আমরা অনেক সময়ই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তার বিকাশে মুসলিমদের অবদানের কথা শুনি। কিন্তু সচরাচর যেভাবে এ তথ্যগুলো দেয়া হয়, তাতে অনেকের কাছে মনে হতে পারে যে সব সভ্যতা বুঝি একই ভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষে অবদান রেখেছে এবং মুসলিমদের অবদান সে অর্থে তেমন কোনও ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃত সত্য তা নয়, ধর্মভিত্তিক সভ্যতার ক্ষেত্রে তো নয়ই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ধর্মীয় চিন্তাধারা দিয়ে অনুপ্রাণিত তো নয়ই, বরং বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। মুসলিম সভ্যতার ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে এর বিপরীতটি লক্ষ্য করা যায়, যা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত এবং পৃষ্ঠপোষণ করেছে।
অনেকেই হয়তো জানেন না যে রোমান সম্রাট কন্সতান্তিন চতুর্থ শতকে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর থেকে পৌত্তলিক গ্রীকদের উপাসনালয় এবং জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রগুলিকে খ্রিস্টধর্মের মূল বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক ধরে নিয়ে একে একে বন্ধ করে দেয়া হয়।
এর জের ধরে ষষ্ঠ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান (Justinian I in 529 CE) বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রসহ জ্ঞানের সাধনায় নিয়োজিত গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর প্রতিষ্ঠিত আকাদেমি চিরতরে বন্ধ করে দেয়। এই জাতীয় মন-মানসিকতার ফলস্বরূপ খ্রিষ্টান ইউরোপে মুক্তচিন্তার সাধনা একরকম বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় এক হাজার বছর ধরে প্রাচীন গ্রীক জ্ঞান-ভান্ডার গ্রীকভাষী খ্রিস্টান বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের হস্তগত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা এ জ্ঞানের ব্যাপক চর্চা, প্রসার, এবং উৎকর্ষ সাধনে ব্যর্থ হয়। রেনেসাঁর উৎপত্তির আগ পর্যন্ত এইসময়টি ইউরোপীয় সভ্যতার জন্য একারণে অন্ধকার যুগ হিসেবে পরিচিত।
ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি সচরাচর আলোচিত হয় না, তা হোল সপ্তম শতাব্দীর পর থেকেই একে একে মিশর, মেসোপটেমিয়া, পারস্য, ভারতসহ অতীত সভ্যতার জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র গুলো মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রীক বিজ্ঞানের স্থপতি হিসেবে পরিচিত ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, টলেমী, গ্যালেনসহ অনেক মনীষী একসময় মিশরে অবস্থিত গ্রীক আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে জ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের কাজগুলো ঐ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত হয় যার বেঁচে যাওয়া (রোমান সিজারের অগ্নিকান্ড হতে) অংশগুলো পরবর্তীতে মুসলিমদের আয়ত্তে আসে। মুসলিমদের কাছে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মাঝে আপাত: দ্বন্দ্ব ছিল না বিধায় তারা হারিয়ে যাওয়া গ্রীক, পারস্য, ভারতীয় সভ্যতার জ্ঞান-ভাণ্ডারকে ধারণ করে। এমনও সময় ছিল যখন বাগদাদের খলিফা অতীতের মূল্যবান পুস্তক অনুবাদের পুরষ্কারস্বরূপ বইয়ের ওজনের সমতুল্য স্বর্ণ অনুবাদককে প্রদান করতেন। বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমাহ'(House of Wisdom) তে শুরু হওয়া আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের ‘Translation Movement’ এর সময় অসংখ্য গ্রীক ক্লাসিক আরবীতে অনুদিত হয়। ইউরোপে প্রচলিত রোমান নিউমেরাল সিস্টেমে গণিতের ব্যাপক উৎকর্ষ সম্ভব ছিল না। আরব গণিতবিদেরা প্রাচীন ভারতীয় নিউমেরাল সিস্টেমের জ্ঞান ধারণ করে এর পরিবর্ধন, উৎকর্ষ, ও ব্যাপক প্রচলন করেন। আল-খোয়ারিজমি (al-Khwārizmī) সহ মুসলিম গাণিতিকরা গ্রীক জ্যামিতির গণ্ডির বাইরে এসে অ্যালজেব্রার উদ্ভাবনসহ আধুনিক গণিতের চরম প্রসার নিশ্চিত করেন। পাশ্চাত্যের সুপরিচিত ইটালীয় গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি (Fibonacci) মুসলিম নর্থ আফ্রিকাতে বসে হিন্দু-অ্যারাবিক নিউমেরাল সিস্টেম অধ্যয়ন করেন।

An imaginary rendition of Al Biruni on a 1973 Soviet post stamp
জ্ঞানসাধনায় মুসলিম মনীষীদের দৃষ্টিভঙ্গি কতখানি উদার এবং প্রগতিশীল ছিল, তা বোঝাতে শুধু একটি উদাহরণই যথেষ্ট। অনেকেই জানেন না যে প্রখ্যাত মুসলিম মনীষী আল-বিরুনী তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যয় করেন। ১০১৭ সনে ভারতে গমনের পর একাদশ শতাব্দীর ভারতের ইতিহাস, জিওগ্রাফি, ভূতত্ত্ব, বিজ্ঞান, গণিত, জাতিভিত্তিক প্রথা ও ধর্মবিশ্বাসের উপর ‘তারিখ আল-হিন্দ’ (History of India a.k.a The Indica) নামে একটি বিশদ, নিরপেক্ষ গবেষণাধর্মী এনসাইক্লোপিডিয়া লিখেন যার জন্য তাঁকে ‘Founder of Indology’ এবং ‘First Anthropologist’ বলা হয় – কাজটির জন্য তাঁকে al-Ustadh (The Master) উপাধিতেও ভূষিত করা হয়। অন্যদিকে গ্রীক পণ্ডিত ইরাতোস্থেনিসের (Eratosthenes) প্রবর্তিত ব্যবস্থার বাইরে এসে (যে ব্যবস্থায় তাঁকে ৫০০ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত দু’টি স্থানে পরিমাপ নিতে হয়) পাঞ্জাবের Pind Dadan Khan এলাকাস্থিত নান্দনা (Nandna) দুর্গে বসে পাহাড়ের উচ্চতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গোলাকার পৃথিবীর ব্যাসার্ধ পরিমাপের নতুন পন্থা তিনি উদ্ভাবন করেন যার দ্বারা নির্ণীত ব্যাসার্ধ প্রায় নির্ভুল (আধুনিক স্যাটেলাইটের সাহায্যে নির্ণীত ব্যাসার্ধের সাথে কেবল ১০০ মাইলের মতো তফাত) পরিগণিত হয়। এ কারণে তাঁকে ‘Father of Geodesy’ বলা হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সমূহ অবদান রাখা এই মনীষী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম।
মূলত উৎস যাই হোক, জ্ঞানসাধনার প্রতি সামগ্রিকভাবে মুসলিম মনীষীদের এমন নিরপেক্ষ, বুদ্ধিবৃত্তিক, এবং আগ্রহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অচিরেই মানবলব্ধ জ্ঞানভাণ্ডার এশিয়া, ইউরোপ, নর্থ আফ্রিকাতে বিস্তৃত সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ যখন ঘোর অন্ধকার যুগে আচ্ছন্ন, তখন মুসলিম সভ্যতা জ্ঞানের মশালকে শুধু প্রজ্বলিতই রাখেনি, মুসলিম মনীষীরা এর প্রভূত বিকাশ ঘটান এবং জ্ঞানের মশাল বয়ে নিয়ে যান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, এর হাত ধরেই একসময় ইউরোপে অ্যাকাডেমিক রেনেসাঁর উৎপত্তি হয়।

Interior of al-Karaouine Mosque and university; note the similarity of the architecture to the Alhambra (الحمراء)
পাশ্চাত্য সভ্যতায় মুসলিমদের অবদান ঠিক কি ও কতখানি, তা নিয়ে তাদের একটি বিশাল অংশ কেবল অজ্ঞই নয়, বরং অনেক রকম বিভ্রান্তি ও মিথ্যা প্রচারণার শিকার। এর পেছনের জটিল কারণগুলো নিয়ে অন্যদিন আলোচনা করা যাবে। এই প্রচারণার একটি বড় শিকার হচ্ছে পাশ্চাত্যের নারীরা। এটা তাদের জানারও কথা নয় যে দ্বিতীয় খলিফা উমর(রা:) এর সময়ে ৬৩৫ ইং সনে প্রথমে মদিনা এবং পরবর্তীতে বসরায় স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী ছিলেন আল-শিফা নাম্নী জনৈক মুসলিম মহিলা। কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০০ বছর আগে ৮৫৯ সনে মরক্কোর ফেজ নগরীতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু থাকা বিশ্বের প্রথম আনুষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয় আল-কারাউইয়্যিন (al-Qarawiyyin, Arabic: جامعة القرويين) প্রতিষ্ঠা করেন ফাতিমা আল-ফিহরি নামক জনৈক ধনী বণিককন্যা। ধর্মীয় উপাসনালয় না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়টির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত আল-ফিহরি নিয়মিত রোজা রাখতেন বলে কথিত আছে। জ্ঞানচর্চাকে ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং সম্পূরক ও পরিপূরক গণ্য করে কতখানি মর্যাদা দেয়া হোত, এ তারই প্রমাণ। দশম শতাব্দীতে Pope Sylvester II (পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্মপ্রধাণ) স্পেনের কর্ডোভা-সহ ফাতিমা আল-ফিহরির আল-কারাউইয়্যিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং ফিরে গিয়ে ইউরোপে তিনি অ্যারাবিক ডেসিমাল নিউমেরাল সিস্টেম প্রচলন করেন। প্রসঙ্গত, আজকের ধনবান আরব প্রিন্স ও প্রিন্সেসদের সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শোনা যায়; এর পরিবর্তে তাঁদের কেউ কি বিশ্বের সবচাইতে বড় পাবলিক লাইব্রেরী নির্মাণ বা তথ্য-প্রযুক্তির সমন্বয়ে জ্ঞানের চর্চা ও প্রসারে বিপুল অবদান রাখার কথা চিন্তা করতে পারেন?
প্রাসঙ্গিকভাবে, বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান HP (Hewlett-Packard Company) এর এককালীন CEO কার্লি ফিওরিনার একটি সাম্প্রতিক মন্তব্য উদ্ধৃত করছি । ২০০৫ সাল পর্যন্ত ফিওরিনা ছিলেন Fortune 500 কোম্পানির সর্বময় কর্তৃত্বে আসা সাকুল্যে তিনজন নারীর একজন। Fortune ম্যাগাজিনের 50 most powerful women in business in the United States লিস্টে ছয়বার ফিওরিনার নাম আসে এক নম্বরে। ম্যানেজমেন্ট এবং বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ডিগ্রিধারী ফিওরিনা Stanford University থেকে Medieval History ও Philosophy তে গ্র্যাজুয়েশন করেন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে ফিওরিনার “Technology, Business, and our way of life: What’s next” শীর্ষক বক্তব্যের অংশবিশেষ নিচে উদ্ধৃত হোল। ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং বাস্তবতার খেই হারিয়ে ফেলা উগ্র ধর্মবিদ্বেষী এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর লাগামহীন প্রচারণায় দিশেহারা অবস্থায় এ উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। একই সাথে এতে রয়েছে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত নেতৃত্ব ব্যবস্থার উপরেও কিছু দিক-নির্দেশনা।
“একসময় পৃথিবীতে এমন এক সভ্যতা ছিল, যাকে সর্বশ্রেষ্ঠ গণ্য করা হোত। এই সভ্যতা একটি আন্ত মহাদেশীয় সুপার-ষ্টেট তৈরি করতে সমর্থ হয়, যার বিস্তৃতি ছিল এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগর পর্যন্ত – উত্তরের হিমাঞ্চল, ক্রান্তীয় অঞ্চল, মরুভূমিসহ বিভিন্ন জলবায়ুর ভূখন্ড এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিভিন্ন মতবাদ এবং জাতিগোষ্ঠীর লক্ষ কোটি মানুষের সমন্বয়ে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
পৃথিবীর বিশাল একটি অংশের জন্য এর ভাষা হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন, যা শত শত ভূখণ্ডের অধিবাসীদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছিল। এর সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন জাতির সৈন্য সমাবেশ ঘটেছিল। রাষ্ট্রের শান্তি এবং সমৃদ্ধির সুরক্ষায় এ সেনাবাহিনী এমন পারদর্শী ছিল, যার জুড়ি মেলা ভার। এই সভ্যতার বাণিজ্যের প্রসার লাতিন আমেরিকা এবং চীনের মধ্যকার সমগ্র অঞ্চলে সুবিস্তৃত ছিল।
আর সবকিছু ছাপিয়ে এই সভ্যতার চলৎশক্তি হয়ে উঠেছিল এর উদ্ভাবনী ক্ষমতা। এর স্থপতিরা অভিকর্ষের বিপরীতে নির্মাণ করেছিলেন বিস্ময়কর স্থাপত্য নিদর্শন। এর গণিতবিদরা আবিষ্কার করেছিলেন আলজেব্রা আর অ্যালগরিদম, যা আধুনিককালে কম্পিউটার থেকে এনক্রিপশন পদ্ধতি আবিষ্কারের দ্বার উন্মুক্ত করেছে। এর চিকিৎসকরা মানবদেহ বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, সেই সাথে আবিষ্কার করেছিলেন বিভিন্ন রোগের প্রতিকার। এর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গভীরভাবে মহাকাশ পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন নক্ষত্রের নামকরণ করেছিলেন, পরবর্তীকালের জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন মহাকাশভ্রমণ ও অনুসন্ধানের দ্বার। এর সাহিত্যিকরা রচনা করেছিলেন বীরত্ব, প্রেম, মোহ নিয়ে হাজারো উপাখ্যান। এর কবিরা অকুণ্ঠে লিখেছেন প্রেমের কবিতা, তাঁদের আগে অন্যরা যা নিয়ে লিখতে সাহস পেত না।
ভিন্ন চিন্তা ও দর্শনের চর্চা – যা নিয়ে সমসাময়িক অন্যান্য জাতির চূড়ান্ত ভীতি ছিল – তা এই সভ্যতার ছায়াতলে ব্যাপক প্রসার ও সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। অতীত সভ্যতার জ্ঞান যখন দমন-পীড়নের কারণে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল, তখন এই সভ্যতার ধারক-বাহকরাই সে জ্ঞানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এবং তা পৌঁছে দিয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতায় এর অনেকগুলো বিষয়ই আজ আমাদের পরিচিত, কিন্তু আমি যে সভ্যতার কথা বলছি, তা হল ৮০০ হতে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মুসলিম সভ্যতা, যার অধীনে ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্য, বাগদাদ, দামেস্ক, কায়রোর মত শহর এবং সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট এর মত জ্ঞানবান শাসক।
যদিও এই সভ্যতার কাছে আমরা ঠিক কতখানি ঋণী, সে ব্যাপারে আমরা অনেকেই বিন্দুমাত্র ধারণা রাখি না, তবে সত্য এই যে, আমাদের ঐতিহ্যের অনেক কিছুই তাঁদের অবদান। আরব গণিতবিদদের অবদান ছাড়া আজকের প্রযুক্তি শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হত না। রুমির মতো সুফি কবি-দার্শনিকরা সত্তা ও সত্য নিয়ে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন। সুলেমানের মতো মহান শাসক সহনশীলতা ও নাগরিক নেতৃত্ব বিষয়ক ধারণায় সমূহ অবদান রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্ব থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে – এ নেতৃত্ব ছিল যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত – উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নয়। এ ছিল এমনই এক নেতৃত্ব ব্যবস্থা যা খ্রিস্টান, মুসলিম, এবং ইহুদি জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছিল।
শিল্প-সংস্কৃতি, সহনশীলতা, বৈচিত্র্য, বীরত্ব গাঁথায় পূর্ণ এমন একটি আলোকিত নেতৃত্ব সুদীর্ঘ ৮০০ বছরের উদ্ভাবন ও সমৃদ্ধির প্রসার নিশ্চিত করেছে।
আজকের অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং গুরুতর সময়ে অনুরূপ মহান একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আমাদের অঙ্গীকার করা প্রয়োজন। অতীতের যে কোনও সময়ের চাইতে এখন সাহসী এবং ব্যক্তিগত আচরণে দায়িত্বশীল একটি নেতৃত্বের উপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। সম্মিলিতভাবে আমাদের জন্য নেতৃত্বের ভূমিকা ঠিক কি হওয়া উচিত, সে প্রশ্ন দিয়ে আমি আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করতে চাই …”
সম্পূর্ণ বক্তব্যটি এখানে
ফিওরিনার মতো একজন প্রভাবশালী নারীর উদ্ধৃতিতে মনে হতে পারে পাশ্চাত্যের প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে, যা আশার কথা। তাঁর এ উক্তি অনেককে ইসলাম সম্পর্কে নতুন করে পড়াশোনা করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে যা তাদের বিভ্রান্তি নিরসনে সহায়ক হবে। কেবল অমুসলিমদের জন্য নয়, হালের মুসলিমদের জন্যও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। সাফল্যের শিখরে থাকা অবস্থায় জ্ঞানের প্রতি ধর্মপ্রাণ মুসলিম মনীষীদের যে উদার, যৌক্তিক, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এই নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে, তা সমকালীন মুসলিম বিশ্বে অনেকটাই অকল্পনীয়। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের এযুগে ধর্মবিদ্বেষী ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ক্রমাগত আগ্রাসনে উঠতি প্রজন্মকে ধর্ম সম্পর্কে খুব সহজে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়, যা থেকে অনেকাংশে প্রতীয়মান হয় যে সঠিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, বা দর্শন সম্পর্কে এদের জ্ঞান খুবই সামান্য।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ইতিহাস নিয়ে কথা বলা কি অতীত নিয়ে পড়ে থাকা? আমার মতে অবশ্যই নয়, কারণ ইতিহাস কেবল অতীতের বিশেষ ঘটনাবলীর চর্চা নয় – অতীতকে পরম তপস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাও এর মূল লক্ষ্য নয়। বরং অতীতের কোন মন-মানসিকতা বা চিন্তা-চেতনা সামগ্রিকভাবে একটি জাতির চরম উৎকর্ষের সহায়ক শক্তি হয়েছিল বা তার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল, তা বিশেষভাবে শেখার বিষয়। ইতিহাসলব্ধ জ্ঞান একটি জীবন্ত ও গতিশীল সমাজে কিভাবে প্রতিফলিত হবে তার কোনও সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। কারও জন্য এর গুরুত্ব বুদ্ধিবৃত্তিক বা জ্ঞানের প্রসারের মাঝে সীমাবদ্ধ। কারও কাছে তা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নির্দেশনার উৎস। প্রতিফলন যেভাবেই হোক, ইতিহাস চর্চার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ অতীতমুখী মনোভাব বা অনুতাপে বিদ্ধ হওয়া নয়, বরং অতীতের নির্মোহ বিশ্লেষণলব্ধ জ্ঞানে উদ্বুদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়ে মানবসভ্যতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া।
http://shankhachilerdana.wordpress.com
Recent Comments