তোমরা যারা আওয়ামী লীগ করো

by অসিউর রহমান

কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই নাতিদীর্ঘ জীবনে আমি সবচেয়ে বিচিত্র, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিষয় কী দেখেছি। আমি এতটুকু দ্বিধা না করে বলব, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লিগ।

তার কারণ, যে বয়সটি হচ্ছে মাতৃভূমিকে গঠন করার বয়স, সেই বয়সে তারা ধ্বংস করে দেশকে, তারা এই মাতৃভূমিকে প্রতি মুহুর্তে ক্ষত বিক্ষত করছে। যে বয়সে একজন তরুণের মুক্তিযুদ্ধের ফসল দেশকে যারা গঠন করেছে, তাদের কাজে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা অনুপ্রাণিত হয় সেই মুক্তিযুদ্ধের ফসল দেশকে ধ্বংসকারীদের দিয়ে। যে বয়সে তাদের স্বপ্ন দেখার কথা দেশের বড় বড় লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিককে নিয়ে, সেই বয়সে তারা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সেই সব মানুষের, যারা রক্ষী বাহীনি তৈরি করে বাহাত্তর থেকে পচাত্তুর পর্যন্ত এই দেশের লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী আর সাংবাদিকদের হত্যা করেছে!

যে বয়সে তাদের পড়াশোনা করার কথা জীবনের নীতিবোধ তৈরী করার কথা, সেই বয়সে তারা যে শুধু এই অবিশ্বাস্য আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখে তা নয়, তারা এগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। যে বয়সে তাদের মুক্তচিন্তা শেখার কথা, গান গাওয়ার কথা, নাটক করার কথা, আদর্শ নিয়ে ভাবালুতায় ডুবে যাওয়ার কথা, সেই সময় তারা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আটকে রাখতে শেখে, সাম্প্রদায়িক হতে শেখে, ধর্মবিদ্বেষী হতে শেখে। যে বয়সে ছেলে আর মেয়ের ভেতর সহজ ভালো লাগা ও পবিত্র, নিস্কাম ও সভ্য ভালোবাসা জন্ম নেওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা সেই অনুভূতিগুলোকে অশ্রদ্ধা করতে শেখে, গোপন ভিডিও ধারন করে বাজারজাত করে—সে জন্য তারা কত দূর যেতে পারে, সেটা আমরা সবাই নিজের চোখে দেখেছি, সেই ভয়ংকর কাহিনি আমি সবাইকে বলতেও দেখেছি! এই সামুতেই আমুলীগার অমি পিয়ালের কথা কে না জানে, ব্লগস্ফিয়ারের সবচেয়ে ভয়াবহ গালিবাজগুলোর দল কোনটা কে না জানে?

যখন এই বাংলাদেশের সব মানুষ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন ছাত্রলীগ নামে এই সংগঠনের হতভাগ্য তরুণদের নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে সাধারন ছাত্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই, এখনো দেশের আনাচকানাচ থেকে তাদের আক্রমনের সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। আমার খুব জানার ইচ্ছে করে যে নেতারা তাদের বুঝিয়েছে, রাস্তায় নেমে হামলা করে মানুষের শরীর ক্ষতবিক্তর করতে হবে, নিজের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে হবে। সেই সব নেতা কি তাদের সন্তানদেরও পথে নামিয়েছে? আমি নিশ্চিত, সেটি ঘটেনি। আমি আগেও দেখেছি, এই নেতারা যখন তাদের কর্মী বাহিনীকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, তখন তাদের সন্তানেরা ইংরেজি মিডিয়াম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, লন্ডনে পড়ে, প্রিমিও গাড়ি হাকিয়ে, চাঁদা’র বখরা পেয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে।

আমি অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনি, কেমন করে বাংলাদেশের মতো রক্তস্নাত একটি দেশে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নৃশংস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, সেখানে একজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ব্যাবসা করতে পারে! আমার মনে আছে, আমি বহুকাল পরে যখন প্রথম এই দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, তখন ছাত্রলীগের তান্ডব দেখে একধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। —এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে?

একজন ছাত্র কেমন করে লীগ করে, তার একটি উত্তর অবশ্য আমি একবার খুঁজে পেয়েছিলাম। আমাদের স্কুলের একজন ছাত্র একবার আমাকে একটি এসএমএস করে জানিয়েছিল যে সে সোনিয়াকে, খুব ভালোবাসে এবং তার বিদ্যালয়ে ফেমাস হওয়ার খুব ইচ্ছে। তার ক্লাসের প্রধান আওয়ামী নেতার লোক এবং তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সে যদি লীগ না করে, তাহলে তাকে সোনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হবে না এবং তাকে বাটে ফেলে পিটানো হবে। সে জন্য সে ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছে এবং এটি নিয়ে তার প্রচন্ড গ্লানী আছে। সেই এসএমএসটিতে আমি একজন মেরুদণ্ডহীন আতংকিত হতভাগা মানুষকে আবিষ্কার করেছিলাম। তার জন্য কোনো মমতা নয়, আমি করুণা অনুভব করেছিলাম। আমি ইচ্ছে করলেই সেই ছাত্রটিকে সাহায্য করতে পারতাম, তার নীতিহীন ক্লাস প্রধানের পরিচয় জানতে পারতাম কিন্তু আমি তার কিছুই করিনি—আমার রুচি হয়নি।

আমার মাঝেমধ্যে জানার ইচ্ছে করে, এ ধরনের কারণে কতজন তরুণ ছাত্রলীগের থ্রেট খেয়েছে—কোনো স্বপ্ন নয়, কোনো আদর্শ নয়, শুধু স্বার্থ, শুধু চাওয়া-পাওয়া। মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই, আওয়ামী লীগের নাকি অনেক অর্থবিত্ত, তাদের অনেক পাওয়ার। এই দলে যোগ দিলে নাকি সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া যায়, টেন্ডার পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা হল দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই হলে সিট পাওয়া যায়। তারা কলেজ দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই কলেজে ভর্তি হওয়া যায়। পত্রপত্রিকায় দেখি, পরিচিতদের কাছে শুনি, তাদের দল নাকি অত্যন্ত হিংস্র। আদর্শ ছাড়া কিংবা ভুল আদর্শের সংগঠন কি খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে?

দীর্ঘদিন মিলিটারির শাসনে থাকার কারণে মানুষ যখন বিভ্রান্ত ছিল, তখন এই দেশে আওয়ামী লীগ ইলেকশনে অংশ নিয়েছিল। (কী লজ্জা!) যখন দেশের মানুষ গণতন্ত্রের ছোঁয়া পেতে শুরু করেছে, একটু বুঝতে শুরু করেছে তখন তারা নির্বাচনে হেরেছিল। উপায় না দেখে তখন তারা রাজাকর জামাতের ঘাড়ে চড়ে বসেছিল, প্রথমবারের মত তারা ক্ষমতা পেয়েছিল। দেশের মানুষ যখন আবার সজাগ হয়েছে, তখন আবার হেরেছে। এখন আবার ঘাড়ে উঠেছে। এই দেশে যদি ধ্বংস- ভাংচুর আর দলীয় নির্বাচন করেই ক্ষমতায় যাওয়া যায়, তাহলে তাদের জন্য পথটুকু খোলা আছে। আমার খুব আশা ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশের মানুষের এত আগ্রহ, এত উত্তেজনা দেখে হয়তো এরা দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে—তারা করেনি। আমি খুব আশাহত হয়েছি যখন দেখছি রাজাকারদের বিচারের বিনিময় হার নির্ধারন করেছে দেশের গণতন্ত্রের সাথে!!!

আমি রাজনীতি ভালো বুঝি, আমার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আমি একটা বিষয় খুব ভালো করে জানি, এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশের উন্নয়ন ও ভবিষ্যত অস্বীকার করে আর কেউ কোনো দিন রাজনীতি করতে পারবে না। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর আর ৮২ – ৯০’র সেই কালো সময় আমরা পার হয়ে এসেছি, আর কেউ কখনো এই দেশের মানুষকে সেই অন্ধকার জগতে ঠেলে পাঠাতে পারবে না।

কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মত দায়িত্বপালন করে তা দেখিয়ে কেউ সুবিধে করতে পারবে না, বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বিচার করে এই গ্লানিময় অধ্যায়কে চিরদিনের মতো সমাপ্ত করে দিতে হবে এবং উন্নয়নের রাজনীতিকরতে হবে।

২.
আমার এই লেখাটি তোমরা যারা লীগ করো, তাদের জন্য। আমি জানি, এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি কাজ—আমার এই লেখাটি তোমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবে না এবং তোমরা যারা পড়ছো তারা আমার এই লেখায় বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে এর মধ্যে নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়েছো। শুধু তা-ই নয়, তোমাদের চরিত্র মোতাবেক—গালাগালি ও ব্যাক্তি আক্রমনে সম্ভবত এই লেখার বিরুদ্ধে বিশাল একটা প্রচারণা শুরু হবে। কিন্তু তবু আমার মনে হয়েছে, আমার এই কাজটুকু করা উচিত, তোমাদের কখনো যে সত্য কথাগুলো বলা হয়নি, আমার সেটা বলা উচিত।

তোমাদের কাছে আমার প্রথম যে প্রশ্ন সেটি হচ্ছে, তোমরা কি জানো আওয়ামী লীগ নামের যে রাজনৈতিক দলটি গড়ে উঠেছে, সেটি বাংলাদেশে প্রথম স্বৈরাচারী শাষন কায়েম করেছিল? যে মানুষটির ডাকে এই দেশ মাত্র ৯ মাসে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছিল সেই মানুষটিকেই হত্যা করে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয়েছিল? তোমরা কি জানো আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র বা উন্নয়নের দল নয়, এটি স্বার্থপর রাজনৈতিক দল এবং এটি সব সময় অতীতমুখী ও ধ্বংসের রাজনীতি করে এসেছে? এই বাংলাদেশ যখন পাপীস্তানীদের বিদেয় করে সোনার বাংলা সৃষ্টি করার স্বপ্ন দেখছে, তখন তারা সেই স্বপ্ন ধ্বংস করেছে। আবার যখন এই দেশের মানুষ পাপিস্তান নামের দানবকে পরাস্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তখন তারা কলকাতায় গিয়ে নিরাপদে অবস্থান নিয়েছে? এখন যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ করে থাকা দেশদ্রোহীদের বিচার করা হচ্ছে, তখন আবার আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অস্বীকার করে স্বৈরাচারী এরশাদকে সাথে নিয়ে গণতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে—সেটি ঘটেছে তোমাদের চোখের সামনে এবং তোমরা খুব ভালো করে জানো, সেখানে তোমাদের নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমার ধারণা, তোমরা যারা লীগ করো, তারা সম্ভবত কখনোই খোলা মন নিয়ে এই দেশের উন্নয়ন সম্পর্কে কারও সঙ্গেই কথা বলো না। তোমরা সব সময়ই নিজেদের সঙ্গে নিজেরা কথা বলো, এবং দূর্নীতি ও আগ্রাসী আচরনের নীতি’তে একে অন্যকে উৎসাহ দাও, একে অন্যের ওপর নির্ভর করো কিন্তু তোমাদের দলের বাইরের মানুষেরা তোমাদের সম্পর্কে কী ভাবে, কখনোই তার খোঁজ নাও নাই। যদি খোঁজ নিতে, তাহলে হয়তো তোমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ছবি দেখতে পেতে। তোমরা সবিস্ময় আতংকে খেয়াল করতে, তোমরা যেভাবে যা কিছু করছো, তার সবকিছু স্বাভাবিক নয়।

তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছো, এই দেশের অজস্র সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে তোমাদের দলের দু-একটি পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়া অন্য কোথাও তোমাদের সম্পর্কে একটিও ভালো কথা ছাপা হয় না। কিছুদিন থেকে বিস্ববিদ্যালের ছাত্র শিক্ষকদের মারধর বা পদ্মা সেতুর মত দূর্নীতির এবং সম্প্রতী দলীয় নির্বাচন করার যে প্রাচীন কর্মকাণ্ড করে চলছো, সেটি করে তোমরা যে নিজেরাই বিপদগ্রস্ত হতে শুরু করেছ, সেটা কি লক্ষ করেছো? গতকালই আমি খবরে জানতে পারলাম, আদালত বিশ্বজিৎকে হত্যার জন্য তোমাদের দায়ী করছে, তোমাদের গোমর ফাঁস করছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এটি ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকবে।

তোমরা নিজেদের জন্য যে জীবন বেছে নিয়েছো, তার মধ্যে কি বিন্দুমাত্র মর্যাদা আছে? আত্মতুষ্টি আছে?

আজ থেকে কয়েক যুগ আগেও এই বাংলাদেশ যে রকম ছিল, এখন সেই বাংলাদেশ নেই। এই বাংলাদেশ অনেক পাল্টে গেছে। নতুন বাংলাদেশ বাকশালের বাংলাদেশ নয়। আওয়ামী লীগ বা ইসলাম বিদ্বেষী বুদ্ধিজীবিদেরও নয়। নতুন বাংলাদেশ হচ্ছে মুক্তচিন্তার পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক এবং ভবিষ্যতমূখী উন্নয়নকামী একটা বাংলাদেশ। এই নতুন বাংলাদেশের মানুষেরা অসাধারণ, তারা একে অন্যের ধর্মকে সম্মান করতে শিখেছে, একে অন্যের সংস্কৃতি আর মূল্যবোধকে রক্ষা করতে শিখেছে, একে অন্যের চিন্তাকে মূল্য দিতে শিখেছে। এই নতুন বাংলাদেশে মানুষে মানুষে কোনো বিভাজন নেই। দেশ-জাতির সীমারেখা পর্যন্ত ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। আর তোমরা দাড়ি-টুপি দেখলেই রাজাকার বলে সেই সম্প্রীতি নষ্টের পায়তারা করছো।

তাই এই নতুন বাংলাদেশে যখন কেউ ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিভাজন করে রাজনীতি করতে চায়, অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিতে চায়, চুরি চামারি করে প্রতিপক্ষকে দোষারপ করার রাজনীতি করতে চায় এবং রাজাকারের বিচার দেখিয়ে সুবিধা আদায় করতে চায়, এবং প্রতিহিংসা ও অতীতমূখী রাজনীতি করতে চায়, দেশকে উন্নয়নবিমুখ করতে চায়, বাংলাদেশের মানুষ তখন তাকে পরিত্যাগ করে।

আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল তাই হচ্ছে বাতিল হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দল—নতুন বাংলাদেশে এই দলগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

আমি জানি, যদিও আমি এই লেখাটি লিখেছি যারা আওয়ামী লীগ করে তাদের উদ্দেশে কিন্তু তারা আসলে আমার একটি কথাও বিশ্বাস করবে না। যদি বিশ্বাস করেও ফেলে, তার পরও তারা কিছু করবে না। কারন এ ধরনের রাজনৈতিক দল তৈরিই করা হয়, স্বার্থপর লোভীদের কাল্ট হিসেবে, অনেক লোভীরা দলে ঢুকে মিলেমিশে আকাম করে। কিন্তু দলে যোগ দিয়ে যদি কিছুটা প্রায়শ্চিত দরকার, এমন বোধ হয়, তবু তারা আর দল থেকে বের হতে পারে না। অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো এক অন্যকে আঁকড়ে ধরে, এবং অন্যায় অপরাধ করেই টিকে থাকতে হয়।

যারা এখনো আওয়ামী লীগে যোগ দাওনি, তারা হয়তো এই লেখাটি পড়ে একটুখানি ভাববে। যখন তাকে এই দলে যোগ দেওয়ার কথা বলবে, হয়তো তারা একটিবার চিন্তা করবে, আমাদের এই ভালোবাসার দেশটির গণতন্ত্রকে যারা টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছিল, আজো দেশের উন্নয়ন স্তব্ধ করে দেয়, শুধু হিংসা আর ননপ্রোডাক্টিভ রাজনীতি করে, আমি কেন সেই দলে যোগ দেব? দেশকে যখন ভালোবাসার কথা, তখন কেন আমি দেশের সঙ্গে বেইমানি করব?

মাতৃভূমিকে ভালোবাসার, মাতৃভূমিকে গড়ে তোলার তীব্র আনন্দ যারা উপভোগ করেনি, যারা ভবিষ্যতেও কোনো দিন অনুভব করতে পারবে না, আমি সেসব হতভাগ্য মানুষের জন্য গভীর করুণা অনুভব করি।
—-

(ডঃ জাফর ইকবালের একটি লেখার কাঠামো’র ভেতর থেকে মুলভাবে কিছুটা পরিবর্তন এনে লেখা)

উইকেটাধিকার চাই

বাংলাদেশে গত কয়েকদিনের পত্রিকায় রাজনৈতিক সংঘাতে নিহতদের সংখ্যা দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন হিসাব মতে গত এক বছরে হেফাজতের আন্দোলনে নিহতদের ছাড়াই প্রায় দুইশতাধিক মানুষ রাজনৈতিক সংঘাতে মারা গেছে।

এত এত মানুষ একদিনে মারা যান নি। এই বছরের ফেব্রুয়ারী থেকে থকে শুরু হয়েছে এই সংঘাত, আর পরিণতিতে মৃত্যুর ঘটনা। এই মানুষদের যদি যদি একটা এদের মৃত্যুর কারণসহ তালিকা করা হয় তাহলে সেই তালিকায় সবচেয়ে বেশি থাকবে কোনটা জানেন? পুলিশের গুলিতে মৃত্যু।

এই একমাসে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে বগুড়ার ইউসুফ; সিরাজগঞ্জের সাকমান; কুমিল্লার দেলোয়ার, বাবুল; ফরিদপুরের মারুফ; কক্সবাজারের বাদশা, মিজান; চাঁদপুরের আরিফ, সিয়াম, রতন, তাজুল ইসলাম; নাটোরের সুজন; ফেনীর মফিজুর; চট্টগ্রামের শরিফুল ইসলাম; সাতক্ষীরার হোসেন আলী, আরিজুল ইসলাম, শামছুর রহমানসহ আরও অন্তত দশ থেকে বারোজন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমরা একজন মনির কিংবা গীতা সরকারের কথা জানি। আমরা জানি নাহিদ-বাবুসহ রহস্যজনক আগুনে নিহত দশ থেকে বারোজনের কথা। তাদের কাদের কি অবস্থা, তার প্রতিটা খবর এদেশের “রাজনীতি সচেতন” কথিত সুশিল সমাজ রাখেন। তাদের সব আপডেট জানার জন্যে টিভির সামনে বসে থাকে সুশিল হওয়ার চেষ্টারত আমাদের মধ্যবিত্তরাও। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি তাদের কেউই গত এক মাসে পুলিশের গুলিতে নিহতদের একজনের নামও জানেন না। বলতেও পারবেন না। অথচ পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা নাশকতায় নিহতদের দ্বিগুন থেকে তিনগুন।

কারণটা খুব সহজ। আমাদের মিডিয়া এদের ব্যাপারে নীরবতা পালন করে। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মী মারা গেলে সে আর তখন মানুষ থাকে না তাদের কাছে, তারা পরিণত হয় একেকটি উইকেটে । একজন রাজনৈতিক কর্মী মারা যাওয়া মানে একজন মানুষের মৃত্যু না, একটা উইকেটের পতন। এই ‘উইকেটগুলোর’ কোন মূল্য আমাদের মূলধারার মিডিয়ার নেই। এই উইকেটগুলোর যে বাবা-মা আছে, এদেরও যে স্ত্রী-সন্তান আছে, এরা মারা যাওয়ার পর তাদের পরিবার কি অবস্থায় আছে, এদের সন্তানরাও যে মৃত্যুর পর হাউমাউ করে কাঁদে, এদের পরিবারও যে এদের মৃত্যুর পর অভাবে-অনটনে দিন কাঁটাচ্ছে- তা মূলধারার মিডিয়ার মাথাব্যাথার কারণ নয়।

এক অন্তঃসত্ত্বা গার্মেন্টসকর্মী বাসায় চুলার আগুনে পুড়ে রসিয়ে রসিয়ে মিথ্যা গল্প বানিয়ে বললেও তার জন্যে পত্রিকার প্রথম পাতার দুই কলাম বরাদ্দ রাখা হয়, কিন্তু বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীর বুক পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেলেও তার জন্যে বরাদ্দ থাকে পত্রিকার এক লাইন। উলটো বুক ঝাঁজরা হওয়ার খবর অনলাইন ভার্সনে থাকলেও সকালের মূল পত্রিকায় তা গায়েব হয়ে যায়। এই নিহতদের কোন স্বজনের আহাজারির ছবি পত্রিকায় আসে না, চ্যানেলগুলো প্রচার করে না।

পুলিশের গুলিতে বুক ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া সিয়াম এবং মাথায় গুলি লাগা রতন

পুলিশের গুলিতে বুক ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া সিয়াম এবং মাথায় গুলি লাগা রতন

এই উইকেটগুলোরও যে কিছু অধিকার আছে, তা আমাদের মিডিয়াকর্মী বা সুশীল সমাজ চেপে যায়। এরা হচ্ছে তাদের কাছে নিছকই বলির পাঁঠা। বাকি সবাই মানুষ। আর তারা তো অতি উচ্চশ্রেণীর মানুষ।

পতিত স্বৈরশাসক এরশাদ জীবনে হাজার হাজার মিথ্যা কথা বললেও গতকাল একটা সত্য কথা বলেছেন

আওয়ামী লীগ যখন মারে, তখন নীরবতা দেখি। কারণ, বেশির ভাগ কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী আওয়ামী লীগের দিকে। তাই তাঁরা কবিতা লেখেন না। দুঃখ পান না।

যেমন, বিপরীত ধারার কেউ অন্যায় করলে বের হয় মোহাব্বত আলীর একদিন, নিজ ধারার কেউ অন্যায় করলে লেখা হয় এই লজ্জা কোথায় রাখি

দূর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্লেষণ

2
বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ওয়াবসাইট থেকে দেখা যায় তাদের প্রকাশিত Corruption Perception Index-এ বাংলাদেশ প্রথম ব্যাপক আলোচিত হয় ২০০১ সালে প্রকাশিত ২০০০-২০০১ সালের CPI তালিকায়।
সেই হিসাবে এই তালিকায় বাংলাদেশ গত এক যুগ ধরে বিভিন্ন স্কোর পেয়ে বিভিন্ন অবস্থানে ছিলো।
এই তালিকায় আমাদের গত একযুগে কখন কি অবস্থা ছিলো তা নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ প্রয়োজন, কারণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলে বিভিন্ন ভাবে বিভ্রান্ত করা হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল যে তালিকা প্রকাশ করে থাকে তা হচ্ছে মূলত জরিপের উপর জরিপ।
অন্তত তিনটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যের উপর জরিপ করে স্কোর নির্ধারণ করে এই তালিকায় তা উল্লেখ করাহয়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ERC (Ethics Resource Center), EIU (Economics Intelligence Unit)-সহ আরও বেশ কয়েকটি সংস্থা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে যেকয়টা CPI-এর হদিস পাওয়া গেছে সেই সবকয়টা মিলিয়ে এখনপর্যন্ত সবচেয়ে কম স্কোর উঠেছে ২০০১ সালে প্রকাশিত রিপোর্টেই- ০.৪ (বর্তমানে ১০০-এর স্কেলে যা ৪)।
এই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী বাংলাদেশ।বলাই বাহুল্য নিচের দিক থেকে প্রথম অবস্থানটাও আমাদেরই ছিল।আমাদের নিকটতম দেশ ছিল নাইজেরিয়া, যাদের স্কোর ছিল আমাদের চেয়ে আড়াইগুণ বেশি (১.০)।
CPI2001

তখন মহাপরাক্রমশালী আওয়ামীলীগ সরকারের শেষ বছর চলছিলো। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম এস এম কিবরিয়া এই রিপোর্ট সরাসরি প্রত্যাখান করেছিলেন, যদিও দেশে দুর্নীতির অবস্থা আসলেই খারাপ ছিলো।

১৯৯৬সালে ক্ষমাতায় এসেই ১৯৯১ থেকে বন্ধ কালোটাকা সাদা করার বিধানকে চালু করে দেন কিবরিয়া সাহেব তাঁরপ্রথম বাজেটেই। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চর দখলের মতো দখল করে সভাপতির পদে বসে পড়েন নেতারা।শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারীর রেশ তখনও কাটেনি। এই স্কোর তাই অনুমিতই ছিলো।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার।

এই সরকারকে মানুষ অনেক আশা নিয়ে ক্ষমতায় বসালেও এদের সময়ও দুর্নীতি খুব একটা কমেনি, তবে বাড়েনি তা নিশ্চিত। প্রমাণ দেয়া হবে।

কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপের কারণে ২০০২ সালে প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের কোন পরিবর্তননা হলেও স্কোর বেড়ে দাঁড়ায় ১.২-এ (বর্তমান স্কেলে ১২)।

নিকটতম রাষ্ট্র ছিল দুর্নীতি জর্জরিত নাইজেরিয়া ১.৬ পয়েন্ট নিয়ে। বাংলাদেশের সাথে ব্যবধান ছিল ০.৪ পয়েন্টের, আগেরবছর যা ছিল ০.৬ পয়েন্ট।

২০০২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা হলে বাংলাদেশের স্কোর ২০০৩ সালের তালিকায় সামান্য বেড়ে ১.৩-এ দাঁড়ায়(বর্তমান স্কেলে ১৩)।

এবছরও নিকটতম রাষ্ট্র ছিল নাইজেরিয়া ১.৪ পয়েন্ট নিয়ে। এবছর বাংলাদেশের সাথে নিকটতম রাষ্ট্রের ব্যবধান কমে দাঁড়ায় ০.১-এ।

২০০৪ সালের প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায় আমাদের স্কোর সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ১.৫-এ (বর্তমান স্কেলে ১৫)। আগের বছরের তুলনায় যা ছিল ০.২ বেশি। এবছর আমাদের সাথে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ‘গৌরবে’ ভাগ বসায় হাইতি। নিকটতম রাষ্ট্র ছিল নাইজেরিয়া, যাদের স্কোর ছিল ১.৬।

অর্থাৎ আমাদের সাথে নিকটতম রাষ্ট্রের ব্যবধান আগের বছরের মতই ০.১-এই আটকে ছিলো।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে ইফতেখারুজ্জামানের নালিশ

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে ইফতেখারুজ্জামানের নালিশ

২০০৪ সাল থেকে শুরু হয় প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল। অর্থের বিনিময়ে কাজ দেয়ার কিছু ঘটনাও বের হয়ে আসা শুরু করে। জ্বালানীমন্ত্রীকে জিপ কেলেঙ্কারী নিয়ে সরে যেতে হয়। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে আরও অনেকের বিরুদ্ধে। এর প্রভাব পড়ে ২০০৫ সালের রিপোর্টে। বাংলাদেশের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকে। স্কোরের বৃদ্ধি ছিল আগের মতই। তবে আমাদের সাথে আগের বছর একই অবস্থানে থাকা হাইতি কিছুটা উন্নতি করে নিকটতম রাষ্ট্রের কাতারে চলে যায় ০.১ পয়েন্টের ব্যবধান নিয়ে। হাইতির জায়গায় আসে চাদ। ২০০৫ সাল মিলিয়ে বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়।

২০০৫-২০০৬ সাল ছিল রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল একটা বছর। অবশ্য বিরোধীদলের প্রবল আন্দোলনের কারণে এ বছর মাঠপর্যায়ে সরকারি কাজও ছিল কম, তাই দুর্নীতিও কম হয় যার ফলে ২০০৬ সালের জোট সরকারের আমলের শেষ রিপোর্টে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান থেকে বেরিয়ে আসে।

তবে এই বছরের টিআইবি রিপোর্টের সাথে টিআইবির কর্তাব্যক্তিদের কথায় মিল ছিল কম। অনেকের অনেক কাজ ছিল সন্দেহজনক। টিআইবির ইফতেখারুজ্জামানকে বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের কাছে রীতিমত নালিশ করতে দেখা যায়। তিনি খালেদা জিয়া এবং তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে বিভিন্ন খতিয়ান দেন যা পরবর্তীতে উইকিলিকসে প্রকাশিত হয়।

ইফতেখারুজ্জামান নিজেই পরে একে নীতিমালা বহির্ভুত কাজ হিসেবে স্বীকার করেন

কিন্তু ২০০৬ সালের টিআইবির প্রতিবেদন ছিল এর উলটো। ২০০৬ সালে প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের স্কোর বেড়ে দাঁড়ায় ২.০-তে। অবস্থানও হয় তৃতীয়। যা ইফতেখারুজ্জামানকে ভুল প্রমাণিত করে। যদিও damages were done, বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রে একটি নেতিবাচক তাঁরবার্তা পাঠানো হয়।

শুধু তাই নয়, তারেক রহমান এবং কোকোর ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম কারণ ইফতেখারুজ্জামানেরা।

এই ছয় বছরের টিআই’র খতিয়ান দেখলে দেখা যায় বাংলাদেশের স্কোরে উন্নতি হয় ১.৬ (বর্তমান স্কেলে ১৬) পয়েন্ট। বাংলাদেশ দুর্নীতি কমিয়ে এনেছে, তথা বাংলাদেশে ২০০০ সালের তুলনায় ২০০৬ সালে দুর্নীতি কম হচ্ছে এমন মত প্রকাশ করে ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল। অন্তত তাদের প্রতিবেদনের স্কোর এবং অবস্থান তাই নির্দেশ করে।

তবে বাংলাদেশের অতি উৎসাহী একটি শ্রেণী ঠিকভাবে রিপোর্ট না দেখেই বিভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন যা অনভিপ্রেত। টিআই’র রিপোর্টে শুধুই একটা দেশের অবস্থান দেয়া থাকে না; একই সাথে সেই দেশের গত বছরের অবস্থান, দুর্নীতির ক্ষেত্রে দেশটির স্কোর- এগুলোও থাকে, যা অনেকেই খেয়াল করেন না। করলে অবশ্যই বুঝতেন বাংলাদেশ কিভাবে দুর্নীতি কমে এসেছিল।

এরপর দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী ক্ষমতা নেয় সেনা সমর্থিত সরকার। এই সরকার দুর্নীতি দমনের নামে বেশ কিছু অভিযান চালায়। তবে এই সকল অভিযানের একটা বড় অংশই ছিল লোকদেখানো। এই সময় দুর্নীতির তেমন কোন হেরফের ঘটেনি। বরং জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের স্কোর বৃদ্ধির যে ধারা বজায় ছিল তাও থেমে যায়। জোট সরকারের শেষ বছরের স্কোর ২.০ থেকে এক দশমিক পয়েন্টও বাড়েনি ২০০৭ সালের টিআই’র দুর্নীতির ধারণাসূচকে। যেখানে ছিল সেখানেই থাকে।

উলটো সেনা সমর্থিত সেই সরকারের সময় ব্যবসায়ীদের ধরে এনে চাঁদাবাজির সাথেও জড়িয়ে পড়ে অনেক সেনা কর্মকর্তা। দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক কর্মযজ্ঞের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ২০০৮ সালের টিআই’র সূচকে বাংলাদেশ মাত্র ০.১ শতাংশ যোগ করতে সক্ষম হয়।

পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার এক সংবাদ সম্মেলনে দাবী করে তখন সেনাদের একাংশ দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিল। টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৭ সালের এগারোই জানুয়ারির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুবছরের শাসনামলে সশস্ত্র বাহিনীর একাংশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অর্থ ও সম্পদ অর্জন করে এবং গণমাধ্যমের ওপরও তারা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।

এরপর ক্ষমতা নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। মহাজোট মন্ত্রীসভার অধীনে প্রথম বছর যথেষ্ট ভালো কাটে বাংলাদেশের। এছাড়া ঐ বছর কিংবা তার পরের বছরও কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা যায়নি। এছাড়া বড় ধরণের দুর্নীতির অভিযোগও ওঠেনি। যার প্রভাব পড়ে টিআই’র সূচকেও। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের স্কোর বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২.৪ এ (বর্তমান স্কেলে ২৪)।

পরের বছর, ২০১০ সালেও অবশ্য এই স্কোরের কোন পরিবর্তন হয়নি। যদিও তেমন কোন বড় ঘটনা ঘটেনি। কিংবা সরকারও কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেয়নি নিজেদের দুর্নীতির মামলাগুলো প্রত্যাহার করা ছাড়া।

২০১১ সালে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ২.৭, যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। তবে ২০১১ সালে কিছু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা বাদে দুদক তেমন কোন কাজই করেনি। তবে উল্লেখ্য যে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদের বিরুদ্ধে এই বছরে অভিযোগ উঠতে থাকে। এদের কয়েকজনকেই দুদক তলব করে।

২০১২ সাল ছিল এক বোমা ফাটার বছর। একের পর এক দুর্নীতি উন্মোচিত হতে থাকে। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় বিশ্বব্যাংক। বের হতে থাকে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারী। যার সামান্য প্রভাব পড়ে টিআই’র সূচকেও। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ধারণা সূচকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায়বাংলাদেশের অবস্থান ২০১১ সালের মতো ২০১২ সালেও ১৩তম অবস্থানে থাকলেও কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশেরতালিকায় (উচ্চক্রমে) বাংলাদেশের অবস্থান ২৪ ধাপ পিছিয়েছে। স্কোর কমে দাঁড়ায় ২.৬-এ, বর্তমান স্কেলে ২৬।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং ভীতিকর বিষয় হচ্ছে গত প্রায় এক যুগের মধ্যে এই প্রথম বাংলাদেশের স্কোরে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেল। যার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ যেভাবে গত এক যুগে ধীরে ধীরে হলেও দুর্নীতি কমিয়ে আনছিল তা এই বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় এই অবস্থা আরও হতাশাজনক।

এক যুগের মধ্যে সূচকে বাংলাদেশের প্রথম পয়েন্ট খোয়ানো

এক যুগের মধ্যে সূচকে বাংলাদেশের প্রথম পয়েন্ট খোয়ানো

এ অবস্থার ব্যাখ্যা দিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন,
এই অবস্থান প্রমাণ করে, গত বছরের তুলনায় দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থার অবনতি হয়েছে।বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতির কারণ সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করা লিখিত মূল্যায়নে বলা হয়, দুর্নীতি দমনে সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ক্রমবর্ধমান ঘাটতি, পদ্মা সেতু, রেলওয়ে কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো বহুল আলোচিত দুর্নীতির অভিযোগ, ক্ষমতাবানদের নির্বিচারে জমি ও নদীর জলাশয় দখল, ক্ষমতাশালীদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ না করা, দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা হ্রাসের উদ্যোগ, উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির ব্যাপারে দুদকের বিতর্কিত ভূমিকা, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাপকসংখ্যক ফৌজদারি ও দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার, বয়কট ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে জর্জরিত সংসদ, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর রাজনীতিকীকরণ, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা এবং সরকারি ক্রয় বিধিমালা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়ার ঘটনা সার্বিক সূচকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এক যুগে বাংলাদেশের স্কোরের তুলনাচিত্র

এক যুগে বাংলাদেশের স্কোরের তুলনাচিত্র

সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায় জোট সরকার যেখানে স্কোরের হিসেবে ১.৬ বা বর্তমান স্কেলে ১৬ উন্নতি করেছিল, মহাজোট সরকার করেছে মাত্র ০.৫ বা বর্তমান স্কেলে ৫ পয়েন্ট।
তাই দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের গান যারা শোনায় তাদের জন্যে একটাই কথা। আপনারা দুর্নীতি করে স্কোর কুয়ার মধ্যে ফেলে গেছিলেন। কোন কিছু কুয়াতে ফেলা যত সহজ তোলা তত সহজ না। যা এখন সম্ভবত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কারা আসল চ্যাম্পিয়ন তাও এখন বোঝা যাচ্ছে।
কটা কথা মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ তথা টিআই’র ইতিহাসে সর্বনিম্ন স্কোর আওয়ামী লীগেরই কীর্তিস্তম্ভ।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ও পুনরুত্থান প্রশ্ন

কানপুরের নানা সাহেব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বৃত্তিহারা হওয়ার পরপরই কোম্পানি কর্তৃক আরও বেশ কিছু অপমানের সম্মুখীন হলেন। কোম্পানি শাসনকালে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কোন সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলে দেশীয় অকর্মণ্য রাজারা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্রিটেনে কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরসদের সভায় আপিল করতেন।

কানপুরের অসন্তুষ্ট নানা সাহেবও তার প্রতি অবিচারের ফিরিস্তি তুলে ধরতে লন্ডনে একজন প্রতিনিধি পাঠালেন। এই প্রতিনিধি ছিলেন সুদর্শন সুপুরুষ আজিমুল্লাহ খান। এক সময়ের এই পরিচারক কঠোর পরিশ্রম করে ইংরেজি এবং ফারসি ভাষা রপ্ত করেন, নিজেকে সুশিক্ষিত করে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন।

আজিমুল্লাহ খান লন্ডনে কিছুদিন অবস্থান করে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেই উপলব্ধি করতে পারলেন যে কোন আবেদনে-নিবেদনেই তার মনিবের কোন লাভ হবে না। তাই তিনি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

ঘটনাচক্রে তাঁর সফরকালীন সময়ে তিনি জানতে পারলেন মাল্টায় জারের রুশ সৈন্যদের কাছে ব্রিটিশ-ফরাসি যৌথ বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। এই সংবাদে আজিমুল্লাহ উৎসাহিত বোধ করলেন। তিনি সরাসরি ভারতের জাহাজে না চড়ে কনস্টান্টিপোল গেলেন। সেখান থেকে তিনি গেলেন বর্তমান ইউক্রেনের ক্রিমিয়ায়, রুশ সৈন্যদের দেখতে। তিনি নিরাপদ দুরত্ব থেকে লক্ষ্য করতে লাগলেন রুশদের যুদ্ধ কৌশল, কিভাবে ব্যাটারিগুলো থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়।

কনস্টান্টিপোলে তার সাথে দেখা হয় এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের, নাম উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেল। রাসেলের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতা হয়। তাঁর সম্পর্কে রাসেল মন্তব্য করেন, ‘ক্রিমিয়াতে যা ঘটেছে আপন চোখে দেখার এত গভীর আগ্রহ দেখে কি অবাক না হয়ে পারা যায়? একজন ইউরোপবাসীর এরকম কৌতূহল থাকা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু অসামরিক গোত্রের একজন এশিয়বাসীর এ কৌতূহল অস্বাভাবিক নয় কি?’

আজিমুল্লাহ ঘোর নাস্তিক ছিলেন, কোনপ্রকার ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে ছিলেন শত ক্রোশ দূরে। তাঁর জ্বলজ্বল চোখে সেদিন যে আগ্রহ খেলা করছিল তা ছিল সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদজাত। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে ব্রিটিশ বাহিনী অজেয় নয়, তাদের হারানো যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল ক্রিমিয়ায় ব্রিটিশ বাহিনীর সেই প্রাথমিক পরাজয়।

আজিমুল্লাহ খানের চোখে যেই আকাঙ্ক্ষা-উন্মাদনা সেদিন দেখা গিয়েছিল, প্রায় একই ধরণের উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে বিশ্বে একটা বড় অংশের মুসলিমদের মধ্যে। অর্থোডক্স মুসলিমরা চিন্তা করতে শুরু করে সুরক্ষিত মার্কিন আকাশসীমার ভেতরে ঢুকে যদি এত ক্ষয়ক্ষতি করা সম্ভব হয়, তবে পৃথিবীর যেকোন দেশের যেকোন স্থানে আঘাত হানা সম্ভব। তাদের এই চিন্তাধারা প্রভাবিত করে তরুণ মুসলিমদেরকেও।

এই চিন্তাধারা যে সমগ্র পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমাণ পরবর্তীকালে লন্ডনের সেভেন সেভেন বোমা হামলা, ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের বোমা হামলা, মুম্বাইয়ের টুয়েন্টি সিক্স ইলেভেনসহ বহু জঙ্গি হামলার ঘটনা। একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশও পুরো পৃথিবীর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেনি।

বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের শুরুর দিকে ওহাবিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুগের পর যুগ লড়াই করেছে। সে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের জয় হয়েছে, কিন্তু ওহাবিরা অন্তর থেকে এই পরাজয় মেনে নেয়নি। তাদের ব্রিটিশ বিরোধী জঙ্গি-চেতনা তারা ধারণ করে গেছে। প্রায় আড়াই লাখ ওহাবি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন সময়ে শহীদ হয়েছে বলে জানা যায়।

বাংলাদেশে এই ওহাবিদের সমর্থকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে এরা ঐক্যবদ্ধ। ওহাবিরা তাদের জঙ্গি চেতনা বিভিন্নভাবে সময়ে সময়ে কাজ করেছে, তবে এই জঙ্গিবাদী চেতনা ছিল মূলত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। ওহাবি তরিকার বহু মানুষ আশির দশকে শেষভাগে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যায়। সিআইএ-আইএসআইর দ্বারা প্রশিক্ষিত এই যোদ্ধারা অনেকে শহীদ হন, অনেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত টিকে যায়।

প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের জঙ্গিরা মূলত আফগানিস্তানের সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফেরত আসা ‘জিহাদি’ মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে শুরু করে। বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সূচনা ২০০১ সালের নাইন ইলেভেনেরও আগে থেকে।

আফগান ফেরত এই জঙ্গির ছোট ভাই তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা মুন্সি আনিসুল ইসলামের নামে ১৯৯৭ সালের ৩০ জানুয়ারি গোপালগঞ্জে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পনগরীর ৭ নম্বর প্লটে চার হাজার ৫০০ বর্গফুট জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এই জমিতেই তৈরি করা হয় সেই সাবান কারখানা যেখানে পাওয়া গিয়েছিল মুফতি হান্নানের বিশালাকৃতির বোমা তৈরির উপাদান ও সরঞ্জাম।

২০০০ সালের ২০ ও ২৩ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাস্থলে দুইদফা অভিযান চালিয়ে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনার সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহ এবং গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলী খান জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেন মুফতি হান্নান।

এছাড়া আফগান ফেরত জঙ্গিরা ১৯৯৯ সালে তিনটি ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনা ঘটায়। এতে ১৮ জন নিহত হলেও আহত হন দুশতাধিক মানুষ। এই বছর সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে যশোরের টাউন হল ময়দানের বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সম্মেলনে। এ হামলায় ১০ জন নিহত হয় আহত হয় শতাধিক। এছাড়াও ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনার আহমেদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় আট জন নিহত ও আহত হয় ৫০ জন।

আল্লাহর দল একটি সংগঠন কবি শামসুর রাহমানের বাসায় ঢুকে কবির উপর হামলা চালানোর চেষ্টাও চালায়।

২০০১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫ পাঁচটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসব বোমা হামলায় ৫৯ জনের প্রাণহানী ঘটে ।
এরমধ্যে ঢাকার পল্টনে কমউনিস্ট পার্টির সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ৭ জন, রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ১১ জন, গোপালগঞ্জের বানিয়ারচরের গির্জায় ১০ জন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের অফিসে ২১ জন, বাগেরহাট জনসভায় ৯ জন, সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের নেতা সুরঞ্জিত সেনের জনসভায় বোমা হামলায় চার জন নিহত হয়। আহত হয় কয়েক শতাধিক।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের এইসব বোমা হামলাগুলোতে অন্তত ৭৬ জন নিহত হন

১৯৯৯ সাল থেকেই মূলত ব্যাপক হারে জঙ্গি হামলা ও গ্রেনেডের ব্যাবহার শুরু হলেও ১৯৯৭ সালের ৩০ জানুয়ারি গোপালগঞ্জে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পনগরীতে মুফতি হান্নানের ভাইয়ের জমির বরাদ্দ পাওয়া নির্দেশ করে যে, অন্তত ১৯৯৭ সাল থেকেই মুফতি হান্নান ও তার সাথীরা বাংলাদেশে জঙ্গি হামলা চালানো এবং ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে।

তৎকালীন সরকারের উদাসীনতার এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতার জড়িত থাকার স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি গোপালগঞ্জে মুফতি হান্নানের জমি বরাদ্দ পাওয়া, সেখানে নির্বিঘ্নে বোমা তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো, কোন জঙ্গিকে না ধরতে পারা এবং পুলিশের গাড়িতে ওঠার সময় মুফতি হান্নানের সেই স্বতঃপ্রনোদিত ‘জবানবন্দী’।

প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশে আরেকটি জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয় বাংলাদেশে- জামায়াত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেমবি)। এই সংগঠনটির সাথে আরব বিশ্বের জঙ্গিদের যোগাযোগ ও বিদেশী ফান্ড আনার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে এরা রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ ও সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে কাজ করলেও পরে টুইন টাওয়ার হামলা ও এর প্রেক্ষিতে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন তাদের বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম বিস্তারে উৎসাহিত করে। 

সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলাভাইর সাথে এক সাক্ষাৎকার প্রকাশ পায় ইংরেজী দৈনিক The Daily Star-এ ২০০৪ সালের ১৩ মে। সেখানে তিনি দাবি করেন তিনি স্কুল জীবনে ছাত্রলীগ করত, পরে কলেজে ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেয়। ১৯৯৫ সালে শিবির ছাড়ে জামায়াতে ইসলামী নারী নেতৃত্ব মেনে নেয়ায়

জেএমজেবির আমির আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজমের দুলাভাই শায়খ আব্দুর রহমান ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সৌদি এম্বেসিতে কাজ করে বলে জানা যায়। এরপর সে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। এরপর আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসে। এসময় এই জঙ্গি নেতা ওহাবি মতাদর্শে প্রভাবিত হয়। শায়খ আব্দুর রহমান একসময় জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিল।

বাংলাদেশে এই দুই জঙ্গি নেতা জঙ্গিবাদের বিস্তারের ক্ষেত্রে মাও সে তুং-এর সেই বিখ্যাত উক্তি “The guerrilla must move amongst the people as a fish swims in the sea”-এর প্রয়োগ ঘটায়। মানুষের সাথে মিশে কাজ করতে তারা জামালপুর থেকে রাজশাহীর বাগমারায় আসে।

সীমান্তবর্তী রাজশাহী জেলায় প্রবল ভারতবিরোধী এবং ইসলামপন্থী মনোভাব তাদের এই কাজের জন্যে বেশ সুবিধাজনক ছিল। গঠন করা হয় জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) ।

জেএমজেবি প্রাথমিকভাবে দেশের পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তারা মূল লক্ষ্য হিসেবে প্রচার করে এইসব অঞ্চলের জেলাসমূহের অধিবাসীদের প্রধান শত্রু সর্বহারা বাহিনী। ফলে তারা ঐসব এলাকায় সাময়িক জনসমর্থন পায়।

রাজশাহীসহ ঐসব অঞ্চলের নেতারা, গোয়েন্দারা এবং সরকার জেএমজেবির ব্যাপারে উদাসীন থাকে, অনেকেই তাদের সমর্থন যোগায়। যার পেছনে কাজ করেছিলো পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টিসহ সকল বামপন্থী চারমপন্থীদের বিরুদ্ধে জেএমজেবিকে কাজে লাগানোর ইচ্ছা

সরকার ডিভাইড অ্যান্ড রুল খেলতে এসে জেএমজেবির ফাঁদে পা দেয়। জঙ্গিরা সারা দেশে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করে তোলে, এবং ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে পাঁচশতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে প্রায় ৬৬ জনকে হত্যা করে জোট সরকার আমলে। এর মধ্যে ময়মনসিংহের সিনেমা হল, ঝালকাঠির দুই আইনজীবী, ব্রিটিশ হাইকমিশনার, যাত্রাপালায় বোমা হামলা উল্লেখযোগ্য। এর আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার উপর হুজির সেই মুফতি হান্নানের নেতৃত্বে হামলা হয়।

উইকিলিকসের ফাঁস করা কেবলে দেখা যায় বিএনপি সরকারের শেষ ভাগে জেএমবির নেতাদের মৃত্যুদন্ডের পর এমনকি এর অর্থ যোগানের পথও বন্ধ করে দেয়ার পর ঢাকার ইউএস এম্বেসি মন্তব্য করে, "অবশেষে জেএমবির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া গেল"।

উইকিলিকসের ফাঁস করা কেবলে দেখা যায় বিএনপি সরকারের শেষ ভাগে জেএমবির নেতাদের মৃত্যুদন্ডের পর এমনকি এর অর্থ যোগানের পথও বন্ধ করে দেয়ার পর ঢাকার ইউএস এম্বেসি মন্তব্য করে, “অবশেষে জেএমবির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া গেল”।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের পর সরকার হুজি, জেএমজেবি ও জেএমবির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযানে নামে। সারা পৃথিবীতেই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের ফলে জঙ্গিদের পৃথিবী ছোট হয়ে আসতে থাকে।

২০০৫ সালের ১ অক্টোবর মুফতি হান্নান, ২০০৫ সালের ২০ নভেম্বর শায়খ আব্দুর রহমানের মেয়ের জামাই ও জেএমজেবির মজলিশে শূরা সদস্য আব্দুল আউয়াল, ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর আতাউর রহমান সানি, ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমানকে সিলেট থেকে এবং চারদিন পর বাংলাভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিলের মধ্যে সরকার জেএমজেবির সকল মজলিশে শুরা সদস্যসহ হাজার হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে ১৪১টি মামলা দায়ের করে, ২২জনকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়।

সরকার জঙ্গি অর্থায়নের দায়ে Revival of Islamic Heritage Society নামক এনজিওর স্থানীয় অফিস বন্ধ করে করে দেয়া হয়। সর্বোপরি জেএমজেবি, জেএমবি এবং হুজির মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া হয়; ২০০৬ সালের তিন মে তারিখে মার্কিন তারবার্তার ভাষায়- The JMB’s back really does look broken।

সফলভাবে জঙ্গিদের দমন করার পর টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন

সফলভাবে জঙ্গিদের দমন করার পর টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন

এখন প্রশ্ন হচ্ছে জঙ্গিদের উপর এত বড় ক্র্যাক ডাউনের পর কি তাদের পক্ষে পুনরায় বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম চালানো আদৌ সম্ভব কিনা?

উত্তরটা অনেক কিন্তু ও যদির সাথে যুক্ত। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত জঙ্গি কার্যক্রমের বিস্তার দেখা গেছে তার মধ্যে প্রতিটিতেই রাজনৈতিক উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক সহায়তা কম বেশি ছিল। কোন দলের কেন্দ্রীয় নেতারাই চাইবে না তাদের সরকারের সময় দেশ অস্থিতিশীল হোক, তবে স্থানীয় ইসলাম পছন্দ নেতারা নিজেদের জিহাদে শামিল করতে কিংবা কোন রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে জঙ্গিদের ব্যবহার করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

সম্প্রতি বগুড়ায় আওয়মী লীগ নেতার বাসায় জঙ্গিদের আস্তানা আর বিপুল বিস্ফোরক উদ্ধার, কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ নেতার প্রশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের নেতার অবাধ বিচরণ আর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দিরে ‘সর্বদলীয়’ হামলার ঘটনা তাই প্রমান করে।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা গেলে আর সরকার কঠোর হলে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম ও এর বিস্তার বন্ধ করা অসম্ভব নয়। আর নাইন ইলেভেন পর থেকে সারা পৃথিবীতে জঙ্গিদের উপর যে ধরণের কড়া নজরদারি চলছে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেভাবে কাজ করছে তাতে জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান প্রায় অসম্ভব।

তাই অহেতুক জঙ্গিবাদ নামক জুজুর ভয় দেখিয়ে এই মৃত ইস্যুটিকে মমি করার আওয়ামী প্রচেষ্টা অর্থহীন।