১৬৪৯ সালে ফরাসী থেকে ইংরেজিতে যে অনুবাদটি করা হয়, তাতে মূল অনুবাদের ভুলের বাইরেও নতুন কিছু ভুল যোগ হয় বলে সেল মন্তব্য করেন। সে তুলনায় সেল এর অনুবাদটি ছিল লক্ষণীয়ভাবে পাঠযোগ্য, পরিশীলিত, এবং তুলনামূলকভাবে শুদ্ধ। কুর’আনের ভাষার সৌন্দর্য এবং তাঁর অনুবাদের সীমাবদ্ধতা বিনম্রভাবে স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, ‘it must not be supposed the translation comes up to the dignity of the original’. এর পরেও তাঁর অনুবাদ কুর’আনের যে কোনও আধুনিক অনুবাদের সাথে তুলনীয়, যেমন আয়াতুল কুরসীর প্রথমাংশের অনুবাদ –

“GOD! there is no GOD but he; the living, the self-subsisting: neither slumber nor sleep seizeth him; to him belongeth whatsoever is in heaven, and on earth.”

একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ঐশ্বর্য

George Sale

জর্জ সেল এর অনুবাদটি কেবল একটি উচ্চমানের সাহিত্য কর্মই নয়, একইসাথে তা পাশ্চাত্যে ইসলাম বিষয়ক জ্ঞানের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একটি সুদীর্ঘ ভূমিকায় তিনি ইসলামের ইতিহাস, তাত্ত্বিক, ও ধর্মীয় বহু বিষয়ের ধারণা উল্লেখ করেন। তাঁর অনুবাদ কাজটির আগে যেকোনো ইংরেজি ভাষীর কাছে ইসলাম সম্পর্কিত তথ্যের একমাত্র উৎস ছিল লাতিন ভাষায়। সেল এর অনুবাদ ইসলাম বা কুর’আন সম্পর্কে পূর্বাপর কুসংস্কার বা উদ্দেশ্যপূর্ণ মিথ্যাচারের লাগাম টেনে ধরে। যেমন, মুহাম্মদ(সা:) এর জীবনী বর্ণনায় তিনি মধ্যযুগ থেকে চলে আসা কাল্পনিক ও বিতর্কিত গালগল্পের আশ্রয় নেন নি। বরং তিনি লেখেন,

“Mohammed was richly furnished with personal endowments, beautiful in person, of a subtle wit, agreeable behaviour, shewing liberality to the poor, courtesy to everone, fortitude against his enemies, and, above all a high reverence for the name of God.”

জর্জ সেল এমন একটি সময়ে অনুবাদ কাজটি করেন যখন ইউরোপে নতুন করে আরবি শেখা এবং ইসলামকে জানার একটি চল শুরু হয়েছিল। সে হিসেবে তিনি তাঁর পূর্বসূরিদের কাজ থেকে উপকৃত হয়েছেন। আবার, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যোগ করেছেন। তুলনামূলকভাবে সঠিক ধ্যান-ধারণা এবং একটি বিজাতীয় ধর্মকে জানার ও বোঝার আন্তরিক অভিপ্রায়ের সমন্বয়ে জর্জ সেল এর ‘Koran’ একটি সুদূরপ্রসারী এবং অসাধারণ কাজ যা বিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত কুর’আনের স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজি অনুবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়। কেবল সেল এর সমসাময়িকরাই নয়, বরং পরবর্তী প্রায় দুইশ বছর ধরে ব্রিটেন ও আমেরিকায় প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে কুর’আন ও ইসলাম বিষয়ক ধ্যান-ধারণার উৎস হিসেবে তা পরিগণিত হয়। বিশদ নোট সম্বলিত হবার কারণে আজও ইতিহাসবেত্তারা জর্জ সেল এর ‘কোরান’ ব্যবহার করেন। ঐতিহাসিক Michael Cook এর ভাষ্যে, “an old translation which has worn very well.”

অধুনা কুর’আনের বহু অনুবাদ হয়েছে। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজিতে কেবল একটি, উনবিংশ শতকে দুইটি, বিংশ শতাব্দীতে এসে অন্তত ১৬টি অনুবাদ পাওয়া যায়। এর পরেও একজন গড়পড়তা পাশ্চাত্যবাসী ইসলাম সম্পর্কে খুব কমই ধারণা রাখেন, যদিও অভিবাসন, বাণিজ্য, বা পর্যটনের কারণে এখন অহরহই মুসলিম-অমুসলিমের দেখাসাক্ষাৎ হয়। এয়ার ট্র্যাভেল, স্যাটেলাইট টিভি, বা ইন্টারনেটের এই যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠীর মানুষদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও সহানুভূতি গড়ে ওঠেনি।

হয়তো জর্জ সেল এবং অসংখ্য প্রতিকূলতার মাঝে করা তাঁর অনুবাদ কাজটি সবার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। অসংখ্য ভুল ধারণা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য কয়েকশ বছর ধরে ইসলাম ও তার সংস্কৃতিকে বোঝার চেষ্টা করছে। ইসলামের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটির অনুবাদ কাজ সামগ্রিকভাবে ইসলামের ধর্মীয়, সাহিত্যিক, এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের স্বাদ আস্বাদন করার প্রচেষ্টারই অংশ।

[এই লেখাটি মূলত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত Alexander Bevilacqua এর সম্প্রতি প্রকাশিত একটি নিবন্ধের ভাবানুবাদ এবং সম্প্রসারণ। বোঝার সুবিধার্থে বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য এবং মন্তব্য এতে যোগ করা হয়েছে। মূল লেখাটির লিঙ্ক এখানে।]

http://shankhachilerdana.wordpress.com/

ফাইনম্যানের চিঠি

ব্রিলিয়ান্ট ও ফ্ল্যাম্বয়্যান্ট ফিজিসিস্ট এবং নোবেল লরিয়েট রিচার্ড ফাইনম্যানের (Richard Feynman) সাথে ফেলো ফিজিসিস্ট ও নোবেল লরিয়েট মারী গেল-ম্যানের (Murray Gell-Mann) খোঁটাখুঁটি লেগেই থাকতো। দুজনেই সুপার স্মার্ট, একই সাথে সুপার ইগোটিস্ট। ফাইনম্যানের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটে লেখা ছিল ‘কোয়ান্টাম'(লাইসেন্স প্লেটে সর্বোচ্চ ছয়টি অক্ষর আঁটতো, অগত্যা QANTUM), তো গেল-ম্যানের লাইসেন্স প্লেটে ‘কোয়ার্কস'(QUARKS)। দু’জন যুগ্মভাবে Weak Decay এর একটি মডেল আবিষ্কার করেন, অথচ তাঁদের মুখোমুখি আলাপে প্রথম কথার পর দ্বিতীয় কথাই হতো ‘এটা আমাকে শেখাতে এসো না, এ আমার ভাল করেই জানা আছে!’ বড় বিব্রতকর পরিস্থিতি! ফাইনম্যান সম্পর্কে গেল-ম্যান মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি অনেক সময় ও এনার্জি ব্যয় করতেন তাঁর মজার মজার কাণ্ড নিয়ে গল্প ছড়াতে। কথা মিথ্যে নয়। সম্প্রতি ফিজিক্স ওয়ার্ল্ডে সায়েন্টিস্টদের ভোটে শ্রেষ্ঠ (পপুলার) পদার্থবিদদের মধ্যে সপ্তম (গ্যালিলীওর ঠিক পরই) নির্বাচিত জিনিয়াস সায়েন্টিস্ট ফাইনম্যান একইসাথে ছিলেন শিশুসুলভ, আমুদে, হৈচৈপ্রিয়। সে তুলনায় গেল-ম্যান গম্ভীর, নির্জন, চিন্তাশীল। তাঁকে নিয়ে আরেকদিন বলা যাবে।

ফাইনম্যানের Dodge Tradesman Maxivan গাড়িটির গায়ে আঁকা ছিল বিখ্যাত ফাইনম্যান ডায়াগ্রামস। একবার রাস্তায় অপরিচিত একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল গাড়িতে ফাইনম্যান ডায়াগ্রামস আঁকা কেন? জবাবে তিনি খুব মজা করে বলেছিলেন,’কারণ,আমিই রিচার্ড ফাইনম্যান!’ ফাইনম্যানের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ১ ডলারে গাড়িটি বন্ধু ও জীবনীকার রালফ লেইটন (Ralph Leighton) কে দিয়ে দেন। ফাইনম্যানের ভাষ্যে লেইটন বেশ কয়েকটি বই লেখেন যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘Surely You’re Joking, Mr. Feynman!’ যাতে ফাইনম্যানের চরিত্রের quirky দিকটি অসংখ্য ঘটনার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। ফাইনম্যান সম্পর্কে লেইটন মন্তব্য করেছিলেন,

“That one person could have so many wonderfully crazy things happen to him in one life is sometimes hard to believe. That one person could invent so much innocent mischief in one life is surely an inspiration.”

Richard and Arline Feynman

১৯৪৫ এ ২৭ বছর বয়সী ফাইনম্যান যখন লস অ্যালামস (Los Alamos) ল্যাবে Manhattan Project এ অ্যাটম বোমা তৈরির উপর কাজ করছিলেন, তখন তাঁর ২৫ বছর বয়স্ক প্রথম স্ত্রী আরলিন যক্ষ্মা এবং Hodgkin’s lymphoma তে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর বিছানার পাশেই ছিল একটি পুরনো ঘড়ি। আরলিন ফাইনম্যানকে বলেছিলেন ঘড়িটি তাঁদের একসাথে কাটানো আনন্দময় অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকবে। আরলিন যেদিন মারা যান, নার্স একটুকরো কাগজে মৃত্যুর ক্ষণটি লিখে ফাইনম্যানকে দেন। কাকতালীয় ব্যাপার হোল, ঘড়িটাও ঠিক ঐ একই সময়ে স্থির হয়ে ছিল, যেন আরলিনের প্রাণ যাওয়ার মুহূর্তে অলৌকিকভাবে ঘড়িটিও বন্ধ হয়ে যায়! ফাইনম্যানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি এর মাঝে কোন আলৌকিক যোগসূত্র খুঁজে পেয়ে ছিলেন কিনা। ফাইনম্যান বলেছিলেন, এক মুহূর্তের জন্যেও না। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন তাৎক্ষণিকভাবে লেগে পড়ে এর ব্যাখ্যা কি হতে পারে, তা উদ্ধারে। ভেবেচিন্তে যে ব্যাখ্যায় তিনি স্থির হন তা হোল, পুরনো ঘড়িটি এর কিছু আগেই সম্ভবত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নার্স মৃত্যুর ক্ষণ রেকর্ড করার সময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যে সময়টি দেখেছে, সেটাই লিপিবদ্ধ করেছে। দুয়ে দুয়ে চার!

ঘটনাটা পড়ে খুব বেরসিক, কাঠখোট্টা টাইপ কিছু মনে হলেও এর সাথে হৃদয়ের যোগ নেই কোনও। এককালের হাইস্কুল সুইটহার্ট আরলিনকে হারিয়ে ফাইনম্যান ভেঙ্গে পড়েছিলেন। আরলিনের মৃত্যুর প্রায় দেড় বছর পর ১৯৪৬ এর অক্টোবরে ফাইনম্যান তাঁর উদ্দেশ্যে আবেগপূর্ণ শেষ চিঠিটি লেখেন যাতে তাঁর একাকীত্ব এবং আরলিনের প্রতি ভালবাসা ফুটে ওঠে। তাঁর অনুভূতিগুলোকে কেবল এই এক ছত্রেই প্রকাশ করা চলে, “You, dead, are so much better than anyone else alive.” খামে বন্ধ এ চিঠিটি ১৯৮৮তে ফাইনম্যানের মৃত্যুর পরই প্রথম খোলা হয়।

October 17, 1946

D’Arline,

I adore you, sweetheart.

I know how much you like to hear that — but I don’t only write it because you like it — I write it because it makes me warm all over inside to write it to you.

It is such a terribly long time since I last wrote to you — almost two years but I know you’ll excuse me because you understand how I am, stubborn and realistic; and I thought there was no sense to writing.

But now I know my darling wife that it is right to do what I have delayed in doing, and that I have done so much in the past. I want to tell you I love you. I want to love you. I always will love you.

I find it hard to understand in my mind what it means to love you after you are dead — but I still want to comfort and take care of you — and I want you to love me and care for me. I want to have problems to discuss with you — I want to do little projects with you. I never thought until just now that we can do that. What should we do. We started to learn to make clothes together — or learn Chinese — or getting a movie projector. Can’t I do something now? No. I am alone without you and you were the “idea-woman” and general instigator of all our wild adventures.

When you were sick you worried because you could not give me something that you wanted to and thought I needed. You needn’t have worried. Just as I told you then there was no real need because I loved you in so many ways so much. And now it is clearly even more true — you can give me nothing now yet I love you so that you stand in my way of loving anyone else — but I want you to stand there. You, dead, are so much better than anyone else alive.

I know you will assure me that I am foolish and that you want me to have full happiness and don’t want to be in my way. I’ll bet you are surprised that I don’t even have a girlfriend (except you, sweetheart) after two years. But you can’t help it, darling, nor can I — I don’t understand it, for I have met many girls and very nice ones and I don’t want to remain alone — but in two or three meetings they all seem ashes. You only are left to me. You are real.

My darling wife, I do adore you.

I love my wife. My wife is dead.

Rich.

PS Please excuse my not mailing this — but I don’t know your new address.

আরলিন সর্বতোভাবেই তাঁর অনুপ্রেরণা ও সঙ্গী ছিলেন, যিনি তাঁকে খুব ভালো বুঝতেন। ফাইনম্যানের দ্বিতীয় বিয়ে খুব অল্প দিন টেকে। ডিভোর্সের আবেদনে তাঁর স্ত্রীর অভিযোগ ছিল যে ফাইনম্যান ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ক্যালকুলাস ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না। তৃতীয় এবং সর্বশেষ স্ত্রী গুয়েনেথ তাঁর প্রবল জীবনবোধ এবং অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তাকে ভালবাসতেন। ৬৯ বছর বয়সে ক্যান্সারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর সাথেই ফাইনম্যান তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। স্বভাবসুলভ লঘুতায় তাঁর শেষ ধারণকৃত উক্তিটি ছিল “I’d hate to die twice. It’s so boring.”

সভ্যতার শিখরে মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক মন ও মানসিকতা

আমরা অনেক সময়ই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তার বিকাশে মুসলিমদের অবদানের কথা শুনি। কিন্তু সচরাচর যেভাবে এ তথ্যগুলো দেয়া হয়, তাতে অনেকের কাছে মনে হতে পারে যে সব সভ্যতা বুঝি একই ভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষে অবদান রেখেছে এবং মুসলিমদের অবদান সে অর্থে তেমন কোনও ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃত সত্য তা নয়, ধর্মভিত্তিক সভ্যতার ক্ষেত্রে তো নয়ই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ধর্মীয় চিন্তাধারা দিয়ে অনুপ্রাণিত তো নয়ই, বরং বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। মুসলিম সভ্যতার ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এর বিপরীতটি লক্ষ্য করা যায়, যা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত এবং পৃষ্ঠপোষণ করেছে।

অনেকেই হয়তো জানেন না যে রোমান সম্রাট কন্সতান্তিন চতুর্থ শতকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর থেকে পৌত্তলিক গ্রীকদের উপাসনালয় এবং জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রগুলিকে খ্রিস্টধর্মের মূল বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক ধরে নিয়ে একে একে বন্ধ করে দেয়া হয়। এর জের ধরে ষষ্ঠ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান (Justinian I in 529 CE) বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রসহ জ্ঞানের সাধনায় নিয়োজিত গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর প্রতিষ্ঠিত আকাদেমি চিরতরে বন্ধ করে দেয়। এই জাতীয় মন-মানসিকতার ফলস্বরূপ খ্রিষ্টান ইউরোপে মুক্তচিন্তার সাধনা একরকম বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় এক হাজার বছর ধরে প্রাচীন গ্রীক জ্ঞান-ভান্ডার গ্রীকভাষী খ্রিস্টান বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা এ জ্ঞানের ব্যাপক চর্চা, প্রসার, এবং উৎকর্ষ সাধনে ব্যর্থ হয়। রেনেসাঁর উৎপত্তির আগ পর্যন্ত এইসময়টি ইউরোপীয় সভ্যতার জন্য একারণে অন্ধকার যুগ হিসেবে পরিচিত।

ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি সচরাচর আলোচিত হয় না, তা হোল সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই একে একে মিশর, মেসোপটেমিয়া, পারস্য, ভারতসহ অতীত সভ্যতার জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র গুলো মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীক বিজ্ঞানের স্থপতি হিসেবে পরিচিত ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, টলেমী, গ্যালেনসহ অনেক মনীষী একসময় মিশরে অবস্থিত গ্রীক আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে জ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের কাজগুলো ঐ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয় যার বেঁচে যাওয়া (রোমান সিজারের অগ্নিকান্ড হতে) অংশগুলো পরবর্তীতে মুসলিমদের আয়ত্তে আসে। মুসলিমদের কাছে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে আপাত: দ্বন্দ্ব ছিল না বিধায় তারা হারিয়ে যাওয়া গ্রীক, পারস্য, ভারতীয় সভ্যতার জ্ঞান-ভাণ্ডারকে ধারণ করে। এমনও সময় ছিল যখন বাগদাদের খলিফা অতীতের মূল্যবান পুস্তক অনুবাদের পুরষ্কারস্বরূপ বইয়ের ওজনের সমতুল্য স্বর্ণ অনুবাদককে প্রদান করতেন। বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমাহ'(House of Wisdom) তে শুরু হওয়া আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের ‘Translation Movement’ এর সময় অসংখ্য গ্রীক ক্লাসিক আরবীতে অনুদিত হয়। ইউরোপে প্রচলিত রোমান নিউমেরাল সিস্টেমে গণিতের ব্যাপক উৎকর্ষ সম্ভব ছিল না। আরব গণিতবিদেরা প্রাচীন ভারতীয় নিউমেরাল সিস্টেমের জ্ঞান ধারণ করে এর পরিবর্ধন, উৎকর্ষ, ও ব্যাপক প্রচলন করেন। আল-খোয়ারিজমি (al-Khwārizmī) সহ মুসলিম গাণিতিকরা গ্রীক জ্যামিতির গণ্ডির বাইরে এসে অ্যালজেব্রার উদ্ভাবনসহ আধুনিক গণিতের চরম প্রসার নিশ্চিত করেন। পাশ্চাত্যের সুপরিচিত ইটালীয় গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি (Fibonacci) মুসলিম নর্থ আফ্রিকাতে বসে হিন্দু-অ্যারাবিক নিউমেরাল সিস্টেম অধ্যয়ন করেন।

An imaginary rendition of Al Biruni on a 1973 Soviet post stamp

জ্ঞানসাধনায় মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গি কতখানি উদার এবং প্রগতিশীল ছিল, তা বোঝাতে শুধু একটি উদাহরণই যথেষ্ট। অনেকেই জানেন না যে প্রখ্যাত মুসলিম মনীষী আল-বিরুনী তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যয় করেন। ১০১৭ সনে ভারতে গমনের পর একাদশ শতাব্দীর ভারতের ইতিহাস, জিওগ্রাফি, ভূতত্ত্ব, বিজ্ঞান, গণিত, জাতিভিত্তিক প্রথা ও ধর্মবিশ্বাসের উপর ‘তারিখ আল-হিন্দ’ (History of India a.k.a The Indica) নামে একটি বিশদ, নিরপেক্ষ গবেষণাধর্মী এনসাইক্লোপিডিয়া লিখেন যার জন্য তাঁকে ‘Founder of Indology’ এবং ‘First Anthropologist’ বলা হয় – কাজটির জন্য তাঁকে al-Ustadh (The Master) উপাধিতেও ভূষিত করা হয়। অন্যদিকে গ্রীক পণ্ডিত ইরাতোস্থেনিসের (Eratosthenes) প্রবর্তিত ব্যবস্থার বাইরে এসে (যে ব্যবস্থায় তাঁকে ৫০০ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত দু’টি স্থানে পরিমাপ নিতে হয়) পাঞ্জাবের Pind Dadan Khan এলাকাস্থিত নান্দনা (Nandna) দুর্গে বসে পাহাড়ের উচ্চতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গোলাকার পৃথিবীর ব্যাসার্ধ পরিমাপের নতুন পন্থা তিনি উদ্ভাবন করেন যার দ্বারা নির্ণীত ব্যাসার্ধ প্রায় নির্ভুল (আধুনিক স্যাটেলাইটের সাহায্যে নির্ণীত ব্যাসার্ধের সাথে কেবল ১০০ মাইলের মতো তফাত) পরিগণিত হয়। এ কারণে তাঁকে ‘Father of Geodesy’ বলা হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমূহ অবদান রাখা এই মনীষী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম।

মূলত উৎস যাই হোক, জ্ঞানসাধনার প্রতি সামগ্রিকভাবে মুসলিম মনীষীদের এমন নিরপেক্ষ, বুদ্ধিবৃত্তিক, এবং আগ্রহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অচিরেই মানবলব্ধ জ্ঞানভাণ্ডার এশিয়া, ইউরোপ, নর্থ আফ্রিকাতে বিস্তৃত সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ যখন ঘোর অন্ধকার যুগে আচ্ছন্ন, তখন মুসলিম সভ্যতা জ্ঞানের মশালকে শুধু প্রজ্বলিতই রাখেনি, মুসলিম মনীষীরা এর প্রভূত বিকাশ ঘটান এবং জ্ঞানের মশাল বয়ে নিয়ে যান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, এর হাত ধরেই একসময় ইউরোপে অ্যাকাডেমিক রেনেসাঁর উৎপত্তি হয়।

Interior of al-Karaouine Mosque and university; note the similarity of the architecture to the Alhambra (الحمراء)

পাশ্চাত্য সভ্যতায় মুসলিমদের অবদান ঠিক কি ও কতখানি, তা নিয়ে তাদের একটি বিশাল অংশ কেবল অজ্ঞই নয়, বরং অনেক রকম বিভ্রান্তি ও মিথ্যা প্রচারণার শিকার। এর পেছনের জটিল কারণগুলো নিয়ে অন্যদিন আলোচনা করা যাবে। এই প্রচারণার একটি বড় শিকার হচ্ছে পাশ্চাত্যের নারীরা। এটা তাদের জানারও কথা নয় যে দ্বিতীয় খলিফা উমর(রা:) এর সময়ে ৬৩৫ ইং সনে প্রথমে মদিনা এবং পরবর্তীতে বসরায় স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী ছিলেন আল-শিফা নাম্নী জনৈক মুসলিম মহিলা। কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০০ বছর আগে ৮৫৯ সনে মরক্কোর ফেজ নগরীতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু থাকা বিশ্বের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয় আল-কারাউইয়্যিন (al-Qarawiyyin, Arabic: جامعة القرويين‎) প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহরি নামক জনৈক ধনী বণিককন্যা। ধর্মীয় উপাসনালয় না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত আল-ফিহরি নিয়মিত রোজা রাখতেন বলে কথিত আছে। জ্ঞানচর্চাকে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং সম্পূরক ও পরিপূরক গণ্য করে কতখানি মর্যাদা দেয়া হোত, এ তারই প্রমাণ। দশম শতাব্দীতে Pope Sylvester II (পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্মপ্রধাণ) স্পেনের কর্ডোভা-সহ ফাতিমা আল-ফিহরির আল-কারাউইয়্যিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ফিরে গিয়ে ইউরোপে তিনি অ্যারাবিক ডেসিমাল নিউমেরাল সিস্টেম প্রচলন করেন। প্রসঙ্গত, আজকের ধনবান আরব প্রিন্স ও প্রিন্সেসদের সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শোনা যায়; এর পরিবর্তে তাঁদের কেউ কি বিশ্বের সবচাইতে বড় পাবলিক লাইব্রেরী নির্মাণ বা তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয়ে জ্ঞানের চর্চা ও প্রসারে বিপুল অবদান রাখার কথা চিন্তা করতে পারেন?

প্রাসঙ্গিকভাবে, বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান HP (Hewlett-Packard Company) এর এককালীন CEO কার্লি ফিওরিনার একটি সাম্প্রতিক মন্তব্য উদ্ধৃত করছি । ২০০৫ সাল পর্যন্ত ফিওরিনা ছিলেন Fortune 500 কোম্পানির সর্বময় কর্তৃত্বে আসা সাকুল্যে তিনজন নারীর একজন। Fortune ম্যাগাজিনের 50 most powerful women in business in the United States লিস্টে ছয়বার ফিওরিনার নাম আসে এক নম্বরে। ম্যানেজমেন্ট এবং বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ডিগ্রিধারী ফিওরিনা Stanford University থেকে Medieval History ও Philosophy তে গ্র্যাজুয়েশন করেন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ফিওরিনার “Technology, Business, and our way of life: What’s next” শীর্ষক বক্তব্যের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত হোল। ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং বাস্তবতার খেই হারিয়ে ফেলা উগ্র ধর্মবিদ্বেষী এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর লাগামহীন প্রচারণায় দিশেহারা অবস্থায় এ উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। একই সাথে এতে রয়েছে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত নেতৃত্ব ব্যবস্থার উপরেও কিছু দিক-নির্দেশনা।

“একসময় পৃথিবীতে এমন এক সভ্যতা ছিল, যাকে সর্বশ্রেষ্ঠ গণ্য করা হোত। এই সভ্যতা একটি আন্ত মহাদেশীয় সুপার-ষ্টেট তৈরি করতে সমর্থ হয়, যার বিস্তৃতি ছিল এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগর পর্যন্ত – উত্তরের হিমাঞ্চল, ক্রান্তীয় অঞ্চল, মরুভূমিসহ বিভিন্ন জলবায়ুর ভূখন্ড এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিভিন্ন মতবাদ এবং জাতিগোষ্ঠীর লক্ষ কোটি মানুষের সমন্বয়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

পৃথিবীর বিশাল একটি অংশের জন্য এর ভাষা হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন, যা শত শত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছিল। এর সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন জাতির সৈন্য সমাবেশ ঘটেছিল। রাষ্ট্রের শান্তি এবং সমৃদ্ধির সুরক্ষায় এ সেনাবাহিনী এমন পারদর্শী ছিল, যার জুড়ি মেলা ভার। এই সভ্যতার বাণিজ্যের প্রসার লাতিন আমেরিকা এবং চীনের মধ্যকার সমগ্র অঞ্চলে সুবিস্তৃত ছিল।

আর সবকিছু ছাপিয়ে এই সভ্যতার চলৎশক্তি হয়ে উঠেছিল এর উদ্ভাবনী ক্ষমতা। এর স্থপতিরা অভিকর্ষের বিপরীতে নির্মাণ করেছিলেন বিস্ময়কর স্থাপত্য নিদর্শন। এর গণিতবিদরা আবিষ্কার করেছিলেন আলজেব্রা আর অ্যালগরিদম, যা আধুনিককালে কম্পিউটার থেকে এনক্রিপশন পদ্ধতি আবিষ্কারের দ্বার উন্মুক্ত করেছে। এর চিকিৎসকরা মানবদেহ বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, সেই সাথে আবিষ্কার করেছিলেন বিভিন্ন রোগের প্রতিকার। এর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গভীরভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন নক্ষত্রের নামকরণ করেছিলেন, পরবর্তীকালের জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন মহাকাশভ্রমণ ও অনুসন্ধানের দ্বার। এর সাহিত্যিকরা রচনা করেছিলেন বীরত্ব, প্রেম, মোহ নিয়ে হাজারো উপাখ্যান। এর কবিরা অকুণ্ঠে লিখেছেন প্রেমের কবিতা, তাঁদের আগে অন্যরা যা নিয়ে লিখতে সাহস পেত না।

ভিন্ন চিন্তা ও দর্শনের চর্চা – যা নিয়ে সমসাময়িক অন্যান্য জাতির চূড়ান্ত ভীতি ছিল – তা এই সভ্যতার ছায়াতলে ব্যাপক প্রসার ও সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। অতীত সভ্যতার জ্ঞান যখন দমন-পীড়নের কারণে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল, তখন এই সভ্যতার ধারক-বাহকরাই সে জ্ঞানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এবং তা পৌঁছে দিয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।

আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় এর অনেকগুলো বিষয়ই আজ আমাদের পরিচিত, কিন্তু আমি যে সভ্যতার কথা বলছি, তা হল ৮০০ হতে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মুসলিম সভ্যতা, যার অধীনে ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য, বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রোর মত শহর এবং সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট এর মত জ্ঞানবান শাসক।

যদিও এই সভ্যতার কাছে আমরা ঠিক কতখানি ঋণী, সে ব্যাপারে আমরা অনেকেই বিন্দুমাত্র ধারণা রাখি না, তবে সত্য এই যে, আমাদের ঐতিহ্যের অনেক কিছুই তাঁদের অবদান। আরব গণিতবিদদের অবদান ছাড়া আজকের প্রযুক্তি শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হত না। রুমির মতো সুফি কবি-দার্শনিকরা সত্তা ও সত্য নিয়ে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন। সুলেমানের মতো মহান শাসক সহনশীলতা ও নাগরিক নেতৃত্ব বিষয়ক ধারণায় সমূহ অবদান রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্ব থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে – এ নেতৃত্ব ছিল যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত – উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নয়। এ ছিল এমনই এক নেতৃত্ব ব্যবস্থা যা খ্রিস্টান, মুসলিম, এবং ইহুদি জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছিল।

শিল্প-সংস্কৃতি, সহনশীলতা, বৈচিত্র্য, বীরত্ব গাঁথায় পূর্ণ এমন একটি আলোকিত নেতৃত্ব সুদীর্ঘ ৮০০ বছরের উদ্ভাবন ও সমৃদ্ধির প্রসার নিশ্চিত করেছে।

আজকের অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং গুরুতর সময়ে অনুরূপ মহান একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমাদের অঙ্গীকার করা প্রয়োজন। অতীতের যে কোনও সময়ের চাইতে এখন সাহসী এবং ব্যক্তিগত আচরণে দায়িত্বশীল একটি নেতৃত্বের উপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। সম্মিলিতভাবে আমাদের জন্য নেতৃত্বের ভূমিকা ঠিক কি হওয়া উচিত, সে প্রশ্ন দিয়ে আমি আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করতে চাই …”

সম্পূর্ণ বক্তব্যটি এখানে

ফিওরিনার মতো একজন প্রভাবশালী নারীর উদ্ধৃতিতে মনে হতে পারে পাশ্চাত্যের প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে, যা আশার কথা। তাঁর এ উক্তি অনেককে ইসলাম সম্পর্কে নতুন করে পড়াশোনা করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে যা তাদের বিভ্রান্তি নিরসনে সহায়ক হবে। কেবল অমুসলিমদের জন্য নয়, হালের মুসলিমদের জন্যও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। সাফল্যের শিখরে থাকা অবস্থায় জ্ঞানের প্রতি ধর্মপ্রাণ মুসলিম মনীষীদের যে উদার, যৌক্তিক, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে, তা সমকালীন মুসলিম বিশ্বে অনেকটাই অকল্পনীয়। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এযুগে ধর্মবিদ্বেষী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ক্রমাগত আগ্রাসনে উঠতি প্রজন্মকে ধর্ম সম্পর্কে খুব সহজে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়, যা থেকে অনেকাংশে প্রতীয়মান হয় যে সঠিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, বা দর্শন সম্পর্কে এদের জ্ঞান খুবই সামান্য।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ইতিহাস নিয়ে কথা বলা কি অতীত নিয়ে পড়ে থাকা? আমার মতে অবশ্যই নয়, কারণ ইতিহাস কেবল অতীতের বিশেষ ঘটনাবলীর চর্চা নয় – অতীতকে পরম তপস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাও এর মূল লক্ষ্য নয়। বরং অতীতের কোন মন-মানসিকতা বা চিন্তা-চেতনা সামগ্রিকভাবে একটি জাতির চরম উৎকর্ষের সহায়ক শক্তি হয়েছিল বা তার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল, তা বিশেষভাবে শেখার বিষয়। ইতিহাসলব্ধ জ্ঞান একটি জীবন্ত ও গতিশীল সমাজে কিভাবে প্রতিফলিত হবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। কারও জন্য এর গুরুত্ব বুদ্ধিবৃত্তিক বা জ্ঞানের প্রসারের মাঝে সীমাবদ্ধ। কারও কাছে তা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নির্দেশনার উৎস। প্রতিফলন যেভাবেই হোক, ইতিহাস চর্চার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ অতীতমুখী মনোভাব বা অনুতাপে বিদ্ধ হওয়া নয়, বরং অতীতের নির্মোহ বিশ্লেষণলব্ধ জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়ে মানবসভ্যতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া।

http://shankhachilerdana.wordpress.com